বুধবার, ২১ মে, ২০২৫

লিন্ডবার্গ! তুমি আমাদের হিরো

 


আকাশ তখন কালো হয়ে আসছে। সন্ধ্যে নেমে গেছে। রুজভেল্ট ফিল্ডের বিমানবন্দরে একটি ছোট্ট সিঙ্গল-ইঞ্জিন বিমান দাঁড়িয়ে আছে, নাম 'স্পিরিট অফ সেন্ট লুইস'। সেই বিমানের পাশে একজন তরুণ পায়লট দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে কিছুটা ক্লান্তি লেগে আছে, সবাই দেখে বুঝতেও পারছে সেটা। কিন্তু তার অদম্য সাহস সম্পর্কে লোকজনের বিশেষ ধারণা নেই। আজকের দিনে, ৯৮ বছর আগে একজন ২৫ বছরের তরুণ ইতিহাস রচনা করেছিল।

১৯২৭ সালের ২০ মে, শুক্রবার। চার্লস লিন্ডবার্গ মাসের পর মাস ধরে এই মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাঁর সামনে এক অসম্ভব চ্যালেঞ্জ-- সম্পূর্ণ একা, বিরতিহীন ভাবে অ্যাটলান্টিক মহাসাগর পার করে নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসে যাওয়া। তখনও এরকম কোনও নজির ছিল না। কেউ এই অসম্ভব কাজ করতে এগিয়ে আসেনি। দু একজন চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু তাদের যাত্রা শেষ হয়েছিল অ্যাটলান্টিকের অতল জলে।

সকালে বৃষ্টি হয়েছে বেশ। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন যে ওয়েদার কন্ডিশনও ভালো নয়। বিমান ওড়ানোর জন্য তখনও আজও সবচেয়ে বড় বিপদ তাই, যা সেই যুগে ছিল। ঝোড়ো বাতাস নয়, বৃষ্টি নয়, বজ্রপাত বা পাখির ঝাঁক নয়, সেই বিপদের নাম কুয়াশা। হ্যাঁ, ঘন কুয়াশায় সেদিন ছেয়ে গিয়েছিল অ্যাটলান্টিক মহাসাগর, সেই কুয়াশা আরো বাড়বে বলে আবহাওয়াবিদরা বলছিলেন। কিন্তু লিন্ডবার্গ আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। প্রথম ব্যক্তি যিনি নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসে অবিরাম ৩,৬০০ মাইল উড়ে যাবেন তার জন্য ২৫,০০০ ডলার পুরস্কার বরাদ্দ আছে। বেশিদিন হলে এত পায়লট চলে আসবে যে একটা অভিযান অবশেষে মানি মেকিং রেসে পরিণত হবে। লিন্ডবার্গ সেটা চান না। তিনি সাফল্য চান ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি চান এই যাত্রার রোমাঞ্চতা অনুভব করতে, যে রোমাঞ্চ তাঁর আগে কেউ অনুভব করতে পারেনি।

লিন্ডবার্গ মনে মনে নিজেকে বললেন, "সময় হয়েছে বাছা। এইবার হয় বাঁচবি, নয় মরবি। কিন্তু যাই হোক না কেন, না লড়ে মরিস না বুঝলি।"

শেষবারের মতো তাঁর বিমানের চারপাশে হেঁটে প্রতিটি যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করলেন তিনি । 'স্পিরিট অফ সেন্ট লুইস' দেখতে সাধারণ ---আগে তাঁর নাম ছিল Ryan NYP, কাস্টম বিল্ট, মোনোপ্লেন, একজন বসতে পারে, ইঞ্জিনও একটা। রেকর্ড করার জন্য খুব কাজের বিমান নয়। কিন্তু লিন্ডবার্গ বিশেষ নকশা তৈরি করে তাঁর যাত্রাপথটিকে বিশ্লেষণ করেছেন। বারবার করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, এই প্লেনই সবচেয়ে বেস্ট। হালকা, জ্বালানিও কম লাগে, নেভিগেট করতে পারলে অনায়াসে এই বিমান ৩,৬০০ মাইল যেতে পারে।

পায়লট কেবিনটা ছোট, একমাত্র সামনের দিকে একটি ছোট্ট জানালা। লিন্ডবার্গ ঠিক করেছিলেন অতিরিক্ত জ্বালানির জন্য বাড়তি জায়গা রাখতে হবে, সকলে সাধাসাধি করার পরও ইমারজেন্সি কো-পায়লট নিতে রাজি হয়নি। আয়োজকদেরও ফিরিয়ে দিয়েছেন। আশ্চর্য কথা হল, তাঁর সঙ্গে কোনও রেডিওও ছিল না, সেক্সটেন্ট ছিল না, এমনকি একটি ম্যারিন কম্পাসও ছিল না-- কেবল সাধারণ যন্ত্রপাতি আর তাঁর ইন্সটিংক্ট। এতটুকুই সম্বল।

সন্ধ্যা ৭:৫২ মিনিটে লিন্ডবার্গ তাঁর চামড়ার জ্যাকেট পরলেন, মাথায় একটি ক্যাপ লাগালেন, তারপর ফ্লায়িং কেবিনে উঠে পড়লেন। উপস্থিত ভিড় তাকে উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে বিদায় জানাল। ট্যাক্সিওয়েতে যাওয়ার আগেই বিমানের চাকা কাদায় আটকে গিয়েছিল, বোঝো! তারপর 'স্পিরিট অফ সেন্ট লুইস'-এ এত জ্বালানি ভরা হয়েছে যে ওজন বেশি হয়ে গেছে। অনেকে বাজি রেখেছিল প্লেন আজ মাটিই ছাড়বে না। এক মাইল লম্বা রানওয়েতে বিমানটি বারবার ঝাঁকুনি খেতে খেতে দুলতে দুলতে এগোচ্ছিল। ভিড় তখন নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে।

শেষ মুহূর্তে, যখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে, 'স্পিরিট অব সেন্ট লুইস' একদম সাঁই করে মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে গেল, আর কয়েক ফুট এগোলেই প্লেনটা সোজা গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেত। লিন্ডবার্গ কোনোরকমে প্লেনটা সমুদ্রের ওপর নিয়ে গেলেন। এরপর আসল সফর শুরু হল।
লং আইল্যান্ড ছেড়ে, তিনি উত্তর-পূর্ব দিকে উড়ে চললেন, নিউ ইংল্যান্ড উপকূল ধরে, কেপ কড পার করে, ফিশিং জাহাজগুলো পিছনে রেখে নোভা স্কটিয়া পর্যন্ত ঠিকঠাক রুটে উড়ে গেল প্লেনটা। সূর্য ডুবে যাযে একটু পরেই। লিন্ডবার্গও জানতেন যে সামনে শুধু অন্ধকার, এবং অ্যাটলান্টিক মহাসাগর। অনন্ত জলরাশি, যেখানে বহু দুরন্ত পায়লটের সলিল সমাধি হয়েছে।

রাতের দ্বিতীয় প্রহর পেরোলে প্রথম সমস্যা দেখা দিল। লিন্ডবার্গ লক্ষ করলেন যে তাঁর বিমানের উপরে বরফ জমা হচ্ছে, ইঞ্জিনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে স্নোফ্লেক্স। ফলে তাকে আরও নিচে দিয়ে উড়তে হবে। কিন্তু সে আরও ঝুঁকির কাজ। প্রায় সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া, বাতাস আরো বেশি গরম থাকে বলে স্নোফ্লেক্স জমবে না ঠিকই কিন্তু ঝড় উঠলে আর দেখতে হবে না। বিপজ্জনক হলেও আর কোনও পথ খোলা ছিল না, ফলে সেই সিদ্ধান্ত নিতেই হল। আর পড়বি তো পড় সেই বাঘের মুখেই পড়তে হল, কারণ একটু পরেই সমুদ্রের ওপর ভীষণ ঝড় শুরু হল। লিন্ডবার্গ দাঁতে দাঁত চেপে নেভিগেশন সামলাতে লাগলেন। সামনে বিপদ, কিন্তু রোমাঞ্চের এই মুহূর্তগুলো তাকে যে 'কিক' দিচ্ছে, সেটাও তো মিথ্যে নয়। রোমাঞ্চ লিখলে সবাই অ্যাড্রেনালিন রাশের কথাই ভাবে, কিন্তু ঝুঁকি আর রোমাঞ্চে আসলে মানুষের মনোনিবেশ বাড়ায়, তাকে শান্ত করে, পরিণত করে, স্থিতিশীল করে। লিন্ডবার্গও এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছিলেন।

ওদিকে, স্নো ফ্লেক্সের চেয়েও বড় সমস্যা আছে, সেটা হল ঘুম। লিন্ডবার্গ আগের রাতে ঘুমাতে পারেনি উত্তেজনায়, নাগাড়ে তিরিশ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জেগে আছেন তিনি। শুনলে মনে হয়, এ আর এমন কি, একদিনের ব্যাপার, জোর করে জেগে থাকলেই হল। কিন্তু এরকম হাই স্ট্রেস মোমেন্টে মানুষের ইন্দ্রিয় মর্জিমতো কাজ করে না। ক্লান্তির সীমা অতিক্রম করে গেলে আমি মানুষকে পাহাড়ে চড়ার সময়েও ঘুমিয়ে পড়তে দেখেছি। লিন্ডবার্গও লড়াই করছিলেন চোখ খোলা রাখতে। কখনও কখনও তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তারপর আবার জেগে উঠছেন, প্লেনের রুট ঠিক করে নিচ্ছেন। একবার তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে গাছের উপর দিয়ে উড়ছেন। অ্যাটলান্টিকের মাঝখানে গাছ আসবে কী করে? কিন্তু ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেলে মানুষ মরুভূমি কেন, প্লেনেও মরীচিকা দেখে।

ঘুমের সঙ্গে লড়াই করতে করতে, লিন্ডবার্গ নিজেকে কল্পনার জগতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি নিজের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন, তারপর গান গাইলেন, সব শেষ হলে মেঘের ছায়াগুলোকে কল্পনার প্রাণীতে পরিণত করে ছড়া বাঁধলেন। সময় কাটাতে হবে, আর ঘুমালেও চলবে না। আর একা থাকার ভাবনাটা মাথায় ভর করলে আরো বিপদ। সময়ে সময়ে তিনি বিমানের জানালা খুলছিলেন যাতে ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে লাগুক, যাতে তিনি জেগে থাকতে পারেন।

একসময় ভোরের আলো ফুটল। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। সূর্য উঠছে, আকাশ রক্তিম হয়ে উঠছে লিন্ডবার্গের মনোযোগ পুনরুজ্জীবিত হল। তিনি এইবার একটি জাহাজ দেখতে পেলেন, অ্যাটলান্টিকের ওপর দিয়ে চলেছে! মানবসভ্যতার এই চিহ্ন দেখে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। বিমানটাকে নামিয়ে আনলেন অনেক নিচে, জাহাজের কাছাকাছি উড়তে উড়তে জিজ্ঞাসা করলেন "এটা কোথাকার জাহাজ?" জাহাজের চালক দল অবশ্য তাঁর কথা বুঝতে পারল না।

আয়ারল্যান্ডের উপকূল দেখা দিল যখন লিন্ডবার্গ ২২ ঘণ্টা ধরে উড়ে চলেছিলেন। তিনি ঠিক পথেই ছিলেন! অবশেষে, ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্স দেখতে পেলেন তিনি। সেকালে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর-- আলোর শহর প্যারিস, দেখেই মনের ভিতরেও একটা আলো জ্বলে ওঠে।

সন্ধ্যা ১০:২১ মিনিটে, ২১ মে, ১৯২৭ তারিখে, ৩৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট উড়ানের পর, চার্লস লিন্ডবার্গ Le Bourget Aerodrome-এর ট্যাক্সিওয়েতে ল্যান্ড করেন। তিনি ভেবেছিলেন এইবার একটা দোকানে গিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া করতে হবে, তারপর ঘুমাবেন। কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি। লক্ষাধিক ফরাসি তাঁর বিমানকে ঘিরে রেখেছিল, চিৎকার করে বলছিল, "লিন্ডবার্গ! লিন্ডবার্গ! তুমি আমাদের হিরো। তুমি পেরেছ, আমরাও পারব।"

সেই উন্মাদনার বহর এমন ছিল যে লোকজন তাঁর বিমানে উঠে ছোট ছোট অংশ ভেঙে নিয়ে যাচ্ছিল স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে। সৈন্যরা খুব কষ্টে তাঁকে ঢেকেঢুকে একটা হ্যাঙ্গারে নিয়ে গেল। ফরাসি পায়লটরা তাঁকে কাঁধে নিয়ে ঘোরাতে শুরু করল এরপর। লিন্ডবার্গ ৩৩ ঘণ্টা ধরে একাকী উড়ে আসার পর সহসা দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষে পরিণত হলেন। অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন তিনি। একজন সাধারণ মেল পায়লট, ৩৩ ঘণ্টা ধরে একা উড়ে যে বাধা অতিক্রম করেছে, সেটা একটা রেকর্ড ভাঙার জন্য নয়। এই ঘটনাটা গোটা এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিকে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। ইতিহাসের সেই মুহূর্তে, মানুষের মনে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। লিন্ডবার্গের এই যাত্রা আধুনিক বিমান চলাচলের যুগের সূচনা করেছিল, এবং প্রমাণ করেছিল যে অ্যাটলান্টিক পাড়ি দেওয়া কেবল সম্ভবই নয়, বরং বাণিজ্যিকভাবেও বাস্তব। ৩,৬০০ মাইল, ৩৩.৫ ঘণ্টা, এবং একটি তরুণ পায়লটের অদম্য সাহস… দুনিয়া বদলাতে এইটুকুও কম নয়।

কাল, সেই ঘটনার আটানব্বই বছর পর একটা বিশেষ বই প্রকাশিত হল। সেই বইয়ের একটা ছবি। ঘটনাটা বিশদে পড়তে হলে লিন্ডবার্গের আত্মজীবনী তো আছেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন