শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫
উইন্ডটকার্স
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫
ঘিবলিকে একা থাকতে দিন
কাজুও ওগা বলে কারো কথা লিখতে গেলে কতজন তাঁকে চিনতে পারবেন বলা মুশকিল। কিন্তু যদি বলি তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি স্টডিও ঘিবলির (অথবা জিবলির, উচ্চারণে কিছু আসে যায় না) মনকাড়া সিনেমার মায়াবী ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো এঁকেছেন, মিয়াজাকির প্রিয়পাত্র এবং ঘিবলি স্টুডিওজের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর, তাহলে অনেকেই নড়েচড়ে উঠবেন। ভদ্রলোক সম্পর্কে দু চার কথা লিখতে ইচ্ছে হল। কেন হল, সে কথা পরে লিখছি।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলা যায়, কাজুও ওগা, স্টুডিও ঘিবলির একজন কিংবদন্তী তো বটেই, অ্যানিমেশন জগতে তাঁর অবদানও অনস্বীকার্য। ওগা শুধু ছবি আঁকেন না, তিনি তাঁর তুলির আঁচড়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রাণ সৃষ্টি করেন। তাঁর কাজের গভীরতা, রঙের ব্যবহার এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি ফ্রেমে স্পষ্ট বোঝা যায়।
কাৎসুহিরো ওতোমো একবার বলেছিলেন, চরিত্র মানে ক্যারক্টার অ্যানিমেশনের চেয়েও পটভূমি মানে ব্যাকগ্রাউন্ড বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একটা বড় বিল্ডিং নির্মাণ করতে গেলে তার ভিত শক্ত হওয়া ভীষণ দরকার। ওগা সেই ভিত স্থাপন করেন, গল্পের ফাউন্ডেশন সৃজন করেন। মিয়াজাকির সিনেমায় আমরা যে জগৎ দেখি, দেখে মুগ্ধ হই, তার পেছনের কারিগর হলেন কাজুও ওগা। হ্যাঁ, মাই নেবার তোতোরো অথবা কিকিস ডেলিভারি সার্ভিস কিংবা হালের দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন, সমস্ত সিনেমার ক্যানভাস তিনি ভেবেছেন, এঁকেছেন। ভারতে না হলেও জাপানে সবাই তাঁকে একবাক্য চেনেন। ওগা ব্যাকগ্রাউন্ডকে কেবল কোনও স্থান হিসেবে দেখেন না, বরং ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইমোশনটাকে বুঝতে চান। গল্পের সঙ্গে কোন ব্যাকগ্রাউন্ড যাবে, তা মানানসই কিনা, সেখানে রঙ বা এলিমেন্ট কী হবে, সেসব তো আছেই, কিন্তু এই প্রতিটা ব্যাকগ্রাউন্ড প্যানেল যেখানে চরিত্ররা ঘুরেফিরে বেড়াবে, তাদের জীবন ও ভাবনার সঙ্গে সেই ব্যাকগ্রাউন্ডের ইমোশনাল কানেক্ট হচ্ছে কী না, সেটা বোঝা, খোঁজা, আঁকা, পরীক্ষা করা আর ফুটিয়ে তোলাই তাঁর প্রধান কাজ। অবশেষে, প্রতিবার ওগা অসামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড উপহার দেন, এমন এক অনুভূতি তৈরি করেন, যা দর্শকদের মনে গেঁথে থাকে বহুদিন বাদেও।
নাওয়া তানাকা (Naoya Tanaka) বলেছেন, ওগা প্রকৃতির স্বাভাবিক দৃশ্য ভাবেন না, বরং সেই দৃশ্যের গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্টগুলোর মূল ভাবনা বা সার এক্সট্র্যাক্ট করেন এবং সেগুলোকে এমনভাবে অগামেন্ট করেন, যাতে পরিচিত ল্যান্ডস্কেপ দেখেও déjà vu-এর মতো মনে হয়। তাঁর কাজের বিশেষত্ব, তিনি খুব সাধারণ উপকরণ ব্যবহার করেন। এমনিতেও পেশাদার কাজে যে পোস্টার কালার ব্যবহার করতেন, তা সাধারণত স্কুলের বাচ্চারা ব্যবহার করে। বাচ্চাদের রোজকার রঙ ব্যবহার করে জাপানের অন্যতম শিল্পী এমন সব চমকপ্রদ ল্যান্ডস্কেপ এঁকে সারা দুনিয়ায় লোককে মুগ্ধ কর রেখেছেন, সে কথা জেনে অনেকে অবাক হয়, বাচ্চারা সেই কথা জেনে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়। জাপানের ব্যাকগ্রাউন্ড শিল্পীদের জন্য এরপর পোস্টার কালারই ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যায়। স্টুডিও ঘিবলি Nicker Poster Color ব্যবহার করত, যা অনেকটা ওপেক ওয়াটার কালারের মতোই।
ভাবলে অবাক হতে হয়, এত এত কাজ, এই সমস্তই ওগা করেছেন মাত্র একুশটা রঙ ব্যবহার করে। রঙ নয়, এলিমেন্টের সঙ্গে মানানসই অনুভূতি ফুটিয়ে তোলাই ছিল প্রধান কাজ, ছোট ছোট জিনিসের ওপর ফোকাস করতেন, তারপর কম্বিনেশন ব্যবহার করে পছন্দসই লুক আনার চেষ্টা করা হত। রঙের গ্রেডেশন আর কম্বিনেশন নিয়ে খেলতেন, অল্প অল্প রঙ ব্যবহার করে সূক্ষ্মভাবে মিশিয়ে নানারকম শেড আঁকতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। পছন্দ না হলে আবার আঁকা হত। এক একটা সময় একটা ল্যান্ডস্কেপ একশো থেকে দুশবার আঁকা হয়েছে, বছর ঘুরে গেছে। কিন্তু যতক্ষণ না সেই আবেগটা ফুটে উঠছে, ওগা থামেননি, হতাশও হননি। রঙ বাদে কী থাকত তাঁর টেবিলে? কাগজ, জাপানি ফ্ল্যাট ব্রাশ TMK poster paper, fine-pointed Sakuyo ব্রাশ...ব্যস!
কিন্তু শুধুই কি দক্ষতা? না, পরেরদিকে লে আউট আর স্টোরিবোর্ড এর জন্য টিম থাকত, ওগার কাজ ছিল ফ্রিমিক্সিং এর ব্যবহার করে ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো কংক্রিটে করা। কিন্তু টেবিলে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই রিসার্চ শুরু হত, দিনের পর দিন তিনি শহরতলি আর গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন, প্রকৃতিকে দেখতেন, মেঘ ছায়া রোদ্দুর দেখে রাফ স্কেচ করতেন, এই অবজার্ভেশন থেকেই কল্পনা উঠে আসত। পমপোকোর ঋতুবদলের সিন আঁকার জন্য তিনি তামাতে গিয়ে থাকতেন, সেখানকার ফলিয়েজ আর সিনারি মনে তুলে নিতেন, কাজের প্রতি নিষ্ঠার কোনও অভাব ছিল না। সে যতই পরিশ্রম হোক না কেন, যত দিনই লাগুক না কেন!
ওগা একা নয়, স্টুডিও ঘিবলির প্রতিটা কর্মী তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে এই নিষ্ঠা দেখিয়েছে। যতগুলো সিনেমা আপনি দেখেছেন, তার একটাও কম্পিউটারাইজড অ্যানিমেশন নয়, প্রতিটা হাতে আঁকা। এক একটা মুভমেন্ট অনেক সময় বছর কাবার করে দিয়েছে। একটা ভিড়ের সিন দেখানোর জন্য কুড়িজন শিল্পী মিলে ছয়মাস ধরে হাজার হাজার স্টোরিবোর্ড এঁকেছেন। একটা সিনের জন্য। সিনেমাগুলো শুধু শুধুই হয়নি।
ইদানীং দেখছি, এআইতে ঘিবলি মুভিজের অনুকরণে একের পর এক ছবি হচ্ছে। আজ সকাল থেকে দেখলাম, হিন্দি বাংলা ছবির স্টিলের অনুকরণে গাদা গাদা ছবি জেনারেট হয়েছে, মুহুর্তের মধ্যে সেগুলো ক্রিয়েট করা যায়। কেউ ইমোশন নিয়ে ভাবে না, কেউ অবজার্ভ করে না, কেউ দিনের পর দিন পিঠ বেঁকিয়ে আঁকে না, কিন্তু ছবি হচ্ছে। কয়েকদিন আগে মিয়াজাকিতে এই নিয়ে প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন, তিনি যারাপনাই ডিসগাস্টেড। এ শুধু শিল্পীদের নয়, মানুষের জীবনেরই অপমান। ইটস অ্যান ইনসাল্ট টু লাইফ ইটসেল্ফ।
সময় বদলাবে। প্রযুক্তি আসবেই। সব কিছু নর্মালাইজ হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুটা সম্মান কি না থাকলেই নয়? এআইকে দিয়ে ঘিবলি স্টাইলে ছবি করার চেয়ে একটা স্বতন্ত্র ভাবনার ছবিই তো হতে পারে! কিন্তু জানি, এই নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। হয়তো কয়েক বছর পর এআই মিয়াজাকির স্টাইলে একটা গোটা সিনেমাই বানিয়ে দেবে। সেখানে কাজুও ওগা রঙয়ের কম্পোজিশন নিয়ে ভাববেন না, গাছপালা পাখিদের দেখে সময় নষ্ট হবে না, হাজার হাজার শিল্পীকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনের পর দিন আঁকতে হবে না। কিন্তু সিনেমা হিট হবে, ট্রেন্ড করবে, আমরা পোস্ট করব, পুরস্কারও পাবে সেই সিনেমা। মানুষের হাতে না তৈরি হলেও এআই আর্ট ক্রমে হিউম্যান আর্ট হয়ে যাবে, হিউম্যান ক্রমে ইনহিউম্যান হয়ে যাবে মানুষ থেকেও। তাই সইই।
কিন্তু, আমি চিরকাল মানুষের বানানো সিনেমাই প্রেফার করব। এইটুকু সেকেলে হয়ে থাকাই আমার প্রতিরোধ। আমি মানুষ হয়ে জন্মেছি, মানুষ হয়েই মরব।
বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫
দ্য চেলিস্ট অফ সারাজেভো
শিল্পের দুনিয়ায় কালচারাল রেজিস্ট্যান্স বলে একটা কথা আছে। তেমন কোনও বিপর্যয় হলে, ফ্যাসিবাদী সরকারের জোরজুলুম বাড়লে, যুদ্ধ লাগলে শিল্পীরা নিজের মতো করে বিরোধ করে। কেউ কবিতা লেখে, কেউ গান বাঁধে, কেউ ছবি আঁকে। কিন্তু আসলে একজন মানুষের ক্ষমটা ঠিক কতটা? তাঁর এই প্রতিবাদী স্বর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে মানুষের মনে? বাস্তবে এই রেজিস্ট্যান্সের কোনও মূল্য আছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমরা বরং পঁয়তাল্লিশ বছর পিছিয়ে যাই। এই সেই সময় যখন পৃথিবীর বুকে একটা রাজনৈতিক বদলের সূত্রপাত ঘটেছিল। ১৯৮০ সালে ইউগোস্লোভিয়ার রাষ্ট্রপতি জোসিপ ব্রজ টিটো মারা গেলেন। এখন টিটো যত বড় ক্রিমিনালই হোক না কেন, তিনি প্রায় জোর করেই ইউগোস্লোভিয়ার সোশালিস্ট সাম্রাজ্যকে সামলে রেখেছিলেন, ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্টও সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতোই ভিতরে ভিতরে ফুটছিল ঠিকই, কিন্তু সেভাবে বিষ্ফোরণ হয়নি। টিটোর মৃত্যু সেই আগলকে আলগা করে দিল। কোসোভো থেকে সার্বিয়া, নানা জায়গায় লোকজন বিদ্রোহ করতে শুরু করল। এর কয়েক বছর পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়তে লাগল, আর বালকানের একাধিক দেশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করে দিল। এদের মধ্যে, বলাবাহুল্য, বোসনিয়া-হার্জেগোভিনা অন্যতম ছিল। বোসনিয়ার কথা আলাদা করে বলার কারণ, এই গল্পের প্রেক্ষাপট বোসনিয়ার রাজধানী সারাজেভো।
সারাজেভো আসলে একটা উপত্যকা নগরী। পাশ দিয়ে মিলয়াকা নদী বয়ে গিয়েছে। ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউককে এখানেই হত্যা করা হয়েছিল, যার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সারাজেভো ইউগোস্লোভিয়ার অংশীভুক্ত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা শহরটাকে অধিকার করে, তারপর দেখা যায় ক্রোয়েশিয়ার আল্ট্রান্যাশনালিস্ট-ফ্যাসিস্ট বিপ্লবী দল উস্তাসের (Ustaše) হাতে পড়ে সারাজেভো ক্রোয়েশিয়ার অংশ হয়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে হতে সারাজেভো আবার ইউগোস্লোভিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে আর সোস্যালিস্ট রিপাবলিক অফ বোসনিয়া আর হার্জেগোভিনার রাজধানী হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এই শহরে তখন বোসনিয়ানরা তো থাকতই, সার্ব আর ক্রোটসরাও থাকত মিলেমিশে। একটু আধটু ঝামেলা থাকলেও কোনোদিন জাতি নিয়ে রেসিয়াল টেনশন বা দাঙ্গা হাঙ্গামা শোনা যায়নি।
গোল বাধল তখন, যখন ৬ মার্চ ১৯৯২ সালে বোসনিয়া হার্জেগোভিনা স্বাধীনতার ঘোষণা করে ফেলল। সার্বদের একাংশ এই ঘোষণাকে মোটেও আমল দিল না, তারা Republika Srpska বলে একটা নতুন স্টেট বানিয়ে স্বাধীন দেশের মতো কাজ শুরু করে দিল। এইবার এই Srpska-তে বোসনিয়ার কিছু অঞ্চলও ঢুকে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি রাদোভান কারাদজিক নিজে সার্ব, তিনি বোসনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে অন্য অঞ্চলগুলোও এই নবনির্মিত 'দেশ'-এ নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।
এইবার এই যুদ্ধে কী হয়েছিল না হয়েছিল সে অন্য বিষয় এবং অনেক জটিল বিষয়, কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি কোপ পড়ল সারজেভোর সাধারণ মানুষের ওপর। একে তো ইউগোস্লোভিয়ান ওয়ার চলছে, স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই ইউগোস্লোভিয়ার সেনাবাহিনী সারাজেভোকে ঘিরে আক্রমণ করছে, তারপর এসে জুটেছে এই শ্রপ্সকা (Srpska) ট্রুপরা। সাঁড়াশি আক্রমণে সারাজেভোর নাজেহাল অবস্থা। সেখানে বোসনিয়ার মানুষ বেশি, তাই সার্বদের রাগ আরো বেশি করে গিয়ে পড়ল রাজধানীর ওপর। প্রথমে ইউগোস্লোভিয়ার সেনা শহরকে ঘেরাও করে রেখেছিল, তারপর শ্রপ্সকা বাহিনী এসে সারাজেভোকে ঘিরে ফেলল। একদিন নয়, এক সপ্তাহ নয়, এক মাস নয়, প্রায় চার বছর ধরে এই সিজ চলল। তেরো হাজার সৈনিক শহরটাকে ঘিরে রেখেছে, আর্টিলারি ফায়ার করছে, ট্যাঙ্ক নিয়ে শহরে ঢুকছে, মর্টার চার্জ করে শহরের নিদর্শনগুলোকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, আনতাবড়ি গুলি চালাচ্ছে নিরপরাধ সিভিলিয়ানদের ওপর।
একটা শহরকে 'সিজ' করলে কী হয়? একটু ভেবে দেখুন। একটা শহরের খাবার বা পানীয় জল, সবই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরবরাহ হয় বাইরে থেকে। বিদ্যুৎ, ওষুধপত্র, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র... জীবনধারনের জন্য সব কিছুই আসে গ্রাম বা গঞ্জ থেকে। এখন কেউ শহরকে ঘিরে যদি এই সাপ্লাই লাইন কেটে দেয়, তাহলে কী হবে? মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে৷ তারপর যদি কেউ রাস্তায় নেমে আপনার ওপর গুলি চালায়, বোমা ফেলে... তাহলে? সোনায় সোহাগা! একদিন দুদিন নয়, দীর্ঘ চার বছর ধরে এমন হয়েছে। আধুনিক যুগে এমন নজির আর নেই। স্টালিনগ্রাড আর লেনিনগ্রাডে যে ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সারাজেভোর অবস্থা হয়েছিল তার চেয়েও শোচনীয়। একের পর এক ম্যাসাকার, একের পর এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে হাজার হাজার মানুষ মরেছে, বিল্ডিংগুলো ধ্বসে গেছে, স্কুল, হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টার ধুলোয় মিশে গেছে, শিশুদের লাশ ধুলোয় লুটিয়েছে দিনের পর দিন। বোসনিয়ার ৭০০০০ ট্রুপ এই শহরে মোতায়েন, কিন্তু সাপ্লাই লাইন কেটে দেওয়ার ফলে তাদের কিছু করার ছিল না।
খাবার নেই, জল নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, কাজকর্ম নেই, আছে শুধু অন্তহীন অপেক্ষা। অন্ধকারে মোমবাতি জ্বেলে বসে থাকত লোকে। কখন মর্টার চার্জ হয়ে মরতে হবে ঠিক নেই। ১৯৯২ সালে সারাজেভোর জনসংখ্যা ছিল ৫ লাখ, চার বছর বাদে যখন সিজ তোলা হয়, তাদের মধ্যে অনকেই আর নেই। যারা আছে, তারা কঙ্কালসার হয়ে বেঁচে রয়েছে।
শুধু বোসনিয়ান নয়, এই যুদ্ধে মূল্য চুকিয়েছে সার্ব জনতাও। যুদ্ধের পর তাদের কাছে ঘরদোর ছেড়ে শ্রপ্সকা রাজ্যে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না।
কিন্তু এই ভীষণ হতাশাজনক সময়েও একজন মানুষ ছিল, লোকজন যাকে দেখে ভরসা পেয়েছে, আশায় বুক বেঁধেছে, সাহস পেয়েছে আগামীর স্বপ্ন দেখার। না, তিনি কোনও রাজনেতা নন, কোনও সেলেব নন, কোনও শক্তিশালী সুপারহিরো নন, তিনি একজন সাধারণ মানুষ। একজন শিল্পী।
মে ২৭, ১৯৯২। দুপুরের দিকে একদল লোক বাজারে পাউরুটি কিনতে গিয়েছিল। এমন সময় প্রচণ্ড শব্দ করে একটা বোমা এসে পড়ে সেখানে। বাইশজন মারা যায়, সত্তরজন আহত হয় ভয়ানক ভাবে। কারো হাত উড়ে গেছে, কারো পা নেই, জনশুন্য বাজারে শুধু রক্ত আর বারুদের গন্ধ। রক্তমাখা পাউরুটির টুকরো পড়ে আছে ধ্বংসাবশেষের ভিতর।
অনেকেই দেখতে এসেছিল, ফিরেও গিয়েছিল। কী আর করার আছে তাদের? কিন্তু, একজন ফিরে আসেনি। সে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে ছিল রক্তাক্ত দেহগুলোর দিকে, তার চোখ বেয়ে নামছিল জলের ধারা।
লোকটার নাম ভেদ্রান স্মেলোভিক। পেশায় একজন চেলো প্লেয়ার। আর কিছুই সে পারে না। এখন যুদ্ধের মধ্যে কে আর চেলো শুনবে, কে আর সঙ্গীতানুষ্ঠান করবে? তাই তাঁরও কিছু করার ছিল না।
কিন্তু, এক একটা মুহুর্ত অনেকের মনে অনেক কিছু বদলে ফেলতে পারে। পরদিন স্মেলোভিক আবার সেই বাজারে এল, পরনে একটা ময়লা সাদা শার্ট আর একটা কালো টেল কোট, হাতে চেলোর বাক্স। এক হাতে ফুলের গোছা। বাজারে এসে সে ধ্বংসাবশেষের ওপর ফুল ছড়িয়ে দিয়ে মৃতদের উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা করল, তারপর একটা ভাঙা পাথরের ওপর বসে চেলো বাজাতে শুরু করল।
কেউ কোথাও নেই। নিঃশব্দ শহর, বাতাসে বারুদের গন্ধ। ভাঙা বিল্ডিংয়ের টুকরো ছড়িয়ে আছে সর্বত্র, ধুলো উড়ছে। অনেক দূর থেকে টেলি লেন্স দিয়ে সার্ব সৈনিকরা তাকে দেখতে পাচ্ছে, এক্ষুনি স্নাইপারের গুলিতে তার বুক ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মানুষটার সে সব খেয়াল নেই। সে একমনে চেলো বাজিয়ে চলল। আলবিনোনি আডাজিওর জি মাইনারের সুর গুঞ্জরিত হতে লাগল সারাজেভোর অলিগলি। যারা শুনল, ভাবল লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখনও যে গুলি খেয়ে বা বোমা ফেটে মরেনি এই আশ্চর্য! এমন পাগলামি কেউ করে?
হ্যাঁ, কেউ কেউ করে। একবার নয়, বারবার করে। পরদিন স্মেলোভিক আবার ফিরে এল সেখানে। আবার বাজাতে লাগল সেই সুর। একই জায়গা, একই সুর, একই দরদ দিয়ে। তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। তারপর দিন সে আবার ফিরে এল। তারপর দিন আবার এল।
বাইশ দিন ধরে, ক্রমাগত, একই জায়গায় এসে সে চেলো বাজিয়ে গেল। বাইশজন অকালমৃত মানুষের স্মৃতির উদ্দেশে। শেষের কয়েকদিন কেউ আর তাকে পাগল বলেনি, বরং ক্রমে একে একে আরো মানুষ এসে জড় হয়েছেন সেখানে। চুপ করে দাঁড়িয়ে বাজনা শুনেছেন, প্রার্থনা করেছেন, ফুল চড়িয়েছেন। সকলেই ভীত, সন্ত্রস্ত, আশঙ্কিত। সবাই জানে শত্রুরা তাদের দেখতে পাচ্ছে। একটা মর্টার চার্জ করলে সবাই মরবে। কিন্তু তবু তারা এসেছেন। প্রথমে দুজন, তারপর চারজন, তারপর পনেরোজন... একজন মানুষ যখন নিজের জীবনের চিন্তা না করে চেলো বাজাতে পারছে, তারা একটু সঙ্গও দিতে পারবে না? যারা চলে গিয়েছে, তাদের একটু শ্রদ্ধাও জানাতে পারবে না মৃত্যুর ভয়ে? তাহলে মানুষ হয়ে জন্মে আর লাভ কী?
বাইশদিন পর সবাই ভাবল, চেলিস্ট মহাশয় এইবার ক্ষান্ত দেবেন। কিন্তু কোথায় কী? দেখা গেল ভেদ্রান স্মেলোভিক তার টেল কোট পরে অন্য এক জায়গায় উপস্থিত হয়েছেন, অন্য কোনও ধ্বংসস্তুপের মধ্যে বসে তিনি বাজিয়ে চলেছেন তাঁর বাজনা! এই তাঁর প্রতিবাদ! এই তাঁর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
দু একদিন নয়, দীর্ঘ দু বছর ধরে এই মানুষটি চেলো বাজিয়েছেন যুদ্ধের পরোয়া না করে। সেরাজেভোর বুকে রোজ সকালে বেজে উঠত তাঁর সেলোর সুর। কোনোদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল, কোনোদিন হাসপাতাল, কোনোদিন ভেঙে পড়া কবরখানার ভিতর থেকে। একদিনের জন্যও থামেননি। সবাই ভাবত, আজই বুঝি শেষ দিন। সেলিস্টটার ছিন্নভিন্ন দেহ নিয়ে আসতে হবে তাদের। কিন্তু, স্মেলোভিক মরেননি। হয়তো শত্রুরাও তাঁকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে এই মানুষের কথা লোকে জানতে শুরু করে। হোয়ান বায়েজ সারাজেভোতে এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন, চলে আসেন সুসান সোনটাগ। শিল্পীমহলে তখন স্মেলোভিক এক কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন৷ সারা দুনিয়া থেকে শিল্পী, লেখক, গায়করা তাঁকে সমর্থন জানাচ্ছেন, তাঁকে নিয়ে বই, নাটক, গান লেখা হচ্ছে, শয়ে শয়ে শিল্পী এসে যুদ্ধবিরোধী মিছিল করছেন সারাজেভোতে। উইনাইটেড নেশনসের টনক নড়েছে, শিল্পীদের বিবৃতি আর অনুরোধের ফলে সাহায্য আসছে একটু একটু করে। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরে তখন একদিকে গুলির শব্দ, অন্যদিকে সঙ্গীত অনুষ্ঠান হচ্ছে। 'চেলিস্ট অফ সারাজেভো' নিয়ে সারা দুনিয়ায় লেখালিখি হচ্ছে, চাপ পড়ছে যুদ্ধবিরতির জন্য।
১৯৯৬ সালে সারাজেভোর সিজ তুলে নেওয়া হয়। শান্তিও আসে একসময়। তার অনেক আগেই স্মেলোভিক নর্দার্ন আইল্যান্ডে চলে গেছেন, এখনও ওখানেই থাকেন। প্রচারমাধ্যম থেকে নিজেকে যথাসম্ভব সরিয়ে রেখেছেন। বলেছেন, "আমি শিল্পী, সেলেব নই। সারাজেভোর মানুষ হয়ে যেটুকু করা জরুরি মনে হয়েছিল, ততটুকুই করেছি। আমাকে হিরো বানাবেন না।"
স্মেলোভিক এর কাহিনি অবশ্য থেমে থাকেনি, তা ছড়িয়ে গিয়েছে সারা দুনিয়ায়। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে। কারিম ওয়াস্ফি বাগদাদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া বাজারে দাঁড়িয়ে তাঁর মতো চেলো বাজিয়েছেন, পারফর্ম্যান্স আর্টিস্টরা নিজের নিজের মতো করে যুদ্ধ আর অবিচারের জন্য প্রতিবাদ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন এই কাহিনি থেকে। স্মেলোভিক নায়ক হতে চাননি, কিন্তু 'চেলিস্ট অফ সারাজেভো' নামটা চিরকালের জন্য কালচারাল রেজিস্ট্যান্সের প্রতীক হয়ে রইল।
কালচারাল রেজিস্ট্যান্স কথাটা শুধুই কথা নয়। এবং, একজন মানুষের ক্ষমতাও কিছু কম নয়।
(উচ্চারণ ভুল হতেই পারে। স্মেলোভিক সম্ভবত সার্বিয়ানে স্মাইলোভিচ। সে ইগ্নোর করুন)
মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫
ব্ল্যাকহোলের ভিতর পিকনিক
সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০২৫
মিশরে আর্কিওলজিকাল বোনাঞ্জা
মিশর নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের তো এই বছর পোয়াবারো। তিন মাস কাটেনি, এর মধ্যেই বিভিন্ন সাইটে এমন সব মাথা খারাপ করা আবিষ্কার হয়েছে যে আর্কিওলজিস্ট আর ইজিপ্টোলজিস্টদের মাথা ঘুরে গেছে। প্রাচীন মিশরের লোকজন আমাদের জন্য গাদা গাদা সারপ্রাইজ প্ল্যান করে গিয়েছিল সন্দেহ নেই কিন্তু এমন পরপর মাইন্ডব্লোইং ডিসকভারি এর আগে কোনওদিন হয়েছে কিনা সন্দেহ! যাকে বলে আর্কিওলজিকাল বোনাঞ্জা! তা ঠিক কী কী হয়েছে মিশরে? চটপট দু চারটে দেখে নেওয়া যাক।
প্রথমেই বলতে হয় গিজা গিগা ডিসকভারির কথা। যেই মুহুর্তে আমরা সবাই ভাবতে শুরু করেছি যে গিজার পিরামিডের সমস্ত রহস্য খতম, এখন শুধু ওই জায়গাটা টুরিস্ট সাইট আর সিজ্জিতদার সিনেমার শুটিংয়ের জন্যই কাজে লাগানো হবে, গবেষকরা এমন একটা বম্বশেল ফেলেছে বেচারি ইন্ডিয়ানা জোনসও টুপি খুলে ঘাম মুছবেন। স্কটিশ আর ইতালিয়ান স্কলারদের একটা টিম গিজার পিরামিডের তলায় একটা বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড শহর আবিষ্কার করছে। হ্যাঁ, শহর, চেম্বার ফেম্বার নয়, আস্ত একটা সাবটেরেনিয়ায় সিটি। এই দলের দায়িত্বে ছিলেন পিসা ইউনিভার্সিটির কোরাদো মালাঙ্গা আর স্ট্রাথক্লাইড ইউনিভার্সিটির ফিলিপো বিওন্দি, তারা অত্যাধুনিক SAR মানে সিন্থেটিক অ্যাপারচার রেডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাফরে পিরামিডের ভিতরে জরিপের কাজ চালাচ্ছিল। এমন সময় তারা সেখানে একটা ঘরের মতো ফর্মেশন দেখতে পায়। আরো ভালো করে খোঁজাখুঁজি করে দেখা যায় একটা বা দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা ঘর, সেগুলো ভূমিগত পথ দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। আজকাল সিমস বলে একটা ভিডিও গেম বেরিয়েছে, সেটার আবার একটা পিরামিড এডিশন আছে, সেখানে হেঁয়ালি সলভ করে আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার আর শহর বানাতে হয়। দেখা যাচ্ছে সাড়ে চার হাজার বছর আগে ইজিপ্টের লোকজন বাস্তবেই সেই গেম খেলছিল। এখন রেডার প্রযুক্তির রিডিং ঠিক হলে এই আন্ডারগ্রাউড চেম্বারগুলো বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। মানে, একটা শহর যত বড় হতে পারে আর কি! রেডারে তোলা ছবিতে ভার্টিকাল শ্যাফট, সর্পিল সিড়ি, ওয়াটার পাইপলাইনের চিহ্ন অব্দি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিতর্কও কম হচ্ছে না। ইজিপ্টের বৈজ্ঞানিকরা ভূমিগত শহরের ভাবনাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন এই বলে যে ওই রেডারের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এই নিয়ে তুমুল শোরগোল পড়েছে। অন্যদিকে রিসার্চাররা অবশ্য সেখানেই থেমে নেই, তারা ক্লেম করেছেন খুব সম্ভবত এই চেম্বারগুলো হলস অফ আমেনতি হতে পারে। এখন আমেনতি মিশরীয় লোককথায় একটা ভয়ানক কন্সেপ্ট, এই নিয়ে একগাদা মিথ আছে। সহজ ভাষায় হলস অফ আমেনতি বাস্তব দুনিয়া আর অতিলৌকিক দুনিয়ার মাঝের সেই জায়গা যেখানে নশ্বর বা কায়িক শরীর ছেড়ে আত্মিক অস্তিত্ব অর্জন করা যায়। সাধারণ মানুষ জীবিত অবস্থায় সেখানে গেলে সেখানে অবস্থিত পোর্টাল ইউজ করে মৃতদের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারে, অতিলৌকিক ক্ষমতাও অর্জন করতে পারে। দশকের পর দশক ধরে পূরাতত্ববিদরা মিশরের এই মিথিকাল চেম্বার খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এই বছর রিসার্চারদের দাবী শুনে তারা এমন জোরে মাথা চুলকোতে শুরু করেছে যেন মাথায় উকুন হয়েছে। সত্যি মিথ্যে যাই হোক, আমাদের এই সব জেনে রোমাঞ্চিত হতে কোনও বাধা নেই। তবে থামুন, আবিষ্কারের ফিরিস্তি এই সবে শুরু হল।
যেই সময় একদল আর্কিওলজিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি নিয়ে ব্যস্ত, সেই সময় এমন একটা ভীষণ আবিষ্কার হল যে ইজিপ্ট প্রেমীরা চেয়ার থেকে পড়ে যায় আর কি! বলা হচ্ছে, তুতানখামের সমাধি পাওয়ার পর এত বড় কোনও আবিষ্কার হয়নি। কথা হচ্ছে ফারানো থুতমোস দ্বিতীয়র ( Thutmose II) প্রায় এক শতাব্দী ধরে ইনি ইতিহাসবিদ আর আর্কিওলজিস্টদের ঘোল খাইয়ে খাইয়ে ঘুরিয়ে মেরেছেন। কত বছর ধরে ভদ্রলোকের সমাধি খোঁজা হচ্ছে তার হিসেব নেই। 'পেল পেল' করে রব উঠেছে বহুবার, কিন্তু পায়নি কেউই। থুতমোস বাবু আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন প্রায় এক শতাব্দী ধরে। ভদ্রলোক এমনিতেই দুর্ভাগা, তার দজ্জাল বউ রানি হাপশেটশুত সব লাইমলাইট নিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, কিন্তু জানা যায় না বলেই মারা যাওয়ার এতদিন পর তিনি ইজিপ্টোলজিস্টদের দুনিয়ায় উচ্চস্থান অর্জন করেছেন। প্রসঙ্গত তার মমি পাওয়া গিয়েছিল বহু আগে, শুধু টুম্বটার খোঁজ চলছে দেড়শো বছর ধরে। যাই হোক, ইজিপ্ট আর ব্রিটেনের আর্কিওলজিস্টরা ভ্যালি অফ দ্য কিংসের পাশেই থেবস অঞ্চলে তাঁর সমাধি আবিষ্কার করেছে। অবশ্য জায়গাটা আড়াই বছর আগে জানা ছিল, কিন্তু হায়েরোগ্লিফগুলো প্রায় মুছে গিয়েছিল, টুম্বের অবস্থাও ভালো ছিল না, সব রিঅ্যানিমেট করে কনফার্ম করতে করতেই এতদিন কেটে গেল। এই আবিষ্কারের সবচেয়ে স্পেশাল পয়েন্ট হল, এই প্রথম কোনও ফারাওয়ের সমাধিতে রাখা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জিনিসপত্র পাওয়া গেল। সে এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিল যে সেটা যে কোনও ফারাওয়ের সেটা আগে কেউ অনুমান করেনি, সবাই ভেবেছিল, সুয়োরানি দুয়োরানি কারো হবে। ওয়েল, জেন্ডার সোয়্যাপের ধারণা আজকের নয়। দেখা গেল, আসলে সেটাই রাজামশাইয়ের টুম্ব। এখন এই সমাধির হিয়েরোগ্লিফ লিপি আর উদ্ধার করা জিনিসপত্র যে আগামীতে কী খেল দেখাবে সেটা ভবিষ্যত বলবে, আপাতত একশো বছরের লুকোচুরি শেষ হল।
আরো আছে। সাক্কারার কথা তো অনেকেই জানেন। মিশরের প্রাচীনতম পিরামিড এবং নেক্রোপলিস, এই বিশাল এক্সক্যাভেশন সাইটে সবসময় কিছু না কিছু আবিষ্কার হচ্ছেই। রহস্য আর শেষ হয় না। সাক্কারার ভূমি দেবতাও দু হাত খুলে কিছু না কিছু দিয়েই যাচ্ছেন। একবারের জন্যও বলছেন না, যতই দাও ততোই চাই। খিল্লি বাদ দিয়ে বলি, জানুয়ারি মাসে জাপান আর ইজিপ্টের একটা জয়েন্ট আর্কিওলজিকাল মিশনের কর্তারা ঘোষণা করলেন, তারা প্রাচীন মাস্তাবা, মানে কফিনই কিন্তু চারটে হাতি ঢুকে যাবে এমন রেক্টাঙ্গুলার সুপারস্ট্রাকচার, আবিষ্কার করেছেন। সঙ্গে সেকেন্ড আর থার্ড ডাইনেস্টির প্রচুর মূল্যবান বস্তু পাওয়া গিয়েছে। সেসব ২৬৫০ বিসির জিনিস। এছাড়াও ১৫৫০-১২৯২ বিসি, মানে যে সময়টা ইজিপ্টে এইটিন্থ ডাইনেস্টি অফ অফ দ্য নিউ কিংডম বলে পরিচিত, সেই সময়ের দশটারও বেশি সমাধির খোঁজ পেয়েছেন। এখানেই শেষ হলেও হত, কিন্তু সাক্কারাতে সেসব হয় না। একটা চাইলে চারটে পাতুরি ঢেলে দেয়। এই দলের লোক এর পাশাপাশি দুটো মাটির ইট দিয়ে নির্মিত মাস্তাবা, দুটো পাথর দিয়ে কুঁদে বানানো সমাধিও খুঁজে বের করেছে, আর সঙ্গে একটা চুনাপাথর দিয়ে সিল করা শ্যাফটও পাওয়া গেছে যেটা একটা আন্ডারগ্রাউন্ড সমাধিক্ষেত্রতে যাচ্ছে। প্রায় রোজই সেখানে নতুন জিনিস জানা যাচ্ছে। কয়েক মাস পর দেখা যাক এই নতুন আবিষ্কারগুলো কী বোমা ফাটায়!
কিন্তু দাঁড়ান। এই বছর আর্কিওলজিকাল জ্যাকপট যখন চলছেই, লাক্সর পিছনে থাকবে তা কেমন করে হয়? ফারাওদের রাজধানী বলে কতা! সেখানে কিছু পাওয়া যাবে না তা হয়?জানুয়ারি মাসেই ইজিপ্টের রিসার্চাররা জানালেন এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা, যা পাওয়া গিয়েছে দেইর-এল-বেহরিতে রানি হাপশেটসুতের মন্দিরের একদম কাছেই। রানির অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্য নির্মিত কমপ্লেক্স থেকে দেড় হাজারেরও বেশি লাইমস্টোন ব্লক পাওয়া গিয়েছে, প্রতিটাই চমৎকার ভাবে মেন্টেন্ড আছে। রঙটঙ চটে যায়নি, হায়েরোগ্লিফে একদম ঠাসা। এখন প্রথম কয়েকটার অর্থ উদ্ধার করে জানা গিয়েছে এ এক বিশাল জিগশ পাজল, কিন্তু অসম্ভব গোপনীয় আর মাথা খারাপ করা কিছু। হায়েরোগ্লিফ এক্সপার্টরা আপাতত মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, কিন্তু বাকিরা দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে। এক্সক্যাভেশনে অবশ্য একগাদা রাজকীয় উপাদানও পাওয়া গিয়েছে, এই ধরনের আর্টেফ্যাক্টও তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পর থেকে আর পাওয়া যায়নি, সে একশো তিন বছর হয়ে গেল। যা বুঝলাম, রানি হাপশেটসুত পণ করেছিলেন, মৃত্যুর পরেও তিনি বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন, গার্ল পাওয়ার কাকে বলে। জাস্ট কিডিং!
এইবার আসল মজা। এতসবের মধ্যে এমন একটা ভয়ংকর আবিষ্কার হয়েছে যে সকলের রাতের ঘুম উড়ে গেছে, ঘেমেনেয়ে গেছে সারা দুনিয়ার মিশর এক্সপার্টরা। আবাইদোসে মাউন্ট আনুবিস নেক্রোপলিসে একজন ফারাওয়ের সমাধি পাওয়া গিয়েছে, এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব এক মার্কিন-ইজিপশিয়ান টিমের। মুশকিল হচ্ছে এই ফারাও কে, কেউ জানে না। মানে, কিছুই জানে না। কোত্থেকে ইনি উড়ে এসে জুড়ে বসলেন, তাঁর বংশ পরিচয় কী, তিনি কোন রাজত্বে ছিলেন, কিছুই জানা যায় না। খোদাই করা লিপি পড়ে অনুমান করা হচ্ছে এই রহস্যময়ী ফারাও এমন এক নতুন বংশ বা ইতিহাসের কথা জানাতে পারে যে সম্পর্কে এখনও কেউ কিচ্ছুটি জানে না। তেমন হলে মিশরের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।
এছাড়াও প্রায় নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে এ বছর। মিশর নিয়ে যারা উৎসাহী, তাদের জন্য রোমাঞ্চিত হওয়ার সুবর্ণ সুয়োগ। এ-ই লেখায় কিছু কিছু আলগা টার্ম আছে, মিশর নিয়ে ক্র্যাশ কোর্স চাইলে অনির্বাণ ঘোষের 'হায়েরোগ্লিফের দেশে' পড়ে ফেলুন।
রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৫
মুনির আজও বিচার পায়নি
আশাবাদী হওয়া খুব ভালো জিনিস। কিন্তু চারিদিকে যা অবস্থা, চোখকান খুলে রাখলে হতাশাই গ্রাস করে বেশি করে। বেনারসে এক পরিচিত ছেলের ভাইকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে শুনলাম, সে নাকি জানেই না কেন তুলেছে! এদিকে মাস চারেক ধরে সে জেলে বসে আছে। কাণ্ড! এদিকে রিসেন্টলি শুনলাম, সুপ্রিম কোর্ট আবারও বলেছে, ট্রায়াল ছাড়া কাউকে দিনের পর দিন আটকে রাখা চলবে না। শুনে ভালোই লাগে, যতক্ষণ না মনে পড়ে, কথাটা সুপ্রিম কোর্ট কুড়ি বছর ধরে বলেই চলেছে। এদিকে হাজার হাজার সাংবাদিক আর অ্যাক্টিভিস্ট বছরের পর বছর ধরে ট্রায়াল ছাড়া জেলে বসে আছে। ভীমা কোরেগাঁও কেসে কবীর কলা মঞ্চের একগাদা শিল্পীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের প্রায় কারো কেসই আদালতে ওঠেনি। উমর খালেদের বেল রিজেক্ট হচ্ছে তো হচ্ছেই। আরে দোষী হলে তদন্ত করে সাজা দিলেই হয়, তদন্তের নামে কুড়ি বছর কাটিয়ে দিলে চলবে? এখন অনেকে এদের নাম শুনে রেগেও যেতে পারে, রাগাই দরকার। কারো নাম আলাদা করে বলবই না কেন? ইউএপিএ ইত্যাদি চুলোয় যাক, নর্মাল কেসেই ট্রায়াল হয় না। আজকাল ঠিকঠাক রিপোর্ট রিলিজ করার চলও উঠে গেছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রিকর্ড বিউরো ২০২১ সালে জানিয়েছিল, ভারতবর্ষের জেলে পাঁচ লাখ চুয়ান্ন হাজার কয়েদি আছে, তাদের মধ্যে চার লাখ সাতাশ হাজার ট্রায়ালের জন্য অপেক্ষা করে আছে। এদের মধ্যে অনেকেই কয়েক বছর কাটিয়ে দিয়েছেন জেলে, কেস আদালতেও ওঠেনি। সাধেই লোকে বলে, পুলিশে ছুঁলে আঠেরো ঘা! জাস্টিস সিস্টেম এমন এক হাস্যকর জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে বলার নয়। নিজে প্যাঁচে না পড়লে কেউ বোঝে না, তা না বোঝাই ভালো। তবে এরকম পরিস্থিতি যে শুধুই ভারতে তেমনটা ভাবলে ভুল হবে। বহু দেশেই কমবেশি একই অবস্থা। বছর ঘোরে, বিচার মেলে না।
এই সূত্রে একটা চমকপ্রদ ঘটনার কথা মনে পড়ে। এই গল্প সম্ভবত খুব বেশি মানুষ জানেন না। অথচ, দুনিয়ার ইতিহাসে এ এক বহুচর্চিত কেস।
গল্পের নায়কের নাম মুনির। মুনির সাইদ তালিব। ১৯৬৫ সালে ইস্ট জাভার বাটুতে তার জন্ম। বাড়ির লোক বেশ উদারবাদী, প্রগেসিভ ধরনের ছিল, শিক্ষা আর সততাকে সমান মূল্য দেওয়া হত পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই তাহিরের মনে তাই জাস্টিস সিস্টেমের জন্য একটা অন্য রকম শ্রদ্ধা জন্মে গিয়েছিল। পড়াশোনায় খুবই ব্রাইট ছিল সে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ধারালো ছিল ন্যায় বিচারের প্রতি সচেতনতা। বড় হয়ে যখন সে ব্রাউইজায়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তে ভর্তি হয়, খুব তাড়াতাড়ি সে সক্রিয় ভাবে অ্যাক্টিভিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। পড়াশোনা শেষ করে সুরাবায়াতে লিগাল এইড এক্সপার্ট হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। তখন কেউ জানত না স্বপ্নালু চোখের এই ছেলেটা কয়েক বছরের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে চর্চিত হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে উঠবে, হাজার হাজার মানুষের বিচারের জন্য আদালতে আওয়াজ তুলবে।
আশি আর নব্বইয়ের দশক ইন্দোনেশিয়ার জনতার জন্য মোটেও ভালো সময় নয়। কেউ সরকারের আলোচনা করলেই তার মাথায় খাঁড়ার ঘা নেমে আসত। রাষ্ট্রপতি সুহার্তোকে নিয়ে এমনিতেই ইন্দোনেশিয়ায় দু ধরনের গল্প আছে। এক, তিনি কড়া হাতে মিলিটারি শাসন চালু করে দেশের অর্থনীতি ঠিক করেছেন, ইনফ্লেশন কমিয়েছেন, ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদির পত্তন করেছেন, কমিউনিস্ট রেবেলদের লাথি মেরে তাড়িয়েছেন। দুই, সুহার্তো এক নম্বরের কোরাপ্ট, ফ্যাসিস্ট, ডিক্টেটর আদমি। কয়েক বছর পর দেশের ক্ষমতা পুরোপুরি নিজের হাতে তুলে নিয়ে ডেমোক্রেসির সাড়ে তেইশ করে ছেড়েছেন, দুর্নীতি এবং বিরোধীদের খুন জখম করাতে বা গুম করাতেও তার জুড়ি মেলা ভার, ইস্ট টাইমারে জোর করে হামলা করতে গিয়ে এক ভীষণ যুদ্ধ শুরু করেছেন, যাতে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন। দুটোই মোটামুটি সত্যি। বেশিদিন পাওয়ারে থাকলে ক্ষমতা মাথায় উঠে মানুষের যা হয় আর কি! মোদ্দা কথা হল, আশির দশকের শেষ দিকে যখন দেশের অবস্থা পড়তির দিকে যাচ্ছে, একটু একটু করে বিরোধের স্বর শোনা যাচ্ছে, সুহার্তোর কথায় আয়রন ফিস্ট রুল শুরু হয়ে গেছে। ফ্রি স্পিচ আর প্রেসকে তুলোধনা করা আর মিলিটারিকে কাজে লাগিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো যা নয় তাই করা। এইসব ঝামেলা হলে যারা সবচেয়ে আগে আওয়াজ তোলে (আর সবচেয়ে আগে মারা পড়ে), ইন্দোনেশিয়াতেও তারাই তুলেছিল। ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা। দেশ জুড়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছে, এদিকে সুহার্তোর সেনা নিষ্ঠুর ভাবে তাদের প্রতিরোধ করছে, লাঠিচার্জ করছে, গুলি চালাচ্ছে, কিডন্যাপ করিয়ে এনকাউন্টার করছে বা বাড়ির লোককে সুদ্ধ তাদের ঘর থেকে তুলে এনে টর্চার করছে, মানে তোহফা অবস্থা।
কিন্তু মুনির ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। তার ভ্যালু সিস্টেম ছোটবেলা থেকেই মজবুত, ন্যায়ের জন্য সে সব কিছু করতে পারে। যখন সরকারের ভয়ে অনেকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকাই সেরা পন্থা বলে মনে করছেন, মুনির ঠিক করল সে দুর্বলদের পক্ষ নিয়ে লড়বে। যাদের জন্য কথা বলার কেউ নেই, তাদের হয়ে লড়বে। সুরাবায়াতে কাজ করার সময় থেকেই সে পুলিশের অত্যাচার, বেআইনি ভূমি অধিগ্রহণ আর লেবার রাইট ভায়োলেশনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে লাগল, গরীব জনতার কেস বিনামূল্যে লড়তে শুরু করল আদালতে। কয়েকদিনের মধ্যেই রটে গেল, এ ছেলের সাহস আছে, এ কম্প্রোমাইজ করার বান্দা নয়!
এদিকে দেশের রাজনীতিক পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে চলেছে। মিলিটারি যথেচ্ছ সব কাণ্ড শুরু করেছে, শয়ে শয়ে মানুষকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গণগত্যা চলছে। ইস্ট টাইমার আর পাপুয়াতে তো ইন্দোনেশিয়ার মিলিটারি তাণ্ডব নৃত্য করছে। কেউ কিছু বলতে গেলেই মুণ্ডু ঘ্যাচাং। এইসব কাণ্ড যত বাড়তে লাগল, মুনিরের কাছে কেসও আসতে লাগল ততো বেশি। সে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া মানুষদের পক্ষ নিয়ে লড়ল, গণহত্যা আর ম্যাসাকারের তদন্ত করল, সেনাবাহিনীর সেই সমস্ত কীর্তিকলাপের হাঁড়ি হাটে ভেঙে ফেলল যে সব চেপে রাখার জন্য সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করছে। KontraS (কমিশন ফর দ্য ডিসঅ্যাপিয়ার্ড অ্যান্ড ভিকটিমস অফ দ্য ভায়োলেন্স) বলে একটা সংগঠন গড়ে তুলল ১৯৯৭ সালে। পরের দুই বছর ধরে প্রো ডেমোক্রেসি অ্যাক্টিভিস্ট আর জার্নালিস্টদের কিডন্যাপিংয়ের তদন্ত করে চলল সে, সম্ভবত তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ততদিনে সুহার্তোর স্বৈরাচারী শাসন নিয়ে নিন্দেমন্দ শুরু হয়ে গেছে সারা দুনিয়ায়। মরিয়া হয়ে সরকার মরণ কামড় দিচ্ছে। শয়ে শয়ে ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সমাজকর্মীকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। কয়েকজনকে টর্চার করে ছাড়া হলেও অনেকে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। মুনির এই কেসগুলোর তদন্ত করে সরাসরি প্রমাণসহ সরকারকে দোষী ঠাউরাল। এক একজনের নাম নিয়ে সে প্রেসে প্রমাণ দাখিল করতে লাগল। স্বভাবতই মুনিরের সঙ্গে সরাসরি মিলিটারি, ইন্টেলিজেন্স আর পলিটিকাল এলিটদের ঠোকাঠুকি লেগে গেল, সে তখন সকলের চোখের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে স্পেশাল ফোর্সের পূর্ব প্রধান জেনারেল প্রাবোও সুবিয়ান্ত আর সুহার্তোর জামাই তাকে দু চক্ষে দেখতে পারত না।
মুনিরের কাছে প্রথমে হুমকি এল। তারপর শাসানো হল নানাভাবে। তাকে ফলো করা হতে লাগল। তারপর এল আক্রমণ। বারবার। কখনও শারীরিক ভাবে, কখনও মানসিক ভাবে। একবার এক শ্রমিক বাঁচাতে গিয়ে নিরাপত্তা কর্মীর কাছে মার খেয়ে হাত ভাঙল, একবার কিডন্যাপিংয়ের ঘটনায় কোপাসাস বা সিক্রেট আর্মির ভূমিকা সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে ঘরে কে যেন বোমা রেখে এল। ততদিনে সুহার্তো শুধু নয়, গোটা রাজনৈতিক ঘরানা আর আর্মি তাকে শত্রু বলে মনে করছে। সুহার্তোর শাসন উঠে যাওয়ার পরেও তার প্রতি আক্রোশ কমল না।কিন্তু মুনির শত ঝুঁকি সত্ত্বেও কাজ থামাচ্ছে না। প্রেস কনফারেন্সে বক্তৃতা দিয়ে সরকারের অবস্থা ঢিলে করে দিচ্ছে, প্রোটেস্ট লেড করছে, ট্রায়াল আর মিলিটারি আধিকারিকদের এক্সপালশনের জন্য ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। টিমোর, পাপুয়া, আসেহতেও যে সমস্ত বেআইনি হত্যা আর ডিটেনশন হয়েছে, সেই নিয়েও সে সোচ্চার। এদিকে সে এও প্রমাণ পেয়েছে যে এই জায়গা থেকে মিলিটারির কোরাপ্ট অফিসিয়ালরা নিষিদ্ধ ড্রাগ আর চোরাই কাঠের ব্যবসাও করছে।
মুনির জানত, সে কোন লেভেলের ঝুঁকি নিয়েছে।একবার সে বলেছিল, "Being a human rights activist means you have to be ready to be beaten, terrorized, and even killed. But if I stop, who else with fight for the justice?"
মুনির ততদিনে ইন্ডোনেশিয়ার সবচেয়ে সক্রিয় হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার হয়ে উঠেছে। মানবাধিকার আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য নিবেদিত 'ইমপার্সিয়াল'-এ তাকে ডিরেক্টর করা হয়েছে, তাতে তার কাজের ব্যাপ্তি আর ঝুঁকি, দুটোই বেড়েছে।
২০০৪ সালের কথা। মুনির অ্যামস্টারডামে আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে যাচ্ছিল। সেপ্টেম্বর মাসের সাত তারিখে সে গরুডা ইন্টারন্যাশনালের আমস্টারডামগামী ফ্লাইটে উঠল, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরেই তার বুকে পেটে ভয়ানক ব্যাথা শুরু হল, বমি হতে লাগল বার বার। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা প্রথমে ভেবেছিল ফুড পয়জনিং, কিন্তু মুনিরের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। প্লেন যখন আমস্টারডামের মাটি ছুঁল, তার দেহে আর প্রাণ নেই। মাত্র ৩৮ বছর বয়স হয়েছিল তার।
অটোপ্সি করে জানা গেল ফুড পয়জনিং নয়, পরিকল্পনা করে তাকে খুন করা হয়েছে। ডাচ অথোরিটিরা জানালেন, তার পেট থেকে প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিক পাওয়া গেছে, লিথাল ডোজ। ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। ঘটনা ইচ্ছে করে ঘটানো হয়েছে, যখন প্লেন থাকবে ৩৫০০০ ফুটে, আর মেডিকাল অ্যাসিস্ট্যান্স পাওয়ার কোনও উপায় থাকভে না। তার খুনের পরিকল্পনা করেছে যারা তারা নিশ্চিত হতে চেয়েছিল মুনির প্লেন থেকে জীবিত অবস্থায় নামবে না।
মুনিরের মৃত্যুতে গোটা ইন্ডোনেশিয়া জুড়ে প্রতিবাদের বন্যা বয়ে গেল। এটা সাধারণ একটা অ্যাসাসিনেশন নয়, মুনির মানুষের কথা ভেবে বাঁচত, আজীবন সাধারণ মানুষকে বিচার দেওয়ার জন্য লড়ে গেছে সে। তার এমন মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেনি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সুসিলো বাম্বাং য়ুধোউনো চাপে পড়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম আর তদন্ত কমিটি বসালেন বটে, কিন্তু অর্ধসত্য ছাড়া কিছুই বেরোল না। পলিটিকাল ইন্টারফেরেন্স আর কভার আপ করে সত্যি চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলতেই লাগল। এদিকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশনে জানা গেল ইন্ডোনেশিয়ার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বিআইএন এর পিছনে আছে। গরুডা ইন্টারন্যাশনানের পাইলটই সম্ভবত মুনিরের পানীয়তে বিষ মিশিয়েছিল, বহুদিন পর তাকে চোদ্দ বছরের সাজা দেওয়া হল, কিন্তু কার নির্দেশে সে এমন করল সেটা জানা গেল না। এদিকে তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হল ওপর থেকে নির্দেশ পেয়ে, প্রমাণ লোপ পেল, সাক্ষীরা হুমকি পেতে লাগল, হাই র্যাঙ্কিং অফিসিয়ালদের জেরা অব্দি করা হল না। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টরা অবশ্য হাল ছাড়লেন না। একে একে সুতো জুড়তে লাগল, বোঝা গেল মুনিরকে সরানোর পিছনে সরকারের বড় বড় নেতা, আর্মি অফিশিয়াল আর ইন্টেলিজেন্সের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের হাত আছে। সকলেরই মুখোশ খুলে দিচ্ছিল মুনির, তাকে বাঁচিয়ে রাখা বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। তাদের অনেকেই এখনও ক্ষমতাসীন, বড় বড় জায়গায় বসে আছে সবাই। প্রচুর প্রতিবাদ হল, মিছিল হল, তদন্ত কমিটি বসল, কিন্তু বিচার হল না। যারা মুনিরকে মেরেছে, তাদের কোনও সাজা হল না।
আজ একুশ বছর কেটে গেছে, মুনিরের হত্যার জন্য দায়ী মানুষরা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার স্ত্রী সুশিওয়াতি নিজেও লেবার রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট, দুই সন্তানকে নিয়ে সে আজও স্বামীর জন্য বিচার চেয়ে চলেছে। এখনও প্রতি মাসে ইন্দোনেশিয়ায় কোথাও না কোথাও মুনিরের জন্য বিচার চেয়ে প্রোটেস্ট হয়, হাজার হাজার আবেদন পড়ে স্বাধীন ভাবে তদন্ত করার জন্য, কিন্তু লাভ হয় না কিছুই। মারা যাওয়ার পর মুনিরের নামে প্রচুর সম্মান দেওয়া হয়েছে, তার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু মানবাধিকার সংগঠন খুলেছে, তার লিগেসি রয়ে গেছে। কিন্তু দোষীদের সাজা হয়নি। যে ছেলেটা অন্যদের বিচার দেওয়ানোর জন্য আটত্রিশ বছর বয়সে মারা গেল, সে নিজে আজও বিচার পায়নি।
দুনিয়া জুড়ে এই অবস্থা। তাহলে কেনই বা কেউ অবিচারের বিরুদ্ধে লড়বে? কেনই বা ন্যায় চাইবে? কেন আশা রাখবে? কেন বিচার চাইতে কোর্টে যাবে?
এর উত্তর মুনির জানত। সে বলেছিল, "If we stay silent in the face of injustice, we become part of the crime."
We have tired of Violence
The new press
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫
ওলাউদার আশ্চর্য জীবন
ধরুন আপনার বয়স দশ। স্কুলের ছুটি, আদর আহ্লাদে দিন কাটছে। সকালে ঠাকুমার কাছে গল্প শুনে, দুপুরে মায়ের হাতে ভাত খেয়ে, এক ঘুম দিয়ে বিকেলে উঠে পাউডার মেখে চুল আঁচড়ে আপনি চার বছরের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পার্কে ক্রিকেট খেলতে গেলেন এবং দুর্বৃত্তদের হাতে কিডন্যাপ হলেন। হলেন তো হলেন, আর আপনার বাড়ি ফেরা হল না। সারাজীবনের জন্য। ছোট ভাইকেও আর কোনোদিন দেখতে পেলেন না। এইবার ইম্যাজিন করুন, আপনার জীবন কেমন হবে?
যতক্ষণ আপনি ইম্যাজিন করছেন, ততোক্ষণে আমি একটা ছোট্ট গল্প বলে নিই। এমন একজন ছেলের গল্প যাকে এই সব কল্পনা করতে হয়নি, তার জীবনে সত্যিই এমন ঘটেছিল। কিন্তু সেই জীবন এমনই ঘটনাবহুল হয়ে উঠল, যে ইতিহাসেও তার সঠিক বিবরণ মেলে না। সবটা জানা যায় না। ভাসা ভাসা তথ্যই আছে। তাই সই।
ছেলেটা আফ্রিকার যে নামহীন জায়গায় জন্মেছিল, সেটা আজকাল নাইজিরিয়ায় পড়ে। অষ্টদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, তখন আফ্রিকা সম্পর্কে সাদা চামড়ার মানুষের কী ধারণা ছিল সে সবাই জানে। সে যাই হোক, ছেলেটার নাম হল ওলাউদা। তার বাবা ছিলেন গ্রামের প্রধান, খুব একটা অভাব ছিল না। গ্রামের মানুষ একে অপরকে ভালোবাসত, সাহায্য করত, বিকেলে আগুনের চারিদিকে বসে সবাই গল্পের আসর জমাত। কমিউনিটির ব্যাপারটা খুব প্রবল ছিল। এই পরিবেশে বড় হয়ে উঠছিল ওলাউদা। বালক বয়সে সবাই যে স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন তারও ছিল। কিন্তু এগারো বছর বয়সে তার সেই সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।
বোনের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল ওলাউদা। এমন সময় ঘোড়সওয়াররা চড়াও হল গ্রামে। চারিদিকে হুলুস্থুলু পড়ে গেল। ওলাউদা কিছু বোঝার আগেই দুজন মানুষ তাকে আর তার বোনকে তুলে একটা অন্ধকার গাড়ির ভিতর ছুঁড়ে দিল, সেই গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল সশব্দে। বাইরে থেকে তখন চেঁচামেচি, আর্তনাদের শব্দ ভেসে উঠছে। ওলাউদা চোট পেয়ে বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিল। সে জানত না বহুদিন আর সে এই অন্ধকার থেকে বেরোতে পারবে না, সূর্যের আলো দেখতে পারবে না। জীবনে আর কোনওদিন বোনের মুখও দেখা হবে না। যখন সে ঘুম ভেঙে উঠবে, তখন অলরেডি সে ক্রীতদাস হিসেবে একজনের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।
এখান থেকে ওলাউদার জীবন এমন একটা রোলার কোস্টার হয়ে উঠল যে সে বুঝেই উঠতে পারল না কী হচ্ছে! কয়েক মাস ধরে ঘুপচি অন্ধকারে এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে ছুঁড়ে ফেলা হল তাকে, প্রায় অর্ধভুক্ত অবস্থায় সে শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে ততদিনে। বাতি জ্বালালে চোখ জ্বালা করে। এর মধ্যে কতবার তার মালিক বদল হয়েছে সে জানেও না। কিন্তু কাজ করতে হয় ঠিকই। মাঝেমধ্যেই চাবুক এসে পড়ে পিঠে, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় গা। এই করে কতদিন কাটল, কী কাজ সে করছে, কে তার মালিক, কিছুই তার আর মনে নেই। সবসময় একটা ঘোর লেগে আছে, যেন কেউ ড্রাগ দিয়ে রেখেছে। আসলে নিকষ অন্ধকারে থেকে, ভিটামিন আর পুষ্টি কমে যাওয়ায় তার মাথা কাজ করছিল না। যখন তার বোধশক্তি ফিরল, তখন সে দেখল সে একটা ক্যারেবিয়ানগামী ক্রীতদাস জাহাজের খোলে অন্যদের সঙ্গে বন্দী।
ট্রান্সঅ্যাটলান্টিক স্লেভ ট্রেড এর কথা আমরা সকলেই জানি। জানি, কিন্তু অনুভব করার ক্ষমতা আমাদের নেই। মিডল প্যাসেজ, যেখানে আফ্রিকার ক্রীতদাসকে শুঁটকি মাছের মতো চেপেচুপে ঢুকিয়ে দেওয়া হত, সেখানকার অবস্থা কার্গোর চেয়েও বেশি খারাপ। অভুক্ত অবস্থায় লোকজন সি সিকনেসে ধুঁকছে, মলমূত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে, লোকে রক্তবমি করছে। জল নেই, ওষুধ নেই, আলোর ব্যবস্থা নেই, নামমাত্র খাবার আর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আছে। একের পর এক মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। এই অবস্থায় একটা এগারো বছরের ছেলের মনে কী ধরনের ভাবনা আসে? বিশেষ করে যখন তাকে কয়েক মাস আগে বাবা মা ভাই বোনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে?
ওলাউদা যে মরল না, সেটাই আশ্চর্য। সেই অন্ধকার খোলের মধ্যেই হয়তো ছেলেটা সার্ভাইভালের শিক্ষা রপ্ত করেছিল। কেউ তাকে শেখায়নি, কেউ উৎসাহ দেয়নি, কেউ সান্ত্বনা দেয়নি, কিন্তু কোনও এক মুহুর্তে বাচ্চা ছেলেটা ঠিক করে নিয়েছিল, অত তাড়াতাড়ি সে মরবে না। কিছুতেই মরবে না।
ওলাউদা মরেনি, ক্যারেবিয়ানে এসে পৌঁছেছিল সে। ডাঙায় পা রাখা মাত্র তাকে আবার বিক্রি করে দেওয়া হয়। তার নতুন মালিক ব্রিটিশ নেভাল অফিসার মাইকেল পাস্কাল। বন্দী ক্রীতদাসদের অবস্থা তখন কহতব্য নয়, কিন্তু ওলাউদার মধ্যে একটা বেপোরোয়া ভাব জন্মেছে। সে অত পরোয়া করে না, কাজ করে মন দিয়ে। কয়েকদিনের মধ্যেই পাস্কাল খেয়াল করলেন, তার নতুন চাকরটা যেন একটু অন্যরকম। ছেলেটার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, কাজেকর্মে চটপটে, মুখে মুখে জবাব দিতেও ভয় পায় না। একে খানিকটা শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে নৌবাহিনীর জাহাজের কাজে লাগানো যায়!
পাস্কাল ওলাউদাকে পড়াশোনা শেখাতে শুরু করলেন, হাতেখড়ি দিলেন জাহাজ চালানোরও। দেখলেন, কালো ছেলেটা একেবারে যাকে বলে কুইক লার্নার, দু'বার তাকে কিছু বলতে হয় না। এদিকে ওলাউদা তখন ভেবে নিয়েছে, জীবন যুদ্ধে সে পরাজয় স্বীকার করবে না। প্রতিদিন নতুন করে শুরু করবে। নতুন জিনিস শিখবে, নতুন কথা জানার চেষ্টা করবে। পুরোনো কথা ভেবে মন খারাপ করবে না। অন্যান্য ক্রীতদাসরা পড়াশোনার সুযোগ পায় না। সে পেয়েছে যখন, সেই সুযোগ হেলায় হারাবে না। কয়েকদিনের মধ্যেই সে ইংরেজি ভাষাটা মোটামুটি রপ্ত করে নিল। রোজ তার শেখার উৎসাহ বাড়ছে।
বছর কয়েক পর দেখা গেল, কিশোর ছেলেটা ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির জাহাজে করে সারা দুনিয়া চক্কর দিচ্ছে। তখন সে আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে ইংরেজি বলে, তার নেভিগেশন স্কিল রীতিমতো ভালো, ঝড়ঝঞ্ঝায় ডরায় না। কেবিন বয় থেকে ভ্যালে বা ইঞ্জিন রুমের সহকারী, রাতপাহারা থেকে লাইফ সেভিং গার্ড, সব কাজেই সে সমান করিৎকর্মা।
বছরের পর বছর ধরে ওলাউদা সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে চলল। কানাডা থেকে আফ্রিকা, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর, ক্যারেবিয়ান থেকে ইউরোপ... কত জাহাজে কতরকম কাজ করল তার ঠিকঠিকানা নেই। এই গোটা সময়টা ধরে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব জরিপ করল, অবজার্ভ করল, বইপত্র পড়ে নিজের জ্ঞান বাড়াল, লোকজনের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং করে কানেকশন তৈরি করল আর পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি এঁটে গেল। মাঝে বেশ কয়েকবার মালিক বদল হয়েছে, তাকে মুক্তি দেওয়ার কথাও হয়েছে৷ মালিকরা কথা দিয়েছে, কিন্তু কেউই কথা রাখেনি। একটা কালা মানুষকে দেওয়া কথার কী দাম? ওলাউদা বুঝেছিল, মুক্তি চাইলে হয় পালাতে হবে, নয় নগদ দিয়ে কিনে নিতে হবে? আর মুক্তি পেলেও সে করবে কী? দিনমজুর হবে? না, আর নয়! তাকে ব্যবসা করতে হবে, নয় অন্য কোনোও কাজ করতে হবে। কিন্তু তা সহজে হবে না। বড় জায়গায় কানেকশন দরকার। আর একজন ব্ল্যাক নেটিভের জন্য সেই কানেকশন তৈরি করা সহজ নয়। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে সে এই কাজ করে গেছে। অবশেষে ১৭৬৬ সালে, বহু বছর ধরে দাসবৃত্তির পর সে চল্লিশ পাউন্ড দিয়ে তার স্বাধীনতা কিনতে পারল। তখন চল্লিশ পাউন্ডে একটা ঘোড়া পাওয়া যেত। এত বছরের পরিশ্রমের দাম চল্লিশ পাউন্ড। সেই টাকা দিয়ে তোমাকে নিজের মুক্তি কিনতে হবে। চমৎকার না!
তা মুক্তি পেয়ে ওলাউদা কী করল? তখনও সে যুবক, যে কোনও কাজেই সে যোগ দিতে পারত। বর্ণবৈষম্যের দুনিয়ায় সে যে বড় কিছু করতে পারবে না, সে তো জানাই কথা! কিন্তু ব্ল্যাক টাউনে একটা ছোট্ট দোকান, একটা সেলাই শপ, একটা কসাইয়ের দোকান দেওয়া হয়তো অসম্ভব ছিল না। এতদিন পর কিছুটা শান্তি কে চায়?
কিন্তু, ওলাউদা অন্য ধাতুতে গড়া। সে কাউকে না জানিয়ে এতদিন ধরে নিজের জন্য নীরবে একটা অন্য জীবনের পরিকল্পনা করেছে, সেটা বাস্তবায়িত করতে সে বদ্ধপরিকর। বহু কষ্টে সে ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছাল। তারপর কাজ নিল অন্য একটা জাহাজে। সিম্যানশিপ তার রক্তে ঢুকে গেছে, ফ্রান্স, লুইসবার্গ, লাগোসের যুদ্ধে সে যোগ দিয়েছে, দীর্ঘ এই অভিজ্ঞতা দিয়েই তাকে উপার্জনের পথ বের করতে হবে। সে একের পর এক জাহাজে, বিশেষ করে এক্সপিডিশন শিপে কাজ করতে লাগল। তার কাজ দেখে খুশি হয়ে ১৭৭৩ সালে ডক্টর চার্লস ইরভিং তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, তিনি সমুদ্রের জল পরিশোধিত করার গবেষণা করছেন, এইচএমএস রেসহর্স বলে একটা জাহাজ নর্থ পোল অভিযানে যাচ্ছে, বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি ওলাউদাকে নিতে চান। ওলাউদা এই অভিযানে যোগ দিল এবং ক্রমে ডক্টর ইরভিংয়ের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠল। নর্থ পোল থেকে ফেরার পর ইরভিং এর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সে সেন্ট্রাল আমেরিকার মসকিউটো কোস্টে গিয়ে আফ্রিকার ক্রীতদাসদের সুপারভাইজ করার কাজ নিল, পাশাপাশি তাদের পরিস্থিতি নিয়ে জার্নাল লেখাও শুরু করে দিল। তার জীবনে যত অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে, না লিখলে আমরা জানতেও পারতাম না।
১৭৭৮ সালে লন্ডনে ফিরে গিয়ে ওলাউদা আস্তে আস্তে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে শুরু করল। এতদিনে তার কিছু সঞ্চয় হয়েছে, অনেকে তাকে চেনে, এই অবস্থান থাকা সত্ত্বেও সেটাকে ব্যবহার না করা বোকামি। আজীবন সে এই কাজটাই করতে চেয়েছে। ১৭৮০ সালে সে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ করার জন্য অ্যাবোলিসানিস্ট মুভমেন্টে অংশগ্রহণ করল। কয়েক বছরের মধ্যেই সে এই আন্দোলনের মুখপাত্র আর অন্যতম নেতা হয়ে উঠল। কংগ্রেসের সঙ্গে বৈঠক করা, আইনি আর্জি দেওয়া, প্রস্তাবিত বিল নিয়ে আলোচনা করা, বিরোধ মিছিল গোটা ইংল্যান্ডে স্লেভ অ্যাট্রসিটি সম্পর্কে বিবৃতি দেওয়া শুধু নয়, আসলে ওলাউদা গ্রাসরুট লেভেল গিয়ে এই আন্দোলনের জমি তৈরি করেছে। দাসপ্রথা উন্মূলনের জন্য সে কী কী করেছে, সেটা নিয়ে বিস্তারে বলতে গেলে একটা বইই হয়ে যাবে।
১৭৮৮ সালে ওলাউদার আত্মজীবনী প্রকাশিত হল, নাম 'The Interesting Narrative of the Life of Olaudah Equiano'. এর আগে ব্রিটেনের মানুষ কোনও কালো মানুষের জবানবন্দিতে ক্রীতদাস জীবনের কথা শোনেনি। ওলাউদার বইটা বাজারে ঝড় তুলে ফেলল। তার জীবনকালেই আট দশটা ভাষায় অনুবাদ হল, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস থেকে লম্বা লম্বা চিঠি আসতে লাগল। সবাই তার জীবনের কথা পড়ে শকড। ক্রীতদাসদের জীবন ঠিক কীরকম হতে পারে সে নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনও ধারণা ছিল না। এই বইয়ের পর ইউরোপে জোর আলোচনা শুরু হল, দাসপ্রথা তুলে দেওয়ার জন্য চাপ পড়তে লাগল। ওলাউদা তখন আয়ারল্যান্ডে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছে। পরবর্তীতে আমেরিকান রেভোলিউশনারি ওয়ারের সময়ও গরিব আফ্রিকান আমেরিকানদের পক্ষ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, ঘুরে ঘুরে দুঃস্থ মানুষের সাহায্য করেছেন, রেডিকাল মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলে অপবাদ কুড়িয়েছেন, কিন্তু কাজ থামাননি। শেষ দিন অব্দি ক্রীতদাসদের মঙ্গলের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
মাত্র বাহান্ন বছর বেঁচেছিলেন ওলাউদা ইকুয়ানো৷ এগারো বছর বয়সে তার বাড়িঘর পরিবার পরিচিত জীবন ছেড়ে এমন এক অনিশ্চিত জীবনে ঢুকে পড়তে হয়েছিল, যা সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না বাচ্চা ছেলেটার। অতীতের সমস্ত কথা, এমনকি নিজের আসল নামটাও বার বার ভুলে থাকার জন্য তাকে জোর দেওয়া হয়েছে। সেই ছেলেই যে একদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করবে, তাদের প্রণেতা হয়ে উঠবে।
জীবনে সব কিছুই সম্ভব।
বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫
দ্য টেইন্টেড কাপ
মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫
চড়ুইচরিত আর কিছু অবান্তর কথা
আগামী কুড়ি মার্চ ওয়ার্ল্ড স্প্যারো ডে। যে হারে মানুষ প্রাণীজগতের জন্য এই ডে সেই ডে বানিয়েছে, তার সিকিভাগ এফর্ট দিলে জীবজগতের উপকার হত। আমি আজকাল সচেতন ভাবে চড়ুই পাখি খোঁজার চেষ্টা করি, চোখে পড়ে না বললেই হয়। ছোটবেলায় দেখেছি, প্রায় প্রতি বাড়িতেই চড়ুই পাখির বাসা থাকত। কুলুঙ্গিতে, দেওয়ালের ফাটলে, এমনকি পাখার ওপরেও। গ্রীষ্মকালে যদি দেখা যেত পাখার ব্লেডের ওপর বাসা আছে, অনেকে পাখা না চালিয়ে হাতপাখা ব্যবহার করত। মাঝেমধ্যে খোলা জানলা থেকে চড়ুই পাখি এসে ঘরে ঢুকে পড়ত, পাখার চলন্ত ব্লেডে ধাক্কা খেয়ে মারাও পড়ত। তখন আমাদের মুখ এইটুকু হয়ে যেত, গলার কাছে কান্না এসে আটকে থাকত। আহত চড়ুই পাখিদের অনেকেই দেখেছি শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তুলতেন। শুধু চড়ুই পাখি কেন, যে কোনও পাখি বা প্রাণীর জন্যই কথাটা বলা চলে। এখন কেউ করে কি করে না সেটা কথা নয়, আসল কথা হল পরিবেশ জিনিসটা চুলোয় গেছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ আর ইকোলজিকাল ডেস্ট্রাকশন যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। প্রতিদিনই চোখে পড়ে নতুন নতুন কাণ্ড ঘটছে। মাইগ্রেশন সাইকেল বদলে গেছে, সমুদ্রের জলের তাপ আর ঢেউয়ের গতি বদলে গেছে। ডিপ সি মাইনিং এর খাঁড়া মাথার ওপর ঝুলছে। এরই মধ্যে শুনলাম হাজার হাজার ফিট নিচে বসবাসকারী সামুদ্রিক প্রাণীরা অক্সিজেনের জন্য ওপরে চলে আসছে আর অন্যান্য প্রাণীদের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে। কোরাল রিফগুলো কঙ্কালে পরিণত হচ্ছে, গলে যাচ্ছে একের পর এক গ্লেশিয়ার। গরীব আর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে নদীগুলোর অবস্থা শোচনীয়! পাহাড় জঙ্গলে দাবানলের ঘটনা বাড়ছে, প্রাণীরা লুপ্ত হচ্ছে দ্রুত। দূষণের কথা আর তুললাম না। এর মধ্যে চড়ুই পাখি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কার আছে?
তবু কয়েকজন মানুষ থাকেন, তাদের দেখে আশা জাগে। মনে হয়, এরা আছে বলেই দেশটা চলছে, দুনিয়াটা এখনও বাসযোগ্য আছে হয়তো! হয়তো! তারা কেউ সেলেব নয়, টিভি আর ইন্টারনেটে মুখ দেখানো ইনফ্লুয়েন্সার নন, সাধারণ মানুষ। আপনার আমার মতোই।
আমাদের দেশে আজও এমন প্রচুর মানুষ আছেন, যাঁরা পাখি বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। শৌনক সেনের পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি 'অল দ্যাট ব্রিথস' দেখে এখন অনেকেই মোহাম্মদ সাউদ আর নাদিম শাহজাদের কথা জানতে পেরেছেন, এরা বহুদিন ধরে দিল্লিতে আহত চিলদের চিকিৎসা করছেন, তাদের সারিয়ে তুলছেন। প্রায় কপর্দকহীন অবস্থা থেকে এই কাজ শুরু করেছিলেন, হাজার বাধা আর ব্যক্তিগত সমস্যা থাকলেও কাজ থামাননি। কিন্তু চড়াই নিয়েই কথা শুরু হয়েছিল যখন, আগে চড়াই ম্যানের কথাই বলা যাক।
রাকেশ খত্রীর গল্প শুনলে রূপকথা মনে হয়। পুরোনো দিল্লির এই বাসিন্দাকে আজ পরিবেশবিজ্ঞানীরা চেনেন এনভায়রনমেন্টিস্ট বা গ্রিন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে, কিন্তু পঁচিশ বছর আগে যখন রাকেশ পুরোদমে চড়াই পাখিদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, তাঁর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ছিল, ছোটবেলায় শোনা সেই চড়াইয়ের কলকাকলি এমন করে হারিয়ে যাচ্ছে কেন? এর কারণ অবশ্য সহজ। আগের মতো বাড়ির গঠন আর নেই, খোলামেলা বাড়িগুলো কঙ্ক্রীটের জঙ্গলে বদলে যাচ্ছে, সপাট দেওয়ালে একটা কুটোটি রাখার জো নেই। গাছপালা তো নেইই। চড়াই পাখিরা বাসা বানাবে কী করে? রাকেশ বুঝেছিলেন, এই সমস্যার সমাধান নেই। নগরায়নকে আটকানো যায় না, একটা বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে হবে। সেখান থেকেই তিনি ভেবে সিদ্ধান্ত নেন, চড়াই পাখিদের জন্য কৃত্তিম বাসা তৈরি করবেন। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ঘাস পাতা কাঠ কুটো নিয়ে লেগে পড়লেন তিনি। বাসাও তৈরি হল শ দুয়েক। নানান জায়গায় লাগিয়ে দিলেন বাসাগুলোকে। কিন্তু সেই বাসায় পাখি আসে না। রাকেশ বুঝলেন, অত সহজ নয়। পাখিদের বাসা মানে কতগুলো ঘাসপাতা এক করে গর্ত বানানো নয়, তার একটা প্রাকৃতিক নিয়ম আছে। একটা বিজ্ঞান আছে, একটা নান্দনিকতা আছে। পাখিদের ইঞ্জিনিয়ারিংকে হেয় করলে চলবে না, সেটা বুঝতে হবে। সময় দিয়ে, দরদ নিয়ে। এরপর থেকে রাকেশ বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের নিয়ে স্টাডি শুরু করলেন। তারা কীভাবে বাসা তৈরি করে, কখন করে, কোত্থেকে তৃণখণ্ড জোগাড় করে আনে, তাদের বাসার ভিতর তাপমাত্রা বা আর্দ্রতা কেমন করে নির্দিষ্ট করা হয়! চল্লিশটা প্রজাতির ছোট পাখি নিয়ে তিনি গবেষণা করে চললেন। এক একটা করে বাসা বানান, বোঝার চেষ্টা করেন কী করে আরো নিঁখুত পাখির বাসা বানানো সম্ভ হবে! কোনও সরকারি বেসরকারি সাহায্য ছিল না, লোকে ভাবত পাগল, কিন্তু রাকেশ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই কাজ করে গিয়েছেন। অবশেষে একদিন এল, দেখা গেল কৃত্তিম ভাবে তৈরি তাঁর বাসায় পাখিরা আসতে শুরু করেছে। উৎসাহ পেয়ে রাকেশ আরো জোর দিয়ে লাগলেন। আজ আড়াই দশক পরে রাকেশ চড়ুই পাখিদের জন্য প্রায় তিনলক্ষ বাসা বানিয়েছেন, সেখানে ঘর বেঁধেছে অসংখ্য পাখি। শুধু তাই নয়, তিনি এই মশালটা ধরিয়ে দিয়েছেন অল্পবয়সীদের হাতে৷ দেশ জুড়ে কয়েক হাজার ওয়ার্কশপ করেছেন, বড়দের পাশাপাশি ছোটদের উদ্বুদ্ধ করেছেন চড়াই পাখিদের রক্ষা করার জন্য। ২০১২ সালে গড়ে তুলেছেন ইকো রুটস ফাউন্ডেশন। কৃত্তিম ভাবে পাখিদের বাসা বানানোর পাশাপাশি তারা ই-ওয়েস্ট আর গ্রিন ডেভেলপমেন্ট নিয়েও কাজ করছেন। যে সব বাচ্চারা প্রথম হাতেখড়ি নিয়েছিল রাকেশের কাছে, আজ তাঁর সহযোদ্ধা। তারা সবাই মিলে পরম নিষ্ঠায় আমাদের চেনা চড়াইপাখিদের ঘরবাড়ি তৈরি করছেন, তাদের আগলে রাখছেন। রাকেশকে নাম দেওয়া হয়েছে নেস্ট ম্যান অফ ইন্ডিয়া।
রাকেশ একা নন। পরিচিতি হোক না হোক, ভারতে এবং অন্যান্য দেশে পাখিপ্রেমীদের অভাব নেই। আজও এমন মানুষ আছেন, যারা নিঃস্বার্থ ভাবে পশুপাখিদের ভালোবাসে, তাদের জন্য ভাবে৷
ডক্টর পূর্ণিমা দেবী বর্মনের নাম আমজনতা কতটা জানে জানি না, কিন্তু এই ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজিস্টকে ২০২৪ সালে টাইম পত্রিকায় জায়গা দেওয়া হয়েছে, সম্মানিত করা হয়েছে গত বছরের হুইটলি গোল্ড অ্যাওয়ার্ড বা গ্রিন অস্কার প্রাইজ দিয়ে। আসামে পূর্ণিমা দেবী প্রায় ২০০০০ মহিলাদের সঙ্গে করে এমন একটা পিপল কমিউনিটি মুভমেন্ট গড়ে তুলেছেন, যার কোনও তুলনা নেই। গ্রেটার অ্যাডজুটেন্ট স্টার্ক বা হাড়গিলেদের রক্ষার জন্য নিবেদিত এই হাড়গিলে আর্মি তৈরি করা অবশ্য সহজ ছিল না। নর্থ ইস্টে হাড়গিলেদের নিয়ে কুসংস্কার কম নেই, তাদের দুর্ভাগ্যের প্রতীক বলা হত। একসময় অকারণে এত হাড়গিলে মারা হয়েছিল যে এই প্রজাতি প্রায় লুপ্ত হতে বসেছিল। পূর্ণিমা আইইউসিএনের স্টার্ক, আইবিস আর স্পুনবিল স্পেশালিস্ট গ্রুপের সদস্য। ২০০৭ সালে তিনি যখন সারস, বিশেষ করে হাড়গিলা আর বোর্টুকুর্লা নিয়ে থিসিস লিখছেন, পূর্ণিমা জানতে পারেন হাড়গিলেদের বসবাসের গাছ, যা কোডোম গোস বা লিচহার্ট পাইন বলে প্রচলিত, সেগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। সারসের বিভিন্ন প্রজাতি আর তাদের ছানারা মারা পড়ছে। এরকম একটা ঘটনার কথা জানতে পেরে তিনি ছুটে যান, তখন তিনি সদ্য জমজ সন্তান প্রসব করেছেন। সেই দুর্বল শরীর নিয়েও পূর্ণিমা হাড়গিলেদের জখম ছানাপোনাদের হাতে করে নিয়ে গুয়াহাটি চলে আসেন, তাদের সারিয়ে তোলেন। কিন্তু দু চারটে ছানা বাঁচিয়ে কী হবে? পাখিই যদি মারা পড়ে তাহলে থিসিস লিখেই বা কী লাভ? এককালে যে পাখিগুলো জলাভূমি আর ঘাসবনে দেখতে পাওয়া যেত, সেসব শেষ হয়ে যেতে সেই পাখি আজকাল ময়লার ডিপো আর ভাগাড়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেই সঙ্খ্যাও প্রায় নিশ্চিহ্ন। পূর্ণিমা ঠিক করেন, এদের বাঁচাতেই হবে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তিনি মানুষজনকে সচেতন করতে শুরু করেন। রাকেশের মতো তাঁকেও সবাই পাগল ঠাউরেছিল, গান গেয়ে খিল্লি করেছে দিনের পর দিন, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। গ্রামের মেয়েদের বউদের নিয়ে আস্তে আস্তে একটা রক্ষাবাহিনী গড়ে তুলেছেন। ভজন আর পিঠে রান্নার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, আন্তরিক আলাপচারিতা আর সহজবোধ্য ভাষায় গাঁয়ের লোককে বুঝিয়েছেন হাড়গিলেদের উপকারিতার কথা। তাঁর প্রচেষ্টার ফলেই এই পাখিদের সঙ্খ্যা একটু একটু করে বাড়ছে।
চেন্নাইয়ের সুদর্শন শাহ আর তাঁর স্ত্রী বিদ্যার কথাই ধরুন। ২০০৪ সালের সুনামির পর যখন উপকূল অঞ্চলে খাদ্য পানীয়ের আকাল চলছে, সুদর্শন সকালে উঠে দেখেন তাঁদের বাড়ির ছাদে চারটে টিয়া এসে বসেছে। নিতান্তই করুণার বশে তাদের আগের দিনের রাখা ভাত বের করে খাওয়ান তিনি। পরদিন দেখেন চারটের জায়গায় ছ'টা টিয়াপাখি। তাদেরও খাওয়াতে কসুর করেন না। এর পরদিন দেখা যায় টিয়াপাখিগুলো তাদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছে, দশ বারোটা পাখি তাঁদের ছাদে বসে আছে। তারপর দিন আসে কুড়িটা, তারপর পঞ্চাশটা, একশোটা, পাঁচশোটা। সুদর্শন ভাবেন, এ ঈশ্বরের ইচ্ছে, এই অবলা প্রাণীগুলোকে খাওয়ানোই হয়তো তাঁর কাজ। সেই শুরু। ভাবতে অবাক লাগে, বহু বছর ধরে প্রায় ছয় হাজার টিয়াপাখিকে ভাত সেদ্ধ আর বাদাম খাওয়ান এই স্বামী স্ত্রী। তাদের ছাদটা আসলে টিয়াপাখিদের স্যাংচুয়ারি হয়ে গেছে। রোজ হাজার হাজার পাখিকে খাবার খাওয়ানো মুখের কথা নয়! প্রতিদিন প্রায় ষাট কিলো চাল লাগে। সেগুলো সেদ্ধ করতে হয়, তারপর ছাদে এসে কাঠের তক্তির ওপর সাজাতে হয়। পুরো খরচটাই হয় নিজেদের পকেট থেকে, পরিশ্রমও তাঁদের। কিন্তু একদিনের জন্যও বিরক্ত হননি সুদর্শন বা বিদ্যা। বরং হাসিমুখে এই কাজ করে চলেছেন। তাঁদের কথা মানতে হলে পাখিদের খাওয়ানো শুরু করার পর তাদের শরীর মন ভালো আছে, ঈশ্বরের আশীর্বাদে খাওয়াপরার অভাব অন্তত নেই। বিলাসিতার উপায় নেই, কিন্তু এতগুলো পাখির কাছে তারা অবলম্বন হয়ে উঠেছেন, এর চেয়ে বড় সুখ আর কী হবে?
স্বামী গণপতি সচ্চিদানন্দের কাহিনি আরো অদ্ভুত। ২০১১ সালে স্বামীজি ভেনেজুয়েলায় গিয়েছিলেন। অ্যাঞ্জেল ফলস দেখতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনার ফলে তিনি প্রায় একশো ফুট নিচে পড়ে যান। এরকম হলে বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না বলা চলে, কিন্তু সচ্চিদানন্দ বেঁচে যান। জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন, তাঁকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য পাখি। সেখানে আমাজনের ম্যাকাও পাখি থেকে শুরু করে কতরকম রঙবেরঙের পাখি আছে, তার হিসেব নেই। স্বামীজি সেই মুহুর্তে অনুভব করেন, এই পাখিদের জন্যই তাঁর প্রাণ বেঁচে গেছে। বাকি জীবনটা তিনি পাখিদের জীবন বাঁচাবেন৷ অসুস্থ, আহত, কুড়িয়ে পাওয়া পাখিদের নিয়ে এসে আশ্রয় দেবেন, যত্ন করবেন। ভারতে ফিরে এসে ম্যায়সোরের কাছে আস্তে আস্তে সুখবন গড়ে তোলেন তিনি। দেশ বিদেশের ৪৬৮ প্রজাতির পাখি আছে এই পাখিরালয়ে। সম্প্রতি তাঁর নাম ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে উঠেছে। এক্সোটিক কালেকটার বা পাখি সংগ্রাহক নয়, স্রেফ একজন সাধারণ মানুষ হয়েও এত রকম পাখি যে কারো বাড়িতে থাকতে পারে, প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি। অথচ, স্বামী সচ্চিদানন্দ পাখি কেনেন না, তিনি পাখিদের নতুন জীবন দেন। এই পক্ষীশালা আসলে একটা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার মাত্র। তাঁর কাছে সব পাখিই সমান। চড়াই, ময়না থেকে শুরু করে কাকাতুয়া, কিছুরই অভাব নেই।
এরা একা নন। ভারতেই শত শত মানুষ পাখিদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই চালাচ্ছেন। সুবাইয়া ভারতীদশন আর প্রেমসাগর মিস্ত্রীর মতো অনেক লুপ্তপ্রায় শকুনদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। দিল্লির অমিত আর অভিষেক জ্যায়েন আহত পশুপাখিদের বাঁচানোর জন্য মোটরসাইকেল অ্যামবুলেন্স চালু করেছেন, প্রায় ৫০০০০ পাখিদের প্রাণ রক্ষা করেছে এই উদ্যোগ। মোহাম্মদ দিলাওয়ার নেস্ট বক্স মুভমেন্ট শুরু করে ঘরোয়া চড়ুইপাখিদের খাওয়া আর বাসস্থান ফিরিয়ে দিচ্ছেন। পক্ষীবিদ অসদ রেহমানি হিউমান ডোমিনেটেড অঞ্চলে থাকা পাখিদের রক্ষা করার জন্য বহু বছর ধরে কাজ করছেন। এই লিস্ট শেষ হওয়ার নয়।
আমরা একটা অদ্ভুত সময়ে বাস করছি। কুড়ি পঁচিশ বছর আগেও যা স্বাভাবিক ছিল, এখন সে সব হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু কারোরই কোনও হেলদোল নেই। সরকারের তো হবেই না, আমাদের অনেকের জন্যও পশুপাখি বনজঙ্গল লুপ্ত হয়ে যাওয়াটা নর্মালাইজ হয়ে গেছে। জেনারেশনাল অ্যামনেশিয়া বলে একটা কথা আছে। যদি পরের প্রজন্ম না জানে যে সাধারণ বাড়িতে চল্লিশ পঞ্চাশটা চড়ুই পাখি বাসা বাঁধত, শালিক ময়না নীলকন্ঠ বুলবুল আকছার দেখা যেত, শয়ে শয়ে শকুন আর হাড়গিলে আর টিয়াপাখি দেখা এমন কোনও ব্যাপার ছিল না, তাহলে তারা জানতেও পারবে না, বুঝতেও পারবে না। দুটো চড়ুই বা একটা শকুন দেখেই তারা রোমাঞ্চিত হবে। এমন হলে আর কোনও আশা নেই। পাখি যে কমে গেছে, সেই নিয়ে কথা হোক। ছোটদের জানানো হোক, তাদের সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতিতে যাওয়া হোক বেশি বেশি। আজকাল চড়াই বা অন্য পাখিদের খাওয়ার জন্য ফিডিং বক্স পাওয়া যায়, খুদ বা চাল দিয়ে জল সহ বালকনিতে লাগিয়ে দিলেই হয়। যাদের সেই সুযোগ আছে, ব্যবহার করুন। নাহলে কয়েক বছর পর চড়াইদের দিন থাকবে, চড়াই থাকবে না। সব পাখিদের নিয়ে এক একটা দিন সেলিব্রেট করা হবে, কিন্তু সে পাখি আর দেখতে পাওয়া যাবে না। এই বছরের কুড়ি মার্চ থেকেই কিছু কাজ করা শুরু হোক।