বৃহস্পতিবার, ২২ মে, ২০২৫

রোজনামচা

 


রান্না আর খাওয়া করতে করতেই অর্ধেক দিন কেটে যায়। রোজ রোজ আর কে করছে? থোড় বড়ি খাড়া খেয়েই চলছে।
চিঁড়ে দই, ওটস আর সবজি সিদ্ধের ছবি তো কেউ তোলে না, এইসব দেখতে ভালো লাগছিল বলে তুলে রাখা হয়েছিল।
এমন শ পাঁচেক ছবি আছে। গত দশ বছরে কী কী খেয়ে বেঁচে আছি, গুগল ফটোতে গেলেই দেখা যায়। মন্দ লাগে না। বেশ একটা নস্টালজিয়া হয়। এই একটা কাজ, রান্না; আমি একেবারে নিজে নিজে শিখেছি। আর খুব একটা মন্দ রাঁধি বলে মনে হয় না। অন্তত খেয়ে নেওয়া যায়। দরকার পড়লে স্পেশাল পদও রেঁধে দেব ইউটিউব দেখে, সেই বিশ্বাস জন্মে গেছে পনেরো বছরে।











বুধবার, ২১ মে, ২০২৫

লিন্ডবার্গ! তুমি আমাদের হিরো

 


আকাশ তখন কালো হয়ে আসছে। সন্ধ্যে নেমে গেছে। রুজভেল্ট ফিল্ডের বিমানবন্দরে একটি ছোট্ট সিঙ্গল-ইঞ্জিন বিমান দাঁড়িয়ে আছে, নাম 'স্পিরিট অফ সেন্ট লুইস'। সেই বিমানের পাশে একজন তরুণ পায়লট দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে কিছুটা ক্লান্তি লেগে আছে, সবাই দেখে বুঝতেও পারছে সেটা। কিন্তু তার অদম্য সাহস সম্পর্কে লোকজনের বিশেষ ধারণা নেই। আজকের দিনে, ৯৮ বছর আগে একজন ২৫ বছরের তরুণ ইতিহাস রচনা করেছিল।

১৯২৭ সালের ২০ মে, শুক্রবার। চার্লস লিন্ডবার্গ মাসের পর মাস ধরে এই মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাঁর সামনে এক অসম্ভব চ্যালেঞ্জ-- সম্পূর্ণ একা, বিরতিহীন ভাবে অ্যাটলান্টিক মহাসাগর পার করে নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসে যাওয়া। তখনও এরকম কোনও নজির ছিল না। কেউ এই অসম্ভব কাজ করতে এগিয়ে আসেনি। দু একজন চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু তাদের যাত্রা শেষ হয়েছিল অ্যাটলান্টিকের অতল জলে।

সকালে বৃষ্টি হয়েছে বেশ। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন যে ওয়েদার কন্ডিশনও ভালো নয়। বিমান ওড়ানোর জন্য তখনও আজও সবচেয়ে বড় বিপদ তাই, যা সেই যুগে ছিল। ঝোড়ো বাতাস নয়, বৃষ্টি নয়, বজ্রপাত বা পাখির ঝাঁক নয়, সেই বিপদের নাম কুয়াশা। হ্যাঁ, ঘন কুয়াশায় সেদিন ছেয়ে গিয়েছিল অ্যাটলান্টিক মহাসাগর, সেই কুয়াশা আরো বাড়বে বলে আবহাওয়াবিদরা বলছিলেন। কিন্তু লিন্ডবার্গ আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। প্রথম ব্যক্তি যিনি নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসে অবিরাম ৩,৬০০ মাইল উড়ে যাবেন তার জন্য ২৫,০০০ ডলার পুরস্কার বরাদ্দ আছে। বেশিদিন হলে এত পায়লট চলে আসবে যে একটা অভিযান অবশেষে মানি মেকিং রেসে পরিণত হবে। লিন্ডবার্গ সেটা চান না। তিনি সাফল্য চান ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি চান এই যাত্রার রোমাঞ্চতা অনুভব করতে, যে রোমাঞ্চ তাঁর আগে কেউ অনুভব করতে পারেনি।

লিন্ডবার্গ মনে মনে নিজেকে বললেন, "সময় হয়েছে বাছা। এইবার হয় বাঁচবি, নয় মরবি। কিন্তু যাই হোক না কেন, না লড়ে মরিস না বুঝলি।"

শেষবারের মতো তাঁর বিমানের চারপাশে হেঁটে প্রতিটি যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করলেন তিনি । 'স্পিরিট অফ সেন্ট লুইস' দেখতে সাধারণ ---আগে তাঁর নাম ছিল Ryan NYP, কাস্টম বিল্ট, মোনোপ্লেন, একজন বসতে পারে, ইঞ্জিনও একটা। রেকর্ড করার জন্য খুব কাজের বিমান নয়। কিন্তু লিন্ডবার্গ বিশেষ নকশা তৈরি করে তাঁর যাত্রাপথটিকে বিশ্লেষণ করেছেন। বারবার করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, এই প্লেনই সবচেয়ে বেস্ট। হালকা, জ্বালানিও কম লাগে, নেভিগেট করতে পারলে অনায়াসে এই বিমান ৩,৬০০ মাইল যেতে পারে।

পায়লট কেবিনটা ছোট, একমাত্র সামনের দিকে একটি ছোট্ট জানালা। লিন্ডবার্গ ঠিক করেছিলেন অতিরিক্ত জ্বালানির জন্য বাড়তি জায়গা রাখতে হবে, সকলে সাধাসাধি করার পরও ইমারজেন্সি কো-পায়লট নিতে রাজি হয়নি। আয়োজকদেরও ফিরিয়ে দিয়েছেন। আশ্চর্য কথা হল, তাঁর সঙ্গে কোনও রেডিওও ছিল না, সেক্সটেন্ট ছিল না, এমনকি একটি ম্যারিন কম্পাসও ছিল না-- কেবল সাধারণ যন্ত্রপাতি আর তাঁর ইন্সটিংক্ট। এতটুকুই সম্বল।

সন্ধ্যা ৭:৫২ মিনিটে লিন্ডবার্গ তাঁর চামড়ার জ্যাকেট পরলেন, মাথায় একটি ক্যাপ লাগালেন, তারপর ফ্লায়িং কেবিনে উঠে পড়লেন। উপস্থিত ভিড় তাকে উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে বিদায় জানাল। ট্যাক্সিওয়েতে যাওয়ার আগেই বিমানের চাকা কাদায় আটকে গিয়েছিল, বোঝো! তারপর 'স্পিরিট অফ সেন্ট লুইস'-এ এত জ্বালানি ভরা হয়েছে যে ওজন বেশি হয়ে গেছে। অনেকে বাজি রেখেছিল প্লেন আজ মাটিই ছাড়বে না। এক মাইল লম্বা রানওয়েতে বিমানটি বারবার ঝাঁকুনি খেতে খেতে দুলতে দুলতে এগোচ্ছিল। ভিড় তখন নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে।

শেষ মুহূর্তে, যখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে, 'স্পিরিট অব সেন্ট লুইস' একদম সাঁই করে মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে গেল, আর কয়েক ফুট এগোলেই প্লেনটা সোজা গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেত। লিন্ডবার্গ কোনোরকমে প্লেনটা সমুদ্রের ওপর নিয়ে গেলেন। এরপর আসল সফর শুরু হল।
লং আইল্যান্ড ছেড়ে, তিনি উত্তর-পূর্ব দিকে উড়ে চললেন, নিউ ইংল্যান্ড উপকূল ধরে, কেপ কড পার করে, ফিশিং জাহাজগুলো পিছনে রেখে নোভা স্কটিয়া পর্যন্ত ঠিকঠাক রুটে উড়ে গেল প্লেনটা। সূর্য ডুবে যাযে একটু পরেই। লিন্ডবার্গও জানতেন যে সামনে শুধু অন্ধকার, এবং অ্যাটলান্টিক মহাসাগর। অনন্ত জলরাশি, যেখানে বহু দুরন্ত পায়লটের সলিল সমাধি হয়েছে।

রাতের দ্বিতীয় প্রহর পেরোলে প্রথম সমস্যা দেখা দিল। লিন্ডবার্গ লক্ষ করলেন যে তাঁর বিমানের উপরে বরফ জমা হচ্ছে, ইঞ্জিনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে স্নোফ্লেক্স। ফলে তাকে আরও নিচে দিয়ে উড়তে হবে। কিন্তু সে আরও ঝুঁকির কাজ। প্রায় সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া, বাতাস আরো বেশি গরম থাকে বলে স্নোফ্লেক্স জমবে না ঠিকই কিন্তু ঝড় উঠলে আর দেখতে হবে না। বিপজ্জনক হলেও আর কোনও পথ খোলা ছিল না, ফলে সেই সিদ্ধান্ত নিতেই হল। আর পড়বি তো পড় সেই বাঘের মুখেই পড়তে হল, কারণ একটু পরেই সমুদ্রের ওপর ভীষণ ঝড় শুরু হল। লিন্ডবার্গ দাঁতে দাঁত চেপে নেভিগেশন সামলাতে লাগলেন। সামনে বিপদ, কিন্তু রোমাঞ্চের এই মুহূর্তগুলো তাকে যে 'কিক' দিচ্ছে, সেটাও তো মিথ্যে নয়। রোমাঞ্চ লিখলে সবাই অ্যাড্রেনালিন রাশের কথাই ভাবে, কিন্তু ঝুঁকি আর রোমাঞ্চে আসলে মানুষের মনোনিবেশ বাড়ায়, তাকে শান্ত করে, পরিণত করে, স্থিতিশীল করে। লিন্ডবার্গও এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছিলেন।

ওদিকে, স্নো ফ্লেক্সের চেয়েও বড় সমস্যা আছে, সেটা হল ঘুম। লিন্ডবার্গ আগের রাতে ঘুমাতে পারেনি উত্তেজনায়, নাগাড়ে তিরিশ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জেগে আছেন তিনি। শুনলে মনে হয়, এ আর এমন কি, একদিনের ব্যাপার, জোর করে জেগে থাকলেই হল। কিন্তু এরকম হাই স্ট্রেস মোমেন্টে মানুষের ইন্দ্রিয় মর্জিমতো কাজ করে না। ক্লান্তির সীমা অতিক্রম করে গেলে আমি মানুষকে পাহাড়ে চড়ার সময়েও ঘুমিয়ে পড়তে দেখেছি। লিন্ডবার্গও লড়াই করছিলেন চোখ খোলা রাখতে। কখনও কখনও তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তারপর আবার জেগে উঠছেন, প্লেনের রুট ঠিক করে নিচ্ছেন। একবার তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে গাছের উপর দিয়ে উড়ছেন। অ্যাটলান্টিকের মাঝখানে গাছ আসবে কী করে? কিন্তু ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেলে মানুষ মরুভূমি কেন, প্লেনেও মরীচিকা দেখে।

ঘুমের সঙ্গে লড়াই করতে করতে, লিন্ডবার্গ নিজেকে কল্পনার জগতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি নিজের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন, তারপর গান গাইলেন, সব শেষ হলে মেঘের ছায়াগুলোকে কল্পনার প্রাণীতে পরিণত করে ছড়া বাঁধলেন। সময় কাটাতে হবে, আর ঘুমালেও চলবে না। আর একা থাকার ভাবনাটা মাথায় ভর করলে আরো বিপদ। সময়ে সময়ে তিনি বিমানের জানালা খুলছিলেন যাতে ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে লাগুক, যাতে তিনি জেগে থাকতে পারেন।

একসময় ভোরের আলো ফুটল। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। সূর্য উঠছে, আকাশ রক্তিম হয়ে উঠছে লিন্ডবার্গের মনোযোগ পুনরুজ্জীবিত হল। তিনি এইবার একটি জাহাজ দেখতে পেলেন, অ্যাটলান্টিকের ওপর দিয়ে চলেছে! মানবসভ্যতার এই চিহ্ন দেখে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। বিমানটাকে নামিয়ে আনলেন অনেক নিচে, জাহাজের কাছাকাছি উড়তে উড়তে জিজ্ঞাসা করলেন "এটা কোথাকার জাহাজ?" জাহাজের চালক দল অবশ্য তাঁর কথা বুঝতে পারল না।

আয়ারল্যান্ডের উপকূল দেখা দিল যখন লিন্ডবার্গ ২২ ঘণ্টা ধরে উড়ে চলেছিলেন। তিনি ঠিক পথেই ছিলেন! অবশেষে, ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্স দেখতে পেলেন তিনি। সেকালে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর-- আলোর শহর প্যারিস, দেখেই মনের ভিতরেও একটা আলো জ্বলে ওঠে।

সন্ধ্যা ১০:২১ মিনিটে, ২১ মে, ১৯২৭ তারিখে, ৩৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট উড়ানের পর, চার্লস লিন্ডবার্গ Le Bourget Aerodrome-এর ট্যাক্সিওয়েতে ল্যান্ড করেন। তিনি ভেবেছিলেন এইবার একটা দোকানে গিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া করতে হবে, তারপর ঘুমাবেন। কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি। লক্ষাধিক ফরাসি তাঁর বিমানকে ঘিরে রেখেছিল, চিৎকার করে বলছিল, "লিন্ডবার্গ! লিন্ডবার্গ! তুমি আমাদের হিরো। তুমি পেরেছ, আমরাও পারব।"

সেই উন্মাদনার বহর এমন ছিল যে লোকজন তাঁর বিমানে উঠে ছোট ছোট অংশ ভেঙে নিয়ে যাচ্ছিল স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে। সৈন্যরা খুব কষ্টে তাঁকে ঢেকেঢুকে একটা হ্যাঙ্গারে নিয়ে গেল। ফরাসি পায়লটরা তাঁকে কাঁধে নিয়ে ঘোরাতে শুরু করল এরপর। লিন্ডবার্গ ৩৩ ঘণ্টা ধরে একাকী উড়ে আসার পর সহসা দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষে পরিণত হলেন। অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন তিনি। একজন সাধারণ মেল পায়লট, ৩৩ ঘণ্টা ধরে একা উড়ে যে বাধা অতিক্রম করেছে, সেটা একটা রেকর্ড ভাঙার জন্য নয়। এই ঘটনাটা গোটা এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিকে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। ইতিহাসের সেই মুহূর্তে, মানুষের মনে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। লিন্ডবার্গের এই যাত্রা আধুনিক বিমান চলাচলের যুগের সূচনা করেছিল, এবং প্রমাণ করেছিল যে অ্যাটলান্টিক পাড়ি দেওয়া কেবল সম্ভবই নয়, বরং বাণিজ্যিকভাবেও বাস্তব। ৩,৬০০ মাইল, ৩৩.৫ ঘণ্টা, এবং একটি তরুণ পায়লটের অদম্য সাহস… দুনিয়া বদলাতে এইটুকুও কম নয়।

কাল, সেই ঘটনার আটানব্বই বছর পর একটা বিশেষ বই প্রকাশিত হল। সেই বইয়ের একটা ছবি। ঘটনাটা বিশদে পড়তে হলে লিন্ডবার্গের আত্মজীবনী তো আছেই।

শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

দ্য ডাইং ডে

 


মালাবার হাউজ সিরিজের দ্বিতীয় বই।

১৯৫০ সালের বোম্বে। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে দান্তের ডিভাইন কমেডির একটা মূল্যবান কপি চুরি হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি উধাও হয়ে গিয়েছেন জন হিলি বলে একজন ভদ্রলোকও, যিনি পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে গবেষণা আর নতুন অনুবাদের কাজ করছিলেন। হিলি আবার যাওয়ার আগে কিছু সংকেত রেখে গিয়েছেন, সে সব এক একটা জটিল ধাঁধা।

প্রথম কেসের পর ইন্সপেক্টর ওয়াডিয়া সবে একটু শান্তির নিশ্বাস ফেলেছেন, ততোক্ষণে নতুন কেস হাজির। ভারতের প্রথম মহিলা অফিসার হওয়ার দরুণ তাকে রোজ নতুন নতুন ঝামেলা পোয়াতে হচ্ছে। একদিকে লোকজন তাকে বরখাস্ত করতে বলছে, খিল্লি করছে, ট্যারা চোখে তাকাচ্ছে, অন্যদিকে একদল লোক তাকে সেলিব্রেট করছে, ভাষণ দিতে ডাকছে, সম্মান দিচ্ছে। আমাদের নায়িকার মাথা খারাপ। সে শুধু মন দিয়ে ইনভেস্টিগেশন করতে চায়, কিন্তু ইনভেস্টিগেশন করা কি অতই সহজ? এমন সময় আবার রেললাইনে একজন বিদেশি মেয়ের দেহ পাওয়া যায়, পোস্টমর্টেম করে জানা যায় তাকে সম্ভবত খুন করা হয়েছে। দুটো কেস নিয়ে তদন্ত চলতে থাকে।

ধীরে ধীরে বোঝা যায়, আসলে দুটো কেসই একসূত্রে জোড়া। জন হিলি বিশ্বযুদ্ধের সময় এক ইতালিয়ান ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন, তিনি সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। কিন্তু কিছু আছে, যা তাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছিল না। কেসের পিছনে ধাওয়া করে ইন্সপেক্টর ওয়াডিয়া আর ব্রিটিশ ক্রিমিনলোজিস্ট আর্চি ব্ল্যাকফিঞ্চ এমন এক রহস্যের সামনে এসে পড়েন, যেখানে হিটলারের এসএস থেকে মুসোলিনির সিক্রেট পুলিশ আছে, দান্তের সাহিত্য আছে, ফ্রিম্যাসনস আছে, ক্রিশ্চিয়ান ফিলোসফি আছে, আর আছে পদে পদে বিপদের আশংকা।

ওয়াসিম খান পিরিওডিকাল প্রসিডেরাল জিনিসটা বোঝেন। প্রায় সাড়ে তিনশো পৌনে চারশো পাতার বই, একের পর এক নতুন ইনফরমেশন, কিন্তু কখনওই ইনফোডাম্প মনে হয় না, একঘেয়েমিও আসে না। প্রত্যেকটা চরিত্রে ব্যাকস্টোরি বুনে তার দ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনের কারণগুলো জাস্টিফাই করতে পারেন বলেই হয়তো চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়। এছাড়া ১৯৫০ সালের বোম্বের স্থাপত্য, ইতিহাস, সিটি কালচার আর রাজনীতির পাসিং রেফারেন্স তো আছেই।

সব মিলিয়ে এই সিরিজটা আমার বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। তৃতীয় বইটাও শুরু করে ফেলেছি দোনামনা করে, ফেলে রাখতে ইচ্ছে করছিল না। উইকেন্ড কাটানোর জন্য পারফেক্ট বই।

দ্য ডাইং ডে
Hodder & Stoughton
Kindle edition 589/- 

শনিবার, ১০ মে, ২০২৫

অদ্ভুত ছবি না অদ্ভুত বই

 


উকেতসু জাপানি ইউটিউবার। হরার মিস্ট্রি ঘরানার বই লিখে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কিন্তু তিনি কে কেউ জানে না। ইউটিউব ভিডিওতেও তাঁর মুখে মুখোশ থাকে, গলার স্বর থাকে কার্টুন ক্যারেক্টরদের মতো।

সেই লোক এমন জবরদস্ত বই লিখবেন আইডিয়া ছিল না। পিওর রহস্য। নো ফালতু কথা। চারটে গল্প। প্রতিটাতেই রহস্যের সূত্র লুকিয়ে আছে হাতে আঁকা ড্রয়িংয়ে। একজন প্রেগন্যান্ট মহিলা পাঁচটা ছবি এঁকে মারা গেছেন, একটা বাচ্চা ছেলে বাড়ির ছবি এঁকে হারিয়ে গেছে, খুন হওয়ার আগে পাহাড়ের ছবি এঁকে গেছেন এক শিক্ষক। সেই ছবি নিয়ে তদন্ত। ভয়ানক গতিতে বই এগোয়। ছবির খুঁটিনাটি বিচার করে শিল্পীর সাইকো অ্যানালাইসিস করা হয়। একসময় বোঝা যায়, সবগুলো গল্পই ইন্টারকানেক্টেড। আস্তে আস্তে এমন এক ভয়ংকর রহস্য উন্মোচিত হয়, যা কেউ কল্পনাও করেনি।

পারফেক্ট উইকেন্ড রিড। ২৪০ পাতার বই। আমি এক সিটিংয়ে পড়েছি। মিস না করাই ভালো।

Harpervia
Kindle edition 499/

বাংলার লুপ্তপ্রায় কেবিন সংস্কৃতি

 


৯ঋকাল বুকস পরপর মচৎকার সব বিষয় নিয়ে কাজ করছে। দু একটা কেনা হয়, আবার কিছু কিছু আনালেও পড়া হয় না, বা পড়তে পড়তে বছর ফুরিয়ে আসে। যাই হোক, এই বছরের দু একটা টার্গেটেড বইয়ের মধ্যে এটা অন্যতম ছিল, অনেকেই প্রচ্ছদ দেখে আগ্রহী হয়েছিলেন যতদূর মনে পড়ছে। তারপর খুব বেশি পোস্ট ফোস্ট দেখিনি, তাই একটা ছোটকু পোস্ট। বড় পোস্ট দিয়েও লাভ নেই। আজকাল বাজারে এসব চলছে না। ফেসবুক হয়তো ভ্যানিশই করে দিল, যেমন করে অর্ধেক কেবিন রেস্তোরাঁ ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে...

যাই হোক, গ্রন্থভাবনা থেকে স্ট্রাকচারিং, সব বিষয়েই যথারীতি লিরিকালিয় যত্নের ছাপ বিদ্যমান। সে অবশ্য প্রকাশনার সব বইতেই থাকে, আলাদা করে বলার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

এখানে ঘটনা হল, লেখক তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে, সংকলনটা বানাতে কতটা খাটাখাটুনি করতে হয়েছে। খুঁজে খুঁজে এক একটা লেখা সংগ্রহ করা অত সহজ লয়!

কে নেই? অরণি বসু থেকে দামু মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় থেকে সুনেত্রা সাধু, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে যশোধরা রায়চৌধুরী...আছেন রঞ্জন রায়, সুনীল কুমার পাল, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত প্রভৃতি। তাবড় সাহিত্যিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এমন লেখকও আছেন, যিনি এই প্রথম একটা লেখা ছাপালেন।

বইটি ভাগ করা হয়েছে এই পাঁচটি বিভাগে।


এক কেবিনের মধ্যে আরেকটা কেবিন

কিসসা কেবিন কা

কলকাতার কেবিন কড়চা

জেলায় জেলায় দুজনে কূজনে

হারিয়ে যাওয়া কেবিনের দিন

চেনা অচেনা কেবিননামা


প্রতিটা বিভাগেই চার পাঁচটা করে লেখা আছে। এছাড়া অতিরিক্ত সংয়োজন, টীকা ইত্যাদি অতিরিক্ত বিভাগও আছেই, যেমন থাকে। লেখায় যে সমস্ত কেবিনের উল্লেখ আছে, সেই কেবিনের ঠিকানা আর বর্তমানে বন্ধ আছে না খোলা আছে সেসবও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রসনাপ্রেমিকদের কথা ভেবে।

সংকলনের কিছু কিছু লেখা স্বাভাবিকভাবেই পরে খুঁজে যোগ করা হয়েছে, তাতে অতীতের রোমান্স আর নস্টালজিয়া থাকলেও 'কেবিন' সেই অর্থে নেই, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। কেবিন নিয়ে এক্সক্লুসিভ লেখা হলেও অনেকেই হয়তো বসন্ত কেবিন/দিলকুশা/সাঙ্গুভ্যালি ইত্যাদি জায়গার কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এই পুনরাবৃত্তি শুধু নামেই, কারণ সকলের চোখ আর মন নিজের, সেই জায়গাটা সম্পর্কে স্মৃতি আর আবেগ প্রত্যেকের আলাদা।

এমনিতেও এই সংলকনে, কেবিন নিয়ে লেখা মানে শুধু কেবিন চরিত নয়, পাশাপাশি কলকাতা ও বাংলার ইতিহাসের নানান খুঁটিনাটি উঠে এসেছে। সমাজ, পরিবার, মূল্যবোধ, সাহিত্য, রাজনীতি, রন্ধনশিল্প, সংস্কৃতি, সিনেমার কথা সাবলীলভাবে জড়িয়ে গেছে আলেখের সঙ্গে। কোন কেবিন রেস্তোরাঁয় কোন সাহিত্যিক আসতেন, কোন অভিনেতা কেবিন রেস্তোরাঁ থেকে মোগলাই প্যাক করে নিয়ে যেতেন... এসব যেমন আছে, ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশও ঘটেছে ইতিউতি।

গৌতম বসু মল্লিকের কলমে 'আড্ডা, প্রেম ও কেবিনকথা' ওপেনিং কলম হিসেবে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য, তথ্যবহুল লেখা। কিন্তু আমার মন ছুঁয়ে গেছে দেবদত্ত গুপ্তের 'চপলেট কাটলেট রমাকান্তর কেবিন'। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে অনেকে হাহুতাশ করেছেন সে যুগে কেবিন রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রেম করা হল না বলে, অনেকে আবার কেবিনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া স্টুডেন্ট লাইফের নোলার কাহিনিই লিখেছেন ঘি গরমমশলা দিয়ে। কেউ কেউ বদলে যাওয়া সমাজ নিয়ে কমেন্ট্রি করেছেন, কেউ আবার অনুসন্ধান করেছেন স্পেসিফিক কেবিন রেস্তোরাঁর রসুই রহস্য।

এত এত কেবিন সর্বস্ব লেখাতেও দামুবাবু যথারীতি নিজস্বতা বজায় রেখে আউট অফ দ্য স্টেডিয়াম ছয় আঁকড়েছেন। যাঁরা রহস্য গল্প লিখবেন বলে হাত পাকাচ্ছেন, অ্যাটমস্ফিয়ার ক্রিয়েট করার বিদ্যাটা তাঁর লেখা পড়ে আয়ত্ত করে ফেলুন। 'পাহাড়ের কেবিনগাথা' অমনভাবে আর কেউই লিখতে পারত না। কুমারপ্রসাদের লেখায় আলিসাহেবের একাধিক ঘটনা পড়ে যারাপরনাই প্রীত হলাম। দারুণ লেগেছে সুনেত্রা সাধুর 'আড়াল আর আগুন স্মৃতি'।

সব নিয়ে ফাটাফাটি সংকলন। যাঁরা জীবনে ডেটিং সাইট বা কেবিন লাইট কিছুই পাননি আমার মতো, বই পড়েই পাপখণ্ডন করুন।

বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০২৫

ফ্যামিলি স্টাইল: স্টাইল সে জিনে কা

 


চমৎকার একখানা গ্রাফিক নভেল। 'আমেরিকান বর্ন চাইনিজ' বা এশিয়ান ইমিগ্রেন্টদের গল্প ভালোবাসলে বলাই যায়, 'ফ্যামিলি স্টাইল'-ও সম্ভবত আপনার মন কাড়বে।
একটা ইমিগ্রেন্ট ফ্যামিলিকে ওয়ার জোন থেকে পালিয়ে নতুন দেশে (বিশেষ করে যদি দেশটা আমেরিকা হয়) এসে থিতু হতে গেলে যে সমস্ত বাধাবিপত্তির সামনে পড়তে হয়, দাঁতে দাঁত চিপে ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে যে সব স্বার্থত্যাগ করতে হয়, তার সব কিছুই এখানে আছে, কিন্তু তাই বলে বইটা কখনওই ন্যাকা প্যানপ্যানে বা ক্লিশে হয়ে ওঠেনি। লেখায় যত্ন আর আবেগ, দুইই সমান পরিমাণে আছে। আঁকাও দিব্যি। যাকে বলে কমপ্লিট প্যাকেজ! ঝকঝকে পাতা। দগদগে অতীত। ফুরফুরে হিউমার। কুড়মুড়ে সংলাপ। কামিং অফ এজ ড্রামা, গ্রেট আমেরিকান ড্রিম... কিছুরই অভাব নেই।
সাধেই কি আর আইসনার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে?
কিন্তু, এসব ছাড়াও যে কারণে বইটা আমার কাছে আলাদা করে কিছুটা স্পেশাল হয়ে উঠল, তা হল এই স্মৃতিকথায় খাদ্য সংস্কৃতির এক বিশেষ ভূমিকা আছে। এক ভিয়েতনামিজ ইমিগ্রেন্ট ফ্যামিলি, যে দুই পুঁচকেকে নিয়ে নৌকায় করে থাইল্যান্ডে এসে ইউএস রিফিউজি ক্যাম্পে উঠেছে আর মাসের পর মাস কোনোক্রমে দিন কাটিয়ে আমেরিকায় থিতু হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তাদের জীবনে খাবারের ভূমিকা এমন কি জোরদার? সারভাইভ করে গেলেই তো হল!
কিন্তু জীবন অত সহজ পথে চলে না। হাফপ্যান্ট পরা পুঁচকে ছেলেটা যখন জলে ভিজে হাফ সাঁতরে, হাফ ঠেলা খেয়ে, সমুদ্রের জল গিলে রিফিউজি ক্যাম্পে এসে পৌঁছচ্ছে আর প্রথম তরমুজ আর ফারমেন্টেড ফিশ মুখে তুলছে, তার কাছে তরমুজের মিষ্টি আর মাছের টকটাই জীবনের একমাত্র স্বাদ হয়ে ধরা পড়ছে। সেটাই তখন তার একমাত্র স্মৃতি, ছোটবেলার প্রথম স্মৃতি। তখন সে জানেও না তিরিশ বছর পর এই কাহিনি সে আঁকতে শুরু করবে, কিন্তু তার অজান্তেই এই খাবারগুলো চিরদিন তার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থেকে গিয়েছে। অনেক কিছু হয়তো আস্তে আস্তে আবছা হয়ে গেছে, কিন্তু এক একটা রেসিপি, এক একটা পদ, এক একটা খাদ্যভাস তার মাথায় রয়ে গেছে। নৌকায় মায়ের হাত থেকে নিয়ে রাইসবল খাওয়া, পেট চালানোর জন্য রিফিউজি ক্যাম্পে সবাই মিলে ভিয়েতনামিজ খাবারের দোকান দেওয়া, আমেরিকার সান জোসে গিয়ে প্রথম স্টেক খাওয়া, স্কুলে ফ্রি লাঞ্চে পাওয়া আপেল আর সালিসবারি স্টেক, বড় হয়ে আমেরিকান ফাস্ট ফুডের অ্যাডিকশন আর বার্গারের নেশায় মায়ের সযত্নে রাঁধা খাবার ময়লার বাক্সে ফেলে দেওয়া... প্রতিটা চ্যাপ্টারই একটা খাবারকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে।
আরেকটা জিনিস যা খুব পছন্দ হল, তা হল বইয়ের শেষে এক একটা পাতায় বইসংক্রান্ত ছোট ছোট কমিক আঁকা। যেমন, এই বইটা আমি কী করে আঁকলাম? বাবা মা বইটা পড়ে কী বলল? ওই দুষ্টু ছেলেটার সঙ্গে এখনও দেখা হয় কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। মজার ছলেই লেখা, কিন্তু জেনুইন।
সব নিয়ে চমৎকার কাজ। সোজাসাপটা। ইমোশনাল। হিউমারাস। ব্যালেন্সড। ফিলগুড তো বটেই। পড়লে আশা করি মন্দ লাগবে না।
First Second
Kindle edition 797/-

বুধবার, ৭ মে, ২০২৫

মাই টেন্ডর ম্যাটাডোর

 


চিলিতে 'মাই টেন্ডর ম্যাটাডোর' বইটির একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। আধুনিক যুগের কুইয়ার ক্লাসিক তো বটেই, পেদ্রো লেমেবেলের এই উপন্যাস ১৯৮৭ সালের যে সময়টা তুলে ধরেছে, যখন চিলিতে বুগিউগি চলছে। ইউনিভার্সিটি চত্বরে ছাত্ররা একাধিক রেবেল গ্রুপ বানিয়ে প্রটস্ট করছে, কমিউনিস্ট গেরিলাবাহিনী পিনোচেকে খুন করে 'ডেমোক্রেসি' আনবে বলে হুঙ্কার দিচ্ছে, ওদিকে সরকার একের পর এক নতুন আইন বানাচ্ছে আর স্টেট স্পন্সর্ড মিডিয়া দেশের সাধারণ মানুষের ব্রেনওয়াশ করে ফেলেছে প্রায়। এমন সময় এই উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়। মূল স্প্যানিশে উপন্যাসের নাম হল Tengo miedo, torero যা আসলে সারা মন্টিয়েলের একটা বিখ্যাত গানের লাইন। এখন এই লাইনের সঙ্গে নানান ইমোশনাল অ্যাস্পেক্ট, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আর নস্টালজিয়ার গল্প জড়িয়ে আছে, সে বলাই বাহুল্য। হিস্প্যানিক সাহিত্যে জনপ্রিয় প্রবাদ বা গানের কথা ব্যবহার করে উপন্যাসের নাম রাখা খুব কমন ব্যাপার, কিন্তু সে নিয়ে আপাতত আর কথা খরচ করলাম না।

আসল কথা হল, পেদ্রো লেমেবেলের এই উপন্যাস ২০০১ সালে প্রকাশিত, এই নিয়ে আগেও অনেক সিনেমা নাটক হয়েছে, এখনও হচ্ছে। নতুন যুগে পাঠকদের আগ্রহ দেখে পুশকিন প্রেস বইটা নতুন করে প্রকাশিত করেছে ২০২৫ সালে। বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে, শেষ করতে বেশ সময়ই লাগল। কেন?

কারণ, উপন্যাসটা ঠিক গতানুগতিক উপন্যাসের মতো লেখা হয়নি। চ্যাপ্টার ফ্যাপ্টারের বালাই নেই। মূল চরিত্র কুইন অফ দ্য কর্নার বলে একজন 'ট্রাভেস্টি' বা মাঝবয়সী সমকামী, তাঁকে মাঝেমধ্যে হি, আবার মাঝেমধ্যে সি লেখা হয়েছে। লাতিন আমেরিকায় ট্রাভেস্টি মানে সম্ভবত পুরুষ যিনি মহিলাদের মতো ক্রস ড্রেস করেন, কিন্তু চরিত্রটির মনের ভাব বা সিদ্ধান্তগুলো বুঝতে আমার বেশ সময় লেগেছে।

এখন এই কুইন একজন তরুণ ছাত্রের প্রেমে পড়েছেন, সেই ছাত্রটির নাম কার্লোস। সে কুইনের বাড়িতে নানান সন্দেহজনক জিনিসপত্র রেখে যাচ্ছে, অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে এসে গোপনীয় আলোচনা করছে, কিন্তু কুইনকে কিছু জানাচ্ছে না। আর প্রেমে অন্ধ হয়ে কুইনও জিজ্ঞেস করছেন না। আমি দিব্যি বুঝতে পারছি, কার্লোস প্যাট্রিওটিক ফ্রন্টের গেরিলাবাহিনীর সৈনিক, সে আসলে অস্ত্রশস্ত্র গোপনে রাখার জন্য কুইনের বাড়িটা ব্যবহার করছে। কিন্তু কুইন বুঝছেন না কেন? না তিনি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না? এটা কি ও-ই 'একতরফা পেয়ার' এর পাগলামি? কার্লোসের মনে কি তাঁর জন্য কোনও ইমোশন আছে, নাকি সবটাই তাঁর ভালো ব্যবহার শুধুই তার কাজ বের করার ফন্দি? এইসব ঝামেলা না হয় হল, কিন্তু এরমধ্যে খোদ পিনোচে আর তাঁর স্ত্রী লুসিয়াও এসে পড়েছেন। পিনোচের স্বৈরাচারী শাসনের সিদ্ধান্ত, ডিপ্লোম্যাসি, এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার চলছে, আবার তাঁদের পারিবারিক জীবনের ঝামেলাও এসে পড়ছে।

এখন বইটায় না অধ্যায় আছে, না ঘটনার ভাগাভাগি আছে, না ডাবল কোট ইত্যাদির ব্যবহার আছে। সংলাপগুলো সব ন্যারেটিভে চলে এসেছে আর চারটে বাক্যের মতো। কুইনের সঙ্গে কার্লোসের কথা চলতে চলতেই লুসিয়া আর পিনোচের কথা শুরু হয়ে যাচ্ছে, কুইনের বেদনাদায়ক অতীতের সঙ্গে ঢুকে পড়ছে লুসিয়ার অতীত। আর তার সঙ্গে চলছে চিলিতে চলতে থাকা অভ্যুত্থানের লড়াই। ছাত্ররা প্রটেস্ট করছে, সেনাবাহিনী কার্ফিউ জারি করে লোকজনের ঘরেঢুকে পড়ছে, গেরিলাবাহিনী আক্রমণ করছে, ওদিকে কুইন অফ দ্য কর্নার তাঁর ওয়ানসাইডে লাভ লাইফ নিয়ে উৎকণ্ঠায় মরে যাচ্ছেন, নিজের বিপদ ডেকে এনে কার্লোসদের সাহায্য করছেন। এই কাহিনির চলন ধরতেই আমার অনেকটা সময় লেগে গেল।

আসল কথা হল, পেদ্রো নিজে সমকামী আর চল্লিশ বছর আগে সান্তিয়াগোর একজন সমকামী মানুষ, যে রেডিও আর সেলাইবোনাই নিয়েই বেঁচে আছে, সে প্রেমকে কীভাবে এক্সপ্রেস করবে, আমরা প্রথমে তা বুঝতে পারি না। তাঁর এক্সপ্রেশন, তাঁর শৈলী, তাঁর কবিতা, তাঁর বিষাদ, সবই আমাদের অচেনা। তাই অনেকেই একসময় এই বইটা পড়ে বিরক্ত হয়েছিলেন, বোলান্যো নাকি বলেছিলেন, এমন corny প্রেমের উপন্যাস আমার চাই না। কিন্তু আসলে এই প্রেম কর্নি নয়, প্রাচীনপন্থী নয়, ন্যাকা নয়, সময় ও চরিত্রের নিরিখে, এইটাই বাস্তব।

“So, like a buzzing bumblebee, he came and went through the house, feathered in his stole of: Yes, Carlos. No, Carlos. Maybe, Carlos. Perhaps, Carlos. As if the repetition of the name embroidered its letters in the air, lulled by the echo of his nearness. As if the pedal of that snarling tongue insisted on naming him, calling him, licking him, savoring those syllables, chewing that name, filling itself entirely with that Carlos so deep, that name so broad, that it remained all sigh, wrapped between the C and the A of that C-arlos that illuminated the entire house with its presence.”

একবার ব্যাপারটা ধরে নেওয়ার পর আমার আর অসুবিধা হয়নি। পেদ্রো লেমেবেল আসলে নিজেই কুইন, তিনি কুইয়ার লেখক হিসেবেই বিখ্যাত, সারাজীবন ক্রসড্রেস করেছেন, মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায় গল্পটা অনেকটাই আত্মজৈবনিক, অটোফিকশন। কিন্তু তাই বলে দেশের তৎকালীন অবস্থা পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি। সান্তিয়াগোর যানবাহন থেকে স্টুডেন্ট লাইফ, সাধারণ মানুষের ভাবনাচিন্তা, রাজনৈতিক পপরিস্থিতি সবই চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন, কিন্তু এসবের ঊর্ধ্বে গিয়েও বারবার মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, এটা আসলে আদতে একটা প্রেমের গল্প। এখন সেই প্রেম কতজন বুঝছে বা কতজন বুঝছে না, সেটা ভাবার দায় তাঁর নয়।

ছোট বই। কিন্তু এটা ইবুক রেকামেন্ড করব না। ভাষা আর শৈলীর কারুকাজ আছে, হার্ডকপি পড়লেই সুবিধা হবে মনে হয়।

পুশকিন প্রেস

রবিবার, ৪ মে, ২০২৫

অপ্রাগৈতিহাসিক

 


কল্পবিশ্বের হাত ধরে যে প্রতিভাবান স্পেকফিক লেখকদের একটা ব্যাচ উঠে এসেছে, তাতে সোহম গুহ-এর নাম আলাদা করে বলতেই হয়। ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সোহমের কয়েকটা গল্প পড়েই আমি তাঁর ছকভাঙা লেখার ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিষয়বস্তু ও চিন্তাভাবনার দিক থেকে অভিনব তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা, সোহমের কলম যে কল্পবিজ্ঞান লেখে, তাতে 'বাঙালি পাঠক ও জিনিস বুঝবে কি না! একটু সহজ করে লিখব নাকি?' জাতীয় মেন্টাল ব্লকেজ থাকে না।

যা থাকে, তা হল এই ভাবনাটা। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে কল্পবিজ্ঞান লিখতে বসেছি যখন, এই যুগের সেরা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সঙ্গেই পাল্লা দিতে হবে, তার সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে, স্ট্রেট অ্যান্ড সিম্পল। এখন, এই অ্যাস্পিরেশন হয়তো অনেকেরই থাকে, কিন্তু সত্যি কথা হল, অ্যাস্পিরেশন থাকলেই তো হয় না, একটা বিশেষ ঘরানায় নিজের লেখাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে হলে, আন্তর্জাতিক করে তুলতে হলে, বহুস্তরীয় করে তুলতে হলে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হয়। আমি সেরা কল্পবিজ্ঞান লিখতে চাই, আবার সেরা ঐতিহাসিক গল্পও লিখব, অসামান্য সামাজিক কাহিনি লিখব, মর্মস্পর্শী স্মৃতিকথাও লিখে দেব ঝটপট... ওসব শুনতেই ভালো লাগে। বাস্তবে, জিনিয়াস বাদে অমন কেউ করতে পারে না। আমার যতদূর ধারণা, সোহম জানেন, তিনি স্রেফ কল্পবিজ্ঞান লিখবেন এবং মন দিয়ে লিখবেন। সেই দায়বদ্ধতা থেকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছেন, হোমওয়ার্ক করেছেন, করছেন, বইপত্রের পাশাপাশি আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের চলন ও দর্শন তিনি একদম গুলে খেয়েছেন। না খেয়ে থাকলে 'অপ্রাগৈতিহাসিক' এর মতো লেখা বেরোতে পারে না।

বইটা পড়েছি বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু আপাতত বইটা সঙ্গে নেই বলে বিস্তারিত আলোচনা লেখা একটু মুশকিল। কিন্তু এমন একটা উচ্চাকাঙ্খী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে যে পরিশ্রম লেগেছে, সে নিয়ে স্পেকফিক আগ্রহী পাঠক হিসেবে দু চার লাইন লিখে রাখলে অন্যায় হবে না।

প্রথমেই, অতি সংক্ষিপ্ত সামারি।

'অপ্রাগৈতিহাসিক' আসলে কী নিয়ে? প্রথমেই জেনে রাখা ভালো, টেকনিক্যালি বইটির নাম 'অপ্রাগৈতিহাসিক: প্রথম পর্ব (ঈশ্বরের বাগান)' এবং এ-ই বইটি একটা ট্রিলজির প্রথম খণ্ড। তেলেঙ্গানার বেআইনি খনিতে কয়েক কোটি বছর পুরোনো একটা ফসিলে মানুষের জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে, সেই কথা চাউর হতে একাধিক দেশের বিজ্ঞানী ও সরকার নড়েচড়ে বসেছেন। এবং সেই সূত্রে একটা অভিযানের সূচনা হয়, যা এই বইটির মূল বিষয়বস্তু। এটুকুতে আশা করি প্লটের কোনও স্পয়লার দেওয়া হল না।

বাট ওয়েট, ডিড আই সে প্লট? বাট ওয়েট, প্লট ইজ নট দ্য অনলি কি থিং হিয়ার! প্লট আছে, কিন্তু শুধুই প্লট থাকলে এই বইয়ের কথা লিখতে হত না। হুম, এখানে দু এক কথা আরো বলে রাখি! বইটা পড়ে আমার অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে যা মনে হয়েছিল সেইটুকুই, কারণ লেখক বা অন্যান্য পাঠকের পাঠ অভিজ্ঞতা বা ইন্টারপ্রিটেশন আমার চেয়ে ভিন্ন হতেই পারে।

'অপ্রাগৈতিহাসিক' ভীষণ একটা চনমনে সাস্পেন্স থ্রিলারের ভঙ্গিতে শুরু হয়েছে। একের পর এক রহস্য, অজানা তথ্য, প্রাগৈতিহাসিক থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক যুগের স্টেট অফ দ্য আর্ট টেকনোলজির তাকলাগানো তথ্য, এবং মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া জটিল সব প্রশ্ন একে অপরের সঙ্গে মিশে একটা স্পাইডারনেট তৈরি করেছে। অনেক পাঠক হয়তো ভাবছেন বইটা একদম টেকনো থ্রিলারের ভঙ্গিতে শেষ লাইন অব্দি আপনাকে এজ অফ দ্য সিটে বসিয়ে রাখবে। মারকাটারি অ্যাডভেঞ্চার হবে ক্রিকটনের বইয়ের মতো। আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু না, বইটার মাঝামাঝি গিয়ে আমার মনে হয়েছে, 'ওই বইটা' লেখক লিখতে চাননি। এখানে রোমাঞ্চকর সব ঘটনা ঘটছে পরপর, সার্ভাইভালের জন্য দাঁত চাপা লড়াই আছে, গায়ের রোম দাঁড় করানো ঘটনা আছে, অ্যাড্রেনালিন রাশ আছে, গতিও আছে, কিন্তু সেই সব ছাপিয়ে কেন এই বইটা স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে তার কারণ হল, বইটা আসলে একটা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের একটা বিশেষ দর্শনকে অবলম্বন করে এগিয়েছে, যার নাম পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম।

এখন ওপর ওপর দেখলে মনে হয় পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম এমন আর কী নতুন জিনিস? ট্রাডিশনালি একরকম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি লেখা হত, তাতে অনুমান করা হত বিজ্ঞানের অগ্রগতি হতে হতে এমন একটা সময় আসবে যখন এই সমস্ত চমৎকার জিনিস থাকবে কিংবা তার ফলে কিছু কিছু ক্রাইসিস তৈরি হবে। কিন্তু পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম এই বিশ্বাসটাকেই চ্যালেঞ্জ করে। এখন technological determinism কে চ্যালেঞ্জ করে বলা যে এআই এলে এই সমস্যা হবে বা রোবটরা বেশি শক্তিশালী হলে মানুষকে দাস হয়ে থাকতে হবে খুবই প্রাথমিক লেভেলের কল্পনা, সে নিয়ে অসংখ্য লেখা আছে। কিন্তু সমকালীন post-paradigm shift আরো অনেক বেশি জটিল প্রশ্ন তুলছে, সেখানে আসলে প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের অস্তিত্ব চেতনা আর মরালিটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা দুর্ঘটনা কীভাবে সমগ্র মানবজাতিকে একটা নৈতিক দ্বন্দের মধ্যে ফেলে দিতে পারে, সে নিয়ে চিন্তাভাবনা করাই পিসিপি ঘরানার প্রধান অস্ত্র।

সেখানে কিছুই নিশ্চিত নেই, সবই ধোঁয়াশা! যদি বিজ্ঞানের অগ্রগতির পূর্বপরিকল্পিত ভাবনাটাই মিথ্যা বলে জানা যায়? মানুষ বা মহাকাশ বা সময়ের যে প্রমাণিত কন্সেপ্ট আছে, তাই যদি বদলে যায়? সত্যি বলতে, বাস্তবেও scientific dogmatism এর দিন চলে গেছে। দিন দিন নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে, তার ফলে বহুদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণা বাতিল হয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের সমস্ত কিছুই রিভিজন করতে হচ্ছে। এর বিকল্প নেই, কারণ 'নতুন' বিজ্ঞান বলছে 'পুরোনো' বিজ্ঞান ভুল, আবার 'ভবিষ্যতের বিজ্ঞান' ও 'বর্তমানের বিজ্ঞান' কে ভুল বলবে বলে অনেকের বিশ্বাস। কে জানে? এই বাস্তবতাবোধ, এই এপিস্টেমিক হিউমিলিটির ফলে মানবজাতির সত্তা ও অস্তিত্বের ধারণাই এখন এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে কোনও কিছুর নিশ্চয়তা নেই।

পোস্ট সার্টেনিটি প্যারাডাইম শিফটে এ-র সঙ্গে ঢুকে গেছে পোস্টমর্ডানিজম আর সিউডোসায়েন্সের নানান ধারণা। নতুন প্রযুক্তির ভুল এবং ইনএফিসিয়েন্সির ফলে নানারকমের পারশেপশন তৈরি হচ্ছে। এই যেমন, যে অ্যাপে টাইপ করছিলাম, সেখানে ইংরেজি শব্দ Dogmatism টাইপ করতেই বাংলায় 'কুকুরজাতীয়' লিখে দিল, Paradigm কে প্যারাডাইম না লিখে প্যারাডিগম লিখে ফেলল, epistemic কে 'জ্ঞানমূলক' করে দিল। অটোকারেক্টের তো যা তা অবস্থা! এখন আমি ভাবছি প্রযুক্তিটা ইনএফিসিয়েন্ট, কিন্তু তবু আমরা গুগল টাইপিং আর ট্রান্সলেট ব্যবহার করছি। এখানেই একটা গোটা জাতির দ্বন্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

বেলাইনে চলে এসেছি। এ নিয়ে বিশদে বলা এখানে অসম্ভব। কিন্তু বটমলাইন হল, আধুনিক কালে এই দর্শনকে অবলম্বন করে লেখা কল্পবিজ্ঞানে মূলত সময়, ইতিহাস, প্রযুক্তি এবং মানুষের অস্তিত্বচেতনার জটিল প্রশ্নগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই বইগুলো শুধুই বিজ্ঞাননির্ভর অনুসন্ধানের গল্প বলে না, বরং মানবচেতনার দার্শনিক দিকগুলো নিয়ে একটা কাহিনি বুনে তোলে। 'অপ্রাগৈতিহাসিক' ও তার ব্যাতিক্রম নয়।

আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের যে আরেকটি বিশেষত্ব এই উপন্যাসে পুরোদমে আছে, তা হল কল্পকাহিনির মাধ্যমে বাস্তব দুনিয়ার কথা তুলে ধরে। সহজ হিসেব হল, কল্পবিজ্ঞান আসলে আগামীর গল্প নয়, সার্থক কল্পবিজ্ঞান চিরকাল বর্তমানের কাহিনি বলতে চেয়েছে। মোড়ক যা ইচ্ছে হতে পারে, রূপক যা ইচ্ছে ব্যবহার করা যেতে পারে, মহাকাশ থেকে জলের নিচে, হাজার বছর পরের দুনিয়া বা হাজার বছর আগের দুনিয়ায় কাহিনি থাকলেও, আসলে তা আজকের গল্প। লেখায় বর্তমানের প্রতিফলন না থাকলে, সোশিওলজিকাল কন্টেক্সট না থাকলে, এই সময়ে অনুভব করা অসহায়তাগুলো লেখায় ফুটিয়ে না ওঠাতে পারলে সেই কল্পবিজ্ঞান কোনও কাজের নয়। এখন যদি কোনও পাঠক সায়েন্স ফিকশনে শুধু উদ্ভট গ্যাজেট খুঁজছে, এলিয়েন খুঁজছে আর রাজনীতি আর সোশ্যাল রিয়ালিটির আলোচনা/সংলাপ পেলেই হাই তুলছে, তাহলে তা পাঠকদের সমস্যা, সায়েন্স ফিকশন বা তার লেখকদের নয়। না না, আমি বলছি না, বিদ্বজনেরা বলছেন।

সেই জায়গা থেকে সোহমের উপন্যাস টপনোচ। প্রথম বইতেই তিনি যথাসম্ভব সোশ্যাল রিয়ালিটি দেখিয়েছেন, ক্রাইসিসটাকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বুনেছেন, পাঠকদের অনাদি-অনন্ত বিস্তৃত জটিল সায়েন্টিফিক-এথনিক ডিলেমার মাঝে ফেলেছেন, এবং যতটা সম্ভব রোমাঞ্চ আর গতি বজায় রেখেছেন। তার ভাষাটাও ঠিক চিরাচরিত বাংলা নয়, একদম ঝরঝরে স্বতঃস্ফূর্ত বাংলা বলতে যা বোঝায় তা নয়, ইংরেজি স্পেকফিকে যে ধরনের ভাষা বা বাক্যগঠন থাকে, অনেকটা সেই ধাঁচের। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে তাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি, পাঠসুখে ব্যাঘাত ঘটেনি, বরং ব্যাপারটা লেখকের ক্রিয়েটিভ চয়েজ বলেই মনে হল। মেলভিল বা ম্যারি ডোরিয়া রাসেলের মতো অনেকেই গতানুগতিক ইংরেজি বর্জনকে একটা নিজস্ব ভাষায় উপন্যাস লিখেছেন, খানিকটা সেরকমই। আরো খোলতাই ভাষা হলে পড়তে বেশি ভালো লাগত না লাগত না, সেটা আপাতত বোঝার উপায় নেই।

যাই হোক, বাংলা সায়েন্স ফিকশনের জগতে এই বইটি এবং সিরিজটি অতি প্রয়োজনীয় সংয়োজন হতে চলেছে, সেটুকু স্বীকার না করে উপায় নেই। যাঁরা সিরিয়াস সাই ফাই নিয়ে ইন্টারেস্টেড, এই বইটা মিস না করাই ভালো। আপাতত দ্বিতীয় খণ্ডের অপেক্ষায়।

অপ্রাগৈতিহাসিক
সোহম গুহ

বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

Mythopoeic শৈলীর গ্রাফিক নভেল

 


জিম উডারিং এর 'ফ্র্যাঙ্ক' সিরিজের একটা সম্পূর্ণ গ্রাফিক নভেল। নো সংলাপ, কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার চলছে প্রথম পাতা থেকেই।
যাঁরা পড়েননি আগে, উডারিং এর কাজের ধরনকে বলা হয় Mythopoeic. ফ্র্যাঙ্ক বলে যে 'বেড়াল' জাতীয় চরিত্রকে কেন্দ্র করে এর আগে ওয়েদারক্রাফট বলে আরেকটি নভেল লিখেছেন, তার সঙ্গে এই বইটার মিল আছে। মানে, শৈলীতে। ইম্প্রেসিভ রেন্ডিশন, সূক্ষ্মতম ডিটেল অব্দি এঁকে ফেলেন উডারিং, কিন্তু এমন বোল্ড স্ট্রোকে আঁকেন যে একটা হিপনোটিক অনুভূতি হয়। উল্টোপাল্টা সব প্রাণী, বেলুনে উড়ে বেড়ানো অপদেবতা, ফ্র্যাঙ্কের ঘর উড়িয়ে দেওয়া ক্যাপিটালিস্টিক সিস্টেম, অর্গ্যান ফ্যাক্টরি... প্রথম পাতা থেকে ছুটোছুটি চলছে। ফ্র্যাঙ্ক মাঝেমধ্যে মনে হয় হ্যালুশিনেট করছে, ওদিকে এ কথাও সর্বজনবিদিত যে জিম উডারিং নিজেই ছোটবেলায় বহুদিন ধরে হ্যালুশিনেশন দেখতে পেতেন, তাঁর একটা সিরিয়াস ট্রমা ছিল; অদ্ভুত সব প্রাণী তাঁর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াত। আসলে এই বইয়ে ফ্র্যাঙ্ক বলে যে চরিত্রটি ঘর হারিয়ে নতুন জীবনের খোঁজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে আর একসময় ভালোবাসা খুঁজে পেয়ে স্বস্তি পাচ্ছে, সেটা খোদ শিল্পীর নিজের জীবনের গল্প। তাই মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই গল্পের প্রায় সবটাই প্রতীকী, প্রতিটা ছবিই সংলাপহীন হয়েও বহুঅর্থবহনকারী।
এমনিতেই উডারিং এর আঁকার হাত অনন্য। বইয়ের প্রতিটা স্কেচই অসম্ভব সাহসী, জটিল, সূক্ষ্ম এবং অনেকটা সাইকেডেলিক ধাঁধাঁর মতো। প্যানেলগুলো যেন নিজের মধ্যে একটি জীবন্ত স্বপ্নজগৎ নিয়ে রয়েছে, যেখানে বাস্তবতা ও কল্পনা মিলে এক অদ্ভুত রূপ নেয়। সত্যি বলতে ছবিগুলো মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কী কঠিন এই সমস্ত ছবি কাগজে তুলে আনা!
যদি Mythopoeic স্টাইল নিয়ে আগ্রহ থাকে, একশো পাতার এই বইটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নেওয়াই ভালো।
ফ্যান্টাগ্রাফিক্স