মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

কোরিয়া, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান ও ক্যানোপি (এবং কিছু খুচরো স্বপ্ন)

 


রিসেন্ট পড়া জার্নালিস্টিক নন-ফিকশন বইয়ের মধ্যে সেরা তো বটেই, কলমের জোর থাকলে একটা হার্ডকোর পেজ টার্নার নন-ফিকশন অ্যাকাউন্ট কীভাবে মন খারাপ করা আর মন ভালো করা কতগুলো হিউমান স্টোরিতে বদলে যেতে পারে, সেটা জানতে হলে এই বইটা পড়া দরকার।

পুনশ্চ: যারা কে-ড্রামা 'ক্র্যাশ ল্যান্ডিং অন ইউ' দেখে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন আর উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে আরো ভালো করে জানতে চান, অতি অবশ্যই পড়ুন।

(দশে কুড়ি)


বুকার লংলিস্টে থাকা একটা বই... বিষয়বস্তু দেখেই মাথা ঘুরছে। এই এক লেখক, বিষয় নির্বাচনেই বাজিমাত করে দেন। প্রতিটি বই অন্য লেভেল। লংলিস্টের বারোটা বইয়ের বিষয়বস্তু একদিকে, রিচার্ডবাবু একদিকে। ভালো মন্দ তো পরের কথা।

এটা পড়লেই চলে যাবে🌹

হরিণী নাগেন্দ্র পাঠকমহলে বিখ্যাত ব্যাঙ্গালোর ডিটেকটিভ সোসাইটি সিরিজের জন্য। কিন্তু এ বাদেও তিনি এই সময়ের অন্যতম এক ইকোলজিস্ট, আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর নামডাকও আছে। দেখে ভালো লাগে ফিকশনের পাশাপাশি হরিণী সমানে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে চলেন। কনজার্ভেশনিস্ট সীমা মুন্দোলির সঙ্গে আগের বছর 'শেডস অফ ব্লু' বলে একটা বই এসেছে, সেটা দেখে মনে পড়ল এই বইটা মিস হয়ে গেছে, ব্লসমসে গিয়ে নেব নেব করে আর নেওয়া হল না, তারপর ব্যাঙ্গালোর যাওয়াই হয়নি। এখন পড়তে গিয়ে যেটা সবচেয়ে ভালো লাগছে, সেটা হল যত্ন। ও জিনিসটার আজকাল বড়ই অভাব দেখি। এই মাঝারি বইটায় হরিণী আর সীমা এমন সুন্দর যত্ন করে আর্বান ট্রি আর পরিবেশের কথা লিখেছেন, বই পড়ছি বলে মনে হয় না। গাছেদের বিজ্ঞান আর বট, জাম, তেঁতুল ইত্যাদি থেকে শুরু করে জীবজন্তু, সামাজিক আচার, রান্নাবান্না, খেলাধুলো সব কিছুই মিশে গেছে সাবলীলভাবে। পাম আর ইউক্যালিপটাস নিয়ে এত লাফালাফি কেন, চিল আর পানকৌড়ি হারিয়ে যাচ্ছে কেন, ব্যাঙ্গালোর সহ ভারতের সমস্ত শহরে হিট আইল্যান্ড এফেক্ট কীভাবে কাজ করে, গোটাটাই ছিমছাম ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুন্দর কিছু ইলাস্ট্রেশন আছে, দেখে বেশ লাগে। বাড়িতে গাছপালা লাগানোর শখ থাকলে কিনে ফেলুন৷ বা বন্ধুবান্ধবদের উপহার দিন। 


মাঝে মাঝে এমন একটা বই পড়ে ফেলি, যে বুঝতেই পারি না ঠিক কীভাবে আর সি এ করব?

মার্টিন ম্যাকিন্স-এর 'In Ascension' এমন একটা সাইফাই, যা পড়ে অনেকেই 'ধুস! কী ফালতু!/ঘুম পেয়ে গেল/এর চেয়ে ভালো আমি লিখি!" করে উঠবে! অনেকে ভীষণ তারিফও অবশ্য করবেন, বাকিরা আমার মতো সম্মোহিত হয়ে, বইটা গোগ্রাসে গিলবে ঠিকই, কিন্তু ভালো লাগল না লাগল না খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে না। কারণ, দে আর ইন শক।

বলে রাখা ভালো ম্যাকিন্সনের লেখা খুব একটা ডিস্টিংটিভ কিছু নয়, বরং বেশ সহজ সরল সাবলীল, আর সেইজন্যই বইটা শুরু করে আর থমকাইনি। আধুনিক সায়েন্স ফিকশনে যা যা থাকতে পারে, বায়োটেক থেকে স্পেস রিসার্চ, মলিকিউলার বায়লোজি থেকে আন্ডারওয়াটার অর্গানিজমের খুঁটিনাটি, সব কিছুই আছে, কিন্তু কোথাও যেন বইটা একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড অ্যাডভেঞ্চারের মোড়কে শুরু হয়েছে আর সেই মোড়কটা প্রায় বারো আনা জুড়ে বজায় রেখে গেছে। হাই স্ট্রেস ড্রামা, একের পর এক অমীমাংসিত প্রশ্ন, ম্যারিন বায়োলজিস্ট প্রোটাগোনিস্ট এর ট্রমাটাইজিং শৈশব.. এসব নিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়া এগিয়ে যায়।

এরপর আচমকা একটা জায়গা আসে, ম্যাকিন্স একেবারে কোর্স চেঞ্জ করে সাইফাইকে ডকে তুলে গল্পকে এমন এক মেলানকলিক কম্পোজিশন দিয়ে ফেলেন যে বেশিরভাগ পাঠক ঘাবড়ে যায়, বাকিরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে চলে। খুব লজ্জা করছে বলতে, কারণ আমি সেকেন্ড দলে। বিচারবুদ্ধি দিয়ে ভাবলে বলা উচিত ছিল, "এটা কী হল দাদু? গল্পের সমস্ত রহস্য ভুলে, সব অজানা প্রশ্ন মাথায় তুলে এখন তুমি সাহিত্য করছ? সারিয়েলিজম করতে হলে স্পেসটাইম নিয়ে গল্প ফাঁদার কী দরকার বাপু, কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে!"

কিন্তু. কিছুই বলা হল না, কারণ লেখক এতক্ষণে আমাকে পুরোপুরি বশ করেছেন। স্পেকফিক বা রহস্য কাহিনিতে সোশ্যাল ড্রামা ঢোকালে আমি বহুত বিরক্ত হই, কিন্তু 'In Ascension' এমন এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করেছে যে আমি স্পিকটি নট থাকতে বাধ্য হচ্ছি। এই লিটারারি সাই-ফাই সোজা কথায় আমাকে ক্লিন বোল্ড করল, প্রায় কুড়ি পার্সেন্ট গল্প, হাজার খানেক অনুত্তরিত প্রশ্ন, আর পুরোপুরি ওপেন এন্ডেড একটা এন্ডিংও আমাকে সেই জায়গা থেকে সরাতে পারল না।

পুনশ্চ: বইতে প্রচুর আন্ডার দ্য লাইন ইস্টার এগ আছে। একটা বই লেখার পিছনে কত চিন্তাভাবনা থাকে, কত না বলা ভাবনা থাকে, বাংলার সীমিত বাজারে সেই নিয়ে আলোচনা হয় না। দেখে ভালো লাগে ইংরেজিতে এমন পাঠক বহু আছেন যারা ঠিক খটকা লাগলে এক একটা জায়গা ধরে রীতিমত রিসার্চ করে রেফারেন্সগুলো টেনে বার করেন। বইয়ের নাম আর নায়িকার নামের পিছনেই একটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং গল্প আছে, বইটা পড়লে কেউ চিন্তাভাবনা করে দেখতে পারেন। বই শেষ করার পর দেখলাম রিসেন্টলি বইটা আর্থার সি ক্লার্ক পুরস্কার জিতে ফেলেছে। 


আমি সাধারণত এক সময়ে পাঁচ ছ'টা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করি। অসম্ভব ধীরে ধীরে পড়ি, এক একটা শেষ করতে কয়েকমাসও লেগে যায়। তার অধিকাংশই পোস্ট করার প্রয়োজন মনে করি না, করে লাভ কী? কিন্তু এরই মধ্যে কিছু কিছু কাজ থাকে, পড়ে মনে হয়-- 'ইস! এত যত্ন করে লিখেছেন, বিশেষ কেউ জানতে পারেনি!' একটা পোস্ট দিলে যদি একজন দুজনও কিনে পড়ে ! বছর চারেক আগে অব্দি বাংলায় এরকম কিছু কিছু বই পড়ে পোস্ট দিতাম, এখন বাংলা বই হাতে পাওয়াই কঠিন হয়ে গেছে।

তবু দু এক সময় মনে হয়, অমুক বইটা এত যত্ন করে করা, কেউ খেয়ালই করছে না! এরকম কত কত বই আছে! শুধু লিরিক্যাল বুকসেরই প্রচুর অনালোচিত বই আছে, প্রতিটাই সংগ্রহযোগ্য। ভাষালিপি, ধানসিড়ি, সৃষ্টিসুখের কত ভালো ভালো কাজ নিয়ে আলোচনা হয় না। কাফে টেবল বছর দুই ধরে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করেছে (খচ্চর সিরিজ বা গল্পকুঞ্জের মতো চমৎকার সংকলন পুনর্প্রকাশ), মৌহারি, অবভাস, সুচেতনার কিছু কিছু কাজ ছকভাঙা। এছাড়া অজস্র ছোট প্রকাশক তো আছেনই। প্রতিটা লেখকই চান তার বই নিয়ে প্রচার হোক, এতদিনের পরিশ্রম অন্তত একটু ভিসিবিলিটি পাক। প্রচারের নিরিখে দেখতে গেলে এই প্রত্যাশায় দোষের কিছু নেই, একটা বই লিখতে মুরাকামিকে যত পরিশ্রম করতে হয়, একজন অজানা লেখককে তার চেয়ে কম করতে হয় না। তবু, কিছু কিছু বই একেবারেই আড়ালে থেকে যায়, এই তাদের নিয়তি। সামান্য কয়েকজন পড়েন, বাকিরা জানতে পারেন না, আর 'মিসম্যাচ' হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এমন হয়, বইটা সত্যিই যাদের ভালো লাগত, তাঁরাই বইটার কথা জানেন না।

যে বইটা পড়ে এই কথাগুলো বলতে ইচ্ছে হল, সেই বই বা লেখিকার কথা এক সপ্তাহ আগেও আমি জানতাম না। জ্যাকালিন হার্পম্যান বেলজিয়ামের লেখিকা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি হওয়ার মাশুল দিতে তাঁকে পরিবারসহ মরক্কোতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। ফিরে যখন আসেন, দু তিন বার কেরিয়ার বদল করে অবশেষে সাইকো অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ফরাসিতে তাঁর বেশ কিছু বই আছে, কিন্তু এই বইটা বাদে কোনো বইই মনে হয় ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি। কেন হয়নি, জানি না। হয়তো হওয়ার মতো নয়, বা কেউ জানতে পারেনি। Moi qui n'ai pas connu les hommes ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হলেও অনেক আগেই লেখা শুরু হয়েছিল, যখন হ্যান্ডমেড টেল বা স্পেকফিক ডিস্টোপিয়ার কালজয়ী কাজগুলো সেভাবে সাড়া ফেলেনি। কিন্তু এই বইটা ইংরেজিতে আসতে আরো কয়েক দশক লেগে গেছে, আর তারপরও বইটা মেনস্ট্রিমে সেভাবে সাড়া ফেলেনি। হয়তো পাঠকদের পছন্দ হয়নি, অথবা সেই 'মিসম্যাচ'... কিন্তু এক ঘরানার পাঠক এই পাতলা (১২০-১৩০ পাতা হবে) বইটাকে যত্ন করে আগলে রেখেছেন, যথাসম্ভব প্রচার চালিয়েছেন। থ্যাংকস টু দেম, না পড়লে একটা অন্যরকম ইমোশনাল এক্সপেরিয়েন্স থেকে বঞ্চিত হতে হত।

ঠিক কী নিয়ে এই বই? সামারি দেখে বললে বলতে হয়--- একটা বাংকারে চল্লিশজন মেয়েকে সারাজীবন বন্দি করে রাখা হয়েছে, আচমকা একদিন সব পালটে যায়। ব্যস!

কিন্তু ওটুকু জেনে কিছুই বোঝা যায় না। আগেই বলে দিই, এই বইটা চিরাচরিত ডিস্টোপিক ফিকশন নয়। বরং যদি 'দ্য মেমোরি পুলিশ' পড়ে থাকলে কিছুটা সাযুজ্য পাওয়া যেতে পারে। এক ডেসপন্ডেন্ট ও ডেসোলেট কাহিনি, যেখানে একজন কিশোরী আবিষ্কার করছে, সে তাঁর শারীরিক, মানসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানে না। যারা জানত, তারা আবার আবিষ্কার করছে, তারাও আসলে ঠিক জানত না। মনুষ্যজাতির চেতনা আর শুন্যতা ধরা পড়ে পদে পদে। কিন্তু এই 'ব্লিক' যাপনের বর্ণনা পড়তে পড়তে একসময় বোঝা যায়, লেখিকা কী ভীষণভাবে হতাশার ছদ্মবেশে একটা আশার গল্প বলে চলছেন। আবার উল্টোটাও বলা যায়! স্ট্রিম অফ কন্সিয়াশনেস জাতীয় ন্যারেটিভ নয়, বইটা পড়তে গিয়ে কোথাও হাই ওঠে না, কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই গতিশীল কাহিনির ডেপথ এতটাই বেশি যে চমকে উঠতে হয়। বিশেষ করে বইটা সেকেন্ড হাফে গিয়ে যে উচ্চতায় পৌঁছে গেল, সেটা লিখে বোঝানো কঠিন। অনেকদিন পর একটা বই মাত্র দু তিন সিটিং এ শেষ করে ফেললাম আর শেষ করেও ভুলে যেতে পারলাম না। যারা এই ধরনের বই পড়তে ভালোবাসেন, এই কাজটা মিস না করাই ভালো।


যখন স্ক্রিপ্ট কবিতা হয়ে পর্দায় ফুটে ওঠে...

পঞ্চাশ মিনিটের সিনেমা, প্রায় কেউই দেখেনি। মুবিতে ছিল একসময়, পরে আর পাইনি। আইএমডিবিতে শুধু একজন রিভিউ দিয়েছে। অচল মিশ্রা যে সিনেমা করছে সেইজন্যই অনেকের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। প্রায় সংলাপহীন একটা ছবি যে কত কিছু বলতে পারে, সেটা বোঝার জন্য এই জিনিসটা দেখা দরকার। এরকম ভিস্যুয়াল পোয়েট্রি পর্দায় তুলে আনা শেখাও যায় না, শেখানোও যায় না। তাজদার জুন্যায়েদের আবহসংগীত কাজটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

ধুইন
অচল মিশ্রা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন