রাজর্ষি দাশ ভৌমিক গোয়েন্দা কানাইচরণ লিখে বাঙালি পাঠকের চোখের মণি হয়ে উঠেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু মুশকিল হল, লেখক গোয়েন্দা গল্প আর ক্রাইম লিটের একনিষ্ঠ ভক্ত হলেও আদপে দীর্ঘকাল ধরে চমক লাগানো 'গোয়েন্দাকাহিনি' লেখার ইচ্ছে তাঁর সম্ভবত ছিল না, গোয়েন্দা কানাইচরণের চেয়ে তিনি ব্যক্তি কানাইচরণকে নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী, অনেক বেশি ইমোশনাল। একজন মাঝবয়সী মানুষ, যার বর্তমান চরিত্রের সঙ্গে কলকাতা আর তার শহরতলির স্পেস আর টাইম জড়িয়ে আছে। মেঠো মফস্বল, ঘেমো রোজনামচা, ধমকধামক আর কেতা দেখানোর ব্যালেন্স শীট মেশানো পুলিশ জীবন। শহরের ঋতুবদল--গ্রীষ্মের একঘেয়েমি, বর্ষার ভাপ, শীতের মার্ক করা উৎসব-- যেখানে জীবনের বদলের সঙ্গে এক হয়ে যায়। সময় যেভাবে বদলায়, শহরও বদলায়, বদলে যায় শহরে থাকা সেই মানুষও। রাজর্ষি সেই মানুষের গল্প বলতে কলম ধরেছেন, গোয়েন্দা কাহিনির চমক, প্লটের অভিনবত্ব বা পুলিশ প্রসিডেরালের সুক্ষ্ণতা দেখানোর পালা তাঁর শেষ। এইবার লেখক কানাইকে নিয়ে যে পথ ধরেছেন, তা দিন দিন আরো ধোঁয়াশা হয়ে উঠবে বলে আমার ধারণা। মনে রাখবেন, এই কাহিনি গোয়েন্দার নয়, এই কাহিনি কানাইয়ের। এবং, কানাই ইজ কলকাতা। কলকাতা ইজ কানাই।
কানাই শুধুই কলকাতা অবশ্য নয়, কানাই আসলে ১৯৮৩ সাল। কানাই আশির দশকের মধ্যনিম্নবিত্ত সমাজের সেই সমস্ত দীর্ঘশ্বাস, যার চিন্তাধারা ও ভাবনাকে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ধরা কঠিন। কানাই কমিউনিস্ট সরকারের থিতিয়ে আসা বিপ্লবের সেই সব ভেঙে যাওয়া প্রেম, যারা জাঁতাকলে পিষে প্রেমিকাকে হারাবে বলে মানসিকভাবে তৈরি থাকে। কানাই সেই সব সম্পর্কের দলিল, যেখানে দমবন্ধ করা জীবনের মাঝে কাঁচি সিগারেট ধরিয়ে নিজেকে সব ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে শত শত যুবক। কানাই পুলিশও বটে, যে পুলিশ নিজেও এক এক্সিস্টেন্সিয়াল ক্রাইসিস নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। কেস আসে, কেস যায়! কখনও অপরাধী ঠিক করে ক্রাইম সিন তৈরি হয়, কখনও ক্রাইম সিন সাজিয়ে অপরাধীর মাথায় মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়! জাস্টিস সিস্টেমের নিকুচি, কেস ফাইল ক্লোজ হোক! জোড়াতালি দিয়ে কোর্টে ম্যানেজ করে নিলেই হল! কানাই তিরাশির বর্ষায় মতিদার শিক্ষানবিশি করা এমন এক যুবক, যার আপাতত হাতেখড়ি চলছে।
ক্রাইম গল্পে ন্যাকাপনা আমার পছন্দ নয়, আমি ক্রিস্প লেখা ভালোবাসি। প্লট জোরালো না হলে বা আদ্যিকালের প্লট হলে আমি প্রথম থেকেই হাই তুলি, সে আমার পছন্দের লেখক হলেও এর হেরফের বিশেষ হয় না। খোদ কানাইয়ের প্রথম বই পড়তে গিয়েই আমি এই কথা বলেছি। অথচ, এই গল্পে না জোরালো প্লট আছে, না এমন কিছু নতুনত্ব আছে, না চমক আছে, তবুও আমি যাকে বলে বোল্ড আউট বাই ইট। এর পিছনে একটাই কারণ, লেখক আমাকে কলমের ম্যাজিকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে আমি নিছক একটা গোয়েন্দা গল্প পড়ছি না, আমি একটা ভালো লেখা পড়ছি। রহস্য গল্প নয়, আসল রহস্য হল লেখকের ভাষা, ন্যারেটিভের বর্ণালীগত সৌন্দর্য! ব্লিক, অথচ ডিটেল্ড! চিরাচরিত, অথচ নতুন। সহজ, অথচ গভীর। মুচমুচে, কিন্তু বিষাদময়। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
একটু সহজ কথায়, বা আরেকটু স্পষ্ট করে লিখি। লেখক 'কলকাতা নুয়া' থেকে 'বর্ষণ অধিক'-এ আসতে যে পথ ধরেছেন, তাতে বোঝাই যায়, তাঁর গোয়েন্দা গল্প আর গোয়েন্দা গল্প শুধু নেই। 'অজ্ঞাত পরিচয়..' এর যে প্লটে প্লটের অভিনবত্ব মুছে এক মেলানকলিক, বহুস্তরীয়, রাত্রিকালীন কমপ্লেক্সিটি ঢুকে পড়েছিল, 'বর্ষণ অধিক'-এ সেটা আংশিক ভাবে বিমূর্ত রূপ নিয়েছে। মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুরের মোড়কে বন্দি জোড়াখুনের কেস আসলে স্পেসটাইমকে অতিক্রম করে একটা প্রজন্মের জীবনদর্শন তুলে ধরেছে। লেখক ইচ্ছাকৃত ভাবে টাইমলাইন তছনছ করে এমন একটা সময়কে তুলে ধরেছেন, যেখানে এই অপরাধ সম্ভব, এই অপরাধের উদ্দেশ্য জাস্টিফায়েড, এই অপরাধের ডিটেকশন আর ফয়সালাও ভ্যালিড। হয়তো আজকের সময়ে নয়, হয়তো আশির দশকে নয়, হয়তো কানাইয়ের অন্য কোনও কাহিনিতে নয়, কিন্তু 'বর্ষণ অধিক' এর তিরাশিতে, এই স্পেসিফিক টাইমলাইনে এই গল্প জাস্টিফায়েড। (এবং, বাস্তব টাইমলাইন মেন্টেন করার কোনও দায় লেখকের নেই।)
এই বইয়ে গল্পের চাল আরো ছন্দময়ী, আরো পোয়েটিক, আরো বেশি অভাজার্ভেন্ট, কিন্তু ক্লাইম্যাক্সের চমক বা রহস্য সমাধানের ব্যাগেজ কলমকে থমকাতে দেয়নি। যদি কারো মনে হয়, কী হল? কিছুই তো তেমন হল না? তাহলে উত্তর, যা হল, তাই হয়ে থাকে! সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, পুলিশের গোয়েন্দারাও নস্যি টিপে মাঝেমধ্যে লেখকের মতো কল্পনা করে ফুটোফাটা বুজিয়ে নেন। এই সেই অতিবাস্তব পুলিশ কাহিনি, যা কোনোদিন কেউ বাংলায় লেখেনি। এই কাহিনি পুলিশ প্রসিডেরালের মোড়কে সাহিত্যের এমন একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইল (অন্তত আমার কাছে, অন্য কারো কাছে বইটা অন্যভাবে ধরা দিতেই পারে) যা ঘুরেফিরে পড়ে মনে করব, বাংলায় এমন একটা বই লেখার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এবং আরেকবার, পিনাকিদার প্রচ্ছদের কোনও তুলনা নেই।
বর্ষণ অধিক
বৈভাষিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন