রবিবার, ২১ জুলাই, ২০২৪

গনেশ হালুই: দ্য ইনারস্কেপ আর্টিস্ট

 


অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট বা মেটাফিজিকাল আর্ট বা 'ইনারস্কেপ'... যা কিনা শিল্পী গনেশ হালুইয়ের সিগনেচার স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই নিয়ে যে সাধারণ মানুষ বা শিল্পপ্রেমিকরাও খুব একটা সময় খরচ করেন না বা আগ্রহ দেখান না, তার যথাযথ কারণ আছে। এমনিতেই মডার্ন আর্ট একটা অববাস্তব আইডিয়া, ভিস্যুয়াল ইন্টারপ্রিটেশনের ঊর্ধ্বে গিয়ে শিল্পীর মাথার ভিতর কী চলছে আর সেই মনের ছবি জ্যামিতি আর কালার কন্ট্যুরের সাহায্য নিয়ে তিনি কীভাবে আর কেন কাগজে ইন্টারপ্রেট করছেন, সেটা বোঝা কঠিন। অবশ্য কখনও কখনও এমনও হয় যে রঙের আধিক্য বা কন্ট্রাস্ট থুড়ি উজ্জ্বলতা একটা ছবিকে সাধারণ মানুষের চোখে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে। কিন্তু তাতে ছবির দর্শন ধরা পড়ে না। শিল্পী কী ভাবছিলেন ধরা পড়ে না।


যাকগে, আমি আর্টের ছাত্র নই, কিছু জানিও না। কিন্তু আজ একটা বিশেষ ছবি নিয়ে (সেই ছবি উচিত না অনুচিত, ভালো না মন্দ, প্রচ্ছদ হিসেবে যথাযথ না নিগেটিভ মার্কেটিং জেনারেট করার উদ্দেশ্য নিয়ে করা, সে নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই, থাকা উচিতও নয়) অনেকের আগ্রহ চোখে পড়ল আর এই সূত্রে বেশ কয়েক বছর আগে পড়া 'দ্য ফিলিং আই' বলে একটা বইয়ের কিছু কথা মনে পড়ে গেল। আসল কথা হল, যদি কেউ সত্যিই কোনও ইনারস্কেপ ছবির বিচার করতে চায়, সেটা নিজের মতো করে বুঝতে চায়, তাহলে তাঁর একমাত্র উপায় শিল্পীকে বোঝা, তাঁর জীবন ও দর্শনের ওঠানামা, তাঁর তুলিকলম গড়ে ওঠার যাত্রাকে বোঝা। পাশাপাশি আর্ট সম্পর্কে যদি খানিকটা আইডিয়া থাকে, তাহলে লাভ বই ক্ষতি হবে না। এখন এই আইডিয়া বলতে আমি ক্রাফটের কথা বলতে চাইছি না, সেটা সম্ভবও নয়। যেমন, গনেশবাবুর ওয়াটারকালার স্টাইলেই এতগুলো লেয়ার আছে, তিনি এতভাবে একটা বিচ্ছিন্ন বস্তুকে রঙের মাধ্যমে ধরেন যে সেই পদ্ধতি বুঝতে গেলে আমাদের কান থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে। ওয়েট ইন ওয়েট, ওয়েট অন ড্রাই, ব্রড ফ্ল্যাট অ্যান্ড গ্রেডেড ওয়াশ, ড্রাই ব্রাশ, লিফটিং অফ পিগমেন্টস... এই প্রতিটা পদ্ধতির মাধ্যমে যে একটা ছোট্ট অবয়ব গড়ে ওঠে, তা মনস্ক দর্শকের মনের একটা বিশেষ তারকে স্পর্শ করে। কিন্তু আমি এখানে শুধুই মডার্ন আর্টের বেসিক কিছু পয়েন্টের কথা বলতে চাইছি, যেমন বিমূর্ত ফর্ম আর জ্যামিতির মাধ্যমে একটা সিম্বলিক ছবি তুলে ধরতে চাওয়া। কীরকম? এই ধরুন, দেশভাগ নিয়ে একটা ছবি, সেখানে কিছুই নেই, শুধু কতগুলো লাইন। এই সরল রেখাগুলো কোথাও কোথাও ওভাল শেপকে কেটে বেরিয়ে গিয়েছে। এমনটা হতেই পারে (নাও হতে পারে, জোর দিয়ে কিছুই বলা যায় না) যে এই রেখাগুলো আসলে দু দেশের মাঝে জোর করে টেনে দেওয়া সীমানাকে রেখাঙ্কিত করছে, এই সরলরেখাগুলো যেভাবে ওভালদের কেটে যাচ্ছে, তার মানে শিল্পী বলতে চাইছেন কীভাবে দেশভাগের এই সীমানা সাধারণ মানুষের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। একটা বৃষ্টির ছবি দেখে আমি একবার হাঁ হতে গেছিলাম। বৃষ্টির ছবিতে বৃষ্টি নেই, জল নেই, ভিজে মাটি নেই, সবুজ পাতা নেই, শুধু একটা ইলুমিনাতি মার্কা বিচ্ছিন্ন চোখ। একটাই চোখ। অনেক কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করে বোঝা গেল, বৃষ্টি আসলে ধরা পড়েছে সেই চোখে। একজন বৃষ্টি দেখছে, আরো ভালো করে বলতে গেলে শিল্পী নিজেই তার বৃষ্টি দেখার কথা ভাবছেন, এখানে তার চোখে দেখা বৃষ্টিই আসল, তিনি কী দেখেছেন, তার চোখে কী ধরা পড়েছে, সেটাই আসল, বৃষ্টিটা গৌণ। এমন হতেই পারে যে দুর্গাপুজোর ছবিতে একটা ত্রিভুজ আসলে ত্রিশুলের কথা বলতে চাইছে, একটা ডিসটর্টেড ঘুড়ি বা খাঁচার মতো আকৃতি আসলে স্বাধীনতার কথা বলতে চাইছে। পুজোর সঙ্গে যে স্বাধীনতার প্রচ্ছন্ন যোগ আছে। এমনও হতে পারে এসব কিছুই নয়, কোনও বিশেষ দিনক্ষণ বা বছরের স্মৃতিই বিমূর্ত রূপ নিয়ে এখানে ধরা দিয়েছে।


সহজ কথায়, জটিল বা কমপ্লেক্স থিমকে সহজ জ্যামিতি তুলে আনা মেটাফিজিকাল আর্টের প্রধান কাজ। কালার প্যালেটের কথাটাও মাথায় রাখলে ভালো। গনেশবাবু সাধারণত মিনিমালিস্ট ছবি আঁকেন, দু একটার বেশি রঙ ব্যবহার করেন না। নীল সবুজ ঘুরেফিরে আসে, লাল বা বেগুনির মতো উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার কমই দেখা যায়। এখন যেখানে রঙের ব্যবহার যতটা উজ্জ্বল, সেই কম্পোজিশনের মুড আর ডেপথ সাধারণত ততোটা বেশি হয়। এই সমস্ত কম্পোজিশন ঠিক কী কী আকারে এসেছে, কোথায় এসেছে, পাতা জুড়ে থাকা এই কম্পোজিশন মুভমেন্ট দেখে বোঝা যায় ছবির থিমটা ঠিক কতটা ডায়নামিক, কতটা তরল! তিনি যা ভাবছেন, তার একটা ছন্দময়তা আছে আর এই জ্যামিতিক আকারগুলো ছন্দবন্ধ জ্যামিতির শেপ নিয়ে স্পেসটাইমে বয়ে যাচ্ছে! এছাড়াও কিছু জিনিস আছে, যা গনেশবাবু বাদে অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যেও থাকে, তা হল স্প্রিচুয়াল আর কালচারার আন্ডারটোন বজায় রাখা। নন লিটেরাল রিপ্রেজেন্টেশন আর কালাচারাল রিপ্রেজেন্টেশন তুলে আনার অসংখ্য উপায় আছে। বিভিন্ন মোটিফের প্লেসমেন্ট, রঙ, লেয়ারিং... রঙের কথাই হোক। নীল রঙটা কতভাবে ব্যবহার হতে পারে একটা শারদীয় ছবিতে?

শরতের আকাশ বোঝানোর জন্য একটা নীল, নীলকন্ঠ শিব, নীল অপরাজিতা, নীলকণ্ঠ পাখি শিবের কাছে দেবীর ফিরে আসার কথা জানায়, নীল পদ্ম দিয়ে রাম দেবীর পুজো করেছিল, নীল উজ্জ্বল জামা পরে বাচ্চারা ঘুরতে বেরোয়... শিল্পীর মন ও স্মৃতিতে কোন রঙের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব কতটা, সেটা বুঝে তিনি রঙের ডেপথ বজায় রাখবেন। একটা জাতি বা গোষ্ঠীর রিটুয়াল সিম্বলকে ছবিতে তুলে আনা কিন্তু একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট রূপ দেওয়া ইনারস্কেপে নতুন কিছু নয়। 

গনেশ হালুই সমসাময়িক কালে ইনারস্কেপের মাস্টার ফিগার শুধু নয়, ভারতবর্ষে বিভিন্ন শিল্প ঐতিহ্যে বজয় রাখার পিছনে (অজন্তা সহ) তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। কিন্তু তাঁর জীবনের একটা অন্ধকার দিকও ছিল, মাতৃভূমি ছেড়ে চলে আসাত বেদনাটা তিনি কোনোদিনই ভুলে যেতে পারেননি। এই মেলানকলিক অতীত রূপক হয়ে তাঁর অনেক ছবিতেই ধরা পড়েছে। একবার কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, 'Pain is the beginning of all art, joy is the end. Art is not the question, art is not the answer. It is a continuous process. You cannot separate heat from fire in the end. If there is heat in fire, you feel it. There is continuity. It is transforming, it means it is continuing. There should be continuity in your life, in things. I was born, like a proverb, I have become old. We cannot stick to one point. You can’t step into the same river twice, because it’s never the same river."

এই পোস্টটা দিলাম, কারণ আর কাউকে দিতে দেখলাম না। এই সূত্রে যদি একজন দুজন গনেশ হালুইয়ের কাজ নিয়ে একটু চর্চা করে, তাহলেই আমি খুশি।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন