ফুটিফাটা রূপকথায় ভরা বোকাসোকা জীবনের কথা। ডক্টর সব্যসাচী সেনগুপ্ত, সব্য নামে যিনি ফেসবুক পাবলিকের কাছে পরিচিত, তাঁর জীবন। হয়তো রাতদুপুরে দেওয়া তাঁর মাইলখানেক লম্বা পোস্ট পড়ে আটশোটা রিয়াকশন আসে হুড়মুড়িয়ে, কিন্তু তাঁর চিকিৎসক জীবনের এই অমূল্য বইটা নিয়ে খুঁজে খুঁজে চারটে পোস্ট পেলাম না। এই লেখাটি শেয়ার করলে অতি অবশ্যই দু একজন বলবেন, "এই বইটার কথা জানতাম না তো!"
ডাক্টার যে বোকা, তারই আরেক প্রমাণ। তবে কিনা বোকা বলেই এই বইটা লেখা সম্ভব হয়েছে মনে হয়। বোকা বলেই এই ডাক্টার মিলেনিয়ালদের শত শত 'প্রলোভন' কে সাবলীল ভাবে এড়িয়ে একটা খড়বড়ে জীবনের মধ্যে থাকা সুখ আর শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। রাজ্যের ঝামেলা, রাতজাগা পরিশ্রম, রাজনৈতিক সামাজিক চাপ উপেক্ষা করে নিঃস্ব মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে আরো একটু ভালো করার জন্য খাটছেন। রোজ, আক্ষরিক অর্থেই রোজ, প্রতি-'দিন' নয়, দিনরাতের ঊর্ধ্বে তাঁর পেশা। চা বাগানের শ্রমিক, শুধু মুলো খেয়ে বেঁচে থাকা রিক্সাওয়ালা, রাতের পর রাত জেগে কাটানো লালচোখের পুলিশের সঙ্গেই তাঁর ইয়ারিদোস্তি, ঘরকন্না। শত শত মৃত্যুকে সাক্ষী রেখে এক একটা জীবন বাঁচিয়ে তোলার লড়াই। ফেসবুকের ভারতবর্ষ যখন আজ অলম্পিক, কাল রাজনীতি, পরশু সাহিত্য নিয়ে 'এক্সপার্ট ওপিনিয়ন' দিতে ব্যস্ত, অন্য একটা ভারতবর্ষে তখন কয়েকজন মানুষ দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করছে... এক একটা জীবন বাঁচানোর অদৃশ্য লড়াই। তাতে কোনও থ্রিল নেই, রোমান্স নেই, আছে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ। হেলথ প্রোটোকল। কন্সিস্টেন্সি। দ্য ব্যানালিটি অফ এভরিডে লাইফ ! ওষুধ এর কড়া গন্ধ, রোগীকে পুষ্টি জোগানোর জন্য আবিষ্কার করা জুগাড়। শহরে, গঞ্জে, অজ পাড়াগাঁয়ে যে সমস্ত চিকিৎসক রাতদিন এক করে এই লেবড়ে যাওয়া দুনিয়ায় মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন, তাদের প্রতিনিধি হয়ে রইল এই লেখাটি।
অদ্ভুত সমস্ত মানুষ, তাদের অদ্ভুত জীবন। টিবির মারণ রোগের চিকিৎসা করতে করতে লেখক থুড়ি ডাক্টার দেখছেন, দেশের মানুষ কতভাবে বাঁচে (বাঁচার চেষ্টা করে), কতভাবে মরে! এক্সডিআর আক্রান্ত কিশোর বেডে শুয়ে কবিতা লিখছে, চেকাপের ডেট মিস করে যাওয়া বুড়ি ডাক্টারকে দেখে ভয় পেয়ে টুল উল্টে পড়ে যায়, প্রায় এক দশক ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যায় এক কিশোরী... এরই মাঝে, ঋতু বদলায়। গাছের পাতা পড়ে যায়, শীত আসে, বসন্তের নতুন কুঁড়ি দেখা যায়, গরমের তাপপ্রবাহে পথ চলা মুশকিল। সময় কাটে। জীবনও কাটে। সময় বদলায়। জীবনও বদলায়। বদলায় না এই লড়াই। ডাক্টারি জীবনের লড়াই। ডাক্টারি জীবনের সম্মোহন। কাঁহা কাঁহা সে ছুটে আসা মানুষ, তাদের ঝুলিতে যত অপরূপ গল্প, সে সব মায়ার পাশের মতো আঁকড়ে ধরে ডাক্টারকে। দাস্তান-এ-দাওয়াখানা সেই ওষুধের গন্ধ জড়ানো মায়ার গল্প।
সুমেধা চট্টোপাধ্যায় আমার চেয়ে অনেক বিশদে বইটা নিয়ে লিখেছেন, ইচ্ছে হলে পড়তে পারেন। সত্যি বলতে বইটা নিয়ে খুব 'অ্যানালিটিকাল' রিভিউ লেখার চেষ্টা করাই যেত, পুস্তকাংশ তুলে ধরে আইডিয়া দেওয়া যেত, কিন্তু আসলে তাতে কোনও লাভ নেই। এই বইয়ের সে সব দরকারও নেই। এই দাস্তান সাহিত্য হতে চায়নি, দাস্তান হতেই চেয়েছে। কিন্তু এই দাস্তানটুকু বড়ই জরুরি, বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। সব্যসাচী সেনগুপ্তের আর চারটে মনকাড়া বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে থাকলে সেই মুগ্ধতার রেশ এখানেও পাবেন, কিন্তু এই লেখার ইম্প্যাক্ট একটা ভালো বইয়ের সীমানা অতিক্রম করে যাবে। যাবেই। প্লিজ পড়ুন, পড়ে ফেলুন। কথা দিচ্ছি, ওয়ান টাইম রিডের পরও বইটা আপনার রিডিং লিস্ট থেকে সরে যাবে না।
(৯ঋকাল বুকসের প্রোডাকশন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রচ্ছদ ভাবনাতেই সেই চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়, ইলাস্ট্রেশনগুলো যথাযথ। আধুনিক ভারতে ডাক্টারি জীবনের ফার্স্ট হ্যান্ড, লিটারারি এবং ফিল্টারহীন এক্সপেরিয়েন্স প্রায় নেই, অন্তত আমি তো দেখিনি। প্রচারিত হলে এই বই কত পুরস্কার পেত, কত দূর পাড়ি দিত কে জানে? প্রকাশক বা লেখক, কারোরই হ্যামারিং মার্কেটিং করার ইচ্ছে নেই! সেই নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। হতে পারে বর্নভিল চকোলেট এর ট্যাগলাইনটাই সত্যি-- ইউ হ্যাভ টু আর্ন ইট!)
দাস্তান-এ-দাওয়াখানা
সব্যসাচী সেনগুপ্ত
শুভদীপ ভট্টাচার্য চিত্রিত
৯ঋকাল বুকস
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন