জয়ঢাক প্রকাশন পরিবেশিত 'অন্য বসন্তের উপাখ্যান' বাংলায় নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী কাজ৷ এই সংকলন সাউথ এশিয়ান কুইয়ার (queer) স্পেকুলেটিভ ফিকশনকে সামনে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কিন্তু 'বাংলায় এই প্রথম' মার্কা শব্দাবলী দিয়ে এই ইনিশিয়েটিভকে খাটো করার কোনও মানে হয় না। কারণ, কুইয়ার স্পেক-ফিক এর আনকোরা বিষয়বস্তু বাদেও, 'বাংলায় এই প্রথম' বাদেও এই সংকলনের অন্যতম প্রধান স্ট্রেন্থ হল সাউথ এশিয়ান সাহিত্যের রেঞ্জ আর বিষয়বস্তু নির্বিশেষে এমন কিছু সুসাহিত্য ও সুসাহিত্যিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, যাদের কথা তুলনামূলক ভাবে খুব বেশি পাঠক জানে না। কাজটা ঝুঁকির, কারণ সাহিত্য বলতে সাধারণত বাংলায় যা 'চলে', সেখানে প্লট আর ভাষা খুব স্পষ্ট, প্রমিনেন্ট, লিটারারি ডিভাইসের ধার পরখ করার চোখ বা ধৈর্য সকলের থাকে না, সবসময় তো নয়ই। (আমি নিজেকে ইনক্লুড করেই বলছি) কিন্তু আন্তর্জাতিক ঘরানার সাহিত্য, বিশেষ করে ছোটগল্প যেভাবে লেখা হয়, তার গভীরটা যেভাবে মাপা হয়, তার সঙ্গে একবার পরিচয় হলে ব্যাপারটা নিজে থেকেই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। উদাহরণ, অ্যালিস মুনরো বা জর্জ সন্ডার্সের গল্প যদি কেউ প্রথম পড়ে, প্রায় প্লটহীন ব্যানাল লাইফের সাদামাঠা বিবরণ পড়ে হাই তোলা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই সাদামাঠা গল্প যে আসলে এক একটা চাবুক, সে উপলব্ধি হলে আর পিছন ফিরে তাকানো যায় না। 'অন্য বসন্তের উপাখ্যান' সেই জরুরি কাজটা করতে আরো এক পা এগিয়েছে। ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে ইংরেজি-বাংলা ভাষায় দক্ষ সাহিত্যিকদের কিছু গল্প নিয়ে এসে বুঝিয়ে দিয়েছে, কলমের ধারে বসন্তের ফুল ফোটানো কাকে বলে?
আপাতত, কুইয়ার স্পেকফিকে ফিরে যাচ্ছি। এই জিনিসটা চাপের। বিশেষ করে সম্পাদকদের কাছে। কিউয়ার মানে গে লেসবিয়ান ট্রান্স সম্পর্ক বাদেও অনেক কিছু হতে পারে, কিন্তু গল্প নির্বাচন করার পন্থাটা অবশ্যই বিচার্য৷ মানে, হতে পারে একজন কিউয়ার লেখক স্পেকুলেটিভ ফিকশন লিখেছেন, হতে পারে একজন হেট্রোসেক্সুয়াল লেখকের সাই ফাই গল্পের মূল চরিত্র কুইয়ার... বলতে চাইছি, গল্পে 'কুইয়ার' কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর 'স্পেকফিক' কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটার ওয়েটেজ ঠিক করাই একটা বিশাল কাজ। কিন্তু এই বইয়ের চার সম্পাদক (সৌমিলি দাস, এম ডি মহাশ্বেতা, অঙ্কিত প্রসাদ আর অমৃতা চক্রবর্তী) যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করে তুলনামূলক এমন সমস্ত গল্প নির্বাচন করেছেন, যেখানে 'স্পেকফিক'--এর স্পেকুলেটিভ কল্পনাটাই আসলে কুইয়ার। সব গল্পে না হলেও বেশ কিছু গল্পে ব্যাপারটা পার্ফেক্ট ভাবে ধরা পড়েছে, আর পাঠককে মুগ্ধ করার পাশাপাশি ভাবিয়েওছে।
খুব সহজ ভাবে বলি, এই প্যাশন প্রজেক্টের পিছনে এই চার তরুণ- তরুণী যে নিষ্ঠা দেখিয়েছেন, তা সব প্রজেক্টে দেখা যায় না। জয়ঢাকের প্রকাশনার প্রোফাইল মন দিয়ে দেখলেও এই বইটা আর দশটা বইয়ের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকবে তার ট্রিটমেন্ট, বিষয় ও লেখক/অনুবাদক নির্বাচন আর সম্পাদনার জন্য। প্রকাশনের সাপোর্ট ও গাইডেন্স অবশ্যই ছিল (যদিও ই-বুকে অন্তত কিছু কিছু বানান ভুল আর স্পেসিং মিসটেক চোখে লেগেছে) কিন্তু মূল ক্রেডিটটা অবশ্যই এই চারজনের।
যদি ভুল না করে থাকি, ঈপ্সিতা হালদারের একটা সুচিন্তিত বক্তব্য ও ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ভূমিকার পর বইয়ে মোট সতেরোটা গল্প আছে, তার কিছু কিছু বাংলায় লেখা, বাকিগুলো অনুবাদ। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, এখানে দক্ষিণ এশিয়ার সেই সমস্ত লেখক লেখিকাদের গল্প তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে যারা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক জগতে সক্রিয় ও পরিচিত। সে মিমি মণ্ডল হোক, ইন্দ্রপ্রমিত দাস হোক, অর্চিতা মিত্র হোক বা কুরালি মানিকভেল, এম এল কৃষ্ণন আর বন্দনা সিং। অনুবাদকদের প্রত্যেকের কাজ চমৎকার, কিন্তু দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ শেঠ বা মৌসুমী রায়ের মতো নিয়মিত অনুবাদক ও সাহিত্যিকদের চেয়েও বেশি এগিয়ে রাখব সৌমিলি দাস আর অহনা মৈত্রের মতো তুলনামূলক ভাবে কম পরিচিত নামদের। বিশেষ করে এক একটা গল্প এতটাই 'উইয়ার্ড' ঘরানার, সেখানে এমন ঝকঝকে একবারও হোঁচট না খাওয়া বাংলা অনুবাদ করা সহজ কথা নয়। মন দিয়ে সম্পাদনা না করলে এমন কন্সিস্টেন্ট রেজাল্টও পাওয়া যায় না। এমনকি দু তিনটে গল্প যা আমার ওপর সেভাবে ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারেনি, সেখানেও অনুবাদ নিয়ে কোনও কথা হবে না।
লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, গল্প। পড়ে কেমন লাগল? সত্যি বলতে, বাংলা মাল্টিপল লেখক স্পেকফিক অ্যান্থোলজিতে এত ভালো গল্প আগে পড়েছি বলে মনে হয় না। বেশিরভাগ গল্পই চমৎকার, কিন্তু কিছু কিছু গল্প কেন বেশি ভালো লেগেছে, কারণ সহ বলে রাখি! এগুলো আমার ভালো লেগেছে, তাই বলে অন্যগুলো লাগেনি তা নয়। অন্য গল্পগুলোও ইকোয়ালি স্ট্রং।
১) শ্যামাপোকার ঘরবাড়ি: সোহম গুহ যে এই মুহুর্তে বাংলা স্পেকফিক জগতের রত্ন তাতে আমার মোটেও সন্দেহ নেই। ইন্টারন্যাশনালি অ্যাক্লেম পেতে হলে লেখায় বা বিষয়বস্তুতে যে ভাষা বা ভাবনা লাগে, তার সব আছে। কয়েক বছর পর নেবুলা বা হিউগোতে তার বই দেখলে আমি মোটেও অবাক হব না।
সংকলনের এউ গল্পটা প্রথম কুইয়ার ব্যাপারটা গল্পের মূল বিষয়বস্তুতে ঢুকিয়ে দিয়েছে আর সেই বুনন ঘটেছেও চমৎকার ভাবে।
২) মৃত্যুঞ্জয়: শাম্ভবী ঘোষকে আবিষ্কার করার জন্য এই সংকলন এর কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। জাস্ট আউটস্ট্যান্ডিং গল্প। একটা ছোট্ট, সহজ গল্পকে ভাষা ও ট্রিটমেন্ট দিয়ে কোন লেভেলে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা বোঝার জন্য এই গল্পটা পড়ে নেওয়া দরকার। লেখিকার আরেকটা গল্পও আছে এই বইয়ে ভুল না হলে, তবে এইটাকে আমি এগিয়ে রাখব। (পরে ভেবে দেখেছি, বইয়ে যুক্ত প্রায় অনেকেই সরাসরি সাহিত্য গবেষণা বা অ্যাকাডেমিক জগত থেকে এসেছেন, তাই হয়তো গল্পগুলো সামগ্রিক ভাবে একটা অন্য অ্যাম্বিয়েন্স ক্রিয়েট করেছে।)
৩) অক্টানিয়নের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কপ্রসূত ভগ্নহৃদয়কে কীভাবে সারিয়ে তোলা যায়: কুরালি মানিকাভেল এর লেখা পড়ার সৌভাগ্য আমার আগেই হয়েছে। প্রথম যদি কেউ তাকে পড়ে, থ হয়ে বসে থাকবে। ভদ্রমহিলা যা লেখেন, অন্য কেউ লিখতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই গল্পটা বিশেষ করে স্মরণীয় হয়ে রইল সৌমিলি দাসের চমৎকার অনুবাদের জন্য। এমন ভীষণ গল্পের এমন সাবলীল অনুবাদ- ব্রাভো!
৪) সবুজকুমারী: অর্চিতা মিত্রের এই বহুস্তরীয় গল্প যতটা মায়ময়ী, অহনা মৈত্রের অনুবাদ তার চেয়ে কম মায়াবী নয়।
এবং, লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, এক একটা গল্প থাকে, সিনেমায় এক একটা সিন থাকে, লাফিয়ে একদম পার্ফেকশনের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। এই সংকলমে এমন একটা গল্প পেয়ে আমি বিশাল খুশি। জাস্ট আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড গল্প। লেখিকার কলম এর ভক্ত আমি আগেও ছিলাম, কিন্তু তিনি এখানে যা করে দিয়ে গেলেন, সেইজন্য আমি তাকে দেখা হলে এক প্লেট বিরিয়ানি/ আইসক্রিম খাওয়ানোর নেমন্তন্ন জানিয়ে রাখলাম। যে জগত তিনি গড়েছেন, তা পার্ফেক্টকি কুইয়ার এবং ম্যাজিকালি স্পেকুলেটিভ। খোদ মার্কেজ বা বোর্খেস পড়লে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের জল ফেলতেন। শুধু এই গল্পটার জন্যই বইটা কিনে পড়ে ফেলুন। গল্পের নাম, 'লেডিজ হোস্টেলের চাঁদ'!
অলোকপর্ণা, ইউ রক!
অন্য বসন্তের উপাখ্যান
জয়ঢাক প্রকাশন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন