শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২০

রূপকথার রন্দা

কল্পনা ও বাস্তবের সন্ধিস্থল আরুন্দার আবেগী আকর্ষণ
Ronda

তোমার বিনিদ্র চোখের হাসিতে শুভ্র চুনের কলি 

 রন্দা থেকে সঞ্চয় করা আলো, বাতাস ও বুদ্বুদ 

 ছায়াঘেরা স্মৃতিতে তোমার কমলালেবুর বাগান,

 সেখানেই আমার গানটি দিয়েছি তোমায়

 জলপ্রপাত? নাকি অশ্রু ঝরে চলে?

 গিরিখাতের নিচ থেকে উড়ে আসা জোড়া পায়রা

 বদলে যায় মার্জিত স্তবকে, শুধু পাথর।

 আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি!


  ~পাবলো গার্সিয়া বায়েনা


১) ১৯৩৭ সালের এক সন্ধ্যেবেলা। পাহাড়ের কোলের ওপর সূর্যের আলো অনেকটাই নিভে এসেছে। আন্দালুসিয়ার পানশালায় বোধ হয় কেউই বন্ধ কামরায় বসে ওয়াইন, বিয়ার অথবা সাঙরিয়া খায় না। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পানশালার বাইরে রঙিন পাথরের চাতালের ওপর বসে নাগাড়ে আড্ডা চলছে মানুষজনের। 

ডান দিকের টেবিলে বসা মানুষটা একদৃষ্টে চেয়ে আছেন সামনের আকাশের দিকে। তার উল্টো দিকে বসে থাকা স্যুট পরিহিত দীর্ঘদেহী লোকটি সিগার থেকে ছাই ঝেড়ে জিগ্গেস করলেন, “ফ্রেম পেলে ওয়েলেস?"

ঠোঁট উল্টে অরসন ওয়েলেস জবাব দিলেন, “ফ্রেম খুঁজছি না হে! এমনিতেও স্পেনের গৃহযুদ্ধে যা চলছে, এখানে এসে সিনেমা করার কথা কল্পনাও করা যায় না। তোমার বন্ধুদের কী খবর আর্নেস্ট?"

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সিগারে আরেক টান দিয়ে বললেন, “খবর ভালো নয় হে। মাদ্রিদের বুলফাইট এরিনাতে ফ্রাঙ্কোর দল নেত্য করছে। কোথায় আমাদের চেনা শিল্পীরা? সব প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে। আচ্ছা, এমন অবস্থায় আমাদের আন্দালুসিয়ায় এসে বসে থাকা কী ঠিক হচ্ছে? আমাদের বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য করার চেষ্টা করা যায় না?"

ওয়েলেস মুচকি হেসে বললেন, “সিনেমাতে সেটিং ব্যাপারটাই আসল বুঝলে? সেটিং বুঝে গেলে চরিত্রদের নিয়ে কোনো অসুবিধে হয় না। এখানেও সেই ব্যাপার। গৃহযুদ্ধের সময় এক একটা চরিত্রকে ধরে ভবনদী পার করাতে গেলে আসল ছবিটা মিস করে যাবে যে! শিল্পী হিসেবে তুমি দেখে যাও। মন বিচলিত হবে ঠিকই! কিন্তু যতটা তুমি আউটসাইডার হয়ে সেটিংটা বুঝতে পারবে, নিজে জড়িয়ে পারলে সেই পক্ষপাত ছাড়া স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক।” 

"এই আবার তোমার সিনেমার জ্ঞান শুরু হল! পাহাড়ের কোলে বসে কোথায় সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে কবিতা বলবে তা নয়..."

"সাহিত্য ব্যাপারটা তোমার জন্যে আর্নেস্ট। তুমি বরং ফিরে গিয়ে সংবাদপত্রে খানিকটা এখানের অবস্থা নিয়ে লেখালিখি কর, তাতে অনেক লোকের টনক নড়বে। সঙ্গে এই অদ্ভুত জায়গাটার কথা লিখতেও ভুলো না।” 

"অদ্ভুত! ঠিকই বলেছ হে! এত জায়গা দেখলাম, কিন্তু এই ছোট্ট গ্রামটা আমাকে যেভাবে সম্মোহিত করেছে... সেরকম আগে কোনো জায়গাতেই মনে হয়নি। অথচ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এখানে করার কিছুই নেই।” 

"সেটাই তো রন্দার মজা হে। এখানের অলস বাতাসে একটা রোমান্টিক ব্যাপার আছে,  ফিরে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে। ঠিক জানাডুর মত..."

"জানাডু? সেটা আবার কি ব্যাপার?"

"সিটিজেন কেন নামে একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছি। সেখানে জানাডু বলে একটা পাহাড়ি শহরে বিরাট এক মহল আছে,  ঠিক আমাদের হোটেলটার মতো..."

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে টেবিলে রাখলেন। তারপর সিগারে একটা টান দিয়ে বললেন, “একটা কথা জানো ওয়েলেস, মানুষ যেখানে জন্মায় সেই জায়গাটার সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। বেনিমামেট শহরে গুপ্তচরদের একটা গোপন ক্যাম্পে গিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে, সেখানে সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশের জেনারেল আলেকজান্ডার অরলভের সঙ্গে কথা হল। ভদ্রলোক ‘এনকেভিডি’-র প্রধান, কিন্তু রাশিয়াতে তার বিন্দুমাত্র মন টেকে না। তার ইচ্ছে ফরাসি দেশের কোনও আঙুর বাগানে জীবনের শেষ নিশ্বাস নেবেন। মানুষ যেখানে মরতে চায়, সেটাই তার আসল জায়গা। মৃত্যুর পরেও এখানে থাকতে পারলেই আমি শান্তি পাব।” 

"এনকেভিডি? তারা তো আমেরিকানদের পিছনে লেগেই আছে। আর্নেস্ট,  কী বলছ গুরু? মার্কিন নাগরিক হয়ে রাশিয়ার গুপ্তচরদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছ, জানতে পারলে যে তোমাকে শূলে চড়াবে সরকার।” 

"একান্তই যদি তাই হয়, এখানে এনে কবর দিও হে। এত সাহিত্য লিখলাম,  ওইটুকু ছাড় পাব কী বল? হাহাহা.."

১৯৩৭ সালের বিকেলের সেই আড্ডা গড়িয়েছিল দীর্ঘ চল্লিশ বছর। বার বার আন্দালুসিয়ার এই ছোট্ট শহরে ফিরে এসেছেন সাহিত্য আর চলচ্চিত্র জগতের দুই মহারথী, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আর অরসেন ওয়েলেস। কখনও রেডিও, কখনও সংবাদপত্রের মাধ্যমে দুজনেই আহ্বান করেছেন স্প্যানিশ শিল্পীদের, যাতে তারা শিল্পবিপ্লব আনতে পারে স্পেনে। এরপর আস্তে আস্তে ওয়েলেস আর হেমিংওয়ে ছাড়াও বহু কবি, সাহিত্যিক, সুরবিদদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে রন্দার রোমান্টিক শহর। 

মালাগার এই ছোট্ট শহরে এমন কী আছে যা সারা ইউরোপ থেকে কবি সাহিত্যিকেরা ফিরে ফিরে আসে এখানে? এর উত্তর কেউই দিতে পারেনি। প্যারিস অথবা ভিয়েনার মত শিল্পচর্চা নিয়ে মাতামাতি হয় না এখানে, রোমের জৌলুস নেই, ফ্লোরেন্সের ইতিহাস নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও অজানা  কোনও কারণে বহু শিল্পীর মনে চিরস্থায়ী অবস্থান অধিকার করে আছে পাহাড়ের মাথায় থাকা এই ছোট্ট গ্রামটি। 

এককালে জার্মানির সুয়েবি জনজাতির অধিকারে থাকা রন্দার হাত বদল হয়েছে ভিসিগথ, রোমান আর মুসলমানদের মধ্যে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আব্বাস ইবন ফির্নাসের বাসস্থান থাকা এই শহর বরাবর শিল্পচর্চায় অগ্রগণ্য ছিল। এখানের বাতাসেই একটা শিল্পের ছোঁয়া আছে, মধ্যযুগেও সেই চর্চা ছিল অমলিন। স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের সময় বহু মুসলমান অন্যান্য শহর থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল রন্দার মত পাহাড়ি গ্রামগুলোয়, যদিও রাজার আদেশে সৈন্যের দল এসে বেশিরভাগ লোককেই কচুকাটা করে। নেপোলিয়ানের সঙ্গে স্পেনের যুদ্ধের সময়েও এখানে বহু লোককে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। 


২) প্রায় আড়াই ঘন্টা বাসে আন্দালুসিয়ার অপ্রতিম দৃশ্য দেখে যখন রন্দার মাটিতে নামলাম, সূর্য মাথার ওপর উঠে গেছে। ছোট্ট জায়গা। কাছেই রন্দার নামকরা পাথরের ব্রিজ 'পুয়েন্তে নুয়েভো'। প্লাজা দে তোরাসের কাছে ঢাউস ষাঁড়ের মূর্তি দেখে বুলফাইটিং রিঙের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্লাজা এস্পানিয়াতে পৌঁছে গেছি। গ্রীষ্মকাল, নানা দেশের পর্যটক বেড়াতে এসেছে গাড়ি করে। রোদের তাপে কাহিল হয়ে অধিকাংশই খাবার দোকানগুলোয় ভিড় করেছে। বাকিরা বাহারি হ্যাট পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পেটে দানাপানি দিয়ে আমরাও গিয়ে দাঁড়ালাম এল তাহো গিরিখাতের ওপর তৈরি পুয়েন্তে নুয়েভো সেতুর ওপর। প্রায় চারশ ফুট উঁচু পাথরের ব্রিজটির ওপর দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অনেক নিচে গুয়াদালেভিন নদীর শাখার জল তিরতির করে বয়ে চলছে পাথুরে শৈলশ্রেণীর আঁকাবাঁকা খাতের মধ্যে দিয়ে। খানিক দূরেই দেখা যাচ্ছে পুয়েন্তে রোমানো আর পুয়েন্তে ভিয়েহো ব্রিজের অংশ। একসময় এই ব্রিজ ভেঙ্গে প্রায় পঞ্চাশজন লোক মারা গিয়েছিল। সেই দুর্ঘটনার পর বিখ্যাত স্থাপত্যকর হোসে মার্টিন দে আল্দেল্হুয়েলা আবার এই সেতুর নির্মাণ করেন এবং প্রধান আর্কের নিচে একটা কুঠুরি বানিয়ে দেন। ওই কুঠুরিতে বন্দিদের রাখা হত। বন্দিশালার কুঠুরির জানলা থেকে দেখতে পাওয়া দৃশ্য সচরাচর এত সুন্দর হয় না। আজকাল অবশ্য সমস্ত জায়গাটাই জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। 

ছোট্ট জায়গা হলেও রন্দাতে নানান মহল, মিউজিয়াম, বুলফাইটিং রিং, পুরোনো আমলের স্থাপত্যের বেশ কিছু দ্রষ্টব্য আছে, কিন্তু অত জায়গা দেখতে গেলে বেশ কিছুদিন থাকতে হয় এখানে। আমরা আপাতত ঘুরে ফিরে গিরিখাতের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। হাওয়া দিচ্ছে বলে গরম লাগছে না। পুয়েন্তে নুয়েভোর দু’দিকেই অবজারভেশন ডেক তৈরি করা আছে,  সেখান থেকে এই অঞ্চলের উঁচুনিচু পাথুরে প্রান্তর দেখা যাচ্ছে। সবুজের প্রলেপ আলতো করে বোলানো হয়েছে লালচে শৈলশ্রেনীর ওপরে। 

ঘাড় ঘুরিয়ে সঙ্গিনীকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “দেখেছিস ওই কাঁচা রাস্তাটা? পাহাড়ের ধার দিয়ে নিচের দিকে চলে গেছে, ইচ্ছে করলে ঘন্টাখানেক হেঁটে একেবারে নদীর ধরে চলে যাওয়া যায়।  যাবি নাকি?”

স্প্যানিশ দিদিমণি বিশেষ উৎসাহ দেখালেন না। অনেকক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরে বললেন, “অত সময় নেই। খানিকটা দূর গিয়ে দেখে আসতে পারি।”

হক কথা। আসল জায়গাতে যেতে অনেক সময় লাগবে, উঠতে সময় লাগবে আরো বেশি। খানিকটা গিয়েই বরং দেখা যাক। সেই ঠিক হল। অনেকেই সেই রাস্তা দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। আমরাও চললুম।

রন্দার অঞ্চলটা সিয়েরা দে গ্রাজেলেমা ন্যাচুরাল পার্কের অন্তর্গত। এখানে কাছাকাছির মধ্যেই অনেকগুলো গ্রামকে পুয়েবলো ব্লাংকো মানে ‘হোয়াইট ভিলেজ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কাসারেস, জাহারা দে সিয়েরা, এল বস্ক, উব্রিকে...মন ভালো করা এক একটা মফস্বলি টাউন, সফেদ ওড়না গায়ে দিয়ে শায়রানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছু কৌতূহলোদ্রেককারী পুরাতাত্ত্বিক গুহাচিত্র আছে এই গ্রামগুলোতে। প্রতিটা গ্রামের বাড়িঘর উজ্জ্বল সাদা রঙ্গে রং করা, বাড়িগুলোর টালি লাল অথবা খয়েরি রঙের। ছুটি পেলে অনেকেই এই ছোট্ট গ্রামগুলোতে এসে থেকে যায় কয়েকদিন। অলস ছুটি কাটায়। নদীর জলে ট্রাউট মাছ ধরে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। এইদিকের আঞ্চলিক রান্নার সুনাম আছে, সময় থাকলে পুয়েবলো ব্লাংকোয় মধ্যকালীন জীবনের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ আজও আছে। অনেকটা নেমে সামনে থেকে গিরিখাত সন্দর্শন করে আবার উঠে এলুম বাজার অঞ্চলে।

আমাদের সিঙ্গল মোটো প্রোগ্রাম, তাতে ফোকাস লুজ করি না। হাঁটো। ওয়াক। ওয়াক ইওর টক। ওয়াক ইওর ড্রিম। ওয়াক ইওর ফিয়ার। ওয়াক ইওর লাইফ। পুরোটাই হাঁটার গল্প। কবিতা। বা ধারাবাহিক উপন্যাস। না হাঁটলে মনে হয় দিনটাই জলে গেল। সুতরাং হাঁটতে হাঁটতে চলেছি। হেঁটে সান্তা মারিয়া গির্জা, হেঁটে ইসলামিক রাজাদের থাকার মহল, হেঁটে অতিক্রম করা রাস্তার পাশে অবস্থিত ছোট ছোট মিউজিয়াম। পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে গেছে। মাঝে মাঝে ডান দিকে বাঁদিকে খেয়াপাথরের পাকা রাস্তা এঁকেবেঁকে হারিয়ে গিয়ে মিশেছে কোনও স্কোয়ার অথবা প্লাজাতে। রাস্তায় লোকজন কম, সাদা বাড়ির সামনের কমলালেবু গাছে থোকা থোকা কমলালেবু দেখতে পাচ্ছি। সঙ্গিনী লাফালাফি করে নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পোড়ো কপালে একটা লেবুও হাতে এল না। একটা পাথরও ছাই নেই রাস্তায় যে পেড়ে খাব। ব্যাজার মুখে দুই মুর্তি এগিয়ে চললাম। এরই মাঝে স্যুভেনির সাজানো দোকান, রকমারি আঞ্চলিক হস্তশিল্প আর পাথরের গয়না নিয়ে বসে গেছে নুড়ি পাহাড়ি দোকান। 

এঁকেবেঁকে চলতে থাকা রাস্তা মাঝে মাঝে চড়াই উঠছে। তখন একটু হাঁপ ধরে যায়। আবার ঝাঁকড়া গাছের নিচে বাঁধানো চাতালে বসে এগোই সামনের দিকে। হঠাৎ করে রাস্তা শেষ হয়ে পথের কিনারায় জেগে ওঠে পাহাড়ের ঢাল, সেখান থেকে দিগন্ত বিস্তৃত আন্দালুসিয়ার পার্বত্য অঞ্চল চোখে ধরা পড়ে। 

নাম পড়তে পড়তে পথ চলি। পালাসিও দে মন্দ্রাগন, অ্যারাবিক বাথহাউস,  আলামেডা ডেল তাহো, এই গির্জা, সেই জাদুঘর, অমুক কবির বাড়ি, তমুক শিল্পীর স্টুডিও। এইটুকুনি শহর, তার পরতে পরতে যত্ন করে রাখা ইতিহাসের পাতা। ভিসিগথ থেকে রোমান সাম্রাজ্য, ইসলামিক প্রাসাদ থেকে অরসন ওয়েলেসের লা সিউদাদের বিশ্রাম গৃহ, সব অক্ষত। এই রুচিশীলতার ঐক্যবদ্ধ চেতনাতেই এখানের অধিবাসীদের আনন্দের বীজ লুকিয়ে আছে। 


৩) চল্লিশ বছর আগে যখন রোজগারের অভাবে গ্রামাঞ্চলের লোকেরা শহরের দিকে পলায়ন করেছিল, তখন থেকেই ইউরোপের নানান জায়গায় গ্রামীণ পর্যটন আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। স্পেনের লোকেরা চিরকালই আমুদে, বিদেশী অতিথিদের পরিবারের অভিন্ন অংশ করে নিতে তাদের দু’বার ভাবতে হয় না। ফ্রাঙ্কোর স্বৈরতন্ত্র চলাকালীন ইউরোপ আমেরিকার নানান সাংবাদিক, লেখকেরা এখানে এসে এই আন্তরিক আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। ক্রমে সে কথা ছড়িয়ে যায়, পর্যটকদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আন্তরিক ব্যবহারের চাহিদা পেশাদারী সৌজন্যর চেয়ে অনেক বেশি। যারা পয়সা খরচ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে বেরিয়েছে, আঞ্চলিক সংস্কৃতির স্বাদ পেলে তারা আর কিছুই চায় না। 

পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক গ্রামগুলোর সংস্কার শুরু হয়, সরকারের সাহায্য নিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয় প্রাচীন স্থাপত্যের। গ্রামের লোকেদের বাড়িতে কম পয়সায় শুরু করা বেড এন্ড ব্রেকফাস্টের চাহিদা আজ সারা পৃথিবীতে। অনেকেই শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসেছে। রিভার্স মাইগ্রেশন। অর্থাভাব নেই তেমন। কেউ ছোট্ট ক্যাফে অথবা হস্তশিল্পের দোকান খুলেছে,  অনেকে বাড়ির তৈরি খাবারের স্টল দিয়েছে। অনেকে গাইড হয়ে টুরিস্টদের বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের জায়গায়। প্যারাগ্লাইডিং থেকে সাইক্লিং, কার্নিভাল অপেরা থেকে ফিয়েস্তা ক্লদিং, সকলেই নিজের মত করে রোজগারের রাস্তা তৈরি করার চেষ্টা করে এখানে। 

হাঁটতে হাঁটতে আমরা শহরের অন্য প্রান্তে এসে পড়েছি ততক্ষণে। সেইদিকে ব্রান্ডের বড় বড় দোকানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আঞ্চলিক বুটিকদের ছড়াছড়ি। আইসক্রিমের দোকানে সবচেয়ে বেশি ভিড়। গরমের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে সকলের হাতেই 'জেলাদো'। এই জেলাদো কিন্তু ইতালির 'জেলাতো' নয়। এ হল এখানকার খাস কমলালেবু স্বাদের কাঠি আইসক্রিম। ঘুরতে ঘুরতে প্লাজা ডেল আহেরোতে এসে গেছি। কাছেই বাস স্টেশন। আমাদের ফিরে যাওয়ার কথা আজই। 

ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসে পড়লাম। জনবহুল রাস্তা চলেছে যাত্রীদের নিয়ে। প্রশস্ত চাতাল থেকে দূরের পাহাড় দেখা যায়। ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চলেছে আবেগহীন পর্যটনকে। রন্দা যেন আর চারটে শহরের মত 'সেল্ফি মঞ্জিল'-এ না পরিণত হয়। এই শহরের সুনাম আছে স্বপ্ন দেখার শহর বলে। যাদের চোখে স্বপ্ন আছে, তারাই এখানকার জাদু বুঝতে পারে। বাকিরা পাহাড় আর গিরিখাত দেখেই ফিরে যায়। রন্দার জন্যে ভালবাসা বেঁচে থাক হেমিংওয়ে আর ওয়েলেসের মত শিল্পীদের,  বেঁচে থাক তাদের স্বপ্ন। আমরা যেন আবার ফিরে আসতে পারি,  স্বপ্ন দেখতে পারি খোলা চোখে। এমনিই থেকো প্রিয় শহর, আবার দেখা হবে!

Image result for white villages andalucia
Puebo Blaco- White Villages

Image result for ronda spain
An walk in serenity


(ক্রমশঃ)


যাত্রার পরের অংশ

গ্রানাদা-প্রথম পর্ব

যাত্রার শুরু থেকে পড়তে হলে 

বই কিনতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

সুন্দরী সেভিয়া

সৌধ, শিল্প ও অভিযান— আন্দালুসিয়ার ইতিবৃত্ত

                                                                                Seville

আমি স্তবকের রহস্য বুঝতে শিখেছি

রহস্যের বয়ান যারা নিজেরাই দিয়ে চলে

শুন্যতা জড়িয়ে থাকা লোভ শুধু রেখেছি

সময়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখা জাঁতাকলে


~লিওপোল্ড মারিয়া পানেরো


১) কয়েক মুহূর্ত স্মৃতি, কিছু আবেগী সম্পর্কের পিছুটান, আর মুষ্টিময় বন্ধু। এইটুকু ছাড়া সঞ্চয় বলতে মানুষের জীবনে যা আছে, সবই মরীচিকা। অর্থ আর যশ আমাদের আলেয়ার মত ছুটিয়ে নিয়ে চলে শুধু, কিন্তু এই অবিরাম জীবনস্রোত আর বৈষয়িক আসক্তি আমাদের জিরোতে দেয় না দু’দন্ড। বাস্তব সঞ্চয়ের ভাঁড় শুন্যই থেকে যায়, বেলাশেষে অভিজ্ঞতার নিরিখে আমাদের হাতে রয়ে যায় কয়েক ঢেলা চকমকি পাথর। 

অভিজ্ঞতার সঞ্চয় পর্বে যেন কোনও আফসোস না থেকে যায়, সেই অভিসন্ধি নিয়ে চলেছি সেভিয়া। পর্তুগালের লাগোস থেকে বাসে করে সেভিয়া আসতে ঘন্টা চার পাঁচের বেশি লাগে না। পথে পড়েছে ফারো, আলগ্রেভের রাজধানী। একসময় পর্তুগাল পেরিয়ে আমরা আবার ঢুকে পড়েছি স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলে। যার পোশাকি নাম আন্দালুসিয়া।   

স্পেনের অন্যতম রাজ্য এই আন্দালুসিয়া। সেই কবে সেভিয়ার বন্দর থেকে স্পানিয়ার্ডদের বিজয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাস থেকে ম্যাগেলান, কে না পাড়ি দিয়েছে এখানকার বন্দর থেকে? নতুন অভিযানের পরিকল্পনা সর্বদাই চলতে থাকত সেভিয়াতে। স্থাপত্য থেকে শুরু করে সাহিত্য, গান, কবিতা, ফ্লামেঙ্কো নৃত্য…প্রতিটা ক্ষেত্রেই আন্দালুসিয়ার সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক মহত্ত্ব অপরিসীম। এককালে মুরদের হাতে নির্মাণ করা মুদেহার স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ কিছু দৃষ্টান্ত আজও সারা পৃথিবীকে বিস্মিত করে চলেছে। অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত আলকাজার দে সেভিয়া আর অন্যান্য প্রাসাদ এবং কেল্লার মধ্যে যে সমস্ত অপরূপ নকশা খোদাই করা হয়েছিল, তার অধিকাংশই আজ হয় খলিফা আলমোহাদ, নয় স্প্যানিশ কনকোয়েস্টে ক্রিশ্চানদের হাতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে মুদেহার স্থাপত্যের সঙ্গে তাতে যোগ হয়েছে গথিক, রোমান্টিক আর রেনেসাঁ শৈলীর কারিগরি। এই বদল সত্ত্বেও মুদেহার শৈলীর চিহ্ন মুছে যায়নি, বরং পাঁচমিশালি শিল্পের সংমিশ্রণে যেন তাদের রূপ আরো বেশি করে খুলেছে।  

ইদানীং কালে সেভিয়া স্পেনের লোক সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করার আদর্শ স্থান এবং পর্যটনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেভিয়া আর গ্রানাদাকে আন্দালুসিয়ার সংস্কৃতির ধ্বজাবাহী বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। প্রাচীন কাল থেকেই আন্দালুসিয়া ছিল শিল্পী এবং সাহিত্যিকদের প্রিয়। এখানকার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যেই হোক অথবা মনোমুগ্ধকর ভূদৃশ্যের জন্যে, প্রতি শতাব্দীতে ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে নামকরা লেখক, কবি, চিত্রকর, মূর্তিকার, চলচ্চিত্র পরিচালকেরা এখানে এসেছেন, পরবর্তীতে তাদের এই সাধের জায়গা সম্পর্কে স্মৃতিচারণও করেছেন বারংবার। সমুদ্র সমীরণের স্পর্শে মাতোয়ারা মন কেবলই ছুটে যেতে চায় প্রিয় শহর বা গ্রামে। মোরোক্কন বাতাসের আভাস পাওয়া যায়  মালাগায়, ইতিহাসের সঙ্গে কানামাছি খেলা যায় কর্ডোবাতে। জিব্রাল্টরও খুব একটা দূরে নয়। আন্দালুসিয়ার ছোট ছোট গ্রাম আর মফস্বলগুলো যেন জাদুর ছড়ি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে কেউ। এখানকার মন ভালো করে কুড়মুড়ে হাওয়ায় যেন শুনতে পাওয়া যায় জিপসিদের বিরহসঙ্গীতের সুর। কমলা রঙে মোড়া থাকে গাছের আদুর গা, জাফরি কাটা বীথিকায় আলোছায়া খেলে শহরের রাস্তায়। 

সেভিয়া আসলে জমজ নগরী। গুয়াদিলকিভির নদীর এক ধারে সেভিয়া,  অন্য ধারে ত্রিয়ানা। লোকে কাজকর্মে নদী পেরোচ্ছে প্রতিদিনই, অনেকেই আবার কায়াক নিয়ে নদীর জলে শরীরচর্চা করতে নেমে পড়েছে। গ্রীষ্মকাল বলে কথা। স্রোত কেটে তারা নৌকো চালিয়ে চলেছে দিব্যি। যারা আমুদে বা অলস, তারা নদীর ধরে ঘাসের ওপর শুয়ে গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়েছে। এই দৃশ্য আমরা বাস থেকেই দেখতে পেলাম শহরে ঢোকার মুখে। 

এখানে আমাদের বেশ কয়েকদিন থাকার কথা। সেভিয়ার সান্তা ক্রুজ এলাকা সারা বিশ্বে বিখ্যাত, তা ছাড়াও প্রাচীন শহরের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন যুগের। 

প্লাজা দে আর্মাস বাস স্টপে নেমে শহরের ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে কাইয়ে ফুয়েন্তেওভেহুনা যাওয়ার সময় শহরের খানিকটা চেহারা চোখে ধরা পড়ল। আন্দালুসিয়ার সবচেয়ে বড় শহর হলেও এখানে একটা আয়েশি মেজাজ আছে। কাজকর্ম থাকলেও অন্য বড় শহরের মত জনস্রোত নেই, বরং একটা বৈঠকি ‘লেডব্যাক’ আমেজ। এই অঞ্চলে 'সিয়েস্তা' জনপ্রিয়,  দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সকলেই খানিকক্ষণ গড়িয়ে নেয়। অনেক দোকানপাটই এই দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দূরে বন্ধ। নির্দিষ্ট পাড়ায় পৌছে ফোন করা হল পাবলোকে। পাবলো আর দাভিদ সেভিয়াতে আমাদের হোস্ট, তাদের বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। 

পাবলো ফোনে জানাল যে সে একটু কাজে আটকে গেছে, কিন্তু তার রুমমেট মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই দেখলাম একটি আমাদের সমবয়সী ছেলে হাসিমুখে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমাদের কাছে সে তার পরিচয় দিল,  তার নাম দাভিদ। পাবলো আর সে একসঙ্গে এই অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়া নিয়েছে। দাভিদকে দেখতে বেশ সুন্দর, সুঠাম নায়কসুলভ চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখে তার ব্যবহার। কয়েকজনের চেহারার মধ্যেই একটা সহজ, খোলামেলা বন্ধুভাব থাকে। এই সফরে দাভিদের সঙ্গে আমাদের যত খোলাখুলিভাবে আড্ডা হয়েছে, অনেকদিনের পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গেও সবসময় সেরকম হয় না। কোথায় বলা হয় “A journey is best measured in friends, not in miles.” আর কিছু না হোক, ভাগ্যের সেই পরীক্ষায় অন্তত আমরা সাফল্য পেয়েছি, সেটা ভেবেই মন ভালো হয়ে যায়। আজ কয়েক বছর পর দাভিদের সঙ্গে অনলাইন আড্ডা দেওয়ার সময় সেভিয়ার সেই দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে। 

দাভিদের হাতে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স, সেটা সামলে চাবি খুলতে খুলতে সে বলল, “তা এই হল আমাদের বাড়ি, আর এখন তো তোমাদেরও বাড়ি।” তার ওইটুকু কথাতেই এমন একটা আন্তরিকতা ছিল যে আমাদের যাবতীয় আড়ষ্ট ভাব কেটে গেল। 

দাভিদ আর পাবলোর ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। রান্নাঘর, হল ছাড়াও তিনটে ঘর আছে। আমাদের সেইদিন আর বেরোনোর কথা ছিল না। দাভিদ বলে দিয়েছে কোনোরকম সংকোচ না করতে। ফ্রিজের খাবার, মশলাপাতি সবই ব্যবহার করা যাবে নিশ্চিন্তে। রান্নাঘরে গিয়ে জম্পেশ করে খানিকটা ম্যাগি আর চায়ের ব্যবস্থা করা হল। দাভিদ ততক্ষণে তার বেয়াল্লিশ ইঞ্চি টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ চালিয়ে বসেছে। টুক টুক করে গল্প চলতে লাগল তার সঙ্গে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই বুঝতে পারলাম তার জীবন যাত্রা অনেকটাই আমাদের মত। পুরোটা না হলেও আমাদের লাইফস্টাইল প্রায় চোদ্দআনা একইরকম। কাদিজের ছেলে, সেভিয়া থেকে শ’খানেক কিলোমিটার দূরের সেই বন্দর শহর ছেড়ে ভালো কাজের আশায় এখানে এসে থাকতে শুরু করেছে। 

কথায় কথায় দাভিদ বলল, “স্পেনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ছাত্র আইন নিয়ে পড়ে। তোমাদের যেমন পাড়ায় পাড়ায় ইঞ্জিনিয়ার দেখতে পাওয়া যায় আজকাল, স্পেনে সেরকম উকিল গিজগিজ করছে। সেই কারণে এই পেশায় প্রতিস্পর্ধাও বেড়ে গেছে। পাবলো আর আমি দুজনেই ওকালতি পড়েছি, কিন্তু ভালো চাকরি পেতে তাদের দুজনকেই দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে। কাজের চাপ এতই বেশি ছিল যে প্রায়ই অনেক রাত করে বাড়ি আসতাম। নিজের জন্যে সময় থাকত না একটুও। শেষমেশ বছর খানেক আগে চাকরি ছেড়ে নিজের ছোট্ট একটা ‘ল ফার্ম’ খুলেছি।”

সঙ্গিনী জিগ্গেস করলেন, “চাকরি কি পাবলোও ছেড়েছে?”

দাভিদ হেসে বলল, “পাবলো ব্যাটা এখনও ওখানেই রগরাচ্ছে। আমার চেয়ে বেশিই রোজগার করে বটে, কিন্তু কাজের বড্ড চাপ বেচারার। অফিসের কাজে সে শহরের বাইরে গেছে আজ। আগামী দু’দিনের মধ্যে ব্যাটা বাড়িও ফিরবে না।”

অবিকল আমাদের জীবন। কর্পোরেট স্ট্রেস হ্যান্ডল করা সকলের কম্ম নয়। ব্যাঙ্গালোরে থাকার সময়ে রেগেমেগে অনেককেই চাকরি ছাড়তে দেখেছি, আমি নিজেও সেই পথের পথিক। তাদের অনেকে স্টার্টআপ খুলে বসেছে। কয়েকজন অবশ্য ধোপার গাধার মতো লাথিঝাঁটা খেয়েও টিকে গিয়েছে। উচ্চপদস্থ চাকরি না করলে নাকি জীবন বরবাদ! 

দাভিদের কাছে এও জানতে পারলাম যে সেভিয়া দামি শহর হলেও স্পেনের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটাই অন্যরকম। শান্তিবহুল আর প্রগতিশীল স্বভাবের লোকজন থাকে বলে অনেকেই আজকাল ছোট শহর ছেড়ে এইখানে চলে আসে। দাভিদের বান্ধবী ক্যাটেরিনা আবার পর্তুগালের মেয়ে, সেও আজকাল সেভিয়াতে থেকে ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়াশুনা করছে। দাভিদ আমাদের মতই নেটফ্লিক্স আর আমাজন প্রাইমের ভক্ত, সিনেমার পোকা। আমার সঙ্গিনী মুখে স্প্যানিশ শুনে সে মহা খুশি হয়ে নানান কথা বলে যেতে লাগল। আমাদের হাতে  কোনও  কাজ নেই, রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা চলতে লাগল নির্বিঘ্নে। খেলা, সিনেমা, দেশকাল, খাবার, ভাষার মিল অমিল...নানান কথায় কোথা থেকে সময় কেটে গেল বোঝাই গেল না। দেশে খুব গভীর বন্ধুদের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলে যেরকম সময়ের জ্ঞান থাকে না, দাভিদের সঙ্গে কথা বলে আমার সেরকমই মনে হল। কে বলবে ঘন্টা চারেক আগেই ওর সঙ্গে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছে?


২) পরের দিন সকালে উঠে বেরোতে বেরোতে খানিকটা দেরিই হয়ে গেল। এখান থেকে আমরা যাব নদীর তীরের কাছে ওল্ড সিটিতে, পায়ে হেঁটে যেতে মিনিট কুড়ি পঁচিশের বেশি লাগে না। বড় রাস্তা পেরিয়ে সান্তা ক্রূজ অঞ্চলে ঢুকে চললুম গির্জার দিকে। পরিষ্কার ঝকঝকে সরু সরু গলি, হলদে কমলা রঙের বাড়ি... হাঁটতে বেশ লাগে। 

একসময় সেভিয়া বন্দরের প্রতিপত্তি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে ইউরোপের প্রতিটা দেশ এখানে এসে সেভিয়ার ব্যবসাদারদের তোয়াজ করতে বাধ্য হত। ১৪৯২ সালে নতুন পৃথিবীর অভিযানের পর থেকেই বাকি পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করার একচেটিয়া অধিকার দখল করে নেয় এই বন্দর। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্ত থেকে পৌঁছানো জিনিসপত্র, মশলা, হস্তশিল্প সব কিছুই এসে ডাঁই হত সেভিয়ার বন্দরে। আমেরিকা আর এশিয়ার স্প্যানিশ কলোনি থেকে মালপত্তর সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এখানেই আসত, অতএব বন্দর প্রশাসনকে তোয়াজ না করে উপায় কী? চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একসময়য় কাদিজ বন্দর থেকেও ব্যবসার জন্যে জাহাজ সমুদ্রে যেতে শুরু করে। এই প্রসঙ্গে জানাই, এই সেই বন্দর যেখানে কাজ নিয়েছিলেন মিগেল সার্ভেন্তিস, তখনও তিনি ডন কিহোতে লেখায় হাত দেননি। সত্যি বলতে, আন্দালুসিয়ার বাতাসেই এমন একটা সাবেকি আর রোমান্টিক ব্যাপার আছে যে কবি সাহিত্যিকদের কলম আপনাআপনি পরিমার্জিত হয়ে ওঠে। আধুনিক যুগের সবচেয়ে নামকরা স্প্যানিশ কবি এবং বহুচর্চিত ব্যক্তিত্ব ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকার 'জিপসি ব্যালাড' থেকে কয়েকটি কবিতার লাইন পড়লেই অনুমান করা যায় কী ভাবে এখানকার পরিবেশ তার কলমকে মুগ্ধ করেছিল। জিপসি ব্যালাড থেকে কয়েক লাইন তুলে দিলাম...

“It will be a long time, if ever, before there is born an Andalusian so true, so rich in adventure. I sing of his elegance with words that groan, and I remember a sad breeze through the olive trees."  

১৯২৭ সালে যখন দেশে চরম অরাজকতা চলছে, সারা দেশ থেকে লেখক আর কবিরা এসে সমবেত হয়েছিলেন সেভিয়াতে। শুরু হয়েছিল ‘জেনারেশন অফ ২৭’। কবিতা নাটক চিত্রনাট্য ছোটগল্প উপন্যাসের চিরাচরিত স্টাইল ভেঙে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে আগ্রহী এই সাহিত্য আন্দোলনে কে ছিলেন না? লোরকা তো ছিলেনই, সঙ্গে ছিলেন নামকরা কবি আর ভাষাবিদ হোর্হে গুলিয়েন, ছিলেন রাফায়েল আলবের্তি, সুরিয়েলিস্টিক স্টাইলের ভক্ত কবি ভিসেন্তে আলিহেন্দ্রে, স্টাইলিস্টের প্রতিষ্ঠাতা আমাদো আলোনসো, পেদ্রো সালিনাস, ডামাসো আলোনসো, এমিলিও প্রাদোস প্রভৃতি। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন শুধু কবিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, লুই বুনুয়েল আর সালভাদোর দালির মত শিল্পীরাও যোগ দিয়েছিলেন এই মুভমেন্টে। কিন্তু এই শিল্পী আর সাহিত্য বিপ্লবীরা জানতেন না যে তাদের এই বিপ্লব কয়েক বছরের মধ্যেই ছারখার হয়ে যাবে!

এক দশকের মধ্যেই স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আন্দোলনের অনেক কবিই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী অথবা বামপন্থী। সুযোগ বুঝে দক্ষিনপন্থী লোকেরা বামপন্থী মানুষ ও লেখকদের খুন করতে শুরু করল, অন্যদিকে ফ্রাঙ্কোর দল দক্ষিনপন্থী সাহিত্যিকদের রেহাই দিল না। সে এক ভয়ানক সময়। কবে, কে মারা পড়বে বা নিখোঁজ হয়ে যাবে, কেউ জানে না। দেশের লোক পথে নামতে হলে চারবার ভাবে। অধ্যাপক আর শিক্ষাবিদরা মারা পড়ছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন সাহিত্যিকরাও। কিন্তু লোরকার মতো মানবদরদী কবিকেও যে রাজনীতি গ্রাস করবে, সেটা কেউই ভাবেনি। কিন্তু ভবিতব্যকে টলাবে কে? লোরকাকেও রেহাই দিল না খুনিরা। সংশয় ছিল আগে থেকেই, কিন্তু গার্সিয়া লোরকার হত্যার পর সকলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। লোরকাকে সকলে একনামে চিনত, তাঁকে কেউ খুন করবে কেন? দক্ষিণপন্থীরা তাঁকে মারার কথা জোর গলায় অস্বীকার করল, অন্যদিকে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর দলও মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। আজ পর্যন্ত এই রহস্যের সমাধান হয়নি। ন্যাশনালিস্ট পার্টি নিজের সমর্থক একজন কবিকে কেন সরিয়ে দিতে চাইবেন তার কোনও যুক্তিযুক্ত ব্যাখাও পাওয়া যায়নি! আবার দক্ষিনপন্থী রিপাপলিকদের অপরাধেরও  কোনও  প্রমাণ মেলেনি। 

অনেকের মতে লোরকা বামপন্থী হলেও আগে একজন কবি ছিলেন, তিনি পার্টিলাইনের নির্দেশের চেয়ে মানুষের জীবনকে গুরুত্ব দিতেন বেশি। অধিকাংশ মামলায় দেখা গিয়েছে তাঁর আদর্শ ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে মিলত না। যাই হোক, প্রচলিত ধারণা হল তাঁকে সমকামী অপবাদ দিয়ে গুপ্তহত্যা করে ফ্রাঙ্কোর সমর্থকরা। এই ঘটনার পর থেকে এক এক করে কবি সাহিত্যিকেরা প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করলেন। যারা রয়ে গেলেন তারা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে লেখালিখি একেবারে বন্ধ করে দিলেন। স্পেনে সাহিত্যের যে অগ্নিশিখা জগমগ করছিল এতকাল, তা নিভতে বসল। গল্প কবিতা লেখার ফলে শুলে চড়তে হলে আর কে কলম ধরবে? 

মাঝে মাঝে কয়েকদিনের জন্যে ছোট ছোট সাহিত্যের কিছু স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়, আবার রাজনৈতিক অস্থিরতাতে তা হারিয়ে যায়। এইজন্য দেখা যায় আধুনিক যুগের হিস্প্যানিক সাহিত্যে অধিকাংশই লাতিন আমেরিকার কবি আর লেখকরা খ্যাতিলাভ করেছেন। তাঁদের অনেকেই সেখানকার আদি বাসিন্দা নয়, বরং স্পেনের নাগরিক। গৃহযুদ্ধের সময়ে স্পেনের সাহিত্যিকরা হয় আর্জেন্টিনা নয় মেক্সিকোর মতো স্প্যানিশভাষী  দক্ষিণ আমেরিকার দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন; অথবা অধ্যাপনার কাজ নিয়েছিলেন ইউরোপ কিংবা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি হোয়ান রামোন হিমেনেথ গৃহযুদ্ধের পর পুয়ের্তো রিকো চলে গিয়েছিলেন, সেকালের শ্রেষ্ঠ কবি আন্তোনিও মাচাদো প্যারিসে যাওয়ার পথে নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা যান, কামিলো হোসে সেলাকে প্রাণ বাঁচানোর খাতিরে শেষমেশ আর্জেন্টিনা চলে যেতে হয়েছিল। ১৯৩০ থেকে ১৯৯০ সালে মধ্যে মাত্র তিনজন স্প্যানিশ সাহিত্যিককে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তাদের প্রত্যেককেই স্পেন ঠেকে নির্বাসিত হয়ে অথবা যথাসম্ভব গোপনীয়তা অবলম্বন করে জীবন কাটাতে হয়েছে। লক্ষ্য করার কথা হল, এদের সকলের সঙ্গেই আন্দালুসিয়ার গভীর যোগাযোগ ছিল। সকলেরই জন্ম, নয় পড়াশুনা হয়েছিল সেভিয়াতে। 

‘আইরনি’ আর কাকে বলে? যে সময়ে স্পেনে গৃহযুদ্ধ আচলছে, সেই একই সময়ে দেখতে গেলে ইউরোপে ফরাসি সাহিত্য আর শিল্প ফুলেফেঁপে উঠেছিল। দূরত্বের দিক থেকে দেখতে গেলে ফ্রান্স তো স্পেনের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। সেখানে হাজার হাজার কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, শিল্পী কাজ করছেন অভিনব সব বিষয়বস্তু নিয়ে, সেই লেখার ইংরেজি অনুবাদ করতেও ফরাসিরা পিছপা হয়নি। ইংরেজির পর স্প্যানিশভাষী পাঠক সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি হলেও স্প্যানিশ সাহিত্যের অনুবাদ খুব কমই হয়েছে। ফ্রাঙ্কোর রাজত্বের পর দিন ফিরলেও সেইভাবে স্প্যানিশ লেখকেরা বিশ্বলেখক হয়ে উঠতে পারেনি। দক্ষিণ আমেরিকার অক্টাভিও পাজ, পাবলো নেরুদা অথবা মার্কেসের মতো জনপ্রিয় সাহিত্যিকের কাজগুলো বাদেও কত অজানা সাহিত্যের ফসল যে এই ভাষায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সে খবর খুব বেশি লোকে জানেও না।  

আন্তোনিও মাচাদো ব্যক্তিগত ভাবে আমার প্রিয় কবি, তার সহজ সরল কবিতাগুলো পড়লে বিশ্বসাহিত্যের সেরা লেখাকে টেক্কা দিতে পারে, কিন্তু অনুবাদ সাহিত্যের অভাবে খুব কম লেখাই সাধারণ মানুষের সামনে আসতে পেরেছে। যেমন… 


সোরিয়া, নীল পাহাড়ে,  

বেগুনি প্রান্তরের কোলে,  

কত ঘন ঘন আমি তোমার স্বপ্ন দেখেছি

যেখানে ফুলের সমভূমি  

গুয়াদিলকিভির বয়ে যায়

অতীতের সুবর্ণ কমলা গাছ বেয়ে

সাগরের দিকে… 

চমৎকার রৌদ্রস্নাত দিন। আমরা গলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে গুগলদার সাহায্যে পৌঁছে গেছি নদীর ঠিক সামনে তোরে ডেল ওরোর কাছাকাছি। আজকাল স্পেনে বুলফাইটের নিষ্ঠূর খেলা অনেক কমেছে, তাও কয়েক জায়গায় বিরাট বিরাট বুলফাইটিং রিঙ তৈরি করা আছে। সাপ্তাহিক আয়োজনে বুলফাইটিং দেখতে দেশ বিদেশের লোকেরা ভিড় জমায় এখনও। আমাদের সামনেই একটা বুলফাইটিং রিংয়ের হলুদ রঙের অনাড়ম্বর গোল চত্বর, বাইরে একটা ছোট্ট মিউজিয়ামে কিছু স্মৃতিবিজাড়িত ঐতিহাসিক দ্ৰব্যসামগ্রীর প্রদর্শনী হচ্ছে। খেলা দেখতে গেলে অথবা রিঙের সামনে যেতে গেলে গলাকাটা পঁচিশ ইউরো টিকিট। বুলফাইটিং নিয়ে আমাদের উৎসাহ নেই, ভিতরে যাওয়ার ইচ্ছেও নেই, অতএব গুটি গুটি পায়ে সেখান থেকে সরে পড়লাম। কাছেই একটা ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর চলছে, ঘুরতে ফিরতে খানিক ইতিহাসের আদল বুঝতে খারাপ লাগবে না, ঝুলে পড়লুম সেখানে। 

গাইডের নাম রক্সি। ইতিহাসের বিবরণ আগেই চলছিল, এখন আমরা পায়ে পায়ে এগোতে শুরু করেছি গির্জার দিকে। সেভিয়ার গির্জার কথা ক্রিশ্চান মাত্রেই জানে, লা গিরালদা টাওয়ার সহ এই গির্জা আয়তন হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা। আয়তনের কথা না ধরলেও রোম আর লন্ডনের পরেই তিন নম্বর জায়গা দখল করে পথচারীদের তাক লাগাতে বাধ্য করে সেভিয়ার সুউচ্চ ক্যাথেড্রাল। গির্জার কথা যখন উঠেছেই, একটা কথা খোলসা করে বলে নেওয়া প্রয়োজন। 

ইউরোপের প্রতিটা শহরেই একটা বিশেষ ধাঁচ আছে। বিশেষ করে যেখানে ক্রিশ্চানরা শহর নির্মাণ করেছে। শহরের একপ্রান্তে একটা ওল্ড টাউন যেখানে প্রধান গির্জা থাকে, সেই ওল্ড টাউনের মধ্যে কয়েকটা প্লাজা অথবা স্কোয়ার, চারিদিকে ঐতিহাসিক বাড়িঘরের জীবন্ত ইতিহাস রঙিন হয়ে থাকে সুপরিকল্পিত পুন:সংস্কারে। এ ছাড়া অনেক শহরেই একটা করে ল্যাটিন কোয়ার্টার আর ইহুদি পাড়া অর্থাৎ ‘জিউস টাউন’ আছে। শহরের প্রাণ কেন্দ্র বলতে এই জায়গাগুলোই, যেখানে পর্যটকের দল ছবির পর ছবি তুলে যায়, সেলফি স্টিকের কেরামতির সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকে বাস্কিং-এর শিল্পীদের অবাধ সুরসাধনা অথবা রেস্তোরাঁর আমোদ। এই কথা শুনে অথবা পড়ে মনে হতেই পারে যে প্রতিটা শহর একইরকম, কিন্তু সেটা একেবারেই নয়। এক ধারার সাহিত্য হলেও যেরকম প্রতিটা গল্প অন্যরকম হয়, এক রাগের গান হলেও যেমন প্রতিটা গান পৃথক হয়,  সেরকমই গির্জা, প্লাজা অথবা ওল্ড টাউনের থাকলেও এই প্রতিটা শহরের নিজস্ব ঘরানা আছে, আছে স্বতন্ত্র মানসিকতা। 

প্রতিবার নতুন একটা গির্জা দেখার আগে আমার মনে হয়, 'ওহ, আবার সেই গির্জা!' কিন্তু অদ্ভুতভাবে প্রথম দর্শনেই কিন্তু আবার মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি সেই গির্জার দিকে। একবারের জন্যেও একঘেয়েমি অথবা আলসেমি আসে না মনে। আমার ক্রিশ্চান ধর্ম নিয়ে খুব বেশি জ্ঞান বা আগ্রহ নেই, কিন্তু এক একটা শহরের সঙ্গে ‘কানেক্ট’ করার সৎ ইচ্ছে ষোলআনা আছে। মনে মনে জানি, এই গির্জাগুলো যতটা না ধর্মস্থান, তার চেয়েও বেশি শহরের সংস্কৃতির বাহক। এখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে এই গির্জাগুলো, তাদের স্মৃতিতে এই জায়গাগুলোর বিশেষ স্থান অধিকার করে। পাড়ার পুজোমন্ডপ বা পুকুরের ধারে বটতলার ভাঙা শিবমন্দির যেভাবে আমাদের শৈশবের নস্টলজিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে যায়, অনেকটা সেরকম। তার সঙ্গে মিশে গিয়েছে শিল্পের প্রতি ভালোবাসাও। এই বিশিষ্ট আর সুবিদিত চরিত্রের জন্যেই এখানে ক্রিশ্চান ধর্মকে ছাপিয়ে যায় তাদের শিল্পের দক্ষতা, আম জনতার আবেগ। এক একটা পাথরের আঘাতে যে পরিশ্রম, অভিলাষ আর হারিয়ে যাওয়া গল্পের ছায়া অনুভব করতে পারি, তার জোরেই বার বার বিস্মিত হতে হয়। 

সেভিয়াতেও তার অন্যথা হল না। গির্জার দিকে প্রথম চোখ পড়তেই সেই কমনীয় বিস্ময় আবার আমাকে নাড়া দিয়ে গেল। কী করে এইসব বৃহৎ অথচ সুদৃশ্য নির্মাণ করেছে সে যুগের লোকেরা? যখন প্রযুক্তি উন্নত ছিল না আজকের মতো, ভারী পাথর তোলার ব্যবস্থাও ছিল না! এত বিশদ আর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে এক একটা পাথরের ওপর কারুকাজ পল্লবিত করা হয়েছে যে চোখ সরতে চায় না। এককালে মুসলমান শাসকদের মসজিদ ছিল এখানে, সেটাকেই পুনঃসংস্কার করে প্রধান চার্চের কাছে নতুন গির্জা বানানোর আবেদন করে এখানের লোকেরা। 

রক্সি তখন বলে চলেছে, “রিকনকোয়েস্টের পর যখন সেভিয়া ব্যবসায়িক বন্দর হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করছে, ঘটনাটা সে সময়ের। চিঠিতে লিখে পাঠানো হয় যে এই শহরে এমন একটা অসামান্য গির্জা তৈরি করা হোক যা দেখে সারা পৃথিবীর লোকে পাগল হয়ে যাবে। সেকালে এর চেয়ে বিপুলায়তন গথিক গির্জা সারা পৃথিবীতে ছিল না। পনেরোটা সুসজ্জিত দ্বার আর আশিটা চ্যাপেল যুক্ত এই গির্জার ভিতরেই সমাধিস্থ করা হয় ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে।”

গির্জার সামনে প্রশস্ত চত্বর, সেখানে লোকের মেলা। রক্সির সঙ্গে আমরা ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি রয়্যাল আলকাজারের সামনে। সাতসকালেই টিকিট নেওয়ার জন্য লম্বা লাইন পড়েছে। মুদেহার স্থাপত্যের সেরা কাজ দেখতে হলে পৃথিবীতে আজ যতগুলো প্রাসাদ অথবা অট্টালিকা আছে, সেভিয়ার আলকাজার তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে। এর কাছেই পালাসিও দে লাস দুয়েনাসে রেনেসাঁ-মুদেহার স্থাপত্যে তৈরি করা বোগেনভিলিয়া আর ফুলের বাগান সহ ছোট্ট প্রাসাদ আছে। রক্সি আমাদের বলল এই সময়ে টিকিট পাওয়া খুবই ভাগ্যের কথা, ঘন্টাতিনেক দাঁড়ালে যদি ভাগ্য সহায় হয়। 

তাই বলে হতাশ হওয়ার কোনও কারণ অবশ্য নেই। প্রাসাদের ভিতরে না গেলেও সারা চত্বর জুড়ে এদিক সেদিকে মনোগ্রাহী ইমারতের ছড়াছড়ি। কমলা আর সাদা রঙে সজ্জিত ভবনগুলোর কালো নকশাদার অলিন্দের ফাঁক দিয়ে রঙিন আলো প্রতিফলিত হয়ে রাস্তায় পড়ছে। প্রতিটা ব্যালকনিতে ফুলের গাছ। থোকা থোকা রঙিন ফুলে গাছের লতাগুলো নুয়ে পড়েছে। এরই মাঝে বসে গেছে কফি আর চুরোসের মজলিশ। 'চুরোস' অনেকটা লম্বা নিমকির মতো দেখতে, ওপরে চিনির গুঁড়ো ছড়িয়ে আইসক্রিম অথবা চকোলেটে ডিপ করে খেতে হয়। চুরোসের কামড় দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আসন্ন ফুটবল বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচের ভবিষ্যদ্বাণী চলছে। স্পেনের লোকেরা ইংরেজদের মত আস্তে আস্তে কথা বলার পরোয়া করে না, জোর গলায় প্রিয় টীমের জন্যে গলা ফাটানোয় আবেগের পাত্র উথলে উঠছে। টাটকা কমলালেবুর রস ঢালা হয়েছে টেবিলের পাত্রতে, রাস্তার দুধারেও কমলালেবু গাছ। এখনও কৈশোরপালন করছে বাচ্চালেবু, কমলার ছাপ তাদের গায়ে লাগেনি। 

এই সব দেখে আমার স্প্যানিশ সঙ্গিনীর আনন্দ আর ধরে না। স্পেনে এসেই তাঁর ফুর্তি বেড়ে গেছে ভাষার সাবলীলতার জন্যে, এখন ‘তেনার’ চালচলন দেখে মনে হচ্ছে হয়তো মুকুলের মত তিনিও জাতিস্বর। কে বলতে পারে, আগের জন্মে হয়তো সেনোরিতা এইখানেই জন্মেছিলেন।

হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, "আহা! কী সুন্দর বাসন্তী রোদ! আমাদের পচা রোদ্দুর নয়! একেই বলে সানি স্টে!"

'সানি স্টে' কথাটা শুনেই আমার মনে পদ্য ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। সেনোরিতার কোনোদিকে খেয়াল নেই, তিনি দিব্যি হেঁটে যাচ্ছেন। দূরে একটা সাদা রঙের দেওয়াল দেখছি, সিরামিক টাইলের কারুকাজ আছে। সেদিকপানেই হাঁটছিলাম, এমন সময় দেখি সামনে একজন হোঁতকা লোক আমাদের গার্ড করে দাঁড়াল। ইশারায় দেখিয়ে দিল অন্য পথ। আড়চোখে দেখলাম, জায়গাটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত কমলালেবুর চারা লাগানো চলছে রাস্তার ধারে। রেনোভেশনও হতে পারে। এখানে সর্বদাই রক্ষণাবেক্ষণ চলে। সঙ্গিনী মেজাজে হাঁটছিলেন, বাধা পেয়ে তাঁর মুখ ব্যাজার হয়ে গেল।

"কী হল আবার?"

"কী আর! সানি স্টে!" আমি চোখ মটকে বললাম।

"মানে? ওই হুমদোটা কী বলল?"

আমি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বললাম, "কবিতা শোনাল একটা।"

"কবিতা?" সঙ্গিনীর চোখ চড়কগাছ।

"ইয়াপ! বলল। 

আহা, যাচ্ছ কোথায়! জান!

ওই সাদা দেওয়ালের দিকে 

তোমার আশার অবসান!

সঙ্গিনী আমাকে ভস্ম করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন দেখে ব্যাপারটা খোলসা করলাম। যেটা বললাম না সেটা হল ছড়াটা যাচ্ছেতাই হলেও মূল লেখাটা স্বয়ং নোবেলজয়ী কবি ভিন্সে আলেহেন্দ্রের লেখা, যদিও তাঁর কবিতার উদ্দেশ্য একেবারেই ভিন্ন ছিল। খানিকটা স্যাটায়ার, আর অনেকখানি প্রতিবাদ লুকিয়ে ছিল লাইনের ভাঁজে ভাঁজে, এই কবিতার মাধ্যমে তৎকালীন সরকারের সমালোচনা করেছিলেন আলেহেন্দ্রে। বাংলা অনুবাদের চেষ্টা না করে বরং ইংরেজি অনুবাদটা দেখে নেওয়া যাক। কবিতার নাম 'যৌবন'। 

Sunny Stay:

Where are you going, look?

To these white walls,

closure of hope.


Walls, ceiling, floor:

dark slice of time.

Closed in him, my body.

My body, life, slim.


Limits will drop one day . What divine

nudity! Pilgrim

light. Happiness happiness!


But the eyes will be closed . Demolished

walls. In the open,

closed lights

আমরা এইবার চলেছি সেভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। আগে এইখানে তামাকের কারখানা ছিল, একসময় নস্যি আর সিগার উৎপাদনের জন্যে এই কারখানার সুখ্যাতিও ছিল। পরের দিকে অবশ্য অন্যান্য জায়গায় সিগার বানানো শুরু হয়, বন্ধ হয়ে যায় কারখানা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন আবার তামাকের কাজ শুরু হয় এখানে, শুধুমাত্র মহিলারাই কারখানায় কাজ করতেন। সেকালে স্পেনের সবচেয়ে বড় কারখানা ছিল এই জায়গাতেই। ১৯৫৩ সালে এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চললাম প্লাজা দে এস্পানিয়ার দিকে। ১৯২৯ সালে ইবেরো আমেরিকান এক্সপোর সময়ে এই বিশাল প্লাজার নির্মাণ করা হয়েছিল, বিশ্বজোড়া খ্যাতি আছে এই জায়গায়। না দেখলে নাকি আফসোস থেকে যাবে।  

স্প্যানিশ স্থাপত্য বলতে স্বতন্ত্র ভাবে যদিও কিছু নেই, কিন্তু যা আছে, সেটা দেখতে হলে এই জায়গাই সেরা। একসঙ্গে মুদেহার, গথিক, রেনেসাঁ,  নিও-মুদেহার আর আধুনিক কল্পনার মিশেল এই প্রশস্ত প্লাজা এবং প্রাসাদের মাঝখানে এক জলপ্রণালী তৈরি করা হয়েছে। ইচ্ছে থাকলে নৌকো নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। মারিয়া লুইসা পার্ক প্লাজার সংলগ্ন বলে জায়গাটা সবুজে সবুজ হয়ে আছে। জম্পেশ পলিশ করা ঘোড়ার গাড়ি আর তাগড়াই ঘোড়া নিয়ে সহিসেরা ডাকাডাকি করেছে সেখানে। অনেকেরই মনে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রাজসিক মেজাজ পাওয়ার ইচ্ছা। বহু লোকের চলাফেরার মাঝখানে বাস্কিংয়ের সুরে গান বাজনা আর ম্যাজিক চলছে। চড়া রোদের পরোয়া না করেই ফোয়ারার জলে লাফালাফি করছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে। জাম্পিং জ্যাক, ডাক প্যাঁক-প্যাঁক, কুকুরের খ্যাঁক, কিছুরই অভাব নেই। গ্লাসে পানীয় ছলকাচ্ছে, ছলকে যাচ্ছে রোদ্দুরও। সাদা চামড়া ট্যান হচ্ছে। বেলা যত বাড়ছে, উদ্দামও ততই বাড়ছে। 

প্লাজা দে এস্পানিয়া থেকে বেরিয়ে সিনাগগের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সান্তা ক্রূজ অঞ্চলে পৌঁছে গেছি ততক্ষণে। বাইরে রোদের তাপ ক্রমেই বাড়ছে, খোলা রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর চেয়ে এখানকার সরু সরু ছায়াঘেরা সুন্দর গলিগুলোতে ঘুরতেই ভালো লাগে দুপুরবেলা। খাবার দোকানে তাপা সাজিয়ে লোক ডাকাডাকি চলছে। সেভিয়াতে প্রধান খাবারের সঙ্গে কম পরিমাণের একটা ছোট প্লেট অর্ডার করা যায়, একেই এখানে তাপা বলা হয়। ড্রিংক এর সঙ্গে বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার যে চল এমনিতে তাপা বলে চলে স্পেনের অন্যান্য জায়গায়, এইখানে সেই ব্যবস্থা নেই। এতদিন ধরে পায়েলার সুখ্যাতি শুনে আসছি, তাপায় সি ফুড পায়েলা অর্ডার করে দিলাম আমরাও অন্য খাবারের সঙ্গে। তেমন কিছু আহামরি বলে অবশ্য মনে হল না। চালের পোলাওয়ের সঙ্গে চিংড়ি মাছ আর সবজি মেশানো। আসলে আমাদের দেশের রান্না এতই ভালো যে ইউরোপের খাবারের স্বাদই আমাদের কাছে সাধারণ মনে হয়। রান্নার স্বাদ আর বৈচিত্রের ক্ষেত্রে আমরা সত্যিই সৌভাগ্যশালী। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। 

খেয়েদেয়ে সান্তা ক্রূজের গলিতে খানিকক্ষণ ঘুরেই হাঁফিয়ে পড়লাম। মারাত্মক গরম আর রোদের তেজ। 'বাসন্তী রোদ' এখন আসল রূপ ধরেছে, ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছে সানি স্টের মজা। ভালো ভালো দৃশ্য চোখের সামনে আসলেও হাঁটতে মোটেই ইচ্ছে করছে না। সেনোরিতার অবস্থাও তথৈচ। শেষমেশ মারিয়া লুইসা পার্কে গিয়ে আইসক্রিম কিনে গাছের নিচে বেঞ্চিতে শুয়ে পড়লাম সটান। আমাদেরও একটা 'সিয়েস্তা' না দিলে চলছে না। এমনিতেও বিকেলে ফুটবল ম্যাচ আছে, টপাটপ ছোটখাটো দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে দাভিদের বাড়ি খুব দূর নয়, বাড়ি গিয়ে জিরিয়ে চা-টা খেয়ে আবার সন্ধ্যে বেলা বেরোব ভেবে উঠে পড়লাম। প্লাজা এস্পানিয়ার সামনে হলুদ কালো ঘোড়াগাড়ির সহিসরা দিব্যি ঘুমোচ্ছে, ঘোড়াগুলোরও চোখ বন্ধ। ওরাও সিয়েস্তার ভক্ত বোঝা গেল। আমরাই বা নিয়মের খেলাপ করব কেন? সিয়েস্তার টানে টুক টুক করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। 


৩) সেভিয়ার সুপারমার্কেটে গিয়ে কিনে আনা হয়েছে সবজি, দুধ, ডিম। দাভিদের সঙ্গে আড্ডা সহযোগে এক কাপ করে চা পানও শেষ। খাস স্প্যানিশ ছেলে দাভিদ, কাজ শেষ হলেই বন্ধুদের সঙ্গে বিয়ার নিয়ে বসে পড়ে। সকালে কফি, সন্ধ্যেতে বিয়ার। কিন্তু দুধ চিনি লবঙ্গ দিয়ে ফোটানো খাঁটি ভারতীয় চা খেতে তার উৎসাহের খামতি দেখা গেল না। 

চা খেতে খেতে দাভিদ বলল, “স্পেনের লোকেরা কাজের পর বাড়িতে থাকতে মোটেই পছন্দ করে না। বেশিরভাগ লোকেই পাব সস্তা খাবারের দোকানে দিয়ে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা জমায়। পকেটে কড়ি থাকলে পানাহার ভালোই হয়, না হলে এক দেড় ইউরো খরচ করে একটা বিয়ার নিয়েই চলতে থাকে গল্প। কিন্তু গল্পের আসর বসে ঠিকই।” 

আজ ক্রোয়েশিয়া আর ইংল্যান্ডের খেলা আছে বিশ্বকাপে। তাও আবার সেমিফাইনাল। দাভিদ কাজকর্ম সেরে পালিয়ে এসেছে খেলা দেখবে বলে। আমাদের ঘরে বসে খেলা দেখার সময় নেই, খেলার আপডেট পেতে হলে রাস্তাই ভালো। রোদ্দূরের তাপ সাড়ে সাতটার সময় খানিকটা কমতেই ফের পথে নেমে পড়লুম। বাসে করে চললুম ত্রিয়ানার উদ্দেশে। গুয়াদালকিভির নদীর অন্য পারে ত্রিয়ানা শহর। এই দুই যমজ শহরে বেশ ভাব, যদিও সেভিয়ার নামের সামনে ত্রিয়ানার নাম খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছে। মিনিট কুড়ির মধ্যেই নদীর কাছে পৌঁছে গেলাম। নদীর উঁচু পাড়ের গা ঘেঁষে চলে গেছে হেঁটে যাওয়ার বাঁধানো এক পথ। সমান্তরাল ভাবে চলছে কচি কলাপাতা রঙের ঘাসের বাগান। নদীর জলে কায়াকিং আজও চলছে। রোদের তেজ কমে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে।  

সেতুর ধারে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকে চলেছে। নদীর পাড় ধরে যমজ নগরীর ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে নীল রঙের গম্বুজ, গির্জার উঁচু মাথা। আমরা মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে গেছি শহরের কেন্দ্রে। ইতিউতি হাঁটাহাঁটি করছি এদিক সেদিক। হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে চেখে নেওয়া হল ত্রিয়ানা বাজারের অলিগলি, সিয়েস্তাভাঙা বিকেলের আড়মোড়া নেওয়া দোকানপাট। কিওরিওর দোকান, নীল সিরামিকের কাজ করা মনমাতানো শিল্পাকৃতি। রঙবেরংযের বাড়ি, নির্জন গলির ভিতরে বসে গেছে সকার সর্বস্ব উল্লাসউৎসব। 

ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে জনশূন্য গলি দিয়ে নেমে এলাম নদীর ধারে। বাঁধানো রাস্তার একপাশে ফুলের গাছ। কয়েক ঠোঙা গ্রীষ্মের বাতাস আর অলস বিকেল হাতধরাধরি করে বসে আছে। চুপচাপ। হইহট্টগোল না করে সেতুর ধার। হাঁটতে থাকলাম ফিরতি পথে সেভিয়ার দিকে। আরেক কাপ গরম পানীয় না হলে মোটেই চলছে না। এমন সময় নজর পড়ল সেতুর কাছেই বিক্রি হচ্ছে চুরোস আর কফি, অবিকল যেরকম করে মোমো আর ফুচকার স্টল বসে থাকে গঙ্গার ধারে। 

তেরছা চোখে সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে জিগ্গেস করলাম, “সেনিওরিতা, চলেগা ? ”

অনেকটা ঘাড় নাড়িয়ে ডানকুনির স্প্যানিশ মেমসাহেব বললেন, “সি।”

সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে আমরা চিরকালই এগিয়ে। নিমেষে হাতে চলে এল গরম গরম কফি আর চিনির গুঁড়ো ছড়ানো চুরোস। ছাতা লাগানো টেবিলের নিচে বসে চুরোস খেতে খেতে দৃষ্টি বিনিময় চলতে লাগল পথচারীদের সঙ্গে। 

সঙ্গিনী চুরোতে কামড় দিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, “গ্রাসিয়াস।”

আমিও সীমিত স্প্যানিশ ভাষা থেকে একটা বাক্য খুঁজে এনে কেতা দিয়ে বললাম, “নো নেসেসিতো, সেনোরিতা।” 

ঘড়িতে প্রায় আটটা বাজতে চলল। কফি খেয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছি, মনেও বেশ কবি কবি ভাব এসেছে। খানিকক্ষণ পরেই শেষ বিকেলের আলো এসে পড়বে সান্তাক্রূজ অঞ্চলের ওপর। এই সময়ে ক্যাফে আর রেস্তোরাঁর গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পুলকের পার্বণ, অনুগ্র দীপ্তশিখার রোশনাইতে বোঝাই হয়ে থাকে পীতবর্ণে মোড়া সান্তাক্রূজের পল্লী অঞ্চল। এই মোহাচ্ছন্ন নাট্যমঞ্চে সশরীরে উপস্থিত থাকা অবশ্য কাম্য, তাই কফির কাপে ঝটপট চুমুক দিয়ে উঠে পড়লুম। নটার কাছাকাছি এল কোটো রেস্তোরাঁয় তাপাস আর কাউচসার্ফিং এর সদস্যদের একটা আড্ডা হওয়ার কথা, সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই আমাদের এক ঘন্টা কাবার হয়ে যাবে। 

হাঁটতে শুরু করেছি সকালের সরু গলির গোলকধাঁধায়। ডান দিক, বাঁ দিক। একটা করে অপ্রশস্ত গলিপথ থেকে বেরোতেই সামনে ম্যাজিকের মত ফুটে ওঠে এক একটা চৌকো আলোঝলমলে প্লাজা। আলোকতরণী বেয়ে নেমে এসেছে গাছের লতা। পানাহারের সঙ্গে জোর জল্পনা চলছে খেলা নিয়ে। ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে। কানে ভেসে আসা মন্তব্যে বেশ বুঝতে পারছি খেলার হাল হকিকত। ক্রোয়েশিয়া এই বছর বিশ্বকাপে অনেক নামি দামি দলকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে এসে পৌঁছেছে। তাদের উৎসাহ দিতে অনেকেই সোচ্চারে গান করছে বিয়ার হাতে। তাপাসের ছোট ছোট প্লেট উড়ে আসছে টেবিলে আর মুহূর্তের মধ্যে শূন্য হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া আর পানাহারের মধ্যেই চলেছে টীকা টিপ্পনী। 

একের পর এক গলি পেরোচ্ছি। আলো মরে আসছে আকাশের আর নতুন এক সেভিয়া চোখের সামনে প্রতীয়মান হচ্ছে আমাদের। শয়ে শয়ে দোকান, সরু অথচ অমলিন সরণির আলোকিত ইমারতের কোনও  কোনোটায় গড়ে উঠেছে কনসার্ট হল আর অপেরা। লোকজন সেজেগুজে চলেছে সেখানে ফ্লামেঙ্কো নাচ অথবা জিপসি অপেরা দেখতে। স্মরণিকার দোকানগুলোয় লোকের জটলা, অনেকে ঘোড়ার গাড়ি করে ঘুরছে গোধুলিবেলায়। আমরা চলেছি তো চলেছিই। গুগল ম্যাপ দেখে এঁকে বেঁকে প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর বুঝতে পারলাম কত বড় অঞ্চল ধরে এই পল্লীর বিস্তার। কত গলি, প্লাজা আর স্কোয়ার যে পেরোলাম তার ইয়ত্তা নেই। শেষে কাইয়ে হুয়েল্ভায় এসে এল কোটো বারে এসে যখন উপস্থিত হলাম অন্ধকার হব হব করছে। 

সরু গলি। পাশের দোকানের সামনে প্রায় পঞ্চাশ জন বিয়ার আর সাঙরিয়া হাতে ম্যাচে রমে গেছে। ইতিমধ্যে হাফটাইম হয়ে গেছে। ক্রোয়েশিয়ার দেওয়া একগোলে সকলেই খুশি। কিন্তু ইংল্যান্ড অত সহজে ছাড়বে নাকি? তারাও মরিয়া হয়ে খেলছে। এল কোটো বার প্রায় ফাঁকা। বুঝতে অসুবিধে হল না সেমিফাইনাল বলে অনেকেই আসেনি। ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে আলাপ হল অরেলিও বলে একটা ছেলের। বেচারা বিয়ার হাতে সকলের অপেক্ষায় বসেছিল। আমাদের পেয়ে দিব্যি গল্প জুড়ে দিল সে। কথা অবশ্য সঙ্গিনীই বেশি বললেন। স্প্যানিশ জানার সুবিধে তো হবেই। এই ক’দিনে দেশের হালহকিকত বুঝে গেছেন, বাড়ি ফিরে দেখছি ছাত্রদের পুরো স্পানিয়ার্ড বানিয়ে ছাড়বেন। রক্ষা কোরো মা! ভারতের ছেলেপুলে স্প্যানিশ শিখলে নিজেকে পাবলো এস্কোবার ভাবতে শুরু করলেই হয়েছে! কে বলবে স্প্যানিশ দিদিমণি আসলে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে আরো অনেকের মতনই সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বসে আছেন। প্রতিভার অপচয় আর কাকে বলে? 

অরেলিও সেভিয়ার ছেলে। স্পেনের বাইরে কস্মিনকালেও যায়নি, কিন্তু নানা দেশের লোকের সঙ্গে আড্ডা দিতে আগ্রহী বলে সে কাউচসার্ফিং মিট-আপগুলোর নিয়মিত সদস্য সে। গলির ধারে উঁচু টেবিলে বসে নানা গল্প চলতে লাগল। সেভিয়ার কাছাকাছি নানান সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। কার্ডোবা, জেরেজ দে লা ফ্রন্টেরা, কাদিজ, রন্দা, মালাগ্গা... বেশ কয়েকবার সেখানে গেছে অরেলিও। এপ্রিল মাসে ইস্টারের সময় সেভিয়াতে সেমানা সান্তা বা হোলি উইক হয়, তখন শহরে পা রাখার জায়গা থাকে না। অনেকেই ঘুরতে চলে যায় কাছাকাছি সমুদ্রের ধারে বা অন্য  কোনও  ছোট্ট শহরে। 

কিছুক্ষণ পর আরো দুটো মেয়ে এসে হাজির হল। পলিনা আর জেনিয়া, দুজনেই রাশিয়ার বাসিন্দা। সেভিয়াতে এসে রয়েছে স্প্যানিশ শিখবে বলে। পলিনার তড়বড় করে স্প্যানিশ বলা শুনে আমার যদিও মনে হল যে শেখার পর্ব ওর অনেক আগেই চুকে গেছে। এখানে স্রেফ সামার্স কাটাতে এসেছে। এরপর আমাদের টেবিলে স্প্যানিশ ভাষার বন্যা বয়ে গেল। আমার দৌড় খুব সামান্য, চারজন স্প্যানিশভাষীর মধ্যে পড়ে ঘাবড়ে গিয়ে শেষে ড্যাবড্যাবে চোখ করে ম্যাচের দিকে মনোযোগ দিলাম। ততক্ষণে ইংল্যান্ড ম্যাচে ফিরে এসেছে। অনেকের হাহুতাশের মধ্যেই ইংল্যান্ড শেষমেশ দুটো গোল দিয়ে ম্যাচ জিতে ফাইনালে জায়গা করে নিল। দশটার কাছাকাছি আমরাও পলিনা, জেনিয়া আর অরেলিওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে চললাম। 

“ওই! দাভিদের জন্য আইসক্রিম কিনবি নাকি?” সঙ্গিনী জিগ্গেস করছেন।

উত্তম প্রস্তাব সন্দেহ নেই। সামনেই একটা আইসক্রিমের দোকান দেখেছি। বললাম, “নিশ্চয়ই বালিকে! ভেরি গুড প্রস্তাব। এস্তা বিয়েন, এস্তা বিয়েন।”

তিন স্কুপ আইসক্রিম মিলিয়ে মিশিয়ে কিনে বাড়ি পৌঁছে দেখি দাভিদের বান্ধবী ক্যাটেরিনাও আছে বাড়িতে। ক্যাটেরিনাকে দেখতে অবশ্য ক্যাটেরিনা কাইফের মত নয়, কিন্তু সে যে সুন্দরী যে তাতে  কোনও  সন্দেহ নেই। তাদের জন্য আইসক্রিম এনেছি দেখে প্রেমিকযুগলের আনন্দ আর ধরে না। আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প চলছে দিব্যি এমন সময় জানলা দিয়ে কী যেন ঘরের মধ্যে এসে পড়লো। বাইরে থেকে কেউ ছুঁড়ে মেরেছে। এরকম কিছু ঘটলেই আমার মনে ছোটবেলায় পড়া বইগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। চকিতে মনে পড়ে গেল কাকাবাবুর গল্পে একজন জানলা দিয়ে বিষাক্ত গ্যাষের স্মোকবম্ব ছুঁড়ে মেরেছিল! তেমন কিছু নাকি? ও হরি! উঠে  গিয়ে দেখি কতগুলো ডিমের খোসা। আমরা বেশ ভড়কেই গেছিলাম। দাভিদ যদিও আমাদের শান্ত হয়ে থাকতে বলল, নিজে যদিও পাড়ার ছেলের ওপর মহা খাপ্পা হয়ে উঠল। ক্যাটেরিনা আর দাভিদ মিলে তখনই সাবানজল এনে জায়গাটা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমার যদিও মনে হল ক্রোয়েশিয়ার কোনও এক সমর্থক হতাশ হয়ে এই সব করেছে। 

যাইহোক, আড্ডা খুব বেশিদূর গড়াল না। ক্যাটেরিনা আমাদের বিদায় জানিয়ে চলে গেল খানিক বাদেই। আমরাও রান্নাবান্না করে খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

 

৪) পরের দিন সকালে উঠে ভালো করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরোতে বেরোতে দশটা বেজে গেল। দাভিদ সাতসকালেই বেরিয়ে গেছে। আমরা ধীরেসুস্থে বেরিয়ে হাঁটা দিলাম লাস সেতাসের দিকে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কাঠের এই পরিকাঠামোকে লোকে ‘মাশরুম’ নামেই বেশি চেনে। অবিকল মাশরুমের মতন দেখতে ক্রিম রঙের এই উঁচু ইমারতের মাথায় লিফ্ট করে উঠে গেলে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। মাশরুমের নিচে দিব্যি বাজার বসেছে। ঢেলে বিক্রি হচ্ছে মাছ মাংস সি-ফুড, সবজি, ফল। এক পাক ঘুরে আমরাও তিন ইউরো টিকিট কেটে উঠে গেলাম মাশরুমের ছাদে। 

ঘোরানো রাস্তা লিফ্ট থেকে বেরিয়ে চলে গেছে ওপরের দিকে। সান্তাক্রূজ ছাড়াও নানান অঞ্চল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে। আজ রোদের তেজ এখনও কম, ছত্রাকের আকৃতিতে বসে থাকা এই স্মৃতিস্তম্ভের নিচে রোমান যুগের অবশেষ পাওয়া গিয়েছিল এক সময়ে। মাশরুমের ছাদেই একটা রেস্তোরাঁ আছে, টিকিট দেখালে দু’ ইউরোর জুস এক ইউরোতে পাওয়া যায়। দুটো লেমোনেড কিনে আমরা কিছুক্ষণ পর নেমে এলাম নিচে। এখনও অনেক জায়গাতেই ঢুঁ মারা হয়নি। হাঁটাহাঁটি করতে করতে ওল্ড টাউনের পিছন দিকটায় পৌঁছে গেছি। 

মানুষের মন বড়ই চঞ্চল। একদিকে আমরা পয়সা বাঁচানোর জন্যে বাড়িতে ডাল ভাত ফুটিয়ে খাচ্ছি, এক ঘন্টার ট্রেনের রাস্তা চার ঘন্টায় বাসে করে পেরোচ্ছি। যতই মন লাফালাফি করুক লাঞ্চ ডিনার কোনও কিছুতেই মনকে মাতাল হতে দিইনি! কিন্তু ওই যা হয়! মনজুড়ানো সুভ্যেনিরের দোকান দেখে সঙ্গিনীর মন গেল চটকে, হরেক রকম জিনিস সাজানো রাখা। একটা দুটো করতে করতে মোট পনেরো জনের জন্য উপহার কিনে যখন কার্ড সোয়াইপ করতে হল, বুকের ভিতর ধুকপুক করতে শুরু করল। কী আর করা? লম্বা সফর! স্মৃতিচিহ্ন না থাকলে ব্যাকপ্যাকিং ট্রিপ না লাক্সারি ট্রিপ, কয়েক বছর পর নিজেরাই হয়তো ভুলে মেরে দেব। 

কেনাকাটা সেরে টুরিস্ট অফিসের দিকে এগিয়ে চললাম। হাতে একদিন সময় আছে, কাছাকাছি অন্তত একটা জায়গা না ঘুরে গেলে ঠাকুর পাপ দেবে। এদিকে 'কোনটা ধরব, কোনটা ছাড়ব' করতে করতে কিছুই মনস্থির করে উঠতে না। টুরিস্ট অফিসে গিয়েও  কোনও  লাভ হল না। এমনিতেই স্পেনে গাদা গাদা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। যেই হারে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পেয়ে চলছে স্পেনের নানা শহর, কয়েক বছরের মধ্যেই চিন আর ইতালিকে পিছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি হেরিটেজ নগরী নিয়ে এক নম্বরে চলে এলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। 

আন্দালুসিয়াতেই শ'খানেক জায়গা আছে। কর্দোবার মুদেহার স্থাপত্য দেখলে নাকি পলক পড়ে না, বায়েজা আর উবেইদার রেনেসাঁ শৈলীর মহল নাকি খোদ ইতালিতেও নেই। বহু লোকে এইসব আগেই দেখে গেছে, তারা চলছে দোনানা ন্যাশনাল পার্কের সাফারিতে। আমরা দোনামনা করেই চলেছি। কাদিজ থেকে মালাগ্গা, সব জায়গাই হয় দূরত্বে পোষাচ্ছে না নয় পকেটে। স্থাপত্যের নমুনা দেখতে গেলে বেশিরভাগ জায়গাতেই কুড়ি থেকে তিরিশ ইউরো মাথাপিছু টিকিট দিতে হবে,  তাহলে আমাদের দিন চারেক না খেয়েই থাকতে হবে। মাদ্রিদ থেকে সেভিয়া অব্দি মুদেহার স্থাপত্য দেখেই চলেছি, এর পর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ গ্রানাদায় যাওয়ার কথা,  সেখানে গেলে যথেষ্ট পরিমাণে মুদেহার স্থাপত্য দেখা হবে। অতএব কর্দোবা, কাদিজ সব বাদ। খুঁজতে খুঁজতে  কোনও  জায়গাই খুঁজে পেলাম না। শেষমেশ 'ধুত্তোর' বলে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক হল কালকে বাসস্টপে গিয়ে যে  কোনও  একটা বাসে উঠে পড়লেই হবে।  

নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বুলফাইটিং এরিনা ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম। পেটে ছুঁচোরা রক কনসার্ট ডেকেছে, কিন্তু মধ্য অঞ্চলে দোকানে ঢুকতে গেলে বিলের ঠেলায় ছাল উঠে যাবে আমাদের। অতএব গুটি-গুটি ভাইয়ের দোকানের দিকে প্রস্থান!  আহা.. ভাই মানে ম্যাকডোনাল্ড ভাই রে বাবা! পকেটে কড়ি কম থাকলে ওই ঠিকানাতে গেলে তাও কিছু জুটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খানিক এগোতেই ভাইয়ের হলুদ লাল ডোরাকাটা দোকান দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।  দু’তলা দোকান। সারে সারে দাঁড় করানো মেশিনেই অর্ডার দিয়ে দেওয়া যায়। ছিমছাম বার্গার মিল নিয়ে দু’তলায় এসে বসে রইলাম বেশ খানিকক্ষণ। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়ে আসছে, জনাকয়েক টুরিস্টের দেখাও পাওয়া গেল।  

ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চিবোতে চিবোতে নানা ধরনের লোকের কার্যকলাপ লক্ষ্য করা, এই অভিজ্ঞতার ধারে কাছে কিছুই আসে না। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের জায়গায় অবশ্য চানাচুর অথবা বাদামভাজা হলেও অসুবিধে নেই। প্রতিষ্ঠিত  কোনও  সাহিত্যিক হলে এই অভিজ্ঞতা নিয়েই একটা ‘মাস্টারপিস’ রচনা করতে পারতেন, আমাদের মত লোকের মুরোদ নেই বলে আলুভাজা খেয়েই সন্তুষ্ট হতে হয়।

আমাদের কাছে বসে আছে কয়েকজন ছেলেমেয়ে। তারা মায়োর্কার সেরা দে ত্রামুন্তানায় ঘুরতে চলেছে, সেই পরিকল্পনা চলেছে কোকের চুমুকের সঙ্গে। কয়েকজন আবার সিয়েরা নেভাদা যাওয়ার টিকিট কেটেছে কাল, সেই আনন্দে মশগুল। মায়োর্কার কাছে নানান জনপ্রিয় ছোট ছোট জনপদ আজকাল অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস আর নিরিবিলিতে দিন কাটানোর জন্যে আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে, সেরা দে ত্রামুন্তানা সেরকমই একটা শহর। স্পেনের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম এক করলে এত বিচিত্রমুখী সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা নয়নাভিরাম গ্রাম আর শহরের ঠিকানা পাওয়া যায় যে বিশ্বাস করা কঠিন। ভারতবর্ষের বাইরে কোনও একটা দেশে এত বৈচিত্র সহজে দেখতে পাওয়া যায় না। কাতালান আর গালিসিয়া ছাড়াও এখানে আরো তিন রকম ভাষা ব্যবহার করা হয়। সেতেনিল দে লাস বদেগাস, পর্তুগেলাতে, ভিলাজয়াসা, জাতিভা প্রতিটা শহর যেন শিল্পীদের কল্পনা থেকে বাস্তবে উঠে এসেছে। প্রধান শহরগুলো ইউরোপমুখী হলেও গ্রামে গঞ্জের লোকেরা ব্যস্ততার ধার ধারে না, তাপাসের সঙ্গে গল্প করতে করতে অথবা দিগন্তের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকা মানুষজনের স্পেনে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে আজও। 

হিসেব করে দেখলে বছরে যত দিন, তার চেয়ে বেশিদিন এখানে উৎসব চলে, ঠিক আমাদের বারো মাসে তের পার্বনের মতোই। মেডিটেরেনিয়ান জীবনধারা নিয়ে বেঁচে থাকা এই চিবুক তোলা গ্রামগুলোয় আজও স্প্যানিশ গিটার সঙ্গে করে গুস্তাভো বেকারের গান গাওয়া হয়, পায়েলা রান্না হয় খাস খরগোশের মাংস দিয়ে,  মুরদের 'লুটে' বাজনার সঙ্গে পাকো দে লুসিয়ার ফ্লামেঙ্কর সুর তোলা হয় আর রাত এগারোটার আগে কেউ ডিনার খাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবে না। 

আমাদের ভাগ্যে অত সুখ নেই। স্প্যানিশ জীবনের ভাব অন্তর্সাৎ করতে হলে যতটা সময় দরকার, তার সিকিভাগও আমাদের হাতে নেই। যাওয়া হবে না মালোর্কার জমাটি রঙিন পাথুরে গ্রামে, বুনিয়েলের টমেটো উৎসব আর আলতামিরার গুহাও না দেখা পড়ে থাকবে। কোস্টা ব্রাভায় সমুদ্রে পা ডোবানোও হবে না, ভ্যালেন্সিয়ার কুড়ি দিন ধরে চলতে থাকা লাস ফালাস এর জাঁকজমকও না দেখাই থাকবে। 

ঘন্টাখানেক পা দুটোকে আরাম দিয়ে উঠে পড়লুম। সিয়েস্তার সময় রোদ্দূরে ঘোরাঘুরি করে  কোনও  লাভ নেই বরং এই ফাঁকে রাতের রান্নাবান্না সেরে রাখা কাজের কাজ। ইন্টারনেট ফোরামে জিগ্গেস করে আমরা লা কার্বনেরিয়া বলে একটা জায়গার সন্ধান পেয়েছি যেখান প্রতি সন্ধ্যেবেলা ফ্লামেংকো নৃত্যের আয়োজন হয়। যে কেউ একটা পানীয় নিলেই সেখানে বসে এই অনুভবের ভাগীদার হতে পারে, তার জন্যে টিকিট লাগে না। 

কাজকর্ম মিটিয়ে সন্ধ্যেবেলা আবার বেরিয়ে পড়া হল সোনাগলা বিকেলের ফিকে রঙ মেখে। আবার সেই কমলা সাদা বাড়ি, আলোর গলি আর লুকিয়ে থাকা প্রাসাদের গোলকধাঁধা পেরিয়ে যখন লা কার্বনেরিয়াতে পৌঁছেছি, শদুয়েক লোক আগেই জমায়েৎ হয়ে গেছে। প্রতি এক ঘন্টায় এক বার করে ফ্লামেংকো নাচের আয়োজন হয়, এখনও প্রায় মিনিট পনেরো বাকি। একটা সাঙরিয়ার গেলাস নিয়ে বসে পড়লাম। 

যথাসময়ে মঞ্চে উপস্থিৎ হল কলাকুশলীরা। কালো ফ্লামেংকোর পোশাক পরিহিত এক মহিলা এসে অনুরোধ করলেন ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি না তুলতে। মঞ্চের পাশে বসেছেন গায়ক এবং গিটারিস্ট। আমরা অপেক্ষা করে আছি। ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে আমাদের পূর্ব পরিচিত জেনিয়া আর পাউলিনাও। একসময় দরাজ গলায় স্প্যানিশ লোকসঙ্গীতের বোলের সঙ্গে স্প্যানিশ গিটারের সুর কানে এসে লাগল। মহিলা গানের বলের সঙ্গে পা ঠুকতে ঠুকতে মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন। ফ্লামেংকো যে আনন্দের সঙ্গীত নয়, বিরহ এবং বিষাদের গান, সেটা আগেই জানা ছিল আমার। গানের এক বর্ণ বুঝতে না পারলেও মর্মস্পর্শী সঙ্গীতের সেই সুর তিরের মত এসে বিঁধে যায় বুকে। ফ্লামেংকোর তালে তালে সেই দরদী গানের ত্তজস্বল মাধুর্য্য সময়কে চালিত করতে শুরু করেছে। অপার প্রাণশক্তি না থাকলে এই ফর্ম আয়ত্ত করা  কোনও  নর্তক অথবা নর্তকীর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে চলা ফ্লামেংকোর আসর যখন শেষ হল,  হাততালি আর থামতে চায় না। 

একসময় পাউলিনাদের বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। সেভিয়ার গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন এগিয়ে চলেছি,  ফ্লামেংকোর সুর আমার মাথায় ঘুরছে। অপেক্ষারত প্রেমিকযুগলের বিরহ সঙ্গীত আর সেভিয়ার হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে আমরাও নিরুদ্দেশে চলেছি। এক শহর থেকে আরেক শহর,  এক গল্প থেকে অন্য গল্পে। এই আবহমান যাত্রার শেষ নেই, শেষ থাকতে পারেও না। গিটারের সুর বেজে চলে নিরন্তর, যাত্রাও চলতে থাকে। শুধু চরিত্রগুলো বদলে যায়।


ক্রমশ

রন্দা

যাত্রা শুরু 

বই কিনতে হলে