শুক্রবার, ২ অক্টোবর, ২০২০

প্রাণোজ্জ্বল পোর্তো (তৃতীয় পর্ব)


Image result for porto street art
Porto Urban Art

৩) ব্যাকপ্যাকিং-এর কয়েকটা অলিখিত বাণীর মধ্যে একটি হল: Walk and Talk. ওয়াক অর্থাৎ হাঁটা আমাদের চলছে পুরোদমে কিন্তু টক করতে গেলেই মাথা ভেবলে যাচ্ছে। স্প্যানিশ ভাষা এবড়ো খেবড়ো ভাবে তাও চলে যাচ্ছিল কিন্তু পর্তুগিজের 'প' ও আমাদের জানা নেই। কিন্তু স্থানীয় লোকের সঙ্গে মন খুলে কথা না বলতে পারলে নতুন দেশের অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। চিরাচরিত টুরিস্ট সেজে শহরের বিখ্যাত নিদর্শনগুলো চাক্ষুষ করেই কেটে পড়ার ইচ্ছে আমাদের একদমই নেই। 

আমাদের হোস্ট মারিয়া দিব্যি ইংরেজি বলে। তার সঙ্গে আমাদের রোজ বিকেলে আড্ডাও চলছে। কিন্তু মারিয়া শহরের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিদৃশ্যের খবর রাখে না। স্থানীয় শিল্পী, লেখক, রাজনেতা, বা শহরের সাধারণ লোকের চিন্তাধারা সম্পর্কে জানতে হলে এক শহরে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়। নতুন লোকেদের সঙ্গে পরিচয় হলেও আলাপ গভীর হতে সময় লাগে। ট্রাভেল স্লো ইজ বেস্ট ওয়ে! আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের হাতে অত সময় নেই। পকেট তো গড়ের মাঠ, সঙ্গে ভিসাও সীমিত সময়ের জন্য। তাহলে উপায়? কাউচসার্ফিং-এর মিট আপে স্থানীয় নানা মানুষের সঙ্গে দেখা হয় বটে কিন্তু সেরকম কোনও  ইভেন্ট এখন হচ্ছে না। কী করা যায়? নেটে এটা সেটা দেখতে দেখতে একটা ফ্রি স্ট্রিট আর্ট ওয়াক দেখতে পেলাম। পরের দিন দুপুরে তেমন কিছু কাজ নেই, ঘুরে ঘুরে স্ট্রিট আর্ট দেখতে ভালই লাগবে। বুক করে ফেললাম। 

সকালটা খালি ছিল। রিভিয়েরার অঞ্চলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্যালেসিয়া দে আর্টস আর বোলসা প্যালেস দেখে নিলাম। সেন্ট ফ্রান্সিস গির্জার কাছেই প্যালেসিয়া দে বোলসা, একসময় স্টক এক্সচেঞ্জ থাকলেও নিওপ্যালেডিয়ান স্থাপত্যকলায় নির্মিত এই মহলটি আজকাল ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। আমাদের অবশ্য ভিতরে যাওয়া হল না। টিকিটের দাম চড়া। তার ওপর শুধু মিউজিয়াম আর নামকরা জায়গাতেই যাব, সেরকম পরিকল্পনা মোটেই নেই। যেখানে খুশি মেট্রোতে করে চলে গেলেই হল। 

এই প্রসঙ্গে পোর্তোর মেট্রো ব্যবস্থার কথা না বলে পারছি না। বিদেশে সবকিছুই ভালো, দেশে সব কিছুই নোনাধরা, সেরকম চোখ আমাদের নয়। যে কোনও বড় শহরের মেট্রোর সঙ্গে দিল্লি মেট্রো পাল্লা দিতে পারে। তফাৎ বলতে এইটুকুই যে ইউরোপে মেট্রোর লাইন অনেক বেশি। প্রায় পুরো শহরে মেট্রোর লাইন বিছিয়ে ফেলেছে, কোনো কোনো জায়গায় স্টেশন এত নিচে মনে হয় পাতালে নেমে যাচ্ছি। মাটির তলায় দশ তলা নেমে স্টেশনে গিয়ে পড়তে হয়। তাছাড়া পরিকাঠামো একই। ওখানে অবশ্য ব্যাগ ফ্যাগ চেক করানোর ব্যাপার নেই, বাচ্চাদের ট্রলি থেকে সাইকেল, সব কিছুই দিব্যি মেট্রোতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে লোকজন। আমাদের এক বন্ধু অস্ট্রিয়া থেকে ব্যাঙ্গালোরে এসে মেট্রোতে ক্যামেরা নিয়ে যেতে গিয়ে সিকিওটির বহর থেকে অবাক হয়ে গিয়েছিল। 

সেই কথা থাক, বরং পোর্তোর কথায় ফেরা যাক। অবাক কাণ্ড হল এখানের  কোনও  স্টেশনেই টিকিটঘর বা মেট্রোর   কোনও   লোকজন চোখে পড়ল না। মেশিনে টিকিট নিয়ে লোকজন চলে যাচ্ছে, এমনকি টিকিট চেক করার জন্যে চেকার বা অন্ততপক্ষে স্বয়ংক্রিয় দরজা, সেইসবেরও বালাই নেই। সোজা গিয়ে মেট্রোতে উঠে পড়, যেখানে খুশি নেমে পড়। টিকিট আছে কি না, সেই সব দেখার জন্য  কোনও  ব্যবস্থাই চোখে পড়ল না। তাও প্রত্যেকেই টিকিট কেটে চড়ছে। কাণ্ড দেখে প্রথমে বেকুব বনে গেলেও তারপর আত্মস্থ করতে হল। তফাৎ পরিকাঠামোতে কম, মানসিকতাতে বেশি।


Image result for church of saint francis porto
Church of Saint Francis
Related image
Palacio de Bolsa
Related image
Inside Palace Bolsa

দুপুরের কাছাকাছি মারকেদো দে বোলহাওর কাছে একটা দোকান থেকে ইয়াবড় একটা ফ্রান্সিন্হা স্যান্ডুইচ আর কডফিশ বাকালহাউ খেয়ে ত্রিনিদাদে মেট্রো স্টেশনে চলে এলাম। আমাদের স্ট্রিট আর্ট ট্যুরের গাইড ফের্নান্দো বাস্তোসের বয়স চল্লিশের আশেপাশে, তার স্ত্রী আনাও আমাদের সঙ্গে যাবে। আনা একবার ভারতবর্ষ থেকে ঘুরে গেছে। তারা দুজনেই স্ট্রিট আর্টের ভক্ত, সারা পৃথিবীর স্ট্রিট আর্ট মুভমেন্টের যাবতীয় খবর ফের্নান্দোর ঠোঁটস্থ। দুজনে মিলে আরবান আর্ট পোর্তো বলে একটা উদ্যোগ চালাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে, উদ্দেশ্য এখানকার স্ট্রিট আর্ট ও শিল্পীদের সম্পর্কে লোকজনকে সচেতন করা। আমাদের সঙ্গে আরো দুজন আমেরিকান আছে, ফের্নান্দোর সঙ্গে গল্প করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম। 

স্ট্রিট আর্ট নিয়ে সারা পৃথিবীতে যত উন্মাদনা, আমাদের দেশে সেই তুলনায় অনেক কম। একসময় দেওয়ালের ওপর প্রতিবাদের বাণী হিসেবে গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়েছিল, গ্রাফিতিকে ‘ভ্যানডালিজ্ম’ বলেই ধরা হত। প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে মাথা গরম যুবক যুবতীদের দল শহরের রাস্তায় সরকারের বিরুদ্ধে দেওয়ালে স্লোগান লিখে রাখত, রঙের স্প্রে ব্যবহার করে। অনেক জায়গাতেই দেওয়ালে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল আইন করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মানসিকতা বদলাতে শুরু করে। 

কিথ হেরিং আর বিস্টি বয়েজের মত কয়েকজন গ্রাফিতি শিল্পী বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় বিশাল নাম করে ফেলল একসময়। লোকেদের আগ্রহ দেখে দেশে বিদেশে বিজ্ঞাপন কোম্পানিরা স্ট্রিট আর্ট আর গ্রাফিতি ব্যবহার করে ক্যাম্পেন চালাতে শুরু করে দিল। গত কুড়ি বছরে এই শিল্প বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে সারা বিশ্বে। স্ট্রিট আর্ট আজকাল নগর সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আমেরিকা থেকে আর্জেন্টিনা, প্রতিটা দেশেই এর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্ট আর ওয়াল আর্টিস্টদের ভূমিকাও। দেশের প্রধান নির্বাচনে স্ট্রিট আর্ট প্রচার অভিযানে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। স্ট্রিট আর্ট বাস্তবে শিল্পীদের মনের আয়না। মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় দেশের সমসাময়িক ঘটনাবলির সঙ্গে স্ট্রিট আর্টের বিষয়গুলো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে।

Image result for porto metro on dom ponte luis
Metro on the Ponte Dom Luis Bridge

Keth Haring 'celebrate the life' art

কিথ হেরিং আর বিষ্টি বয়েজের মত কয়েকজন গ্রাফিতি শিল্পী বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় বিশাল নাম করে ফেলল।লোকেদের আগ্রহ দেখে দেশে বিদেশে বিজ্ঞাপন কোম্পানিরা স্ট্রিট আর্ট আর গ্রাফিতি ব্যবহার করে ক্যাম্পেন চালাতে শুরু করে দিল।
Related image
World cup football street art in Latin América
           Shepard Fairey Barack Obama Presidential election campaign art              

Shephard Faiery Kickstarter initiative to protest policies of Donald Trump

P1090724
Painting by MOTS, on the desert galleries of Centro Comercial de Cedofeita

Arte Urbana - Dr Dheo
Street Art Porto by MrDheo,most popular artist from Porto,he has artworks around the World

নব্বইয়ের দশকে পোর্তোর নাম শুনলে লিসবনের লোকেরা নাক কুঁচকোত। সেই সময়ে নানান শিল্পী এসে জটলা করেছে লিসবনে, রাজধানীকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে, সেই তুলনায় এখানকার সাদাকালো, একঘেয়ে জীবনযাত্রায় বিষাদের রং প্রবল। গ্রাফিতির নামে দেওয়ালের ছাইরঙের ওপর উদ্ধত পাঙ্ক ছেলেমেয়েদের দল সাদা রঙের A লিখে রাখত বৃত্তের ভিতরে, যা আসলে অ্যানার্কির (anarchy) চিহ্ন। আর যাই হোক দেওয়ালের সেই কুৎসিত, থ্যাবড়া লেখাকে শিল্প বলা চলে না। গ্রাফিতি লেখার কায়দাকানুনও সময়ের সঙ্গে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে, এককালে গ্রাফিতির ইগোইসটিক (egoistic) লেখা সমমনস্ক শিল্পী অথবা লেখকদেরই নাড়া দিত, কিন্তু নয়ের দশকের শেষের দিক থেকে গ্রাফিতির সঙ্গে চোখধাঁধানো রঙিন শহুরে জীবনের ছবি জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। পৃথিবীর নানান জায়গায় শিল্পীরা ট্রেনের ওপর ছবি আঁকতে শুরু করে যাতে দূর দূরান্তরের মানুষ তাদের কাজের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। 

২০০১ সালে শহরের বিবর্তনের ফলে এবং প্রধানত 'ইউরোপিয়ান ক্যাপিটাল অফ কালচার' সম্মেলনের পর এখানে স্ট্রিট আর্ট উন্নত হতে শুরু করে। হলিউডি সিনেমা, হিপহপ কালচার থেকে প্রভাবিত হয়ে শিল্পীরা নিজেদের মতো এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করেছিল। কিন্তু শহরের মানুষ শিল্পের নতুন এই ফর্ম নিয়ে উৎসাহী হলেও সরকার কিন্তু কোনোদিনই স্ট্রিট আর্টকে উৎসাহ দেয়নি। ২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত শহরের মেয়র লুই রিও শিল্প কিংবা শিল্পীদের মোটেই গ্রাহ্য করতেন না। তাঁর মত ছিল সরকারি সম্পত্তির ওপরে আঁকিবুঁকি কাটা বেআইনি এবং এতে শুধুই হুলিগানিজ্মকে (hooliganism) প্রশ্রয় দেওয়া হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই লুই রিও একটা অ্যান্টি গ্রাফিতি স্কোয়াড গঠন করে কাজে নেমে পড়লেন। স্ট্রিট আর্টকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তারা পুরোদমে শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলোর ওপর চুনকাম শুরু করে দিল। নতুন ছবি আঁকার ওপরও কড়া নিষেধ জারি হল। 

কিন্তু লুই রিও নিজের শহরের মানুষদের চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ২০১৩ সালে শহরের কেন্দ্রে জনপ্রিয় শিল্পী 'আজুল'-এর একটি ছবি চাপা দেওয়ার অনুমতি দিতেই ইন্টারনেটে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। তিনি যে নতুন যুগের শিল্প ও শিল্পীদের দমিয়ে মুক্ত শিল্পের মৃত্যু ঘটাচ্ছেন সেই নিয়ে সারা দুনিয়া থেকে নানা শিল্পী লুই লিওর সমালোচনা করতে শুরু করল। পোর্তোয় সাধারণ মানুষেরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে লুই রিওর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করল। শহরের স্বাভাবিক চরিত্রকে বধ করে তিনি যে আন্তর্জাতিক পেইন্ট কোম্পানির গোলাম হয়ে কাজ করছেন সেই প্রবাদে খবরের কাগজ আর সোশ্যাল মিডিয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠল কয়েকদিনের মধ্যেই। 

কথায় বলে There are a lot of powerful catalysts and the most flammable is Repression. এই ছোট্ট ঘটনা যে শহরের পৌরসভার ভিত নড়িয়ে দেবে সেটা রিও ভাবতেও পারেননি। রেগেমেগে তিনি সমস্ত গ্রাফিতি মুছে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন অ্যান্টি গ্রাফিতি স্কোয়াডকে। তার পরদিন থেকে এক আজব খেলা শুরু হয়ে গেল পোর্তোয়। দিনের বেলায় অ্যান্টি গ্রাফিতি স্কোয়াডের লোকেরা যে ছবিগুলো মুছে দিয়ে যায়,  সেইখানে পরের দিন সকালে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে লেখা থাকে ‘Continua a pintar’ অর্থাৎ ‘আঁকতে থাকো’। শিল্পীদের দল ভারী হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর নানান প্রান্তে এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে শিল্পী 'আজুল'-কে নিয়ে আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে সারা পর্তুগালে, সবাই আজুল নামে তার আঁকা দেখেছে কিন্তু আসল মানুষটাকে কেউ কোনোদিন দেখেনি। তাঁকে নিয়ে মাতোয়ারা সোশ্যাল মিডিয়া, কয়েকদিনের মধ্যেই সে রহস্যময় নায়ক আর শিল্পী হিসেবে পরিচত হয়ে উঠেছে। 

জনাক্রোশে শেষ পর্যন্ত সরকারকে স্ট্রিট আর্টকে সম্মতি দিতে হয়। মিটিয়ে দেওয়া ছবিগুলোকে আবার নতুন করে আঁকার জন্যে এক পেশাদার শিল্পীকে ডেকে নিয়ে আসা হল। ২০১৪ সালে নির্বাচনে লুই মোরেইরা শহরের মেয়র হলেন। মোরেইরা আবার একেবারেই অন্য গোছের মানুষ, পোর্তো শহরেই তিনি বড় হয়েছেন। শহরের সংস্কৃতি ও মানুষের মানসিকতার সঙ্গে মোরেইরা গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর বন্ধু ও বুদ্ধিজীবী পাউলা কুনহার সঙ্গে পরামর্শ করে মোরেইরা ঠিক করলেন পোর্তোকে লিকুইড সিটি(liquid city) করে তুলতে হবে। সংস্কৃতির গতি যাতে অবাধে বইতে থাকে, সেইজন্যে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীতকে বিশেষ ভাবে প্রাধান্য দিতে হবে এখন থেকে। এই পরিকল্পনাকে কাজে লাগানোর জন্যে প্রথমেই একটা স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভাল করবেন বলে ঠিক করলেন মোরেইরা। সারা দেশের শিল্পীরা এই উৎসবে অংশগ্রহণ করবেন। এপ্রিল ২০১৪ সালে, আইনগত ভাবে পোর্তোর প্রথম মুরাল উদ্বোধন করা হয় মিগুয়েল বোমার্ডা এবং রুয়া ডায়োগো ব্র্যান্ডাউনের মাঝামাঝি অংশে,  যা আর্ট গ্যালারি জেলা ব্যার্রো দাস আর্টসের গেটওয়েগুলির মধ্যে একটি। 

এরপর থেকে স্ট্রিট আর্ট নিয়ে একের পর এক প্রজেক্ট শুরু হয়। স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে করে শহরের নানা জায়গায় বিশাল মুরাল আঁকা হল,  রুয়া দে ফ্লোরাসের ইলেকট্রিক বক্সগুলোর ওপরে আঁকা ছবিগুলো হল বিদ্যুত বিভাগ আর শহরের পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে। ত্রিনিদাদের মেট্রো স্টেশনের কাছেই কার পার্কে আজুল এবং অন্যান্য শিল্পীদের নানান ছবি আঁকা হল। এদিফিসিও একসা বলে একটি রাস্তায় নানা ছবির কাজ শুরু করে তারা,  ফোনের বুথগুলোও স্ট্রিট আর্টের ফলে হয়ে রঙিন হয়ে ওঠে। গত পাঁচ বছরে শহরের রূপই বদলে গেছে স্ট্রিট আর্টের সৌজন্যে। রাস্তা জুড়ে রঙবেরংয়ের ছবি, পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়ে ছবির দিকে চেয়ে থাকে। বছর কুড়ি আগের ময়লারঙের শহরটা অদৃশ্য হয়েছে। বছরে যৌথ ভাবে শিল্পী সম্মেলন হয়, তাতে নানা শিল্পী এসে পরীক্ষানিরীক্ষা করে। 

এত সব কথা আমরা জানতে পারলাম ফের্নান্দোর কাছ থেকেই। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকটা অসামান্য ছবি দেখে ফেলেছি। কয়েকজন শিল্পী সম্পর্কেও জানতে পেরেছি তার কাছ থেকে। ফের্নান্দো নিজে আঁকে না ঠিকই, কিন্তু কোনও ছবির সম্পর্কে বলতে গেলে সে যতটা উত্তেজনা বোধ করে তাতে মনে হয় ছবিটা সে নিজেই এঁকেছে। নিজে অ্যান্ডি ওয়ারহোলের আঁকা ‘banana’ ছাপ্পা দেওয়া একটা টি শার্ট পরে আছে সে, সেটার কথা জিগ্গেস করতেই সে অ্যান্ডি ওয়ারহোলের পপ আর্ট আর ভিজ্যুয়াল আর্ট মুভমেন্টের গল্প শুরু করে দিল খোশমেজাজে। আনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি জানতে পারলাম যে আনার বরং একটু আধটু আঁকার হাত আছে, কিন্তু সে ফোটোগ্রাফি করতেই বেশি ভালোবাসে। আনা আর ফের্নান্দো দুজনেই গতানুগতিক ট্যুর গাইড নয়,  বরং মনে হয় বন্ধুবান্ধবকে নিজের শহর দেখাতে নিয়ে চলেছে।

Related image
Train graffiti 
Near Dom Ponte Luis1
On the street
Near Ponte Dom Luis



Street arts at Car park

Image result for porto street art
Rua de Paraiso, In 2014 an urban art festival left a legacy of murals by BreakOne, Frederico Draw, Fedor, Oker and Alma.

এদিকে স্ট্রিট আর্টিস্টদের তালিকা বেড়েই চলেছে। তথ্যগুলো ফোনে নোট করে রেখেছিলাম বলে এখনও মনে আছে। শহরের প্রতিটা শিল্পীরই নিজস্ব ঘরানা আছে। গদমেস(Godmess) রঙের আধিক্য দিয়ে রাগ আর বিরক্তির প্রকাশ করেন, মেস্কেরের(Mesk) ছবিতে প্রতীক হিসেবে ইঁদুরের ছড়াছড়ি, এইমে(Daniel Eime) স্টেন্সিলের কাজে স্বচ্ছন্দ, মাই নেম ইস নট স্যাম(My name is not Sam) আবার জ্যামিতিক নকশার কাজ করতে ভালোবাসে। 'আজুল'(Hajul) এখনও শহরে সবচেয়ে উজ্জ্বল শিল্পীদের মধ্যে একজন।তিনি ক্যানভাস হিসাবে ব্লক উইন্ডো এবং দরজার ফ্রেম ব্যবহার করে একের পর এক কাজ করে চলেছেন।কস্টাহার (Costah)বেশিরভাগ জনপ্রিয় শিল্প, রঙিন কোলাজ যেখানে পাখি আর চোখ ব্যবহার করে ছবি এঁকেছেন তিন।সেই ক্রিউ(Chei Krew)আবার জিরাফের ভক্ত।

একসময় হাঁটতে হাঁটতে আমরা রিভিয়েরার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। ফের্নান্দোর সঙ্গে গল্প চলছে তো চলছেই,  হাঁটা শেষ হওয়ারও নাম নেই। এময় সময় রাস্তায় প্রচুর হইহল্লা শুনে দেখি প্লাজা চত্বরে পর্দা টাঙিয়ে মৌজ করে রবিবারের দুপুরে ফুটবল চলছে। অন্যদিকে এলজিবিটি প্যারেডে চলেছে কাতারে কাতারে লোক, রঙিন জামাকাপড় পরে বাস থেকে ছেলেমেয়েরা আমাদের দিকে হাত নাড়িয়ে চলছে, আমরাও হাত নাড়িয়ে গানের তালে তালে এগোচ্ছি বেশ। 

সেন্ট বেনটো স্টেশন হয়ে আমরা একটা ছোট গলিতে পৌছে গেছি, ততক্ষণে ফের্নান্দো আমাদের থামিয়ে দিয়েছে একটা আর্ট ওয়ার্কের সামনে। প্রথমে ঠিক ঠাহর করতে পারিনি, তারপর বুঝতে পারলাম। প্রায় তিরিশ হাজার সিরামিক টাইলে ছোট ছোট করে আঁকা আছে অসংখ্য ছবি। নানান বিষয়, নানান লেখা, নানান শৈলীতে আঁকা। সেগুলোর ওপরে বড় বড় করে লেখা Qem Es Porto? অর্থাৎ, কে তুমি পোর্তো?

P1090716
From left to right: Paintings by Chei Krew, GODMESS, Costah & Hazul
Work by Mesk
Work by Costah-hidden birds
LGBT Parade Bus
Soccer Match
Qem Es Porto

ফের্নান্দো বলল, “প্রায় দশ হাজার সাধারণ মানুষের সাহায্যে তৈরি হয়েছে এই অসামান্য কোলাজ। মাইসমেনস বলে একজন শিল্পীর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে অনেক বছর সময় লেগেছে, প্রতিটি মানুষকে চারটে করে সিরামিক টাইল দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছিল ছবির মাধ্যমে জানাতে তাদের জীবনে এই শহরের কী ভূমিকা? এই আঁকায় শুধুই সাধারণ মানুষের জীবনের ছবি দেখতে পাবে। তাদের আনন্দ, দুঃখ, প্রেম, বিরহ, সম্পর্ক, বন্ধুত্বের গল্প।"

শুনে অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠল। আমরা তো এই শহরের সঙ্গেই পরিচিত হতে চেয়েছিলাম, শহরের সাধারণ মানুষের জীবনের কথা জানতে চেয়েছিলাম। এই ছবিটাই কি এই শহরের বাস্তব চিত্র নয়?

ফের্নান্দোকে জিগ্গেস করলাম, “কত লোকে এই ছবির কথা জানে বল তো? পন্টে ডোম লুইস দেখতে যত লোকে যায় তার এক শতাংশ লোকও কি এখানে আসে? অথচ এই কোলাজেই তো প্রতিফলিত হয়েছে এই শহরের জীবনের, এখানকার মানুষের স্বপ্ন আর বাস্তব! তাহলে এই ছবিও তো প্রতীক হয়ে উঠতে পারে পোর্তোর!”

ফের্নান্দো আমার কথার উত্তরে হেসে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ। লোকজন এখানে আসে না বিশেষ। সাধারণ মানুষদের জীবন দেখার বা বোঝার আগ্রহ বা ইচ্ছে সকলের খুব একটা নেই। তবে আমি কিন্তু এখানে প্রায়ই আসি।” 

কৌতূহলী হয়ে জিগ্গেস করলাম, "কেন? লোকজনদের দেখাতে?"

ফের্নান্দো আবার মুচকি হেসে বলল, “না। সেসব নয়। এখানে অনেক বছর আগে আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছিলাম, প্রপোজ করার কথাটাও এখানেই মনে আসে। ভাগ্য ভালো ছিল, মেয়েটা না বলেনি। সেই স্মৃতির আমেজটুকুই অনুভব করতে আসি এখানে। সেই মেয়েটাও আমার সঙ্গে আসে মাঝেমাঝে। আজও এসেছে তো, দেখছ না?"

দেখলাম আনাও হাসছে। ফের্নান্দোর মুখের হাসি আরো চওড়া হয়েছে। আমেরিকান মেয়ে দুটোও খিল খিল করে হাসছে। আমার সঙ্গিনীর মুখ থেকেও হাসি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমিও হেসে ফেললাম। এডিথ হোয়ার্টন একসময় বলেছিলেন যে ভ্রমণের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হল এই সত্যিটুকু জানা যে পৃথিবীতে কত ভালো আর অমায়িক মানুষ আছে। এইটুকুই সারসত্য। বাকি সবকিছুই সাইডলাইনে রাখা যায়, যদি কয়েকজন বন্ধু পাওয়া যায়। কয়েকজন ভালো মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। সত্যিই, এদের সঙ্গে পরিচয় হওয়াও আমাদের বিশাল পাওনা।

স্ট্রিট আর্ট সম্পর্কে অবশিষ্ট কথাগুলো না হয় থাক। এই মুহুর্তটিকে সাক্ষী রেখেই পোর্তোর গল্প শেষ করা যাক। এই হাসির মাধ্যমেই কয়েকটা বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল সেইদিন, সেই স্মৃতিঘন মুহুর্তেই এই স্মৃতিকথা শেষ হোক। 

(এর পর আমরা আরো ঘন্টাখানেক ঘুরেছিলাম। পন্টে লুইস ব্রিজ হয়ে শহরের পুরোনো গলিঘুঁজিতে। বিদায় নেওয়ার সময় ফের্নান্দো আমার হাত ধরে কথা কথা দিয়েছিল, ভারতে তাকে আসতে হবেই। আমাদের সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখবে। সেই কথা সে ভোলেনি। শেষ বিকেলের বিদায় আলোয় বুঝেছিলাম, এই যাত্রায় আমাদের আরো দু’জন বন্ধু হল। ফের্নান্দো আর আনা। সেই বন্ধুত্ব এখনও বজায় আছে।)


(ক্রমশঃ)

যাত্রার পরের অংশ
লাগোস-আলগ্রেভ-পর্তুগাল

(পোর্তো )প্রথম পর্ব এখানে পড়ুন

বই কিনতে হলে:

https://joydhakbooks.in/product/anhc



২টি মন্তব্য: