“One of the great things about travel is that you find out how many good, kind people there are.” -Edith Wharton-
ব্যাকপ্যাকিং এর কয়েকটা অলিখিত বাণীর মধ্যে একটি হলো, 'Walk and talk.' ওয়াক অর্থাৎ হাঁটা আমাদের চলছে পুরোদমে কিন্তু টক করতে গেলেই মাথা ভেবলে যাচ্ছে।স্প্যানিশ ভাষা এবড়ো খেবড়ো ভাবে তাও চলে যাচ্ছিল কিন্তু পর্তুগিজের 'প' ও আমাদের দুজনের মধ্যে কারোরই জানা নেই।কিন্তু স্থানীয় লোকের সঙ্গে মন খুলে কথা না বলতে পারলে নতুন দেশের অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণই থেকে যায়।চিরাচরিত টুরিস্ট সেজে শহরের বিখ্যাত নির্দেশনগুলো চাক্ষুষ করেই কেটে পড়ার ইচ্ছে আমাদের একদমই নেই।আমাদের হোস্ট মারিয়া দিব্যি ইংরেজি বলে,তার সঙ্গে আমাদের বিকেলে আড্ডাও চলছে কিন্তু মারিয়া শহরের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিদৃশ্যের খবর রাখে না।স্থানীয় শিল্পী,লেখক,রাজনেতা,সাধারন লোকজনদের চিন্তাধারা সম্পর্কে জানতে হলে এক শহরে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়।নতুন লোকেদের সঙ্গে পরিচয় হলেও আলাপ গভীর হতে সময় লাগে।আমাদের হাতে অত সময় নেই।কাউচসর্ফিঙ এর মিট-আপে স্থানীয় নানা মানুষের সঙ্গে দেখা হয় বটে কিন্তু সেরকম কোন ইভেন্ট এখন হচ্ছে না।কি করা যায়? নেটে এটা সেটা দেখতে দেখতে একটা ফ্রি স্ট্রিট আর্ট ওয়াক দেখতে পেলাম।পরের দিন দুপুরে তেমন কিছু কাজ নেই,ঘুরে ঘুরে স্ট্রিট আর্ট দেখতে ভালই লাগবে।বুক করে ফেললাম।
Church of saint francis
পরের দিন সকালে উঠে রিভিয়েরার অঞ্চলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্যালেসিয়া দে আর্টস আর বোলসা প্যালেস দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।সেন্ট ফ্রান্সিস গির্জার কাছেই প্যালেসিয়া দে বোলসা,একসময় স্টক এক্সচেঞ্জ থাকলেও নিওপ্যালেডিয়ান স্থাপত্যকলায় নির্মিত এই মহলটি আজকাল ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ।
Palacio de Bolsa
Inside Palace Bolsa
আমাদের অবশ্য ভিতরে যাওয়া হলো না।টিকিটের দাম চড়া।তার ওপর শুধু মিউজিয়াম আর নামকরা জায়গাতেই যাব,সেরকম পরিকল্পনা মোটেই নেই।যেখানে খুশি মেট্রোতে করে চলে গেলেই হলো।
এইখানে পোর্তোর মেট্রোব্যবস্থার কথা না বলে পারছি না।বিদেশে সবকিছুই ভালো,দেশে সব কিছুই নোনাধরা,সেরকম চোখ আমার নয়।যে কোন বড় শহরের মেট্রোর সঙ্গে দিল্লি মেট্রো পাল্লা দিতে পারে।তফাৎ বলতে এইটুকুই যে ইউরোপে মেট্রোর লাইন অনেক বেশি।প্রায় পুরো শহরে মেট্রোর লাইন বিছিয়ে ফেলেছে,কোন কোন জায়গায় স্টেশন এত নীচে মনে হয় পাতালে নেমে যাচ্ছি।মাটির তলায় দশ তলা নেমে স্টেশনে গিয়ে পড়তে হয়।তাছাড়া পরিকাঠামো একই।ওখানে অবশ্য ব্যাগ ফ্যাগ চেক করানোর ব্যাপার নেই,বাচ্চাদের ট্রলি থেকে সাইকেল,সব কিছুই দিব্যি মেট্রোতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে লোকজন।আমাদের এক বন্ধু অস্ট্রিয়া থেকে ব্যাঙলোরে এসে মেট্রোতে ক্যামেরা নিয়ে যেতে গিয়ে সিকুইরিটির বহর থেকে অবাক হয়ে গিয়েছিল।সেই কথা থাক,বরং পোর্তোর কথায় ফেরা যাক।অবাক কান্ড হলো এখানের কোন স্টেশনেই টিকিটঘর বা মেট্রোর কোন লোকজন চোখে পড়ল না।মেশিনে টিকিট নিয়ে লোকজন চলে যাচ্ছে,এমনকি টিকিট চেক করার জন্যে চেকার বা অন্ততপক্ষে স্বয়ংক্রিয় দরজা,সেইসবেরও বালাই নেই।সোজা গিয়ে মেট্রোতে উঠে পড়,যেখানে খুশি নেমে পড়।টিকিট আছে কি না,সেই সব দেখার জন্য কোন ব্যবস্থাই করা নেই।তাও প্রত্যেকেই টিকিট কেটে চড়ছে,কান্ড দেখে প্রথমে বেকুব বনে গেলেও তারপর আত্মস্থ করতে হলো।তফাৎ পরিকাঠামোতে কম,মানসিকতাতে বেশি।
Metro on the Ponte Dom Luis Bridge
দুপুরের কাছাকাছি মারকেদো দে বোলহাওর কাছে একটা দোকান থেকে ইয়াবড় একটা ফ্রান্সিন্হা স্যান্ডুইচ আর কডফিশ বাকালহাউ খেয়ে ত্রিনিদাদে মেট্রো স্টেশনে চলে এলাম।আমাদের স্ট্রিট আর্ট টুরের গাইড ফের্নান্দো বাস্তোসের বয়স চল্লিশের আশেপাশে,তার স্ত্রী আনাও আমাদের সঙ্গে যাবে।আনা একবার ভারতবর্ষ থেকে ঘুরে গেছে।তারা দুজনেই স্ট্রিট আর্টের ভক্ত,সারা পৃথিবীর স্ট্রিট আর্ট মুভমেন্টের যাবতীয় খবর ফের্নান্দোর ঠোঁটস্থ।দুজনে মিলে আরবান আর্ট পোর্তো বলে একটা উদ্যোগ চালাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে,উদ্দেশ্য এখানকার স্ট্রিট আর্ট ও শিল্পীদের সম্পর্কে লোকজনকে সচেতন করা।আমাদের সঙ্গে আরো দুজন আমেরিকান আছে,ফের্নান্দোর সঙ্গে গল্প করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম। স্ট্রিট আর্ট নিয়ে সারা পৃথিবীতে যত উন্মাদনা,আমাদের দেশে সেই তুলনায় অনেক কম।একসময় দেওয়ালের ওপর প্রতিবাদের বাণী হিসেবে গ্রাফিতি করা শুরু হয়েছিল,গ্রাফিতির আঁকা ভ্যানডালিস্ম বলে ধরা হত।প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে মাথা গরম যুবক যুবতীদের দল শহরের রাস্তায় সরকারের বিরুদ্ধে দেওয়ালে স্লোগান লিখে রাখত, রঙের স্প্রে ব্যবহার করে।অনেক জায়গাতেই দেওয়ালে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল আইন করে।কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মানসিকতা বদলাতে শুরু করলো।
Keth Haring 'celebrate the life' art
কিথ হেরিং আর বিষ্টি বয়েজের মত কয়েকজন গ্রাফিতি শিল্পী বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় বিশাল নাম করে ফেলল।লোকেদের আগ্রহ দেখে দেশে বিদেশে বিজ্ঞাপন কোম্পানিরা স্ট্রিট আর্ট আর গ্রাফিতি ব্যবহার করে ক্যাম্পেন চালাতে শুরু করে দিল।
World cup football street art in Latin Amarica
গত কুড়ি বছরে এই শিল্প বিশাল মর্যাদা পেয়েছে সারা বিশ্বে।স্ট্রিট আর্ট আজকাল নগর সংস্কৃতি একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
Shepard Fairey Barack Obama Presidential election cammpain art became viral
Shephard Faiery Kickstarter initiative to protest policies of Donald Trump
আমেরিকা থেকে আর্জেনটিনা প্রতিটা দেশেই এর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।দেশের প্রধান নির্বাচনে স্ট্রিট আর্ট প্রচার অভিযানে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে।স্ট্রিট আর্ট বাস্তবে শিল্পীদের মনের আয়না।মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় দেশের সমসাময়িক ঘটনাবলির সঙ্গে স্ট্রিট আর্টের বিষয়গুলো আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে।
Painting by MOTS, on the desert galleries of Centro Comercial de Cedofeita
Street Art Porto by MrDheo,most popular artist from Porto,he has artworks around the World
নব্বইয়ের দশকে পোর্তোর নাম শুনলে লিসবনের লোকেরা নাক কুঁচকোতো। সেই সময়ে নানান শিল্পী এসে জড় হতে শুরু করেছে লিসবনে,রঙের আধিক্যে শহরকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে,সেই তুলনায় এখানে সাদাকালো,একঘেয়ে জীবনযাত্রায় বিষাদের রং প্রবল।গ্রাফিতির নামে দেওয়ালের ছাইরঙের ওপর উদ্ধত পাঙ্ক ছেলেমেয়েদের দল সাদা রঙের A লিখে রাখত বৃত্তের ভিতরে,যা আসলে এনার্কির (anarchy) চিহ্ন।আর যাই হোক দেওয়ালের সেই কুৎসিত,থ্যাবড়া লেখাকে শিল্প বলা চলে না।গ্রাফিতি লেখার কায়দাকানুনও সময়ের সঙ্গে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে,এককালে গ্রাফিতির ইগোইসটিক (egoistic) লেখা সমমনস্ক শিল্পী অথবা লেখকদেরই নাড়া দিত,কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে গ্রাফিতির সঙ্গে চোখধাঁধানো রঙীন শহুরে জীবনের ছবি জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে শুরু করে।পৃথিবীর নানাণ জায়গায় শিল্পীরা ট্রেনের ওপর ছবি আঁকতে শুরু করে যাতে দূর দুরান্তরের লোক তাদের কাজের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।
Train graffiti
২00১ সালে শহরের বিবর্তনের ফলে এবং প্রধানত 'ইউরোপিয়ান ক্যাপিটাল অফ কালচার' সম্মেলনের পর পর এখানের স্ট্রিট আর্ট উন্নত হতে শুরু করে।হলিউডি সিনেমা,হিপহপ কালচার থেকে প্রভাবিত হয়ে শিল্পীরা কিছুদিনের মধ্যেই নিজেদের মত এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করে।কিন্তু শহরের লোকেরা শিল্পের নতুন এই ফর্ম নিয়ে উৎসাহী হলেও সরকার কোনদিনই স্ট্রিট আর্ট কে উৎসাহ দেয়নি।২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত শহরের মেয়র লুই রিও শিল্প কিংবা শিল্পীদের মোটেই গ্রাহ্য করতেন না।তার মত ছিল সরকারী সম্পত্তির ওপরে আঁকিবুঁকি কাটা বেআইনি এবং এতে শুধুই হুলিগানিস্ম(hooliganism) কে প্রশ্রয় দেওয়া হয়।কয়েকদিনের মধ্যেই লুই রিও একটা এন্টি গ্রাফিতি স্কোয়াড গঠন করে পুরোদমে শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলোর ওপর চুনকাম শুরু করে দিলেন।নতুন ছবি আঁকার ওপর নিষেধ জারি হলো।কিন্তু লুই রিও নিজের শহরের মানুষদের চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।২০১৩ সালে শহরের কেন্দ্রে জনপ্রিয় শিল্পী 'আজুল' এর একটি ছবি চাপা দেওয়ার অনুমতি দিতেই ইন্টারনেটে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে গেল।নতুন যুগে তিনি যে শিল্প ও শিল্পীদের দমিয়ে মুক্ত শিল্পের মৃত্যু ঘটাচ্ছেন সেই নিয়ে সারা দুনিয়া থেকে নানা শিল্পী লুই লিওর সমালোচনা করতে শুরু করলো।পোর্তোয় সাধারন মানুষেরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে লুই রিওর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করলো,শহরের স্বাভাবিক চরিত্রকে বধ করে তিনি যে আন্তর্জাতিক পেইন্ট কোম্পানির গোলাম হয়ে কাজ করছেন সেই প্রবাদে খবরের কাগজ আর সোশ্যাল মিডিয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠলো কয়েকদিনের মধ্যেই।
Near Dom Ponte Luis1
On the street
Near Ponte dom luis
কথায় বলে "There are a lot of powerful catalysts and the most flammable is Repression"এই ছোট্ট ঘটনা যে শহরের পৌরসভার ভিত নড়িয়ে দেবে সেটা রিও ভাবতে পারেননি।রেগে মেগে তিনি সব গ্রাফিতি মুছে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন এন্টি গ্রাফিতি স্কোয়াডকে।তারপর এক আজব খেলা শুরু জয়ে গেল।দিনের বেলায় এন্টি গ্রাফিতি স্কোয়াডের লোকেরা যেই ছবিগুলো মুছে দিয়ে যায়,সেইখানেই পরের দিন সকালে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে লেখা থাকে Continua a pintar অর্থাৎ আঁকতে থাকো।শিল্পীদের দল ভারী হতে শুরু করেছে।পৃথিবীর নানান প্রান্তে এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।ইতি মধ্যে শিল্পী 'আজুল' কে নিয়ে আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে সারা পর্তুগালে,সবাই আজুল নামে তার আঁকা দেখেছে কিন্তু আসল মানুষটাকে কেউ কোনদিন দেখেনি।তাকে নিয়ে মাতোয়ারা সোশ্যাল মিডিয়া,কয়েকদিনের মধ্যেই সে রহস্যময় নায়ক আর শিল্পী হিসেবে পরিচত হয়ে উঠেছে।
জনাক্রোশে শেষ পর্যন্ত সরকারকে স্ট্রিট আর্টকে সম্মতি দিতে হলো।একজন শিল্পীকে মিটিয়ে দেওয়া ছবিগুলোকে আবার করে আঁকার জন্যে ডেকে নিয়ে আসা হলো।২০১৪ সালে নির্বাচনে লুই মোরেইরা শহরের মেয়র হলেন।লুই রিও থেকে মোরেইরা একেবারেই অন্য গোছের মানুষ,পোর্তো শহরে তার বড় হওয়া।শহরের সংস্কৃতি ও মানুষের মানসিকতা ও ওঠানামার সঙ্গে মোরেইরা গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন।তার বন্ধু ও বুদ্ধিজীবী পাউলা কুনহার সঙ্গে পরামর্শ করে মোরেইরা ঠিক করলেন পোর্তোকে লিকুইড সিটি(liquid city) করে তুলতে হবে।সংস্কৃতির গতি যাতে অবাধে বইতে থাকে,সেইজন্যে সাহিত্য,শিল্প,সঙ্গীতকে বিশেষ ভাবে প্রাধান্য দিতে হবে এখন থেকে।এই পরিকল্পনা কে কাজে লাগানোর জন্যে প্রথমেই একটা স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভাল করবেন বলে ঠিক করলেন মোরেইরা যেখানে দেশের নানা জায়গা থেকে শিল্পীরা এসে জড়ো হবে।এপ্রিল ২০১৪ সালে,আইনগত ভাবে পোর্তোর প্রথম মুরাল উদ্বোধন করা হয় মিগুয়েল বোমার্ডা এবং রুয়া ডায়োগো ব্র্যান্ডাউনের মাঝামাঝি অংশে,যা আর্ট গ্যালারী জেলা ব্যার্রো দাস আর্টসের গেটওয়েগুলির মধ্যে একটি।
Street arts at Car park
এর পর থেকে স্ট্রিট আর্ট নিয়ে একের পর এক প্রজেক্ট শুরু হল।স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে করে শহরের নানা জায়গায় বিশাল মুরাল আঁকা হল,রুয়া দে ফ্লোরাসের ইলেকট্রিক বক্সগুলোর ওপরে আঁকা ছবিগুলো হল বিদ্যুত বিভাগ আর শহরের পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে।ত্রিনিদাদের মেট্রো স্টেশনের কাছেই কার পার্কে আজুল এবং অন্যান্য শিল্পীদের নানান ছবি আঁকা হল।এদিফিসিও একসা বলে একটি রাস্তায় নানা ছবির কাজ শুরু করে তারা,ফোনের বুথ গুলোও স্ট্রিট আর্টের ফলে হয়ে রঙীন হয়ে ওঠে।
গত পাঁচ বছরে শহরের রূপই বদলে গেছে স্ট্রিট আর্টের সৌজন্যে।রাস্তা জুড়ে রং বেরঙের ছবি,বছর কুড়ি আগের ময়লারঙের শহরটা অদৃশ্য হয়েছে।বছরে যৌথ ভাবে শিল্পী সম্মেলন হয়,তাতে নানা শিল্পী এসে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে।
Rua de Paraiso,In 2014 an urban art festival left a legacy of murals by BreakOne, Frederico Draw, Fedor, Oker and Alma.
এত সব কথা আমরা জানতে পারলাম ফের্নান্দোর কাছ থেকেই।ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকটা অসামান্য ছবি দেখে ফেলেছি।কয়েকজন শিল্পী সম্পর্কেও জানতে পেরেছি তার কাছ থেকে।ফের্নান্দো নিজে আঁকে না ঠিকই,কিন্তু কোন ছবির সম্পর্কে বলতে গেলে সে যতটা উত্তেজনা বোধ করে তাতে মনে হয় ছবিটা সে নিজেই এঁকেছে।সে নিজে এন্ডি ওয়ারহোলের আঁকা banana ছবি দেওয়া একটা টি শার্ট পরে আছে,সেটার কথা জিগ্গেস করতেই সে এন্ডি ওয়ারহোলের পপ আর্ট আর ভিজ্যুয়াল আর্ট মুভমেন্টের গল্প শুরু করে দিল খোশমেজাজে।আনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি জানতে পারলাম যে আনার বরং একটু আধটু আঁকার হাত আছে,কিন্তু সে ফোটোগ্রাফি করতেই বেশি ভালোবাসে।আনা আর ফের্নান্দো দুজনেই গতানুগতিক ট্যুর গাইড নয়,বরং মনে হয় বন্ধুবান্ধবকে নিজের শহর দেখাতে নিয়ে চলেছে।
প্রতিটা শিল্পীরই নিজস্ব ঘরানা আছে।গদমেস (Godmess) রঙের আধিক্য দিয়ে রাগ আর বিরক্তির প্রকাশ করেন,মেস্কের(Mesk) আঁকায় ইঁদুরের ছড়াছড়ি,এইমে(Daniel Eime) স্টেন্সিলের কাজে স্বচ্ছন্দ,মাই নেম ইস নট স্যাম(My name is not Sam) আবার জ্যামিতিক নকশার কাজ করতে ভালোবাসে।
'আজুল'(Hajul) এখনও শহরে সবচেয়ে উজ্জ্বল শিল্পীদের মধ্যে একজন।তিনি ক্যানভাস হিসাবে ব্লক উইন্ডো এবং দরজার ফ্রেম ব্যবহার করে একের পর এক কাজ করে চলেছেন।কস্টাহার (Costah)বেশিরভাগ জনপ্রিয় শিল্প, রঙিন কোলাজ যেখানে পাখি আর চোখ ব্যবহার করে ছবি এঁকেছেন তিন।সেই ক্রিউ(Chei Krew)আবার জিরাফের ভক্ত।
From left to right: Paintings by Chei Krew, GODMESS, Costah & Hazul
Work by Mesk
Work by Costah-hidden birds
একসময় হাঁটতে হাঁটতে আমরা রিভিয়েরার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম।ফের্নান্দোর সঙ্গে গল্প চলছে তো চলছেই,হাঁটা শেষ হওয়ারও নাম নেই।এময় সময় রাস্তায় বিশাল হইহল্লা শুনে দেখি একদিকে পর্দা টাঙিয়ে মৌজ করে রবিবারের দুপুরে ফুটবল চলছে,অন্যদিকে এল জি বি টি প্যারেডে চলেছে কাতারে কাতারে লোক,রঙীন জামাকাপড় পরে বাস থেকে ছেলেমেয়েরা আমাদের দিকে হাত নাড়িয়ে চলছে,আমরাও হাত নাড়িয়ে গানের তালে তালে এগোচ্ছি বেশ।
LGBT Parade Bus
Soccer Match
সেন্ট বেনটো স্টেশন হয়ে আমরা একটা ছোট গলিতে পৌছে গেছি,ততক্ষণে ফের্নান্দো আমাদের থামিয়ে দিয়েছে একটা আর্ট ওয়ার্কের সামনে।প্রথমে ঠিক ঠাহর করতে পারিনি,তারপর বুঝতে পারলাম।প্রায় তিরিশ হাজার সেরামিক টাইলে ছোট ছোট আঁকা ছবি।নানান বিষয়,নানান লেখা,নানান ছবি।সেগুলোর ওপরে বড় বড় করে লেখা Qem Es Porto অর্থাৎ কে তুমি পোর্তো?
Qem Es Porto
ফের্নান্দো বলল যে প্রায় দশ হাজার সাধারণ মানুষের সাহায্যে তৈরী হয়েছে এই অসামান্য কোলাজ।মাইসমেনস বলে একজন শিল্পীর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে অনেক বছর সময় লেগেছে,প্রতিটি মানুষকে চারটে করে সেরামিক টাইল দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছিল ছবির মাধ্যমে জানাতে তাদের জীবনে এই শহরের কি ভূমিকা?এই আঁকায় শুধুই সাধারণ মানুষের জীবনের ছবি।তাদের আনন্দ,দুঃখ,প্রেম,বিরহ,সম্পর্ক,বন্ধুত্বের গল্প।এই ছবিই কি এই শহরের বাস্তব চিত্র নয়?
ফের্নান্দোকে জিগ্গেস করলাম যে কত লোকে এই ছবির কথা জানে?পন্টে ডোম লুইস দেখতে যত লোকে যায় তার এক শতাংশ লোকও কি এখানে আসে?অথচ এই কোলাজেই তো প্রতিফলিত হয়েছে এই শহরের জীবনের,এখানকার মানুষের স্বপ্ন আর বাস্তব?তাহলে এই ছবিও তো প্রতীক হয়ে উঠতে পারে পোর্তোর!ফের্নান্দো আমার কথার উত্তরে হেসে বলল,"তুমি ঠিকই বলেছ।লোকে এখানে আসে না,সাধারণ মানুষদের জীবন দেখার খুব একটা ইচ্ছে সকলের নেই,কিন্তু আমি এখানে প্রায়ই আসি।"
কৌতুহলী হয়ে জিগ্গেস করলাম,"কেন?লোকজনদের দেখাতে?"
ফের্নান্দো আবার মুচকি হেসে বলল,"না।এখানে অনেক বছর আগে আমার গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে এসেছিলাম,প্রপোজ করার কথাটাও এখানেই মনে আসে।সেই স্মৃতির আমেজটাই অনুভব করতে আসি এখানে।সেই মেয়েটাও আমার সঙ্গে আসে।আজও এসেছে তো,দেখছ না?"
দেখলাম আনাও হাসছে।ফের্নান্দোর মুখের হাসি আরো চওড়া হয়েছে।আমেরিকান মেয়ে দুটোও খিল খিল করে হাসছে।আমাদের মুখেও হাসি।
স্ট্রিট আর্ট সম্পর্কে অবশিষ্ট কথাগুলো না হয় থাক।এই মুহুর্তটিকে সাক্ষী রেখেই পোর্তোর গল্প শেষ করা যাক।এই হাসির মাধ্যমেই কয়েকটা বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল সেইদিন,সেই স্মৃতিঘন মুহুর্তেই এই স্মৃতিকথা শেষ হোক।
(এর পর আমরা আরো ঘন্টাখানেক ঘুরেছিলাম।পন্টে লুইস ব্রিজ হয়ে শহরের পুরোনো গলিঘুঁজিতে।বিদায় নেওয়ার সময় ফের্নান্দো আমার হাত ধরে কথা কথা দিয়েছিল,ভারতে তাকে আসতে হবেই।আমাদের সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখবে।সেই কথা সে ভোলেনি।শেষ বিকেলের বিদায় আলোয় বুঝেছিলাম,এই যাত্রায় আমাদের আরো দুজন বন্ধু হোল।ফের্নান্দো আর আনা।)
তিনটে পার্টের মধ্যে এইটা আমার মন সবচেয়ে কেড়েছে
উত্তরমুছুনথ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ
মুছুন