শুক্রবার, ২ অক্টোবর, ২০২০

পোর্তো ( দ্বিতীয় পর্ব)


Livraria Lello Bookstore
“I sometimes think that I enjoy suffering. But the truth is I would prefer something else.”― Fernando Pessoa, The Book of Disquiet

পর্তুগালকে ঘিরে মানুষের মনে যে ধারণা আছে তাতে মনে হয় পর্তুগিজ সমাজ আমুদে,উদার,মিশুকে এবং বন্ধুভাবাপন্ন।এর প্রতিটাই সত্যি,কিন্তু যেই ভাবের প্রকাশ এখানকার লোকজনের রোজকার জীবনযাপনে সহজে বুঝতে পারা যায় না সেটা হলো বিষাদ,আরো ভালো করে বলতে গেলে 'পর্তুগিজ পেন্চ্যান্ট অফ মেলানকলি।'প্রচলিত এই কথার শিকড় আছে বহু গভীরে।এ ভাব ঠিক আমাদের চেনা দুঃখের নয়,এই অনুভূতি অন্য।পর্তুগিজরা প্রচন্ড আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল।এককালে এখানকার বহু মানুষ আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা করেছে,অনেকেই ফিরে আসেনি কোনোদিন।ব্ল্যাক প্লেগে এই ছোট্ট দেশের এক তৃতীয়াংশ মুছে গিয়েছিল আগেই,তার পর ব্যবসার খাতিরে প্রতিটা বাড়ি থেকেই একজন দুজন করে সমুদ্রসফরে বেরিয়ে পড়ত।পরিজনদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি ও বন্ধুবিচ্ছেদ পর্তুগিজ সমাজের সাহিত্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সময়ের সাথে।

আজকাল পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গাতেই যখন ভিজ্যুয়াল মিডিয়ামের দৌরাত্ম বেড়ে চলছে সেদিন দিয়ে পর্তুগালের লোকেরা অনেকটাই পিছিয়ে।আজও সিনেমা,টিভি,ইন্টারনেট স্ট্রিমিং এর যুগে তাদের সাহিত্যকে পর্তুগিজরা আন্তরিক ভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।প্রতিটা শহরেই প্রচুর ছোট বড় বইয়ের দোকান,পৃথিবীর প্রাচীনতম বইয়ের দোকানও লিসবনে অবস্থিত।ফার্নান্দ পেসোওয়া,আলমেইডা গ্যারেট,কিয়েরজ,সারামাগো,ক্যামিলো ব্রাঙ্কা সকলের লেখাতেই এই বিষন্নতা অনুভব করা যায়।শুধু সাহিত্যেই নয়,এই বিষন্নতাবোধ অনুভব করা যায় পর্তুগালের সঙ্গীতেও।'ফাদো' আর 'সাউদাদে' গানে উঠে আসা দুঃখ,দ্বন্দ,আশা,প্রেম এবং নষ্টালজিয়া।

Statue of Camilo Branco 

ক্যামিলো ব্রাঙ্কোর মূর্তির সঙ্গে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল আদ্রিয়ানোর সাথে।সকালবেলায় রিভিয়েরা অঞ্চলের ক্লেরিগোস গির্জার কাছ থেকে আমরা কয়েকজন এগোচ্ছি নদীর দিকে।
Porto City Hall


Igreja do Corma Cathedral 

রুয়া দে কারমো থেকে এগিয়ে ডান দিকে কার্লস আলবের্তো স্কয়ারে পড়তেই সামনে বিশাল একটি গির্জা দেখা গেল।গির্জার ডানদিকের দেয়ালে এখানকার বিখ্যাত নীল টালির কাজ করা।বোরাক- রোককো তৈরী করা এই গির্জা আসলে একটি নয়,দুটি গির্জার সন্ধিস্থল।বাঁদিকে কার্মেলাইট গির্জার সঙ্গে ঘেঁসাঘেষি করে থাকা এই স্থাপত্যকে রাষ্ট্রীয় স্মৃতিস্তম্ভ করে তোলা হয়েছে।ডান দিকে পোর্তো বিশ্ববিদ্যালয়কে পাশ কাটিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম লেভেরিয়া লেললোর বইয়ের দোকানের সামনে।হালে এই বইয়ের দোকান বিরাট নাম করেছে হ্যারি পটারের দৌলতে।জে কে রাউলিং হ্যারি পটারের নানা চরিত্র আর জাদুর দুনিয়া গড়ে তুলেছিলেন ইউরোপের নানা প্রান্তের বাস্তব জীবন থেকেই,বইয়ে ডায়াগন এলিতে থাকা বইয়ের দোকান 'ফ্লোরিশ এন্ড বোল্টস' হুবহু লেভেরিয়া লেল্লোর আদলে লেখা।এখানে দোকানের মাঝবরাবর সর্পিল এক সিঁড়ি আছে যেখানে উঠে ফটো তুলতে টুরিস্টদের ভিড় লেগে থাকে সারাদিন।বিশাল লাইন পড়েছে ভিতরে ঢোকবার জন্যে,সেই দিকে আর পা বাড়ালাম না।রাউলিং লেভেরিয়া লেললো ছাড়াও পোর্তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিফর্মের আদলে হগওয়ার্টসের ইউনিফর্ম তৈরী করেছিলেন।আদ্রিয়ানো আমাদের জানালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের দল প্রতিদিনই গান বাজনা পারফর্ম করে শহরের রাস্তাঘাটে,দেখলে মনে হবে অবিকল হগওয়ার্টস থেকে লোকজন নেমে এসেছে মাগালদের সামনে।ভাগ্যক্রমে সেই দৃশ্য আমরা খানিকবাদেই দেখতে পেয়েছিলাম।
Porto University students playing on streets 
হাঁটতে হাঁটতে পার্কে দে লিসবোয়ার পাশ দিয়ে এসে রাস্তা পেরিয়ে ফটোগ্রাফি মিউজিয়ামের কাছে এসে পড়লাম।প্রাচীন কাল থেকে সমসাময়িক কাল অব্দি ফটোগ্রাফির জিনিসপত্র,ক্যামেরা আর ছবি ছাড়াও ফ্রিদা কাহলোর জীবনের নানা ছবি রাখা আছে এখানে।কাছেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানকার লাইব্রেরি,কোর্টহাউস,কয়েকটা ক্যাথলিক চার্চ।সেইদিকে না এগিয়ে টুকিটাকি গল্পের ফাঁকে আদ্রিয়ানোকে অনুসরণ করে আমরা ঢুকে পড়লাম ডান দিকের সরু গলিতে।ইহুদিদের পাড়া পেরিয়ে গিয়ে গলির প্রান্তে পৌঁছতেই চোখ জুড়িয়ে গেল।গলিটা শেষ হয়েছে একটা চত্বরে।সেখান থেকে সারা রিভিয়েরা অঞ্চলটা দেখা যাচ্ছে।বাঁ দিকে পথটা ঘুরোনো সিঁড়ি হয়ে সরু গলির গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে।সামনে সার সার রং বেরঙের বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে রাস্তা দেখা যাচ্ছে।এখানকার সব বাড়িঘরের ছাদ খয়েরি লাল টালির।লাল টালির ছাদগুলো চোখে পড়ছে নদীর ধার পর্যন্ত।তার মাঝে শির উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে গির্জার মিনার।পশ্চিমবাহিনী ডোউরো নদীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে অনেক ছোট বড় জাহাজ।এক মুহুর্তের জন্যে মনে হলো আমরা যেন পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফিরে এসেছি।বন্দর থেকে একের পর এক ব্যবসায়ীদের জাহাজ চলেছে সমুদ্রের বক্ষে।আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সিগালের দল,তাদের ডাকে ডাকে মুখরিত হয়ে আছে নদীর ধার।নদীর অপর প্রান্তে আজকাল পোর্ট ওয়াইনের নানান সেলার আছে,অনেকেই পোর্ট ওয়াইনের কারখানা দেখতে আর ওয়াইন টেস্ট করতে যায় সেদিকে।আদ্রিয়ানো আমাদের এই বন্দরের আর্থিক আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছিল।

অনেকক্ষণ পর সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমরা পৌঁছে গেলাম রুয়া দে মৌজিন্হা দা সিলভেইরাতে।গলির শেষ অংশটা আসলে নদীর একটা টানেলের ওপরে তৈরী করা হয়েছিল,বলা যায় গলিটার নীচে দিয়ে এখনো নদী বইছে।আঁকা বাঁকা গলিতে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলাম রুয়া দাস ফ্লোরেসে।আক্ষরিক অর্থেই এই গলির নাম ফ্লাওয়ার স্ট্রিট।একসময় এক পাদ্রীর ফুলের দোকান ছিল এখানে,তার পর নানা লোকে এখানে ফুলের ব্যবসা করতে শুরু করে।ইহুদিদের ব্যবসার প্রধান জায়গা ছিল এই ফুলগলি।আজ অবশ্য চোখ ধাঁধানো সুন্দর দোকানপাট,রেঁস্তরা দিয়ে সাজানো এই পথ দেখে মন ভালো হয়ে যায়।

Rua das flores
ফ্লাওয়ার্স স্ট্রিট সাও বেনটো স্টেশন থেকে প্যালেশিও দাস আর্তেস অব্দি চলে গেছে।আর্টস মিউজিয়ামের দিকে না এগিয়ে আমরা চললুম সাও বেনটো স্টেশনের দিকে।ততক্ষণে জমাটি বাজার বসে গেছে ফুলগলিতে।নানান শিল্পী অসাধারণ ছবি আর হস্তশিল্প বিক্রি করছেন রাস্তার ধারে বসে,সঙ্গে চলছে বাস্কিং স্ট্রিট মিউজিকের সুর।একসময় আমরা এসে হাজির হলাম সাও বেনতো ট্রেন স্টেশনে।স্টেশনের প্রধান ফটক পার হলেই দেওয়ালের অসামান্য সাজসজ্জা দেখে চমকে উঠতে হয়।কুড়ি হাজার নীল সাদা সিরামিক টাইলের ওপরে ভালদেভেজের যুদ্ধ সহ নানা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।আদ্রিয়ানোর কাছে জানতে পারলাম শিল্পী জর্জ কোলাকরের এই টাইলগুলো আঁকতে লেগেছিল প্রায় এগারো বছর।
Tiles Painting Sao Bento Station Porto 
Sao Bento Station 
স্টেশন থেকে গির্জা চত্বরে আসতে আসতে আমাদের পায়ে ব্যথা হয়ে গেল।দুরত্ব খুব বেশি না হলেও গির্জাটি তৈরী হয়েছে পাহাড়ের ওপর।সেখান থেকে নদীর অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।এদিকে রোদ বেশ চড়া হয়ে গেছে,পেটেও ইঁদুর লাফাতে শুরু করেছে।আদ্রিয়ানো কে বিদায় জানিয়ে খানিক হেঁটে সানটো আন্তনিও গির্জার কাছে ম্যাকডোনাল্ড এ এসে হাজির হলাম।বলার মত কিছুই থাকত না যদি না এই ম্যাকডোনাল্ড অন্য কোন জায়গায় হত।এই বিশেষ ম্যাকডোনাল্ড তৈরী করা হয়ে একসময়ের বিখ্যাত ইম্পেরিয়াল ক্যাফেতে, "বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ম্যাকডোনাল্ডস" বলে সারা পৃথিবীতে এর সুনাম আছে।বাইরের বিশাল ইগল আর ভিতরের আঁকা সিলিং আর ঝাড়বাতি সহ এই রেঁস্তরাটি প্রাচীন ডেকো বৈশিষ্ট্যগুলি একইভাবে ধরে রেখেছে।
Most Beautiful Mcdonald of the World 
পেট ঠান্ডা করে আমরা চললুম রিভিয়েরার অন্তরীণ এলাকাগুলোতে।পোর্তোর পুরোনো শহরটি প্রচন্ড উঁচুনিচু,খাড়া পাহাড়ের ধারে রাস্তাগুলো ওপরে নীচে নেমে গেছে।রিভিয়েরা অঞ্চল একসময় নাবিকদের আড্ডা ছিল,ছোট ছোট ঢালু রংবেরঙের গলিতে বন্দরে আসা নাবিকদের জন্যে আমোদপ্রমোদের সব বন্দোবস্তই থাকত।সেই সব দিনের ইতিহাস আজও হালকা ভাবে জড়িয়ে রেখেছে রিভিয়েরাকে।বন্যার সময় বেশ কয়েকবার রিভিয়েরা অঞ্চল জলের তলায় চলে গেছিল,উচ্চবিত্তরা তখন সবাই শহরের অন্য পাড়াতে চলে গিয়েছিল।এখন পর্যটকদের ভিড়ে রিভিয়েরা অঞ্চলের বাড়ির মালিকদের পোয়াবারো।বারোমাস টুরিস্টের ভিড় লেগে থাকে,গজিয়ে উঠেছে নানান রিসর্ট,ছোট বড় হোটেল,রেঁস্তরা।সৌভাগ্যক্রমে এই সব হওয়া সত্ত্বেও রিভিয়েরার স্বাভাবিক সত্তা এখনো বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে।
গলির মধ্যে দিয়ে চলেছি।হলুদ,নীল,গোলাপী বাড়ির গায়ে নানা নকশা করা আছে।লাল টালির ঢালু ছাদ বলে ছাদে কাপড় শুকনোর উপায় নেই,বেশ কয়েকটি বাড়িতে দেখলাম জানলা দিয়ে গলিতে কাপড় মেলেছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ডোউরো নদীর ধারে এসে পড়লাম।নদীর ধার দিয়ে ধার দিয়ে বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে পন্টে লুইস ব্রিজের দিকে।একের পর এক রেঁস্তরায় পরিবেশিত হচ্ছে জিভে জল আনা সব খাবারের পদ,ওয়াইনের বন্যা এসেছে তার সঙ্গে।সুবাসিত খাবারের গন্ধের সঙ্গে বন্দরের উল্লাস মিশে এক আনন্দ উৎসবের আবেশ তৈরী করেছে।দেশ বিদেশের লোকে ঘোরাফেরা করছে।
Near Dom Luis Bridge 
Restaurants at Riviera bank 
Ferry at Douro river 
তারই মাঝে প্রথম আমাদের চোখে দর্শন দিল গুস্তাভ আইফেলের মনমাতানো নকশায় নির্মিত পোর্তোর অদ্বিতীয় প্রতীক ডোম লুইস ব্রিজ,পর্তুগিজে যাকে বলে পন্টে ডোম লুইস।
Ponte Dom Luis 1,Porto 
গুস্তাভ আইফেলকে সারা দুনিয়ার লোকে চেনে আইফেল টাওয়ারের ডিজাইনর হিসেবে,আইফেল টাওয়ারের আগেও যে তিনি পৃথিবীর নানান জায়গায় নানান সৌধের নির্মাণ করেছেন,সেই খবর নিয়ে বেশিরভাগ লোকেই মাথা ঘামায় না।অথচ এই কাজগুলো না হলে আধুনিক স্থ্যাপত্যশিল্প যে অনেক পিছিয়ে থাকত আজ তাতে কোন সন্দেহ নেই।ডোম লুইসের পরিকল্পনার আগেই গুস্তাভ আইফেল সিঙ্গল ডেক ব্রিজ বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন,কিন্তু তখন সেই প্রস্তাবে সাড়া পাননি।১৮৮০ সালে ডোউরোর ওপর ডবল ডেক ব্রিজ বানানোর জন্যে নকশা আমন্ত্রণ করা হয়,সেখানে গুস্তাভের পরিশীলিত নকশা পছন্দ করে নির্মাণ কার্য শুরু হয়।সেই সময় ১৩০০ ফুট লম্বা আর প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু এত বিশাল আর্চ ব্রিজ পৃথিবীতে কোথাও ছিল না।এখনও এই নির্মাণের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়।ব্রিজের নীচের ডেক দিয়ে বাস,গাড়ি ইত্যাদি চলে।অপরের উঁচু ব্রিজের দুদিকে পায়ে হেঁটে চলার রাস্তা আছে।এই অপরের ডেক দিয়েই মেট্রো চলে কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে পথচারীদের এই ব্রিজে মেট্রোর গতি খুব কম রাখা হয়।নদীর ধার দিয়ে ফার্নিকুলার লিফ্ট ব্রিজের উঁচু ডেকে নিয়ে যায়,সেখানে না গিয়ে আমরা পাশের ঘোরানো পাথরের সিঁড়ির গলি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম।উঁচু বলে একটু হাঁপ ধরে ঠিকই,কিন্তু উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে রিভিয়েরার দৃশ্যও সুন্দর হচ্ছে বলে সেই কষ্ট ভুলে যাওয়া যায়।একসময় হেঁটে ডোম লুইসের উঁচু ডেকের মাঝখানে যখন পৌঁছলাম,সব কষ্টই এক লহমায় হাওয়া হয়ে গেল।
The view from dom ponte luis 
এখান থেকে সারা রিভিয়েরা এলাকাটাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।লাল টালির বাড়িগুলো গায়ে গায়ে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বন্দরের পাশে।অনেক নীচের জলে একের পর এক জাহাজ এগিয়ে চলেছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে।শহরের দু দিকের মধ্যযুগের কেল্লার আদল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,দেখতে পাচ্ছি খানিক দুরের মারিয়া পিয়া রেল ব্রিজ।কিছুক্ষণ মুগ্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।ব্রিজের অন্য দিকে ডোউরো পার্ক থেকে অসামান্য সূর্যাস্ত দেখতে পাওয়া যায়।আমাদের হাতে এখনো সময় আছে,সূর্য ডুবতে প্রায় ঘন্টা তিনেক বাকি।এই ফাঁকে সমুদ্র দর্শন করে এলে খারাপ হয় না।

যেমন ভাবা তেমনই কাজ।স্যাটাস্যাট নেমে নদীর পাড় দিয়ে এগিয়ে চললাম ট্রাম স্ট্যান্ডের দিকে।মারিয়ার কাছে কাল জানতে পেরেছি,নদীর একদম ধার দিয়ে ট্রাম চলে সমুদ্রের ধার পর্যন্ত।সমুদ্রের কাছেই হার্দিম দে পাসেইও আলেগ্রে বলে একটা ছোট্ট বাগান আর লাইটহাউস আছে।ট্রাম পেতে অসুবিধে হলো না।টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম।টুক টুক করে ট্রাম চলতে শুরু করলো নদীর ধার দিয়ে।একদিকে নদী,অন্যদিকে শহরের নানা নির্দেশন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখা যাচ্ছে।রেইল মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে,আরাবিদা ব্রিজ দেখে আমাদের সমুদ্রের কাছে পৌঁছতে কুড়ি মিনিট লাগলো।পার্কের ভিতরে গিয়ে মোহনার ধারে এসে বসলাম।

Sea from Jardim do Passeio Alegre
সামনে উত্তর অতলান্তিকের অতল জলরাশি।এর আগে অতলান্তিক মহাসাগরের দেখা পাইনি,স্বভাবতই মনটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।বিশাল কোন কিছুর সামনে এলেই মন শান্ত হয়ে আসে,এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।গাঢ় নীল রঙের জল।
শহরের সীমানা এখান থেকে উত্তরে ঘুরে গেছে,সেখানে আধুনিক কায়দার ঘরবাড়ি তৈরী হচ্ছে নজরে পড়ল।দেদার হাওয়া দিয়ে চুল উড়িয়ে দিচ্ছে,রোদের মধ্যে এরকম সামুদ্রিক হাওয়া কার না ভালো লাগবে?সীগালরা দল বেঁধে উড়ছে,নিমেষে দেড় ঘন্টা কেটে গেল।
আবার ডোম লুইসে ফিরতে হবে,উঠে পড়ে আবার গিয়ে ট্রামে চড়ে বসলাম।

ডোম লুইস পেরিয়ে যখন জোর কদমে হাঁটছি ডোউরো পার্কের দিকে,সূর্যাস্ত প্রায় হব হব করছে।আকাশের রং বদলে গিয়ে লালচে কমলা একটা আভা ছড়িয়ে পরেছে সারা রিভিয়েরাতে।টালির বাড়িগুলোতে একটা দুটো করে আলো জ্বলে শুরু করেছে,ডোউরো পার্কে শুরু হয়ে গেছে গ্রীষ্মের সান্ধ্যকালীন মিউজিক কনসার্ট।তাড়াতাড়ি পার্কে এসে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম।সূর্য অস্ত যাচ্ছে নদী ছাড়িয়ে,পশ্চিমে রিভিয়েরার পিছনে।আকাশ এখন রক্তিম,বন্দরের জাহাজগুলোর প্রতিকৃতি পড়ছে নদীর জলে।পন্টে ডোম লুইসের নিঃশব্দে নদীর বুকে নেমে আসা এই রাতকে স্বাগত জানাচ্ছে।সন্ধ্যের রঙ।আকাশের রঙ।জলের রঙ।এই রঙ এর নাম নেই।এই রঙ ফটোগ্রাফ অথবা ক্যানভাসে দেখা যায় না।এই রঙ একমাত্র প্রকৃতিই উপহার দিতে পারে।মনের সঙ্গে চোখের সন্ধি থাকলে দৃষ্টিতে ধরা পড়ে এই মায়াবী সূর্যাস্তের রঙ।কেউ কেউ দেখতে পায়,কেউ পায় না।
Sunset over Ponte Dom Luis 1 

Sunset Riviera 
Concert in Douro Park 

ক্রমশঃ


পরের পর্ব পড়তে হলে

পোর্তো (তৃতীয় পর্ব)


আগের পর্ব পড়তে হলে

পোর্তো (প্রথম পর্ব)






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন