এই বিচ্ছেদ আপনার কোমর মত হতে পারত, তন্বী। আর এই বসন্ত ফুলের মত হল, ক্ষণিক; আপনার গোলাপের গালের মত না, বার্ষিক। আমার ধৈর্যও তাদের মতনই স্থায়ী, তোমার অনুপস্থিতিও সেইরূপ। পরিপূরক ছাড়াও তুমিও আমাকে কত খুশি করেছ..." ~আল মুতামি
ঘন নীল জল তটরেখার কাছে স্বচ্ছ সবুজ রঙের ওড়না টেনে নিয়েছে, ধীরে ধীরে সূর্য ডুবছে আকাশে, অযত্নে কেউ আবির ঢেলে ভুলে গেছে মেঘের গায়ে, সোনাঝুরি রঙের বালিয়াড়ির ওপর হু হু করে হাওয়া চলে মাথার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে, প্রকাণ্ড শিলাপাথরের সৈন্যবিন্যাস এঁকেবেঁকে হারিয়ে গেছে তটরেখা ধরে। অন্ধকার হতে আর দেরি নেই। এই স্মৃতিটুকুর জন্যেই তো লোকে ফিরে ফিরে আসে।
সারা পৃথিবী থেকে যে লক্ষ লক্ষ লোকে যে এইখানে ছুটে আসবে ছুটি কাটাতে, তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? পর্তুগালের দক্ষিণ প্রান্তের জনপ্রিয় অঞ্চল আলগ্রেভের সমুদ্রসৈকতের সম্মোহনী ক্ষমতার কথা আজকাল সকলেই জেনে গিয়েছে। এই সৌন্দর্য সৈকতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রধানত গ্রীষ্মকালে যেরকম হুড়োহুড়ি পড়ে, সেরকম দক্ষিণ ইউরোপের কোনও সমুদ্রসৈকতেই পড়ে না। ইতালির আমালফি কোস্টও অবশ্য সমুদ্র দেখার জন্যে আদর্শ জায়গা, সেখানেও বেশ কিছু রিসর্ট টাউন গড়ে উঠেছে। কিন্তু আলগ্রেভের মেজাজ তার চেয়ে একেবারেই অন্যরকম। পর্তুগাল ইতালির চেয়ে সস্তাও বটে, তার ওপর কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চল নিয়ে বহুবার লেখালিখি হয়েছে খবরের কাগজে আর পত্র পত্রিকায়। পর্তুগালের সবচেয়ে বিত্তশালী অঞ্চলের একটি হল আলগ্রেভ, অবসর জীবন যাপন করার জন্যে পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গার আখ্যা পেয়ে এখানকার খ্যাতি ছড়িয়েছে আগুনের গতিতে। লাগোস, ফারো, আলবুফেইরা, পোর্তিমাও প্রভৃতি জায়গার বিচগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমুদ্রসৈকতের দৌড়ে অগ্রগণ্য। অতএব খানিকটা বিত্তবান ভ্রমণপিপাসুদের দৌলতে আর খানিকটা বিপণন আর প্রচারের ফলে আলগ্রেভ বিশ্বপর্যটনের প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
Tavira |
কয়েক দশক আগে অব্দি যেই শহরগুলো শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকত প্রায় সারা বছর, এখন সেখানে অনবরত টুরিস্টদের আনাগোনা লেগে থাকে। বিশাল বিশাল রিসর্টের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নানা মাপের হোটেল আর রেস্তোরাঁ। সাদা পাথরের ধপধপে সাদা বাড়ির ওপর লোহার বাহারি ঝুলবারান্দা, আর রঙিন চৌকো খাঁজকাটা দরজা জানলা দিয়ে সাজানো এখানকার বাড়িগুলো দেখে মনে হয় ছবির বই থেকে উঠে এসেছে।
পোর্তো আসার আগেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল অন্তত আলগ্রেভের একটা জায়গায় সন্দর্শন করে অতলান্তিকের জলে যাবতীয় পাপ ধুয়ে ফেলব। প্রকৃতিকে কাছে পেলেই আমাদের ভক্তি ভাব উমড়ে আসে, তীর্থ করার ইচ্ছে প্রবল হয়। সেই কারণে আমাদের তীর্থস্থানে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সিনাগগ না থাকলেও হয় সমুদ্র, নয় পাহাড়, কিংবা জঙ্গল থাকেই। ইশ্বর প্রকৃতির কোনও এক অবয়বের রূপ ধরে এসে আমাদের দর্শন দিয়ে উদ্ধার করেন।
আমরা ঠিক করেছি লাগোস যাব। ফারো আলগ্রেভের রাজধানী, আকারেও বড়। তাভিরা, সিলভেস আর মনচিকেও আশ্চর্য সুন্দর জায়গা, হয়তো ভিড়ও একটু কম হবে। কিন্তু একমাত্র লাগোসেই প্রকৃতির সঙ্গে ইতিহাসের মেলবন্ধন ঘটেছে অপরূপ ভাবে। সমুদ্রের ধারের বিশ্ব বিখ্যাত পোন্টা দে পিয়েদাদের শ্বাসরুদ্ধকর রক ফরমেশন যেমন আছে তেমনই শহরের পুরোনো এলাকায় আছে বারোক(boroque) শৈলীতে তৈরি করা কেল্লা, গির্জা আর ঐতিহাসিক নিদর্শন।
পোর্তো থেকে সরাসরি লাগোস সচরাচর কেউ যায় না। বেশিরভাগ লোকেই লিসবনে গিয়ে দিন কয়েক থাকে। আমাদের দুর্ভাগ্য, লিসবন যাওয়ার সময় আমাদের নেই। পোর্তো থেকে ট্রেনে করে লিসবনে যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে তুনেস। তুনেস থেকে আবার গাড়ি বদলে গিয়ে পৌঁছাব লাগোসে। মারিয়ার কাছ থেকে বিদায় দিয়ে রুকস্যাক তুলে আমরা মেট্রো করে পোর্তোর ট্রেন স্টেশনে চলে এলাম। ইংরেজিতে কিছুই লেখা নেই, পর্তুগিজে লেখা ট্রেনের ডিজিটাল সময়সারণী বুঝতে আমাদের পুরো লেজে গোবরে অবস্থা। শেষে লোকজনের সাহায্য নিয়ে ছুটতে ছুটতে যখন প্ল্যাটফর্মে এলাম, গাড়ি ছাড়তে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই।
ইউরোপের ট্রেনগুলো অধিকাংশই চেয়ার কার। শুয়ে শুয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা সচরাচর চোখে পড়ে না। এমনিতেই ট্রেনের দাম বাসের চেয়ে বেশি, বাসের চেয়ে ট্রেনে অনেক কম লোকে চলাফেরা করে। মনমতো জায়গা পাওয়া যায় অনায়াসে। কিন্তু এখানে দেখলাম ট্রেনে প্রচুর লোকে চলেছে। পর্তুগালে সব জায়গায় স্পেনের মত আলসা অথবা বাকি ইউরোপের মতন ফ্লিক্সবাস সেবা শুরু করেনি সে সময়, ট্রেনের টিকিটের দাম মোটামুটি সস্তাই ছিল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে দুটো পাশাপাশি বসার জায়গা পাওয়া গেল। সামনে একজন জাপানি (অথবা চাইনিজ বা কোরিয়ানও হতে পারে) মনের সুখে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে চিপস চিবোচ্ছেন। গাড়ি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। জাপানিই বটে, কিন্তু তিনি থাকেন আমেরিকার টেক্সাসে। ইলেক্ট্রনিক্সের বড় কোম্পানিতে আই সি চিপ নিয়ে রিসার্চ করছেন। জাপানি বললেই আমার মনে সবচেয়ে প্রথমে উন্নত প্রযুক্তি আর স্বয়ংক্রিয় রোবটের ছবি ভেসে ওঠে, তাতে এই বিশেষজন খাপে খাপে বসেছেন।
তিনি আমাদের চিপস দিতে চাইলেন, আমি হাত বাড়াব বাড়াব করেও শেষ পর্যন্ত হেসে দু' দিকে মাথা নাড়লাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে। সকাল সকাল তাড়াহুড়োতে বিশেষ কিছু খাওয়া হয়নি, সঙ্গে অবশ্য কেক আর আপেল আছে, কিন্তু জাপানি দাদা যখন আলুভাজা দিতেই চাইছিলেন সেটা মুখে নিয়ে কচরমচর করে চিবুতে চিবুতে বাইরের দৃশ্য দেখতে খারাপ লাগত না। নির্লজ্জের মত তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম এই আশায় যে আবার হয়তো আলুভাজার অফার আসতে পারে। টুকিটাকি কথাও বলছি মাঝে মাঝে। এমন সময় জাপানিজ দাদা আরেকবার আমার দিকে চিপসের প্যাকেট বাড়িয়েই 'ওহো তুমি তো খাবে না বললে' বলে প্যাকেটটা ফিরিয়ে নিলেন। ধুস! মেজাজটা খিঁচড়ে গেল বিলকুল। পরের বার থেকে কেউ কিছু দিতে চাইলেই হ্যাঁ বলে দেব।
পাশের ভদ্রমহিলা নির্বিকার চিত্তে বই পড়ে যাচ্ছেন। কেউ বই পড়লেই আমার আবার উঁকি ঝুঁকি মেরে বইয়ের নামটা দেখা অভ্যেস, কিন্তু এখানে বইটা পর্তুগিজে লেখা বলে কিছুই বুঝতে পারছি না। বাইরের দৃশ্যও আহামরি তেমন কিছু নয়, ট্রেনে আসতে আসতে বুঝতে পারছি ভৌগোলিক ভাবে দেশটার সঙ্গে আমাদের দেশের বেশ মিল আছে। ক্ষেত, ঘাসের মাঠ, অযত্নে পড়ে থাকা ফাঁকা প্রান্তর, মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম বা শহর। ইংল্যান্ড অথবা স্পেনের মত সব জায়গাই অত নিঁখুত ভাবে সাজানো নয়। লিসবন আসতে তিন ঘন্টা লাগবে। এতক্ষণ কী করব?
ট্রেনে বসলেই আমার অনবরত ক্ষিদে পায়। ভারতবর্ষের ট্রেনে ঘুরে ঘুরে এই রোগ হয়েছে, এইখানে সস্তার বাদামভাজা, ঝালমুড়ি, আলুকাবলি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কফি, বিস্কুট, স্যান্ডউইচ পাওয়া যায় বটে কিন্তু তাহলে উঠে ক্যান্টিনে যেতে হবে। কোনো কোনো জায়গায় কয়েকজন সুট বুট পরা রেলের লোক একটা ট্রলি নিয়ে ঘোরাফেরা করে বটে, কিন্তু সেরকম কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না। আমার সঙ্গিনী মনের সুখে মোবাইলে ছবি ঘাঁটছেন সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করবেন বলে, বেশি বিরক্ত করলে ক্ষেপে যেতে পারেন। আমি আর কী করি, গুগল ম্যাপ খুলে অফলাইন মোডে রাস্তা, শহর, নদী, জায়গার নাম দেখতে দেখতে চললাম।
লিসবনের কাছাকাছি আসতে জানা গেল আসলে দুটো স্টেশন আছে লিসবোয়া নামে। আমাদের প্রথমটাতেই নেমে তুনেসের গাড়ি ধরতে হবে। টিকিটে দেখাচ্ছে পরের গাড়ি ধরার জন্যে হাতে মাত্র পাঁচ মিনিট টাইম। চেকারকে জিগ্গেস করে আস্বস্ত হওয়া গেল যে অন্য গাড়িটা অপর দিকের প্ল্যাটফর্মেই অপেক্ষা করবে। সিট নম্বরের কোনও বালাই নেই কোনও ট্রেনেই, সেকেন্ড ক্লাসে যে কোনও জায়গাতে উঠে পড়লেই হল। সেইমতো লিসবোয়া থেকে তুনেসের ট্রেনে উঠতে অসুবিধে হল না ঠিকই। ট্রেন তুনেস পৌঁছাতে দেড় ঘন্টা লাগাবে, এই ফাঁকে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। আপেল, কেক সব লিসবোয়া আসতে আসতেই শেষ, অতঃপর গুটিগুটি ট্রেনের রেস্তোরাঁর দিকে পা বাড়ানো হল। ইয়া লম্বা লাইন পড়েছে। মিনিট পনেরো পর চিজ স্যান্ডউইচ আর কফি খেতে খেতে নিজেকে বেশ বড়লোক বড়লোক মনে হতে লাগল। আহা... পর্তুগালের উষর প্রান্তর চোখের সামনে থেকে পিছনে পিছলে যাচ্ছে, আমি ট্রেনে বসে চিজ স্যান্ডউইচ চিবোচ্ছি। সঙ্গে কফিও আছে। আজ সন্ধ্যের আগেই পৃথিবী বিখ্যাত সমুদ্র সৈকতে গিয়ে সূর্যাস্তের বাহার দেখব! বহুত খুব! এই তো চাই।
তুনেস থেকে লাগোসের গাড়ি ধরার কথা আবার সেই অন্য দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে। লাগোস যাওয়ার গাড়িটা আমাদের ছ্যাকরা প্যাসেঞ্জার গাড়ির ভদ্র সংস্করণ, বহু ছেলেমেয়ে বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে লাগোস চলেছে। সেখানের সমুদ্রসৈকতে যে তোয়ালে বিছানোর জায়গা পাওয়া যায় না তাতে আর আশ্চর্য কী? এই ট্রেনের নাম হচ্ছে ‘আর’ অর্থাৎ রিজিওনাল ট্রেন। আলগ্রেভের যাত্রীদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্যেই এই ট্রেন চলে। আমরা পর্তুগালের দক্ষিণ অঞ্চলে এসে পড়েছি। মাঝে মাঝে কয়েক ঘর বাড়ি, তারপরেই আবার খোলা প্রান্তর। দুপুরের রোদে সব তেতে গেছে। গরমে ঘেমে নেয়ে গেছি। এইদিকে বাসের বালাই নেই, লোকেরা নিজেদের গাড়ি করেই চলাফেরা করে প্রধান শহরের বাইরে ছোট ছোট জায়গায় যেতে হলে।
লাগোসে পৌঁছানোর মিনিট পাঁচেক আগেই সমুদ্রের ঘন নীল রঙ আমাদের এক চিলতে দেখা দিয়ে মাথা খারাপ করে দিল। জলের রং দেখেই পাগল হওয়ার জোগাড়! সামনাসামনি দেখলে কী যে হবে? সঙ্গিনীও দেখি ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম ভুলে মহা আহ্লাদে নাচানাচি করছেন। লাগোসের সমুদ্রের ধার দিয়ে উঁচু উঁচু পাথরের শৈলশিখর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্রের নোনা জল এসে পাথরের পাহাড়ের নিচে বিস্ময়কর কয়েকটা গুহার নির্মাণ করেছে। লাগোস থেকে খানিক দূরেই বেনেজিল কেভ আছে, যেখানে সমুদ্রের মাঝবরাবর পাহাড়ের গুহায় আশ্চর্য সুন্দর একটি বেলাভূমি আর পাহাড় ক্ষয়ে নির্মিত পাথরের নানান আকৃতির উৎপত্তি ঘটেছে।
লাগোস শহরে খুব ঘন ঘন বাস চলে না। আমাদের টাক্সি নিয়ে যেতে হল শহরের এক প্রান্তে। ছোট্ট সুন্দর ফাঁকা ফাঁকা শহর, যেরকম ভেবেছিলাম সেরকম ব্যস্তসমস্ত জায়গা মোটেও নয়। চওড়া চওড়া রাস্তায় গাড়িঘোড়া নামমাত্র, প্রচুর গাছপালা আছে। শহরের মধ্যে খানিকটা জায়গায় বাজার, অফিসকাছারি। বাকিটা শান্ত, নির্জন। সুন্দর সুন্দর বাংলো ধরনের বাড়ি আছে রাস্তার ধারে, সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমাদের নির্দিষ্ট এয়ার বিএনবিতে পৌঁছাতে আমাদের পনেরো মিনিটও লাগল না।
অনেকটা গোল মতন পাড়াটা। মধ্যেখানে একটা বড় পার্কের চার পাশে এপার্টমেন্ট ঘেরা শান্ত এলাকা। সাওজিন্হা আমাদের হোস্ট। আমাদের সে সাদরে আহ্বান জানাল। মারিয়ার বাড়ির মত এখানে রান্নাঘর পাওয়া যাবে না। একদিনের ব্যাপার, বাইরেই খেয়ে নেওয়া যাবে। সাউজিন্হার বাড়িতে তিন চারটে বাড়তি ঘর আছে, সেগুলো সে টুরিস্টদের ভাড়া দেয়। মিষ্টি হেসে আমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে সে আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করল। তার বাড়িতে একটা হুমদো বেড়াল আছে, তার গম্ভীর চেহারা দেখে মনে হল বাড়ির কর্তা সেইই। সাওজিন্হা মাঝবয়সী, তারপর সে ভালো ইংরেজি বলতে পারে না, কাজেই মারিয়ার মত করে তার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব জমল না। কিছুক্ষণ পর সে বিদায় নিল।
এদিকে আরেকটা উটকো ফ্যাসাদে পড়া গেছে। পোর্তোতে ফের্নান্দোর সঙ্গে টানা পাঁচ ঘন্টা হেঁটে আমার সঙ্গিনীর পা ফুলে কলাগাছ। সকাল বেলায় তিনি মনের সুখে ইনস্টাগ্রামে ফটো আপলোড করছিলেন, পায়ের অবস্থা দেখে এখন প্রায় ডাক ছেড়ে কাঁদেন আর কি! আমিও ভাবনায় পড়লাম। আমাদের মন্ত্রই যেখানে হেঁটে বেড়াও, সেখানে হাঁটতে না পারলে পুরো ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে। টাক্সি ভাড়া করে ঘুরতে গেলে আমরা একদিনে ফতুর হয়ে যাব, তার ওপর পোন্টা দে পিয়েদাদেতে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটাহাটি আছে, বেলাভূমিতে নামতে গেলেও সিঁড়ি ভাঙ্গতে হয়। তাহলে উপায়? মনে পড়ল কাছেই একটা সুপারমার্কেট দেখেছিলাম, সেখান থেকে যদি ব্যাথার ওষুধ পাওয়া যায়! পায়ে গরম জল লাগাতে বলে দরজায় চাবি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
সন্ধ্যে আটটা বাজে, সূর্য ডুবতে আরো ঘন্টা দেড়েক বাকি। এখানে সবকিছুই দূরে দূরে, প্রায় আধ ঘন্টা হাঁটলে বাজারে অথবা কাছাকাছি বিচে পৌঁছোন যাবে। হাতে সময় বেশি নেই। সুপারমার্কেট বন্ধ হব হব করছে, তারা জানাল ফার্মেসি ছাড়া ওষুধ পাওয়া যাবে না। ওষুধের দোকান প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। কী আর করব, স্কাউটের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে, কুড়ি পা হেঁটে-কুড়ি পা দৌড়ে শেষমেশ ফার্মেসি থেকে ওষুধের পাতা কিনে ফিরতেই সাড়ে আটটা হয়ে গেল।
ঘরে ঢুকেই চটপট জামা বদলে, সঙ্গিনীকে ওষুধ গিলিয়ে বেড়িয়ে পড়া হল। সূর্যের আলো কমে এসেছে। সূর্যাস্ত না দেখতে পেলেও সন্ধ্যের একটা আভাস পাওয়া যাবে সমুদ্রের ধারে যেতে পারলে। ধীরে ধীরে চলতে লাগলাম। সমুদ্রের কাছে বলে সবসময়ই এখানে জোরে হাওয়া চলে, রাতে বেশ শীত শীত করে। সান্তা কাসা দে মিসেরিকর্দিয়ার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাঁ দিকে টেনিস কোর্ট ফেলে আমরা গিয়ে পড়লাম চৌমাথায়। রাস্তার ওপরেই পালাসিও দে চায়না বলে একটা রেস্তোরাঁ আছে, রাস্তার উল্টো দিকে 'অশোকা' বলে একটা ভারতীয় খাবারের দোকানও দেখতে পেলাম। আজকে এখানেই ডিনার সেরে নেব ভেবে, আমরা ডান দিকে এগিয়ে চললাম ডোনা আনা বিচের দিকে। বেলাভূমির কাছাকাছি খালি মস্ত মস্ত রিসর্ট আর দামি দামি খাওয়ার জায়গা, সেইসব পাশ কাটিয়ে যখন সমুদ্রের দেখা পেলাম তখন অন্ধকার হতে বেশিক্ষণ বাকি নেই।
লাগোস শহরটা পাহাড়ের মাথার ওপর হওয়ার কারণে সমুদ্র সৈকতগুলোতে যেতে গেলে পাহাড় থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হয়। রাতের বেলায় বেলাভূমি জনশুন্য, এখানে লোকে রোদ পোহাতেই আসে। রাতে সমুদ্রের জলের রঙও বোঝা যায় না, কিন্তু আমরা জায়গাটার বৈশিষ্ট্য অনুভব করতে পারলাম ঠিকই। ডান দিকে একের পর এক খাড়াই পাথরের শিলা সমুদ্রের ধারে বিশাল চেহারার অসুরের মতো দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে এসে ধাক্কা মারছে সমুদ্রের ঢেউ। যেহেতু সমুদ্রের কাছাকাছি সরাসরি যাওয়া যায় না সিঁড়ি না নেমে, সেইজন্যেই জল এবং বেলাভূমির সৌন্দর্য অবিকৃত রয়ে গেছে। অনেকগুলো সৈকতে যাওয়ার কোনও রাস্তাই নেই, একমাত্র পথ নৌকো করে যাওয়া। এই অভাবনীয় পরিবেশের কারণে সমুদ্রের ধারে এক নৈসর্গিক আমেজ অভিক্ষিপ্ত।
Train in Lisboa |
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সমুদ্রের শব্দ শুনলাম। আমাদের সামনেই রাত নেমে এল অতলান্তিকের বুকে। জনশুন্য বেলাভূমিকে পিছনে ফেলে আমরা ফিরে চললাম শহরের দিকে। এখন দেখলে কে বলবে এই শহরে প্রতি জুলাই আগস্ট মাসে প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ লোকে এসে দাপাদাপি করে।
অশোকা হোটেলের রান্না বেশ ভালো। পর্তুগিজ এক ভদ্রমহিলা আমাদের অর্ডার নিয়ে গেল। রেকর্ডে বেশ ভালো ভালো হিন্দি গান চলছে। লাগোসে বসে আর ডি বর্মন শুনতে শুনতে ভারতীয় রান্না খাব, সে কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে বিদেশ হলেও এই রেস্তোরাঁয় রাঁধুনিরা সবাই ভারতীয়। কথা বলে জানতে পারলাম তারা মধ্যপ্রদেশ থেকে এসে এখানে ব্যবসা করছে। ভালোই চলছে দোকান। আমাদের দীর্ঘ সফরে প্রায় সব জায়গাতেই আমরা ভারতীয় খাবারের চাহিদা চাক্ষুষ করেছি। গুগল ম্যাপে গন্ডায় গন্ডায় ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ দেখতে পাওয়া যায়। এখানে লোকে ঝাল মশলা বেশি খায় না বটে, কিন্তু কম মশলাদার ভারতীয় বিরিয়ানি, মিট কারি আর ডেজার্ট খেতে প্রচুর লোকে ভারতীয় খাবারের দোকানে এসে উপস্থিত হয়। ইউরোপের অনেক দেশেই ডিনার অথবা লাঞ্চে সস্তায় কিছু পাওয়া চাপের ব্যাপার। একটা স্টিক অথবা পায়েলা কিংবা ফুল কোর্স মিল নিতে হলে যত খরচা পড়ে, তার অর্ধেক দামে সহজেই ভারতীয় খাবারের দোকানে গিয়ে রুটি তরকারি অথবা বিরিয়ানি খাওয়া যায়। স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে হলে বরং বড় দোকানে না ঢুকে ফুড স্ট্রিটগুলোতে চক্কর মারাই ভালো। সেখানে বরং কম পয়সায় অনেক ভালো রান্না করা স্থানীয় খাবার পাওয়া যায়। অনেকে অবশ্য এইসবের ধার ধারেন না, সে প্রয়োজনও থাকে না হয়তো। কিন্তু শুস্ট্রিং বাজেট নিয়ে বিশ্বভ্রমণ করতে গেলে এইসব শিখে রাখা দরকার।
এককালে এই অঞ্চলে মুরদের রাজত্ব কয়েক শতাব্দী ধরে চলেছে। সমুদ্রের ধারে ব্যবসা বানিজ্য করতে তাদের সুবিধেই হত। এইদিকে অলিভ, ক্যারব, লেবুর চাষ সেইসময়েও হত। প্রায় একশ মাইল লম্বা সমুদ্র সৈকত, নানা রকমের মাছ, কাঁকড়া, অক্টোপাস, চিংড়ির বাহুল্য। আইসল্যান্ড আর জাপানের পর আজও পর্তুগালের লোকেরা সবচেয়ে বেশি মাছ খায়, নুন মাখিয়ে মাছ স্টোর করে রাখতেও তারা ওস্তাদ, আর তখন তো এখানকার লোকেরা বোধহয় মাছ নিয়ে লোফালুফি খেলত। পানীয় আর খাবার দুইই সস্তা, এইসব জায়গা ছেড়ে কেই বা যেতে চায়?
আরবরা একবিংশ শতাব্দিতে ইয়েমেন থেকে এসে এখানে জাঁকিয়ে বসে। এখানকার নাম দেয় আল-গারাব-আন্দালুস, এই আলগারাবই পরে আলগ্রেভ হয়ে যায় আর আন্দালুস হয়ে ওঠে স্পেনের আন্দালুসিয়া। আল-গারাব এর আক্ষরিক অর্থ পশ্চিম, আন্দালুস পূর্বে আর এই অঞ্চল পশ্চিমে ছিল বলেই এই নামকরণ। এই অঞ্চলের রাজধানী ছিল সিলভেস। সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থলে থাকা সিলভেসে সেই যুগে বহু নামকরা কবি থাকতেন। তাকে বলা হত ইচ্ছেপূরণের শহর। তখনকার রাজ্যপাল এবং বিখ্যাত কবি আল-মুতামিদের লেখা পংক্তি আজও নানা নাটকে ও গানে ব্যবহার করা হয়।
উত্তর আফ্রিকা থেকে মুররা এসে এক সময় শহর অধিকার করে, পরে তাদের কাছ থেকে ক্রিশ্চানরা দখল নেয় এই অঞ্চলের। যা স্পেনে হয়েছিল, তার চেয়ে ছবিটা খুব আলাদা নয়। কিন্তু আরব প্রভাব খানিকটা হলেও থেকে গেছে এখানকার জীবনযাত্রার মধ্যে। পর্তুগিজ ভাষার প্রায় তিন হাজার শব্দ নেওয়া হয়েছে আরবি থেকে। আলজেজুর, আলুফাইরা, আলভর, আলফামব্রাস ইত্যাদি শহরের নামও এসেছে আরবি থেকে। আলগ্রেভের নানান শহরের পর্তুগিজ সংস্কৃতির আড়ালে আরবি সংস্কৃতির একটি অংশ লুকিয়ে আছে। আগস্টের কোনও এক সময়ে সিবেলেসে বেশ বড় করে একটি আরব মেলাও হয়।
২) পরের দিন সকালে উঠে আমাদের পাড়াতেই এল গাতো ক্যাফেতে কমলালেবুর রস সহ ক্রোয়াশ আর কফি খেয়ে হাঁটা দিলাম পোন্টে দে পিয়েদাদের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তা পড়ল, আমরা এগিয়ে চলেছি পাহাড়ের কিনারায়। পোন্টে দে পিয়েদাদে আসলে পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া একটা পথ। শিলাবিন্যাসের ওপর থেকে একটা রাস্তা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে বহুদূর পর্যন্ত সমুদ্রের শোভা দেখতে পাওয়া যায়। পর্তুগালের অন্যতম জনপ্রিয় প্রাকৃতিক বিস্ময় বলে নানান সিনেমায়, বইয়ে, গল্পে এই জায়গার কথা বারে বারে এসেছে। একসময় কাঁচা রাস্তা থেকে বেরিয়ে আবার আমরা পাকা রাস্তায় পড়লাম, সামনেই একটা ফটক। তারপর উঁচু নীচু পাথরের রক ফরমেশন শুরু হয়েছে। পথ খানিকটা ওপর নিচে চলে গেছে পাহাড়ি রাস্তার মতন। সাবধানে না চললে পা পিছলে আছাড় খাওয়া অসম্ভব নয়। প্রথম যখন আমরা পাথরের ওপর পাহাড়ের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন সত্যিই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। অনেক, অনেক নিচে সমুদ্রের জলে রোদ পড়ে চিক চিক করছে। আর রঙ? জলের এই রঙ দেখে মনে হয় বিপুলকায় একটা অ্যাক্যুরিয়াম এনে সমুদ্রের তলায় রাখা হয়েছে। তার সবুজ নীল জ্বলজ্বলে আলোয় পুরো সমুদ্রটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। সমুদ্র আগে কম দেখা হয়নি, আন্দামানের সমুদ্র দেখেও খুব কম বিস্মিত হইনি আগে। কিন্তু এখানকার জলের রঙের সঙ্গে কোনও কিছুরই তুলনা চলে না।
ডাইনে তাকাও। নীল।
বাঁয়ে তাকাও। নীল।
ওপরে তাকাও। নীল।
নিচে তাকাও নীল।
দৃশ্যমান বর্ণালীতে কত রকম নীল থাকে?
বেগুনি। ইন্ডিগো। সবজেটে। আসমানি। ব্লুবেরি। লাপিস লাজুলি। ট্রাম্যারিন। আজুরাইট।
কিন্তু শুধু নীল তো নয়, চোখে যে সবুজও ধরা পড়ছে।
কোবাল্ট ব্লুর সঙ্গে এমরেল্ড গ্রিনের সোহাগ। সেরুলিয়ান ব্লু হাত ধরেছে লাইম গ্রিনের। টারকোয়াজের সঙ্গে জুটি বেঁধেছে প্রুশিয়ান ব্লু। কিন্তু কোন রঙ কোন অবযবে মিশে গিয়েছে চিহ্ন না রেখে, সে বোঝে কার সাধ্য? নীলের কোন শেডের সঙ্গে সবুজের কোন শেড মিশে গেলে সমুদ্র জেগে ওঠে? কোন রঙের জুটি মেঘকে নামিয়ে আনে সামুদ্রিক পাখির ডানায়? রঙমিলান্তি রহস্য। ঘন হয়ে আসা ঢেউয়ের গায়ে দিগন্ত বিস্তৃত জলছবি। বুঝতে গেলেই মাথা ঝিমঝিম। আপনারা চেষ্টা করুন বরং! রঙ বাছাইয়ের খেলা হোক।
সমুদ্র
ঢেউ।
স্রোত।
আকাশ।
পাথর।
সিগাল।
মেঘ।
স্বপ্ন।
নৌকো।
ওই তো নৌকো!
সত্যিই তো! ঘোর কাটিয়ে দেখি, জলের ওপর ছোট ছোট রবারের নৌকোয় করে কায়াকিং হচ্ছে। দাঁড় বেয়ে অনেক ছেলে মেয়ে কায়াক নিয়ে এগিয়ে চলেছে পাহাড়ের নিচে থাকা গুহাগুলোর(grotto) ভিতর যেখানে সুড়ঙ্গের মত রঙিন জল গিয়ে রূপকথার রাজ্য সৃষ্টি করেছে। পাল তোলা কয়েকটা নৌকো আর জাহাজও দেখা যাচ্ছে বহু দূরে। একদিকে বেলাভূমি অনেক নিচে, সেখানে অনেক লোকে রোদ পোহাচ্ছে, সাঁতার কাটছে। সোনা রঙের বালির ওপর সবজে নীল আলোকভেদ্য জল এসে ছলকে পড়ছে। পাহাড়ের খয়েরি লাল রঙের উঁচু সারি জলের ধার দিয়ে চলে গেছে বহুদূরে। এই সমুদ্রে জাহাজ নিয়ে নামলে সোজা আমেরিকা বা কানাডা চলে যাওয়া যাবে। কতক্ষণ সেখানে কাটিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। একবার এইদিক থেকে দেখছি, আবার লাফিয়ে অন্যদিকের পাথরে উঠছি আরো ভালো করে দেখার জন্যে। দেখার জিনিস অবশ্য একটাই, কিন্তু এই অপরূপ দৃশ্য দেখে দেখেও যেন মন ভরে না। শেষমেশ সেখান থেকে যখন এগোলাম কাঠের রাস্তার ওপর দিয়ে ডানদিকের পাহাড়গুলোর ওপরে, মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি পরবর্তী পদক্ষেপ। সমুদ্রে কায়াকিং করতেই হবে, নাহলে কাছ থেকে গুহাগুলো আর লুকোনো বেলাভূমিগুলো দেখা যাবে না। ভেবেছিলাম পায়ে ব্যথা বলে স্প্যানিশ দিদিমণি উশখুশ করবেন, তেনার সাঁতারও ভালো জানা নেই কিনা! (অবশ্যি আমিও খুব ভালো জানি না, তবে বিপাকে পড়লে কিছুক্ষণ হাট পা ছোঁড়বার মতো বিদ্যা আছে) ও হরি! সে গুড়ে বালি। সমুদ্রের রং দেখেই নাকি তিনি একেবারে ফিট, অতলান্তিকের বুকে কায়াকিং করতেও একপায়ে খাড়া। ভ্রমণ সঙ্গিনী ভালই জুটেছে, নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানলাম সেইজন্যে।
পোন্টে দে পিয়েদাদের কাছেই বিশাল জায়গা নিয়ে প্রকাণ্ড কয়েকটা বিলাসবহুল বিচ রিসর্ট তৈরি হয়েছে। প্রাইয়া দো কানাভিয়াল আর প্রাইয়া দো বারাঙ্ক দো মার্তিনহো বেলাভূমি পাহাড়ের ওপর থেকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জায়গাগুলো বেশ দূরে। সেখানে হেঁটে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তার ওপর বালিতে তোয়ালে পেতে সূর্যের তাপ গায়ে লাগানোর কোনও ইচ্ছেই আমাদের নেই, এমনিতেই সানস্ক্রিন লেপা মুখ কোনও বাধানিষেধ না মেনে কালাভূত হয়ে গিয়েছে। দূর থেকে দেখতে জায়গাগুলো যতটা সুন্দর মনে হচ্ছে, রোদবিলাসী জনতার মাঝে গিয়ে পড়লে হয়তো সেই ভাব উবেও যেতে পারে। অতএব আমরা ফিরে হাঁটা দিলাম কামিলো বিচের দিকে। অনেকগুলো বেলাভূমিই খাড়া পাহাড় দিয়ে ঘেরা, রক ক্লাইম্বিং করে অথবা সমুদ্রের দিক থেকে না গেলে সেখানে পৌঁছানোর উপায় নেই। রাস্তার খাঁ খাঁ রোদ্দূরের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় একটা রাস্তা ডান দিকে বেলাভূমির দিকে চলে গেছে। কামিলো বিচে যাওয়ার জন্যে সিঁড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে প্রথম আমরা মূলধারার বিচ টুরিস্টদের সম্মুখীন হলাম। শয়ে শয়ে লোক গাড়িতে করে আসছে সমুদ্রে স্নান করতে আর গায়ে রোদ লাগাতে। তোয়ালে, সানস্ক্রিন, ছাতা, বই, পানীয়, খাবার নিয়ে বেলাভূমিতে মেলা লেগে গেছে। সমুদ্র অবশ্য বাছবিচার করে না, এখানেও সমুদ্রের জল চমৎকার, একদিকে দুটো পাথরের খাঁজে একটা ছায়াঘন জায়গা নির্মিত হয়েছে, সেখানে পায়ের তলায় এসে লাগছে ঢেউয়ের ঠান্ডা জল। ছবি তোলার রব পড়ে গেছে কয়েকজনের মধ্যে। কেউ কেউ অবশ্য ছবি টবির পরোয়া করে না, প্রায় সারা বছরই শনিবার রোববার চলে আসে রোদ পোহাতে, বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে ছাতার তলায় চিতপটাং হয়ে পড়ে আছে।
Ponta de Picadede |
কামিলো বিচ থেকে বেরিয়ে আমরা পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিলাম। কায়াকিং করতে হলে ওল্ড টাউনের বাজারে গিয়ে খোঁজখবর করতে হবে, কেল্লা আর গির্জার দিকেও উঁকি মারা উচিত। সেইমতো শহরের প্রধান কেন্দ্রের দিকে চলতে শুরু করলাম। বাইরে থেকে কেল্লা আর রাস্তার লাগোয়া সাজানো বাগান আর সৌধ দেখতে দেখতে যখন পুরোনো শহরের প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছালাম দুপুর একটা বাজে।
লাগোসের ওল্ড টাউনের বর্ণনা আগেও শুনেছি, কিন্তু সেটা চোখের সামনে দেখে যেই রোমাঞ্চ হল সেটা ইউরোপের অন্য কোনও শহর দেখে হয়নি। খেয়াবাঁধানো গলির দুই ধারে দুধসাদা পাথরের বাড়ি। ছবির মতো সুন্দর। রঙিন পাথর দিয়ে রাস্তার ওপরে নকশা কাটা হয়েছে। উঁচুনিচু গলির দুই ধারে সুদৃশ্য দোকানপাট, নেশা ধরানো বারোক(boroque) আর রেনেসাঁ(Renaissance) শৈলীর কাজ করা গির্জা, সৌধ আর খাওয়ার দোকান। অধৈর্য আগন্তুককে প্রতিশ্রুতি দেওয়া দোকানি, সীসা শপের মিঠে ধোঁয়ার আবেশ। মাঝে মাঝে ছোট ছোট প্লাজা, সেও ধপধপে সাদা। লোকজন অলস ভঙ্গিতে বসে লাঞ্চ সারছে, অথবা পানীয় নিয়ে গল্পগাছা করছে।
রেস্তোরাঁর ভিতর থেকে সি ফুড আর অন্য খাদ্যের সৌরভ ভেসে আসছে। মাছ আর নুনের ব্যবসা করে মধ্যকালে যে এই শহর সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল, আজও ওল্ড টাউনে সেই সম্পদের স্পষ্ট নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। এরই মাঝে আমরা দেখতে পেলাম সান আন্তানিও আর সান্ত সেবাস্তিও গির্জা, এখানকার দুই প্রধান দ্রষ্টব্য। প্রসাধিত বুটিকদের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে গিটার অথবা আলগ্রেভের গানের সুর ভেসে আসছে, স্থানীয় অলিভ আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে প্রতিটা দোকানে। সেই সুবাস মিশে গেছে পায়েলা আর স্মোকড ক্যারাবের গন্ধের সঙ্গে।
খুঁজে খুঁজে একটা সি স্পোর্টসের দোকানে এসে আমরা কায়াকিং-এর খোঁজ নিলাম। জানা গেল আজকেই ঘন্টা দেড়েক পর কায়াকিং-এর দলে জায়গা খালি আছে। আমাদের হাতেও একদিনই সময়, অতলান্তিকের বুকে নৌকো চালানোর সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই ওঠে না। নামধাম লিখিয়ে দিয়ে লাঞ্চ করতে একটা চাইনিজ দোকানে এসে উপস্থিত হলাম। রেস্তোরাঁর দু-তলা থেকে লাগোসের মারিনা দেখা যাচ্ছে যেখানে সমুদ্র থেকে একটা খাঁড়ি টেনে এনে সমুদ্রে যাওয়ার নৌকোগুলো নোঙ্গর করে রাখা হয়। এই রাস্তার নাম আভেনিদা দোস দেসকোবরিমেন্তস। লাগোসের প্রধান রাস্তা, এই রাস্তার একদিকে মারিনা, অন্যদিকে কালচারাল সেন্টার, ইভা বাস স্টেশন, পোস্ট অফিস ইত্যাদি। এখান থেকে মারিনাতে দাঁড় করানো নৌকোর সারি দেখতে অপূর্ব লাগছে, কমলালেবুর রস সহকারে ফ্রায়েড রাইস খেয়ে উঠে পড়লাম। এইবার কায়াকিং পয়েন্টের দিকে যেতে হয়।
Old Town |
Kayaking in Lagos,Atlantic ocean |
Inside the Grotto |
In the Group |
মারিনার পাশেই কায়াকিং-এর পয়েন্ট। আমাদের আগে থেকে কোনও পরিকল্পনা ছিল না, অতএব জুতো পরেই বেরিয়েছিলাম। নৌকোতে তো আর জুতো পরে দাঁড় টানা যায় না। তাই লকারে বাকি জিনিসের সঙ্গে জুতো ফুতো জমা দিয়ে চললুম সমুদ্রের ধারে। আমাদের গাইডের নাম পিটার, দলে আরো কুড়ি বাইশ জন আছে। প্রতিটা কায়াক নৌকোতে দুজন করে থাকবে। দুজনকেই একসঙ্গে দাঁড় টানতে হবে অনেকটা চামচ দিয়ে জল তোলার মত করে। এর আগে একবার কায়াকিং-এর অভিজ্ঞতা ছিল হিমালয়ের নদীতে, কিন্তু সেখানে ভালো স্রোত থাকার জন্যে নিজেকে খুব একটা মেহনত করতে হয়নি। বাঁ দিকে ঘোরাতে হলে ডান দিকে জল ঠেলতে হবে, ডান দিকে ঘোরাতে হলে বাঁ দিকে। খুব একটা কঠিন ব্যাপার বলে মনে হল না। কায়াক টেনে জলে নামিয়ে ফটাফট উঠে পড়লাম। মুশকিল হল সিন্ক(sync) নিয়ে। আমি ডান দিকে করলে সঙ্গিনী বাঁ দিকে জল ঠেলছেন, ব্যাপারটা আয়ত্তে আসতে যতক্ষণ সময় লাগল ততক্ষণে সকলেই এগিয়ে গেছে। তাতে লজ্জা পাওয়ার অবশ্য কিছুই নেই, এখানকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে নদীতে বা হ্রদে ছোটবেলা থেকে কায়াকিং আর রোয়িং করে, সকলেরই পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের কায়াকটা দড়ি দিয়ে বেঁধে মোটর বোট খানিকটা এগিয়ে দিয়ে গেল। ততক্ষণে ব্যাপারটা কব্জা করে ফেলেছি, দিব্যি টুক টুক করে স্বচ্ছ সবুজ জলের ওপর দিয়ে সমুদ্রের ওপর নৌকো নিয়ে এগিয়ে চললুম।
পিটার আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে পাথরের খিলান আর সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে গুহাগুলোর মধ্যে, সেইদিকে তাকালে বিস্ময়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। কোথাও গোল, কোথাও ত্রিভূজাকৃতি হয়ে পাথরের খিলানগুলো ঝুলে রয়েছে মাথার ওপর দিয়ে। মাঝে মাঝে আমরা নৌকো বেয়ে চলেছি দুইদিকের জলে ডুবে থাকা উঁচু পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে, তখন মাথার ওপর আলো ঢেকে যাচ্ছে।
পিটার একে একে আমাদের পাহাড়ের অন্যদিকে থাকা বেলাভুমিগুলো দেখাতে দেখাতে চলেছে। পিনাহাও, ডোনা আনা, বালানকাও... একের পর এক বেলাভূমি পড়ছে, তারপরই নৌকো বেয়ে অন্যদিক দিয়ে গিয়ে আমরা পৌছে যাচ্ছি এক একটা গ্রোট্টো(grotto) অথবা গুহার মধ্যে। মাঝে আমরা মিনিট তিরিশেক এক লুকোনো সৈকতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে দাঁড়ালাম। বালির ওপর থেকেই পাহাড় উঠে গেছে সরাসরি ভাবে প্রায় পাঁচশ ফুট। পাহাড়ে চড়ার বাতিক আছে আমার, বোল্ডারগুলো পরখ করে বুঝলাম রক ক্লাইম্বিং-এর জন্য আদর্শ জায়গা। চমৎকার বোল্ডারিং আর অ্যাঙ্করিং স্পট চোখে পড়ছে, কোনও অসুবিধা হবে না।
একসময় আমরা ফেরার পথ ধরলাম। নৌকোতে কয়েকবার ইয়া ঢেউ এসে আমদের আপাদমস্তক চুপচুপে করে ভিজিয়ে ছেড়েছে। অতলান্তিকের আদর মনে করে ব্যাপারটা আর গায়ে মাখলাম না। তীরে ফিরে ঝোড়ো কাকের মত চেহারা নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম। মাত্র একদিন।
সকাল থেকে পাহাড়, সমুদ্র, বেলাভূমি, ইতিহাস, কেল্লা, গির্জা, বাজার, অ্যাডভেঞ্চার…এরকম মিশেল বোধহয় কমই পাওয়া যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য অস্ত যাবে, অস্তরাগের সাক্ষী হয়ে থাকবে বেলাভূমি।
ঘন নীল জল তটরেখার কাছে স্বচ্ছ সবুজ রঙের ওড়না টেনে নিয়েছে, ধীরে ধীরে সূর্য ডুবছে আকাশে, অযত্নে কেউ আবির ঢেলে ভুলে গেছে মেঘের গায়ে, সোনাঝুরি রঙের বালিয়াড়ির ওপর হু হু করে হাওয়া চলে মাথার চুল এলমেলো করে দিচ্ছে, প্রকাণ্ড শিলাপাথরের সৈন্যবিন্যাস এঁকে বেঁকে হারিয়ে গেছে তটরেখা ধরে। অন্ধকার হতে আর দেরি নেই। এই স্মৃতিটুকুর জন্যেই ...বিদায় লাগোস, বিদায় আলগ্রেভ।
https://joydhakbooks.in/product/anhc
Just mesmerizing ! I want to go this place.
উত্তরমুছুনThank you thank you 😊
মুছুন