বুধবার, ৩১ মে, ২০১৭

ডবলডেকার বাস সফর আর এবনি পার্ক সিমেট্রি


প্রতিটা শহরের একটা চরিত্র থাকে। পৃথিবীতে হাজার হাজার শহর থাকলেও প্রত্যেকটা শহর তার পরিচয় বহন করে নিজস্ব ভাবে, নিজস্ব স্টাইলে। উপর থেকে দেখে কখনো কখনো অনেক মিল মনে হয় অন্য কোনো শহরের সঙ্গে, কিন্তু গভীরে প্রতিটা শহরের আত্মা নিজস্ব। লন্ডনে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে যখন চেনা জানা সবই দেখা হয়ে গেলো, তখন আমি অনুসন্ধান শুরু করলাম তুলনামূলক ভাবে অখ্যাত জায়গাগুলোর। অবশ্য হাজার হাজার বছর ধরে লন্ডন এমনভাবে উঠে এসেছে গল্পে, পত্রিকায়, সিনেমায়, মানুষের মনে, যে কোনো জায়গায় সেরকম ভাবে অজ্ঞাত রয়ে যায়নি। কিন্তু খুঁজলে কিছু না কিছু তো বেরোবেই। প্রথমেই যেটা আবিষ্কার করলাম সেটা হলো লন্ডনের বাস। লাল ডবলডেকার বাস।  

বাস আবার দেখার কি আছে?ঠিক। বাস না, বাসের রুট। বেশিরভাগ লোকই লন্ডনে এসে দেদার টিউবে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। মাটির তলা দিয়ে টিউবের নেটওয়ার্ক এমন ভাবে কানেক্ট করা আছে যে পাঁচ মিনিটের জন্যেও ওপরে পা রাখতে হবে না। কিন্তু শহর দেখতে এসে যদি অন্ধকার সুরঙ্গই দেখবো তাহলে আর কি লাভ?লন্ডন শহরের বেশিরভাগ রাস্তাঘাট, দোকান বাজার, বাড়িঘর সবই ভিক্টরিয়া আমলের, কোথাও কোথাও জর্জিয়ান আর্কিটেকচারও দেখতে পাওয়া যায়। মাটির ওপর থেকে না দেখলে লন্ডনের শহরের সঙ্গে পরিচয়ই হবে না। আর ওপর থেকে দেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এখানকার ডবল ডেকার লাল বাস। বিরাট বিরাট কাঁচের জানলার পাশে বসে থাকো। কোথাও নামার দরকার নেই। উপরে উঠে সামনের সিট পেয়ে গেলে তো কথাই নেই। লন্ডনের প্রতিটা চরিত্র বুঝতে পারা যায় এক এক রুটের বাসে উঠলে। উইকলি কার্ডে যে কোনো সময় যে কোনো রুটে বাসে উঠে পড়া যায়। 

একদিন সাতসকালে ঠিক করে বেরোলাম, খালি বাসে উঠে বসে থাকবো। প্রথম থেকে শেষ স্টপ। নামবো না কোথাও। যেমন ভাবা তেমনি কাজ।  প্রথমে গিয়ে ধরলাম ২৭৪ এঞ্জেল বাসস্টপ থেকে। যদি লন্ডনে সবুজ দেখতে চান এই হলো বেস্ট রুট। ক্যালেডোনিয়ান রুট ধরে বাস চললো। পথে পড়লো ক্যামডেন টাউনের বিখ্যাত মার্কেট, তারপর ফাঁকা সুন্দর সবুজ ছোট ছোট পাড়া পেরিয়ে বাস এগোতে থাকলো লন্ডন চিড়িয়াখানার দিকে। এদিকের বাড়িঘর শান্ত, কোনোকোনো স্কুলের সামনে ছেলেরা মেয়েরা সকার খেলছে। লোকজন দেখাই যায় না।  কিন্তু সবুজের প্রলেপ লেগে আছে চারদিকে। একের পর এক পার্ক চলে যাচ্ছে দুদিক দিয়ে। প্রিন্স আলবার্ট রোড ধরে প্রিন্স ক্যানাল হয়ে প্রিমরোস হিলের কাছে পৌঁছতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। দিগন্তপ্রসারিত সবুজ ঘাসের মাঠ উঠে গেছে একটা পাহাড়ের ওপর। পাহাড় না বলে ঢিলা বললেও তার সৌন্দর্য কমে না একটুও। পার্কের চারদিকে পাকা বাঁধানো রাস্তা দিয়ে কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, কেউ ঘুরছে কুকুর নিয়ে। এই অনাড়ম্বর সৌন্দর্য লন্ডন ব্রিজ বা বিগবেনের চেয়ে কম কিসে?বাঁদিকে চিড়িয়াখানার ক্যাম্পাস থেকে বাঁদরের হুপহুপ শোনা যাচ্ছে। ক্যালেডোনিয়ান ক্যানালের পাশে পাশে চলেছে আমাদের বাস। মাঝে মাঝে লোকে নামছে, উঠছে। আমি আরামসে বসে আছি, সেই গিয়ে নামবো লাস্ট স্টপে।  কেন্ট পেসেজের পাশে বোটিং লেক ছাড়িয়ে, লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড কে পিছনে রেখে পৌঁছে গেলাম হাইড পার্কে। এই পার্কে সার্পেন্টাইন বলে লেকের কাছে হামেশাই শয়ে শয়ে হাঁস আর পায়রা ঘুরে বেড়ায়। ল্যাংকেস্টার গেটে যখন নামলাম চোখে আর মনে সবুজ লেগে আছে তখনও। 

দুপুরে গিয়ে উঠলাম ১৫ নম্বরে। ওরে বাবা, এই বাস একেবারে টুরিস্ট সার্কিট এর ওপর দিয়ে যায়। প্রথমে টাওয়ার ব্রিজ, তারপর একে একে চোখের সামনে আসতে থাকে নানা দ্রষ্টব্য। টাওয়ার অফ লন্ডন, ব্ল্যাকফ্র্যায়ার্স ব্রিজ, ফ্লিট স্ট্রিট, রয়েল কোর্ট অফ জাস্টিস, ট্রাফালগার স্কয়ার, সেন্ট পল ক্যাথেড্রাল। পরের দুদিন শুধু বাসেই ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম।  যেখানে ইচ্ছে নাম, হেঁটে হেঁটে ঘোরো, আবার অন্য বাসে উঠে পড়। ১০০ নাম্বার একেবারে প্রাচীন লন্ডনের দর্শন করিয়ে দেয় আবার মিউজিয়াম দেখতে হলে ১৪ নম্বর বেস্ট। কয়েকটা দূরপাল্লার বাস ও আছে,  শহরের বাইরে চলে যাওয়া যায় গ্রামের দিকে। সেই সুযোগ আমার হয়নি। 

কিন্তু নতুন জিনিস পেলাম ডি থ্রী নম্বরে উঠে। আমরা থাকতাম ক্যানারি ওয়ার্ফে। একদিন সেখান থেকেই উঠে বসলাম এই বাসে। বাসটা যায়  লন্ডনের ডক এলাকা দিয়ে। টেম্স নদী এঁকে বেঁকে চলে গেছে। একের পর এক ছোট ছোট জেটি, সেখানে কনসাইন্টমেন্ট ওঠা নামা হচ্ছে জাহাজে। প্রচুর লোকে কাজ করে এই ওয়ার্ফে। কানাডা ওয়াটার, ক্যানারি ওয়ার্ফ ইত্যাদি। একটা পাড়া পড়লো যার নাম ইস্ট ইন্ডিয়া কলোনী, ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিডিল ইস্টের লোকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গত কয়েক বছরে এই দিকের এলাকাগুলো নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে। ওল্ড ফোর্ট রোড ধরে, ইয়র্ক হল দেখে সবুজ বেথনাল গার্ডেনের সামনে দিয়ে চললো বাস। এক শহরে যে কত রকম চরিত্র থাকতে পারে, সেই অনুভব করতেই এই বাসযাত্রা। পুরোনো, অপেক্ষাকৃত ভাবে অগুছালো পাড়ার পর পাড়া পেরিয়ে চললাম। মনে হচ্ছিলো অন্য দেশে চলে এসেছি।  

প্রায় একঘন্টা পড়ে নেমে যেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম সেটা এক আশ্চর্য সুন্দর কবরখানা। এবনি পার্ক সিমেট্রি। লন্ডন শহরের সাতটা সিমেট্রির একটি। সারি সারি কবরের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। নানা ধরণের গাছ আর বুনো ফুলের রাজত্ব। মাঝে এক পুরোনো গির্জা। কবরখানায় এলে যে মন ভালো হয় সেটা এই প্রথম অনুভব করলাম। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কবরখানায় হারিয়ে গেলাম। প্রতিটা কবরের ওপর মার্বেলের ফলকে নাম লেখা। এক এক করে পড়তে লাগলাম। অনেক কবর সৈন্যদের, কত কিশোর আর যুবক মারা পড়েছে যুদ্ধে সতেরো, উনিশ, একুশ বছর বয়েসে। একটা মেয়ের কবরের সামনে কয়েকগাছা টিউলিপ ফুল। আগ্রহী হয়ে এগিয়ে গেলাম। প্রায় একশো বছর আগের সমাধি। ১৩ বছর বয়েসে মারা গেছিলো কোনো কারণে। কবরের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, "টিউলিপ বুথ"। টিউলিপের কবরের ওপর প্রায় একশো বছর পরেও কে যেন একগোছা টিউলিপ ফুল রেখে গেছে। 
 


















1 টি মন্তব্য: