মিউজিয়াম অথবা জাদুঘরে যাওয়া যে খুব আনন্দদায়ক,তা মোটেও নয়।তারপর যে শহরে শয়ে শয়ে মিউজিয়াম আর আর্ট গ্যালারির রমরমা,সেখানে তো নয়ই।হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যাথা ধরে যাওয়া,দেখতে দেখতে হাই তোলা আর বিবরণ পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যাওয়াই শুধু নয়,একটা সময় পর যতই দরকারি আর অমূল্য দ্রষ্টব্যই থাক না কেন,কিছুই আর মনে ধরে না।কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় লন্ডনের সবকটা প্রধান মিউজিয়ামে হানা দিয়েছি,কয়েক জায়গায় একাধিকবার।এই পাগলামির কারণ মাত্র একটাই।বুক ধড়ফড়,পা টনটন আর মাথা ঝিমঝিম করার মাঝখানে কখনো কখনো হঠাৎ এরকম এরকম একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলা যায় যাতে এই সব বেদনাদায়ক মনোভাব কে ছাড়িয়ে একটা কথাই মাথায় ঘুরতে থাকে।সেই যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতিতে বেশ একটা নেশা ধরে।"বাপরে,কি করেছিল লোকটা!" কিংবা "ধুস,কিছুই জানি না।জীবনটাই বরবাদ।" এই কথাগুলো হল সেই অবস্থার প্রাথমিক লক্ষণ।এই নেশাতুর কয়েকটা অবস্থার কথাই বয়ান করার চেষ্টা করছি।
১)মিউজিয়াম অফ লন্ডন
প্রথম দিনেই পাড়ি দিলাম মিউজিয়াম অফ লন্ডনে।টিকিট ফিকিটের বালাই নেই,যে কেউ ব্রোশার হাতে ঢুকে পড়তে পারে।ছবি তোলার ব্যাপারেও দেখলাম কড়াকড়ি নেই কোথাও।রোমান আক্রমণের সময় থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত লন্ডনের ইতিহাস ধরে রাখা হয়েছে।নানা ধরণের ব্যবস্থা।কোথাও একের পর এক প্রাগৈতিহাসিক ফসিল,মূর্তি,হাড়,বাটিঘটি আর অস্ত্র কোথাও আবার ইন্টারেক্টিভ ভাবে নানা কার্ডবোর্ড কুইজ,হেঁয়ালির মাধ্যমে বলা হয়েছে ইতিহাসের নানা ঘটনা।চৌহদ্দির বাইরে রোমান ওয়ালের রুইন্স দেখতে দেখতে অডিও ভিসুয়াল দেখে নেওয়া যায়।একের পর এক ঘরে ঢুকছি আর থমকে যাচ্ছি।রাশি রাশি পেইন্টিং,ফটোগ্রাফ,ছাদ থেকে ঝোলানো নানা কারুকার্য,কিছুতেই শেষ হয় না।ভিক্টরিয়ান আমলের জীবনযাত্রা বোঝানোর জন্যে একটা আলাদা সেকশান করা আছে,সেখানে রকমারি ব্যবস্থা।আদ্যিকালের সোনার বাতি থেকে শুরু করে বাড়িঘরের মডেল,গয়নাগাঁটি,দোকানপাট,সব করা হয়েছে।প্রত্যেক সেকশানে আলাদা করে প্রজেক্টর রুমে ফিল্ম দেখানোর বন্দোবস্ত আছে।ঘুরতে ফিরতে অলিম্পিক হলে চলে এলাম।২০১২ সালে লন্ডনে হওয়া অলিম্পিকের জন্যে তৈরী নীল রঙের বিশাল পাত্রের মডেলটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে।প্রতিটা দেশের জন্যে এক একটা তামার প্রদীপ তৈরী করে এই মডেল অফ কলড্রন বানানো হয়েছিল।অলিম্পিকের পরে প্রত্যেক দেশের খেলোয়াড় আর স্মৃতির ফটোগ্রাফ নিয়ে এই অলিম্পিক হলে সাজানো হয়েছে।
একের পর এক ব্রিটিশদের কীর্তি দেখে যখন হয় তুলতে তুলতে পরের সেকশানে ঢুকলাম মুহূর্তে চারদিকের আলোকিত মায়ার জগৎ উধাও হয়ে গেলো।'ওয়ার্ল্ড সিটি' আর 'চেন্জিং লন্ডন' অন্যভাবে ধরেছে এই শহরের ছবিকে,সেখানে মহত্ব নেই,স্বপ্ন নেই,আছে দুর্ভিক্ষ,কালোবাজারি,যুদ্ধ, রঙভেদের কথা।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তৈরী হতে থাকা নতুন সমাজের বিবর্তনের ইতিহাস।বার্ট হাইডি সেখানে তুলে ধরেন ৪১ সালের ব্ল্যাকফ্র্যায়ার্স ব্রিজে বোমাবাজির বিভীষিকা।গ্রাহাম সাদারল্যান্ড এঁকে যান 'বিল্ডিং' যেখানে বোমা পড়ে ধ্বসে যাওয়া ইমারতের নিচে মৃতদের চিৎকার কথা বলে।যেখানে ঝাঁ চকচকে শহরের আড়ালে পানীয় জল,স্যানিটেশন এর অভাবে হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়ে যাওয়া লুকোনো থাকে না।যেখানে চামড়ার রঙের মায়া কাটিয়ে উঠতে একশো বছরের সংগ্রাম দেখতে পাওয়া যায়।প্রায় আশি লক্ষ্য লোকেদের নিয়ে এগিয়ে চলা আজকের লন্ডনে সারা পৃথিবীর লোক নিবাস করে।তাদের সঙ্গে করে এগিয়ে চলতে আজও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়,কিন্তু কাজ হতে থাকে নিরন্তর।চোখ থেকে ঘুম উবে গেলো অজান্তেই।
২)টেট মডার্ন
মডার্ন আর্ট যে কি বস্তু সেটা কিছুই বুঝি না।যতটা জানা আছে ততটা হলো,শিল্পীর চোখ আর মন সব সময় কোনো বাস্তব ব্যাপারকে নিজস্ব রূপে দেখে না।তিনি নিজের মত ফর্ম বা স্ট্রাকচার বদলে দিতে পারেন।কিন্তু সেই মেনে নিয়ে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং দেখে লোকেরা কি আহা উহু করে তা বেশিরভাগ সময়ই মাথায় ঢোকে না।তা টিকিট যখন লাগছে না,শেখার আগ্রহ আমার পুরোদমে আছে।ধৈর্যেও কম যাই না।তাই আমি সেই মহাপ্রচলিত 'এস্থেটিক রিলেটিভিসম' বুঝতে লাইন দিলাম যেখানে বলা আছে "beauty is in the eye of the beholder." টেট ব্রিটেন আর টেট মডার্ন টেমসের দুই পাড়ে।একটা থেকে বেরিয়ে বোটে করে দশ মিনিটে অন্যটাতে চলে যাওয়া যায়।তা টেট মডার্ন পুরোটাই মডার্ন আর্ট দিয়ে সাজানো।এই নতুন মিউজিয়াম খুব বেশিদিন হলো খোলেনি।সাউথব্যাঙ্কের কাছেই সুন্দর সাজানো সবুজ চত্বরের মধ্যে দুটো বিশাল বিল্ডিং।ভয়ে ভয়ে ঢুকেই পড়লাম শেষ মেশ।প্রায় দশতলা জুড়ে সাজিয়ে রাখা নানান জিনিস।কোনটা দেখতে খারাপ লাগে না,কোনটা আবার পুরোটাই মাথার ওপর দিয়ে যায়।দেখেশুনে বুঝলাম আমরা না বুঝলেও বুঝদার লোকের অভাব মোটেই নেই।শয়ে শয়ে লোকে ভিড় করেছে নানা জায়গায়। অনেকে আবার আর্ট ফার্টের ধার ধারে না।দশতলায় গিয়ে টেমসের দুর্দান্ত ভিউ দেখা আর ক্যাফেটেরিয়াতে বসে থাকাই একমাত্র উদ্দেশ্য।(ভিউ আমরাও দেখেছিলাম,আর সেটা যে অনবদ্য সেটা না হয় নাই বললাম)যাই হোক,আমরা সামনের ঘরে ঢুকে পড়লাম।
সাউ পাউলো বিয়েনিয়াল মুভমেন্ট নিয়ে এক্সিবিশান চলছে,যেখানে পঞ্চাশের গোড়ায় নতুন সমাজ ব্যবস্থা পত্তন করার জন্য নানা ল্যাটিন আমেরিকান আর ইউরোপিয়ান আর্টিস্টরা কাজ করেছেন 'এবস্ট্রাক্শন আর সোসাইটি' নিয়ে।বেশিরভাগ আঁকা অথবা দ্রষ্টব্যই দেখলাম রাজনৈতিক বিচারধারাকে তুলে ধরেছে।যতটা রকেট সাইন্স ভেবেছিলাম তার তুলনায় সহজেই ব্যাপারস্যাপার ধরে ফেললাম।আসল খেলা শুরু হলো পরের ঘরে ঢুকে।মাথা ভোঁ ভোঁ।তা দেখলাম বড় বড় করে লেখা আছে মডার্ন আর্ট দেখার চারটে প্রধান স্টেপ। গড় গড় করে পড়ে গেলাম।
১)কোনো আর্ট দেখার পর তোমার প্রথম কি মনে হলো?এবং কেন?
২)আর্ট কি কি উপাদান দিয়ে তৈরী করা হয়েছে?আর্টিস্ট সেই উপাদান গুলো কি ভেবে নির্বাচন করলো?
৩)আর্টের সাইজ কি আমাদের কোনো ভাবে আকৃষ্ট করছে?আর্টিস্টের নিবাস এবং জীবনের সাথে এই আর্টের কি সম্পর্ক?
৪)আর্টটা দেখে কি বিষয়ের কথা মনে পড়ে ?
এই সূত্র আউড়েই একের পর এক ছবি,শিল্প,মূর্তি,মডেল দেখে চললাম।পাসমর থেকে পিকাসো কিছুই বাদ গেলো না।লেভেল ফোরে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।নীলচে আলোয় ঘরের মাঝবরাবর একটা উঁচু গোল টাওয়ার কিন্তু সেটা তৈরী হয়েছে নানা ধরনের এনালগ রেডিও দিয়ে।প্রত্যেকটা রেডিও বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে সেট করা তাই নানা ভাষায় নানা কথা একে অপরের সঙ্গে মিশে কানে আসছে।সঙ্গের আলোগুলো একটা মায়াময় আবহ সৃষ্টি করেছে।আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করতে জানা গেলো এই স্রষ্টার নাম সিলডো মেইরেলিস।বাবেল নামের এই আর্ট আসলে tower of incomprehension.এগারো বছর ধরে তৈরী করা এই জিনিসটার নানা ভাবে নানা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।কেউ কেউ বলেছে ভগবানের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের রিপ্রেসেন্টেশান এই 'বাবেল,'আবার কেউ বলেছে রাজনৈতিক কারণ আছে এর পিছনে।নানা লোকের নানা কথায় কথার স্তম্ভ তৈরী হয় বটে কিন্তু উপলব্ধি হয় না কিছুই,কেননা সকলে নিজের স্বার্থের ভাষায় চেঁচিয়ে যাচ্ছে।
মিডিয়া নেটওয়ার্ক বলে একটা সেকশানে নানা আর্টের প্রদর্শনী হচ্ছে।'কার্নিভাল' বলে একটা ছবি বিশেষ ভাবে আমাকে আকৃষ্ট করলো।গাইড বললো যে আর্টিস্ট ম্যাক্স বেকমানের বেশিরভাগ ছবি তৈরী হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।যুদ্ধের অরাজকতায় তার কার্নিভাল ছবির সঙ দুটি বিষণ্ণ।ছবিতে তিনি নিজেকেও এঁকেছেন মাটিতে কাতরানো অবস্থায়।ফ্যাকফুর্টে থাকাকালীন বেকম্যানকে শিক্ষকতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় "cultural Bolshevik" আখ্যা দিয়ে।তিনি আমস্টার্ডাম চলে যান দশ বছরের জন্যে।তার ছবির ভাষা ডিস্টর্টেড কিন্তু খুঁজলে সেই ছবি গভীর অর্থ বহন করে।
কিন্তু যেই ছবিটা দেখে সত্যি চোখ কপালে তুললাম সেটা মার্তা মিনুজিনের সত্যিকারের তৈরী স্ট্রাকচার 'পার্থেনন অফ বুকস'।আশির দশকে এই প্রজেক্টে মার্তা আর্জেন্টিনাতে কুড়ি হাজার বই দিয়ে পার্থেননের আকৃতি তৈরী করেন।এই সুবিশাল মনুমেন্ট বেশ কয়েকদিন সকলের চোখের সামনে থাকে তারপর সেটা ভেঙে ফেলে বইগুলো বিলি করে দেওয়া হয় আমি জনতার মধ্যে।উদ্দেশ্য দেশে গণতন্ত্রের প্রচার,লোকে বই পড়ে জানুক দেশে কি হচ্ছে!চোখ বন্ধ করে না থেকে সোচ্চার আওয়াজ তুলুক অন্যায়ের বিরুদ্ধে।এমন অভিনব প্রজেক্ট আর কোথাও হয়েছে বলে শুনিনি?যারাপনাই বেশ কিছুক্ষণের জন্য অবাক হয়ে গেলাম।
(ক্রমশঃ)
----------------------------------------------------------------------
ছবির কথা
ছবির কথা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন