সোমবার, ২৯ মে, ২০১৭

স্যান্ডম্যান ওয়াকিং ট্যুর
যারা যারা ইতিহাসে আগ্রহী কিন্তু পকেট গড়ের মাঠ,তাদের জন্য স্যান্ডম্যান ট্যুর ভূতের বরের মত।সারা ইউরোপের বড় বড় শহরে হয় এই ঘন্টা দুয়েকের ওয়াকিং ট্যুর।যতটা সম্ভব ঐতিহাসিক হেরিটেজ আর ল্যান্ডমার্ক দেখে নেওয়া যায় হাঁটতে হাঁটতে।সঙ্গে জানা যায় ইতিহাসের নানা গল্প।আর যদি আপনার ইচ্ছে হয়(হলফ করে বলছি ইচ্ছে না হয় যায় না)ট্যুরের শেষে নিজের পছন্দমত টাকা দিতে পারেন উৎসাহী গাইডদের।না দিলেও চলে,যদিও গাইডদের উৎসাহ দেখে কিছুই না দিতে আপনার নিজেরই লজ্জা করবে।নিশ্চয়ই ভাবছেন,হেরিটেজ তো আপনি নিজেই হেঁটে হেঁটে ঘুরে নিতে পারেন।ইতিহাস জানতে গেলে তো মোবাইলে ইন্টারনেট চালিয়ে নিলেই হলো।আজ্ঞে না।এত সোজা না।ওয়াকিং ট্যুরের গাইডগুলো যে কি বস্তু,একটা ট্যুর করলেই বুঝতে পারবেন।ইতিহাস তো তাদের জানা বটেই,তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা প্রচলিত কাহিনী আর অসামান্য হিউমার।দু ঘন্টার ট্যুরে একমিনিটের জন্যেও বোর মনে হয় না।তাই একদিন রোববার সকালে সময় করে চললুম ট্রিপ এডভাইসারে এক নম্বরে থাকা এই একটিভিটি করতে।
টিউবে করে এসে হাজির হলাম কভেনান্ট গার্ডেনে।আপেল মার্কেটের কাছ থেকে শুরু হবে হাঁটা।কিছুক্ষণ আগে পৌঁছে গেছি।ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।পারফর্মিং আর্টস এর কতরকম নমুনা যে লন্ডনে আর সারা ইউরোপে রাস্তা ঘাটে দেখা যায়,বলে বোঝানো যাবে না।টিউবের রাস্তায় কেউ গিটার বা সেলো বাজাচ্ছে,অথবা গলির কাছে কেউ ব্যাগ্পায়পারে মুখ দিয়ে বসে আছে।পিকাডিলি সার্কাসে মাঝরাস্তায় হয়ত আচমকা একজন এসে ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে দিল,কিংবা ট্রাফালগার স্কয়ারে নিজস্ব গান গেয়ে মাউথ অর্গান বাজাতে লাগলো কোনো কিশোরী।দিব্যি লাগে।আপেল মার্কেটের ভিতরে নানা ধরণের সুন্দর সাজানো দোকান বাজার,সবসময় জমজমাট।এখানের পাই হাউস সারা লন্ডনে বিখ্যাত।তার মাঝে কয়েকজন বাজিয়ে চলেছে বেহালা।জানা গেল নতুন ক্যাসেট বার করার আগে প্রতিদিন এসে এখানে কয়েকঘন্টা ফ্রি কনসার্টে বেহালা বাজিয়ে যায় তারা নিজের ইচ্ছেয়।সকলেই ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিকের ছাত্র ছাত্রী।কিছুক্ষণ ঘুরে বেরিয়ে ফিরে এলাম নির্দিষ্ট জায়গায়।
অনেক লোক জড় হয়ে গেছে ততক্ষণে।দুটো ভাষায় ট্যুর হয়,ইংরাজি আর স্পানিশ।আমাদের সঙ্গে চলল যেই গাইড মেয়েটা,তার নাম পাউলিনা,তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম সে আগে থাকত নিউয়র্কে,বছর পাঁচেক আগে ইউরোপে এসেছে।আগে ছিল এডিনবার্গে,চার বছর ধরে লন্ডনে।চললুম তার পিছন পিছন।আমরা ঘুরে দেখবো সিটি অফ ওয়েস্টমিনিস্টার।প্রায় প্রতিটা চেনা জানা ল্যান্ডমার্ক ই আছে এই সিটি অফ ওয়েস্ট মিনিস্টারে।পাউলিনার সঙ্গে আমরাও চললুম ইতিহাসের খোঁজ খবর নিতে।কভেনান্ট গার্ডেন থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলুম লেইষ্টার স্কয়ার।পৃথিবীর সবচেয়ে বড় থিয়েটার ডিস্ট্রিক্ট ঘিরে ওয়েস্টএন্ডের এই সব জায়গা।যেদিকে চোখ যায় একটা না একটা অপেরা হাউস বা থিয়েটার চোখে পড়ে যায়।কিন্তু টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া,তাই লোকেরা হন্য হয়ে থাকে ডিস্কাউন্ট এর জন্যে।ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারী পেরিয়ে পৌছে গেছি ততক্ষণে ট্রাফালগার স্কুয়ার।১৮০০ সালে  ফ্রান্স আর স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধে  ব্রিটেন ন্যাভাল  সেনার জয়গাথার ইতিহাস বহন করে লন্ডনের কেন্দ্রে থাকা এই পাবলিক স্কয়ার।পাশেই শেয়ারিং ক্রস রেল স্টেশন।হোরাসিও নেলসনের নাম বিরাট উঁচু এক স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে,যিনি ট্রাফলগর্ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন।চারদিকে ঘেরা ঐতিহাসিক প্রতিমার মাঝে একটা বুড়ো আঙুলের কালো মূর্তি আলাদা করে  অস্তিত্ব জানান দেয়।ট্রাফালগার স্কোয়ারের পিছনেই ন্যাশনাল গ্যালারি,প্রায় সারা বছরই কোনো না কোনো আর্টিস্ট কে নিয়ে এক্সিবিশন চলতেই থাকে এখানে।

একটু এগিয়ে গেলেই সমারসেট হাউস,পাশেই কিংস কলেজ।সেদিকে না গিয়ে আমরা বিরাট গেটের ভিতর থেকে লন্ডনের বিখ্যাত নাক দেখে(শাসকতন্ত্রের বাড়াবাড়ি দেখে আর্টিস্টরা নাক খোদাই করে দিয়েছিল সোহোর বিখ্যাত আর্ক্গুলোতে,নাক টিপলে নাকি ভাগ্য খোলে) চললুম রয়েল হাউস প্যারেডের রাস্তা ধরে বাকিংহাম প্যালেসের দিকে।1200 শতাব্দী থেকে আজকে অব্দি কত রঙবেরঙের গল্পই না শুনলাম এর মাঝে পাউলিনার দৌলতে।কয়েকটা যেরকম কৌতুহল সৃষ্টি করে কয়েকটা আবার ঠোঁটের কোনে হাসি এনে দেয়।গড সেভ দি কুইন।রানীর দৌলতে ভালই আয় করছে লন্ডনের টুরিস্ট ডিপার্টমেন্ট।বাকিংহাম প্যালেসের নানা দ্রষ্টব্য বিক্রি হচ্ছে কুইনের বাকিংহাম প্যালেসের সাতটা রয়াল গার্ডেন লন্ডনের অন্যতম আকর্ষণ।কাছেই হলো গ্রীন পার্ক আর সেন্ট জেমস পার্ক।এই পার্কগুলোতে ঢুকলে সবুজের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।পেলিকানদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে সেন্ট জেমস পার্কে,অনেকেই দুটোর সময় এসে ভিড় জমায় পেলিকানদের খাওয়া দেখতে।সেদিকে না গিয়ে আমরা পিছন দিয়ে চললাম ওয়েস্টমিনিস্টার এবের দিকে।

লন্ডনের সবচেয়ে বিরাট ও পুরোনো চার্চের মধ্যে একটা,প্রথম স্থান অবশ্য লিভারপুল চার্চের।রাজবাড়ির নানা অনুষ্ঠান,রানীর বিয়ে সবই হয়েছে এই চার্চে।ভিতরে ঢোকার টিকিট কুড়ি পাউন্ড,অবশ্য মাঝে মাঝে চার্চের দরজা প্রেয়ারের জন্যে খোলে,সেই সময় এমনিতেই ঢুকে পড়া যায়।পাউলিনা এরকম নানা ফন্দি ফিকির বলে চলেছে সস্তায় সব দেখে নেওয়ার।ওয়েস্টমিনিস্টার এবের বাইরে সারা পৃথিবীর নেতাদের প্রতিমা লাগানো আছে।গান্ধীজি থেকে নেলসন মান্ডেলা।সামনে টেমস নদীর পাশে হাউস অফ পার্লামেন্ট আর বিগবেন।সকলেই সিনেমাতে দেখেছে যদিও,সামনে থেকে দেখার উৎসাহ দেখলাম তাতে একটুও কমেনি।

পাউলিনার সঙ্গে গল্প হতে লাগলো হাঁটার মাঝে।ভারতে সে একবার তিন সপ্তাহের জন্যে ঘুরে গেছে,এবার তার প্ল্যান একবছরের জন্যে আসার।আমরা এডিনবার্গে যাব শুনে সে মহা খুশি।পাউলিনার পছন্দের শহর এডিনবার্গ,নানা ইনসাইট পেয়ে গেলাম ওর কাছ থেকে।রাজার চক্রান্ত,স্কটল্যান্ডের সঙ্গে লন্ডন শাসকদের যুদ্ধ,রানীর ঘরে ঢোকা পাগলের কান্ড।কোথা থেকে যে সময় কেটে গেল বুঝতেও পারা গেল না।প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস আর দ্রষ্টব্য একসঙ্গে দেখা হলো কানাকড়ি খরচা না করে।পাউলিনা বার বার করে বলল,যদি একটা জিনিস দেখতে হয় টাকা খরচ করে তাহলো টাওয়ার অফ লন্ডন। না দেখলেও চলে অবশ্য।
একসময় ট্যুর শেষ হলো।মেয়েটা একনাগাড়ে গল্প করে গেছে আমাদের সঙ্গে,সঙ্গে সঙ্গে চলেছে নানা রসিকতা,আর গল্প।দশ পাউন্ড দিতে লজ্জাই  করছিলো।পাউলিনা মিষ্টি হেসে বিদায় নিলো।আমরা তার গল্পের ঝুলি সঙ্গে করে টেমস নদীর ধরে এগিয়ে গেলাম।  












২টি মন্তব্য:

  1. নাকের ব্যাপারটা কী আজ বুঝলাম। খুব ইনফরমেটিভ লেখা গুলো। মনে মনে বেড়াচ্ছি :(

    উত্তরমুছুন