ন্যাশনাল গ্যালারি
ছবি দেখতে যাওয়ার আগে কয়েকটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নেওয়া ভালো।প্রথম,আর্টের নিরানব্বই শতাংশ আমাদের আয়ত্তের বাইরে।তাই সবসময় যে নাম করা ছবি দেখতে হবে তার কোনো মানে নেই।যা ভালো লাগে তাই সময় নিয়ে দেখো।দ্বিতীয়,ইউরোপের শহরের আর্ট গ্যালারি গুলো ষোলআনা শেষ করা মানুষের কর্ম না,একদিনে তো ভাবাই যায় না।তাই দশ ভাগের এক ভাগ দেখলেও যাওয়া সফল।তৃতীয়,যদি সত্যি ইন্টারেস্ট থাকে একটু পড়াশুনা করে রাখলে সুবিধে হবে।বেশি কিছু করতে হবে না,শুধু মোটামুটি আর্ট জগতের স্ট্রাকচারটা আর মনোভাব জেনে নিলেই হবে।এই যেরকম,ইউরোপে একসময় ক্যাথোলিক চার্চের জ্বালাতনের ফলে অন্য ধরণের আঁকা বন্ধ হতে বসেছিল।কারাভাজ্জিও সেই যে লিজেন্ডারি ফলের বাস্কেটের স্টিল এঁকে ধার্মিক বিষয় নিয়ে যীশুর আখ্যান আর বাইবেলের আখ্যান তুলি তে ধরতে লাগলেন,তা একমাত্র চার্চের গোঁড়ামির জন্য।মনোভাব ছিল যে বাইবেলের ছবি আঁকা আসল আর্ট,তার নীচের পর্যায় পড়ত ল্যান্ডস্কেপ,আর স্টিল আর্ট কে তো কেউ পাত্তাই দিতো না।কয়েকটা দেশে অবশ্য ছবিটা একটু অন্যরকম ছিল।স্ক্যান্ডিনিভিয়া অর্থাৎ ডেন্মার্ক্,নরওয়ে আর সুইডেনে আর্টিষ্টরা ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেই বেশি পছন্দ করত,এই সব দেশের আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই হোক অথবা ধর্মের বাড়াবাড়ি না হওয়ার কারণেই হোক,পাঁচটার মধ্যে চারটে ল্যান্ডস্কেপ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার আর্টিস্টরাই এঁকে গেছে।হল্যান্ডে আবার স্টিল আঁকা নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের উত্তেজনা ছিল।তাই স্টিল আর্টের নানা নির্দেশন দেখা যায় ফ্লেমিশ পেন্টারদের কাজে।ফ্রান্স,ইতালি,ব্রিটেনে আবার আর্টিস্টরা নানা ধরণের সূত্র লুকিয়ে রাখত ধার্মিক আর্টওয়ার্ক এর ফাঁকেফোকরে যাতে শিল্পী হিসেবে তাদের জাত বোঝা যায়।যেমন কাপড়ের বিশেষত্ত্ব আর ডিটেইলিং,আয়নাতে প্রতিবিম্বের ব্যবহার,সেকেন্ডারি সাবজেক্ট হিসেবে স্টিল ওয়ার্ক কে নিয়ে আসা।রেনেসাঁর পর যদিও ধার্মিক গোঁড়ামির ব্যাপারটা আর্টের ক্ষেত্রে অনেক কমে গিয়েছিলো।নানা ভাবে পরীক্ষা নীরিক্ষা শুরু হয় আঁকা নিয়ে।
ন্যাশনাল গ্যালারি নাকি লুভ্যর এর বাবা।অনেককেই বলতে শুনলাম পেরিসে গিয়ে পাঁচমাসে লোকে লুভ্যর দেখে শেষ করতে পারে না কারণ,যেখানে যত পেইন্টিং ছিল,ভালো অথবা খারাপ,তাই দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে সারা লুভ্যর মিউজিয়াম।কিন্তু ন্যাশনাল গ্যালারি নাকি খালি বেস্ট আর্ট ছাড়া নিলামে কেনেই না।সেই তর্কে না গিয়ে আমরা একদিন বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় পৌঁছে গেলাম ট্রাফালগার স্কয়ারে থাকা ন্যাশনাল গ্যালারি তে।লন্ডনে সব আর্ট গ্যালারি আর মিউজিয়াম ই ফ্রি,টিকিট ফিকিটের কোনো ব্যাপার নেই।ঢুকে চললাম প্রথমে সামনের ব্লকে থাকা ডাচ আর ল্যান্ডস্কেপ পেন্টিং দেখতে।রঙের ব্যবহার,আলোর ব্যবহার,আর থিম,এই নিয়েই নাকি খুঁটিয়ে দেখতে হয় ছবি।আমার মাথায় এত কিছু ঢোকে না।কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ দেখেই বুঝলাম নরওয়ে,ডেনমার্ক না হয় সুইডেনের চিত্রকরদের আঁকা।স্ক্যানিডিনিভিয়ান আর্ট।অনেকেই আবার জীবনকালে একটা করে প্রমান আকারের সেলফ পোর্ট্রেট করে গেছেন।ডিস্টর্টেড আর্টের ও ছড়াছড়ি।
দুটো ব্যাপার এই সব আর্ট গ্যালারিতে খুব ভালো।এখানে রোজ নানা ধরণের গাইডিং ট্যুর হয় গ্যালারির পক্ষ থেকে।অনেক ছবি দেখানো হয়,তার খুঁটিনাটি বুঝে নেওয়া যায়,টাকাপয়সা দিতে হয় না।প্রায়ই স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে থাকে ব্রিটিশ মিউজিয়াম,টেট,লন্ডন মিউজিয়াম আর ন্যাশনাল গ্যালারিতে।স্কুলের তরফ থেকেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা হয়,হয় তারা ছবি আঁকে দেখে দেখে না হয় আর্ট একটিভিটি করে।এরকম যদি আমাদের দেশে হত!
আর প্রায় প্রতিটা জায়গাতেই ফ্রি ওয়াই ফাই আছে।ছবি সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে ফ্রেমের ওপর থেকে ছবি আর আর্টিস্টের নাম দেখে মোবাইলে সার্চ করে নিলেই সব জেনে নেওয়া যায়।
হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যাথা হয়ে গেছে,অথচ সিকি ভাগও দেখা হয়নি।ফার্স্ট ফ্লোর এর একদিকে খালি বাইবেল সংক্রান্ত যীশুর গল্প,রিলিজিয়াস পেইন্টিং নিয়ে আমার আগ্রহ কম।সেইদিকে জোরে পা চালিয়ে কভার করে অন্যদিকে গিয়ে ঢুকলাম।সেখানে বিরাজ করছে রাফায়েল,কারাভাজ্জিও,টার্নার,মিকেল এঞ্জেলো,ভ্যান গঘ।ভ্যান গঘের আঁকা সানফ্লওয়ার্স দেখার জন্যে এখানে লাফালাফি কান্ড,ঠিক লুভ্যর এ যেমন হয়ে থাকে লিওনার্দো না ভিঞ্চির মোনালিসার জন্যে।সে যাই হোক,কয়েকটা ছবি দেখে সত্যি দারুণ লাগলো।সেই ছবিগুলো সম্পর্কে নীচে লিখলাম।
১)Susanna at her Bath
যতদূর মনে পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনো লেখায় এই ছবির কথা আগে পড়েছিলাম।Francesco Hayez ১৮৫০ সালে যখন এই ছবি আঁকেন তখন রোমান্টিক পেইন্টিংয়ে তার বেশ নাম ডাক হয়েছে।জেলের ছেলে হয়ে জন্মালেও ফ্রান্সেস্কো দিব্যি মিলানে গিয়ে আর্টিস্ট জগতে সাড়াশব্দ তুলেছিলেন।সুসানার ছবি আসলে বাইবেলের একটা গল্প থেকেই নেওয়া,যেখানে সুসানা স্নান করতে গিয়ে বুঝতে পারে তাকে কেউ দেখছে।যেখান থেকেই দেখো মনে হবে সুসানার চোখ তোমাকেই দেখছে।
২)The Ambassadors
হান্স হলবেইনের আঁকা এই পিসটা নিয়ে নানা কথা হয়েছে। ১৫৩৩ সালে আঁকা এই পেইন্টিঙ দুজন মানুষের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থাকার,কিন্তু তার সঙ্গে নানা ধরণের স্টিল লাইফ ব্যবহার করা হয়েছে।বাঁদিক থেকে দেখলে সেগুলো এক অর্থ বহন করে,ডান দিক থেকে দেখলে মনে হয় অন্য কিছু।উজ্জ্বল রঙে আঁকা এই বিরাট ছবির সামনে লোকেরা ডানদিক বাঁদিক করেই চলে।
৩)Whistlejacket
হুইসিলজ্যাকেট আসলে একটা তেজি ঘোড়ার ছবি।কিন্তু বাদামি রঙের বিরাট ছবিটাকে দেখলে এতো জীবন্ত মনে হয় যে বলার নয়।মনে হয় আসল ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে পা ছুঁড়ছে ক্যানভাসের মধ্যে।এমন রিয়ালিজম এর ব্যবহার খুব কম দেখতে পাওয়া গেছে।প্রায় তিনশো বছর আগের জর্জ স্ট্যাবসের আঁকা এই ঘোড়া আজও একইরকম ভাবে তেজি ও জীবন্ত।
৪)Seaport with the Embarkation of Saint Ursula
দারুণ ছবি হওয়া সত্ত্বেও লোকের ভিড় কম ছিল সম্ভবত ক্লদে লরেন লোকেদের কাছে ততটা পরিচিত নয় বলেই ,সেই জন্যেই মনোযোগ দিতে পেরেছিলাম মনে হয়।সেন্ট উরসুলা আসলে একজন ব্রিটিশ রাজকুমারী যে রোম পাড়ি দিয়েছিলো অনেকের সাথে,কিন্তু ফেরার সময় তাদের কেউই আর বেঁচে নেই।পেইন্টিংয়ে পোর্ট আর নৌকোর সঙ্গে উরসুলাকে দেখা যাচ্ছে পতাকা হাতে।
৫)An Experiment on a Bird in the Air Pump
এই হলো ন্যাশনাল গ্যালারিতে আমার শ্রেষ্ঠ পাওনা।জোসেফ রাইটের আঁকা এই ছবি কোনো অংশে সিনেমার চেয়ে কম যায় না।রাইট ছিলেন কারাভাজ্জিওর ভক্ত।কারাভাজ্জিওর প্রতিটি ছবিতেই একটা করে আলোর উৎস থাকে এমনিতে কিন্তু সেটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় না।সেই প্রধান উৎস থেকে আলোএসে পড়ে নানা লোকের মুখে।একটা বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট করছে একটা পাখির ওপর,ভ্যাকুম তৈরী করার চেষ্টা চলছে।এক্সপেরিমেন্ট শেষ হলেই পাখি মারা পড়বে কিন্তু সঙ্গের চরিত্ররা সকলেই এক ভাবে ব্যবহার করছে না।একটি বাচ্চা মেয়ে ভয়ে মুখ ঢেকেছে,আরেকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।কয়েকজন নিজেরদের মধ্যে প্রেমালাপে মত্ত্ব।বৈজ্ঞানিক অবশ্য খুবই স্পর্শকাতর এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিয়ে।যতই দেখো ছবিতে নতুন নতুন ইমোশান আবিষ্কৃত হতে থাকে।
এছাড়া ভেনিসের আঁকা কয়েকখানা ছবি আমার ভালো লেগেছিলো।ভ্যান গঘের সানফ্লওয়ার্স ছাড়াও সেজানের আঁকা ভাঙা প্লেটের স্টিল আর্ট ছিল।এই সেজানকেই মডার্ন আর্টের পিতা বলা হয়।পল সেজান বলেছিলেন,গেলাস যে গেলাসের মতোই আঁকতে হবে তার কোনো মানে নেই,আমার চোখে যদি গেলাস ডিস্টর্টেড হয়ে গামলার মত মনে হয় তাহলে সেটাই আমি আঁকবো।এই শিল্পীর চোখে আর মনে ধরা অর্থের প্রেসেন্টেশানই হলো মডার্ন আর্ট।তাতে রিয়ালিজম এর দরকার পড়ে না।
একসময় যখন ঘেমে নেয়ে বসে পড়লাম হাঁপিয়ে,তখন মাত্র পঞ্চাশ ষাটটা ছবি দেখেছি।মনে মনে বললাম,বাকিগুলো না দেখাই থাকে।খুব ভালো লাগছে,বেশি দেখলে যদি খারাপ লাগে?বাকি পরে দেখবো।
এর পর যদিও তিন বার গেছিলাম ন্যাশনাল গ্যালারিতে।তিনবার যোগ করেও আশিটার বেশি ছবি উদ্ধার হয়নি।
ছবি দেখতে যাওয়ার আগে কয়েকটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নেওয়া ভালো।প্রথম,আর্টের নিরানব্বই শতাংশ আমাদের আয়ত্তের বাইরে।তাই সবসময় যে নাম করা ছবি দেখতে হবে তার কোনো মানে নেই।যা ভালো লাগে তাই সময় নিয়ে দেখো।দ্বিতীয়,ইউরোপের শহরের আর্ট গ্যালারি গুলো ষোলআনা শেষ করা মানুষের কর্ম না,একদিনে তো ভাবাই যায় না।তাই দশ ভাগের এক ভাগ দেখলেও যাওয়া সফল।তৃতীয়,যদি সত্যি ইন্টারেস্ট থাকে একটু পড়াশুনা করে রাখলে সুবিধে হবে।বেশি কিছু করতে হবে না,শুধু মোটামুটি আর্ট জগতের স্ট্রাকচারটা আর মনোভাব জেনে নিলেই হবে।এই যেরকম,ইউরোপে একসময় ক্যাথোলিক চার্চের জ্বালাতনের ফলে অন্য ধরণের আঁকা বন্ধ হতে বসেছিল।কারাভাজ্জিও সেই যে লিজেন্ডারি ফলের বাস্কেটের স্টিল এঁকে ধার্মিক বিষয় নিয়ে যীশুর আখ্যান আর বাইবেলের আখ্যান তুলি তে ধরতে লাগলেন,তা একমাত্র চার্চের গোঁড়ামির জন্য।মনোভাব ছিল যে বাইবেলের ছবি আঁকা আসল আর্ট,তার নীচের পর্যায় পড়ত ল্যান্ডস্কেপ,আর স্টিল আর্ট কে তো কেউ পাত্তাই দিতো না।কয়েকটা দেশে অবশ্য ছবিটা একটু অন্যরকম ছিল।স্ক্যান্ডিনিভিয়া অর্থাৎ ডেন্মার্ক্,নরওয়ে আর সুইডেনে আর্টিষ্টরা ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেই বেশি পছন্দ করত,এই সব দেশের আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই হোক অথবা ধর্মের বাড়াবাড়ি না হওয়ার কারণেই হোক,পাঁচটার মধ্যে চারটে ল্যান্ডস্কেপ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার আর্টিস্টরাই এঁকে গেছে।হল্যান্ডে আবার স্টিল আঁকা নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের উত্তেজনা ছিল।তাই স্টিল আর্টের নানা নির্দেশন দেখা যায় ফ্লেমিশ পেন্টারদের কাজে।ফ্রান্স,ইতালি,ব্রিটেনে আবার আর্টিস্টরা নানা ধরণের সূত্র লুকিয়ে রাখত ধার্মিক আর্টওয়ার্ক এর ফাঁকেফোকরে যাতে শিল্পী হিসেবে তাদের জাত বোঝা যায়।যেমন কাপড়ের বিশেষত্ত্ব আর ডিটেইলিং,আয়নাতে প্রতিবিম্বের ব্যবহার,সেকেন্ডারি সাবজেক্ট হিসেবে স্টিল ওয়ার্ক কে নিয়ে আসা।রেনেসাঁর পর যদিও ধার্মিক গোঁড়ামির ব্যাপারটা আর্টের ক্ষেত্রে অনেক কমে গিয়েছিলো।নানা ভাবে পরীক্ষা নীরিক্ষা শুরু হয় আঁকা নিয়ে।
ন্যাশনাল গ্যালারি নাকি লুভ্যর এর বাবা।অনেককেই বলতে শুনলাম পেরিসে গিয়ে পাঁচমাসে লোকে লুভ্যর দেখে শেষ করতে পারে না কারণ,যেখানে যত পেইন্টিং ছিল,ভালো অথবা খারাপ,তাই দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে সারা লুভ্যর মিউজিয়াম।কিন্তু ন্যাশনাল গ্যালারি নাকি খালি বেস্ট আর্ট ছাড়া নিলামে কেনেই না।সেই তর্কে না গিয়ে আমরা একদিন বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় পৌঁছে গেলাম ট্রাফালগার স্কয়ারে থাকা ন্যাশনাল গ্যালারি তে।লন্ডনে সব আর্ট গ্যালারি আর মিউজিয়াম ই ফ্রি,টিকিট ফিকিটের কোনো ব্যাপার নেই।ঢুকে চললাম প্রথমে সামনের ব্লকে থাকা ডাচ আর ল্যান্ডস্কেপ পেন্টিং দেখতে।রঙের ব্যবহার,আলোর ব্যবহার,আর থিম,এই নিয়েই নাকি খুঁটিয়ে দেখতে হয় ছবি।আমার মাথায় এত কিছু ঢোকে না।কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ দেখেই বুঝলাম নরওয়ে,ডেনমার্ক না হয় সুইডেনের চিত্রকরদের আঁকা।স্ক্যানিডিনিভিয়ান আর্ট।অনেকেই আবার জীবনকালে একটা করে প্রমান আকারের সেলফ পোর্ট্রেট করে গেছেন।ডিস্টর্টেড আর্টের ও ছড়াছড়ি।
দুটো ব্যাপার এই সব আর্ট গ্যালারিতে খুব ভালো।এখানে রোজ নানা ধরণের গাইডিং ট্যুর হয় গ্যালারির পক্ষ থেকে।অনেক ছবি দেখানো হয়,তার খুঁটিনাটি বুঝে নেওয়া যায়,টাকাপয়সা দিতে হয় না।প্রায়ই স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে থাকে ব্রিটিশ মিউজিয়াম,টেট,লন্ডন মিউজিয়াম আর ন্যাশনাল গ্যালারিতে।স্কুলের তরফ থেকেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা হয়,হয় তারা ছবি আঁকে দেখে দেখে না হয় আর্ট একটিভিটি করে।এরকম যদি আমাদের দেশে হত!
আর প্রায় প্রতিটা জায়গাতেই ফ্রি ওয়াই ফাই আছে।ছবি সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে ফ্রেমের ওপর থেকে ছবি আর আর্টিস্টের নাম দেখে মোবাইলে সার্চ করে নিলেই সব জেনে নেওয়া যায়।
হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যাথা হয়ে গেছে,অথচ সিকি ভাগও দেখা হয়নি।ফার্স্ট ফ্লোর এর একদিকে খালি বাইবেল সংক্রান্ত যীশুর গল্প,রিলিজিয়াস পেইন্টিং নিয়ে আমার আগ্রহ কম।সেইদিকে জোরে পা চালিয়ে কভার করে অন্যদিকে গিয়ে ঢুকলাম।সেখানে বিরাজ করছে রাফায়েল,কারাভাজ্জিও,টার্নার,মিকেল এঞ্জেলো,ভ্যান গঘ।ভ্যান গঘের আঁকা সানফ্লওয়ার্স দেখার জন্যে এখানে লাফালাফি কান্ড,ঠিক লুভ্যর এ যেমন হয়ে থাকে লিওনার্দো না ভিঞ্চির মোনালিসার জন্যে।সে যাই হোক,কয়েকটা ছবি দেখে সত্যি দারুণ লাগলো।সেই ছবিগুলো সম্পর্কে নীচে লিখলাম।
১)Susanna at her Bath
যতদূর মনে পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনো লেখায় এই ছবির কথা আগে পড়েছিলাম।Francesco Hayez ১৮৫০ সালে যখন এই ছবি আঁকেন তখন রোমান্টিক পেইন্টিংয়ে তার বেশ নাম ডাক হয়েছে।জেলের ছেলে হয়ে জন্মালেও ফ্রান্সেস্কো দিব্যি মিলানে গিয়ে আর্টিস্ট জগতে সাড়াশব্দ তুলেছিলেন।সুসানার ছবি আসলে বাইবেলের একটা গল্প থেকেই নেওয়া,যেখানে সুসানা স্নান করতে গিয়ে বুঝতে পারে তাকে কেউ দেখছে।যেখান থেকেই দেখো মনে হবে সুসানার চোখ তোমাকেই দেখছে।
২)The Ambassadors
হান্স হলবেইনের আঁকা এই পিসটা নিয়ে নানা কথা হয়েছে। ১৫৩৩ সালে আঁকা এই পেইন্টিঙ দুজন মানুষের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থাকার,কিন্তু তার সঙ্গে নানা ধরণের স্টিল লাইফ ব্যবহার করা হয়েছে।বাঁদিক থেকে দেখলে সেগুলো এক অর্থ বহন করে,ডান দিক থেকে দেখলে মনে হয় অন্য কিছু।উজ্জ্বল রঙে আঁকা এই বিরাট ছবির সামনে লোকেরা ডানদিক বাঁদিক করেই চলে।
৩)Whistlejacket
হুইসিলজ্যাকেট আসলে একটা তেজি ঘোড়ার ছবি।কিন্তু বাদামি রঙের বিরাট ছবিটাকে দেখলে এতো জীবন্ত মনে হয় যে বলার নয়।মনে হয় আসল ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে পা ছুঁড়ছে ক্যানভাসের মধ্যে।এমন রিয়ালিজম এর ব্যবহার খুব কম দেখতে পাওয়া গেছে।প্রায় তিনশো বছর আগের জর্জ স্ট্যাবসের আঁকা এই ঘোড়া আজও একইরকম ভাবে তেজি ও জীবন্ত।
৪)Seaport with the Embarkation of Saint Ursula
দারুণ ছবি হওয়া সত্ত্বেও লোকের ভিড় কম ছিল সম্ভবত ক্লদে লরেন লোকেদের কাছে ততটা পরিচিত নয় বলেই ,সেই জন্যেই মনোযোগ দিতে পেরেছিলাম মনে হয়।সেন্ট উরসুলা আসলে একজন ব্রিটিশ রাজকুমারী যে রোম পাড়ি দিয়েছিলো অনেকের সাথে,কিন্তু ফেরার সময় তাদের কেউই আর বেঁচে নেই।পেইন্টিংয়ে পোর্ট আর নৌকোর সঙ্গে উরসুলাকে দেখা যাচ্ছে পতাকা হাতে।
৫)An Experiment on a Bird in the Air Pump
এই হলো ন্যাশনাল গ্যালারিতে আমার শ্রেষ্ঠ পাওনা।জোসেফ রাইটের আঁকা এই ছবি কোনো অংশে সিনেমার চেয়ে কম যায় না।রাইট ছিলেন কারাভাজ্জিওর ভক্ত।কারাভাজ্জিওর প্রতিটি ছবিতেই একটা করে আলোর উৎস থাকে এমনিতে কিন্তু সেটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় না।সেই প্রধান উৎস থেকে আলোএসে পড়ে নানা লোকের মুখে।একটা বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট করছে একটা পাখির ওপর,ভ্যাকুম তৈরী করার চেষ্টা চলছে।এক্সপেরিমেন্ট শেষ হলেই পাখি মারা পড়বে কিন্তু সঙ্গের চরিত্ররা সকলেই এক ভাবে ব্যবহার করছে না।একটি বাচ্চা মেয়ে ভয়ে মুখ ঢেকেছে,আরেকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।কয়েকজন নিজেরদের মধ্যে প্রেমালাপে মত্ত্ব।বৈজ্ঞানিক অবশ্য খুবই স্পর্শকাতর এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিয়ে।যতই দেখো ছবিতে নতুন নতুন ইমোশান আবিষ্কৃত হতে থাকে।
এছাড়া ভেনিসের আঁকা কয়েকখানা ছবি আমার ভালো লেগেছিলো।ভ্যান গঘের সানফ্লওয়ার্স ছাড়াও সেজানের আঁকা ভাঙা প্লেটের স্টিল আর্ট ছিল।এই সেজানকেই মডার্ন আর্টের পিতা বলা হয়।পল সেজান বলেছিলেন,গেলাস যে গেলাসের মতোই আঁকতে হবে তার কোনো মানে নেই,আমার চোখে যদি গেলাস ডিস্টর্টেড হয়ে গামলার মত মনে হয় তাহলে সেটাই আমি আঁকবো।এই শিল্পীর চোখে আর মনে ধরা অর্থের প্রেসেন্টেশানই হলো মডার্ন আর্ট।তাতে রিয়ালিজম এর দরকার পড়ে না।
একসময় যখন ঘেমে নেয়ে বসে পড়লাম হাঁপিয়ে,তখন মাত্র পঞ্চাশ ষাটটা ছবি দেখেছি।মনে মনে বললাম,বাকিগুলো না দেখাই থাকে।খুব ভালো লাগছে,বেশি দেখলে যদি খারাপ লাগে?বাকি পরে দেখবো।
এর পর যদিও তিন বার গেছিলাম ন্যাশনাল গ্যালারিতে।তিনবার যোগ করেও আশিটার বেশি ছবি উদ্ধার হয়নি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন