শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৪

বর্ষায় বর্ষণ/ রেসের বাইরের লেট রিড

রাজর্ষি দাশ ভৌমিক গোয়েন্দা কানাইচরণ লিখে বাঙালি পাঠকের চোখের মণি হয়ে উঠেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু মুশকিল হল, লেখক গোয়েন্দা গল্প আর ক্রাইম লিটের একনিষ্ঠ ভক্ত হলেও আদপে দীর্ঘকাল ধরে চমক লাগানো 'গোয়েন্দাকাহিনি' লেখার ইচ্ছে তাঁর সম্ভবত ছিল না, গোয়েন্দা কানাইচরণের চেয়ে তিনি ব্যক্তি কানাইচরণকে নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী, অনেক বেশি ইমোশনাল। একজন মাঝবয়সী মানুষ, যার বর্তমান চরিত্রের সঙ্গে কলকাতা আর তার শহরতলির স্পেস আর টাইম জড়িয়ে আছে। মেঠো মফস্বল, ঘেমো রোজনামচা, ধমকধামক আর কেতা দেখানোর ব্যালেন্স শীট মেশানো পুলিশ জীবন। শহরের ঋতুবদল--গ্রীষ্মের একঘেয়েমি, বর্ষার ভাপ, শীতের মার্ক করা উৎসব-- যেখানে জীবনের বদলের সঙ্গে এক হয়ে যায়। সময় যেভাবে বদলায়, শহরও বদলায়, বদলে যায় শহরে থাকা সেই মানুষও। রাজর্ষি সেই মানুষের গল্প বলতে কলম ধরেছেন, গোয়েন্দা কাহিনির চমক, প্লটের অভিনবত্ব বা পুলিশ প্রসিডেরালের সুক্ষ্ণতা দেখানোর পালা তাঁর শেষ। এইবার লেখক কানাইকে নিয়ে যে পথ ধরেছেন, তা দিন দিন আরো ধোঁয়াশা হয়ে উঠবে বলে আমার ধারণা। মনে রাখবেন, এই কাহিনি গোয়েন্দার নয়, এই কাহিনি কানাইয়ের। এবং, কানাই ইজ কলকাতা। কলকাতা ইজ কানাই।
কানাই শুধুই কলকাতা অবশ্য নয়, কানাই আসলে ১৯৮৩ সাল। কানাই আশির দশকের মধ্যনিম্নবিত্ত সমাজের সেই সমস্ত দীর্ঘশ্বাস, যার চিন্তাধারা ও ভাবনাকে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ধরা কঠিন। কানাই কমিউনিস্ট সরকারের থিতিয়ে আসা বিপ্লবের সেই সব ভেঙে যাওয়া প্রেম, যারা জাঁতাকলে পিষে প্রেমিকাকে হারাবে বলে মানসিকভাবে তৈরি থাকে। কানাই সেই সব সম্পর্কের দলিল, যেখানে দমবন্ধ করা জীবনের মাঝে কাঁচি সিগারেট ধরিয়ে নিজেকে সব ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে শত শত যুবক। কানাই পুলিশও বটে, যে পুলিশ নিজেও এক এক্সিস্টেন্সিয়াল ক্রাইসিস নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। কেস আসে, কেস যায়! কখনও অপরাধী ঠিক করে ক্রাইম সিন তৈরি হয়, কখনও ক্রাইম সিন সাজিয়ে অপরাধীর মাথায় মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়! জাস্টিস সিস্টেমের নিকুচি, কেস ফাইল ক্লোজ হোক! জোড়াতালি দিয়ে কোর্টে ম্যানেজ করে নিলেই হল! কানাই তিরাশির বর্ষায় মতিদার শিক্ষানবিশি করা এমন এক যুবক, যার আপাতত হাতেখড়ি চলছে।
ক্রাইম গল্পে ন্যাকাপনা আমার পছন্দ নয়, আমি ক্রিস্প লেখা ভালোবাসি। প্লট জোরালো না হলে বা আদ্যিকালের প্লট হলে আমি প্রথম থেকেই হাই তুলি, সে আমার পছন্দের লেখক হলেও এর হেরফের বিশেষ হয় না। খোদ কানাইয়ের প্রথম বই পড়তে গিয়েই আমি এই কথা বলেছি। অথচ, এই গল্পে না জোরালো প্লট আছে, না এমন কিছু নতুনত্ব আছে, না চমক আছে, তবুও আমি যাকে বলে বোল্ড আউট বাই ইট। এর পিছনে একটাই কারণ, লেখক আমাকে কলমের ম্যাজিকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে আমি নিছক একটা গোয়েন্দা গল্প পড়ছি না, আমি একটা ভালো লেখা পড়ছি। রহস্য গল্প নয়, আসল রহস্য হল লেখকের ভাষা, ন্যারেটিভের বর্ণালীগত সৌন্দর্য! ব্লিক, অথচ ডিটেল্ড! চিরাচরিত, অথচ নতুন। সহজ, অথচ গভীর। মুচমুচে, কিন্তু বিষাদময়। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
একটু সহজ কথায়, বা আরেকটু স্পষ্ট করে লিখি। লেখক 'কলকাতা নুয়া' থেকে 'বর্ষণ অধিক'-এ আসতে যে পথ ধরেছেন, তাতে বোঝাই যায়, তাঁর গোয়েন্দা গল্প আর গোয়েন্দা গল্প শুধু নেই। 'অজ্ঞাত পরিচয়..' এর যে প্লটে প্লটের অভিনবত্ব মুছে এক মেলানকলিক, বহুস্তরীয়, রাত্রিকালীন কমপ্লেক্সিটি ঢুকে পড়েছিল, 'বর্ষণ অধিক'-এ সেটা আংশিক ভাবে বিমূর্ত রূপ নিয়েছে। মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুরের মোড়কে বন্দি জোড়াখুনের কেস আসলে স্পেসটাইমকে অতিক্রম করে একটা প্রজন্মের জীবনদর্শন তুলে ধরেছে। লেখক ইচ্ছাকৃত ভাবে টাইমলাইন তছনছ করে এমন একটা সময়কে তুলে ধরেছেন, যেখানে এই অপরাধ সম্ভব, এই অপরাধের উদ্দেশ্য জাস্টিফায়েড, এই অপরাধের ডিটেকশন আর ফয়সালাও ভ্যালিড। হয়তো আজকের সময়ে নয়, হয়তো আশির দশকে নয়, হয়তো কানাইয়ের অন্য কোনও কাহিনিতে নয়, কিন্তু 'বর্ষণ অধিক' এর তিরাশিতে, এই স্পেসিফিক টাইমলাইনে এই গল্প জাস্টিফায়েড। (এবং, বাস্তব টাইমলাইন মেন্টেন করার কোনও দায় লেখকের নেই।)
এই বইয়ে গল্পের চাল আরো ছন্দময়ী, আরো পোয়েটিক, আরো বেশি অভাজার্ভেন্ট, কিন্তু ক্লাইম্যাক্সের চমক বা রহস্য সমাধানের ব্যাগেজ কলমকে থমকাতে দেয়নি। যদি কারো মনে হয়, কী হল? কিছুই তো তেমন হল না? তাহলে উত্তর, যা হল, তাই হয়ে থাকে! সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, পুলিশের গোয়েন্দারাও নস্যি টিপে মাঝেমধ্যে লেখকের মতো কল্পনা করে ফুটোফাটা বুজিয়ে নেন। এই সেই অতিবাস্তব পুলিশ কাহিনি, যা কোনোদিন কেউ বাংলায় লেখেনি। এই কাহিনি পুলিশ প্রসিডেরালের মোড়কে সাহিত্যের এমন একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইল (অন্তত আমার কাছে, অন্য কারো কাছে বইটা অন্যভাবে ধরা দিতেই পারে) যা ঘুরেফিরে পড়ে মনে করব, বাংলায় এমন একটা বই লেখার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এবং আরেকবার, পিনাকিদার প্রচ্ছদের কোনও তুলনা নেই।
বর্ষণ অধিক
বৈভাষিক

 

বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০২৪

অন্য বসন্তের উপাখ্যান

 


জয়ঢাক প্রকাশন পরিবেশিত 'অন্য বসন্তের উপাখ্যান' বাংলায় নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী কাজ৷ এই সংকলন  সাউথ এশিয়ান কুইয়ার (queer) স্পেকুলেটিভ ফিকশনকে সামনে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কিন্তু 'বাংলায় এই প্রথম' মার্কা শব্দাবলী দিয়ে এই ইনিশিয়েটিভকে খাটো করার কোনও মানে হয় না। কারণ, কুইয়ার স্পেক-ফিক এর আনকোরা বিষয়বস্তু বাদেও, 'বাংলায় এই প্রথম' বাদেও এই সংকলনের অন্যতম প্রধান স্ট্রেন্থ হল সাউথ এশিয়ান সাহিত্যের রেঞ্জ আর বিষয়বস্তু নির্বিশেষে এমন কিছু সুসাহিত্য ও সুসাহিত্যিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, যাদের কথা তুলনামূলক ভাবে খুব বেশি পাঠক জানে না। কাজটা ঝুঁকির, কারণ সাহিত্য বলতে সাধারণত বাংলায় যা 'চলে', সেখানে প্লট আর ভাষা খুব স্পষ্ট, প্রমিনেন্ট, লিটারারি ডিভাইসের ধার পরখ করার চোখ বা ধৈর্য সকলের থাকে না, সবসময় তো নয়ই। (আমি নিজেকে ইনক্লুড করেই বলছি) কিন্তু আন্তর্জাতিক ঘরানার সাহিত্য, বিশেষ করে ছোটগল্প যেভাবে লেখা হয়, তার গভীরটা যেভাবে মাপা হয়, তার সঙ্গে একবার পরিচয় হলে ব্যাপারটা নিজে থেকেই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। উদাহরণ, অ্যালিস মুনরো বা জর্জ সন্ডার্সের গল্প যদি কেউ প্রথম পড়ে, প্রায় প্লটহীন ব্যানাল লাইফের সাদামাঠা বিবরণ পড়ে হাই তোলা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই সাদামাঠা গল্প যে আসলে এক একটা চাবুক, সে উপলব্ধি হলে আর পিছন ফিরে তাকানো যায় না। 'অন্য বসন্তের উপাখ্যান' সেই জরুরি কাজটা করতে আরো এক পা এগিয়েছে। ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে ইংরেজি-বাংলা ভাষায় দক্ষ সাহিত্যিকদের কিছু গল্প নিয়ে এসে বুঝিয়ে দিয়েছে, কলমের ধারে বসন্তের ফুল ফোটানো কাকে বলে?


আপাতত, কুইয়ার স্পেকফিকে ফিরে যাচ্ছি। এই জিনিসটা চাপের। বিশেষ করে সম্পাদকদের কাছে। কিউয়ার মানে গে লেসবিয়ান ট্রান্স সম্পর্ক বাদেও অনেক কিছু হতে পারে, কিন্তু গল্প নির্বাচন করার পন্থাটা অবশ্যই বিচার্য৷ মানে, হতে পারে একজন কিউয়ার লেখক স্পেকুলেটিভ ফিকশন লিখেছেন, হতে পারে একজন হেট্রোসেক্সুয়াল লেখকের সাই ফাই গল্পের মূল চরিত্র কুইয়ার... বলতে চাইছি, গল্পে 'কুইয়ার' কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর 'স্পেকফিক' কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটার ওয়েটেজ ঠিক করাই একটা বিশাল কাজ। কিন্তু এই বইয়ের চার সম্পাদক (সৌমিলি দাস, এম ডি মহাশ্বেতা, অঙ্কিত প্রসাদ আর অমৃতা চক্রবর্তী) যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করে তুলনামূলক  এমন সমস্ত গল্প নির্বাচন করেছেন, যেখানে 'স্পেকফিক'--এর স্পেকুলেটিভ কল্পনাটাই আসলে কুইয়ার। সব গল্পে না হলেও বেশ কিছু গল্পে ব্যাপারটা পার্ফেক্ট ভাবে ধরা পড়েছে, আর পাঠককে মুগ্ধ করার পাশাপাশি ভাবিয়েওছে।


খুব সহজ ভাবে বলি, এই প্যাশন প্রজেক্টের পিছনে এই চার তরুণ- তরুণী যে নিষ্ঠা দেখিয়েছেন, তা সব প্রজেক্টে দেখা যায় না। জয়ঢাকের প্রকাশনার প্রোফাইল মন দিয়ে দেখলেও এই বইটা আর দশটা বইয়ের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকবে তার ট্রিটমেন্ট, বিষয় ও লেখক/অনুবাদক নির্বাচন আর সম্পাদনার জন্য। প্রকাশনের সাপোর্ট ও গাইডেন্স অবশ্যই ছিল (যদিও ই-বুকে অন্তত কিছু কিছু বানান ভুল আর স্পেসিং মিসটেক চোখে লেগেছে) কিন্তু মূল ক্রেডিটটা অবশ্যই এই চারজনের। 


যদি ভুল না করে থাকি, ঈপ্সিতা হালদারের একটা সুচিন্তিত বক্তব্য ও ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ভূমিকার পর বইয়ে মোট সতেরোটা গল্প আছে, তার কিছু কিছু বাংলায় লেখা, বাকিগুলো অনুবাদ। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, এখানে দক্ষিণ এশিয়ার সেই সমস্ত লেখক লেখিকাদের গল্প তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে যারা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক জগতে সক্রিয় ও পরিচিত। সে মিমি মণ্ডল হোক, ইন্দ্রপ্রমিত দাস হোক, অর্চিতা মিত্র হোক বা কুরালি মানিকভেল, এম এল কৃষ্ণন আর বন্দনা সিং। অনুবাদকদের প্রত্যেকের কাজ চমৎকার, কিন্তু দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ শেঠ বা মৌসুমী রায়ের মতো নিয়মিত অনুবাদক ও সাহিত্যিকদের   চেয়েও বেশি এগিয়ে রাখব সৌমিলি দাস আর অহনা মৈত্রের মতো তুলনামূলক ভাবে কম পরিচিত নামদের। বিশেষ করে এক একটা গল্প এতটাই 'উইয়ার্ড' ঘরানার, সেখানে এমন ঝকঝকে একবারও হোঁচট না খাওয়া বাংলা অনুবাদ করা সহজ কথা নয়। মন দিয়ে সম্পাদনা না করলে এমন কন্সিস্টেন্ট রেজাল্টও পাওয়া যায় না। এমনকি দু তিনটে গল্প যা আমার ওপর সেভাবে ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারেনি, সেখানেও অনুবাদ নিয়ে কোনও কথা হবে না। 


লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, গল্প। পড়ে কেমন লাগল? সত্যি বলতে, বাংলা মাল্টিপল লেখক স্পেকফিক অ্যান্থোলজিতে এত ভালো গল্প আগে পড়েছি বলে মনে হয় না। বেশিরভাগ গল্পই চমৎকার, কিন্তু কিছু কিছু গল্প কেন বেশি ভালো লেগেছে, কারণ সহ বলে রাখি! এগুলো আমার ভালো লেগেছে, তাই বলে অন্যগুলো লাগেনি তা নয়। অন্য গল্পগুলোও ইকোয়ালি স্ট্রং।


১) শ্যামাপোকার ঘরবাড়ি: সোহম গুহ যে এই মুহুর্তে বাংলা স্পেকফিক জগতের রত্ন তাতে আমার মোটেও সন্দেহ নেই। ইন্টারন্যাশনালি অ্যাক্লেম পেতে হলে লেখায় বা বিষয়বস্তুতে যে ভাষা বা ভাবনা লাগে, তার সব আছে। কয়েক বছর পর নেবুলা বা হিউগোতে তার বই দেখলে আমি মোটেও অবাক হব না।

সংকলনের এউ গল্পটা প্রথম কুইয়ার ব্যাপারটা গল্পের মূল বিষয়বস্তুতে ঢুকিয়ে দিয়েছে আর সেই বুনন ঘটেছেও চমৎকার ভাবে।


২) মৃত্যুঞ্জয়: শাম্ভবী ঘোষকে আবিষ্কার করার জন্য এই সংকলন এর কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। জাস্ট আউটস্ট্যান্ডিং গল্প। একটা ছোট্ট, সহজ গল্পকে ভাষা ও ট্রিটমেন্ট দিয়ে কোন লেভেলে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা বোঝার জন্য এই গল্পটা পড়ে নেওয়া দরকার। লেখিকার আরেকটা গল্পও আছে এই বইয়ে ভুল না হলে, তবে এইটাকে আমি এগিয়ে রাখব। (পরে ভেবে দেখেছি, বইয়ে যুক্ত প্রায় অনেকেই সরাসরি সাহিত্য গবেষণা বা অ্যাকাডেমিক জগত থেকে এসেছেন, তাই হয়তো গল্পগুলো সামগ্রিক ভাবে একটা অন্য অ্যাম্বিয়েন্স ক্রিয়েট করেছে।)


৩) অক্টানিয়নের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কপ্রসূত ভগ্নহৃদয়কে কীভাবে সারিয়ে তোলা যায়: কুরালি মানিকাভেল এর লেখা পড়ার সৌভাগ্য আমার আগেই হয়েছে। প্রথম যদি কেউ তাকে পড়ে, থ হয়ে বসে থাকবে। ভদ্রমহিলা যা লেখেন, অন্য কেউ লিখতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই গল্পটা বিশেষ করে স্মরণীয় হয়ে রইল সৌমিলি দাসের চমৎকার অনুবাদের জন্য। এমন ভীষণ গল্পের এমন সাবলীল অনুবাদ- ব্রাভো!


৪) সবুজকুমারী: অর্চিতা মিত্রের এই বহুস্তরীয় গল্প যতটা মায়ময়ী, অহনা মৈত্রের  অনুবাদ তার চেয়ে কম মায়াবী নয়। 


এবং, লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, এক একটা গল্প থাকে, সিনেমায় এক একটা সিন থাকে, লাফিয়ে একদম পার্ফেকশনের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। এই সংকলমে এমন একটা গল্প পেয়ে আমি বিশাল খুশি। জাস্ট আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড গল্প। লেখিকার কলম এর ভক্ত আমি আগেও ছিলাম, কিন্তু তিনি এখানে যা করে দিয়ে গেলেন, সেইজন্য আমি তাকে দেখা হলে এক প্লেট বিরিয়ানি/ আইসক্রিম খাওয়ানোর নেমন্তন্ন জানিয়ে রাখলাম। যে জগত তিনি গড়েছেন, তা পার্ফেক্টকি কুইয়ার এবং ম্যাজিকালি স্পেকুলেটিভ। খোদ মার্কেজ বা বোর্খেস পড়লে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের জল ফেলতেন। শুধু এই গল্পটার জন্যই বইটা কিনে পড়ে ফেলুন। গল্পের নাম, 'লেডিজ হোস্টেলের চাঁদ'! 


অলোকপর্ণা, ইউ রক! 


অন্য বসন্তের উপাখ্যান 

জয়ঢাক প্রকাশন

মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

এক ডক্টর কি জিন্দেগি

 


ফুটিফাটা রূপকথায় ভরা বোকাসোকা জীবনের কথা। ডক্টর সব্যসাচী সেনগুপ্ত, সব্য নামে যিনি ফেসবুক পাবলিকের কাছে পরিচিত, তাঁর জীবন। হয়তো রাতদুপুরে দেওয়া তাঁর মাইলখানেক লম্বা পোস্ট পড়ে আটশোটা রিয়াকশন আসে হুড়মুড়িয়ে, কিন্তু তাঁর চিকিৎসক জীবনের এই অমূল্য বইটা নিয়ে খুঁজে খুঁজে চারটে পোস্ট পেলাম না। এই লেখাটি শেয়ার করলে অতি অবশ্যই দু একজন বলবেন, "এই বইটার কথা জানতাম না তো!"

ডাক্টার যে বোকা, তারই আরেক প্রমাণ। তবে কিনা বোকা বলেই এই বইটা লেখা সম্ভব হয়েছে মনে হয়। বোকা বলেই এই ডাক্টার মিলেনিয়ালদের শত শত 'প্রলোভন' কে সাবলীল ভাবে এড়িয়ে একটা খড়বড়ে জীবনের মধ্যে থাকা সুখ আর শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। রাজ্যের ঝামেলা, রাতজাগা পরিশ্রম, রাজনৈতিক সামাজিক চাপ উপেক্ষা করে নিঃস্ব মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে আরো একটু ভালো করার জন্য খাটছেন। রোজ, আক্ষরিক অর্থেই রোজ, প্রতি-'দিন' নয়, দিনরাতের ঊর্ধ্বে তাঁর পেশা। চা বাগানের শ্রমিক, শুধু মুলো খেয়ে বেঁচে থাকা রিক্সাওয়ালা, রাতের পর রাত জেগে কাটানো লালচোখের পুলিশের সঙ্গেই তাঁর ইয়ারিদোস্তি, ঘরকন্না। শত শত মৃত্যুকে সাক্ষী রেখে এক একটা জীবন বাঁচিয়ে তোলার লড়াই। ফেসবুকের ভারতবর্ষ যখন আজ অলম্পিক, কাল রাজনীতি, পরশু সাহিত্য নিয়ে 'এক্সপার্ট ওপিনিয়ন' দিতে ব্যস্ত, অন্য একটা ভারতবর্ষে তখন কয়েকজন মানুষ দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করছে... এক একটা জীবন বাঁচানোর অদৃশ্য লড়াই। তাতে কোনও থ্রিল নেই, রোমান্স নেই, আছে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ। হেলথ প্রোটোকল। কন্সিস্টেন্সি। দ্য ব্যানালিটি অফ এভরিডে লাইফ ! ওষুধ এর কড়া গন্ধ, রোগীকে পুষ্টি জোগানোর জন্য আবিষ্কার করা জুগাড়। শহরে, গঞ্জে, অজ পাড়াগাঁয়ে যে সমস্ত চিকিৎসক রাতদিন এক করে এই লেবড়ে যাওয়া দুনিয়ায় মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন, তাদের প্রতিনিধি হয়ে রইল এই লেখাটি।

অদ্ভুত সমস্ত মানুষ, তাদের অদ্ভুত জীবন। টিবির মারণ রোগের চিকিৎসা করতে করতে লেখক থুড়ি ডাক্টার দেখছেন, দেশের মানুষ কতভাবে বাঁচে (বাঁচার চেষ্টা করে), কতভাবে মরে! এক্সডিআর আক্রান্ত কিশোর বেডে শুয়ে কবিতা লিখছে, চেকাপের ডেট মিস করে যাওয়া বুড়ি ডাক্টারকে দেখে ভয় পেয়ে টুল উল্টে পড়ে যায়, প্রায় এক দশক ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যায় এক কিশোরী... এরই মাঝে, ঋতু বদলায়। গাছের পাতা পড়ে যায়, শীত আসে, বসন্তের নতুন কুঁড়ি দেখা যায়, গরমের তাপপ্রবাহে পথ চলা মুশকিল। সময় কাটে। জীবনও কাটে। সময় বদলায়। জীবনও বদলায়। বদলায় না এই লড়াই। ডাক্টারি জীবনের লড়াই। ডাক্টারি জীবনের সম্মোহন। কাঁহা কাঁহা সে ছুটে আসা মানুষ, তাদের ঝুলিতে যত অপরূপ গল্প, সে সব মায়ার পাশের মতো আঁকড়ে ধরে ডাক্টারকে। দাস্তান-এ-দাওয়াখানা সেই ওষুধের গন্ধ জড়ানো মায়ার গল্প।

সুমেধা চট্টোপাধ্যায় আমার চেয়ে অনেক বিশদে বইটা নিয়ে লিখেছেন, ইচ্ছে হলে পড়তে পারেন। সত্যি বলতে বইটা নিয়ে খুব 'অ্যানালিটিকাল' রিভিউ লেখার চেষ্টা করাই যেত, পুস্তকাংশ তুলে ধরে আইডিয়া দেওয়া যেত, কিন্তু আসলে তাতে কোনও লাভ নেই। এই বইয়ের সে সব দরকারও নেই। এই দাস্তান সাহিত্য হতে চায়নি, দাস্তান হতেই চেয়েছে। কিন্তু এই দাস্তানটুকু বড়ই জরুরি, বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। সব্যসাচী সেনগুপ্তের আর চারটে মনকাড়া বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে থাকলে সেই মুগ্ধতার রেশ এখানেও পাবেন, কিন্তু এই লেখার ইম্প্যাক্ট একটা ভালো বইয়ের সীমানা অতিক্রম করে যাবে। যাবেই। প্লিজ পড়ুন, পড়ে ফেলুন। কথা দিচ্ছি, ওয়ান টাইম রিডের পরও বইটা আপনার রিডিং লিস্ট থেকে সরে যাবে না।

(৯ঋকাল বুকসের প্রোডাকশন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রচ্ছদ ভাবনাতেই সেই চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়, ইলাস্ট্রেশনগুলো যথাযথ। আধুনিক ভারতে ডাক্টারি জীবনের ফার্স্ট হ্যান্ড, লিটারারি এবং ফিল্টারহীন এক্সপেরিয়েন্স প্রায় নেই, অন্তত আমি তো দেখিনি। প্রচারিত হলে এই বই কত পুরস্কার পেত, কত দূর পাড়ি দিত কে জানে? প্রকাশক বা লেখক, কারোরই হ্যামারিং মার্কেটিং করার ইচ্ছে নেই! সেই নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। হতে পারে বর্নভিল চকোলেট এর ট্যাগলাইনটাই সত্যি-- ইউ হ্যাভ টু আর্ন ইট!)

দাস্তান-এ-দাওয়াখানা
সব্যসাচী সেনগুপ্ত
শুভদীপ ভট্টাচার্য চিত্রিত
৯ঋকাল বুকস

বেশি বই না পড়াই ভালো

 


বইপত্র ঘেঁটে এতদিনে যা উপলব্ধি করেছি, সেটা হল জীবনে সময় সত্যিই কম। একটা ভালো বই পড়তে যথেষ্ট সময় লাগে, যদি না সে বই শুধু ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার জন্য পড়া হয়। লাখে একজন দুজন হয়তো এআই এর গতিতে বই পড়ে কানেক্ট করতে পারে, আমি ভাগ্যিস সে ক্যাটেগরিতে পড়ি না। প্রতিবছর বুঝি, হাজার হাজার ভালো বই না পড়েই বিদায় নিতে হবে।

তাতে অসুবিধা কিছুই নেই, বইয়ের পাশাপাশি হাজার হাজার গান শোনা হবে না, পৃথিবীর অনেক জায়গায় যাওয়া হবে না, অনেক কিছু চেখে দেখা হবে না, অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই কারণে যে এত এত ভালো বই বা ভালো সিনেমা যে আছে, যা আমি পড়তে বা দেখতে পারব না, সেটা ইন্টারনেট আমাকে ক্রমাগত মনে করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এই ঝামেলা আগে ছিল না, একটা বই নিয়েই সময় কাটত, অন্য বইয়ের খবরই জানতাম না। কিন্তু এখন সে প্রিভিলেজ গোল্লায় গেছে। ফলে খুব কড়াভাবে ফিল্টার করতে চেষ্টা করে অনেকেই।

এমতাবস্থায় কী জানি কী মাথায় ভূত চেপেছিল যে এক জনপ্রিয় লেখকের কয়েকটা উপন্যাস পড়ে ফেললাম। তারপর থেকে নিজেকে দোষ দিচ্ছি যে কেন পড়তে গেছিলাম! পড়ে আমার ঠিক কী লাভটা হল? ভ্যালু অ্যাডিশন না হোক, পড়তে গিয়ে ভালো লাগলেও না হয় হত! কিন্তু বয়সের দোষে এখন অনেক কিছুই ভালো লাগে না, যা এককালে বসে বসে পড়েছি, কারণ এখন হাতে বিকল্প আছে, একটা কামচালাউ বই পড়া বা সিনেমা দেখা মানেই একটা ভালো জিনিস হাতছাড়া করা। আদতে এই দ্বন্দের কোনও মানেই নেই, কারণ দুটোটেই কিছু লাভ হয় না। কিন্তু অসুখ হলে মানুষ অসুখী হবেই, তাই এই সব ভ্যান্তারা করা আর কি!

আসলে রেজোল্যুশন হল, বেশি নয়, বইপত্র আরো কম পড়তে হবে। আরো ধীরে ধীরে পড়তে হবে। না পড়া বইয়ের ছবি দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলব না। একটা বই কুড়িপাতা পড়ে না পোষালে স্কিপ মারব, সে জন্য আর নিজেকে দোষ দেব না। এই সব ভেবে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এই বইটা তুলেছি, রোজ একটা করে কবিতা পড়ব, একাধিকবার পড়ব, কিন্তু শেষ করার জন্য তাড়াহুড়ো করব না। আপাতত ভূমিকা থেকে কয়েক লাইন---

"Whatever inspiration is, it's born from a continuous "I don't know."...That is why I value that little phrase "I don't know so highly. It's small, but it flies on mighty wings. It expands our lives to include spaces within us as well as the outer expanses in which our tiny Earth hangs suspended...Poets, if they're genuine, must always keep repeating "I don't know"

(Szymborska, The Poet and the World)

কোরিয়া, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান ও ক্যানোপি (এবং কিছু খুচরো স্বপ্ন)

 


রিসেন্ট পড়া জার্নালিস্টিক নন-ফিকশন বইয়ের মধ্যে সেরা তো বটেই, কলমের জোর থাকলে একটা হার্ডকোর পেজ টার্নার নন-ফিকশন অ্যাকাউন্ট কীভাবে মন খারাপ করা আর মন ভালো করা কতগুলো হিউমান স্টোরিতে বদলে যেতে পারে, সেটা জানতে হলে এই বইটা পড়া দরকার।

পুনশ্চ: যারা কে-ড্রামা 'ক্র্যাশ ল্যান্ডিং অন ইউ' দেখে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন আর উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে আরো ভালো করে জানতে চান, অতি অবশ্যই পড়ুন।

(দশে কুড়ি)


বুকার লংলিস্টে থাকা একটা বই... বিষয়বস্তু দেখেই মাথা ঘুরছে। এই এক লেখক, বিষয় নির্বাচনেই বাজিমাত করে দেন। প্রতিটি বই অন্য লেভেল। লংলিস্টের বারোটা বইয়ের বিষয়বস্তু একদিকে, রিচার্ডবাবু একদিকে। ভালো মন্দ তো পরের কথা।

এটা পড়লেই চলে যাবে🌹

হরিণী নাগেন্দ্র পাঠকমহলে বিখ্যাত ব্যাঙ্গালোর ডিটেকটিভ সোসাইটি সিরিজের জন্য। কিন্তু এ বাদেও তিনি এই সময়ের অন্যতম এক ইকোলজিস্ট, আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর নামডাকও আছে। দেখে ভালো লাগে ফিকশনের পাশাপাশি হরিণী সমানে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে চলেন। কনজার্ভেশনিস্ট সীমা মুন্দোলির সঙ্গে আগের বছর 'শেডস অফ ব্লু' বলে একটা বই এসেছে, সেটা দেখে মনে পড়ল এই বইটা মিস হয়ে গেছে, ব্লসমসে গিয়ে নেব নেব করে আর নেওয়া হল না, তারপর ব্যাঙ্গালোর যাওয়াই হয়নি। এখন পড়তে গিয়ে যেটা সবচেয়ে ভালো লাগছে, সেটা হল যত্ন। ও জিনিসটার আজকাল বড়ই অভাব দেখি। এই মাঝারি বইটায় হরিণী আর সীমা এমন সুন্দর যত্ন করে আর্বান ট্রি আর পরিবেশের কথা লিখেছেন, বই পড়ছি বলে মনে হয় না। গাছেদের বিজ্ঞান আর বট, জাম, তেঁতুল ইত্যাদি থেকে শুরু করে জীবজন্তু, সামাজিক আচার, রান্নাবান্না, খেলাধুলো সব কিছুই মিশে গেছে সাবলীলভাবে। পাম আর ইউক্যালিপটাস নিয়ে এত লাফালাফি কেন, চিল আর পানকৌড়ি হারিয়ে যাচ্ছে কেন, ব্যাঙ্গালোর সহ ভারতের সমস্ত শহরে হিট আইল্যান্ড এফেক্ট কীভাবে কাজ করে, গোটাটাই ছিমছাম ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুন্দর কিছু ইলাস্ট্রেশন আছে, দেখে বেশ লাগে। বাড়িতে গাছপালা লাগানোর শখ থাকলে কিনে ফেলুন৷ বা বন্ধুবান্ধবদের উপহার দিন। 


মাঝে মাঝে এমন একটা বই পড়ে ফেলি, যে বুঝতেই পারি না ঠিক কীভাবে আর সি এ করব?

মার্টিন ম্যাকিন্স-এর 'In Ascension' এমন একটা সাইফাই, যা পড়ে অনেকেই 'ধুস! কী ফালতু!/ঘুম পেয়ে গেল/এর চেয়ে ভালো আমি লিখি!" করে উঠবে! অনেকে ভীষণ তারিফও অবশ্য করবেন, বাকিরা আমার মতো সম্মোহিত হয়ে, বইটা গোগ্রাসে গিলবে ঠিকই, কিন্তু ভালো লাগল না লাগল না খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে না। কারণ, দে আর ইন শক।

বলে রাখা ভালো ম্যাকিন্সনের লেখা খুব একটা ডিস্টিংটিভ কিছু নয়, বরং বেশ সহজ সরল সাবলীল, আর সেইজন্যই বইটা শুরু করে আর থমকাইনি। আধুনিক সায়েন্স ফিকশনে যা যা থাকতে পারে, বায়োটেক থেকে স্পেস রিসার্চ, মলিকিউলার বায়লোজি থেকে আন্ডারওয়াটার অর্গানিজমের খুঁটিনাটি, সব কিছুই আছে, কিন্তু কোথাও যেন বইটা একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড অ্যাডভেঞ্চারের মোড়কে শুরু হয়েছে আর সেই মোড়কটা প্রায় বারো আনা জুড়ে বজায় রেখে গেছে। হাই স্ট্রেস ড্রামা, একের পর এক অমীমাংসিত প্রশ্ন, ম্যারিন বায়োলজিস্ট প্রোটাগোনিস্ট এর ট্রমাটাইজিং শৈশব.. এসব নিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়া এগিয়ে যায়।

এরপর আচমকা একটা জায়গা আসে, ম্যাকিন্স একেবারে কোর্স চেঞ্জ করে সাইফাইকে ডকে তুলে গল্পকে এমন এক মেলানকলিক কম্পোজিশন দিয়ে ফেলেন যে বেশিরভাগ পাঠক ঘাবড়ে যায়, বাকিরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে চলে। খুব লজ্জা করছে বলতে, কারণ আমি সেকেন্ড দলে। বিচারবুদ্ধি দিয়ে ভাবলে বলা উচিত ছিল, "এটা কী হল দাদু? গল্পের সমস্ত রহস্য ভুলে, সব অজানা প্রশ্ন মাথায় তুলে এখন তুমি সাহিত্য করছ? সারিয়েলিজম করতে হলে স্পেসটাইম নিয়ে গল্প ফাঁদার কী দরকার বাপু, কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে!"

কিন্তু. কিছুই বলা হল না, কারণ লেখক এতক্ষণে আমাকে পুরোপুরি বশ করেছেন। স্পেকফিক বা রহস্য কাহিনিতে সোশ্যাল ড্রামা ঢোকালে আমি বহুত বিরক্ত হই, কিন্তু 'In Ascension' এমন এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করেছে যে আমি স্পিকটি নট থাকতে বাধ্য হচ্ছি। এই লিটারারি সাই-ফাই সোজা কথায় আমাকে ক্লিন বোল্ড করল, প্রায় কুড়ি পার্সেন্ট গল্প, হাজার খানেক অনুত্তরিত প্রশ্ন, আর পুরোপুরি ওপেন এন্ডেড একটা এন্ডিংও আমাকে সেই জায়গা থেকে সরাতে পারল না।

পুনশ্চ: বইতে প্রচুর আন্ডার দ্য লাইন ইস্টার এগ আছে। একটা বই লেখার পিছনে কত চিন্তাভাবনা থাকে, কত না বলা ভাবনা থাকে, বাংলার সীমিত বাজারে সেই নিয়ে আলোচনা হয় না। দেখে ভালো লাগে ইংরেজিতে এমন পাঠক বহু আছেন যারা ঠিক খটকা লাগলে এক একটা জায়গা ধরে রীতিমত রিসার্চ করে রেফারেন্সগুলো টেনে বার করেন। বইয়ের নাম আর নায়িকার নামের পিছনেই একটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং গল্প আছে, বইটা পড়লে কেউ চিন্তাভাবনা করে দেখতে পারেন। বই শেষ করার পর দেখলাম রিসেন্টলি বইটা আর্থার সি ক্লার্ক পুরস্কার জিতে ফেলেছে। 


আমি সাধারণত এক সময়ে পাঁচ ছ'টা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করি। অসম্ভব ধীরে ধীরে পড়ি, এক একটা শেষ করতে কয়েকমাসও লেগে যায়। তার অধিকাংশই পোস্ট করার প্রয়োজন মনে করি না, করে লাভ কী? কিন্তু এরই মধ্যে কিছু কিছু কাজ থাকে, পড়ে মনে হয়-- 'ইস! এত যত্ন করে লিখেছেন, বিশেষ কেউ জানতে পারেনি!' একটা পোস্ট দিলে যদি একজন দুজনও কিনে পড়ে ! বছর চারেক আগে অব্দি বাংলায় এরকম কিছু কিছু বই পড়ে পোস্ট দিতাম, এখন বাংলা বই হাতে পাওয়াই কঠিন হয়ে গেছে।

তবু দু এক সময় মনে হয়, অমুক বইটা এত যত্ন করে করা, কেউ খেয়ালই করছে না! এরকম কত কত বই আছে! শুধু লিরিক্যাল বুকসেরই প্রচুর অনালোচিত বই আছে, প্রতিটাই সংগ্রহযোগ্য। ভাষালিপি, ধানসিড়ি, সৃষ্টিসুখের কত ভালো ভালো কাজ নিয়ে আলোচনা হয় না। কাফে টেবল বছর দুই ধরে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করেছে (খচ্চর সিরিজ বা গল্পকুঞ্জের মতো চমৎকার সংকলন পুনর্প্রকাশ), মৌহারি, অবভাস, সুচেতনার কিছু কিছু কাজ ছকভাঙা। এছাড়া অজস্র ছোট প্রকাশক তো আছেনই। প্রতিটা লেখকই চান তার বই নিয়ে প্রচার হোক, এতদিনের পরিশ্রম অন্তত একটু ভিসিবিলিটি পাক। প্রচারের নিরিখে দেখতে গেলে এই প্রত্যাশায় দোষের কিছু নেই, একটা বই লিখতে মুরাকামিকে যত পরিশ্রম করতে হয়, একজন অজানা লেখককে তার চেয়ে কম করতে হয় না। তবু, কিছু কিছু বই একেবারেই আড়ালে থেকে যায়, এই তাদের নিয়তি। সামান্য কয়েকজন পড়েন, বাকিরা জানতে পারেন না, আর 'মিসম্যাচ' হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এমন হয়, বইটা সত্যিই যাদের ভালো লাগত, তাঁরাই বইটার কথা জানেন না।

যে বইটা পড়ে এই কথাগুলো বলতে ইচ্ছে হল, সেই বই বা লেখিকার কথা এক সপ্তাহ আগেও আমি জানতাম না। জ্যাকালিন হার্পম্যান বেলজিয়ামের লেখিকা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি হওয়ার মাশুল দিতে তাঁকে পরিবারসহ মরক্কোতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। ফিরে যখন আসেন, দু তিন বার কেরিয়ার বদল করে অবশেষে সাইকো অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ফরাসিতে তাঁর বেশ কিছু বই আছে, কিন্তু এই বইটা বাদে কোনো বইই মনে হয় ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি। কেন হয়নি, জানি না। হয়তো হওয়ার মতো নয়, বা কেউ জানতে পারেনি। Moi qui n'ai pas connu les hommes ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হলেও অনেক আগেই লেখা শুরু হয়েছিল, যখন হ্যান্ডমেড টেল বা স্পেকফিক ডিস্টোপিয়ার কালজয়ী কাজগুলো সেভাবে সাড়া ফেলেনি। কিন্তু এই বইটা ইংরেজিতে আসতে আরো কয়েক দশক লেগে গেছে, আর তারপরও বইটা মেনস্ট্রিমে সেভাবে সাড়া ফেলেনি। হয়তো পাঠকদের পছন্দ হয়নি, অথবা সেই 'মিসম্যাচ'... কিন্তু এক ঘরানার পাঠক এই পাতলা (১২০-১৩০ পাতা হবে) বইটাকে যত্ন করে আগলে রেখেছেন, যথাসম্ভব প্রচার চালিয়েছেন। থ্যাংকস টু দেম, না পড়লে একটা অন্যরকম ইমোশনাল এক্সপেরিয়েন্স থেকে বঞ্চিত হতে হত।

ঠিক কী নিয়ে এই বই? সামারি দেখে বললে বলতে হয়--- একটা বাংকারে চল্লিশজন মেয়েকে সারাজীবন বন্দি করে রাখা হয়েছে, আচমকা একদিন সব পালটে যায়। ব্যস!

কিন্তু ওটুকু জেনে কিছুই বোঝা যায় না। আগেই বলে দিই, এই বইটা চিরাচরিত ডিস্টোপিক ফিকশন নয়। বরং যদি 'দ্য মেমোরি পুলিশ' পড়ে থাকলে কিছুটা সাযুজ্য পাওয়া যেতে পারে। এক ডেসপন্ডেন্ট ও ডেসোলেট কাহিনি, যেখানে একজন কিশোরী আবিষ্কার করছে, সে তাঁর শারীরিক, মানসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানে না। যারা জানত, তারা আবার আবিষ্কার করছে, তারাও আসলে ঠিক জানত না। মনুষ্যজাতির চেতনা আর শুন্যতা ধরা পড়ে পদে পদে। কিন্তু এই 'ব্লিক' যাপনের বর্ণনা পড়তে পড়তে একসময় বোঝা যায়, লেখিকা কী ভীষণভাবে হতাশার ছদ্মবেশে একটা আশার গল্প বলে চলছেন। আবার উল্টোটাও বলা যায়! স্ট্রিম অফ কন্সিয়াশনেস জাতীয় ন্যারেটিভ নয়, বইটা পড়তে গিয়ে কোথাও হাই ওঠে না, কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই গতিশীল কাহিনির ডেপথ এতটাই বেশি যে চমকে উঠতে হয়। বিশেষ করে বইটা সেকেন্ড হাফে গিয়ে যে উচ্চতায় পৌঁছে গেল, সেটা লিখে বোঝানো কঠিন। অনেকদিন পর একটা বই মাত্র দু তিন সিটিং এ শেষ করে ফেললাম আর শেষ করেও ভুলে যেতে পারলাম না। যারা এই ধরনের বই পড়তে ভালোবাসেন, এই কাজটা মিস না করাই ভালো।


যখন স্ক্রিপ্ট কবিতা হয়ে পর্দায় ফুটে ওঠে...

পঞ্চাশ মিনিটের সিনেমা, প্রায় কেউই দেখেনি। মুবিতে ছিল একসময়, পরে আর পাইনি। আইএমডিবিতে শুধু একজন রিভিউ দিয়েছে। অচল মিশ্রা যে সিনেমা করছে সেইজন্যই অনেকের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। প্রায় সংলাপহীন একটা ছবি যে কত কিছু বলতে পারে, সেটা বোঝার জন্য এই জিনিসটা দেখা দরকার। এরকম ভিস্যুয়াল পোয়েট্রি পর্দায় তুলে আনা শেখাও যায় না, শেখানোও যায় না। তাজদার জুন্যায়েদের আবহসংগীত কাজটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

ধুইন
অচল মিশ্রা