বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭

---(আগের পর্বের পর)

৩)ব্রিটিশ মিউজিয়াম 

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যেতে হলে রাসেল স্কোয়ারে নামতে হয়।সেইমত বাস থেকে নেমে দেখি মিউজিয়ামের গেটের সামনে লম্বা লাইন পড়েছে।এই মিউজিয়ামের জগৎজোড়া নাম,তা লাইন পড়াটা আশ্চর্য কিছু নয়।মিনিট পনেরো লাইনে দাঁড়িয়ে,ব্যাগ চেক করিয়ে সামনের বিশাল দরজা দিয়ে চৌহদ্দির ভিতর ঢুকে পড়লাম।ভিতরে ক্যাফেটেরিয়ার পাশ দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে।বাঁদিকে গেলে মিশর,মেসোপটেমিয়া দেখে নেওয়া যাবে।তিনতলায় জাপান,চারতলায় ইউরোপ,মাটির তলায় আফ্রিকা।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভাবছি কোথায় যাবো?শেষমেশ মিশরেই চললাম।রাশি রাশি জিনিস সাজানো আছে।রহস্যময় সারকোফেগাস থেকে শুরু করে আস্ত পাথরের দরজা অব্দি।গায়ে লেখা গিজিগিজি হিয়েরোগ্লিফিক লেখা দেখতেও কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।মমির ঘরে ভিড়ে ভিড়।কালো বেড়াল(আনুবিস নাকি?) থেকে শুরু করে ক্লিওপেট্রা অব্দি মমি কাঁচের বাক্সে রাখা আছে একের পর এক।



কিছুক্ষণেই জিভ বেরিয়ে হা হা করতে লাগলাম।পঞ্চাশ মিলিয়নের বেশি জিনিসপত্র আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে,আরো যোগ হচ্ছে দিন দিন।এক একটা স্পেসিমেন নিয়ে উপন্যাস লিখে ফেলা যায়।প্লটের অভাব হবে না সারাজীবনেও।কথাটা যে খুব ভুল ভাবিনি,কিছুক্ষণের মধ্যেই তার প্রমাণও পেয়ে গেলাম।নানা লোকে দেখছি,নোটবুক হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হলো,তিনি স্পেন থেকে এসে লন্ডনে বাস করছেন।পেশায় লেখিকা।বললেন,গল্প ভাবতেই হয় না।ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ঘন্টা কয়েক কাটালেই নতুন ভাবনা মাথায় এসে ভিড় করে।স্কুল থেকেও ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দল এসেছে মিউজিয়াম দেখতে।কাঁচের ওপর নাক লাগিয়ে তাকিয়ে থাকার উত্তেজনা চোখে চোখে। 

মিশর থেকে বেরিয়ে ফ্লাইট ছাড়াই গ্রিসে চলে গেলাম।কাস্ট আর মার্বেলের প্রতিমার ছড়াছড়ি।কি যে দেখবো আর কি যে দেখবো না কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না।ইতি মধ্যে দু ঘন্টা হতে চললো।গ্রিস থেকে বেরিয়ে ভাবতে লাগলাম যাবো কোথায়?মিশরের কথা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি,ইউরোপ আমেরিকার গল্পও মোটামুটি জানা।ভেবেচিন্তে চললুম জাপানে।জাপানের কথা বেশি কিছু জানি না।ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে অপেক্ষাকৃত শান্ত একটা হলে ঢুকে পড়লাম।হালকা আলোতে অনেক কিছু সাজানো আছে কাঁচের শোকেসের ভিতরে।প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসের সভ্যতার নির্দেশ।১৬০০ থেকে ১৮৬৮ অব্দির সময়কে জাপানে ইডো যুগ  বলে।সামুরাইদের শাসনকালে জাপান থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয় কিন্তু ব্যবসা পত্তর চলতে থাকে সমুদ্রের মাধ্যমে।অন্যান্য সভ্যতার প্রভাব পড়েনি বলেই হয়ত জাপানিরা নিজের মত করে বেঁচে ছিল যুগের পর যুগ  ধরে।পটারি তৈরী,বুদ্ধের উপাসনা,আর চায়ের আসরের জন্য তৈরী করা তালামি ঘর।এক একটা নিখুঁত ডিজাইন তৈরী করতে জাপানিরা বছরের পর বছর ধরে কাজ করে গেছে।হয়ত সেটা একটা ফুলদানি,একটা কাঁচের সাদা বাটি,হয়ত একটা প্লেট কিন্তু ডিজাইনের পারফেকশন একশো শতাংশ।পোর্সেলিনের এক একটা মূর্তি আর ডিজাইন নিয়ে বছরের পর বছর কাজ হয়।এই মানসিকতা বুঝে উঠে পারা কঠিন কিন্তু সেই জন্যেই হয়ত ডিজাইনের ব্যাপারে আজও জাপানিরা সবচেয়ে এগিয়ে।তান্ত্রিক বুদ্ধিজম এর বেশ কয়েকটা মূর্তি চোখে পড়লো।আর চোখে পড়লো সাদা রঙের এই পোর্সেলিনের ফুলদানি,ফুলগুলোও আসল নয়,কিন্তু কি সুক্ষ কারুকাজ করা আছে ।

হোসোনো হিতামির তৈরী এই সিরামিক বোটানি আর্টের কদর নাকি সারা পৃথিবীতে।উঁচু দামে বিক্রি হয় তার কাজ,কিন্তু তিনি কখনো সামনে আসেন না।বছরের পর বছর ধরে নতুন নতুন বোটানিক আর্ট নিয়ে কাজ করে যান।কাকিমনের হাতি এই সেকশনের আরেক পাওনা। কাকিমন আসলে পোর্সেলিনের ওপর এনামেলিংয়ের একটা স্টাইল যা ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে সাকাইদা কাকিমন তৈরী করেছিলেন।কাকিমন স্টাইলের এই হাতি ইউরোপে চলে আসে জাহাজে করে।জাপানের লোকেরা কস্মিনকালেও হাতি দেখেনি।শুধু হাতির বর্ণনা শুনে আর বই পড়েই এই হাতি তৈরী হয়েছিল।পৃথিবীর সেরা ১০০টা ডিজাইনের মধ্যে এই হাতি অন্যতম।


জাপান থেকে বেরিয়ে অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমণ করে হাজির হলাম আফ্রিকাতে। আফ্রিকাতে যে কি আর্ট তৈরী হয় কোনো ধারণাই নেই।উৎসুক হয়ে গিয়ে দেখি আফ্রিকানরা দুশো বছর আগেই মডার্ন আর্ট বানিয়ে বসে ছিল।কোনো মূর্তি বা মডেল বাস্তব জিনিসের মত দেখতে নয়,বরং ধাতুর তৈরী জিনিস,বাঁশ,মেশিনের টুকরো সব দিয়ে একটা উদ্ভট আকার দেওয়া হয়েছে বেশিরভাগ জায়গায়।সেটা দেখতে যে খুব সুন্দর তা নয়,কিন্তু  আকর্ষণীয় তো বটেই।





৪)ভিক্টরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়াম 

প্রথমে ভেবেছিলাম যাবো না।গন্ডায় গন্ডায় মিউজিয়াম।কাঁহাতক সহ্য করা যায়?একেই তিন বার ন্যাশনাল গ্যালারি গেছি,ব্রিটিশ মিউজিয়ামে মাথা ধরে গেছে,সাইন্স মিউজিয়াম আর ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামে হেঁটে হেঁটে অবস্থা খারাপ।এর মধ্যে আরেকটা মিউজিয়াম।না বাবা দরকার নেই। তারপর দেখলাম একদিন টুক টুক করে মিউজিয়ামের সামনে এসে হাজির হয়েছি।ভাবলাম সামনে যখন এসেই পড়েছি ঢুকেই পড়া যাক আধ ঘন্টার জন্যে।ধুমধাম ওপর থেকে দেখে পালিয়ে আসবো।এই ভেবে ঢুকে গেলাম।
ডানদিকে খানিকটা এগোতেই যে চক্ষু চড়কগাছ হলো,সেটা আর পরের চার ঘন্টা ধরে আগের অবস্থায় ফিরলো না।কাস্ট বা আসল মূর্তির নকল রাখা হয়েছে বিশাল দুটো হলে।ওরে বাবা। কি নেই সেখানে!মিকেল এঞ্জেলোর ডেভিড থেকে শুরু করে হেন জিনিস নেই যা সেখানে দেখতে পেলাম না।কাস্ট দেখেই যখন এই অবস্থা হচ্ছে আসল দেখলে যে লোকেদের কি হয় সেটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না।কাস্ট হলে কি হবে,প্রতিটা মূর্তি বানানো হয়েছে পরম যত্ন নিয়ে।না বলে দিলে আসল নকলে তফাৎ করার কোনো উপায়ই নেই।কি সূক্ষ্ম কারুকার্য এই কাস্টগুলোয়।ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকলেও চোখ ক্লান্ত হয় না।একটা কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফিট তোরণদ্বার অব্দি বানিয়ে ফেলা হয়েছে।বেশ কয়েকজন ফাইন আর্টসের ছাত্ররা বসে এঁকে যাচ্ছে কাস্টগুলোর ছবি।মানুষের আকৃতি আঁকা নাকি কঠিন ব্যাপার।ডোনাটেলোর মনোলিথ আর সান পেট্রোনিয়া বাসিলিকার কাস্ট দেখতেই অর্ধেক সময় কেটে 
গেছে।




কোনোরকমে সেখান থেকে বেরিয়ে রেনেসাঁ গ্যালারিতে পড়লাম।উরেব্বাবা!সেখানে আরেকপ্রস্থ অবাক হওয়ার পালা।রাজ্যের জিনিস,গ্লাস পেইন্টিং থেকে শুরু করে তৈলচিত্র অব্দি।যাই দেখতে যাচ্ছি,সেখানেই সময় কেটে যাচ্ছে।শেষপর্যন্ত ধুত্তেরি বলে অন্যদিকে সরে গেলাম।কোন আর্টিস্ট ভারতবর্ষে ভিক্টরিয়ান আর্কিটেক্চার নিয়ে গেছিলেন সে নিয়ে কি একটা প্রদর্শনী হচ্ছে।তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে উপরে উঠে গেলাম।আবার একটা বিরাট হলে পড়েছি।রাফায়েল আর টার্নারের প্রমাণ সাইজের পেইন্টিংয়ে ভর্তি।আমার ওই সব দেখা অনেক হয়েছে ন্যাশনাল গ্যালারিতে।সামনে এগিয়ে দেখি আরেকটা ঘর।সেখানে রাজ্যের পোর্সিলিনের সাজানো জিনিস,অস্ত্র শস্ত্র,সুন্দর করে সাজানো।সেটা শেষ হবে হবে করেও শেষ হচ্ছে না।বাঁক ঘুরতেই দেখলাম আরেকটা যাচ্ছেতাই রকমের বড় ঘরে পৌঁছেছি।হাজারো জিনিস নিয়ে সুসজ্জিত।সোনার ঘড়ি,রুপোর কাস্কেট,সারা পৃথিবী থেকে উপহার পেয়েছেন রানী।এর পর যেখানেই এগো সেই এক কান্ড।একটা করে বাঁক নিচ্ছি আর আরেকটা বিরাট ঘরে গিয়ে পড়ছি।গোলকধাঁধা নাকি?বাইরে থেকে তো ছোটই মনে হয়েছিল।প্রতিটা দ্রষ্টব্য অলৌকিক সুন্দর।কিন্তু কত আর দেখবো? ল্যান্ডস্কেপ এর ঘর,ট্যাপেস্ট্রির ঘর,ফটোগ্রাফির ঘর,ফার্নিচারের ঘর,সোনা রুপোর কাস্কেট আর শো পিসের আরেকটা ঘর।নাটক আর লন্ডনের নাট্যজগতের ইতিহাস আর জামা কাপড় নিয়ে আরেকটা ঘর। আমার পুরো পাগল হওয়ার জোগাড়।এক মাসেও এতো দেখা যাবে না।আবার বেরিয়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না।এরকম জিনিস কি আর রোজ রোজ দেখা যায়!বিশেষ ভাবে তৈরী একটা পোর্সিলিনের ক্যাসকেট দেখলাম যার এক একটা তক্তা তৈরি হয় এক মাস ধরে।প্রতিটা জিনিসের পিছনে একশো দুশো বছরের ইতিহাস।সবশেষে গয়নার ঘরে গিয়ে আবার মাথা ঘুরে গেলো।হিরে,মণিমুক্তোখচিত হার,দুল,আংটি।দামি দামি পাথর লাগানো হাজারো গয়না। 



একরকম পালিয়ে গেলাম সেখান থেকে।বেরিয়ে যেতে যেতেও একটা জিনিসে চোখ আটকে গেলো।

লাইব্রেরি।এতক্ষণে সত্যিকারের জন্য রানীর ওপর রাগ হলো।হাজারে হাজারে বই সাজানো।বইগুলো সোজা দু তলা অব্দি উঠে গেছে বুককেসে।প্রতিটা বই সোনার জল ড়ানো লাল ভেলভেট দিয়ে বাঁধানো।কোনো মেম্বারশিপের দরকার নেই শুনলাম।কোনো রক্ষনাবেক্ষনের কাজ না চলতে থাকলে যে কেউ এসে বই পড়তে পারে এখানে।এতক্ষণে সত্যি সত্যি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।



এছাড়া অন্যান্য জায়গায় যে জিনিসগুলো সত্যি সত্যি ভালো লেগেছিলো তার মধ্যে আরো কয়েকটার কথা লিখলাম। 

১)Cutty Sark(গ্রিনউইচ) :- Cutty Sark এর এই বিশাল মডেল আসল জাহাজের চেয়ে কম যায় না।একসময় টি ক্লিপার জাহাজগুলো তৈরী হয়েছিল চায়ের ব্যবসায় দ্রুত সমুদ্রে যাতায়াত করার জন্য।সুয়েজ ক্যানাল খুলে যাওয়ার পর নতুন রাস্তা খুলে এই জাহাজগুলো বন্ধ হয়ে যায়।


২)ব্যাটল অফ ট্রাফালগার :-গ্রিনউইচের ন্যাশনাল ম্যারিটাইম মিউজিয়ামে থাকা জে এম ডাব্লিউ টার্নার এর এই বিরাট পেইন্টিং দেখে সত্যি শিহরণ জাগে।ট্রাফালগার যুদ্ধের এই ছবি নিয়ে নানা কথা হয়েছে আর্ট মহলে। 


৩)No Woman No Cry:- টেট ব্রিটেনে থাকা এই ছবি একসময় বছরের সেরা টার্নার প্রাইজ পেয়েছিলো।রঙভেদের দরুণ ১৯৯৩ সালের স্টিফেন লরেন্স নাম এক কিশোরের হত্যা এই ছবি আঁকতে বাঁধ্য করেছিল ক্রিস ওফিকে।এক্রলিক পেন্ট,অয়েল পেন্ট আর পলিস্টার রেসিনের সঙ্গে নানা জিনিস মিশিয়ে তৈরী করা এই মডেলের চোখের প্রতিটা অশ্রুতে স্টিফেনের ছবি দেখতে পাওয়া যায়।

৪)হেনরি মুর কালেকশান :-টেট ব্রিটেনে থাকা সেমি অ্যাবস্ট্রাক্ট ফিগারগুলো এক কোথায় অনবদ্য। 



৫)দা ডক্টর :-স্যার লুক ফিল্ডসের আঁকা এই ছবি দেখে মনে একটা অন্যরকম ভাব জাগে।একটা বাচ্চার জন্য সারা রাট জেগে বসে থাকা ডাক্তার। পিছনে কাঁদতে থাকা মা এবং তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকা চিন্তিত বাবা।টেট ব্রিটেনের এই ছবিটা দেখার পরেও স্মৃতিতে তাজা থেকে যায়। 


৬)জেরিকো স্কাল :- লেভান্টে থেকে খুঁজে পাওয়া নিওলিথিক সময়ের এই খুলিগুলো বিশেষ ভাবে  পরীক্ষা করে বোঝা যায় যে মাটিতে মৃতদেহ পুঁতে ফেলার পরে কঙ্কালের খুলি সরিয়ে নেওয়া হতো এবং খুলির ভিতর প্লাস্টার অফ প্যারিস ভরে রেখে দেওয়া হত।হাজার হাজার বছর পরেও মৃত ব্যক্তি কেমন দেখতে ছিল তার একটা আন্দাজ পাওয়া সম্ভব ছিল তাতে।এর চেয়ে আগে এরকম কোনো পদ্ধতি ছিল বলে জানা ছিল না।ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রহস্যময় আবিষ্কারের সারিতে জেরিকো স্কাল প্রথম সারিতে। 


৭)স্ট্যাম্প কালেকশান ব্রিটিশ লাইব্রেরি:--ফিলাটিলিক বা স্ট্যাম্পের এতো বিশাল কালেকশান দেখার সুযোগ সচরাচর হয় না।সময় এবং ইচ্ছা থাকলে এই গুপ্তধনা দর্শন করতে দারুণ লাগবে। 

------------------------------------------------------------------------------
ছবির কথা 




















1 টি মন্তব্য:

  1. বাপরে!! এত মিউজিয়াম দেখাও একটা ব্যপার কিন্তু আর সাথে এত কিছু মনে রাখা!
    প্রদীপ্ত

    উত্তরমুছুন