শুক্রবার, ৯ জুন, ২০১৭

হ্যামস্টেড হিথ ও অন্যান্য




লন্ডনের সীমানার মধ্যে থাকা হ্যামস্টেড গ্রামটি নিয়ে আমার কৌতুহল প্রথম থেকেই ছিলশান্ত, সবুজ, একলা গ্রামহ্যাম্পস্টেড গ্রামটি ঘেরা আছে সবুজ উঁচুনিচু প্রান্তর বা গ্রাসল্যান্ড দিয়ে, যার নাম হ্যামস্টেড হিথপ্রায় ৮০০ acre এ ছড়িয়ে থাকা এই সবুজের সমারোহে বেশ কয়েকটা পুকুর, উঁচু পাহাড়ের টিলা, আর প্রাচীন গাছের জঙ্গল দেখতে পাওয়া যায়হিথের একদিকের টিলার নাম পার্লামেন্ট হিলসযেখান থেকে প্রায় সারা লন্ডনটাই দেখতে পাওয়া যায়অন্যদিকে কেনউড হাউস ও গ্রামের জনপদলন্ডনের ব্যস্তসমস্ত জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় এখানেলন্ডন শহরে নয়, সবচেয়ে বেশি মিলেনিয়ারদের বাস এই ছোট্ট গ্রামেপ্রায় একশো বছরের বেশি সময় ধরে নানা আর্টিস্ট, লেখক, কবি, অভিনেতা এখানে এসে বাস করছেনএলিয়ট, আগাথা ক্রিস্টি, ইয়ান ফ্লেমিং, কিটস, হাক্সলি, জন কনস্টেবল, স্ল্যাশ, জুডি ডেঞ্চ থেকে হালের শার্লক হোমস বেনেডিক্ট কুম্বারবাক পর্যন্ত সকলেই হ্যামস্টেডের নিবাসীহ্যামস্টেডকে ইন্টেলেকচুয়াল গ্রাম বললে মোটেই বাড়াবাড়ি হয় নানাজি শাসনের সময় যখন একের পর এক আভ্যান্ট গার্ডে আর্টিস্টরা এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে, এখানকার লোকেরা সাগ্রহে তাদের অভিবাদন করেছে'হ্যাম্পস্টেড লিবেরিসম' সাড়া ফেলেছে লন্ডনের বাইরেওক্রমে নানা দেশের নানা লোকে এসে এখানে থাকতে শুরু করেছে কিন্তু গ্রামটা এখনো সেই একই রকম ভাবে শান্ত ও সুন্দর রয়ে গেছেকোলাহলের রেশমাত্র নেই।  




হাইগেট থেকে হ্যাম্পস্টেড হিথ পৌঁছতে সময় লাগলো আধ ঘন্টা ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছেগা ভেজে না এইরকম বৃষ্টিতেযতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজবৃষ্টির পরোয়া না করে নানা লোকে ঘুরে বেড়াচ্ছেপোষা কুকুররা দৌড়াদৌড়ি করছেএ এক আশ্চর্য সুন্দর জায়গাগাছের তলায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়কাঁচাপাকা রাস্তা চলে গেছে হোয়াটসস্টোন পণ্ডের দিকেসেখানে সুন্দর একটা ব্রিজ তৈরী হয়েছেআমরা ঘুরতে ঘুরতে পার্লামেন্টারি হিলের ওপর চলে এলামএকধার দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে লন্ডন আই, ওয়্যারলেস টাওয়ার, কুকুম্বার টাওয়ার নিয়ে লন্ডন শহরটাঝিরঝিরে বৃষ্টি মেখে, ভেজা ঘাসের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টাখানেক পর কিট্স হাউসের দিকে এগোলামবাড়িটা সুন্দরসামনে পিছনে ফুলের বাগানএখানে থাকলে কবিতা নিজেই নিজেকে লিখিয়ে নেবেহ্যাম্পস্টেড থেকে ফেরার সময় মনে হলো, লন্ডন না এলেও ক্ষতি নেইশুধু এই ছোট্ট গ্রামটার জন্যেই এখানে ফিরে আসা যায়









লিটল ভেনিস ও প্রিমরোস হিলস 

বাজারে যাওয়ার মজাই আলাদাএই কদিনে যত লোকাল বাজার ছিল চষে ফেলেছিস্পেটলফিল্ড মার্কেট, ব্রিক লেনের বাংলা বাজার, গ্রিনউইচ মার্কেট, ফ্লিট স্ট্রিট, নটিংহিল মার্কেট সবগুলোর নিজস্ব একেকটা বিশেষত্ব আছে, কিন্তু ক্যামডেন লক মার্কেটের মতন আর একটাও নয়ক্যামডেন মার্কেট একেবারে অন্য চরিত্র মেলে ধরে চোখের সামনেকালো দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতি, লেদার জ্যাকেট আর হিপিদের বাজনা, ফুটপাথের জিভে জল আনা সারা পৃথিবীর খাবার আর উদ্ভট এবং আনকমন জিনিসের দোকানপাট এখানকার ভোল পাল্টে দিয়েছে







প্রায় ঘন্টাদুয়েক ধরে ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরোনো বইয়ের দোকানট্যাটুর কারিগরি, নতুন ধরণের বাইক তৈরির ওয়ার্কশপ, বিস্তর জিনিসপত্রের নামও জানি নাসাড়ে চার পাউন্ডে পাওয়া গেলো একবাক্স খাবারথাই নুডল্স, চিকেন, পোর্ক, সবজি, সস মিশিয়ে তৈরী একটা দারুণ জিনিস(শেষ করতে পারিনি, এত বেশি ছিল)


তারপর সন্ধ্যে হব হব করছে, আমি আবিষ্কার করলাম পাশের ক্যানালটার পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে লন্ডন জুয়ের দিকেব্যাসচললুম সেইদিকে

এই দিকের খবর বিশেষ কেউ জানে নাটেমস যদি থেকে বেরোনো এই শাখানদী বা খালে দিব্যি নৌকো করে ঘুরে বেড়ানো যায় ইচ্ছে করলে ভেনিসের গন্ডোলার মতন দেখতে নৌকাগুলো বেশ রংচঙেএই জন্যে এই জায়গাটাকে বলা হয় লিটল ভেনিসখালটা বেশ গভীরপাশ দিয়ে রাস্তাটা উঁচু নিচু হয়ে এগিয়ে চলেছেমাথার ওপরে একটা ব্রিজ পড়লোসেই ব্রিজের তলা দিয়ে মিনিট পনেরো এগিয়ে গিয়ে দেখি ক্যানাল বেশ চওড়া হয়ে ডানদিকে বেঁকেছেবাঁদিকে পুরোনো একটা চার্চ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অন্য পাড়েখানিকটা এগিয়ে এই ক্যানাল চলে গেছে চিড়িয়াখানার পাশ দিয়েপাশের সিঁড়ি দিয়ে মেন রাস্তায় উঠে এলাম খানিকটা এগোতেই দেখি প্রিমরোস হিলের বিশাল পার্কটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছেলন্ডনের পার্কগুলো নামেই পার্কএকেকটা ছোট শহর ঢুকে যাবে এক একটা পার্কেচললুম সেখানেসবুজ ভেলভেটের চাদর পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে গাছের পাশ দিয়েযখন পাহাড়ের মাথায় গিয়ে পৌঁছলাম সন্ধ্যে হয়ে এসেছেলন্ডন শহরের আলো জ্বলে উঠেছেরঙ্গীন আলোয় মায়াময় দেখাচ্ছে দূরের সাউথব্যাংকের এলাকাগুলোয়ঘোর লেগে যায়ঘন্টাখানেক পর নামতে শুরু করলামপ্রিমরোস হিলের সেই সন্ধ্যে মনে বাসা বেঁধে রইলো চিরকালের মত














সাউথব্যাংকসে একটা বিকেল 

টেমস নদীর দক্ষিণ প্রান্তে নদীর ধার দিয়ে বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে টাওয়ার ব্রিজ থেকে বিগ বেন আর হাউস অফ পার্লিয়ামেন্ট পর্যন্তডান দিকে নদীর ওপর একের পর এক ব্রিজটাওয়ার ব্রিজের পর পড়ে লন্ডন ব্রিজ, সাউথওয়াক ব্রিজ, মিলেনিয়াম ফুট ব্রিজ, ব্ল্যাকফ্র্যায়ার্স ব্রিজ, ওয়াটারলু ব্রিজ, ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজগোটা সাউথব্যাংকে নদীর ধারটা সাজিয়ে তোলা হয়েছে রং বেরঙের  ক্যাফে, তাভার্না শপ আর মিউজিয়াম দিয়েকাছাকাছির মধ্যেই প্রাচীন আমল থেকে বিখ্যাত বরো মার্কেট, যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত লোভনীয় খাবারদাবারের দোকান বসেটাওয়ার ব্রিজের কাছেই নানা ব্যাংকের অফিস, অনীশ কাপুরের ডিজাইন দিয়ে সাজানো চত্ত্বরসেখান থেকে একটু এগোলেই শেক্সপিয়ার গ্লোব থিয়েটার। 




সেদিন সন্ধ্যেবেলায় শেক্সপিয়ার গ্লোব থেকে হাঁটতে হাঁটতে এগোলাম ওয়েস্টমিনিস্টারের দিকেএর চেয়ে ভালো সন্ধ্যাযাপন আর হয় নাদিনটা ছিল বৃহস্পতিবারএখানে বৃহস্পতিবার রাত্তির থেকেই উইকএন্ডের আমেজ চলে আসেনানা লোকে বসে আছে টেমসের কাছাকাছি ক্যাফেগুলোতেচলছে খাদ্য ও পানীয় সহ খোশগল্পটেট ব্রিটেন ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম ব্যাংকসাইড গ্যালারিকে পাশ কাটিয়েরঙিন আলোয় সাজানো গাছগুলো আরো মায়াময় করে তুলেছে টেমস পাথ কেদূরে সূর্য ডুবে আকাশে লাল রং ছড়িয়ে গেছেনদীর দিক থেকে বেশ ফুরফুরে হওয়া দিচ্ছেআমরা খোশমেজাজে হেঁটে চলেছিমাঝে মাঝে এক একেকজনের দেখা পাচ্ছিনিজের মনে গিটার বাজিয়ে গান করছেঅনেকে সেই গান শুনে হাততালি দিচ্ছেএই আমুদে জীবনযাত্রা চলছে কয়েকশো বছর ধরেযতই বড় বিপদ আসুক না কেন, সাউথব্যাংকস ঠিক নিজের চরিত্রে ফিরে আসে গান, বাজনা, হইহুল্লোড় আর টেমসের ভেজা বাতাস নিয়ে 



ন্যাশনাল থিয়েটারের কাছে পৌঁছে দেখলাম বহুলোকে এসেছে প্লে দেখতেলন্ডন শহরে নাটক দেখার উৎসাহ সিনেমা দেখার চেয়ে অনেক বেশিউজ্জ্বল আলোয় ন্যাশনাল থিয়েটার জগমগ করছেঅনেক দূর থেকেই দেখতে পাওয়া গেলো লন্ডন আইর নাগরদোলার লাল আলোহাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম এম্ব্যাঙ্কমেন্ট ছাড়িয়ে লন্ডন একোয়ারিয়াম এর কাছেজুবিলী গার্ডেনে কত লোকে বসে আছে খাবার দাবার নিয়েআলোয় আলো চারদিকেকতক্ষণ বসে থাকা হলো খেয়াল নেইবিগবেনের ঘড়ির টিক টিক কাঁটা একসময় মনে করিয়ে দিলো ফেরার কথাএখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু ফিরতে হবেপা দুটো ফিরে গেলো আমাদের, মনটা সেখানেই রয়ে গেলো 


                        
                        
                        
-------------------------------------------------------------------------------

ছবির কথা 







২টি মন্তব্য:

  1. Hampstead Heath e Shonku r Sonders er bou Dorothy sandhyo vromone beriyechilen, Swarnaparni - Satyajit Ray...

    উত্তরমুছুন
  2. hyan mone ache,sandhyobhromoner adorsho jayga.Kheyal korecho egiptio atonke bola hoyechilo golda macher gop diye mirakiural toiri seta pore palte geche..:-) ekhane bari thakle nije nijei kobi aar lekhok hoa jeto

    উত্তরমুছুন