আজকাল ল্যাদ বেড়েছে বলে গল্প উপন্যাস দূর, আগের মতো ব্লগ বা ফেসবুক পোস্টও করা হয় না। বছর দুই তিন আগে যে সমস্ত অদ্ভুত অনালোচিত ঘটনা আর ইতিহাস নিয়ে লেখালিখির ইচ্ছে ছিল, সে সব লিস্টি করলেই একটা পুস্তিকা হয়ে যেত৷ দেদার ডকুমেন্ট আর কাটিং রাখা আছে এখনও ল্যাপটপে। বেশিরভাগ বিষয় নিয়েই এখনও তেমন কথাবার্তা হয় না (বা আমার নজরে পড়ে না) বলে একটু অবাকই লাগে। যেমন- চাটনি!
কুলের, আমের, তেঁতুলের চাটনির কথা ভেবে হুসহাস করার আগে জানাই, এ-ই চাটনি সেই চাটনি নয়। এ এক ইন্টারন্যাশনাল চাটনি, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ যে চাটনির পাঙ্খা। গুয়ানা থেকে ফিজি, সাউথ আফ্রিকা থেকে ভারত, চাটনির অনুরাগী কম নয়। এই চাটনির ইতিহাসও অসামান্য। মুচমুচে, সাস্পেন্সফুল এবং সুরেলা। সুরেলা, কারণ এই চাটনি আসলে হল চাটনি মিউজিক।
ভারতবর্ষ থেকে দরিদ্র গিরমিটিয়াদের হাত ধরে সুদূর ক্যারিবিয়ানে এই পূর্ব ভারতীয় সঙ্গীত কীভাবে পৌঁছল আর ফুলেফেঁপে সাম্রাজ্য বিস্তার করল, সে এক অসামান্য কাহিনি। ১৮৫৭ সালের সৈন্য অভ্যুত্থান এর পর থেকে ভারতবর্ষের গ্রামগঞ্জে ব্যাপক দারিদ্র্য দেখা যায়, কাজকর্মের অভাব আর সাহেবদের সন্দেহপ্রবণ অ্যাটিটিউডের জন্য প্রচুর মানুষকে ছাঁটাই করা হয়। এর আগে থেকেই ক্যারেবিয়ান আর ফ্রেঞ্চ গুয়ানাতে বিভিন্ন জায়গায় সস্তা শ্রমিকদের চাহিদা বেড়েছে, আর ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ফড়েদের মারফত কুলি ধরে আনার কিসসাও কিছু নতুন নয়। গিরমিটিয়া কুলিদের ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু কিছু বাংলা বইতেও উঠে এসেছে, কিন্তু প্রামাণ্য, ওয়েল রিসার্চড ডকুমেন্টেশন পড়তে চাইলে প্রবীণ কুমার ঝা- এর 'কুলি লাইনস' একটা অসামান্য কাজ। যাই হোক, সেই সময় উত্তরপ্রদেশ আর বিহার (বা পূর্বাঞ্চল যাকে বলে) থেকে প্রচুর গিরমিটিয়া কুলি ক্যারেবিয়ানে গেছে, আর ফেলে আসা মাটির দীর্ঘশ্বাস আর স্মৃতির পাশাপাশি ভোজপুরি আর ম্যায়থিলী ভাষার সংস্কার, লোককথা, শিল্প ও সংগীত সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। যেভাবে জ্যাজ গড়ে উঠেছিল কাপাস প্ল্যানটেশনের ব্ল্যাক লেবারদের হাত ধরে, চাটনি মিউজিকের ক্রেডিট এই সমস্ত গিরমিটিয়া কুলিদের দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অবশ্য সেই সঙ্গীত সম্পূর্ণ ভাবে বিকশিত হতে হতে কয়েক শতাব্দী লেগে গেছে, ততদিনে গিরিমিটিয়াদের পরবর্তী প্রজন্মদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সম্পর্ক বেড়েছে, দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষজন মিলে পরিবার গড়ে তুলেছে, ভোজপুরি সঙ্গীতের সঙ্গে ক্যালিপ্সো মিশেছে, ঢোলকের পাশাপাশি সোকা বিটস আর তাশা ড্রাম ঢুকে গেছে। ভাষাও হয়েছে পাঁচমিশালি। পরবর্তীতে চাটনি মিউজিক জ্যাজ, আমেরিকান রক, লাতিনো সঙ্গীতের পাশাপাশি বলিউডি সঙ্গীতেও প্রভাব ফেলেছে, যদিও সে কথা খুব বেশি মানুষ জানেন না।
আমার এক পূর্বাঞ্চলের বন্ধু গিরমিটিয়াদের বংশধরকে বিয়ে করে ট্রিনিডাডে সেটল করে গেছে। দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব কম নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখতে গেলে মনে হয় একই গ্রামের মানুষ। খাওয়াদাওয়া এক, আচার আচরণ এক, শখ আহ্লাদ উৎসবও এক। শুধু একটাই তফাত, প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়া লেগে ওদেশের গিরমিটিয়া বংশধররা কুসংস্কার ঝেড়ে অনেকটা ওপেন মাইন্ডেড হয়ে গেছে। মানাউসে এক বৃদ্ধা স্টুডিও মালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাঁর পূর্বপুরুষরা সবাই ফ্রেঞ্চ গুয়ানায় কুলির কাজ করত। কিন্তু শিক্ষা দীক্ষা ক্যাথোলিক স্কুলেই হয়েছে, বড় হয়ে বিদেশ গেছে। অনেকেরই এক কাহিনি। ক্রমে এ-ই ক্রস কালচার লিঙ্গুয়া সভ্যতা কুড়ি পঁচিশটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
যাই হোক, কথা হচ্ছিল চাটনি নিয়ে। প্রায় দু আড়াইশ বছর ধরে চাটনি সঙ্গীত গিরমিটিয়া এবং স্থানীয় মানুষের জীবনের অংশ হয়েছিল, কিন্তু ১৯৬৮ সালের আগের কোনও রেকর্ডিং পাওয়া যায় না। লোকগানের সঙ্গে এমনটা প্রায়ই ঘটে থাকে। ম্যায়থিলি আর ভোজপুরি ভাষী সংস্কৃতিতে প্রায় প্রতিটা আচার অনুষ্ঠান উৎসবের জন্য একগাদা করে ঘরোয়া গান বাঁধা হয়, ধনতাল ঢোল সহযোগে গাওয়াও হয় হরদম, সেই সব গানের কথাও দারুণ মজার। কিন্তু সেসব খুব ভালো করে ডকুমেন্ট করে রাখা হয়নি।
১৯৬৮ সালে রামদেব চ্যায়তোয়ে 'কিং অফ সুরিনাম' বলে একটা অ্যালবাম রেকর্ড করে চর্চায় চলে আসেন। এইসময় উঠে আসেন দ্রৌপতি বলে এক গায়িকাও। কিন্তু চলতি হিন্দিতে যাকে বলে 'ফাট জানা', সেই পপ কালচার বিষ্ফোরণটা হল হ্যারি মহাবীরের সৌজন্য, তিনি বিহার আর ইউপিয়ান অর্কেস্ট্রার পাশপাশি হিন্দি সিনেমার গান আর স্থানীয় সঙ্গীত মিশিয়ে এমন এক জগাখিচুড়ি জিনিস বানিয়ে ফেললেন, যা শুনলেই সেখানকার মানুষের মনে অতীতের-- যে অতীতের কথা অনেকে শুধু শুনেই এসেছে-- টক মিষ্টি স্মৃতির নস্টালজিয়া তাজা হয়ে ওঠে। এই টক মিষ্টি স্বাদের গানের স্বাদ আসলে আম বা ধনেপাতা পুদিনার চাটনির মতোই। সুতরাং, চাটনি মিউজিক।
সত্তর আশির দশকে সুন্দর পোপো চাটনি মিউজিককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছিলেন। তাঁকে চাটনির গডফাদারও বলা হয়। মজার মজার সব গান, কিন্তু এরই মধ্যে খুব সূক্ষ্ম ভাবে ডার্ক হিউমার আর সমাজের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরার স্বভাব ছিল তাঁর। যেমন...
আগে আগে নানা চলে
নানি গোইং বিহাইন্ড
নানা ড্রিংকিং হোয়াইট রাম
অ্যান্ড নানি ড্রিংকিং ওয়াইন
নানা রাইডিং বাইসাইকল
নানি রিংগিং বেল
নানি লকড দ্য হ্যান্ডল
দে ফেল ইনসাইড আ ওয়েল
মাই নানা অ্যান্ড নানি
ওয়েন্ট টু টাই আ গোট
মাই নানা মেড আ মিসটেক
অ্যান্ড কাট দ্য নানিজ থ্রোট
নানি ডেড অ্যান্ড গন
মাই নানা গন টু হ্যাং
সো আই হ্যাড টু টেক ওয়ান
ফর মাই কম্প্যানিয়ন
সুন্দর পোপোর এই 'নানা নানি' আগুনের মতো দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল, রেকর্ড বিক্রি হতে লাগল খাস্তা কচুরির মতো। সুন্দর পোপো হ্যারি মহাবীরের শিষ্য ছিলেন, তিনি গুরুর কথা শুনে একেবারে ভারতের গাঁও দেহাতের গানগুলো চাটনিতে নিয়ে এলেন, বিয়ের বাসর রাত্রে পিসিমাসিদের হাসিঠাট্টা করে গাওয়া দ্বিঅর্থী গানগুলো ওয়েস্টার্ন কম্পোজিশন সহ তুলে এনে মানুষকে সেই নস্টালজিয়া ফিরিয়ে দিলেন, যা তারা প্রায় ভুলতে বসেছিল।
'রতিয়া মে দুলহা কে মৌসী বোলল গয়ে...'
'হমরে ভিলেজ মে কোহরা ব্যায়গন বহুত হ্যায়, হম তুরব তু না বেচবে কে নাহি..'
কিন্তু এ বাদেও সুন্দর পোপো এক্সপেরিমেন্টাল গান, গভীর গান কম গাননি। ইংরেজিতে গাওয়া গান I wish I was a virgin বা Don't fall in love এর মতো গানগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুন্দর পোপোর পাশাপাশি স্যাম বুদ্রাম, আইজ্যাক আর রাকেশ ইয়াঙ্করণ, জগেসসর এর মতো শিল্পীরা নানা স্বাদের গান গাইতে শুরু করে। ইয়াঙ্করণের একটা গান আছে... বড়ে দূর সে আয়ে হ্যায়!
'আনজানে লোগো মে কোই সাথ তো মিলেগা, কোই তো হোগা জো হমকো সামঝেগা..'
ঠিক এই সময়েই দেশের গরীব মানুষরা আধুনিক ভারত থেকে কাজের খোঁজে দূর দেশে যেতে শুরু করেছে। কেউ আরবে, কেউ আফ্রিকায়, কেউ আরো দূরে। এই মর্মস্পর্শী গানগুলো তাঁদের আপন হয়ে উঠল। যাঁরা বলেন চাটনিতে অশ্লীল গান ছাড়া কিছু নেই, তাঁরা সম্ভবত এই ঘরানার অনেক গানই শোনেনি।
পরবর্তীতে এই ধারায় অনেকেই এসেছেন, কিন্তু সকলের কথা বলা সম্ভব নয়। তবু চাটনির কথা উঠলে যে দুজনের কথা না বলে থামা যায় না তারা হল হরি ওম শরণ আর বাবলা-কাঞ্চন জুটি।
পূর্বাঞ্চলে হরি ওম শরণের ভজন ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় শোনেনি, এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। 'ম্যায়লি চাদর ওড় কে ক্যায়সে হো' আর 'তেরে রামজি করেঙ্গে বেড়া পার' এখনও হরদম বাজে। তা ওম শরণ এর বিয়ে হয় গুয়ানার চাটনি গায়িকা নন্দিনীর সঙ্গে, এরপর থেকে তিনি 'শ্বশুরবাড়ি'তে ভারতীয় ভজনের প্রোগ্রাম করে অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বলা যায় আধুনিক যুগে তিনি ভারতের সঙ্গীতকে ক্যারেবিয়ানে নিয়ে গেছেন। তাহলে এও বলতে হবে যে বাবলা-কাঞ্চন আবার চাটনি আর চাটনি-সোকা ঘরানাকে ভারতে আর বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় জনপ্রিয় করতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। বাবলা ছিলেন আসলে বিখ্যাত কম্পোজার কল্যাণজি-আনন্দজির ভাই, শোনা যায় 'খাইকে পান বানারস ওয়ালা' থেকে শুরু করে তাঁদের অনেক গানই বাবলা কম্পোজ করেছিলেন, তাদের সুরে অনেক গান গেয়েছিলেন কাঞ্চন। কিন্তু দিনের পর দিন বম্বেতে ঘুরেও, বড় বড় নামের কাছে আশ্বাস পেয়েও তাঁদের কেউ স্বাধীন ভাবে ব্রেক দেয়নি। মনক্ষূণ্ণ হয়ে বাবলা-কাঞ্চন (একসময় তারা বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন) নিজেদের ব্যান্ড খুলে প্রোগ্রাম করতে শুরু করেন এবং ক্রমে ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ক্যারেবিয়ানে৷ এরপর তারা সারা দুনিয়ায় অনুষ্ঠান করেছেন, 'ক্যায়সে বানি' অ্যালবাম তো এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে বড় বড় কর্পোরেট থেকে তাঁদের বিজ্ঞাপনের জন্য গান করতে বলা হয়েছিল। ২০০৪ সালে কাঞ্চন মারা যান, বাবলা অবশ্য অনুষ্ঠান করছিলেন।
যে সময় সবাই ভাবছে চাটনির কথা ভারতে আর কেউ জানবে না, সেই সময় একটা মেয়ে এসে হাজির হল ক্যারেবিয়ানে। নতুন একটা সিনেমা হচ্ছে, সেই জন্য সে চাটনি মিউজিক ব্যবহার করতে চাইছে। মাসের পর মাস ধরে এই দ্বীপ সেই দ্বীপে ঘুরে, অজস্র পুরোনো রেকর্ড শুনে, চাটনি আর সোকা মিউজিকের সর্বেসর্বা আর অতীত শিল্পীদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা করে সেই মেয়ে ফিরে গেল। কয়েক বছর পর সিনেমা রিলিজ হল আর এই গানগুলো লোকেদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল।
'আই অ্যাম আ হান্টার আই ওয়ান্ট টু সি ইওর গান'
'ইলেক্ট্রিক পিয়া'
'মুরা'
'উমনিয়াঁ'
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। মেয়েটার নাম স্নেহা খানবলকর। সিনেমার নাম 'গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর'।
চাটনি মিউজিকের জয়যাত্রা অব্যাহত। ইচ্ছে হলে ইউটিউবে শুনে দেখতে পারেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন