ইউরো, কোপা, টি টোয়েন্টি কিছুই নয়, আসল থ্রিলিং ম্যাচ চলছে ইউ পার্লিয়ামেন্ট ইলেকশনে। ফিঞ্চারবাবু একেবারে এজ অফ দ্য সিট সিনেমা করতে পারবেন, মশলার অভাব নেই। ফার রাইট আর ফার লেফটের মধ্যে রেষারেষি, রুশ ইউক্রেন ওয়ার, ইমিগ্রেশন, অয়েল ডিপ্লোম্যাসি, গাজার জেনোসাইড, টেক ওয়ার, হ্যাকিং... মিলেমিশে দম দিয়ে বিরিয়ানি হয়ে গেছে।
ইউকেতে সুনক বাবু হেরে ভূত হয়েছেন (যাক, 'ব্রিটিশ ব্যাটাদের কাছ থেকে বদলা নিয়েছি' মার্কা কথা আর শুনতে হবে না), লেবর পার্টির কেয়ার স্টার্মার তুলনায় ভালো চয়েজ মনে হয়। তিনি বলেছেন, নৈতিকতা বজায় রেখে প্রোগ্রেসিভ লিবারিজমে বিশ্বাসী। কিন্তু খেলা আসলে জমেছে ফ্রান্সে। জমে ক্ষীর।
যারা জানেন না, ফ্রান্সের এই ইলেকশন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির জন্য, সেখানে ৫৭৭টা সিট থাকে। যে কেউই জিতুক, ২০২৭ অব্দি ইম্যানুয়েল ম্যাকরন রাষ্ট্রপতি থাকছেনই।
কিন্তু দেশের জনতার মতিগতি যে একটু হলেও পাল্টাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। একে তো ফ্রান্সের ইলেকশনে নানান ফ্যাকড়া। একবারে নয়, ভোট বেশিরভাগই হয় দু রাউন্ডে। প্রথম রাউন্ডে যদি কেউ ক্লিয়ার উইনার না হয়, তাহলে সেই সমস্ত পার্টি সেকেন্ড রাউন্ডে যেতে পারে যারা ১২.৫% এর বেশি ভোট পেয়েছে।
এইবার প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে সবাইকে দুরমুশ করে সবচেয়ে বেশি ভোট শেয়ার পেয়েছে ন্যাশনাল র্যালি, উনচল্লিশটা সিটে ক্লিয়ার উইনার (৩৩% ভোট শেয়ার)। জেনে রাখা ভালো ন্যাশনাল র্যালি একেবারে কট্টর ফার রাইট বা দক্ষিণপন্থী দল, একদম কপিবুক দক্ষিণপন্থী আদর্শ মেনে চলে। এরপর বামপন্থী নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এন এফ পি) ২৯% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় নম্বরে আছে, তিন নম্বরে মুখ থুবড়ে পড়েছে ম্যাকরনের সেন্ট্রিস্ট অনসম্বল কোয়ালিশন। কিন্তু যেহেতু ক্লিয়ার উইনার নেই, তাই এই রবিবার সেকেন্ড রাউন্ড হবে। কিন্তু মজা হল, এই দু রাউন্ডের মধ্যে নানারকম খেলা হয়, আর সেখানেই সব থ্রিল। ফ্রান্সে এই বছর ভোটার টার্ন আউট ৫০%, তাই সবাই যে একেবারে কট্টর হয়ে গেছে এসব ভেবে লাভ নেই। দেখা গেছে যে প্রথম রাউন্ডে লোকে ভোট দেয় অমুক পার্টিকে জেতাবে ভেবে, দ্বিতীয় রাউন্ডে (প্রথম রাউন্ডের রেজাল্ট দেখে) আরো বেশি লোকে ভোট দেয় এই ভেবে যে যে ইচ্ছে জিতুক, অমুক পার্টিকে হারাতে হবে।
আপাতত ম্যাকরনের সেন্ট্রিসট পার্টি আর এন এফ পি জোট বেঁধে ন্যাশনাল র্যালিকে আটকানোর চেষ্টা করছে, সে জন্য সাম দাম দণ্ড ভেদ কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এই লেফট সোশ্যালিস্ট জোট প্রায় ২০০ জন ক্যান্ডিডেটকে সরিয়ে দিয়েছে, ভিতরে ভিতরে দলবদল আর স্কুইড গেম ভালোই চলছে। ওপর ওপর নিউজ হল, ন্যাশনাল র্যালি একদম নাজি মার্কা পার্টি, এমনকি নাজিদের জন্য নাকি সফট কর্নারও আছে, ওরা এলে ইমিগ্রেশন দূরস্থান, ডুয়াল সিটিজেনদেরও নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। কিন্তু ব্যাপার অতটাও সহজ নয়। আদর্শ ফাদর্শ ঠিক হ্যায়, কিন্তু আম জনতার জন্য সেন্ট্রিস্ট পার্টি যে বিশেষ কিছু করতে পারেনি সেটাই আসলে আগুনটাকে আরো কয়লা জুগিয়েছে। কিন্তু ধারণা এটাই যে, সেকেন্ড রাউন্ডে ন্যাশনাল র্যালিকে আটকাতে না পারলে ফ্রান্সের লিবারাল রাজনীতির যুগ শেষ। খতম। টাটা গুডবাই। গয়া।
সে সব তো হল, কিন্তু ছবির এই বাবাজি কে? এই তো! এটাই তো মজা! ইনি হলেন সেই মানুষদের প্রতিনিধি, যারা সেন্ট্রিস্ট কোয়ালিশনের এই বাজে পারফর্ম্যান্স দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন! ইনি আর্থার মেনশ, ফ্রেঞ্চ এ আই কোম্পানি মিস্ট্রালের হর্তাকর্তা বিধাতা। গত কয়েক মাসে ফ্রেঞ্চ এ আই কোম্পানিরা হুড়মুড়িয়ে উঠে এসেছে, আর মিস্ট্রাল তো একদম ট্রেন্ড সেটার। স্যাম অল্টম্যানের সঙ্গে তার তুলনা টানা হয়েছে বারবার। দুজনেই তিরিশের কোঠায়, দুজনেই অসম্ভব শার্প মাইন্ড, দুজনেই এ আই রেভোলিউশুনারি। কথা তো হচ্ছিল যে এতদিন ধরে যে ইউ এস বেসড টেক অন্ত্রেপনইয়োরদের মোনোপলি চলছে, তাকে টক্কর দিতে পারে মিস্ট্রালের মতো নিউ এজ ফ্রেঞ্চ স্টার্ট আপ আর আর্থার মেনশের মতো ছেলেরাই। মিস্ট্রাল নিয়েই কথা বলছি, কিন্তু গত এক দেড় বছরে টেক দুনিয়ায় বেশ কিছু সাড়াজাগানো ফরাসি স্টার্টআপ এসেছে।
এখন আর্থারবাবু পড়েছেন মহা বিপদে। মুশকিল হল, দেশের যা হাল, মিস্ট্রালের ভবিষ্যত কী হবে কেউ জানে না! জোট বেঁধে যদি সেকেন্ড রাউন্ডে ন্যাশনাল র্যালিকে আটকানো যায়, তাহলে অ্যাডভান্টেজ থাকবে এন এফ পি মানে লেফট অ্যালাইন্ড পার্টিরই। তারা আবার বলেই রেখেছে, ক্ষমতায় এলে টেক কোম্পানিদের বিশেষ কোনও ছাড় দেওয়া হবে না, সবাইকে হেভি ট্যাক্স দিতে হবে। এই সোশ্যালিস্টদের নিয়ে এই জ্বালা! রিসার্চ এর জন্য বরাদ্দ টাকা যদি ট্যাক্সে যায়, ওপেন এ আই এর সঙ্গে কম্পিটিশন দূর, কোম্পানি চালানো মুশকিল হয়ে যাবে।
ওদিকে যদি ন্যাশনাল র্যালি যেতে, তাহলেও সাড়ে সর্বনাশ! মিস্ট্রাল যারা ডেভেলপ করেছে (বা অন্যান্য টেক কোম্পানিতে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন) তারা সবাই বেশিরভাগ ম্যাকরনের 'ফ্রেঞ্চ টেক ভিসা' প্রোগ্রামের মারফত ফ্রান্সে এসেছে, বাদবাকি ইন্ডিয়ান(সে আর নতুন কি) পকিস্তানি, আরব, ফিলিপিনো ইত্যাদি। কন্সাল্টান্টরাও ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ব্রাজিল থেকে অনলাইনে কাজ করে। এদিকে ন্যাশনাল র্যালি হুমকি দিয়ে রেখেছে, নতুন কাউকে আসতে দেবে না, সবাইকে উল্টে তাড়িয়ে ছাড়বে। কোর ইঞ্জিনিয়াররাই ভ্যানিশ হলে মিস্ট্রালের এ আই বানাবে কে, রাইট উইং নেতারা? এদিকে কুমির অন্যদিকে ডায়নাসোর। যে বাঁচাতে পারত, সেই ম্যাকরনবাবু নিজেকেই বাঁচাতে ব্যস্ত! তাই মিস্ট্রাল নাকি ভাবছে, হ্যাকারদের সাহায্য নিয়ে ন্যাশনাল র্যালির পাশাপাশি এন এফ পি-এর এর রাজনীতিক খেলাও সাবোতাজ করবে।
খেলা দারুণ জমে গেছে! এইবার দেখা যাক, রবিবার ম্যাচের ফলাফল কী হয়!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন