আমার প্রিয় বইয়ের অন্যতম হল পর্তুগিজ কবি ও লেখক ফের্নান্দো পেসোয়ার লেখা বই 'দ্য বুক অফ ডিসকোয়াইট'। তথ্যশূন্য এই আত্মজৈবনিক লেখাটা পেসোয়া প্রায় সারাজীবন ধরে লিখেছেন। প্রতিদিন রাতে এসে লিখতেন কয়েক পাতা। অস্পষ্ট রোজনামচা, খামখেয়াল অথবা দর্শন, চিন্তাভাবনা, আশাআকাঙ্খা, নিরাপত্তাহীনতা, বিষাদ... জড়মড় করে মিশে গেছে একে অপরের সঙ্গে। পেসোয়ার মৃত্যুর আশি বছরেরও পরে বইটা প্রকাশিত হয় এবং কয়েক বছরের অন্তরালে বিশ্বসাহিত্যে বরাবরের মত জায়গা করে নেয়।
'আত্মহত্যার সম্পূর্ণ বিবরণী' ইতিহাসে জায়গা করতে পারবে কি না আমার জানা নেই। হয়ত কয়েকজন আগ্রহী পাঠক বছর তিরিশ পর খুঁজে খুঁজে পড়বে বইটা, আবার হয়ত বছর দুয়েক পরেই আউট অফ প্রিন্টও হয়ে যেতে পারে। সব পাঠকের এই লেখা পছন্দ হবে কি না বলতে পারছি না, কিন্তু যদি কোন উত্সাহী পাঠক আকস্মিক ভাবে পাতাগুলো উল্টে যায়, বইটা তাকে সম্পূর্ণ ভাবে গ্রাস করবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রজ্ঞাদীপা হালদারের সঙ্গে আমার আলাপ নেই। বছর তিনেক আগে তার ফেসবুক প্রোফাইলের সন্ধান পেয়েছিলাম কিভাবে যেন! কয়েকটা লেখা পড়ে অসম্ভব ভাল লেগেছিল। কাজেই অনেকের মত তার কিবোর্ডকেও ফলো করেছিলাম। আজ সোশ্যাল মিডিয়া ফেক নিউজ, প্রপোগান্ডা, ভার্চুয়াল যুদ্ধ, ট্রলিং আর বিপ্লবের জায়গা হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ স্ক্রল করলেই শরীর খারাপ করে। তাও পালাতে পারি না, তার একটা কারণ প্রজ্ঞাদীপার মত কিছু কলম। এর আগেও একটা বই লিখেছিলেন মনে হয়, সংগ্রহ করতে পারিনি। ভাগ্য ভাল, এই বইটা শেষমেস হাতে পেয়েছি।
আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয়, কিন্তু লেখিকার প্রতিভাকে 'ঈশ্বরপ্রদত্ত' ছাড়া আর কি বলব মাথায় আসছে না। একটাই কথা, সবাই পারে না। সম্ভব নয়।
মন আর আঙ্গুলের মাঝে দূরত্ব অনেকখানি। যেটা অনুভব করি, সেটা প্রকাশ করতে গেলে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ভাষার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম! এই বইয়ের লেখাগুলো হৃদয় থেকে সরাসরি চুঁইয়ে পড়েছে বইয়ের পাতায়। কোন রকম ফিল্টারের তোয়াক্কা করেননি লেখিকা। কোনটা সাহিত্য আর কোনটা নয়, কোনটা ঠিক স্ট্রাকচার কোনটা নয়, পাঠক কি পড়বে কি নয় .. সেই সব চিন্তা তাঁর কোনদিনই ছিল বলে আমার মনে হয় না। ফলে বইটা নিখাদ সোনা (অথবা কাদার তাল, পাঠক যেভাবে নিতে চায়) হয়ে উঠেছে।
গত দুদিনে জ্বরের মধ্যে আমি পুরো বইটা একটানা পড়ে শেষ করলাম। হয়ত জ্বরের ঘোর ছিল বলেই, নাহলে এই বইয়ের গভীরতা আত্মসাৎ করা সম্ভব ছিল না। আবার এও বলা চলে বইটা আপাতসরল, কারণ ভাবনার সাবলীলতা কোন কিছুই জটিল হতে দেয় না। বইটা বিভক্ত করা হয়েছে ছয়টি ঋতুতে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। প্রতিটা ঋতুর সঙ্গে বদলে যাওয়া জীবন ও ভাবনার প্রকাশ। অতীতের নস্টালজিয়া আর স্মৃতিচারণ যেমন ঘুরে ঘুরে এসেছে, তেমনই এসেছে বিষাদ। আত্মহত্যার প্রয়োজনীয়তা। সিলভিয়া প্লাথ। জীবনানন্দ দাস। আর্নেস্ট হেমিঙওয়ে। অচ্যুত মণ্ডল। সমাজতত্ব নেই, দার্শনিকদের বিজ্ঞ প্রজ্ঞাপন নেই, মনোবিজ্ঞানের কককচি নেই, আছে বিলীয়মান জীবনের অবচুয়ারি। মানুষের জীবন, মফস্বলের জীবন। স্মৃতি আছে, মনখারাপ আছে, কবিতা আছে। আর আছে বিষাদ। স্বতফুর্ত সেই অনুপ্রবেশ।
পড়তে পড়তে আচমকা এক একটা জায়গা চলে আসে, যেখানে থেমে যেতে হয়। বার বার করে পড়ি।
যেমন বর্ষার এই জায়গাটা...
"ভেবে দেখ এমন প্রকল্প কত সহজ ছিল যেখানে তোমায় ভালোবাসা জানাতে রোজ লিখে ফেলব দু'হাজার শব্দ। মায়ের সঙ্গে আহ্লাদ, মাত্র আড়াইশো। বাবার স্নেহছায়ার জন্যে কৃতজ্ঞতায় শ পাঁচেক। এবং ঘৃণা জানাতে পাতার পর পাতা সাদা রাখাই অভিপ্রেত বোধ হয়। তাই পার্বতী বাউল গেয়ে ফ্যালেন উতর যাবি,সতর হবি, বলবি আমি যাই দখিনে। কিংবা হরিণা হরিণীর নিলয় না জানে। না জানা এই গৃহের সন্ধানে ঘুরেছি কত। বছর ঘুরে যায়, পছন্দের পায়রাখোপের সন্ধানে। আচ্ছা ধর যদি মাসগুলোকে এমন করে চেনা যায়, জুলাই- আগস্ট চিঠির মাস, সারা সকাল জুড়ে উঠোন ভরে চিঠির বৃষ্টি ঝরে। সেপ্টেম্বর - অক্টোবর উপেক্ষার মাস। তোমার চুলে বিশীর্ণ পাতারা অনুরোধের মত লেগে থাকে, তুমি রেলিংয়ে আংটি বাজিয়ে গাও 'পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোলে'। নভেম্বর - ডিসেম্বর- জানুয়ারি লাজলজ্জাহীন স্মৃতিমন্থন। ফেব্রুয়ারির দিন যেই উইড়্যা গেছে শুয়াপঙখী, আর পইড়্যা আছে মায়া। মার্চ- এপ্রিল-এর ক্যালেন্ডার জুড়ে ঋতুস্রাবের মতো লাল সব দিন, ছুটি ছুটি ছুটি, ভালরাক্ষস,চল পাহাড় বেরিয়ে আসি। মে-জুন কেবল বিশ্বাসঘাতকতা আর গৃহত্যাগের মাস মনে রেখো। ভাল লাগে না, বুঝেছ?"
ন্যারটিভের অভাবনীয় উপস্থাপনা আর স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া পরিচিত দৃশ্যের অসাধারণ বর্ণনা বার বার পাঠককে নিজের জীবনে উঁকি দিতে বাধ্য করে। গালিব আর অরণি বসুর কবিতার পাশাপাশি শৈশবের নানা চরিত্র আর ঘটনা এসে আদর করে দিয়ে যায়। দুপুর রোদ্দুরে বাড়িতে চলে আসা বাসনওয়ালিরা, একটা ছাদের মধ্যেই থাকা একাধিক ছোট ছোট ছাদ আর সেখানে কঞ্চির মাথায় জ্বালানো তারাবাজি, আকাশপ্রদীপ, কাচের আলমারিতে লুকিয়ে রাখা দিদিভাইয়ের খেলনা, স্মৃতির সুতো জড়ানো রেকাবি আর থালা যাতে খাবার না দিলে আমাদের অনেকেরই মাথা গরম হয়ে যেত। আশ্চর্য কিছু মিল! কিছু শাশ্বত সংস্কৃতি আর বিশ্বাসের অভ্যেস যা সময় পেরিয়ে গেলে অবান্তর মনে হয়, কিন্তু অধুনালুপ্ত সেই দৃশ্যকল্পগুলো ফিরে পাওয়ার আশায় ব্যাকুল হয়ে থাকি আজও। স্বীকার করি না।
এক জায়গায় লেখা--
"নতুন বছরের প্রথমদিন আমার কাছে কোন দ্যোতনা নিয়ে আসে না। আজ পয়লা বৈশাখ। আমি বলি একলা বৈশাখ। বৈশাখ একদিন একলা, আর আমি রোজ। সুতরাং ভাল থাক, ভাল আছি এইসব আমার আদ্যন্ত ভন্ডামি লাগে। উত্সবকে আমি চিনেছি তার নিঃশব্দ ব্যথাময়তায়। কোনও কিছু আয়ত্তে না রাখতে পারার অসহায়তায়। তবু অনেক বছর পর ভীষণ ভাল লাগছিল বলে আমি আজ ডিমের কুসুম রঙের শাড়ি পরেছিলাম। ঘর গুছিয়ে তুলতে গিয়ে আমার আকাশ -পাতাল আঁধার করা ঘুম পেতে থাকে। বচ্ছরকার দিনে আমি বসি বিছানায় আদুরে বেড়ালের মত গড়াই। বাইরের আমগাছে জোড়া শালিখ ভুরু কুঁচকে ভাবতে থাকে আমি বিষাদে না আনন্দে।"
এই বইয়ের আরো একটি পাওয়া হল পাতায় পাতায় করা অসাধারণ অলঙ্করণ। বাবলি পালের এই আঁকাগুলো লেখাগুলোকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। ছাদের তারে মেলা চাদর আর টব থেকে ঝুলে থাকা মানিপ্ল্যান্ট-এর ছবি অজান্তেই আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যায় মফস্বলের পুরোনো বাড়ি অথবা ঝড়ের বিকেলে।
কিছু কিছু লেখার পাঠ প্রতিক্রিয়া হয় না। হওয়া সম্ভবও নয়। তাও যদি এটা পড়ে কেউ ঝুঁকি নিয়ে বইটা পড়তে চান, তাই লিখলাম।
আত্মহত্যার সম্পূর্ণ বিবরণী
প্রজ্ঞাদীপা হালদার
লিরিকাল বুকস
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন