রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০

চরাচর ভুলিয়ে দেওয়া বইয়ের সন্ধান


"এই বইটা আমার অসাধারণ লাগল।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?

মানে?

মানে, বইটা তো পছন্দ নাও হতে পারত।

কিন্তু বইটা ভাল বলেই তো আমার পছন্দ হয়েছে।

কিন্তু, পছন্দের তো রকমফের আছে। আমার যদি পছন্দটা অন্যরকম হত, তাহলে কি বইটা ভাল লাগত?

সেক্ষেত্রে বইটাও তো অন্যরকম হতে পারত।

কিন্তু বইটা তো এরকমই। আমার পছন্দও অন্যরকম নয়।

কিন্তু, আমি কি নিশ্চিত সেটাই সত্যি?"

এই কথোপকথনটি যদি আপনার ইন্টারেস্টিং মনে না হয়, ' সদানন্দনের পথ ও অন্যান্য ' বইটি আপনার কেমন লাগবে, সেটা আমি বলতে পারছি না। ব্যাক্তিগত ভাবে বলতে পারি, বইটা আমাকে প্রথমে বেদম আছাড় দিল, তারপর কুচি কুচি করে কাটল, শেষে গরম তেলে ভাজল। তেল থেকে আমাকে তোলার পর দেখলাম, আসলে কিছুই হয়নি।

' সদানন্দনের পথ ও অন্যান্য ' কয়েকটি ছোট গল্পের সঙ্কলন। গল্পগুলো আসলে কি ধারার সেটা নিয়ে আমার সংশয় আছে। কয়েক জায়গায় দেখলাম লেখাগুলোকে কল্পবিজ্ঞান তকমা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু শেষের গল্পটি বাদে কোন গল্পকেই আমি প্রচলিত কল্পবিজ্ঞানের আঙ্গিকে ভাবতে অক্ষম রইলাম।

তাহলে গল্পগুলো কি নিয়ে?

এককথায় বলতে গেলে গল্পগুলো হল, যাকে বলে - ইন্ট্রশপেক্সন অফ হিউম্যান রেস ইন স্পেসটাইম কন্টিনিউয়াম' অথবা অস্তিত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে লেখা। একটা ক্ষুদ্র ঘটনা কীভাবে মানব জীবনের উর্ধ্বে গিয়ে জড়িয়ে থাকে সৃষ্টির নিয়মে, সেই প্রশ্ন, দ্বন্দ, শঙ্কা আর অনুসন্ধান নিয়েই বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় প্রত্যেকটি গল্প এঁকেছেন।

এঁকেছেন বলাই শ্রেয়, কারণ এধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে লিখলে কোনভাবেই পাঠকের অনুভূতিটা সাধারণত এরকম হয় না। আগে এধরনের বহু লেখা পড়তে গিয়ে লেখার জটিলতা, তত্ত্বের কচকচিতে নাজেহাল হয়েছি। আমারই দোষ, তাতে সন্দেহ নেই। আত্মদর্শন উপলব্ধি করতে গিয়ে যদি আমি বাংলা গল্পের ফ্লো নিয়ে বসে থাকি তাহলে কি জ্ঞান চক্ষু উন্মোচিত হয়? কিন্তু এই ম্যাচে রেফারি অন্য। খেলার নিয়মটাই আমূল পাল্টে দিয়েছেন বিশ্বদেববাবু। আর এটাই এই বইয়ের তুরুপের তাস।

প্রতিটা গল্প শুরু হয় সোজাসাপ্টা একটা প্লট দিয়ে। গ্রাম, শহর, মফঃস্বল, বন, জঙ্গল, পাহাড়। রক্তমাংসের চরিত্র। আটপৌরে সুঃখ-দুঃখ, দাম্পত্যের টানাপড়নে, অশ্রু, দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, পাগলামি নিয়ে চলতে থাকা যাপনের গল্প। আমাদের চেনাশোনা জগতের বাইরের কিছু উদ্ভট চরিত্র যে নেই তা নয়, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড ও নিতান্ত স্বাভাবিক। এরকম চরিত্র বাংলা কিশোর উপন্যাসে আমরা আকছার দেখে থাকি। খানিকটা এগোতেই গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং হয়ে পড়ে আর আপনি তুমুল আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন এবার কি হবে? বিলকুল রহস্য অথবা অলৌকিক গল্পের প্লট!  সাবলীল ভাষায় দুর্দান্ত গতিতে গল্পটা এগোচ্ছে, হঠাৎ দু প্যারার মধ্যে প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে গল্প আপনাকে উল্টে ফেলে দিল। সামলে সুমলে উঠে বসেছেন, এমন সময় গল্পের রকেটের জানলা দিয়ে বাইরে দেখে আপনি পুরো ভ্যাবাচ্যকা খেয়ে গেলেন। কোথায় গ্রাম? মফস্বল? বন জঙ্গল? কোথায় পৃথিবী? ব্রহ্মাণ্ডের জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে এগিয়ে চলেছেন পাঠক। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত্ সব একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন। রেগেমেগে চালককে জিজ্ঞেস করলেন, 'এটা কি হল? কোথায় আনলেন?' চালক হেসে বললেন, 'কোথায় আবার? যেখানে ছিলেন সেখানেই আছেন।' আপনি চেঁচিয়ে উঠলেন, 'আরে, বন জঙ্গল, পুকুর ডোবা, আমাদের বাড়ি, গেল কোথায়। এতো অনন্ত শূন্য!' জবাব এল 'অন্তত শূন্যই আমাদের বাড়ি, আবার বাড়িটাই অনন্ত শূন্য।'

এই হল এই বইয়ের ম্যাজিক। এর চেয়ে বেশী বোঝাবার কোন উপায় নেই, নিজে না পড়লে কেউ বুঝতে পারবেও না।

এরকম বইয়ের প্রতিক্রিয়া জানানোও চাপ, শুধু নিজের জন্যেই এটা লিখে রাখলাম। এমন একটা অসাধারণ কাজে ইচ্ছে করলেই ম্যাজিক রিয়ালিজম, সুরিয়ালিজম নানা তকমা দিয়ে দেওয়া যায়, আলোচনা চলতেই থাকে। অথচ বইটা খুবই কাজ চালানোর মত করে প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে হল। দেদার বানান ভুল। পেপারব্যাক এডিশনের তাৎপর্য ও আমি বুঝতে পারলাম না।

যারা এই লেখাটা পড়বেন, তাদের অনুরোধ করলাম, বইটা প্লিজ কিনে পড়ুন। সাধারণত এরকম বলি না। কিন্তু ব্যতিক্রম হলেই খুশী হই সবচেয়ে বেশি।

সদানন্দনের পথ ও অন্যান্য
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়
ধ্যানবিন্দু

1 টি মন্তব্য: