বইয়ের ভূমিকাতেই লেখক জানিয়েছেন, আনকোরা ও অশ্রুতপূর্ব বই কিনে পড়ার আগে তাঁর বাবা তাকে ভূমিকাটা পড়ে নিতে বলতেন। 'অপচ্ছায়া' বইটার ভূমিকা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। সব্যসাচী সেনগুপ্তের লেখা অন্যান্য জনপ্রিয় বইগুলোও আগে পড়িনি। কিন্তু ভূতের বই বলেই কিনা কে জানে, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মোটেও ভুল করেনি।
গত কয়েক বছরের মধ্যে ভৌতিক ঘরানার যত বই পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে, নিঃসন্দেহে বলতে পারি, 'অপচ্ছায়া' তাদের মধ্যে সেরা। কিন্তু একটা ডিসক্লেইমার আগে থেকেই দিয়ে রাখলাম, দাঁত কপাটি লাগা ভূতের গল্প পড়ার ইচ্ছে হলে এড়িয়ে যেতে পারেন। এই বইয়ের লেখায় ভয় দেখানো ভূতের দেখা প্রায় মিলবে না বললেই চলে। তন্ত্র নেই, বৌদ্ধ অপদেবতা নেই, রহস্যময় পুঁথি নেই, গ্রাফিক হরর নেই, নিদেনপক্ষে একটা আস্ত প্রেতাত্মাও ভাল করে দেখা দেয় না।
তাহলে আছে কি?
হুমম! সেটা বোঝানো মুশকিল। লেখক বইটা দুইভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে নিরেট ফিকশন গল্প, দ্বিতীয় ভাগে ইন্দ্রিয়তীত অভিজ্ঞতার বর্ণনা। অস্পষ্ট, আবছা অনুভূতির কাহিনী। কিন্তু যেই জিনিসটা এই বইয়ের সম্পদ, সেটা হল- হিন্দিতে যাকে বলে 'মাহৌল'। সেটিং অথবা মেজাজ বলাই যায়, কিন্তু মাহৌল কথাটা এই বইয়ের ক্ষেত্রে একবারে খাপে খাপ।
সমস্ত বই জুড়ে অনবদ্য এই মাহৌল তৈরী করেছেন লেখক। ন্যারেটিভের সাবলীল গতিময়তা আর দুর্দান্ত ডিটেইলিং একদম ঘাড় ধরে বসিয়ে রাখে পাঠককে। একবারের জন্যেও মন উচাটন হয় না। ভাষার বাঁধুনি এমনই পোক্ত, টক-ঝাল-মিষ্টি এতটাই পরিমাণ মতন যে ভূতের গল্পে ভূত না এলেও পাঠক উশখুশ করে না। ভূতের কথা ভুলে ততক্ষণে সে মজে গিয়েছে গল্পের পাতায়। হয়ত ডাক্তারি ছাত্রদের হোস্টেল, অথবা মফস্বলের রোজনামচা, কিংবা শৈশবের কোন স্মৃতি। আমাদের অবচেতনে থাকা খুঁটিনাটি কথা, যেগুলো বড্ড আপন হলেও কলমে ধরা যায় না, সেই অনুপ্রাসকে এত সহজে তুলে ধরতে আমি খুব বেশী লেখককে দেখিনি। এই মায়াজাল এমন বিস্তার হয়েছে সমস্ত বই জুড়ে, যে লেখাগুলো ভৌতিক না রম্যরচনা, স্মৃতিচারণ না কলাম, সেইসব ভাববার আগেই আপনি তরতর করে গল্পের শেষে পৌঁছে যাবেন আর ওভারের শেষ ইয়র্কর বলে ক্লিন বোল্ড হবেন। একটু গাটা যে শিরশির করবে না, সেটা বলতে পারছি না। (আমার বেশ ভয় ভয় লাগল বাবা।)
সব গল্পই যে দশে দশ তা অবশ্য নয়। 'আপাত ফিকশন' বিভাগের পাঁচটি গল্প অনুভূতির নানা তারে বাঁধা। কিন্তু কলমের দক্ষতায় রসস্বাদনে ছেদ পড়ে না। 'নিছক গল্প নয়' বিভাগের রচনাগুলো আরো তীক্ষ্ণ, তাতে অবশ্য সন্দেহ নেই। (তার একটা কারণ, প্রতিটা গল্পই একাধারে ব্যক্তিগত এবং কোন না কোন ভাবে লেখকের স্মৃতির অনেকটা দখল করে রয়েছে।)
বইটার আরো একটি বিশেষত্ব হল লেখকের রেঞ্জ। বইয়ের প্রথম গল্প খাঁটি সাধু ভাষায় লেখা, কিন্তু বইয়ের শেষ লেখায় যেতে যেতে সমস্ত আর্কটা ধরা পড়বে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলাম।
১ --
"দুর্ভাবনায় ভ্রূকুঞ্চন ক্রমশ গভীরতর হইতেছিল শিবশঙ্করের। তাবিজ কবচ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ চলিতেছিল মহামায়াপুরের জমিদারবাড়িতে। পালকি ছড়িয়া কাশীদেশের জ্যোতিষার্ণব, পদব্রজে, কামাখ্যাপীঠের তন্ত্রসিদ্ধ অথবা হিমালয়বাসী হঠযোগীর সশব্দ আগমন এক্ষণে এ স্থানের নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য। আজিকে এই রক্তাম্বর সন্যাসীর আগমন তাই এই আটচালাটিতে ঔৎসুক্যের পরিবর্তে বক্রোক্তিই অনিয়াছিল অধিক।"
২-
"মিনিট পাঁচেক বাদেই, ঠ্য়াকাস ঠ্য়াকাস শব্দে রুটির থালা, তড়কার প্লেট আর ন্যাতানো পেঁয়াজের বাটি নামিয়ে দিয়ে চলে যেত কর্মচারী। ঠকাঙ ঠোক্করে নামাত টাল খাওয়া এনামেলের খালি গেলাস। পড়পড়িয়ে জল ঢেলে দিয়ে যেত আকাশী রঙের জাগ থেকে। আর আমি পাঁচ আঙুলে রুটি ছিঁড়ে, তড়কায় মাখিয়ে, মুখে ঢুকিয়েই তড়িঘড়ি মচৎ কামড়াতাম পেঁয়াজ। ধাবার পেঁয়াজে কখনও কচাৎ শব্দ হয় না। এখানে পেঁয়াজ, হরবখত্ এট্টু এট্টু মিয়ানো।"
ক্লিশে রোমাঞ্চ আর শিহরণের ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি অন্যরকম ভূতের গল্প পড়বেন খোঁজাখুঁজি করছেন, এই বইটা পড়ে দেখতে পারেন। মনে হয়, ঠকবেন না।
অপচ্ছায়া
লেখক - সব্যসাচী সেনগুপ্ত
প্রকাশক - সৃষ্টিসুখ
মূল্য - ১৭৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন