সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত জয়া চৌধুরীর লেখা 'ম্যাজিক রিয়ালিজমের গল্প' অবশ্যই একটা আলোচনা দাবী করে। নিজে পড়ার সময় ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে হয়েছে, সেটাই সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। খুব সংক্ষেপে অবশ্য বলা যাবে না, কারণ আশি পাতার এই বইতে লেখিকা ল্যাটিন বুম যুগের তাবড় তাবড় সাহিত্যিকদের গল্পগুলো অনুবাদ করেছেন। মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, স্পেন, বলিভিয়া ইত্যাদি নানা দেশের লেখক লেখিকাদের কলমকে বুঝতে গেলে আশি পাতার একটি বই কিছুই নয় বিশেষ করে সূচীতে যখন খুয়ান রুলফো, ইসাবেলে আইয়েন্দে আর খুলিও কোরতাসারের মতন নাম মজুদ আছে। তাছাড়া নবীন যুগের দুই লেখকের কাহিনীও আছে এখানে। এদের অনেকেই পৃথিবী বিখ্যাত, বাস্তববাদ থেকে পরাবাস্তববাদ, সুরিয়ালিজম থেকে সাইন্স ফিকশন, সব ধারাতেই অবাধে বিচরণ করেন। এইবার আমি বইটার ভাল মন্দ ধাপে ধাপে বলার চেষ্টা করছি।
প্রথমত এরকম একটা অসাধারণ কাজের জন্যে প্রকাশক ও লেখিকাকে ধন্যবাদ। হিসপ্যানিক জগতের সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ, খুব পরিচিত না হলে বইয়ের বাংলা অনুবাদও হয় না। ফলে সাধারণ পাঠক মার্কেস আর অন্য দু একজনের লেখা পড়েই থেমে যান। ল্যাটিন বুম যুগ অর্থাৎ ৬০ এবং ৭০ এর দশকে যে সাহিত্যিক বিপ্লব হয়েছিল স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্যে, সেই নিয়ে আমরা খুব একটা বেশি জানি না। কার্লোস ফুয়েনতেস থেকে হোসে দনোসো, মার্কেস, মারিও লোসা সকলেই এই সময়ে পরিচিত হয়েছেন জগতের কাছে। ম্যাজিকল রিয়ালিজম নিয়ে এই সময়ে বেশিরভাগ সাহিত্যিক চর্চা করেছেন, সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে তুলে ধরেছেন গল্পের মাধ্যমে। সমস্যা হল যে যদি লেখক এবং লেখার সঙ্গে পরিচিতি না থাকে, তাহলে এই রেফারেন্সগুলো ধরা প্রায় অসম্ভব। ফলে গল্পে ম্যাজিক রিয়ালিজম কোথায়, বাক্যচয়ন আর প্রেক্ষাপটের অন্তরে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা বোঝা দুষ্কর। আমি কয়েকটা গল্পের উদাহরণ দিচ্ছি, তাহলে হয়ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
যেমন আমপারো দাভিইয়ার লেখা গল্প El Huisped বা অতিথি। সাড়ে তিন পাতার এই গল্পে এক অতিথিকে নিয়ে হাজির করে বাড়ির কর্তা। তার স্ত্রী প্রথম থেকেই এই প্রাণীটিকে পছন্দ করছেন না, বরং ভয়ে ভয়ে আছেন। কিন্তু তার ভয়কে পাত্তা দেয়না বাড়ির কর্তা। প্রথম থেকে শেষ অব্দি বোঝা যায় না অতিথি কে? কুকুর না বেড়াল না প্যাঁচা? এক সময়ে বহু কষ্টে প্রাণীটির আতঙ্ক থেকে মুক্ত হয় বাড়ির বাড়ির লোকজন।
ঘটনাটা বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেকেই ভাববে সেটা একেবারেই একটা ভয়ের কাহিনী, কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মেক্সিকান লেখিকা আমপারো দাভিইয়া আতঙ্ক, সাসপেন্স আর মৃত্যুর আবহাওয়া সৃজন করেন প্রতি গল্পে কিন্তু প্রতিটা চরিত্র আসলে রূপক অথবা মেটাফরিকাল। এই গল্পের আঙ্গিকে তিনি আঘাত করেন প্রাচীনপন্থী পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে, যেখানে নারীদের শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক ভাবেও নির্যাতন করা হয়। অতিথি গল্পের প্যাঁচা অথবা কুকুর ( যাই হোক না কেন?) সে আসলে মেয়েটির স্বামীরই এক্সটেন্ডেড ভার্সন অথবা প্রতিরূপ। এমন ভাবেও ইন্টারপ্রেট করা যায় যে সমস্ত গল্পটা পুরুষ ও নারী সমাজের কনফ্লিক্ট নিয়ে, যেখানে জড়িয়ে আছে ভয়, দুঃখ, স্বাধীনতাবোধ ও রাগের নানা চিহ্ন। কিন্তু কিছুই যখন ঠিক করে লেখা নেই, তাহলে এই রহস্য সমাধান পাঠকের কাছে হবে কি করে? লেখিকা সেই সূত্রগুলো ছড়িয়ে রেখেছেন বিশেষ বিশেষ বাক্যের আড়ালে। এক একটা বাক্য আসলে ইঙ্গিত করে গল্পের ঊর্ধ্বে বলতে চাওয়া সত্যিটাকে। সেই কারণেই এখানে প্রতি লেখক অথবা লেখিকার নিজস্ব স্টাইল খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে অনুবাদ করা হয়ে ওঠে আরো কঠিন। যদি গল্পটা আত্মসাৎ করতে অথবা বাক্যের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সূত্রের অবস্থান, গুরুত্ব আর প্রয়োজন না বোঝা যায়, অনুবাদ হলে নবীন পাঠক খুব সম্ভবত কিছুই বুঝতে পারবেন না।
হয়ত অনেকে ভাবছে এত ঝামেলার দরকার আছে কি? নিজের মত ইন্টারপ্রেট করে নিতে হবে যখন, সেটা যে যার নিজের মত করলেই চলে! উহুঁ! সেটা খুব কাজের হবে বলে মনে হয় না। কারণ ভঙ্গিমা ও বাক্যের আঙ্গিকে আড়াল করা দর্শনগুলো প্রত্যেকটি লেখকের একেবারে নিজস্ব। জীবন, সমাজ, মৃত্যু, রাষ্ট্র, ধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয় সম্পর্কে প্রতিটা লেখকের নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে, তার অনেকটাই এসেছে তাদের নিজস্ব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। যেমন ইসাবেলে আইয়েন্দেকে চিলি থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হয় ভেনেজুয়েলায়। জীবনের অনেকটা সময় তাকে প্রাণের ভয় নিয়ে কাটাতে হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার কারণে। আজকাল তিনি মার্কিন মুলুকে থাকেন। এই অভিজ্ঞতা তার লেখায় প্রতিফলিত হয়। 'বিকৃত মেয়েছেলে' গল্পটিতেও তার একটি ব্যাখা মেলে।ইসাবেলে বিশ্বাস করেন জীবনে কিছুই আগে থেকে বলা চলে না। কোন অভিজ্ঞতার তাত্ক্ষণিক প্রভাব যা হয়, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা হয়ত সেটা বদলে দিতে পারে। একটি দুঃসহ অভিজ্ঞতা ভুলিয়ে কেউ হাসিখুশি জীবনযাপন করতে পারে, আবার ক্ষুদ্র কোন ঘটনা একজন মানুষকে সারজীবনের মত পাপবোধে দগ্ধ করতে পারে। একই ভাবে খুয়ান রুলফোর লেখা যে পড়েনি, তার জীবন সম্পর্কে না জানলে 'লগনচাঁদা' গল্পের অর্থ করা তার কাছে প্রায় অসম্ভব। মেক্সিকোয় থাকার সময়ে ক্রিস্টেরো রেবেলিয়নে তার বাড়ির লোকজনকে প্রচন্ড ভাবে ভুগতে হয়েছে। মেক্সিকান রেভলিউশন আর ক্যাথলিক পাদ্রীদের বাড়াবাড়ি নিয়মকানুনের ওপর তার রাগ ধরে গিয়েছিল প্রথম থেকেই। সেই নিয়েই স্যাটায়ার লিখেছেন ম্যাজিক রিয়ালিজমের মাধ্যমে। অপরাধবোধ আর জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্তে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ নিয়ে রহস্যচ্ছলে মজা আর কটুক্তি করে গেছেন।
প্রতিটা গল্প নিয়ে পৃথক ভাবে লেখা সম্ভব নয়। কথা হল বইটা কি তার উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে?
হ্যাঁ এবং না।
হ্যাঁ, কারণ এই লেখাগুলো তুলে আনা দরকার ছিল। প্রতিটা লেখাই অসম্ভব গভীর যদি সেই গভীরতার আন্দাজ পাওয়া যায়। সত্যি বলতে তিনটে লেখা আমার আগেই পড়া ছিল, বাকি প্রত্যেকটা আমায় ইংরেজিতে পড়তে হয়েছে বাংলাটা পড়ার পর। লেখিকা জটিল লেখাগুলিকে তুলে ধরতে ভয় পাননি মোটেই। বইয়ের শেষে তিনি একটা লেখক পরিচিতিও দিয়েছেন প্রতিটা লেখকের, ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে ভূমিকাতেও লিখেছেন বেশ খানিকটা। কিন্তু তাও অভাববোধ করলাম বেশ কয়েকটা বিষয়ে।
প্রথমত, অনুবাদ। কয়েকটা জায়গা ছাড়া কোন গল্প পড়েই মনে হয় না বাংলা গল্প পড়ছি। মনে হয় স্প্যানিশ গল্পের অনুবাদ পড়ছি আর সেটা পড়তে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছে। বাংলার পাঠকদের কথা ভেবে যদি লেখিকা বাংলা গল্পের মত করে লিখতেন তাহলে খুবই ভাল লাগত। আমরা আজকাল দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য আর ঋজু গাঙ্গুলীর অসাধারণ অনুবাদ পড়ে স্বভাব খারাপ করে ফেলেছি, অনুবাদের এই ঠোক্কর খাওয়া আমাদের খুবই অসহজ করবে। আমি কোন উদাহরণ দেব না, সেটা উচিৎও নয়। কিন্তু আমার মনে হয়েছে লেখিকা স্প্যানিশ ভাষা থেকে সরাসরি 'লিটারল ট্রানলেশন' করেছেন। সেটা ভাষার দিক থেকে একদম ঠিকঠাক হয়েছে ,কিন্তু বাংলা ভাষার পাঠকের জন্যে উপযুক্ত হয়নি। স্প্যানিশ ভাষার খানিকটা চর্চা করেছি বছর দুয়েক আগে, এটাও আমার মাথায় আছে যে এই গল্পগুলো অনুবাদ করা আসলে প্রচন্ড কঠিন। সাধারণ একটা গল্পের চেয়ে বেশিমাত্রায় জটিল তো বটেই, কিন্তু সেই চ্যালেন্জটা নিয়ে আরো সাবলীল ভাবে বাংলায় লেখাগুলো অনুবাদ করলে বইটা অন্য মাত্রা পেত। (আবার এও হতে পারে লেখিকা এরকম ভাবেই লেখাগুলো অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন, যাতে স্প্যানিশ ফ্লেভার রয়ে যায়। সেটা আমি বলতে পারব না।)
দ্বিতীয়ত, প্রতিটা লেখার একটা সংক্ষেপে এনালিসিস অবশ্যই দরকার ছিল। ম্যাজিক রিয়ালিজমের গল্প যখন, সেটা গল্পে কি করে এসেছে সেটা পাঠকের বোঝা জরুরী। আমাদের মত সাধারণ পাঠক যারা বিশ্বসাহিত্য নিয়ে খুব বেশী চর্চা করেনি, তাদের অন্তত সুবিধে হত। বাকি সব কিছুই ভাল। আশি পাতার বইটি যদি পাঠকদের এই লেখকদের অন্য লেখা পড়তে উত্সাহিত করে তাহলেই বইটার উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে।
প্রকাশক : সৃষ্টিসুখ
মূল্য : ১৩৫ টাকা