Diego Velázquez's Equestrian Portrait of the Count-Duke of Olivares
ঝকঝকে সকাল। এখনও রোদের তেজ বাড়েনি, মিঠে বাতাস বইছে। ট্যুরের আগে আমরা হস্টেল থেকে বেরিয়ে হাঁটাহাটি করছিলাম এদিক সেদিক। স্পেনে টমেটোর কাঁচা পিউরি দিয়ে টোস্ট চিবোনোর অভ্যেস আছে লোকজনের, সেই স্থানীয় জলখাবার খেতে গেলে ওয়াক উঠতে বাধ্য। সব জায়গায় এক্সপেরিমেন্ট সইবে না, প্রথম দিনেই এই জরুরি শিক্ষা হল। চুপচাপ কফি দিয়ে পাউরুটি শেষ করে হাঁটা দিলাম। ইউরোপের বেশিরভাগ শহরেই ‘টিপ বেসড ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর’-এর ব্যবস্থা আছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হল নিউ ইউরোপ স্যান্ডম্যান ট্যুর। আগে থেকেই নেটে বুক করে রেখেছিলাম। পায়ে পায়ে হাজির হয়ে দাঁড়িয়েছি প্লাজা মেওর চত্বরে। ফুটফুটে রোদে নানা দেশের লোকের আনাগোনা, দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। আমাদের সদাহাস্যমান গাইড অ্যালেক্স এসে হাজির হয়েছে আগেই। আয়ারল্যান্ডের ছেলে, বছর দুয়েক মাদ্রিদে এসে রয়েছে। ইউরোপে অনেকেই, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রী আর চাকুরিজীবীরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করতে পারে। অনেকে আবার কলেজের গ্যাপ ইয়ারে ভলান্টিয়ার করতে দূর দেশে পাড়ি দেয় অথবা নতুন অভিজ্ঞতার খোঁজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। স্কুল কলেজের গন্ডির বাইরের এই অভিজ্ঞতা জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সাহায্য করে। অ্যালেক্সও তাদের একজন। ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা আছে মাদ্রিদে। কলেজের ক্লাস আর সকার প্র্যাক্টিসের পাশাপাশি গাইডের কাজ করতে আর নতুন লোকজনের সঙ্গে মিশতে তার ভালো লাগে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ইতিহাসে ডুব দিলাম। নীরস ইতিহাসের ক্লাস নয়, আড্ডার মেজাজে বলা গল্প। সঙ্গে ‘হিউমার’-এর অনবদ্য মিশেল আছে। ওয়াকিং ট্যুরের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরাই প্রখর বুদ্ধিমান, নিজের দেশের মন্দ জিনিস চাপা দেওয়ার কোনও চেষ্টা করতে দেখিনি তাদের। পূর্বপুরুষের ভালো কাজের জন্য যেমন গর্ববোধ করে, অন্যায়ের জন্যে লজ্জা প্রকাশ করতেও দু’বার ভাবে না। কলোনিয়ালিজমের প্রসঙ্গ উঠলে কয়েকজনকে রীতিমত লজ্জিত হতে দেখেছি, অনেকে পূর্বপুরুষের দোষের জন্য সরাসরি ক্ষমা চায়। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, কিন্তু আমার অন্তত এই ব্যবহারটা মেকি বলে মনে হয়নি।
গল্পের ফাঁকে প্লাজা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি কাটলেরি স্ট্রিটের দিকে। পুরোনো গলির গোলকধাঁধা দিয়ে চলেছি রাস্তার নাম পড়তে পড়তে। কাইয়ে মেওর, কাইয়ে দে আরেনাল, কাইয়ে সান ক্রিস্টোবাল। অনেক বাড়িঘরেই আগেকার মুরিশ স্থাপত্যের ছাপ দৃশ্যমান। ক্রিশ্চানরা ক্ষমতায় আসার পর সেইসব বাড়িঘর বদলে ফেলা হয়েছে বলে মুরিশ বা ‘মুদেহার’ স্থাপত্যের পাশাপাশি বারোক অথবা স্প্যানিশ রেনেসাঁর ছাপও দেখতে পাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এসে পৌঁছালাম সোবরিনো দে বোটিন এর সামনে।
Sobrino de Botin |
পৃথিবীর প্রথম রেস্তোঁরা হিসেবে বিখ্যাত সোবরিনো দে বোটিনকে নিয়ে বেশ মজার মজার গল্প আছে। অ্যালেক্সের কাছ থেকে তেমনই একটা গল্প জানতে পারলাম। ফ্রান্স থেকে হিয়ান বোটিন বলে একজন ভদ্রলোক মাদ্রিদে এসে ১৭২৫ সালে এখানে একটা সরাইখানা খুলে বসেন, নাম দেন কাসা বোটিন। কিন্তু তখন এখানে আরো একগাদা সরাইখানা ছিল, কারণ কাছেই আছে রয়্যাল প্যালেস। ব্যবসার জন্যে নানা জায়গা থেকে নানা লোকে আসছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যে বোটিন ঠিক করলেন সরাইখানায় যাত্রীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও করা হবে। শুরু হল রান্না। রান্না শুরু হতেই টম্যাটো পাউরুটি খাওয়া পাবলিক যেন অমৃতের সন্ধান পেল। কিছুদিনের মধ্যেই কাঠের আগুনে সেঁকা পোর্ক আর মাছের উপাদেয় পদ খেতে লোকজন ফিরে ফিরে আসতে লাগল। বোটিনবাবুর মুখে হাসি আর ধরে না।
কালের নিয়মে কয়েক বছর পর কাসা বোটিনের মালিকানা উঠে এল বোটিনের ভাইপোর হাতে। ভাইপোকে স্প্যানিশে বলে সোবরিনো। সেই সুবাদে আস্তে আস্তে জায়গার নামই হয়ে গেল সোবরিনো দে বোটিন। ভাইপো চালু মাল, এসেই সে দেখল পয়সা আসছে আসলে রান্নাঘরকে কেন্দ্র করে। আস্তে আস্তে সরাইখানার জায়গা কমিয়ে বসে খাওয়ার জায়গা বাড়াতে শুরু করল সে। বছর কয়েকের মধ্যেই তাদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। আগের শতকে নানা সাহিত্যিকের আড্ডা মারার জায়গা ছিল এই রেস্তোঁরা। এমনকি রয়্যাল একাডেমি অফ আর্টস-এ সুযোগ পাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর ফ্রান্সিসকো দে গোয়া এখানে বেয়ারার কাজ করতেন। শোনা যায় এখানকার বিখ্যাত স্প্যানিশ পায়েলা(স্প্যানিশ পোলাও, সঙ্গে সবজি, মাংস, পেস্তাবাদাম, সি- ফুড যা খুশি দেওয়া যায়) খেয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লেখা ছেড়ে রাঁধুনি হওয়ার কথা ভেবেছিলেন। সে কথা বলেওছিলেন তার বন্ধু এমিলো গঞ্জালেজকে। হেমিংওয়ে রান্নাবান্নার চেষ্টা করেছিলেন কি না ঠিক জানা নেই, কিন্তু পাঠকদের অশেষ সৌভাগ্য যে তিনি শেষমেশ লেখাতেই মনোনিবেশ করেছেন।
ক্যামেরার সদ্ব্যবহার করার পর গুটিগুটি পায়ে এগোলাম সান ক্রিস্টোবাল স্কোয়ারের দিকে। এখান থেকে খানিকটা এগোলেই ক্যাথেড্রাল দে আলমুদেনা। মাদ্রিদের সবচেয়ে নামকরা গির্জা। তার পাশেই পালাসিও রিয়্যাল অর্থাৎ রয়্যাল প্যালেসের বিশাল চত্বর। ১৫৬১ সালে যখন স্প্যানিশ শাসকেরা দেশের রাজধানী তোলেদো থেকে মাদ্রিদে নিয়ে আসেন তখন কিন্তু এখানে কোনও গির্জাই ছিল না। কিন্তু গির্জা ছাড়া কি রাজধানী শোভা পায়? অতএব নির্মাণ করা হল নিও গথিক স্থাপত্যে মোড়া এই চোখ ধাঁধানো ক্যাথেড্রাল। যদিও কাজ শেষ হতে কয়েক শতাব্দী লেগে গিয়েছিল। আজ অবশ্য গির্জার দিকে তাকালে পর্যটকরা চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়।
Almudena Cathedral |
পালাসিও রিয়্যাল আর গির্জার মাঝখানের অনেকটা খোলা চত্বর রেখে দেওয়া হয়েছিল। বিবাহের সময় রাজা অথবা রানী রাজমহল থেকে বেরিয়ে এই চত্বর দিয়ে হেঁটে এসে গির্জায় প্রবেশ করতেন। সদর রাস্তার অপর প্রান্তে থাকা উঁচু পার্ক থেকে শহরের লোকজন দাঁড়িয়ে সেই উৎসব দেখতে ভিড় করত। চত্বরের পিছনে লা কাসা দে কামপো পার্কের বিস্তার। এই প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যান একসময় রাজরানীর নিজস্ব বিচরণভূমি ছিল, আজ এই সুবিশাল এলাকা জুড়ে একটা অরণ্য তৈরি করা হয়েছে শহরের আমজনতার জন্যে। অনেকেই সেখানে গিয়ে খেলাধুলো করে, সাইকেল চালায়। মাদ্রিদ শহরের কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির সন্নিবেশে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসে নির্ভাবনায়। সূর্যাস্তের সময় প্যালেসের পশ্চাতপটে আকাশে রঙের খেলা দেখতে শহরের বাসিন্দারা আজও আগের মতো জটলা করে এখানে।
Palacio Real |
Royal Opera |
ইতিহাসের তথ্য। তথ্যে ইতিহাস। এমনিতে তথ্য জিনিসটা অতিশয় বোরিং, সাল তারিখের ঝুটঝামেলা কাটিয়ে ইতিহাসের খেই পেতে পেতে ঘুম পেয়ে যায়। এখানে কিন্তু তেমনটা মনে হয়নি। দিব্যি বৈঠকী গল্পের মেজাজে কথাবার্তা হচ্ছে, হাসি আর কথার মাঝে টুকটাক ইতিহাস গুঁজে দিচ্ছে অ্যালেক্স। যেন গল্পদাদুর ঠেক। ভারী চমৎকার গল্প বলে এই ছেলেটি। গল্প চলতে চলতেই আমরা এসে দাঁড়িয়েছি রয়্যাল অপেরার সামনে থিয়েটরো রিয়ালের সামনে ওরিয়েন্টে স্কোয়ারে। ইতিমধ্যে এক রাউন্ড ড্রিংক ব্রেক হয়ে গেছে।
“কী খাবি বল দিকিনি?” বিনীত প্রশ্ন করলাম সঙ্গিনীকে।
“কমলালেবুর রস।” চটজলদি জবাব এল।
উরিব্বাস! ঠিক তো। দেদার কমলালেবু রাখা আছে। কী বাহার তাদের। লেবু না ট্যাঞ্জরিন জানি না, কিন্তু আগুন রঙের সেই ফল দেখেই জিভে জল চুকচুক করে। স্পেনে যে মারকাটারি কমলালেবু পাওয়া যায়, সেই কথাটা একদম খেয়াল ছিল না। আর সেই লেবুর কী স্বাদ। শুভানাল্লাহ! রস খেয়ে প্রাণটা একদম জুড়িয়ে গেল। খাওয়াদাওয়ার পাট মিটিয়ে আবার হাঁটা। এইবার আমরা উপস্থিত ওরিয়েন্টে স্কোয়ারে। ওরিয়েন্টে স্কোয়ার অজস্র ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো, বাহারি কালো সিংহের মাঝে অবস্থিত প্রস্রবণ প্রতিমা থেকে জল পড়ছে। বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন যে এত সুন্দর একটা জায়গায় এক সময় হাজার হাজার লোককে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
১৯৩০ সালের পর থেকেই স্পেন মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দেশের হাল তখন রিপাবলিকদের হাতে। রিপাবলিকরা মূলত রাইট উইং সমর্থক অর্থাৎ দক্ষিণপন্থী। অনেক বিত্তশালী মানুষ, ক্যাথোলিক গির্জার গন্যমাণ্য ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছিলেন এই দলে। কিন্তু অন্যদিকে একটু একটু করে লেফট উইং সমর্থক ন্যাশনালিস্ট পার্টির শক্তি ক্রমেই বাড়ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। জার্মানির নাজিরা নানা ভাবে রিপাবলিকনদের সাহায্য করছে, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মেক্সিকোর গোপন সাহায্য নিয়ে ন্যাশনালিস্ট দলের নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কো নিজেকে দেশের প্রতিনিধি বলে ভাবতে শুরু করেছেন।
১৯৩৬ সালের একদিন আচমকা ন্যাশনালিস্টদের বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে জলে, স্থলে, আকাশে। সুদূর জার্মানি আর সোভিয়েত দেশ থেকে লড়াকু জাহাজের এসে বোমাবর্ষণ শুরু করে স্পেনে। একদিকে সরকারের লোকেরা ন্যাশনালিস্ট সন্দেহ করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষকে, অন্যদিকে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর দলও তাদের রেহাই দিচ্ছে না, যদি সরকারের চর হয়? মানুষের শক্তি দখলের এই উন্মত্ত লড়াইয়ে অচিরেই লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ হারাতে শুরু করল। খাওয়াদাওয়ার কষ্ট শুরু হল, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রিপাবলিকানরা পালিয়ে আশ্রয় নিলেন ভ্যালেন্সিয়াতে। প্রায় তিন বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের পর জেনারেল ফ্রাঙ্কো নিজেকে দেশের শাসক ঘোষিত করে বসলেন। ন্যাশনালিস্টদের জয় হল।
কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েই চলে যুগ যুগ ধরে। বামপন্থী পার্টির সমর্থক জেনারেল ফ্রাঙ্কো ক্ষমতাসীন হয়েই ঘোষণা করেন, গৃহযুদ্ধে যারা আগের সরকারের সমর্থক ছিল তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে। শুরু হল লোকেদের ধরপাকড়। রাস্তাঘাট থেকে কারণে অকারণে লোকেদের তুলে নির্যাতন শুরু হয়ে গেল। একের পর এক লোক অদৃশ্য যেতে লাগল স্পেনের শহরগুলো থেকে। ত্রাসের সঞ্চার হল জনসাধারণের মনে। ফ্রাঙ্কোর কড়া আদেশ, তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারবে না। শিল্পী, সাহিত্যিকরা দেশ ছেড়ে পালাতে লাগল। এই বন্ধ আবহাওয়ায় প্রায় চল্লিশ বছর কেটেছে স্পেনের মানুষদের। ১৯৭৮ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর তিন বছর পর রেফারেন্ডাম করে কন্সটিনিউশনাল মোনার্কি অর্থাৎ সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়ে স্পেনে। ধীরে ধীরে আবার গণতন্ত্র মজবুত হতে শুরু করে। আশির দশকের শেষের দিকে স্পেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হয়ে ওঠে।
অ্যালেক্সের সঙ্গে গল্প চলছিল টুকটাক। কথায় কথায় সে জানাল তাপাসের কথা। স্পেনের বেশ কিছু শহরে 'তাপাস বার' দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাপা আসলে যে কোনও পানীয়ের সঙ্গে পরিবেশন করা শুকনো খাবার। তাপাস বারে যে কেউ একটা পানীয় অর্ডার করে বিনিপয়সায় এক প্লেট স্ন্যাক্স পেয়ে যেতে পারে। বুলফাইটিং আর ফ্লামাঙ্কো নাচকে পাঁচ গোল দিয়ে 'তাপাস বার ক্রল'-এর উন্মাদনা যে তুঙ্গে সেটা আমরা পরবর্তী কয়েক দিনে ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। যাই হোক, একসময় অ্যালেক্সকে বিদায় জানাতেই হল। এরকম কত মানুষের সঙ্গেই আলাপ হয় পথে। কয়েক ঘন্টার আড্ডা, প্রত্যাশাহীন কথোপকথন। হাসিঠাট্টা। সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডল বিনিময়। হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি। পরে কি এদের সঙ্গে কোনোদিন দেখা হবে? না হওয়াই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণের বন্ধুত্ব, কিন্তু এই আন্তরিকতায় কোনও ভেজাল নেই।
Prado Museum |
২)১৫৭০ সালের এক দুপুরে ইতালির রোম শহরে বোঁচকা হাতে এক যুবকের আবির্ভাব হল। প্লাজা ফার্নেসের সামনে এসে এদিক ওদিক চেয়ে সে দোনামোনা করতে লাগল। এত দূরে এসে কি ঠিক হল? সাহসী বলে তার নামডাক আছে। কিন্তু ভিনশহরে সাহস দেখিয়ে আর কী হবে? কোন সাফল্যের সন্ধানে সে এক শহর থেকে আরেক শহর পাড়ি দিচ্ছে কে জানে! কিন্তু ঘরেও যে মন বসে না।
বাড়ির কর্তা আলেসান্দ্রো ওপর থেকে তাকে লক্ষ করছিলেন। ধীর পায়ে নিচে নেমে এসে ছেলেটির সামনে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম হে তোমার? মতলব কী এখানে?"
ছেলেটি থতমত খেয়ে বলল, “আজ্ঞে ডোমিনিকোস। ছবি আঁকি। শুনেছি এই জায়গাটাতে শিল্পীরা থাকতে পারে। তাই, মানে..."
আলেসান্দ্রো যুবকটির আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে বললেন, “ভেনিস থেকে আসছ বুঝি?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ। “
ঘাড় নাড়লেন আলেসান্দ্রো। ছেলেটির কথা তাঁর এক পরিচিত তাঁকে বলেছিলেন। ক্রেট-এর ছেলে, আঁকার হাত নাকি মন্দ নয়। ভেনেসিয়ান শৈলী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে বছরকয়েক, নামডাকও হয়েছে খানিক। কিন্তু ভেনিস আর রোম তো এক নয়। গির্জার সুনজরে না পড়লে অনেক তাবড় তাবড় শিল্পীকেও অদৃষ্টের কাছে পরাজিত হয়ে সরে পড়তে হয়েছে। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, “শোনো হে ছোকরা, আমার নাম আলেসান্দ্রো কার্ডিনাল। তোমাকে এখানে থাকতে দিচ্ছি ঠিকই কিন্তু কাজ জোগাড় করার দায়িত্ব নিতে পারব না বলে দিলাম।”
যুবক ঘাড় নাড়ল। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আলেসান্দ্রো বুঝতে পারলেন এই ছেলের হাত অন্য। বাইবেলের ধার্মিক ছবি আঁকতে আর চারটে শিল্পীর মতোই দক্ষ, কিন্তু অন্য এক মাত্রা যোগ করে দেয় প্রতিটি ছবিতেই। ম্যানেরিজম চমৎকার, নতুন স্টাইল ধরে ফেলতেও সময় লাগে না। শুধু একটাই অসুবিধে। ছোকরা বড্ড গোঁয়ার। জিজ্ঞাসাবাদ করে চার্চের ফ্রেস্কো আঁকার কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন, নবাবপুত্তুরের তা পছন্দ হল না। ক্যানভাস ছাড়া ছবি আঁকা নাকি ছোকরার পছন্দ নয়! এদিকে পকেট তো ঢনঢনে। এত তেজ আসে কোত্থেকে?
যেমন তেমন করে সময় কাটতে লাগল। এদিকে ডোমিনিকোসও বুঝতে পারছে রোম আর ভেনিস এক নয়। সংস্কৃতির পার্থক্য অনেকটাই। টিটিয়ান, তিনতোরেত্তো, বাসানোদের যে ন্যারেটিভ স্টাইল সে পছন্দ করে সেই নিয়ে রোমের গির্জায় ফ্রেস্কো আঁকা চলে না। এখানে গির্জার নিয়মকানুন বড় কড়া, স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলেই বাবুদের কপাল কুঁচকে যায়। প্রথম প্রথম আলেসান্দ্রো তার প্রতি সহায় ছিলেন ঠিকই কিন্তু রাজপ্রাসাদে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় তাঁর সেই ভাব উধাও হয়েছে। ডোমিনিকোস ঠিক করল, আর না। উনিশ মাস হয়ে গেছে, এবার রোমকে বিদায় জানানোই ভালো।
১৫৭৭ সালে মাদ্রিদ হয়ে ডোমিনিকোস এসে পৌঁছাল স্পেনের তোলেদোতে। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত তোলেদো সম্রাটের রাজধানী ছিল, এখনও প্রধান গির্জা আছে সেখানেই। ধর্মের বাড়াবাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু লোকজন রোমের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। আমোদ আর উৎসব চলতে থাকে সারাক্ষণ। ডোমিনিকোস বুদ্ধিমান। সে ছবি আঁকার পাশাপাশি ব্যবসাও ফেঁদে বসল তোলেদোতে। ব্যবসায়ী হিসেবে যখন সে পসার জমিয়ে ফেলেছে, সম্ভ্রান্ত বর্গের বিত্তশালী মানুষের কাছেও পরিচিত হয়ে গিয়েছে, তখন সে শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল মঞ্চে। শুধু আত্মপ্রকাশই করল না, বরং বলা যায় ওপেনিং ব্যাট করতে নেমেই চালিয়ে খেলতে শুরু করে দিল।
ডোমিনিকোস একের পর এক কাজ করে যেতে লাগল এই সময়। যাবতীয় চিন্তা তার মাথা থেকে দূর হয়ে গেছে, তার তুলি চলছে অবাধ গতিতে। ফর্ম ভেঙে বেরিয়ে আসতে তাকে দু’বার ভাবতে হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই এক নতুন স্টাইলের জন্ম দিয়েছে সে। মান্যিগণ্যি ব্যক্তিরা ভালো দাম দিয়ে তার ছবি কিনে নিয়ে যেতে চায়, রাজপ্রাসাদেও আকছার ডাক পড়ে তার। ‘ট্রিনিটি আর এসাম্পসন অফ দ্য ভার্জিন’ ছবিটি আঁকার পর সে এক লাফে জনপ্রিয় শিল্পীদের তালিকায় চলে এসেছে। কিন্তু খ্যাতি যখন আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে ভোগান্তিও। অনুরাগীদের সংখ্যা বাড়লে শত্রুবৃদ্ধি হয় দ্বিগুণ গতিতে। ডোমিনিকোস আশা করেছিল রাজার অনুগ্রহ হলে সে মাদ্রিদে গিয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু তার আঁকা কয়েকটি ছবি রাজা ফিলিপের মনঃপুত হয়নি। এর পিছনে অবশ্য কারণও ছিল। রাজার তোষামোদকারীদের মধ্যে অনেকেই ডোমিনিকাসের ত্বরিত জনপ্রিয়তায় খাপ্পা হয়েছিল। তাদের প্ররোচনায় তার বিরুদ্ধে নানান গুজব রটিয়ে দেওয়া হল। এই শিল্পী যে ধরা কে সরা জ্ঞান করছে, রাজামশাইকেও সে পাত্তা দেয় না, এই কথা নানাভাবে কিং ফিলিপকে বুঝিয়ে দেওয়া হল।
মাদ্রিদে যাওয়া ডোমিনিকোসের হল না। ১৫৮৬ সালে সব চিন্তা ভুলে সে এঁকে ফেলল আরেকটি ছবি, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। ‘বিউরিয়াল অফ কাউন্ট অফ অরগাজ’... শেষ জীবনে সে আরো বেশি করে নতুন নতুন ফর্মের ছবি আঁকতে শুরু করল। নাওয়াখাওয়া ভুলে সে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে তুলি আর রঙ নিয়ে। লোকে আড়ালে বলে পাগলা ডোমিনিকাস। তখনও সে জানে না, স্পেনের শিল্প ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে সোনালি অক্ষরে।
প্রাদো মিউজিয়ামে এল গ্রেকোর আঁকা ‘নোবলম্যান উইথ হিস হ্যান্ড অন দ্য চেস্ট’ ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে এই গল্পটা আমার মনে পড়ে গেল। ছবির নিচে শিল্পীর খানিকটা পরিচয় দেওয়া ছিল।
Nobleman with his Hand on his Chest |
স্পেনের অনেক শিল্পীই ইতালি আর ফ্রান্স-এ গিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এককালে। কিন্তু খুব বেশিসংখ্যক শিল্পী নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে উঠতে পারেননি। সেদিক দিকে ডোমিনিকোস ওরফে এল গ্রেকো সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। এমনিতে আমাদের মত সাধারণ মানুষ, যারা আর্ট ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না, তাদের কাছে ক্লাসিকাল আর্ট বিষয়টা ভীষণ জটিল। বাইবেলের গল্পযুক্ত ধার্মিক ছবি পর পর কয়েকটা দেখলেই আমাদের একঘেয়ে মনে হতে থাকে। গল্পের ভিতরে লুকিয়ে থাকা রেফারেন্স বোঝা যায় না বলে ঘনঘন হাই ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে এল গ্রেকো অবশ্যই অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী। কার সাধ্য তাঁর আঁকা ক্লাসিকাল আর্ট দেখে হাই তুলবে! তাঁর ফর্ম ভাঙ্গা মানুষজনের আকৃতি, তাঁর রঙের ব্যবহার অন্যদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। একের পর এক ছবি দেখলেও চোখ অথবা মন ক্লান্ত হয় না। শোনা যায় পিকাসো প্রথম জীবনে প্রাদোতে এসে গ্রেকো আর ভ্যালেনকুইজের ছবি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। ফর্ম ভেঙ্গে তোলার মূল অনুপ্রেরণা পিকাসো গ্রেকোর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন।
প্রাদোতে অবশ্য এল গ্রেকো ছাড়াও বহু শিল্পীর কাজ আছে। কারাভাজ্জিও, পিকাসো, গোয়া সকলেই মজুদ। প্রকাণ্ড মিউজিয়াম, চার তলা জুড়ে নানান শিল্পের নিদর্শন। একদিনের টিকিট কাটা হয়েছে মাত্র, হুড়মুড় করলে কিছুই ভালো করে দেখা হবে না। যতটা ঠিকঠাক সময় নিয়ে দেখা যায়! তার মাঝে কোথাও কোথাও পা নিজেই আটকে যায় অপূর্ব এক একটা পেইন্টিং দেখে। সেরকমই একটা কাজ হল ‘দ্য গার্ডেন অফ আর্লি ডেলাইটস’, শিল্পী হিয়েরনিমস বস। তিনটে ভিন্ন ক্যানভাস জুড়ে এই বিশাল চিত্রে একই সঙ্গে পৃথিবীর ভালো-মন্দ-সুন্দর-বীভৎস যা আছে তা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। চোখ ফেরানো যায় না।
The Garden of Early Delights |
আর একটা ছবি গোয়ার ‘থার্ড অফ মে, ১৮০৮’। এই দিনেই নেপোলিয়ানের সৈন্যের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল স্পেনের মানুষ। তার দাম অবশ্য বন্দুকের গুলি খেয়ে চুকোতে হয়েছিল প্রত্যেককেই। অপূর্ব সুন্দর ভাবে সে ঘটনার খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন শিল্পী।
হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে একসময় বেরিয়ে পড়াই স্থির করলাম। মাদ্রিদের মিউজিয়াম কোয়ার্টারে আরো বেশ কয়েকটা নামকরা মিউজিয়াম আছে। টিকিটের দাম আর প্রাদোর বিহ্বল করা অভিজ্ঞতা, দুই নিয়ে সেগুলোতে যাওয়ার সাহস হল না। একদিনে কতটাই বা দেখা যায়! ঘন্টা পাঁচেকের বেশি হাঁটা অসম্ভব। আমাদের কাছে এত সময়ও নেই। অতঃপর চল যেদিকে দু’ চোখ যায়। সব কিছুই দেখার। চোখ থাকলেই হল।
Third of May, 1808 |
(ক্রমশ )
মাদ্রিদ - তৃতীয় পর্ব
প্রথম থেকে পড়তে হলে এখানে পড়ুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন