রবিবার, ২৭ মে, ২০১৮

মহাকাশের আর্তনাদ

 

হেলিক্স নেবুলা

মহাকাশ বিজ্ঞান বা গবেষণা নিয়ে ফেসবুকে বিশেষ আগ্রহ দেখি না। কয়েকজন অবশ্য নিয়মিত পোস্ট করেন, ভালো ছবি-টবি থাকলে অনেকে সেই পোস্টে লাইক করে এগিয়ে যান। অথচ এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে, যুগান্তকারী সব আবিষ্কার হচ্ছে। হাবল টেলিস্কোপের নতুন নতুন ছবি আসছে, ইন্টারস্টেলার স্পেস থেকে ভয়েজর-১ আর ভয়েজর-২ এমন সব তথ্য পাঠাচ্ছে যে মহাকাশবিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসেছে। 

ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রনমিতে Coryn A.L. Bailer-Jones কয়েকদিন আগে ইন্টারস্টেলার নেভিগেশন নিয়ে একটা পেপার সাবমিট করেছেন, সেটা নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। প্রসঙ্গত বলা ভালো ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, ভয়েজরের পাশাপাশি নিউ হরাইজনও 'হেলিওপজ' বা সোলার সিস্টেমের সীমানা অতিক্রম করে কিছুদিন পর আন্তনক্ষত্র মহাকাশে পৌঁছে যাবে, কিন্তু সমস্যাটা হল যোগাযোগের পন্থা ও সময়কাল নিয়ে। 

প্রক্সিমা সেন্টারি বা অন্য কোনও স্টার সিস্টেমের কাছে পৌঁছতে হলে সিগন্যাল ক্রমে দুর্বল হতে থাকবে, আর পৃথিবীতে পৌঁছতে তার সময় যাবে বেড়ে। দূর নক্ষত্রের কাছে যেতে হলে বর্তমান যোগাযোগের পন্থা মোটেও কার্যকর হবে না। তাছাড়া সময় তো বেশি লাগবেই। এই সমস্যা এড়াতে বাইলার-জোন্স মৃত নক্ষত্রের স্পন্দনের উপর নির্ভর করে একটা গ্যালাক্টিক জিপিএস তৈরি করতে জোর দিয়েছেন, যাতে স্পেসক্রাফট কোর্স কারেকশন করতে পারে প্রয়োজনে। নক্ষত্রের একটা ক্যাটালগ দিয়ে বাইলার-জোন্স প্রমাণ করেছেন যে এই কাজটা স্পেসশিপকে করতে হবে সিক্স ডাইমেনশন কোঅর্ডিনেট বা স্থানাঙ্কের  উপর নির্ভর করে। তিনটে থাকবে মহাকাশে, বাকি তিনটে ঠিক হবে গতির নিরিখে। তাহলেই এই ক্যালকুলেশন করা সম্ভব হবে। বাইলার জোন্স বলেছেন, ""As a spacecraft moves away from the Sun, the observed positions and velocities of the stars will change relative to those in a Earth-based catalog due to parallax, aberration, and the Doppler effect. By measuring just the angular distances between pairs of stars, and comparing these to the catalog, we can infer the coordinates of the spacecraft via an iterative forward-modelling process."

পুরো পেপারটাই ইচ্ছে হলে এখানে পড়া যাবে।
https://arxiv.org/abs/2103.10389

অন্যদিকে এই প্রথম M87* ব্ল্যাকহোলের চারিধারে বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপে থেকে যে ধরনের বেঁকেচুরে যাওয়া আলোকরশ্মি চোখে পড়েছে, সেই পোলারাইজেশন ইফেক্ট যে আসলে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের কারণেই হয়েছে, সেই প্রমাণ পেয়ে বিশেষজ্ঞরা উচ্ছ্বসিত। এই ব্ল্যাকহোল বর্তমানে সম্ভবত অস্তিত্বেও নেই, কয়েক যুগ আগের একটা অসামান্য ঘটনাএই প্রথম দেখতে পাচ্ছে মানুষ। এই আলোকরশ্মির ব্যবহার স্টাডি করে যে মহাকাশ ও সৃষ্টির বহু রহস্য সম্পর্কে নতুন তথ্য মিলবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। 

আরো একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে নভেম্বর মাসে। পৃথিবী থেকে ৬৫৫ আলোকবর্ষ দূরের হেলিক্স নেবুলা থেকে পাওয়া একটা শব্দকে( আসলে ফ্রিকোয়েন্সি ভ্যারিয়েন্স, মহাকাশে শব্দের কন্সেপ্ট নেই) 'ডেটা সোনিফিকেশন' করে রেকর্ডিং করা হয়েছে। মহাকাশে নিঃশব্দ ঠিকই, কিন্তু সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাওয়া এই 'অডিটেরি' রেকর্ড শুনলে মনে হয় কোনও মহিলা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করছে দূর দূরান্তের কোনও পৃথিবী থেকে। শুনে দেখুন তো গায়ে কাঁটা দেয় কি না?

https://twitter.com/NASAHubble/status/1325816192288890881

আরেকটা ঘটনার কথা বলার আছে। তার আগে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত 'সাইলেন্টিয়াম' বইয়ের খানিকটা অংশ পড়তে অনুরোধ করলাম। না না, বইয়ের প্রচার নয়, পরবর্তী ঘটনাটা বুঝতে সুবিধে হবে বলেই বলা!

#পুস্তকাংশ 

“ইচিকা, ইচিকা, এক্ষুনি একবার এখানে এস।” তার কপালে ঘাম জমে উঠেছে। ইচিকা “কী হয়েছে অয়ন? ” বলে ঘরে ঢুকতেই অয়ন তাকে টেনে এনে টেলিস্কোপের সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল, “দেখ তো চিনতে পার কিনা? ”

ইচিকা এক মুহূর্ত দেখেই বলল,  “এটা তো হেলিক্স নেবুলা। সাতশো আলোকবর্ষ দূরে। এই দৃশ্য কি ভোলার অয়ন? মহাশূন্যের সবচেয়ে সুন্দর কয়েকটা দৃশ্যের মধ্যে অন্যতম। একদম চোখের মতন দেখতে দেখেছ, যেন ঈশ্বর নিজের চোখে দেখছেন এই সৃষ্টিকে।”

অয়ন বলল, “হেলিক্স নেবুলা তো তুমি আগেও দেখেছ, তার মাঝে ব্যাঙাচির মত গোল হয়ে ঘুরতে থাকা এই  বিন্দুগুলো সম্পর্কেও তুমি নিশ্চয়ই জানো? ”

“সেগুলো তো কমেটেরি নটস। তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও মনে হয় বিশেষ কোনো মাধ্যাকর্ষণের ফলে তারা সুপারনোভার পর থেকে নেবুলার ক্লাউড ডাস্টে চক্কর খেয়ে চলেছে।”

“ঠিক বলেছ ইচিকা। ” অয়ন টেলিস্কোপের অন্য একটা বিন্দুতে ফোকাস করে বলল,  “এইবার এইটা দেখ।”

ইচিকা আবার টেলিস্কোপে চোখ লাগল। তারপর অয়নকে প্রশ্ন করল,  “এটা তো মনে হচ্ছে একটা সুপারনোভা, কোন গ্যালাক্সি এটা অয়ন? এটা তো আগে দেখিনি। এরকম দুর্লভ দৃশ্য দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”

অয়ন বলল, “ইচিকা, ভুলে যেও না আমরা পৃথিবী থেকে প্রায় চার আলোকবর্ষ দুরে আছি, অনেক দৃশ্যই এখান থেকে দেখতে পাওয়া সম্ভব যা হয়ত পৃথিবীতে বসে আমরা দেখতে বা জানতে পারিনি। আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি এন্ড্রমিডার একটা তারার সুপারনোভা বিস্ফোরণ এটা, পৃথিবী থেকে যার দূরত্ব প্রায় আড়াই মিলিয়ন আলোকবর্ষ দুরে। এবার তুমি লক্ষ করে দেখো তো এখানে কোন কমেটেরি নটস দেখতে পাও কিনা?”

ইচিকা আবার টেলিস্কোপে চোখ রাখল। কিছুক্ষণ লক্ষ করে চমকে উঠে সে বলল,  “ঠিক বলেছ অয়ন। এইখানেও কমেটেরি নট্স দেখতে পাওয়া যাচ্ছে হেলিক্স নেবুলার মত, যদিও আকারে খানিকটা পার্থক্য আছে।”

অয়ন উত্তেজিত হয়ে বলল,  “আমি এই সুপারনোভার ছবি নিয়ে তার একটা ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করেছি। এইবার ইন্টারস্টেলার অ্যাস্ট্রনমি অ্যালগরি্দম প্রোগ্রামের সাহায্যে আমি সময়টাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি কয়েক হাজার বছর। মানে আমি দেখতে চাইছি হাজার বছর পরে আমি যদি এই সুপারনোভা থেকে সৃষ্ট নেবুলা দেখতে পাই, তাহলে কেমন দেখতে হবে তাকে? দেখ ইচিকা, কেমন হবে এন্ড্রমিডার গ্যালাক্সির এই নেবুলা? ”

ইচিকা এক ঝলক দেখে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,  “কী বলছ তুমি অয়ন, এইটা তো হেলিক্স নেবুলার ছবি।”

অয়ন উত্তর দিল,  “না ইচিকা, এই ছবি হেলিক্স নেবুলার নয়, তুমি এন্ড্রমিডার গ্যালাক্সির যে সুপারনোভা দেখছ, সেই ছবিরই ভবিষ্যৎ সংস্করণ...”

“এটা কী করে সম্ভব? হেলিক্স নেবুলা প্রায় সাতশো আলোকবর্ষ দূরে, অন্তত কয়েক হাজার বছর আগে কোন মহাবিস্ফোরণের সময় সৃষ্ট হয়েছে, এদিকে এন্ড্রমিডার গ্যালাক্সির দূরত্ব আড়াই মিলিয়ন আলোকবর্ষ! আমরা যে সুপারনোভা দেখছি সেখানে, হয়ত কয়েক লক্ষ বছর আগে সেই ঘটনা ঘটেছে। সেখান থেকে আলো এসে পৌছতেই এতটা সময় লেগেছে। দুটো ঘটনার অবস্থান এবং সময়ে আকাশ পাতাল তফাৎ। তুমি কী বলতে চাইছ অয়ন আমি বুঝতে পারছি না।”

অয়ন গম্ভীর গলায় বলল,  “আমি বলতে চাইছি যে মহাকাশে সময় আর অবস্থানের হিসেব আমরা যেভাবে দেখি, সেই ভাবে বাস্তবে হচ্ছে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের না জানা কোন মাধ্যমে স্পেসটাইমের নানান বিন্দু একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছে। একই মুহুর্তে আমরা লক্ষ লক্ষ বছরের তফাতে থাকা অনেকগুলো ঘটনা দেখতে পাচ্ছি।”

ইচিকা হতভম্ব হয়ে বলল,  “তুমি কী বলছ অয়ন? ”

“ভেবে দেখো ইচিকা, প্রায় চল্লিশ বছর ধরে হাবল টেলিস্কোপে মহাকাশে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছে। যতদুর পর্যন্ত আলোর নিয়মে আমাদের দেখতে পাই, সব কিছুর ছবি তোলা হয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু হেলিক্স নেবুলা ছাড়া কোথাও কি আমরা ব্যাঙাচির আকৃতির কমেটেরি নট্স দেখতে পেয়েছি?”

“মানে তুমি বলছ এন্ড্রমিডা গ্যালাক্সির এই সুপারনোভার ফলেই হেলিক্স নেবুলার জন্ম, যা অজানা কোনো উপায় আড়াই মিলিয়ান আলোকবর্ষ থেকে সাতশো মিলিয়ান আলোকবর্ষে চলে এসেছে? আর ইউ স্পিকিং এবাউট দি ওয়ার্মহোল প্রফেসর ওয়াং ওয়াস টেলিং আস? ”

অয়ন ইচিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,  “জানি না ইচিকা। হয়ত ওয়ার্মহোল, হয়ত বা অন্য কিছু। কিন্তু দূরত্ব আর সময় অতিক্রম করার একটা বিকল্প থাকতে বাধ্য।”

-----

পুরো লেখাটাই কল্পনা। কমেটরি নটস বা তথ্যে সম্ভবত খুব একটা ভুল নেই, কিন্তু ঘটনাটা কল্পনাপ্রসূত অবশ্যই। কিন্তু কয়েকদিন আগেই বৈজ্ঞানিকরা Polycyclic aromatic hydrocarbons বা PAH কণার খোঁজ পেয়েছে। এদের দেখা যায় মৃত নক্ষত্রের কাছাকাছি, কিন্তু সেই নিয়মের বিরুদ্ধে এখন এদের দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সক্রিয় নক্ষত্র বা মহাকাশের অন্যান্য জায়গাতেও। মহাকাশবিজ্ঞানীরা ৪৩০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত Taurus Molecular Cloud (TMC-1)-এর মলেকিউলার ক্লাউডে এই  PAH কণাকে খুঁজে চালানোর একটা প্রজেক্ট চালাচ্ছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে GOTHAM অর্থাৎ Green Bank Telescope (GBT) Observations of TMC-1: Hunting Aromatic Molecules. সেই বিশ্লেষণ এখনও চলছে কিন্তু এরই মধ্যে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। অনেকের ধারণা এই কণাগুলো আসলে PAH কণা নয়, বরং হেলিক্স নেবুলাতে দেখতে পাওয়া কমেটারি নটস-এর মতো ছোটো ছোটো ডার্ক পকেট। স্পেসটাইমের ভিতরে এই কণাগুলোর সাহায্যে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে সময় ও দূরত্ব অতিক্রম করার জন্যে। বোঝো!

এত বড় একটা লেখা লিখে ফেললাম এইটা পড়ে! কিন্তু এইসব নিয়ে খুব বেশি মানুষের মনে আগ্রহ তৈরি হয় না আজকাল! পরিবেশ বদল নিয়েও হয় না, প্রাণীজগতের অসামান্য জীবনযাত্রা দেখেও আমরা নির্বিকার থাকি! চল্লিশ বছর আগে একজন আন্দোলনে গিয়েছিলেন কি যাননি, সেই সত্যি-মিথ্যে খুঁড়ে বার করতেই আমরা সকলে ব্যস্ত! 

(ছবিটা হেলিক্স নেবুলার)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন