রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

দ্য ম্যাজিক অফ মাদ্রিদ (তৃতীয় পর্ব)



Bernabeu Stadium: Fast-track Santiago Bernabéu - Visit to the Real ...
Real Madrid Stadium

১) ফুটবল নিয়ে ইউরোপের সব দেশেই মাতামাতি। লা লিগা থেকে ইউরো কাপ... সবেতেই দেশের মানুষ ফুটবলের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। মাদ্রিদের রয়্যাল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের বিশ্বজোড়া খ্যাতি, এখানে ছোটবেলায় প্রায় প্রত্যেকেই সেখানে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমরা যখন মাদ্রিদে, ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে পুরোদমে। বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই মজে আছে বিশ্বকাপে। আমাদের দেশে ছোটবেলায় ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেতে দেখেছি, এখানে সেই দৃশ্যটা একেবারেই আলাদা। টিভির পর্দা নয়, বেশিরভাগ লোকে খেলা দেখতে ভিড় করে প্লাজাগুলোতে। সেখানে ঢাউস ঢাউস স্ক্রিন টাঙিয়ে খেলা চলছে। যাকে বলে কমিউনিটি ভিউইং। প্রতিটা পাব ভর্তি, ওপেন এয়ার স্ক্রিনের সামনে হাজার হাজার মানুষ। পানাহারও চলছে সঙ্গে। সে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। বল পায়ে আসতে না আসতেই উদঘোষ শুরু হয়, হিল্লোল ওঠে ঢেউয়ের মতোই। খেলা জিতে গেলে মানুষজন নাচানাচি শুরু করে দেয়, হুল্লোড় চলে রাতভর। সে সময় পাবে অথবা রেস্তোঁরায় গেলে হয়তো বিনা পয়সায় খাদ্য বা পানীয়ও জুটে যেতে পারে। 

মোট কথা ২০১৮ সালে স্পেন যদি বিশ্বকাপ জিতে যেত, আমাদের স্পেনের দিনগুলো হয়তো আরো অনেক বেশি রঙিন হতে পারত। কিন্তু সে হওয়ার ছিল না। রাশিয়ার সঙ্গে ম্যাচে পেনাল্টিতে হেরে স্পেন বিশ্বকাপ থেকেই বেরিয়ে গেল। রেস্তোরাঁতে বসে বিশাল বার্গারে কামড় দিতে দিতে খেলা দেখছিলাম আমরাও, খেলা শেষে উদাস মনে চললাম টেম্পলো দে দেবোদের উদ্দেশ্যে। মেজাজ বিগড়ে গেছে। সকলেই বিমর্ষ মুখে পথ হাঁটছে। সঙ্গিনীর অবশ্য হেলদোল নেই। সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, পরপর ছবি তুলছেন আর সুযোগ পেলেই স্প্যানিশে বকর-বকর করতে শুরু করে দিচ্ছেন। কী জ্বালা রে বাবা!  

টেম্পলো দে দেবোদে পৌঁছে মাথাটা খানিক ঠান্ডা হল। ইজিপ্সিয় এই মন্দির নির্মাণ করে ইজিপ্টের সরকার উপহার দিয়েছিলেন স্পেন সরকারকে। মন্দিরটি সাদামাঠা কিন্তু পিছনের সুন্দর বাগানের ওপর থেকে পার্ক কাসা দে কামপোর অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এই পার্ক নাকি নিউয়র্কের বিখ্যাত সেন্ট্রাল পার্কের পাঁচগুণ। টেম্পলো দে দেবোদ থেকে সেই বিস্তার দেখে মনে হয় আধুনিক মাদ্রিদের মধ্যে জাদুবলে এই বিস্তীর্ণ অরণ্য উপত্যকা এসে উপস্থিত হয়েছে। 

বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল ঢেউ খেলানো ঘাসের বিছানার ওপর শুয়ে বসে। ভয়ঙ্কর রোদের তেজ, গাছপালার মধ্যে বেশ আরামই লাগছিলো। ম্যাচ দেখে এসে অনেকেই শুয়ে বসে আছে। একজন বৃদ্ধ আপন মনে গিটার বাজিয়ে চলেছেন। সামনের টুপিতে হয়তো কেউ কেউ খুচরো টাকা দিয়ে যাচ্ছে। ঘড়িতে দেখি সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। সূর্য এখনও মধ্যগমনে বিরাজমান, খাঁ-খাঁ করছে রোদ্দুর। আমাদের দেশে বারোমাস সকালের পর বিকেল, বিকেলের পর সন্ধ্যে, সন্ধ্যের পর রাত্তির দেখে এসেছি। মাদ্রিদের গ্রীষ্মে সেইসবের বালাই নেই। রাত পৌনে এগারোটার সময় যখন সূর্য অস্ত হল, তার আগে সন্ধ্যের কোনও চিহ্ন দেখলাম না। দিনের পর কোনও কমা দাঁড়ি সেমিকোলন ছাড়াই ঝুপ করে অন্ধকার। ভড়কে গিয়েছিলাম বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।  

দিন কয়েক পর অবশ্য ব্যাপারটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মুশকিল হয়েছিল রাতের খাওয়া নিয়ে। অন্ধকার না হলে মস্তিষ্ক কিছুতেই ডিনার করতে রাজি হচ্ছে না। অতএব খাওয়াদাওয়া হতে রাত সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা। ভাগ্যিস মাদ্রিদ ছাড়া অন্য জায়গায় এরকম হয়নি। দেরি করে সূর্য অস্ত গেলেও সন্ধ্যের কোমলতার একটা প্রচ্ছন্ন আভাস পেয়েছি অন্য সব জায়গাতেই। 

ঘড়ির কাঁটার হিসেবে দেখতে গেলে অবশ্য বিকেলের পর থেকেই জনস্রোত উপচে পড়ছে রাস্তায়। হস্টেলে ফেরার পথে দেখি সিটি সেন্টারের কাছের ফাঁকা রাস্তাগুলো ভোজবাজির মতো আলোকিত রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়েছে। কোথাও স্প্যানিশ পায়েলা পরিবেশন হচ্ছে, কোথাও কলকল করতে করতে ছেলেমেয়েরা চলেছে 'তাপাস বার ক্রল'-এ। আমাদের হস্টেলের সামনে স্যান মিগেল মার্কেটের ভিতরে উপচে পড়া লোক। ওয়াইন,  বিয়ার, শ্যাম্পেন, হুইস্কির পাশাপাশি চলছে স্পেনের ফল দিয়ে তৈয়ার ড্রিংক 'সাঙরিয়া'। কোথাও সি ফুডের রমরমা, কোথাও আবার চুরোসের সঙ্গে চকোলেট আইসক্রিমের সৌরভ মাতোয়ারা করে তুলেছে বাতাস। অন্ধকার হওয়ার পর নানারঙের আলোর রোশনাইতে পথে নেমেছে জনস্রোত। হাসির কলরব শুনতে পাওয়া যাচ্ছে বারবার। খাওয়াদাওয়া সেরে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই গলিতে গলিতে। একটা রেস্তোরাঁ খালি নেই, প্রতিটা দোকানেই ভর্তি লোক। আমরা একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে এই গলি সেই গলি করে হেঁটে চলেছি, প্রতিটা মোড়ে মুরিশ কোয়ার্টারের আনকোরা সাজ চমকে দিচ্ছে বারবার। রাস্তায় রাস্তায় ‘লাইভ মিউজিক’-এর অনুষ্ঠান। গিটার থেকে বেহালা কিছুই বাদ নেই। রাত বারোটা বা একটা তো কিছুই নয়। এক ফোঁটা অ্যাল্কোহল মুখে না ঠেকিয়েও পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। স্প্যানিশ সামার্স আমাদের রেহাই দেয়নি।   

Related image
Templo de Debod
Puerta del Sol Protest
Buskers music
Plaza Mayor at 10:30 PM
Crowd in Evening

২)১৫৫৫ সালের আলাকালা শহর। শহরের এক প্রান্তে এক বয়স্ক মানুষ কয়েকজন বালককে গল্প বলছেন। স্পেনের সেনাবাহিনীর গল্প। ষোড়শ শতাব্দী স্পেনের মানুষের জন্যে গৌরবময়। ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছে, মুরদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুদূর আফ্রিকায়। পৃথক রাজ্যগুলো মিলিত হয়ে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের পত্তন করেছে। গোটা ইউরোপে এমন কেউ নেই যারা এই সেনাবাহিনীকে ভয় পায় না। স্পেনের নাইটদের নিয়ে কত কত বীরগাথা, কত শৌর্যকাহিনি। সেই কাহিনিই শুনছে আলাকালার শিশুর দল। তাদের মধ্যে একজন গল্প শুনতে শুনতে তন্ময় হয় গেছে। সাত বা আট বছর বয়স তার। তার কল্পনাপ্রবণ চোখে স্বপ্ন! ভবিষ্যতে সেও একদিন নাইট হয়ে বীরত্বের প্রদর্শন করবে। 

ছেলেটির নাম মিগেল। বয়স কম হলে কী হবে, তার কল্পনার ঘোড়া আকাশ স্পর্শ করে। বাড়িতে থাকলে সে ছটফট করে দেশে দেশে ঘোরার নেশায়। কবে এই চার দেওয়াল থেকে মুক্তি পাবে সে? কিন্তু সুযোগ এল তাড়াতাড়িই। একদিন মিগেলের বাবা বের হলেন ভাগ্যন্বেষণে, সঙ্গে নিলেন ছেলেকেও। একের পর এক শহর, পাহাড়, নদী, গ্রাম, নতুন মানুষজন। স্পেনের বাস্তব চেহারা ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগল বালক মিগেলের কাছে। 

সময় থেমে থাকে না। বয়স বাড়তে লাগল মিগেলেরও। একসময় যখন তাদের পরিবার থিতু হল মাদ্রিদে, মিগেলের বয়স উনিশ। এই কয় বছরে সে বিভিন্ন শহরে থেকেছে, নানান জায়গায় বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছে। সে কবিতা লিখতে ভালোবাসে, নতুন শহরে এসে সেই নেশা আরো বেড়ে উঠল। মাদ্রিদে তার কবিতার সুনামও হল। যুবরাজ ডন কার্লোর মৃত্যুর পর তখন দেশে শোকের ছায়া। কাজকর্ম পাওয়া যাচ্ছে না, ক্রমে বাড়ির আর্থিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। ভেবেচিন্তে মিগেল ঠিক করল সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। পোপের দূত জুলিয়ার সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলল সে ইতালিতে, তারপর সময়ের নিয়মে অনেক ঘাটের জল খেয়ে একসময় ইতালিতে স্পেনের সেনাপতি ডন হুয়ানের সঙ্গে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেনাদলে নাম লেখাল। লেপান্তরের যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের প্রমাণও দিল সে। 

তার সৈনিক জীবন চলেছে বেশ কয়েক বছর। একটা সময়ের পর মিগেল ভাবল এবার দেশে ফিরে যাওয়া যাক, অনেক হয়েছে। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না তার। দেশে ফেরার সময় তুর্কিদের হাতে বন্দি হল মিগেল। এরপর দীর্ঘ দশ বছর অসহ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাকে। বার বার চেষ্টা করেও পালানোর পথ পায়নি। অবশেষে ছাড়া পেয়ে যখন মাদ্রিদে এল মিগেল, তার আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এরই মধ্যে সে লেখালিখির চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু বেশিদিনের জন্যে নয়। মাদ্রিদে অর্থাভাব কিছুতেই যাচ্ছে না। তার বিয়েও টেকেনি, পূর্ব সৈনিক হিসেবে যেই পদের আশা করেছিল রাজসভায় সেই আশাও গেছে ভেঙে। ওদিকে তার ছাপা গ্রন্থ 'গ্যালেটিয়া'-ও কেউ কিনছে না। 

শেষমেশ সে মাদ্রিদের বাইরে নৌবাহিনীর খাদ্য বিভাগে ছোট একটা কাজ পেল। প্রচন্ড খাটুনি, টাকা এত কম যে খাওয়াও চলে না। তাও কোনোরকমে চালাচ্ছিল মিগেল। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি এখানেও। খাদ্য বিভাগে কী একটা গন্ডগোলের জন্যে তাকে অন্যায়ভাবে জেলে পাঠালেন কর্তারা। বাঁচার সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়ে মিগেল সে সময়ে জেলে বসে উপন্যাস লিখতে শুরু করল। লিখছে তো লিখছেই। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার যখন সে পুরোনো চাকরিতে বহাল হল, সেই উপন্যাস তখনও লেখা চলছে। ১৬০৩ সালে তাঁর সুবিশাল উপন্যাস 'অ্যাডভেঞ্চার্স অফ ইনজিনিয়াস নাইট ডন কিহোতে দ্য লা মাঞ্চা' প্রকাশিত হয়। খানিক টাকা পেয়েই মিগেল খুশি। কিন্তু অর্থাভাব গেল না। শেষ জীবনে ভীষণ অর্থাভাব নিয়েও লেখালিখি চালিয়ে গিয়েছেন মিগেল সের্ভান্তেস।  

আজ চারশ বছর পর মিগেল সের্ভান্তেসের লেখা 'ডন কিহোতে'-কে নিয়ে সারা পৃথিবীতে গবেষণা হচ্ছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রচনা বলে সম্মান দেওয়া হয়েছে এই উপন্যাসকে। স্পেনের বিখ্যাত 'ইনস্টিটিউটো সের্ভান্তেস'-এর বিশ্বজোড়া নাম। আমরা এখন সেখানেই দাঁড়িয়ে সের্ভান্তেষের কথা ভেবে যাচ্ছি। 'ইনস্টিটিউটো সের্ভান্তেস' হিস্প্যানিক সাহিত্যের পীঠস্থান, ভাষাচর্চা ছাড়াও নানা ধরনের ওয়ার্কশপ, কোর্স চলে সারাবছর। আমার সঙ্গিনীর কাজের জায়গাও এখানেই, অতঃপর কিছুটা খবর তো রাখতেই হয়।

ম্যান্ডারিনের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখলাম আমরা। সের্ভান্তেসের পরবর্তীকালে স্পেনে অসংখ্য নামকরা সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছে। ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা, রাফায়েল আলবের্তি, গুস্তাভো বেকের, ভেগা, রোসালিয়া দে কাস্ত্র ইত্যাদি... সে সূচি শেষ হওয়ার নয়। সমসাময়িক কবি, লেখকদের পরিচিতিও কম নয়। কয়েক বছর আগেই মাদ্রিদকে 'ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল'-এর সম্মান দেওয়া হয়েছে। 

গত কয়েকদিনে এখানকার ব্যাপার স্যাপার ভালোই বুঝে গেছি আমরা। সিবেলেস স্কোয়ার থেকে শহরতলির টাউনশিপ, গ্র্যান ভিয়া থেকে মানাজানারেস নদী পর্যন্ত, এই রাস্তা সেই রাস্তা সব চষে ফেলেছি। এ হল পরিকল্পনাহীন ভ্রমণ। এই ধরুন, বাসে বসে দু’দিকে দেখতে দেখতে যাচ্ছি এমন সময় হয়তো হঠাৎ কোনও অপূর্ব নাম না জানা স্থাপত্য বা ছিমছাম কোনও পাড়া চোখে পড়ল। ব্যস! টুক করে পরের স্টপে নেমে জায়গাটা এক্সপ্লোর করা শুরু হল। কাফের লোকের সঙ্গে গল্প জুড়লাম, রকের আড্ডাবাজ বা ফুটবল ক্লাবের ট্রেনিদের সঙ্গে আলাপ জমালাম। একসময় আবার উঠে পড়লাম অন্য বাসে। মেট্রো আর বাসের নেটওয়ার্ক বেশ ভালো, অডিও ভিজ্যুয়াল ব্যবস্থা আছে। প্রতিটা স্টপের নাম আগেই দেখানো হয়। রাস্তা হারানোর কোনও ভয় নেই, এমনকি সুযোগও নেই। তাই মাঝে মাঝে গুগল ম্যাপ বন্ধ করে উল্টোপাল্টা রাস্তাতে চলে যাই ইচ্ছে করেই। তখন বেশ একটা ‘হারিয়ে গেছি, হারিয়ে গেছি’ ভাব হয়। 

পুয়ের্তা দেল সোল শহরের কেন্দ্রে প্রকাণ্ড প্লাজা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের পর প্রায় প্রতিদিনই মিউজিক কনসার্ট হয়। কিন্তু বড় কনসার্টের চেয়েও প্লাজা ও রাস্তার ধারে বসা স্ট্রিট মিউজিশিয়ান বা বাস্কার্সদের বাজনা শুনে চমকিত হতে হয়। এর মধ্যে একদিন হাঁটতে হাঁটতে রেটিরো পার্কে গিয়ে পড়েছি। হ্রদের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পালাসিও দ্য ভ্যালেনকুয়েজ মিউজিয়ামের মডার্ন আর্ট সংগ্রহ দেখে ক্রিস্টাল প্যালেসের দিকে এগোচ্ছি বনবীথিকার পথ দিয়ে, এমন সময় নাম না জানা একটি বাদ্যযন্ত্রের সুর কানে এসে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটি যুবক অবিকল উড়ন্তচাকির মত দেখতে একটা যন্ত্র বাজিয়ে চলেছে তবলার মত। অপূর্ব সেই সুর। ক্রিস্টাল প্যালেস দেখে এসেও সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকেই বিভোর হয়ে সেই সুরের ঝংকার উপভোগ করছে। এক ইউরো তার বক্সে ঢেলে গুগল বাবার শরণাপন্ন হলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই জানা গেল বাদ্যযন্ত্রের নাম ‘হ্যাঙ’ বা ‘হ্যাঙড্রাম’। মাত্র বছর দশেক আগে সুইডেন আর সুইজারল্যান্ডে এই যন্ত্রের উদ্ভব, তারপর কয়েক বছরের মধ্যেই ছড়িয়ে গেছে সারা ইউরোপে। পড়ে ভারী অদ্ভুত ভাব এল মনে। কী আশ্চর্য! এখনও নতুন বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে, লোকে শিখছে, বাস্কার সমাজের স্বীকৃতিও আদায় করে নিচ্ছে! নতুন নোটেশন, নতুন সুর, নতুন নেশা... নতুন বাদ্যযন্ত্রকে কেন্দ্র করেই হয়তো কত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, হ্যাংয়ের সুরের প্রেক্ষাপটে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, বদলে গিয়েছে কত মানুষের জীবন! কত গল্প ছড়িয়ে থাকে এক একটা বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে! আমরা আর কোনটুকু খবর রাখি? তখনও সেই মন কেড়ে নেওয়া সুর আমাদের কানে এসে লাগছে। 

Related image
Instituto Servantes
Image result for don quixote best book

Image result for puerta del sol summers
Puerta del Sol
Related image
Crystal Palace
Hang drum halo en Madrid - Instrumentos Musicales | 247862
Hang Drum

৩)আমাদের  ব্যাকপ্যাকিং-এর খানিকটা সময় নির্বিঘ্নে কেটেছে। বহু দেশের বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, আড্ডাও মেরেছি দেদার। আমাদের দেশের বাইরে ভ্রমণকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় জীবনে, অনেকে জীবনের এক তৃতীয়াংশ পথেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু ভ্রমণ মানে শুধু শখের টুরিস্ট নয়। এখানে ব্যাকপ্যাকিং সংস্কৃতির উল্লেখ করা প্রয়োজন। ব্যাকপ্যাকাররা সাধারণ টুরিস্ট নয়, শুধুমাত্র সাইটসিইং করতেই তারা পথে বেরোয়নি। ব্যাকপ্যাকার কথার শাব্দিক অর্থ এখনও বাংলায় হয়তো লেখা হয়নি। ভারতের শ্রেষ্ঠ ভবঘুরে রাহুল সাংকৃত্যয়নের লেখা বই ‘অথাতো ঘুমাক্কড় জিজ্ঞাসা’ পড়লে ঘুমাক্কাড়দের সঙ্গে ব্যাকপ্যাকারদের মিল ও অমিল সম্পর্কে খানিকটা জানা যেতে পারে। 

ব্যাকপ্যাকিং-এর উদ্ভব ষাটের দশকে হলেও এর পত্তন বিখ্যাত ইতালিয়ান অভিযাত্রী জিওভানি ফ্রান্সেস্কো কেরেরির হাত ধরে। বস্তুতপক্ষে ব্যাকপ্যাকিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্য বিনোদন নয়, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এবং শিক্ষা। একসময়ের বিখ্যাত অভিযাত্রীদের যে ভ্রমণ কাহিনীগুলো পড়ে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছি তারা পেশাগত ভাবেই সকলেই বিশেষ কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শুধু দেশ দেখতে তারা পথে নামেননি, সঙ্গে বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য ছিল। হয়তো নতুন কোনও দেশের সন্ধান, বা ধর্মপ্রচার, নয়তো ব্যবসাপত্তর... কিন্তু লাভ লোকসানের প্রশ্নটা সর্বদাই জড়িয়ে থাকত যাত্রায়। কিন্তু ব্যাকপ্যাকিং লাভ লোকসানের চিরাচরিত কনসেপ্টের উর্ধ্বে।

ব্যাকপ্যাকিং সংস্কৃতি ধর্ম, দেশ, জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ ও তার সংস্কৃতিকে সম্মান জানায়। পথে অন্য দেশের, অন্য পরিবেশের লোকের সঙ্গে যখন কথোপকথন হয়, বন্ধুত্ব হয়, বোঝা যায় হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা মানুষেরা আসলে অনেকেরই আমাদের মতন। দেশ, ধর্ম, কাল, শিক্ষা, পরিবেশ ভিন্ন হলেও আমরা আসলে একই বন্ধনে জড়িয়ে আছি। এই সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি আর পরস্পরকে নির্বিশেষে বন্ধু ভেবে পথে এগিয়ে চলাই ব্যাকপ্যাকারদের লক্ষ্য। আইনকে গুরুত্ব দিলেও মনের দিক থেকে আমরা একই পৃথিবীর বাসিন্দা। সীমানা বলতে আমরা মনের সীমানাই বুঝি, কাঁটাতারের বেড়া নয়। আজকে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে, তরুণ যুবক বৃদ্ধ পিঠে রুকস্যাক নিয়ে পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে। যত কম খরচে যত বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়, এই তাদের উদ্দেশ্য। নিজের অজান্তেই চিরাচরিত ভাবনাচিন্তাকে ভেঙে তারা পৃথিবীর লোকজনকে কাছাকাছি এনে দিচ্ছে। 

গত কয়েক দশকে ব্যাকপ্যাকিংয়ে আগ্রহী মানুষজনদের একটা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ভাবে এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়। ইন্টারনেট, ক্যামেরা, স্মার্টফোন নিয়ে আজকাল নতুন যুগে 'ফ্ল্যাশপ্যাকিং' কথাটা চলনে এসে গেছে। কাউচসার্ফিং হল এরকমই একটা প্রোগ্রাম। ইন্টারনেটে কাউচসার্ফিংয়ের মাধ্যমে কোনও ব্যাকপ্যাকার পৃথিবীর যে কোনো শহরের উৎসাহী স্থানীয় লোককে অনুরোধ করতে পারে তাকে থাকতে দেওয়ার জন্যে। এইজন্যে কোনো পয়সাকড়ি দিতে হয় না। নতুন লোকেদের সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখা,  বোঝা ও নতুন বন্ধু পাতানোর জন্যেই এই অভিনব ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। কাউচসার্ফিং হোস্টরা ব্যাকপ্যাকারদের আশ্রয় দেওয়া ছাড়াও নানা ‘মিট আপ’ করতে পারে তাদের শহরে, সেখানে গিয়ে নানান দেশের নানান লোকের সঙ্গে দেখা হয়, গল্প হয়, অনেকেই বন্ধু হয়ে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখে পরবর্তী কালে। 

এহেন সেদিন আমার কাউচসার্ফিং অ্যাকাউন্ট খুলে দেখি ফ্রান্সিসকো রদ্রিগেজ বলে একজন আমায় সেরকম একটা কাউচসার্ফিং মিটআপে আসতে অনুরোধ করেছে। নির্দিষ্ট সময় গুগল ম্যাপ ধরে জায়গাটায় পৌঁছালাম। জাহারা দে অসবর্ন বলে একটা ব্যস্ত পাব। প্রচুর ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ফ্রান্সিসকো কিন্তু আমাকে দেখেই চিনেছে। ডেকে আমাদের আলাপ করিয়ে দিল অন্য কয়েকজন ব্যাকপ্যাকারের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ জমাটি আড্ডা শুরু হয়ে গেল। কয়েকজন জার্মানি থেকে এসেছে স্প্যানিশ ভাষাটা ঝালিয়ে নিতে, কয়েকজন মাদ্রিদেই ভলান্টিয়ার করছে। কিউবার একটি ছেলে বেশ কয়েক বছর ধরে স্পেনে কাজ করছিলো, তার সঙ্গে প্রচুর কথা হল। এর মধ্যে চায়না থেকে কিম, হংকং থেকে কেজ আর এস্টোনিয়া থেকে ডেভিড এসে যোগ দিয়েছে। এক গ্লাস সাঙরিয়া নিয়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প চলতে লাগল। কিছুক্ষণ আগেই কেউ কাউকে চিনত না, এখন সেখানে কথার বন্যা বইছে। ভাষার ব্যবধান মিটিয়ে চাহনি বিনিময়, তারপর সম্যক ভাবের আদানপ্রদান। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধুত্বের পেয়ালা ছলকে পড়ে। গল্প বয়ে যায় শহরের মতোই। পরস্পরের গল্প শুনতে শুনতে আবিষ্কারের আনন্দ ঝিলিক দেয় চোখে। রেশমি সবুজ পানীয় আর অ্যাম্বর লিফ তামাকের নরম ধোঁয়ায় আবিষ্ট হয়ে বসে থাকে পথের যাত্রীরা। আন্তরিক হাসির ফোয়ারায় ভর দেওয়া হাইফাইভ, বাম্প ফিস্টের পিঠে সওয়ার নির্ভেজাল আড্ডা। ছুটির আমেজে নাম পতাকার পার্থক্য অবান্তর হয়ে ওঠে। শুধু গল্প বয়ে যায়। গল্প ফিরে আসে। গল্পের পিঠে গল্প। স্মার্টফোনে সঞ্চয় করা নতুন বন্ধুত্বের চিহ্ন নিয়ে যখন ফিরছি, মাদ্রিদের আলোকোৎসব তখনও পুরোদমে চলছে।   

Image result for zahara de osborne party
Couchsurfing meet


ব্যাকপ্যাকিং নিয়ে লেখা এই বইটা কিনতে ক্লিক করুন 
https://joydhakbooks.in/product/anhc/

মাদ্রিদ প্রথম পর্ব থেকে
মাদ্রিদ প্রথম পর্ব

যাত্রার পরের অংশ
তোলেদো - প্রথম পর্ব


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন