অর্জুনের সিনেমা
(একপর্নিকা পত্রিকায় প্রকাশিত)
১) অর্জুনের বেজায় সিনেমার শখ। ছোটবেলা থেকে শুরু করে আজ পঁয়ত্রিশ বছর বয়স অব্দি সে শখ বেড়েছে বই কমেনি। শুধুমাত্র বাংলা ছায়াছবি নয়, সারা পৃথিবীর সিনেমা নিয়ে তার উৎসাহ। সত্যজিৎ রায় থেকে শ্যাম বেনেগাল, বার্গম্যান থেকে স্কোরসেজি কিছুই দেখতে বাকি রাখেনি সে। কোন পরিচালকের সিনেমাতে কিভাবে আর্ট ডিরেকশন করা হত, কোন অভিনেতা চরিত্রের খাতিরে নিজস্ব জীবনেও ক্রাইম করত, এই সব গল্প অর্জুনের মুখস্থ। শুধু সিনেমা দেখাটুকুই নয়, সেই সিনেমার অগ্রপশ্চাতের প্রতিটি খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে। ভালো সিনেমা যে আসলে কেন ভালো আর বাজে সিনেমার বাজে হওয়ার পেছনে কী কারণ, সেই বোধ তৈরি করেছে অর্জুন বছরের পর বছর ধরে।
তার ভারী ইচ্ছে, নিজেও সে একদিন চিত্র পরিচালক হবে। বাংলায় ভালো সিনেমার বড়োই অভাব। অনেকদিন ধরেই তেমন সাড়াজাগানো কাজ করছে না কেউ। মাঝে মধ্যে কয়েকটা ভালো ছবি নিয়ে হইচই হয়ে বটে কিন্তু সে তো খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজে পাওয়ার মত ব্যাপার। কলেজে পড়ার সময় থেকেই অর্জুন মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, একদিন সে নিজের সিনেমা করবেই। কিন্তু বাইরে থেকে সিনেমা দেখে যতই সোজা মনে হোক, আসলে যে একটা সিনেমা তৈরি করতে যে কী পরিমাণ পরিশ্রম থাকে, আর কত কত লোকের অবদান থাকে সেটা কেউ তলিয়ে দেখে না। আর কোনও শিল্প মাধ্যমেই এতগুলো সৃজনশীল লোক একসঙ্গে কাজ করে না। স্ক্রিপ্ট থেকে শুরু করে স্ক্রিনপ্লে লেখা, স্টোরিবোর্ডিং, আর্ট ডিরেকশন, কাস্টিং, ক্যামেরা, লাইট, সাউন্ড, এডিটিং নিয়ে যেন যুদ্ধ চলে প্রতিদিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচালককে এতো কিছু সামলাতে হয় একসঙ্গে যে সিনেমাটা শিল্প না হয়ে প্রোডাক্ট হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত। ব্যবসার তাগিদেই হোক বা ঝুঁকি নিতে না পারার কারণেই হোক, প্রয়োজকেরাও চেনা গন্ডি ছেড়ে বেশি দূর যেতে সাহস পান না। সেই জন্যেই সকলে চেয়েও ভালো সিনেমা করতে পারে না।
ছোটবেলা থেকে এই জগতের সঙ্গে কাছাকাছি থাকায় অর্জুন বুঝতে পেরেছিল যে হুটহাট করে কিছু করা চলবে না। আটঘাট বেঁধে নামতে হবে মাঠে। সেই জন্যে সে প্রথমেই পরিচালনা করার চেষ্টা না করে সিনেমার অন্যান্য ব্যাপারগুলো বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। ভারতের নানা প্রান্তে ছায়াছবির ইতিহাস ও বর্তমান কেমন সেটা বুঝে ওঠাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। সিনেমা ইউনিটের পুরোনো লোকেদের সঙ্গে কথা বলে, প্রাক্তন পরিচালকদের ইন্টারভিউ নেওয়া ও নানা ধরনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে সিনেমার হালহকিকত জানিয়ে সংবাদপত্রে লেখালিখি করা হয়ে উঠলো তার প্রধান কাজ। তারই সঙ্গে সে নিজের প্রস্তুতি চালাতে লাগল সিনেমার গল্প লেখার। কোথাও কোনও ক্যামেরা ওয়ার্কশপ হলে সেখানে গিয়ে সে যোগ দেয়, আবার এডিটিং বা স্ক্রিনপ্লে নিয়ে কাজ হলেও সেখানে হামলে পড়ে। প্রেস কার্ড থাকার দরুণ তাকে এইসব জায়গায় আলাদা করে কোনওরকম ফি দিতে হয় না।
টুক টুক করে কেটে যাচ্ছিলো সময়। যত দিন যাচ্ছে সে উৎসাহ পাচ্ছে আরো বেশি। বেশ কয়েকটা স্ক্রিপ্ট লেখা হয়ে গেছে তার। কাজের টেকনিকাল দিকগুলোর সাথে পরিচয় হয়েছে দ্রুত। নিয়মিত ভাবে ছায়াছবি সম্পর্কে লেখালিখি করার জন্যে অনেক নামকরা পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। কাজকম্মের ফাঁকে অর্জুন অনেককেই জানিয়েছে তার ইচ্ছের কথা। সে পরিচালনা করতে চায় একটা ছবি। কয়েকজন প্রযোজক আগ্রহও দেখিয়েছেন তার সঙ্গে কাজ করার জন্যে। সব কিছুই ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ঘটে গেল একটা অদ্ভুত ঘটনা।
২) অর্জুনের সংবাদপত্রের সম্পাদক হলেন পার্থবাবু। নাদুসনুদুস চেহারা, রং ময়লা, মাথার চুল পাট করে আঁচড়ানো থাকে সারাদিন। কস্মিনকালেও তিনি সিনেমা টিনেমা নিয়ে মাথা ঘামান না, তাই অর্জুনের সঙ্গে তার কথাবার্তা হয় না বললেই চলে। পার্থবাবুর ইন্টারেস্টের জায়গা হচ্ছে ক্রাইম। কোন বাড়িতে কে খুন হয়েছে, কোন ব্যাংকে টাকা লুট করতে গিয়ে একজন ব্যাংক ডাকাত গণপিটুনি খেয়েছে এই সব খবর পেলে তার নাকের পাটা ফুলে ওঠে উত্তেজনাতে। এহেন পার্থবাবুর সাতসকালে যদি অর্জুনের কাছে ফোন আসে দেখা করার জরুরি তলব দিয়ে তাহলে অবাক হওয়ারই কথা।
ফোনটা কানে লাগাতেই পার্থবাবুর বাজখাঁই গলা শুনতে পেলো অর্জুন, “এই যে ভায়া। তাড়াতাড়ি চলে এস। একটা জব্বর ক্রাইমের খবর পেয়েছি। জলদি এস..”
অর্জুন কোনও রকমে বলার চেষ্টা করল, “স্যার। আমি তো ওই ব্যাপারগুলো ঠিক বুঝি না। আপনি সুবিমলকে ফোন করতে গিয়ে মনে হয় ভুল করে আমাকে ফোন করে ফেলেছেন।”
পার্থবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন, “এই যে শোনো ছোকরা, তুমি যে ওই ফিলিম ফিলিম করেই ঘুরে বেড়াও সে আমার জানা আছে। ঠিক লোককেই ফোন করেছি। কথা হলো এই ক্রাইমটার সাথে ফিলিমের একটা যোগাযোগ আছে হে। নাহলে তোমার মত ক্যাবলাকে ফোন করতে আমার বয়ে গেছে। যত তাড়ারাড়ি পারো এসে আমার কেবিনে দেখা করো।”
ফোন ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়লো অর্জুন। ফিলিম লাইনের ক্রাইম। আবার কোনও অভিনেতা টভিনেতা আত্মহত্যা করল নাকি? তা হলেও সে আর কি করতে পারে? কিন্তু বুড়ো যখন বলছে একবার যেতেই হয়। হুড়মুড় করে তৈরি হয়ে বাস ধরে যতক্ষণে অফিসে পৌঁছলো অর্জুন, ততক্ষণে সাড়ে দশটা বেজে গেছে। পার্থবাবু সিগারেট টানছিলেন। তাকে দেখেই বললেন, “এই যে ভায়া! এসে গেছো..বসো!”
অর্জুন চেয়ার টেনে বসলো। পার্থবাবু কতগুলো বলার আগে একটু গুছিয়ে নিলেন। তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “দেখো হে। আমি জানি তুমি ক্রাইম ফ্রাইম কিছু বোঝো না। তাই ময়না তদন্তের খবর আনার কাজ তোমার নয়। তোমার দায়িত্ব অন্য।“
অর্জুন মাথা নেড়ে বলল, “স্যার। ব্যাপারটা পুরোটা না শুনলে তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে বললেন পার্থবাবু, “শপথ দাসের নাম শুনেছ? ফিল্ম ডিরেক্টর।”
অর্জুন ঘাড় নাড়ল। ভদ্রলোককে সে চেনে। নামকরা লোক। সবসময় খবরের শিরোনামে থাকেন। বেশ কয়েকটা সিনেমা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার টুরষ্কার পেয়েছে। অর্জুনের সঙ্গে কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। অনেক বয়স হয়েছে যদিও, স্বভাবে ছেলেমানুষের মত ছটপটে। সোজা সাপ্টা কথা বলে দেন মুখের ওপরে বলে সিনেমাজগতে অনেকেই ওর ওপর হাড়েচটা। অর্জুন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।
পার্থবাবু এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “শপথ দাসকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি পরশু রাত থেকে নিরুদ্দেশ।”
৩) একটা মোটা চশমার ফ্রেম, একটা কালির কলম, কয়েকটা ক্যামেরার সরঞ্জাম আর একটা হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট পাওয়া গেছে শপথ দাসের বাড়ির কামরা থেকে। স্ক্রিপ্টটা বহুদিনের পুরোনো বলে পাতাগুলো হলদেটে হয়ে গেছে। কিন্তু মজার কথা হলো স্ক্রিপ্টে লেখকের অথবা গল্পের নাম লেখা নেই যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, স্ক্রিপ্টের হাতের লেখা শপথবাবুর নয়। পুলিশের ধারণা, শপথবাবু নিজের জালে নিজে জড়িয়ে পড়েছেন। ইদানীং কোনও প্রযোজক তাকে সিনেমা করার জন্যে টাকা দিতে চাইছিলো না, তার সিনেমা পুরস্কার পেলেও বাজারে টিকিট কেটে লোকে দেখতে আসে না। তার ওপর মন জুগিয়ে কথা বলার লোক কোনওদিনই নন শপথবাবু। এই নিয়ে বদনামও আছে! তাই তিনি দুষ্কৃতীদের কাছ থেকে মোটা সুদে টাকা ধার করেছিলেন। সেই টাকা ফিরিয়ে দিতে অনেকদিন ধরেই চাপ সৃষ্টি করছিলো দুষ্কৃতীরা। কাগজপত্রের মধ্যে তাদের পাঠানো হুমকি চিঠি দেখতে পেয়ে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু এতো সব তদন্তের মধ্যে অর্জুনের জড়িয়ে পড়ার তাও কোনও দরকার ছিল না যদি পার্থবাবু শপথবাবুর তাকে লেখা চিঠিটা তাকে দেখাতেন। সকালবেলা পার্থবাবুর সাথে দেখা করতে গিয়ে অর্জুন জানতে পারে যে হপ্তাখানেক আগেই শপথবাবু তাদের সংবাদপত্রের সম্পাদক পার্থবাবুর কাছে সংক্ষিপ্ত একখান চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সিনেমার প্রোমোশন আর নিজের সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুরোধ করে পরিচালকেরা সম্পাদকদের আকছার চিঠিপত্তর লেখেন। পার্থবাবু তার ওপর সিনেমা ফিনেমা নিয়ে একেবারেই উদাসীন। চিঠিটা খুলেও দেখেননি। কিন্তু কালকে তার নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা শুনেই তার সন্ধানী মন জেগে ওঠে। তাড়াতাড়ি দেরাজ হাতড়ে চিঠিটা খুঁজে বের করেন তিনি। চিঠির বক্তব্য পড়ে তার তো মাথা ঘুরে যায়।
সামান্য কটা লাইন লেখা ছিল চিঠিতে।
“পার্থবাবু,
সামান্য দরকারে আমি আপনাকে চিঠি লিখতাম না। খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের লোকজনের সঙ্গে যে আমার সদ্ভাব নেই সে কথা অনেকেরই জানা। কিন্তু এখন সে বাদবিচার করার সময় নেই। আপনার সাহায্য আমার একান্তই প্রয়োজন। আপনার সঙ্গে আমার ভালো খারাপ কোনও সম্পৰ্ক নেই বলেই আপনাকে এই চিঠি লিখছি। অন্য যে কোনজন এই চিঠি পড়ে সত্যতা যাঁচাই না করেই আমার মস্তিষ্কের বিকৃতির কথা প্রচার করতো বলেই আমার মনে হয়। কিছুদিন আগে একটা পুরোনো রাজবাড়িতে শুটিং লোকেশান দেখতে গেছিলাম। প্রযোজকেরা যদিও আমাকে টাকা দিতে ইতস্তত করে সিনেমা করার জন্যে, তাই ভেবেছিলাম শেষ সিনেমাটা নিজের পয়সাতেই করবো। সেই রাজবাড়িতে হঠাৎ করেই আমি এমন এক মহামূল্যবান জিনিসের সন্ধান পাই, যার মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় তিরিশ কোটি টাকা। এমনিতে জিনিসটা সাধারণ কিন্তু যারা সিনেমা নিয়ে চর্চা করে শুধু তারাই এই জিনিসের মূল্য বুঝবে। পুরোনো সেই রাজবাড়িতে জিনিসটা অযত্নে পড়ে ছিল। আমি কাউকে না বলে জিনিসটা হস্তগত করি। এতে আমি কোনও দোষ দেখিনি। ইচ্ছে ছিল কোনও কালেক্টারকে জিনিসটা বিক্রি করে পরের সিনেমাগুলোর জন্যে টাকার ব্যবস্থা করবো। কিন্তু সে আর সম্ভব নয়। আমি ঘোর বিপদে পড়েছি। বাজারে আমার অনেক ধার। সে ধার সুদে আসলে বেড়ে এখন আমার আয়ত্তের বাইরে পৌঁছেছে। যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম তার ক্রমাগত আমাকে হুমকি দিয়ে চলেছে। ভুল করে একদিন আমি ওদের বলে দি যে আমার কাছে মহামূল্যবান একটা জিনিস আছে। তার পরেই বুঝতে পারি নিজের সর্বনাশ আমি নিজেই ডেকেছি। তিন দিন তারা আমার বাড়ি তছনছ করে গেছে। আমার কাছে সময় বেশি নেই। যদি আপনি এই মহামূল্যবান এন্টিকটা নিয়ে একটা ফিচার করতে পারেন যাতে অকশান করে জিনিসটা বিক্রি করা যায় আমি লাভের একটা অংশ আপনাকে দেব। আমি নিজে যতটা সম্ভব গা ঢাকা দিয়ে আছি। এই মুহূর্তে এই জিনিসের খরিদার জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সঙ্গে দেখা করুন।
বিনীত
শপথ দাস
পার্থবাবু বুঝতে পেরেছিলেন চিঠিটা আগে না পড়ে কি সাংঘাতিক ভুল তিনি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে ওই লোকগুলো তাকে কিডন্যাপ করেছে, হয়ত সেই মূল্যবান জিনিসটাও হাতিয়ে ফেলেছেন তার কাছ থেকে। এত বড় ‘স্কুপ’ হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু এখনো যদি খোঁজখবর করে জানা যায় কি জিনিস উদ্ধার করেছিলেন শপথবাবু তাহলে সেই গল্পটা দিয়ে নাহয় কিছুটা লোকসান চাপা দেওয়া যাবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জিনিসটা তিনি নিজে চিনতে পারবেন বলে মনে হয় না, সিনেমা টিনেমা সংক্রান্ত জিনিস নিয়ে তার জ্ঞান নেই। যদি পুলিশের কাছ থেকে তার বাড়ির ভিতর ঢুকে খোঁজাখুঁজির অনুমতি পেয়েও যান তাহলেও লাভ হবে না। তাই ডাক পড়েছে অর্জুনের। ভাগ্যক্রমে যদি এখনো জিনিসটা তার বাড়িতেই লুকিয়ে থাকে। অর্জুন ছাড়া আর কে আছে যার ওপর ভরসা করবেন তিনি।
৪) একমনে ব্যাপারটা শুনলো অর্জুন। রীতিমতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা। কী পেয়েছিলেন শপথবাবু সেই রাজবাড়ির ভিতর থেকে? পুরোনো কোনও মুভিক্যামেরা? কোনও নামকরা পরিচালকের অপ্রকাশিত স্ক্রিপ্ট? সিনেমা জগতে এই ধরণের এন্টিককে বলা হয় সিনেমা মেমোরাবিলিয়া। প্রচুর দাম দিয়ে কলেক্টররা কেনেন এইসব। জেমস বন্ডের অস্টিন মার্টিন গাড়ি, মাই ফেয়ার লেডিতে অড্রে হেপবর্ণের ড্রেস অথবা কাসাব্লাঙ্কা ছবির পিয়ানো নিলাম হয়েছে কয়েক কোটি টাকায়। কিন্তু মেমোরাবিলিয়া বাজারে অনেক জালি জিনিসও থাকে। অনেকসময় কিছুতেই বুঝে ওঠা যায় না কোনটা আসল কোনটা নকল। বড় গাড়ি, পিয়ানো, ক্যামেরা ইত্যাদির তাও রেকর্ড থাকে কিন্তু কোনও ড্রেস, কোনও আংটি, কোনও ছোট মডেলের বেলায় রেকর্ড রাখা অসম্ভব। শপথবাবু যা পেয়েছিলেন তা জাল না সত্যি তা বোঝার আগে জিনিসটা কি জানা দরকার। কিন্তু সেটা সে খুঁজবে কি করে। পার্থবাবুকে সে কথা বলতেই তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন, “আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। ওই কেসটার তদন্ত করছে সুদীপ। থানায় চলে যাও সব খবর পেয়ে যাবে।”
অফিস থেকে বেরিয়ে থানার দিকে চললো অর্জুন। সিনেমার গল্পের মত ব্যাপার। ভাগ্যক্রমে যদি কিছু সুরাহা হয়ে যায় কেসটার এই নিয়েই একটা স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলবে না হয়। প্রথম কাজ হলো শপথবাবুর বাড়ি থেকে কি কি জিনিস পাওয়া গেছে, সেগুলো দেখা। তারপর দেখতে হবে শপথবাবু কোন রাজবাড়িতে শুটিং করতে গেছিলেন। সেখানে একবার তাকেও যেতে হবে। তাড়াতাড়ি পা চালালো অর্জুন।
৫) আন্দুল রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অর্জুন অবাক হয়ে গেল। হাওড়া জেলায় যে এরকম একটা জমিদারদের প্রাচীন বাড়ি আছে সে সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। জায়গাটা সরকারের দিক থেকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু অনেকটা জায়গা জুড়ে এখনো অব্যবস্থিত ভাবে পড়ে আছে একশো দুশ বছর আগেকার সরঞ্জাম। প্রায় দেড়শো বছর ধরে এখানকার জমিদারদের বাসস্থান ছিল এই বাড়িটা। থানায় গিয়ে সুদীপবাবুর কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অর্জুন তেমন কিছু জানতে পারেনি। শুধু শপথবাবুর বাড়ি থেকে পাওয়া পুরোনো হাতে লেখা স্ক্রিপ্টটা পুলিশের কোনও কাজে লাগছিলো না বলে অর্জুনের অনুরোধ এড়াতে পারেননি তারা। স্ক্রিপ্টটা এখন তার ব্যাগের ভিতর। যদিও মনে হয় না সেই লেখাটার সঙ্গে এই কেসের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক আছে। তারপর শপথবাবুর বাড়িও ঘুরে এসেছে অর্জুন। তন্ন তন্ন করে সব ঘর দেখে অর্জুন একটা জিনিস বুঝেছে নিজের সিনেমা ছাড়া ভদ্রলোকের অন্য কোনও বিষয় নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না। ঘরে দামি জিনিস বলতে তেমন কিছুই নেই। শুধু দেদার স্ক্রিপ্টের খসড়া, কবিতার কয়েকটা বই, একটা ট্রাইপড ক্যামেরা আর কয়েকটা সিডি। অর্জুনের অবশ্য সেই স্ক্রিপ্টের অগোছালো স্তুপের মধ্যে বসে থাকতে দারুণ লাগছিলো। যেন গল্প রাজ্যে চলে এসেছে। চোখের সামনে দিয়ে চিত্রনাট্য চলছে অসমাপ্ত লেখাগুলোর। সেখান থেকে বেরিয়ে পার্থদার সঙ্গে ফোনে কথা বলে যখন আন্দুলে এসে পৌঁছলো অর্জুন সন্ধ্যে হবো হবো করছে। তার আজকে এখানে থাকার বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। রাধাকৃষ্ণ আর অন্নপূর্ণার মন্দির ছাড়িয়ে অর্জুন যখন তার নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছলো, দিনের আলো নিবে এসেছে। আজকে তাকে এখানেই থাকতে হবে। কাল সকালে এখানে তল্লাশি চালাতে হবে যদি কোনও সূত্র পাওয়া যায়। এই জায়গাটা পাণ্ডববিবর্জিত নয়, অনেকেই রাজবাড়ী দেখতে আসে। এখানে শপথবাবু কোথায় মহামূল্য কোনও জিনিস খুঁজে পেলেন তা খুঁজে বের করা কঠিন ব্যাপার। এখানকার জমিদারেরাও সিনেমা ফিনেমা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন বলে তো মনে হয় না। আস্তে আস্তে অন্ধকার গভীর হচ্ছে। কাছেই আন্দুল বলে একটা নদী আছে বলে শুনেছে অর্জুন। সেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগছে। শীত শীত ভাব কাটাতে এক কাপ চা পেলে মন্দ হতো না। একটা লোক আছে মান্টু বলে, সেই তার জন্যে রান্নাবান্না করে দেবে। ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁক পারল অর্জুন।
“মান্টু, ও মান্টু।”
মান্টু দূর থেকে দৌড়ে এল, “হ্যাঁ দাদাবাবু। কিছু লাগবে?”
“হ্যাঁ, একটু চা হলে মন্দ হতো না, হবে?”
“কেন হবে না দাদাবাবু! এই করে আনছি। রাতে খিচুড়ি করছি। খান তো?”
অর্জুন হেসে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। খিচুড়ি আমার দারুণ লাগে। রসুন না দিলেই হল! থ্যাংক ইউ মান্টু।”
মান্টু একগাল হেসে চলে গেল। অর্জুন ধীর পায়ে সামনের গাছের দিকে এগিয়ে গেল। কী একটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে এই অন্ধকারেও। প্যাঁচাও হতে পারে। শহরের এতো কাছে যে এরকম একটা জায়গা থাকতে পারে, ভাবা যায় না। আকাশে এক ফালি চাঁদ তখন দেখা দিয়েছে। সিনেমাটিক সাইলেন্স বলে একটা কথা হয় সিনেমা জগতে। প্রকৃতি আর মানুষের চরিত্রের মধ্যে একটা বোঝাপড়া আছে, একটা দৃশ্য একটা চরিত্রকে নতুন মাত্রা দিতে পারে সিনেমার পর্দায়। অর্জুনের প্রিয় পরিচালক হলেন টেরেন্স মালিক। তিনি এই ব্যাপারটা সুন্দর করে তুলে ধরেন তার ছবিগুলোতে। আবার উডি আলেনের ছবি যেমন এক একটা শহরের চরিত্রের সঙ্গে তার সিনেমার চরিত্রের মিল খুঁজে পাওয়ার সম্পর্ককে তুলে ধরে।
অর্জুন বসে বসে ভেবে যাচ্ছিলো, এমন সময় মান্টু চা নিয়ে এল। তার হাতে চা দিয়ে বলল, “দাদাবাবু। কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার হয়ে যাবে। একটা কথা দাদাবাবু, রাতে একটু সাবধানে থাকবেন। ঘর থেকে হুটহাট বেরোবেন না।”
অর্জুন চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল। বলল, “কেন? কী ব্যাপার মান্টু?”
মান্টু একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “না, লোকে বলে এ বাড়িটা ভালো না। অনেক কিছু দেখা দেখা যায়।”
অর্জুন কৌতূহলী হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। ভৌতিক ব্যাপার নাকি? এটা তো জানা ছিল না। এতো কেঁচো না খুঁড়তেই সাঁপ। কিন্তু অনেক জিজ্ঞেস করেও মান্টুর মুখ খোলানো গেল না আর। অর্জুন নিজের মনেই হেসে ফেলল। ভালোই কাণ্ড! সকাল থেকে একটা হারিয়ে যাওয়া লোক, গুপ্তধনের খোঁজ, কিডন্যাপিংয়ের গল্প, শেষে ভূত। এক স্ক্রিপ্টে এতো গোঁজামিল দিলে খিচুড়ি হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং সুদীপবাবুর কাছ থেকে চেয়ে আনা স্ক্রিপ্টটা পড়া যাক খেয়েদেয়ে। বাকিটা কাল সকালে দেখা যাবে।
ঘন্টাখানেক পর মান্টু তার খাবার দিয়ে চলে গেল। এ বাড়িতে এখনো কারেন্ট নেই। একটা লণ্ঠন রেখে গেছে সে। খাওয়ার পর অর্জুন নিজের ঘরে গিয়ে লণ্ঠনের আলোয় স্ক্রিপ্টটা বের করল। তুলোটে কাগজটা উল্টোতেই প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখা দেখতে পেল সে। The nth Project.
৬) রাত গভীর হয়েছে। অর্জুন এক মনে স্ক্রিপ্ট পড়ে যাচ্ছে। লেখকের হাতের বাঁধুনি চমৎকার। প্রথমটা একটু নড়বড়ে লাগলেও একটু এগোতেই গল্পটা জমে গেছে। এতো অভিনব চিত্রনাট্য বাংলায় আগে পড়েনি অর্জুন। এমন সময় একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে অর্জুনের মনোযোগ কেটে গেল। ঘরের বাইরে একটা কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। যেন পা টেনে টেনে কে যেন হাঁটছে। কিন্তু এখন তো কারো আসার কথা নয়। মান্টু বাড়ি ফিরে গেছে রাত দশটার সময়। এমন সময় অর্জুনের মাথায় একটা সম্ভাবনার কথা চিড়িক দিয়ে উঠলো। সে এখন সারা রাজবাড়িতে একা। রাজবাড়িতে ভূতের বদনাম আছে। অর্জুন যুক্তিবাদী কিন্তু এখন সে বুঝতে পারল তার গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেছে। সে কাঠ হয়ে বসে রইলো। শব্দটা একটু একটু করে এগোতে লাগল তার ঘরের দিকে। অর্জুন এবার স্পষ্ট বুঝতে পারছে ভয়ে সে মাথা ঘোরাতে পর্যন্ত পারছে না। সে মনকে বোঝাবার চেষ্টা করল, হয়ত বেড়াল-ফেরাল, কিংবা মান্টুই তাকে দেখতে এসেছে, কিন্তু কিছুতেই সেই অস্বস্তিকর ভয়ের অনুভূতি তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না। তার বুকের মধ্যে জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে।
এমন সময় ঘরের মধ্যে একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। শিউলি ফুলের গন্ধ। পায়ের সাড় চলে গেছে। অর্জুন বুঝতে পারছে এক অশরীরী অনুভূতিতে তার বোধশক্তি কাজ করছে না, পায়ের শব্দটা তার টেবিলের দিকে আসছে ধীর পায়ে। এবার সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। প্রচন্ড মনের জোরে সে এক ঝটকায় মাথাটা ঘুরিয়ে নিলো পিছনে। কেউ নেই। অর্জুন ভয়ে কাঁটা হয়ে গেছে। ঠিক তখনই তার কানের কাছে খুব আস্তে কে যেন বলল, “স্ক্রিপ্টটা কেমন লাগছে?”
প্রচন্ড ভয়ে আঁতকে উঠে অজ্ঞান হবো হবো করেও অর্জুন জ্ঞান হারাল না। তার শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ধুতি পড়া একজন ভদ্রলোক। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। চোখে চশমা। মুখে মিহি হাসি। গোলগাল চেহারা। অর্জুন হাঁ হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো খানিকক্ষণ। জ্যান্তলোকের মতোই দেখতে লাগছে বটে, কিন্তু তার যুক্তি বলছে এই অজপাড়াগাঁয়ে রাতদুপুরে এসে এমন অদ্ভুতুড়ে প্রশ্ন যে করে, সে ভূত না হয়ে যায় না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে অর্জুন বলল, “দেখুন। আগে একটা কথা সত্যি সত্যি বলুন তো? আপনি কি ভূত?”
লোকটা ফিক করে হেসে মাথাটা একটু হেলিয়ে বলল, “নিজের কথা নিজে কি আর বলতে আছে? তবে ওই আর কি!”
অর্জুন রেগে গেল, “ওই আর কি মানে কি? আপনি ভূত কিনা ঠিক করে বলুন।”
লোকটা এবার চশমাটা ঠিক করে নিতে নিতে বলল, “সেই রকমই তো মনে হয়।”
অর্জুন চেঁচিয়ে উঠলো, “মানে? আপনি ভূত?”
এবার লোকটা বেশ রেগে গেল। এক ধমক দিয়ে বলল অর্জুনকে, “বার বার এক সিন করছেন কেন বলুন তো? অন্য ডায়ালগ নেই? বলছি তো আমি ভূত।”
অর্জুন এবার আঁ আঁ করে অজ্ঞান হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই সে অজ্ঞান হচ্ছে না তো। ভয় লাগছেও বটে কিন্তু সে পালাচ্ছে না কেন? ভারী বিরক্ত হয়ে সে বলল, “আপনি ভূত হলে আমি ঠিকঠাক ভয় পাচ্ছি না কেন? আপনি কি এই রাজবাড়ির ভূত?”
ভূতটা এবার ধুতিটা ঠিক করে খাটের ওপর উঠে বসল। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে নিয়ে জ্বালিয়ে বলল, “বাজে বকছেন কেন বলুন তো? আমি এই রাজবাড়ির ভূত নই। আপনাকে জানিয়ে রাখি, এই রাজবাড়িতে কোনও ভূত ফুত কোনওকালে ছিল না।”
অর্জুন বলল, “তাহলে আপনি এলেন কোথেকে?”
ভূতটা এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “আপনিই তো নিয়ে এলেন ব্যাগে করে।”
অর্জুন হাঁ হয়ে গেল। ভূতটা এবার একটু লজ্জা লজ্জা পেয়ে বলল, “বলছি বলছি। ধৈর্য না থাকলে কি হয়! আপনি যে স্ক্রিপ্টটা আপনার ব্যাগে নিয়ে ঘুরছেন ওটা এই অধমেরই লেখা। আসলে কি জানেন, ওটার মায়া ছাড়তে পারিনি আজও। বড় শখ করে, বড় সময় নিয়ে লিখেছিলাম তো।”
অর্জুন এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছে। লোকটা ভূতই বটে কিন্তু ভূত যদি সিনেমাপ্রেমী হয়, তাহলে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। বোঝা যাচ্ছে ভুতটা আবার লেখালেখিও করেছে এককালে। এর সঙ্গে কথা বলা দরকার। সে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, “কিন্তু লেখাটা তো আমি পেলাম শপথবাবুর কাছ থেকে। আপনার লেখা ওর কাছে গেল কি করে? একটু খুলে বলবেন ব্যাপারগুলো? মনে হচ্ছে আপনি অনেক কিছু জানেন এ ব্যাপারে।”
ভূতটা একটু উদাস হয়ে বলল, “তা বলতে পারো। অনেক কিছু কেন, আমি সব কিছুই জানি। তুমি তো... তোমাকে তুমিই বলছি, অনেক ছোট তুমি। তুমি তো সিনেমা করবে বলে স্বপ্ন দেখছো, দেখো যদি কিছু বোঝো। আমিই এই গল্পে পালের গোদা।”
অর্জুন বলল, “বলুন না স্যার। সারারাত বাকি। অসুবিধে তো কিছু নেই।”
ভূতটা হেসে বলবো, “বলছো? তাহলে শোনো। দাঁড়াও আগে একটা সিগারেট খেয়ে নি। আর ওইসব স্যার-ট্যার চলবে না। আমার ডাক নাম বুম্বা, বুম্বাদা বলে ডেকো। ভালো নাম শৌভিক বোস।”
বুম্বাদা তার গল্প শুরু করল।
৭) বহুবছর আগের কথা। তখন আমি ধুলিভরাপুরম বলে দক্ষিণ ভারতের একটা বর্ধিষ্ণু এলাকায় থাকি। ভালো চাকরি। এমন সময় আমার মাথায় সিনেমার পোকা নাড়া দেয়। আমরা বেশ কয়েকজন একটা নাটকের দলে (এনাদ) শখের নাটক করতাম। সেখানেই আমার সঙ্গে আলাপ হয় বেশ কয়েকজন ছেলের। শপথ দাস তাদেরই একজন। সে তখন নেহাৎই বাচ্চা। কিন্তু সিনেমা অন্তপ্রাণ। পড়ালেখা চুলোয় দিয়ে খালি মাথায় সিনেমা করার চিন্তা। আমি অবশ্যি তোমারই মতন আটঘাট বেঁধে নামায় বিশ্বাস করতাম। ধীরে ধীরে আমরা সবাই মিলে একটা সিনেমার দল গড়ে তুলি। স্ক্রিপ্ট লেখা হচ্ছে, নতুন সিনেমা দেখা হচ্ছে, শর্টফিল্ম নিয়ে কাজ চলছে। কিন্তু কিছুদেই আমরা সিনেমা বানানোর আসল জমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় শপথ কলকাতায় ফিরে আসে। নিজের মত করে চেষ্টা চরিত্র করতে আরম্ভ করে সিনেমার জগতে। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না, তাই তোমারই মতন একটা বাঁধাধরা কাজের সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টাচরিত্র চালাচ্ছিলাম নিজের জায়গা খুঁজে পাওয়ার। বেশ কয়েকটা শর্টফিল্ম পরিচালনা করে তখন আমার বেশ নামডাক হয়েছে। টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে আমার একটা ছবি সে বছর বেশ নাম করেছে।
এমন সময় আমার মাথায় একটা গল্প আসে, সিনেমার গল্প। একেবারেই অভিনব আইডিয়া, চিত্রনাট্যের প্রতিটা খুঁটিনাটি সোজা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমি সেই গল্পটা নিয়ে কাজ শুরু করি। ভেবেছিলাম এই গল্পটা হবে আমার ড্রিম প্রজেক্ট। কিন্তু আস্তে আস্তে গল্পের সঙ্গে আমি এমনভাবে জড়িয়ে পড়ি যে প্রতিটা ড্রাফট লেখার পর আমার মনে হতে শুরু করে, এর চেয়েও ভালো করা যায়। এমন সময় আমার জীবনে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। টরেন্টো ফিল্ম স্কুল থেকে আমাকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেকচারারশিপের কাজ দিয়ে ডেকে পাঠালো। প্রতি শনি রবিবারে আমাকে সেখানে ওয়ার্কশপ করাতে হবে। টরেন্টোতে একটা বাঁধাধরা চাকরিও জুট গেল আমার। কাজ আর সিনেমা নিয়ে তরতর করে এগিয়ে চললো সময়। টরেন্টো ফিল্ম স্কুলে একটা সময় আমি স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করি। বেশ কয়েকটা সিনেমা পরিচালনা করি সেখানে। কিন্তু আমার বাংলা ছবি আর ড্রিম প্রজেক্ট অধরা থেকে যায়। এরকম করে সময় কাটতে থাকে। এই সময় আমার জীবনে একটা মোড় আসে। টরেন্টোর বিখ্যাত অকশান হাউস আমাকে পার্টনারশিপ অফার করে। সিনেমা সংক্রান্ত যে সব মেমোরাবিলিয়া নিয়ে অকশন হবে তার তত্বাবধানে আমি যোগ দিই। ততদিনে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। বছর কয়েক পরে সেখানে আমার হাতে এসে পৌঁছয় একটা আশ্চর্য জিনিস। একটা বাজপাখির মূর্তি যা বিখ্যাত ছবি The Maltese Falcon এ দেখানো হয়েছিল। আমি জিনিসটা হাতে পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যাই। কেননা এই জিনিস আগেই একজন তার ব্যক্তিগত কালেকশানে রেখেছেন। এই একই মূর্তির দাম নিলামে উঠেছে প্রায় কুড়ি কোটি টাকা। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি যে আসলে এই ফ্যালকন স্ট্যাচু একসঙ্গে চারটে তৈরি করা হয়েছিল। সবকটাই সিনেমার সেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে এতো জলঘোলা করা হয় যে আমরা সেই মেমোরাবিলিয়াটা নিলাম করতে পারিনি।
অবশেষে আমি জিনিসটা নিজের কাছেই রেখে দিই। এমন সময় শপথের সঙ্গে আমার দেখা হয় টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। সে ততদিনে সিনেমা টিনেমা করে বেশ নাম করেছে দেশে। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ঠিক করি আমি তাকে সঙ্গে করে আমার ড্রিম প্রজেক্টটা আরম্ভ করবো। প্রযোজক পেতে আমার কোনও অসুবিধে হলো না। কিন্তু এর মাঝে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেছে লোকেশন দেখে প্রিপ্রোডাকশন শেষ করতে। অবশেষে সেই দিনটা এসে উপস্থিত হলো। শপথ আর আমি আবার আগের মত একসঙ্গে সিনেমার সেটে এসেছি প্রথম দিন। জানো কোথায়? এই রাজবাড়িতেই। এখানেই নির্ধারিত ছিল আমাদের প্রথম দিনের শুটিং। কিন্তু যদি ভাগ্য সহায় না হয় তাহলে শত কাঠখড় পোড়ালেও কোনও লাভ হয় না। আমি হঠাৎ করে সেটেই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সেই আমার সিনেমা পরিচালনার শেষ দিন। তারপর যখন চোখ খুললাম সশরীরে সিনেমা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
বুম্বাদা একটু থামলেন। অর্জুন বলল, “তারপর?”
বুম্বাদা বললেন, “তারপর আমি বুঝতে পারলাম আমি ওই অপূর্ণ স্ক্ৰিপ্ট এর মোহে পড়ে গেছি। আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখা, সবচেয়ে বেশি চাওয়া লেখার পিছুটান আমি কিছুতেই কাটাতে পারলাম না। কত বছরের স্বপ্ন! শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করি যদি শপথ কোনওরকমে আমার অপূর্ণ স্বপ্নটা শেষ করতে পারে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু একজন ভূত হয়ে একজন জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে দেখা করা কি চাট্টিখানি কাজ। শপথ আর আমার নামে একসঙ্গে গল্পটার রাইট ছিল, কিন্তু শপথ ততদিনে অনেকচেষ্টা করেও কোনও প্রযোজক জোগাড় করতে পারেনি এই প্রজেক্টের জন্যে। এমনকি সে গুণ্ডাবদমাশদের কাছেও টাকা ধার করেছিল যদি কোনও রকমে টাকা ধার করে সিনেমাটা নেমে যায়। এই ছেলেটার সঙ্গে আমার প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়েছে সিনেমা নিয়ে একসময়, ওর সিনেমা আর আমার সিনেমার ভাষা একদম আলাদা। কিন্তু যেইদিন শপথ একা এসে বসল এইখানে দিন পনেরো আগে আমি বুঝতে পারলাম শপথ ছাড়া কেউই আমাকে মুক্তি দিতে পারবে না। আমাদের ভাবনা, সিনেমার চিন্তা আলাদা হতে পারে কিন্তু সিনেমার জন্যে আমাদের ভালোবাসা একই। শপথের সামনে এসে দাঁড়াতেই সে আমাকে দেখতে পেলো। তারপর থেকে শুরু হলো একজন অশরীরী আর একজন জীবিত মানুষের ছবি করার পরিকল্পনা, একসঙ্গে। কেমন লাগছে ভাবতে?”
অর্জুন তখন বিহ্বল হয়ে শুনছে এই গল্প। সিনেমার পাগলামিতে সে এদের ধারে কাছে যায় না। সে বলল, “অসামান্য। তারপর কী হল?”
বুম্বাদা বললেন, “তারপর আমি ঠিক করলাম এই সিনেমা শেষ করার জন্যে একমাত্র পথ আমার সঞ্চিত মেমোরাবিলিয়াটাকে বিক্রি করা। সেটা আমি সঙ্গে করে এনেছিলাম কলকাতায়, সিনেমাটা শেষ করে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে দেব বলে কিন্তু সেই সময় আর হয়নি। জিনিসটা রয়ে গেছিলো আমার জিনিসপত্রের মধ্যেই। আমি আমার লুকিয়ে রাখা বাজপাখি তুলে দিই শপথের হাতে। এর পরের ঘটনা তো তুমি জানোই। মেমোরাবিলিয়া পেয়ে শপথ সেটাকে বিক্রি করার চেষ্টা করে কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তার মত লোকের পক্ষে এমন একটা জিনিস বিক্রি করা সোজা কথা নয়। এদেশে এমনিতেই ওই জিনিসের কদর বুঝবে না কেউ। তাই সে সংবাদপত্রে চিঠি পাঠিয়ে সাহায্য চেয়েছিলো যদি কোনওরকমে কেউ তাকে জিনিসটা বিক্রি করতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল সেই ব্যাপারটা।”
“কি ঘটে গেল? কোন ব্যাপারটা?”
অর্জুন প্রশ্ন করে। শৌভিক বোস উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাকে পিছনে আস্তে ইঙ্গিত করে এগিয়ে যান বাইরের দিকে। অর্জুন সম্মোহিতের মত তার পিছন পিছন চলতে থাকে।
৮) লম্বা দালান পেরিয়ে বাড়ির পিছন দিকে চলেছে তারা। অর্জুন অন্ধের মত হাঁটছে শৌভিক বোসের ছায়ামূর্তির পিছন পিছন। এই পথ, সেই পথ, এই ঘর সেই ঘর পেরিয়ে তারা একটা ছোট কামরায় পৌঁছল। ঘোরানো সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে। ঘরের মেঝে ধসে পড়েছে। বহু নীচে দেখা যাচ্ছে অতল গহ্বর। বোঝাই যাচ্ছে দিকটা আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে পড়লো। অর্জুন জিগ্গেস করল, “এখানে থামলেন কেন? এখানে কি আছে?”
বুম্বাদা বললেন, “এই বাড়িটা আমার পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। জমিদারি শেষ হওয়ার পর সবাই উত্তরপাড়ায় চলে যায় কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার এই জায়গাটা সম্পর্কে একটা মায়া রয়ে গেছে। সেইজন্যেই বোধহয় এখান থেকেই শুরু করতে চেয়েছিলাম আমাদের সিনেমার যাত্রাটা। এই ঘরটার নীচে একটা লুকোনও ঘর আছে। শপথ সেখানেই লুকিয়ে রেখেছিলো আমার মেমোরাবিলিয়াটাকে যাতে তার বাড়িতে হামলা করা লোকেদের হাতে সেটা ভুল করেও না পড়ুক। কিন্তু আমিও জানতাম না যে তার পরিণতি এরকম হবে। সেইদিন বিকেলে এইখান থেকে জিনিসটা বের করতে গিয়েছিলো শপথ, ঠিক তক্ষুণি পুরো ঘরটা ধসে পড়ে। মেঝেতে ফাটল ধরেছিলো। শপথ গিয়ে পড়ে ১০০ ফিট নীচে।”
অর্জুন কোনও কথা বলতে পারে না। কেটে যায় খানিকটা সময়। কিছুক্ষণ পর অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আপনার জিনিসটা?”
“এই যে।” অন্য একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে অর্জুন। বুম্বাদার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শপথবাবুর প্রতিকৃতি। মাথার একপাশে অনেকখানি কাটা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মুখে হাসি। শপথবাবুর আবার বলেন, “হ্যাঁ। আমিও বুম্বাদাকে সঙ্গ দিলাম। এককালে প্রচুর লড়াই করেছি, কিন্তু নিয়তি আমাদের একসঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল। মরার সময় অবশ্য বুঝতে পারিনি। এইটা ধরো।”
তার হাতে চকচক করছে কালো পাথরের তৈরি একটা বাজপাখির মূর্তি। অর্জুন বলে, “কিন্তু আমি কী করবো এটাকে নিয়ে?”
এবার বুম্বাদা বলল, “অর্জুন, ভূত হয়েছি বলে অনেক কিছুই নিজে নিজে জেনে যাই। আমাদের মুক্তি নেই যতদিন না তোমার কাছে রাখা আমাদের nth প্রজেক্টটা সিনেমার পর্দায় আসছে। এই কাজটা করার জন্যে তুমিই উপযুক্ত লোক। তোমার পড়াশুনা আছে, নিষ্ঠা আছে। তুমি পারবে। টাকার জন্যে ভেবো না। এই মূর্তিটার কথা নিউইয়র্কে বোনহামসে জানালেই তারা ঠিক দাম দিয়ে কিনে নেবে, তারা জানে কি করে আসল জিনিস পরখ করতে হয়। তুমি চিন্তা কর না। প্রথম সিনেমাটা আমার গল্প নিয়েই কর। তারপর তো তুমি অন্য ছবি করবেই। আমরা জানি, তুমি আমাদের কথা রাখবে।”
অর্জুন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শপথ আর শৌভিক তার পিঠে হাত রাখলো। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
৯) সিনেমার শুটিঙের আজ প্রথম দিন। অর্জুনের প্রথম ছবি। নায়ক মিতাঙ্কর আর নায়িকা মৌসুমী, এদের সঙ্গেই বুম্বাদার আর শপথদার ছবি করার কথা ছিল। The Maltese Falcon এর মেমোরাবিলিয়া সে কলকাতা জাদুঘরে জমা করে দিয়েছে। প্রযোজক পেতে তার কোনও অসুবিধেই হয়নি, অভিনব বিষয় দেখে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন নিজে থেকে। কিন্তু তাও তার ওপর বিশ্বাস করার জন্যে এই দুজনের কাছে সে ঋণী থাকবে চিরকাল। প্রথম শট নিতে যাওয়ার আগে অর্জুন অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো সামনের আন্দুল রাজবাড়ীর দিকে। বুঝতে পারল, তার দিকেও হাসিমুখে চেয়ে আছে দুজন সিনেমাপাগল।
(নভিস হাতে লেখা এই গল্পটার একটা ইতিহাস আছে, এখানে সব চরিত্র কাল্পনিক নয়, তাদের সম্পর্ক, প্যাশন, পেশা বা জীবনের অনেক কথাও সত্য। ধুলিভরাপুরম যেমন ব্যাঙ্গালোরের কুন্দনাহল্লী। অর্জুন ওরফে অর্জুন নিয়োগী বহুদিন কর্পোরেট চাকরি করে একদিন সব ছেড়ে ফিল্ম স্কুলে চলে যান, তখন তিনি তিরিশের শেষ কোঠায়; এখন তিনি মুম্বাইতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন, নিজের স্ক্রিপ্টও লিখেছেন কয়েকটা। শপথ দাস কোনোদিন চাকরি করেনি, বাংলা ও ভারতীয় সিনেমার জন্য মাটি কামড়ে কাজ করে গেছে দশ বছর ধরে, তখন সে নেহাতই ছেলেমানুষ। আর্টহাউস এশিয়ার মতো ফেস্টিভাল করেছে, ইন্ডি সিনেমার জন্য পিচিং কম্পিটিশন করেছে, বার্লিন, দোহা, কান ফিল্ম ফেস্টিভালে বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দিয়েছে, এখন সে আনসুপারভাইজড বলে এক এ আই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চাইছে। মিতাঙ্কর সত্যিই অভিনেতা, কিন্তু সিনেমায় নয়, নাটকে। ব্যাঙ্গালোরে গেলে তাঁর সাবলীল অভিনয় দেখতে পারেন, মাঝেমধ্যে কলকাতাতেও কাজ করে। শৌভিকদা’র nth project এখনও শুরু হওয়ার অপেক্ষায়, তিনি এখনও ব্যাঙ্গালোরে কাজ করে যাচ্ছেন, ধুলিভরাপুরমেই থাকেন, বাকি চরিত্ররাও কম বেশি বাস্তব।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন