মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

একটা গান কি জীবন বদলাতে পারে?

 



একটা গান আপনার জীবন বদলাতে পারে? কয়েকজন হ্যাঁ বললেও অনেকেই হয়তো না বলবেন। সত্যি কথা বলতে, একটা বই, একটা পেন্টিং, একটা কবিতা, একটা সিনেমা বা একটা গান যে আদৌ জীবনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারে, সে কথা সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ মানুষই বিশ্বাস করেন না। তর্ক না করে বরং একটা গানের চার লাইন শোনানো যাক, তারপর একটা গল্প হোক।
নেলি ব্লাই নেলি ব্লাই
নেভার নেভার সাই
নেভার ব্রিং দ্য টিয়ারড্রপ
টু দ্য কর্নার অফ ইওর আই
না, গানটার মূল লাইন এটা নয়। এই অংশটা আসলে কোরাসের পার্ট। গান শুরু হচ্ছে এভাবে...
Nelly Bly! Nelly Bly!
Bring de broom along,
We’ll sweep de kitchen clean, my dear,
And hab a little song.
কিন্তু, একটা মেয়ের কাছে কোরাসে গাওয়া ওই লাইনগুলো কীভাবে জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠল, সে এক অসামান্য কাহিনি। ১৮৫০ স্টিফেন ফস্টার এই গানটা কম্পোজ করেছিলেন এক দরিদ্র মেয়ে নেলি ব্লাইকে কল্পনা করে, যে শত দুঃখ কষ্টেও কোনোদিন ভেঙে পড়ে না, কোনোদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে না। তিনি জানতেন না, চোদ্দ বছর পর পেনিসেলভেনিয়াতে এলিজাবেথ বলে এক মেয়ে জন্মাবে, আর মায়ের পাশে রান্নাঘরে বসে তাঁর এই গান শুনতে শুনতে তাঁর জীবনে এক অদৃশ্য বদলের সূচনা হবে।
এলিজাবেথ জন্মেছিল আর্মস্ট্রং কাউন্টির কোচরান মিলসে। বাবার নাম ছিল মাইকেল কোচরান। তিনি জীবন শুরু করেছিলেন দিন আনি দিন খাই মজুর হিসেবে, কিন্তু কর্মজীবনে নানা ঘাটের জল খেয়ে নানা কাজ করতে হয়েছে তাঁকে৷ কখনও পোস্টমাস্টার, কখনও মিল ওয়ার্কার, অবশেষে তিনি কোচরান মিলস কিনে ব্যবসা শুরু করেন। এই ব্যস্ত কর্মজীবনের মধ্যে তিনি দু'বার বিয়ে করেছেন, পনেরোটি সন্তানের বাবা হয়েছেন, কিন্তু প্রায় কাউকেই সময় দিতে পারেননি। অবশেষে যখন তিনি মারা যান, ব্যবসা পড়তির দিকে, দেনাপাওনা ভালোই বেড়েছে, তখন এলিজাবেথের বয়স মাত্র ছয়।
পনেরোজন সন্তানের মধ্যে বিষয় সম্পত্তি বাঁটোয়ারা হওয়ার পর দেখা গেল, নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। উপায়ান্তর না দেখে এলিজাবেথের মা আবার বিয়ে করলেন, এই ভেবে যে নতুন স্বামী দায়িত্ব নিলে অন্ততপক্ষে পাঁচ সন্তানের পড়াশোনা খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা থাকবে না। কিন্তু সে বিয়ে টিকল না। প্রায় প্রতিদিন স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে, শুতে বসতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খোঁটা শুনতে শুনতে দিন কাটানো দুস্কর হয়ে পড়ল তাঁর জন্য। বরের হাত মার খাওয়ার সময় মেয়েকে রান্নাঘরে বসিয়ে যান, ফোনোগ্রাফ আবিষ্কার হয়েছে কয়েক বছর হল। এলিজাবেথ বসে বসে নেলি ব্লাইয়ের গান শোনে, পাশের ঘর থেকে মায়ের আর্তনাদ শোনা যায়। শোনা যায় অমানুষিক সব শব্দ। এলিজাবেথ মনপ্রাণ দিয়ে গান শোনার চেষ্টা করে, এক একটা শব্দ তাঁর মাথার মধ্যে গেঁথে যায়।
এমন করে বেশিদিন চলতে পারে না। এলিজাবেথের মা ম্যারি বিবাহবিচ্ছেদ করে পিটসবার্গে চলে আসেন, তখন সে জায়গার নাম অ্যালেগেনি সিটি। সম্বল বলতে তেমন কিছুই নেই, পেট চালানোর জন্য একটা বোর্ডিং হাউস চালাতে শুরু করেন ম্যারি। ততদিনে এলিজাবেথ কিশোরী হয়েছে। পাঁচ ছেলেমেয়ে বোর্ডিং হাউসের কাজ করে হাঁফিয়ে পড়ে, দিনান্তে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম এলিজাবেথ। সে ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই পড়ে। ম্যারি এই পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন না, কিন্তু ম্যারি জেদ ধরে রইল, সে পড়া চালিয়ে যাবে। জেদ করে সে জোর করে ইন্ডিয়ানা নর্মাল স্কুলে নাম লিখিয়ে ফেলল, প্রায় চারশো মাইল দূরের কলেজ, কিন্তু টাকাপয়সা ছিল বা বলে এক সেমেস্টার পরেই তাকে বের করে দেওয়া হল। বোর্ডিং স্কুলে ফিরে আসা ছাড়া আর উপায় রইল না।কিন্তু মেয়ের জেদ কম নয়। সে পড়বেই। কিছুতেই সে পরিস্থিতির কথা বলে কান্নাকাটি করবে না, হার স্বীকার করবে না। নেলি ব্লাইয়ের মতোই সে লড়াই চালিয়ে যাবে।
এরকম করেই ছয় বছর কেটে গেল। ১৮৮৫ সালে পিটসবার্গ ডিসপ্যাচ কাগজে "What Girls Are Good For" বলে একটা কলাম ছাপা হল। সেখানে জানানো হয়েছে ভালো মেয়েদের জায়গা ঘরের ভিতর, তাদের কাজ শুধু পুরুষদের কাজে সাহায্য করা। সেই কলাম পড়ে এলিজাবেথের গা পিত্তি জ্বলে গেল। রেগেমেগে সে সম্পাদককে একটা চিঠি লিখে পাঠাল। নিজের নামের জায়গায় লিখল... লোনলি অরফ্যান গার্ল।
১৮৮৫ সালের কথা। জর্জ ম্যাডন তখন পিটসবার্গ ডিসপ্যাচের সম্পাদক। তিনি এই চিঠির ভাষা ও শৈলী দেখে মুগ্ধ হয়ে সেটা কাগজে তো ছাপলেনই, সঙ্গে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন পাঠিকা যেন তার আসল পরিচয় জানিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে। এলিজাবেথের কোনও সংশয় ছিল না। সে বিশ্বাসী ভঙ্গিতে কাগজের দপ্তরে গিয়ে জর্জ ম্যাডনের সঙ্গে দেখা করল। তার সঙ্গে কথা বলে ম্যাডন আবারও মুগ্ধ হলেন, এলিজাবেথকে নিয়মিত কলাম লেখার চাকরি দেওয়া হল। কিন্তু কয়েকদিন লেখার পরই সে মেয়ে একটা বেয়াড়া অনুরোধ করে বসল। এলিজাবেথ নয়, সে লিখতে চায় নেলি ব্লাই নামে। এই ছদ্মনামই তার কলমের পরিচয় হবে। ম্যাডন সব শুনলেন, বুঝলেন না ভালো, কিন্তু আপত্তি করলেন না৷
কিন্তু, কয়েকদিনের মধ্যেই ম্যাডন বুঝতে পারলেন এই মেয়ে অন্য ধাতুতে গড়া। টেবল ওয়ার্ক করলে ওর মন ভরবে না। এলিজাবেথ থুড়ি 'ব্রেভ নেলি ব্লাই' কে ছদ্মবেশে স্থানীয় কারখানায় পাঠানো হল সেখানকার মহিলা কর্মচারীদের প্রতি চলতে থাকা অন্যায় অবিচারের ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য। কোনও মেয়ের জন্য এই ধরনের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের কাজ সে যুগে ভাবাই যেত না। নেলি অবশ্য নিঁখুত পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে সেই ফ্যাক্টরির অন্তরীণ দুর্নীতি আর মেয়েদের জোর জুলুম করে খাটিয়ে নেওয়ার বিরোধে একের পর এক কলাম লিখে চলল। ফলে ফ্যাক্টরির মালিকরা গেলেন মহা চটে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে আবার ডেস্কে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল। কিন্তু ফ্যাশন আর ঘরোয়া বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার প্রতি নেলির বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, ব্রেভ নেলি নামটা যখন সে নিয়েছে, তখন পুতু পুতু করে জীবন সে কাটাবে না। পিটসবার্গ ডিসপ্যাচের ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে মেক্সিকোতে একটা জায়গা খালি ছিল। তখন সেখানে স্বৈরাচারী পোরফিরিও ডিয়াজের শাসন চলছে, কেউ ভয়ে যেতে চায় না৷ নেলি প্রায় জোর করে ছয় মাসের জন্য মেক্সিকো চলে গেল। সেখানে সরকারের নিষ্ঠুরতা আর প্রেস ফ্রিডমের সেন্সরশিপ নিয়ে সে এমন সব জ্বলন্ত ভাষায় কলাম লিখতে লাগল, মেক্সিকোর সরকারের বড়কর্তাদের কালঘাম ছুটে গেল৷ একজন লোকাল জার্নালিস্টকে বেআইনি ভাবে গ্রেপ্তার করা হলে নেলি ভীষণ কড়া ভাষায় পোরফিরিও ডিয়াজের আলোচনা করল। এরপর সে ক্রমাগত হুমকি পেতে শুরু করল। লোকাল গুণ্ডা থেকে পুলিশ, কেউ খুন করার ভয় দেখায় তো কেউ বলে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হবে। নেলি অবিচল। সে একা থাকলে নেলি ব্লাইয়ের ছোটবেলায় শোনা গান গুনগুন করে। সে কিছুতেই ভেঙে পড়বে না, কিছুতেই দুর্বল হবে না। শেষমেশ কেউ তাকে গ্রেপ্তার করেনি, পিটসবার্গ ডিসপ্যাচই ভয় পেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনে। নেলি এতে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে নিউইয়র্কে চলে আসে, কয়েকদিন ঘোরাফেরা করে 'নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডে' চাকরি পেয়ে গেল সে।
এইবারের কাজটা আরো চ্যালেঞ্জিং। সত্যিকারের (এবং কোনও মেয়ের জন্য প্রথম) ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের কাজ, মাঝেমধ্যেই নানান ঝুঁকি নিতে নয়। সবচেয়ে বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টটা এল যখন নিউয়র্কের মেন্টাল অ্যাসাইলাম মানে পাগলখানার পরিস্থিতি বিচারের জন্য একজনকে কাজ দেওয়ার কথা উঠল। নেলি প্রায় লাফিয়ে উঠে এই দায়িত্ব নিল। সে বদ্ধ উন্মাদ সেজে দশ দিন সেই অ্যাসাইলামে কাটিয়ে দিল, সব কিছু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর করল। এসে সে অ্যাসাইলামের অব্যবস্থা আর দুর্নীতি নিয়ে এইসা ভয়ানক ডিটেলস সহ রিপোর্ট লিখল যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটা তদন্ত কমিটি বসানো হল অ্যাসাইলামের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করার জন্য, বাজেটও বাড়িয়ে দেওয়া হল কয়েক গুণ। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে নেলি পরে 'টেন ডেজ ইন দ্য ম্যাডহাউস' বলে একটা বই লিখবে, যে বই একশো বছর পরেও পাঠকপ্রিয়তা হারাবে না।
পরবর্তী দশ বছর ধরে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট হিসেবে নেলি ব্লাই যে কত সামাজিক অবিচার আর দুর্নীতির কথা লিখেছে, কত শক্তিশালী মানুষের মুখোশ খুলে দিয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। বহুবার হুমকি পেয়েছে, মাফিয়ারা ভয় দেখিয়েছে, নেতারা চোখ রাঙিয়েছে, কিন্তু নেলি পরোয়া করেনি। শুধু মনে মনে গুনগুন করে গেছে ছোটবেলায় শোনা সেই গান।
শুধু পেশার জন্য তদন্ত করেই অবশ্য সে থামেনি। অ্যাডভেঞ্চার তার ধমনীতে বইত। 'অ্যারাইন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ' থেকে অনুপ্রানিত হয়ে সে একবার ৭২ দিনে দুনিয়া ঘুরে ফেলেছিল। সে এক ভ্রমণ বটে। চল্লিশ হাজার মাইলের এই রোমাঞ্চকর সফর করা হয়েছিল ঘোড়াগাড়ি, রেলগাড়ি, স্টিমার, নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি করে। এই গোটা সফরের বিবরণ ধরা আছে 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ৭২ ডেজ' বইতে। কত প্রকাশক বেআইনি ভাবে ইংরেজি বই অনুবাদ করছেন, এই পাবলিক ডোমেনে থাকা চমৎকার বইগুলো তাঁদের চোখে পড়ে না কেন কে জানে?
এই বই লেখার পর নেলি সেলেব্রিটি হয়ে গেলেন। মেয়েরা সবাই নেলির উদাহরণ টেনে কথা বলতে শুরু করলেন। ষোল বছরের পারিবারিক জীবনের নানান ওঠানামার পর নেলি কিছুদিনের জন্য সাংবাদিকতা থেকে ব্রেক নিয়েছিলেন, ১৯১১ সালে তিনি 'নিউইয়র্ক ইভিনিং জার্নাল'- এর জন্য আবার কাজ করতে শুরু করেন। বারবার লেখালিখির মাধ্যমে তিনি জানিয়ে গিয়েছেন মেয়েরা কোনও অংশেই, কোনও ক্ষেত্রেই ছেলেদের চেয়ে কম নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ইউরোপের ফ্রন্ট লাইনে গিয়ে ট্রেঞ্চের ভিতরে থেকে রিপোর্ট করেছেন, এরম কোনও নজির তখন ছিল না। বাইরে যখন বোমা ফেলা হচ্ছে, নেলির বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে, তখনও সে মনে মনে ছোটবেলার গান গুনগুন করছে।
নেলি ব্লাই নেলি ব্লাই
নেভার নেভার সাই
নেভার ব্রিং দ্য টিয়ারড্রপ
টু দ্য কর্নার অফ ইওর আই
আট্টান্ন বছরের স্বল্প আয়ুতে যে সংবেদনশীল জীবন নেলি কাটিয়েছেন, যে সাহস দেখিয়েছেন, পুরুষপ্রধান সমাজে বহু মেয়েকে, এমনকি বহু ছেলেকেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। স্টিফেন ফস্টার শুধু জানতে পারলেন না, নেলির জন্য লেখা একটি গান আসলে সত্যি সত্যিই এক নেলিকে জন্ম দেবে, যার জীবনের সঙ্গে গানের এই লাইনগুলো একেবারে খাপে খাপ।
নেলি ব্লাই হ্যাভ আ হার্ট
ওয়ার্ম অ্যাজ আ কাপ অফ টি
অ্যান্ড বিগার দ্যান দ্য সুইট পট্যাটো
ডাউন ইজ টেনেসি
হ্যাঁ। একটা গানও আপনার জীবন বদলে দিতে পারে।

শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

চাটনি পুরাণ

 


আজকাল ল্যাদ বেড়েছে বলে গল্প উপন্যাস দূর, আগের মতো ব্লগ বা ফেসবুক পোস্টও করা হয় না। বছর দুই তিন আগে যে সমস্ত অদ্ভুত অনালোচিত ঘটনা আর ইতিহাস নিয়ে লেখালিখির ইচ্ছে ছিল, সে সব লিস্টি করলেই একটা পুস্তিকা হয়ে যেত৷ দেদার ডকুমেন্ট আর কাটিং রাখা আছে এখনও ল্যাপটপে। বেশিরভাগ বিষয় নিয়েই এখনও তেমন কথাবার্তা হয় না (বা আমার নজরে পড়ে না) বলে একটু অবাকই লাগে। যেমন- চাটনি! 

কুলের, আমের, তেঁতুলের চাটনির কথা ভেবে হুসহাস করার আগে জানাই, এ-ই চাটনি সেই চাটনি নয়। এ এক ইন্টারন্যাশনাল চাটনি, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ যে চাটনির পাঙ্খা। গুয়ানা থেকে ফিজি, সাউথ আফ্রিকা থেকে ভারত, চাটনির অনুরাগী কম নয়। এই চাটনির ইতিহাসও অসামান্য।  মুচমুচে, সাস্পেন্সফুল এবং সুরেলা। সুরেলা, কারণ এই চাটনি আসলে হল চাটনি মিউজিক।  

ভারতবর্ষ থেকে দরিদ্র গিরমিটিয়াদের হাত ধরে সুদূর ক্যারিবিয়ানে এই পূর্ব ভারতীয় সঙ্গীত কীভাবে পৌঁছল আর ফুলেফেঁপে সাম্রাজ্য বিস্তার করল, সে এক অসামান্য কাহিনি। ১৮৫৭ সালের সৈন্য অভ্যুত্থান এর পর থেকে ভারতবর্ষের গ্রামগঞ্জে ব্যাপক দারিদ্র‍্য দেখা যায়, কাজকর্মের অভাব আর সাহেবদের সন্দেহপ্রবণ অ্যাটিটিউডের জন্য প্রচুর মানুষকে ছাঁটাই করা হয়। এর আগে থেকেই ক্যারেবিয়ান আর ফ্রেঞ্চ গুয়ানাতে বিভিন্ন জায়গায় সস্তা শ্রমিকদের চাহিদা বেড়েছে, আর ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ফড়েদের মারফত কুলি ধরে আনার কিসসাও কিছু নতুন নয়। গিরমিটিয়া কুলিদের ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু কিছু বাংলা বইতেও উঠে এসেছে, কিন্তু প্রামাণ্য, ওয়েল রিসার্চড ডকুমেন্টেশন পড়তে চাইলে প্রবীণ কুমার ঝা- এর 'কুলি লাইনস' একটা অসামান্য কাজ। যাই হোক, সেই সময় উত্তরপ্রদেশ আর বিহার (বা পূর্বাঞ্চল যাকে বলে) থেকে প্রচুর গিরমিটিয়া কুলি ক্যারেবিয়ানে গেছে, আর ফেলে আসা মাটির দীর্ঘশ্বাস আর স্মৃতির পাশাপাশি ভোজপুরি আর ম্যায়থিলী ভাষার সংস্কার, লোককথা, শিল্প ও সংগীত সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। যেভাবে জ্যাজ গড়ে উঠেছিল কাপাস প্ল্যানটেশনের ব্ল্যাক লেবারদের হাত ধরে, চাটনি মিউজিকের ক্রেডিট এই সমস্ত গিরমিটিয়া কুলিদের দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অবশ্য সেই সঙ্গীত সম্পূর্ণ ভাবে বিকশিত হতে হতে কয়েক শতাব্দী লেগে গেছে, ততদিনে গিরিমিটিয়াদের পরবর্তী প্রজন্মদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সম্পর্ক বেড়েছে, দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষজন মিলে পরিবার গড়ে তুলেছে, ভোজপুরি সঙ্গীতের সঙ্গে ক্যালিপ্সো মিশেছে, ঢোলকের পাশাপাশি সোকা বিটস আর তাশা ড্রাম ঢুকে গেছে। ভাষাও হয়েছে পাঁচমিশালি। পরবর্তীতে চাটনি মিউজিক জ্যাজ, আমেরিকান রক, লাতিনো সঙ্গীতের পাশাপাশি বলিউডি সঙ্গীতেও প্রভাব ফেলেছে, যদিও সে কথা খুব বেশি মানুষ জানেন না। 

আমার এক পূর্বাঞ্চলের বন্ধু গিরমিটিয়াদের বংশধরকে বিয়ে করে ট্রিনিডাডে সেটল করে গেছে। দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব কম নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখতে গেলে মনে হয় একই গ্রামের মানুষ। খাওয়াদাওয়া এক, আচার আচরণ এক, শখ আহ্লাদ উৎসবও এক। শুধু একটাই তফাত, প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়া লেগে ওদেশের গিরমিটিয়া বংশধররা কুসংস্কার ঝেড়ে অনেকটা ওপেন মাইন্ডেড হয়ে গেছে। মানাউসে এক বৃদ্ধা স্টুডিও মালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাঁর পূর্বপুরুষরা সবাই ফ্রেঞ্চ গুয়ানায় কুলির কাজ করত। কিন্তু শিক্ষা দীক্ষা ক্যাথোলিক স্কুলেই হয়েছে, বড় হয়ে বিদেশ গেছে। অনেকেরই এক কাহিনি। ক্রমে এ-ই ক্রস কালচার লিঙ্গুয়া সভ্যতা কুড়ি পঁচিশটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

যাই হোক, কথা হচ্ছিল চাটনি নিয়ে। প্রায় দু আড়াইশ বছর ধরে চাটনি সঙ্গীত গিরমিটিয়া এবং স্থানীয় মানুষের জীবনের অংশ হয়েছিল, কিন্তু ১৯৬৮ সালের আগের কোনও রেকর্ডিং পাওয়া যায় না। লোকগানের সঙ্গে এমনটা প্রায়ই ঘটে থাকে। ম্যায়থিলি আর ভোজপুরি ভাষী সংস্কৃতিতে প্রায় প্রতিটা আচার অনুষ্ঠান উৎসবের জন্য একগাদা করে ঘরোয়া গান বাঁধা হয়, ধনতাল ঢোল সহযোগে গাওয়াও হয় হরদম, সেই সব গানের কথাও দারুণ মজার। কিন্তু সেসব খুব ভালো করে ডকুমেন্ট করে রাখা হয়নি। 

১৯৬৮ সালে রামদেব চ্যায়তোয়ে 'কিং অফ সুরিনাম' বলে একটা অ্যালবাম রেকর্ড করে চর্চায় চলে আসেন। এইসময় উঠে আসেন দ্রৌপতি বলে এক গায়িকাও। কিন্তু চলতি হিন্দিতে যাকে বলে 'ফাট জানা', সেই পপ কালচার বিষ্ফোরণটা হল হ্যারি মহাবীরের সৌজন্য, তিনি বিহার আর ইউপিয়ান অর্কেস্ট্রার পাশপাশি হিন্দি সিনেমার গান আর স্থানীয় সঙ্গীত মিশিয়ে এমন এক জগাখিচুড়ি জিনিস বানিয়ে ফেললেন, যা শুনলেই সেখানকার মানুষের মনে অতীতের-- যে অতীতের কথা অনেকে শুধু শুনেই এসেছে-- টক মিষ্টি স্মৃতির নস্টালজিয়া তাজা হয়ে ওঠে। এই টক মিষ্টি স্বাদের গানের স্বাদ আসলে আম বা ধনেপাতা পুদিনার চাটনির মতোই। সুতরাং, চাটনি মিউজিক।

সত্তর আশির দশকে সুন্দর পোপো চাটনি মিউজিককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছিলেন। তাঁকে চাটনির গডফাদারও বলা হয়। মজার মজার সব গান, কিন্তু এরই মধ্যে খুব সূক্ষ্ম ভাবে ডার্ক হিউমার আর সমাজের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরার স্বভাব ছিল তাঁর। যেমন...

আগে আগে নানা চলে

নানি গোইং বিহাইন্ড

নানা ড্রিংকিং হোয়াইট রাম

অ্যান্ড নানি ড্রিংকিং ওয়াইন

নানা রাইডিং বাইসাইকল

নানি রিংগিং বেল

নানি লকড দ্য হ্যান্ডল

দে ফেল ইনসাইড আ ওয়েল

মাই নানা অ্যান্ড নানি

ওয়েন্ট টু টাই আ গোট

মাই নানা মেড আ মিসটেক

অ্যান্ড কাট দ্য নানিজ থ্রোট

নানি ডেড অ্যান্ড গন

মাই নানা গন টু হ্যাং

সো আই হ্যাড টু টেক ওয়ান

ফর মাই কম্প্যানিয়ন

সুন্দর পোপোর এই 'নানা নানি' আগুনের মতো দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল, রেকর্ড বিক্রি হতে লাগল খাস্তা কচুরির মতো। সুন্দর পোপো হ্যারি মহাবীরের শিষ্য ছিলেন, তিনি গুরুর কথা শুনে একেবারে ভারতের গাঁও দেহাতের গানগুলো চাটনিতে নিয়ে এলেন, বিয়ের বাসর রাত্রে পিসিমাসিদের হাসিঠাট্টা করে গাওয়া দ্বিঅর্থী গানগুলো ওয়েস্টার্ন কম্পোজিশন সহ তুলে এনে মানুষকে সেই নস্টালজিয়া ফিরিয়ে দিলেন, যা তারা প্রায় ভুলতে বসেছিল।

'রতিয়া মে দুলহা কে মৌসী বোলল গয়ে...'

'হমরে ভিলেজ মে কোহরা ব্যায়গন বহুত হ্যায়, হম তুরব তু না বেচবে কে নাহি..'

কিন্তু এ বাদেও সুন্দর পোপো এক্সপেরিমেন্টাল গান, গভীর গান কম গাননি। ইংরেজিতে গাওয়া গান I wish I was a virgin বা  Don't fall in love এর মতো গানগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুন্দর পোপোর পাশাপাশি স্যাম বুদ্রাম, আইজ্যাক আর রাকেশ ইয়াঙ্করণ, জগেসসর এর মতো শিল্পীরা নানা স্বাদের গান গাইতে শুরু করে। ইয়াঙ্করণের একটা গান আছে... বড়ে দূর সে আয়ে হ্যায়! 





'আনজানে লোগো মে কোই সাথ তো মিলেগা, কোই তো হোগা জো হমকো সামঝেগা..'

ঠিক এই সময়েই দেশের গরীব মানুষরা আধুনিক ভারত থেকে কাজের খোঁজে দূর দেশে যেতে শুরু করেছে। কেউ আরবে, কেউ আফ্রিকায়, কেউ আরো দূরে। এই মর্মস্পর্শী গানগুলো তাঁদের আপন হয়ে উঠল। যাঁরা বলেন চাটনিতে অশ্লীল গান ছাড়া কিছু নেই, তাঁরা সম্ভবত এই ঘরানার অনেক গানই শোনেনি।

পরবর্তীতে এই ধারায় অনেকেই এসেছেন, কিন্তু সকলের কথা বলা সম্ভব নয়। তবু চাটনির কথা উঠলে যে দুজনের কথা না বলে থামা যায় না তারা হল হরি ওম শরণ আর বাবলা-কাঞ্চন জুটি।

পূর্বাঞ্চলে হরি ওম শরণের ভজন ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় শোনেনি, এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। 'ম্যায়লি চাদর ওড় কে ক্যায়সে হো' আর 'তেরে রামজি করেঙ্গে বেড়া পার' এখনও হরদম বাজে। তা ওম শরণ এর বিয়ে হয় গুয়ানার চাটনি গায়িকা নন্দিনীর সঙ্গে, এরপর থেকে তিনি 'শ্বশুরবাড়ি'তে ভারতীয় ভজনের প্রোগ্রাম করে অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বলা যায় আধুনিক যুগে তিনি ভারতের সঙ্গীতকে ক্যারেবিয়ানে নিয়ে গেছেন। তাহলে এও বলতে হবে যে বাবলা-কাঞ্চন আবার চাটনি আর চাটনি-সোকা ঘরানাকে ভারতে আর বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় জনপ্রিয় করতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। বাবলা ছিলেন আসলে বিখ্যাত কম্পোজার কল্যাণজি-আনন্দজির ভাই, শোনা যায় 'খাইকে পান বানারস ওয়ালা' থেকে শুরু করে তাঁদের অনেক গানই বাবলা কম্পোজ করেছিলেন, তাদের সুরে অনেক গান গেয়েছিলেন কাঞ্চন। কিন্তু দিনের পর দিন বম্বেতে ঘুরেও, বড় বড় নামের কাছে আশ্বাস পেয়েও তাঁদের কেউ স্বাধীন ভাবে ব্রেক দেয়নি। মনক্ষূণ্ণ হয়ে বাবলা-কাঞ্চন (একসময় তারা বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন) নিজেদের ব্যান্ড খুলে প্রোগ্রাম করতে শুরু করেন এবং ক্রমে ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ক্যারেবিয়ানে৷ এরপর তারা সারা দুনিয়ায় অনুষ্ঠান করেছেন, 'ক্যায়সে বানি' অ্যালবাম তো এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে বড় বড় কর্পোরেট থেকে তাঁদের বিজ্ঞাপনের জন্য গান করতে বলা হয়েছিল। ২০০৪ সালে কাঞ্চন মারা যান, বাবলা অবশ্য অনুষ্ঠান করছিলেন।

যে সময় সবাই ভাবছে চাটনির কথা ভারতে আর কেউ জানবে না, সেই সময় একটা মেয়ে এসে হাজির হল ক্যারেবিয়ানে। নতুন একটা সিনেমা হচ্ছে, সেই জন্য সে চাটনি মিউজিক ব্যবহার করতে চাইছে। মাসের পর মাস ধরে এই দ্বীপ সেই দ্বীপে ঘুরে, অজস্র পুরোনো রেকর্ড শুনে, চাটনি আর সোকা মিউজিকের সর্বেসর্বা আর অতীত শিল্পীদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা করে সেই মেয়ে ফিরে গেল। কয়েক বছর পর সিনেমা রিলিজ হল আর এই গানগুলো লোকেদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল।

'আই অ্যাম আ হান্টার আই ওয়ান্ট টু সি ইওর গান'

'ইলেক্ট্রিক পিয়া'

'মুরা'

'উমনিয়াঁ'

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। মেয়েটার নাম স্নেহা খানবলকর। সিনেমার নাম 'গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর'।

চাটনি মিউজিকের জয়যাত্রা অব্যাহত। ইচ্ছে হলে ইউটিউবে শুনে দেখতে পারেন।