বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

স্টিমপাঙ্কের দুনিয়ায়

 

হ্যালোউইনের মরসুমে ভূতপ্রেত চর্চা করতে করতে মাথা এমনে বিগড়োল, একেবারে ভূত প্রেত ড্রাকুলার দেশে এসে পড়লাম। ইয়ে, রোমেনিয়ার কথাই বলছি। আজকাল নতুন যুগের সঙ্গে বেশ তাল মেলাচ্ছে বটে, কিন্তু এখনও বুখারেস্ট ব্রাসোভ ক্লুজের বাইরে গ্রামে-গ্রুমে গেলে ভূতপ্রেতের দেখা বিস্তর পাওয়া যায় শুনেছি, যাদুকর বা ওঝাবদ্যির দেখাও মেলে। আর নেকড়ে আর ভাল্লুক তো হরবখত ঘুরছে। বিশেষ করে রোমেনিয়া হল ভাল্লুকের স্বর্গরাজ্য। তা রোমেনিয়ার গল্প যা হবে তা পরে হবেখন, এটা হল একটা বিশেষ অ্যাপ্রিশিয়েশন পোস্ট। ভূত প্রেত দানো দত্যির চেয়েও বেশি ইন্টারেস্টিং বটেক! সবটা বলাও যাবে না, তবে ছবি দিয়ে কম্পেন্সেট করার চেষ্টা করছি।

ক্লুজে নাপোকা ট্রান্সিলভিনিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্র। সেখান থেকে নানান জায়গায় যাওয়া যায়, কিন্তু এই বিশেষ জায়গাটা শহরের মধ্যেই একটা গলিতে অবস্থিত, তুলনামূলক ভাবে খুব কম মানুষই এখানকার কথা জানে। তা জিনিসটা কী? না, একটা মিউজিয়াম। তবে যে সে মিউজিয়াম নয়, দুনিয়ার প্রথম স্টিমপাঙ্ক মিউজিয়াম। বোতন্ড ইস্টভান্ডি বহুদিন এক্সিবিশন মার্কেটে কাজ করেছেন, কিন্তু কিছুই তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। শেষমেশ পাঁচ বছরের চেষ্টায়, ভ্যাম্পায়ারদের দেশে তিনি ফ্যান্টাসির একটা জাদু দুনিয়ার নির্মাণ করেছেন। এমন চমৎকার স্টিমপাঙ্ক মিউজিয়াম যে একজন মানুষ একা দাঁড় করাতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আবার মনে হয়, এইসব প্যাশন প্রজেক্ট একজন দুজন পাগলই করতে পারে। খবরটা শুনেই মাথার পোকা নড়ে উঠল। আমি স্টিমপাঙ্ক এরার ভক্তই বলতে হয়, খুব বেশি জ্ঞানগম্যি না থাকলেও। একটা উপন্যাস লিখতেও শুরু করেছিলাম, সে সত্তর পার্সেন্ট হয়ে পড়ে আছে। তবে আগ্রহটা রয়ে গিয়েছে একইরকম।

কল্পবিজ্ঞানের অ্যাডমায়াররা স্টিমপাঙ্ক সম্পর্কে ভালোই জানে। ভিক্টোরিয়ান যুগে বা প্রাক পেট্রোলিয়াম ইকোনমিতে যখন স্টিম বা বাষ্পই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আর উন্নত জীবনের প্রধান অস্ত্র ছিল, স্টিমপাঙ্ক দুনিয়া গড়ে উঠেছে সেটা মাথায় রেখেই। এইচ জি ওয়েলস আর জুলে ভের্নের দুনিয়ায় যে সমস্ত যন্ত্রপাতি কল্পনা করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই স্টিমপাঙ্ক ইনোভেশন। হাওয়াই সাবমেরিন থেকে শুরু করে মেকানিকাল এক্স রে গগলস,  যাদুঘড়ি থেকে শুরু করে স্টিমপাঙ্ক পাপেট, ভ্যাম্পায়ারদের সঙ্গে লড়াই করার অস্ত্র, বন্দুক, টাইটেনিয়াম টাইপিং মেশিন, গথিক অটোমেটিক আয়না, সাজুগুজুর জিনিস, রেকর্ড প্লেয়ার... হাজারো জিনিস কল্পনা করা হয়েছে, কিছু কিছু বানানোও হয়েছে।

ব্যাক টু মিউজিয়াম! এই অসামান্য জায়গাটির বিশেষত্ব, একবার ঢুকে গেলে সত্যি সত্যিই মনে হয় কল্পনার দুনিয়ায় প্রবেশ করলাম। দরজা নেই, টিকিট কাটলে দড়ি ধরে টানতে শুরু করে। সেই দড়ি একটা পুলিকে ঘুরিয়ে একটা আদ্যিকালের পর্দাকে দুদিকে সরিয়ে দেয়, আর উন্মোচিত হয় অন্য এক জগত। সেখানকার গাইডরা কেউ কাউন্ট ড্রাকুলার সহকারী, কেউ হগওয়ার্টসের ছাত্র, কেউ ক্যাপ্টেন নিমোর পার্টনার। চারিদিকে অদ্ভুতুড়ে সব যন্তপাতির মডেল, বিচিত্র আলোর নকশা। পোশন ফুটছে টগবগ করে। গাছড়া ঝুলে আছে মাথার ওপর৷ আদ্যিকালের সব যন্ত্রপাতি বলে মনে হলেও কিন্তু প্রতিটাই অপারেশনাল, মানে শুধুই দেখার জিনিস নয়। এইসব বানাতে গিয়ে/জোগাড় করতে ইস্টভান্ডি বাবুকে কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে সে কল্পনারও বাইরে! ঘন্টা দেড় দুই পর বাইরে এলে মনে হয়, দেখার মতো একটা জিনিস দেখলাম বটে।

দু তলা জুড়ে মিউজিয়াম, জিনিসপত্রে ঠাসা। স্টিমপাঙ্ক শুধু নয়, ফ্যান্টাসির হরেক উপাদান আছে। প্রকাণ্ড এক বুকসেল্ফ আছে, সেখান থেকে নিয়ম মেনে বিশেষ জায়গা থেকে দুটো বই সরিয়ে নিলে মাঝখান থেকে লাইব্রেরি দু ফাঁক হয়ে একটা গোপন ঘরের সন্ধান মেলে, সেখানে রাখা আছে একটা টাইমমেশিন। আজ্ঞে, চলেও। স্টিমপাঙ্ক রোমিও গেম আছে, হাতের উত্তাপ আর গতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা গানের কল আছে, ইন্সটাগ্রাম বা রিলের অ্যাডিকশন ছাড়ানোর মেশিন আছে। বিস্তর ভূতপ্রেত পরী দানো ভ্যাম্পায়ার ইত্যাদিও আছে। মুখে কথা সরে না। চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়েই থাকে। আঙুল কামড়ে বার বার ভাবি, কতটা প্যাশন থাকলে এমন একটা জায়গা তৈরি করা সম্ভব? 

স্টিমপাঙ্ক মিউজিয়ামে নতুন জিনিসপত্র নিচ্ছে।টেম্পোরারি এক্সিবিশন বা অ্যাকোয়ারমেন্ট, দুটোই হতে পারে, যদি আপনার মডেল পছন্দ হয়! স্টিমপাঙ্ক শিল্পীরা যদি চিলেকোঠায় বসে অদ্ভুত কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে থাকেন, ইন্টারেক্টিভ স্টিমপাঙ্ক মিউজিয়ামে আপনার জায়গা বাঁধা!

কিছু ছবি পরে আরো অ্যাড করার ইচ্ছে রইল।









প্রাক পঞ্চাশ যুগের স্বাধীন ভারত ও এক পার্সি গোয়ন্দার কাহিনি


ওয়াসিম খান ব্রিটিশ পাকিস্তানি লেখক। তাঁর বেবি গনেশ ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি সিরিজ ইউকেতে বেশ জনপ্রিয় তো বটেই, ভারতেও তাঁর পাঠক কম নেই। আবির মুখার্জির ভক্তরা অনেক সময় ওয়াসিম খানের লেখাও পছন্দ করেন বলে শুনেছি, দুজনে একসঙ্গে একটা পডকাস্টও করেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে ব্রিটিশ পাঠকের কথা ভেবে তিনি বেশ কিছু ক্লিশে 'ইন্ডিয়ান মোটিফ' লেখায় নিয়ে আসেন, হয়তো সেই কারণেই কিন্তু কিন্তু ভাব থেকে এতদিন তাঁর কলমের স্বাদ নেওয়া হয়নি। এদিকে কানাইচরণ রোজ রোজ মিলবে না, ভারতীয় পুলিশ প্রসিডেরালের জন্য মন আঁকুপাঁকু করে। এমন সময় জানা গেল ওয়াশিম খান বছর কয়েক আগে পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপটে একটা নতুন সিরিজ শুরু করেছেন। মালাবার হাউস সিরিজের নায়িকা ভারতের প্রথম আইপিএস অফিসার পারসিস ওয়াডিয়া, মিডনাইট অ্যাট মালাবার হাউস এই সিরিজের প্রথম বই। পড়ে বলতেই হচ্ছে, দারুণ উপভোগ করলাম।

একটু সামারি দেওয়া যাক। সময়টা ১৯৫০ সাল। তবে বছর শুরু হওয়ার ঠিক আগ্ব্র দিন রাত্রে, যখন মুম্বাই শহরে নতুন বছরের উৎসব চলছে, মালাবার হাউস থানায় একটা ফোন আসে যে জনৈক ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাট খুন হয়েছেন। ভদ্রলোক কেউকেটা ব্যক্তি, স্বাধীনতার পর ভারত সরকারের তরফ এর গোপন একটা তদন্ত করছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রভাব আর ব্যবসা বাণিজ্য চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। এহেন ভাগ্যক্রমে এই কেসটা গিয়ে পড়ে পারসিস ওয়াডিয়ার কাছে। পুলিশে প্রথম মেয়ে হওয়ার সুবাদে সে নিজে প্রতিদিন নানান ফ্যাকড়ার সামনে পড়ছে, তারপর এমন হাই ফাই কেস আসতে তাকে (ঘুরিয়ে) বলা হয় ছাব্বিশ দিন পর কন্সটিটিউশন ইম্পলিমেন্ট করা হবে, তার আগে কেস সমাধান না করলে মুণ্ডু ঘ্যাঁচাং! এমনিতেও পুলিশে মেয়েদের কী কাজ?

বাকিটা খাঁটি পুলিশ প্রসিডেরাল। পারসিস আর তার সঙ্গী ব্রিটিশ পরামর্শদাতা অফিসার আর্চি ব্ল্যাকফিঞ্চ সন্দেহের তালিকায় থাকা সকলকে সাক্ষাৎকার করছে, অতীতের পাতা খুঁড়ে বার করছে, ফরেন্সিক, অ্যালিবাই, জবানবন্দির ক্রস ভেরিফিকেশন করছে... কিন্তু যে জিনিসটা বইটাকে সত্যি সত্যি ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে সেটা হল সেটিং।

এমন একটা সময়, যখন বম্বে দ্রুত বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে দেশও। স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু সকলের কাছে তার মানে অন্যভাবে ধরা দিচ্ছে। সমসাময়িক রাজনীতি, কাস্ট আর রিলিজিয়ান নিয়ে কচকচি, পুলিশ ডিপার্টমেন্টে দুর্নীতি আর ব্রিটিশদের লেগাসির প্রতি একটা চাপা ভক্তি, সাদা চামড়ার মানুষের প্রশাসনে গুরুত্ব, অর্থনৈতিক বিভাজন... সমান ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে পারসিসের পার্সি ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বা সেকালের নগরসংস্কৃতির বিভিন্ন অ্যানেকডোট! অমুক দোকানের ভালো রান্না, তমুক অফিসের সামনে লাগানো গুলমোহর গাছ...  পারসিস এর নিজের জীবনেও কিছু কিছু জট রয়ে গেছে। চরিত্রগুলো যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে, হুড়মুড়ি ভাব নেই, কোথাও মনে হয় লেখক  রকেট চালাচ্ছেন। আবার ঘ্যানঘ্যানও বিশেষ করেন না। প্রি আর পোস্ট ইন্ডিপেন্ডেন্সের বিপ্লব এর বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ আছে, বর্মার যুদ্ধ আছে, আর সব কিছুই কোনও না কোনও ভাবে গল্পে ঢুকে গেছে। ফলে ইনফো ডাম্প মনে হয় না। এক্সট্রা পয়েন্ট ফর দ্যাট! 

তবে এ সবই মাঠে মারা যেত, যদি রহস্যটা না জমত! আমার কাছে অবশ্য মনে হয়েছে, ওয়াসিম খান ভালোই জট পাকিয়েছেন, খুলেছেনও সাবলীলভাবে। ব্রিটিশ রাইটার হওয়ার কারণে কিছু কিছু জিনিস একটু স্পুনফিড করতে হয়েছে, তবে তাতে গতি থমকায়নি। 

পার্টিশনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে গল্পে। এখানে হয়তো প্রাসঙ্গিক, ওয়াসিম খানের বাবা নিজেই দেশভাগের সময় পাঞ্জাব থেকে চাপে পড়ে পাকিস্তান যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেখান থেকে তাদের ফ্যামিলি ইউকে ইমিগ্রেট করে যায়। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের মতো তিনিও ভারতকে কোনোদিন অন্য দেশ ভাবতে পারেননি। তাঁর মায়ের ক্ষেত্রে অবশ্য মনোভাব ভিন্ন ছিল, তিনি পাকিস্তানে বেশি সময় কাটিয়েছেন। ওয়াসিম নিজে অবশ্য বেশ কিছুটা সময় ভারতবর্ষে থেকেছেন, তার লেখা দেখে বোঝাই যায় এই দেশটাকে তিনি খুব ভালো করে খেয়াল করেছেন। ভারতের প্রতি একটা মমতাবোধও অনুভব করলাম, কেউ কেউ অবশ্য সেটা মেকি বলে উড়িয়ে দিতে পারেন, তবে আমার কাছে লেখক এর কলম যথেষ্ট যত্নশীল আর এমপ্যাথেটিক বলে মনে হল।

সব মিলিয়ে, মিডনাইট অ্যাট মালাবার হাউস চমৎকার বই। এই সিরিজের বাকি তিনটে বইও পড়ার ইচ্ছে রইল।

হেল্ড

 

অ্যানা মিশেলস এককালে কবি বলেই পরিচিতি পেয়েছিলেন বলে জানি, 'ফিউজিটিভ পিসেস' উপন্যাসটা তাঁকে গদ্যের জগতে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সেই বইটা আমার পড়া হয়নি, 'হেল্ড' বইটা বেশি বড় নয় বলেই হয়তো পড়তে শুরু করেছিলাম।

গল্প শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত অবস্থায় জর্জ তার ছোটবেলা আর প্রেমিকা হেলেনার কথা ভাবছে। পরের পর্বে জর্জ ফিরে এসেছে, হেলেনার সঙ্গে মিলে একটা ফোটোগ্রাফির বিজনেস খুলে এসেছে। সেখানে আচমকা ছবি তুলতে গিয়ে মৃত মানুষের ছবি ধরা দিতে শুরু করে তার তোলা ছবিতে। গল্প এখান থেকে বেশ বেশ ইন্টারেস্টিং হতে পারত, কিন্তু লেখিকা প্লট নিয়ে মাথা ঘামাননি, তিনি স্পেসটাইমের বিভিন্ন বিন্দুতে মানুষের জীবনের ওপর চোখ বোলাতে চেয়েছেন। ফলে পরবর্তীতে এই গল্প প্রথমে তিরিশ বছর লাফিয়ে ১৯৫০ সালে পৌঁছে যায়, জর্জ আর হেলেনার মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় পাঠকের। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। প্রতিটা চ্যাপ্টারে গল্প লাফ মেরে কখনও কুড়ি বছর আগে, কখনও আশি বছর পিছিয়ে... ১৯০৮ থেকে ২০২৫ সাল অব্দি একটা জেনারেশনাল সাগা লেখার চেষ্টা করে গেছে। নাহ, ভুল হল। জেনারেশনাল সাগা কথাটা খাটবে না, কারণ লেখিকা আসলে বিভিন্ন মানুষের গল্প বলেছেন, অতীত ও ভবিষ্যতের বিভিন্ন সময়ে দুনিয়ায় আসা মানুষদের জীবন, তাদের সত্তা, অতীত, দ্বন্দ আর শোক ডকুমেন্ট করতে চেয়েছেন, কোনও একটা পরিবারের গল্প বিশেষ ভাবে বলতে চাননি। এই হিউম্যান স্টোরির ট্যাপেস্ট্রি বোনার পিছনে সম্ভবত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিচ্ছিন্ন মানুষ আর তাদের জীবনের মাঝে, সে তারা যে সময়ে বা যে অবস্থাতেই জীবন কাটাক না কেন, একটা কমন ইমোশনাল অ্যাঙ্গল খুঁজে ডকুমেন্ট করা। এই গল্পে যারা এসেছে, তাদের পরিবারের গল্প মাঝে মাঝে অতীত বা ভবিষ্যতে কোথাও গিয়ে মিলেছে, বা নাও মিলতে পারে।

অ্যানা মিশেলসের গদ্য মন্দ নয়। কবি হিসেবে তিনি যে ভাষার ওপর যথেষ্ট দখল রাখেন, তা বোঝা যায়। সংলাপ আর পারিপার্শ্বিক বর্ণনার সময়েও তা আরো বেশি করে ধরা পড়ে। কিন্তু, কেন জানি না, আমার কাছে 'হেল্ড' খুব একটা ইন্টারেস্টিং রিড হতে পারেনি। ভালো মন্দ বিচার করার কথাই নয়, কারণ এক একটা বই ভিন্ন পাঠকের কাছে ভিন্নভাবে ধরা দেয়। একটা বই লেখার সময়ে যে চিন্তাভাবনা আর পরিশ্রম একজন লেখককে করতে হয়, তা শুধু আমার খুব ভালো লাগেনি বলে 'ফালতু বই' বলে উড়িয়ে দেওয়া আমার পছন্দ নয়। অ্যানা মিশেলসের চিন্তাভাবনা, তাঁর গদ্যের স্বচ্ছতা, 'অনেস্টি' ও গভীরতা বহু পাঠকের কাছে সমাদৃত, আমি শুধু বলতে পারি আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে বইটা কানেক্ট করতে পারেনি। একে তো মাত্র সোয়াশো পাতার বই, সেখানে টাইমলাইনে ব্যাক অ্যান্ড ফোর্থ গিয়ে, বিভিন্ন চরিত্র এসে, নাম কে ওয়াস্তে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড আর মারি কিউরিকে এনে... বিরিয়ানি বানাতে গিয়ে খিচুড়ি হয়ে গেছে। তা খিচুড়ি অবশ্য অতি উপাদেয় জিনিস, কিন্তু এখানে স্বাদটা ঠিক খোলেনি মনে হল।

কয়েকটা চ্যাপ্টার এত ছোট যে সেখানে আসা চরিত্র বা তাদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সময়ই ছিল না। তার চেয়ে, একটা ফ্যামিলি নিয়ে গল্প এগিয়ে নিয়ে গেলে সম্ভবত বইটা আরো চমৎকার  হত বলে আমার ধারণা।

তবে, 'হেল্ড' নিয়ে প্রচুর উচ্ছ্বসিত রিভিউ দেখেছি। নিজে পড়ে বিচার করাই ভালো।

বউবাজারের ড্রাগন পরিবার



ও, আই লাভড দিজ ওয়ান সো মাচ!

ইন্দ্রপ্রমিত দাসের খুচরো লেখা আগেও বেশ কিছু পড়েছি। কিন্তু এই বইটা আমাকে মুগ্ধ করল। ভাব ও ভাষার দিক থেকে চমৎকার সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ তো বটেই, কিন্তু ফ্যান্টাসি গল্প হিসেবেও ইউনিক। ভীষণ ভাবে বাঙালি, আর ততোটাই আন্তর্জাতিক।   

একটা সংক্ষিপ্ত আইডিয়া দিচ্ছি নামধাম বদলে। ধরে নিন, বৌবাজারের কাছে হাউস অফ ড্রাগন মানে ড্রাগন বংশের ফ্যামিলি থাকে। একসময় ড্রাগন কুইনের এর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল, তাদের জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে ড্রাগনদের একটা ভূমিকা ছিল। কিন্তু কালে কালে ড্রাগন বংশ লোপ পেয়েছে, কয়েকজন প্রাণ বাঁচাতে ড্রাগনদের রাজ্য ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘর বেঁধেছে, সেখানকার সমাজ আলাদা, নিয়মকানুন ভিন্ন। এইবার, এই সময়, এই বংশে যদি একটা সন্তান জন্মায় যার পূর্ব জীবন সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, সে কলকাতা মেট্রো, বৌবাজারের ভিড় আর বাঙালি চাইনিজ চাউ খেয়ে বড় হচ্ছে, তার সঙ্গে ড্রাগন বংশের ইমোশনাল সম্পর্ক কতটা থাকবে, কী করে থাকবে?

“Belief is a serpent eating its tail forever, knowing that its tail is finite.”

ইন্দ্রবাবুর বইটা এ-ই জায়গা থেকেই গল্পটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এখানে কোনও ভীষণ ক্রাইসিস নেই, বিরাট কোনও যুদ্ধ নেই, শুধু স্মৃতি আর বাস্তবের মধ্যে, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস এর মধ্যে সেতু বানিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার একটা মায়াময় গল্প আছে। পাশপাশি, এটা একটা কামিং অফ এজ গল্পও বটে, যেখানে দুই ভিন্ন দুনিয়ার দুই ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বড় হচ্ছে। 

গল্প এতটাই মসৃণ ভাবে, তরতর করে এগিয়েছে যে আমি এক সিটিং-এ গোটা বই শেষ করেছি। রু আর অ্যালিস...দুই ছেলেমেয়ের বড় হওয়ার অংশটা অসম্ভব ভালো। 

ইন্দ্রবাবুর ভাষা লিরিকাল হয়েও সহজ, কিন্তু মাঝেমধ্যে সেই ভাষা মনে চাঁদনি রাতের রোশনাইয়ের মতো মায়াবী আলো ছড়িয়ে দেয়। 

খুব সূক্ষ্ম অথচ সাবলীল ভাবে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আর সেক্সুয়ালিটির দ্বন্দগুলো তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বাঙালি পাঠকের জন্য সবচেয়ে আনন্দের জায়গা, ব্রিটিশ ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড জয়ী এই লেখাটা ভীষণ ভাবে বাঙালি। এমন সুন্দর ভাবে ইংরেজি ন্যারেটিভের মধ্যে বাংলা কথা চলে এসেছে, একটুও বেমানান লাগেনি। 

আকাশ থেকে একটা প্রাণী পড়েছে আর রঞ্জন বলে একটা স্কুলে সেটা নিয়ে এসে বলছে, এটা কি তোমাদের সেই ছোট্ট ড্রাগন? রু বলছে, হ্যাঁ, ছোট বলে উড়তে গিয়ে ডানা খসে গেছে। তখন একটা ছেলে এসে মুখ ভেংচে বলছে, "ডোন্ট বি অ্যান ইডিওট। দ্যাটস আ টিকটিকি!" 

অ্যালিস রু এর মায়ের সামনে চালাকি করছিল বলে তাকে অবলীলায় 'Paka Meye' বলে বলে দেওয়া হচ্ছে। গল্পজুড়ে কলকাতার চিহ্ন, মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের হরেক রকম অ্যানেকডোট ছড়ানো। শেষ পর্যন্ত আসতে আসতে মন ভালো হয়ে যায়, আবার একটু মনখারাপও হয়।

ফ্যান্টাসির ভক্তরা না পড়ে থাকলে অতি অবশ্যই পড়ে ফেলুন।