বুধবার, ৫ জুন, ২০২৪

শোগুন, নোহ আর কাবুকি কথা

 

শোগুন টিভি সিরিজ

যাঁরা সিরিয়াসলি লং ফর্ম্যাট কাজ মানে সিরিজ/লিমিটেড সিরিজ নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাঁদের অনেকের মতে এই বছরের সেরা কাজ হল 'শোগুন'। জাপানের শেনগোকু পিরিয়ড (১৪৬৭-১৬০০) এর এই গল্পে জাপানের সমাজ, রাজপরিবার, চার্চ আর ওয়ারলর্ডদের ইন্টারনাল কনফ্লিক্টকে হুবহু তুলে আনা হয়েছে। জেমস ক্লাভেলের এশিয়ান সাগার এই উপন্যাস নিয়ে আগেও ভিস্যুয়াল মিডিয়ামে কাজ হয়েছে, কিন্তু এইবার যেভাবে জাপানের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে, তেমন সম্ভবত আগে কোনও ওয়েস্টার্ন প্রোডাকশনেই হয়নি। (ও, ব্লু আই সামুরাই বাদ। অ্যানিমে জগতে ও জিনিসটা লেজেন্ড হয়ে থাকবে) অ্যাপল টিভি আর এইচবিও ম্যাক্স এখন হাত কামড়াচ্ছে, কেন এটা তাঁরা আগে কমিশন করল না? ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টরাও নড়েচড়ে বসেছে, কিন্তু কিছুতেই কেউ সিক্রেটটা বুঝে উঠতে পারছে না। এফ এক্স নেটওয়ার্ক আর ক্রিয়েটর র‍্যাচেল কন্ডো-জাস্টিন মার্ক্স জুটি ঠিক কী আলাদা করল? আর দশটা সিরিজকে পিছনে ফেলে এই সিরিজটা এনসিয়েন্ট জাপানকে এত সূক্ষ্মভাবে ধরল কী করে? হোয়াট হ্যাভ দে ডান ডিফারেন্ট?

কিছুদিন আগে সে রহস্য খোলসা হয়েছে। আর কিছুই নয়, শোগুনকে অথেন্টিক বানানোর জন্য যে রেফারেন্স পয়েন্ট ধরে ধরে এক একটা করে সিন ব্লক করা হয়েছে, যেভাবে গল্পের ট্রিটমেন্ট আর স্টোরিবোর্ড ডিজাইন হয়েছে, তার সবটাই এসেছে জাপানের ট্রাডিশনাল থিয়েটার, বিশেষ করে নোহ আর কাবুকি থিয়েটার থেকে। সে জন্য ক্রিয়েটররা নোহ থিয়েটারের এক মহারথীকে প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে টিমে নিয়ে এসেছিলেন, যাঁর নাম মাস্টার কোজুফুসা হোসো। হোশো স্কুল অফ নোহ থিয়েটারের এই 'মাস্টার' শুধু কন্সাল্টেশন দেননি, তিনি গোটা সিরিজটাকেই একটা নো পারফর্ম্যান্সের মতো করে প্রেজেন্ট করার কথা বলেছিলেন। 'শোগুন' এর ছয় নম্বর এপিসোডে একটা সত্যি নাটকের দৃশ্যও মঞ্চস্থ হচ্ছে, আর এই নাটকটাই অভিনীত হচ্ছে গোটা সিরিজ জুড়ে, মানে, গল্প ইজ সেম, বাকিটা টেক ইট অ্যাজ আ মেটাফর। 

প্রশ্ন হল, কাবুকি আর নোহ থিয়েটার নিয়ে এত মাতামাতি কেন? জাপানি থিয়েটার নিয়ে এমনিতে জাপানের বাইরে খুব একটা কিছু শোনা যায় না, কিন্তু শিন্টো ধর্ম ( ইয়ে, মানে জাপানে শিন্টোইজমটাই প্রধান ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম দু নম্বরে আসে৷ ব্যাপারটা অনেকেই জানেন না, শিন্টোইজম কথাটাই অনেকে শোনেনি) আর শোগুনেতে সমাজে এই নাটকগুলো এত গুরুত্বই বা পেল কেন? আর তাদের মধ্যেও বুনরাকু (জাপানিজ পাপেট শো), কিওজেন প্রভৃতিকে পিছনে ফেলে নোহ আর কাবুকি এগিয়ে গেল কেন? আর সেই নিয়ে এত লাফালাফিই বা কেন?

কারণটা বলতে হলে আগে ভূতের গল্পই ফাঁদতে হবে। কারণ, উত্তরটার সঙ্গে সুপারন্যাচারাল এলিমেন্টের একটা প্রচ্ছন্ন যোগাযোগ তো আছেই। কিন্তু, তার আগে, খুব সংক্ষেপে একটু ইতিহাসের ওপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক!

প্রথমে নোহ (Noh) এর কথাই হোক। নোহ একেবারে যাকে বলে ক্লাসিকাল জাপানিজ নৃত্যনাট্য, তাতে নাচ গান কবিতা আবৃত্তি ড্রামা সবই থাকে, কিন্তু সংলাপ থাকে না, এ হল সিরিয়াস মিউজিকাল ড্রামা। ড্রামা  (কিওজেন বা নোহ-কিওজেনে অবশ্য সংলাপ থাকে, আর প্রায় একই ধারার শিল্প হলেও কিওজেনে গল্পটা কিছুটা কমিকাল স্টাইলে বলা হয়। মাঝেমধ্যে একই স্টেজে দুই ফর্মের দেখা পাওয়া যায়) চতুর্দশ আর পঞ্চদশ শতাব্দীতে নাট্যকর কানামি আর তাঁর ছেলে জিয়ামির হাত ধরে এই ফর্ম অফ নাটকের সূত্রপাত, সে যুগেই তাঁরা তিনশোটার কাছাকাছি নাটক লিখেছিলেন, পরিচালনা, অভিনয় আর আর্ট প্রোডাকশন নিয়েও সমস্ত খুঁটিনাটি লিখে গেছিলেন। আসলে অবশ্য এই ধারার সূত্রপাত আরো আগে, খুব ছোট করে বলতে হলে স্ট্রিট থিয়েটার 'সারাগাকু' আর ধান রোপণ উৎসবের ড্রামা মিলেমিশে একাকার হয়ে নতুন এক আর্ট ফর্মের সৃষ্টি হয়েছিল। যাই হোক, মিলিটারি লিডার থুড়ি শোগুন আশিকাগা য়োশিমিতসু নোহ নাটক দেখে একদম ফিদা হয়ে গেছিলেন, তাঁর রাজত্বে নোহ থিয়েটার একদম ফুলেফেঁপে উঠেছিল। 

নোহ নাটকে সাধারণত দুটো সিন থাকে, আর প্রায়ই সেখানে একটা ভূত, একটা শয়তান রাক্ষস কিংবা একটা অত্যাচারিত মানুষের দেখা মেলে। গদ্য পদ্য মিশিয়ে লেখা ন্যারেটিভ, পুরোটাই সুর করে অভিনয় হয়, শেষে একটা দীর্ঘ ডান্স। একটায় অবশ্য চলত না, শুরু হলে প্রায় চার পাঁচটা নাগাড়ে অভিনয় হত, আট ঘণ্টার আগে শেষও হত না।

১৬০৩ থেকে ১৮৬৮ এর মাঝে এদো পিরিয়ডেও মিলিটারি শাসকদের ফেভারিট ছিল নোহ, রাজত্বের অফিশিয়াল আর্টফর্ম বলতে আর কিছুর কথাই মনে পড়ত না। শিন্টো শ্রাইনে পারফর্ম্যান্স হত, সামুরাই আর নোবল ফ্যামিলির লোকজন এসে সমবেত হত। এর পর মেইজি পিরিয়ডে অবশ্য অবস্থা পাল্টায়, রয়্যাল পেট্রোনেজ সরে যায়, তবে আর্টিস্ট অ্যাক্টরদের ফ্যামিলিরা ফর্মটাকে কোনওমতে বাঁচিয়ে রাখে। 

এইবার আসা যাক কাবুকি থিয়েটারের কথায়। কাবুকির ইতিহাস আরো বেশি ইন্টারেস্টিং, আর তাতে অনেক ওঠানামাও আছে। এর উদ্ভব প্রায় চারশো বছর আগে কিয়োটোতে ওকুনি বলে এক মহিলার হাত ধরে। সময়টা তোকুগাপা শোগুনাতের, মানে ওই ১৬০৩-১৮৬৮ হবে হয়তো। কাবুকি কথাটা এসেছে 'কাবুকু' থেকে, তার মানেই হল অদ্ভুত পোশাক পরে উল্টোপাল্টা কাণ্ড করা। ক্রমে কিয়োটো থেকে কাবুকি ইদোর রেড লাইট ডিসট্রিক্টে ছড়িয়ে পড়ে, সে জায়গার নাম দেওয়া হয়েছিল উকিও মানে ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড। ট্রি হাউসে গেইশাদের পাশাপাশি কাবুকি শিল্পীদেরও দেখা যেত সে সময়।

তা কাবুকি আর নোহের মধ্যে মূল পার্থক্য হল, নোহ সামুরাই দর্শকদের মাথায় রেখে পারফর্ম করা হত, মার্শাল আর্টের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি আর দার্শনিক কথা বেশি থাকত, প্রপের ব্যবহার কম, ইম্যাজিনেশনের ওপরেই জোর বেশি। এদিকে কাবুকি শ্রাইনের জায়গায় আমজনতার জন্য রাস্তাঘাটে করা হত, সাধারণ মানুষকে নিয়ে গল্প, চরিত্রদের ওপর জোর থাকত, হাজার ধরনের রঙচঙে কিমোনো আর প্রপ এর ব্যবহার হত। দরকারে ইরোটিকা আর মজার মজার সিকোয়েন্সও ঢোকাত। জাপানি থিয়েটারের এক শিক্ষক তফাত বোঝাতে লিখেছিলেন, "Noh is austere, Kabuki flamboyant. Noh ritual, Kabuki spectacle, Noh offers spiritual consolation, Kabuki physical excitement; Noh seeks chaste models, Kabuki delights in the eccentric, the extravagant and the willfully perverse; Noh is gentle, Kabuki cruel; Noh is concerned with the hereafter, Kabuki bound bu here-and-now."

মুশকিল হল, মেয়েরা কাবুকি বলে নতুন এক আর্টফর্ম করছে বলে কোথায় সবাই বাহবা দেবে, তা না, সমাজ উচ্ছন্নে গেল বলে মেয়েদেরই কাবুকি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। মানে, ইলন মাস্ক নিজেই আউট অফ টেসলা। যাই হোক, ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ডের টি হাউসে (মানে ওই জাপানি হীরামণ্ডি আর কি) কাবুকি না হলে চলে না, তাই ছেলে অল্পবয়সী ছেলে প্রস্টিটিউটরাই মেয়ে সেজে নাটক করত। তাদেরকেও একই কথা ভলে ভাগানো হল, সমকামিতা নিয়েও আইন ফাইন পাস হল। ছেলে আবার মেয়ে সেজে নেচে নেচে নাটক করবে কি! দেশটা গোল্লায় গেল! 

তারপর থেকে পুরুষরাই কাবুকি (যারা মেয়েদের চরিত্র করছে, তাদের বলা হয় ওনাগাতা অ্যাক্টর) করছে, এখনও মেয়েরা কাবুকিতে অ্যালাউড নয়। তবে কাবুকি থেকে বিতাড়িত হয়ে মেয়েরা নিজের মতো একটা ডান্স ফর্ম তৈরি করে, সেই 'নিহান বুশি' ডান্স এখনও রয়ে গেছে, আমরা সবাই সেই হাতপাখা ঘোরানো নেত্য দেখেছি। কালে কালে নোহ থিয়েটার এর মতো কাবুকির অবস্থাও খারাপ হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসবের চিহ্নই ছিল না, স্টেজগুলোও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে একটু একটু করে আবার এই দুই ধারার নাটক মূলধারায় ফিরেছে, ইউনেস্কোর রেকগনিশন পেয়েছে। কাবুকি থিয়েটারে তো কার্টেন রেইজ থেকে স্টেজ ঘুরে যাওয়া, 'হানামিচি' বা ফ্লাওয়ার ওয়ের মতো নানান টেকনিক এসেছে, থ্রি ডি সিনেমার মতো ব্যাপার স্যাপার। এই দুই ধারার অভিনেতারাই কিন্তু কাজ নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস, সারাজীবন ধরে নিজেকে ইম্প্রুভ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। 

এইবার আসল প্রশ্ন? হোয়াই অন আর্থ দিস নাটকস আর সো সিগ্নিফিকেন্ট? কী এমন আছে যে একটা সময়কে ধরার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শেষমেশ নাটকের এক্সপার্টকে বোর্ডে আনতে হল, ভালো কোনও প্রোডাকশন ডিজাইনার দিয়ে কাজ চলছিল না? 

না, চলছিল না। কারণ দুটো। প্রথম হল, অন্য সমাজ থেকে এসে জাপানকে পর্দায় তুলে ধরতে হলে যে অ্যাস্থেটিকসের ধারণা থাকতে হয়, জাপানে সেটা অন্য কোনও ফর্ম থেকে পাওয়া মুশকিল। দুটো বিকল্প আছে আইডিয়া পাওয়ার জন্য, সাহিত্য আর জাপানিজ আর্ট, মূলত উডব্লক প্রিন্ট। কিন্তু যখন জীবন্ত একটা আর্টফর্ম ছ'শো বছর আগের সমাজকে আজও হুবহু, উইথ অল ডিটেলিং, তুলে আনতে সক্ষম, তাহলে সেকেন্ডারি সোর্সের কাছে কে যায়? 

দ্বিতীয় কারণটা অবশ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল, সমাজের সঙ্গে নোহ আর কাবুকির সংয়োগ আর সাধারণ মানুষের ওপর সেই গল্পের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। যেমন, কাবুকির শেক্সপিয়ার হলেন চিকামাতসু, তিনি নাটক লিখতেন খবরের কাগজ পড়ে, নিষিদ্ধ প্রেম বা হনার কিলিং এর যে ঘটনা সত্যিই ইমপেরিয়ালিস্ট জাপানে ঘটেছে, সে সব আরেকটু নাটুকে ভাবে কাবুকি থিয়েটারে উঠে এসেছে। এখানে মনে রাখা দরকার, শোগুনের প্লটেও এরকম একটা নিষিদ্ধ প্রেমের ছায়া আছে যেখানে এক সামুরাইয়ের স্ত্রী এক ইংরেজ বণিকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য আমাদের সিরিজে নোহ থিয়েটার এর রিফ্লেকশানই বেশি, কারণ শোগুনের গল্প আর নোহ থিয়েটারে অভিনীত পাঁচ ধরনের নাটকের বিষয়বস্তু প্রায় সেম টু সেম। 

কী এই পাঁচটা প্লে? কামি মোনো (শিন্টো শ্রাইনের এক ধার্মিক গল্প), শুরা মোনো (যোদ্ধাদের গল্প, যেমন যোদ্ধা আতসুমোরি নিয়ে বেশ কিছু নাটক আছে), কাতাসুরো মোনো (যেখানে ছেলেরা উইগ পরে মেয়ে হয়ে অভিনয় করে, মানে ছদ্ম পরিচয়ের গল্প), গেন্ডাই মোনো (ন্যাচারালিস্টিক স্টোরি) আর কিয়োজো মোনো (এই নাটকে প্রেমিকার সন্তানকে হারিয়ে এক মা উন্মাদ হয়ে উল্টোপাল্টা কাণ্ড শুরু করে)। যাঁরা সিরিজটি দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন এই পাঁচটা এলিমেন্টই 'শোগুন' এর প্রাণ, এরাই স্টোরিলাইনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর ক্রিয়েটররা যেভাবে গল্পকে বুনেছে, তার পুরোটাই এসেছে নোহ নাটকের সিকোয়েন্সকে মাথায় রেখে। জাপানের জনতার মনন ও দর্শনে এই এলিমেন্টগুলো এমন ভাবে বাসা বেঁধে আছে যে এগুলো ছাড়া এনসিয়েন্ট জাপানের কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু তার চেয়েও বেশি যে জিনিসটা কাবুকি আর নোহ সম্পর্কে মানুষের সম্মোহনী আকর্ষণ ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে, সেটা হল এই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সুপারন্যাচারাল মিথগুলো। 

জাপানে অনেকেই বিশ্বাস করে, নোহ আর কাবুকি থিয়েটারে যখন কেউ শিন্টো ধর্মের দেবতা কিংবা অপদেবতার অভিনয় করে, তখন সে আর নিজের মধ্যে থাকে না, সুপ্রিম পাওয়ারের বশবর্তী হয়েই তারা মঞ্চে অভিনয় করে। আমাকে কেউ তুলোধনা না করে, তাই আগেই দু একটা উদাহরণ দিয়ে দিলাম। 

'ফ্যান্টম অফ জিয়ামি' নাটকটা লিখেছিলেন খোদ জিয়ামি মতোকিয়ো। অনেকের বিশ্বাস, এই নাটকটা অভিনীত হলেই তাঁর আত্মা এসে মঞ্চে আসন গ্রহণ করে। নারা আর কিয়োতোয় শো করার সময় শিল্পীরা বলেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই একটা অদৃশ্য শক্তিকে অনুভব করেন, সেই অদৃশ্য এন্টিটি তাঁদের গাইড করে, শাসন করে, মাঝেমধ্যে তাঁদের মুখ দিয়ে যে সংলাপ বেরোয়, সে কথা পরে আর অভিনেতারা মনে করতে পারে না। 'হন্টেড মাস্ক অফ ওকিনা' নাটকে একটা বিশেষ মাস্ক ব্যবহার করা হয়, সেটা নিয়ে আসা হয় কিয়োটোর একটা মন্দির থেকে। এই মাস্কটা যে ভূতুড়ে, সবাই একবাক্যে সে কথা স্বীকার করেছে। মাস্কটা মঞ্চে আনলেই অনেক সময় অদ্ভুত ঘটনা শুরু হয়, মুখোশটা নিজে নিজে হাওয়ায় উঠে যায়, পারফর্ম্যারদের কানে কানে ফিসফিস করে কে কথা বলে! এখানেই শেষ নয়, কাবুকি থিয়েটারে 'য়োতসুয়া কাইদান' নিয়ে তো এমন বদনাম রটেছে যে কেউ ওই নাটকটা করতেই চায় না। একটু এদিক ওদিক হলেই নাকি অভিনেতা আর অন্যান্য শিল্পীদের মাথা ঝিমঝিম করে, শরীর খারাপ হয়ে লোকে মারা গেছে বলেও জানা যায়। অনেকের মতে, ওকুনির প্রেতাত্মা আজও কাবুকির মঞ্চায়নের সময় সাদা কিমোনো পরে ঘুরে বেড়ায়। অনেক দর্শক মঞ্চে সাদা কিমোনো পরা এক মহিলাকে দেখতে পায়, কিন্তু আসলে তার কোনও অস্তিত্ব নেই, টিমের কেউই এরকম কোনও চরিত্রের কথা পরিকল্পনা করেনি। 

এসব গুজব হতে পারে, কিন্তু শিন্টো ডেইটিজের এই প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যায় না। শিন্টোইজম বিশ্বাস করে দুনিয়ার প্রতিটা সজীব বা নির্জীব বস্তুর মধ্যে দিয়েই স্পরিচুয়ালিটিকে হার্নেস আর ম্যানিফেস্ট করা যায়, আর প্রকৃতির মধ্যে যে সমস্ত মেটাফিজিকাল ফর্ম বা আধিভৌতিক বা দৈব এন্টিটি থাকে, তারা মাঝে মাঝে মানুষদের বশীভূত করে তাদের মধ্যে দিয়ে কথা বলে। মঞ্চ, বেশভুষা, আলো, সবকিছুই তখন দৈবের অংশ হয়ে ওঠে। যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আগেই 'কেগারে' মানে অপবিত্র জিনিসকে পিউরিফিকেশন করার জন্য পুজোপাঠ হয়, আর তার সবচেয়ে বেশি আয়োজন হয় নোহ থিয়েটারেই। ফলে, দর্শক আর শিল্পীদের বিশ্বাস, নাটকটা একটা সময়ের পর তারা নিজেরা করে না, করে 'কামি' নামের এই সুপারন্যাচারাল এন্টিটি। তাই নোহ নাটক শুধু বিনোদনের মিডিয়াম নয়, এইগুলোর সঙ্গে জাপানি সমাজের একটা দীর্ঘ ধার্মিক বিশ্বাস জড়িয়ে আছে।

শোগুন যে সময়টার কথা বলছে, সে সময় ব্যাপারটা আরো বেশি প্রবল ছিল, সামুরাইরা মাঝেমধ্যেই যাদুবলে কামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধ বিজয় এর জন্য আশীর্বাদ নেওয়ার চেষ্টা চালাতেন। সে জন্যে অনেক পুরুত ফুরুতও ছিল, আজও আছে। সেই বিলিফ সিস্টেমের লেগাসিও হারিয়ে যায়নি। 

ও, জাপানি উডব্লক প্রিন্টের মাস্টার শিল্পীরা নোহ আর কাবুকি নিয়ে প্রচুর এঁকে গিয়েছেন, সে সব দেখলে তাজ্জব হতে হয়। মাস্টার উতাগাওয়া কুনিয়োশির কিছু ছবি স্যাম্পল হিসেবে সঙ্গে দিলাম।












কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন