শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪

ইয়েমেন: দ্য লং স্টোরি অফ হাউথি মিলিশিয়া

 

Photographs by Amira Al-Sharif

গোটা দুনিয়া ধরে যে ছিছালেদর শুরু হয়েছে, তাতে ডিসকোর্সের কোনও জায়গা আর বাকি নেই। বাকি নেই কোনও রিস্ট্রেনও। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকার, অ্যাগ্রেশন আর রাগ সকলের নাকের ওপর বসে আছে। পান থেকে চুন খসলেই গালাগাল চড় থাপ্পড় লাথি ঘুষি কাট্টা চাকু ট্যাঙ্ক মিসাইল সার্জিকাল স্ট্রাইক যুদ্ধ... এখন এসব কোনও ব্যাপারই নয়। যেদিকে তাকাও, ভারত থেকে মেক্সিকো, রাশিয়া থেকে ইউক্রেন, কোরিয়া থেকে শ্রীলঙ্কা, নারকো টেরর থেকে রিলিজয়াস পোলেরাইজেশন... সব জায়গায় এক কাণ্ড। নিজের ইমোশন কন্ট্রোল না করতে পেরে রাগের বশত একটা ভুলভাল কাজ ঘটিয়ে ফেলা, তারপর সেটা জাস্টিফাই করা। জাস্টিফিকেশানের জন্য তামাম কারণ, হোয়াটাবাউটারি আর যুক্তিও তৈরিই থাকে। কিন্তু কেউই ভাবে না এক একটা ছোট্ট অ্যাকশনের দীর্ঘকালীন কনসিকোয়েন্স কী হতে পারে!
উদাহরণ এর জন্য, এই সময়ের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে ঘটনা গোটা দুনিয়ার ঘুম কেড়ে রেখেছে, গ্লোবাল সাপ্লাই চেনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কোটি কোটি ডলার লোকসান করিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য সহ বাকি পৃথিবীর শক্তি সমীকরণ বদলে দিচ্ছে, তা শুরু হয়েছিল এরকমই একটা ছোট্ট ঘটনা থেকে। কিছু অপমানজনক কথা, আর তারপর অন্য পক্ষকে হেয় করে একটা ছোট্ট ভায়োলেন্ট অ্যাকশন! এখন সারা দেশ ও অর্ধেক দুনিয়াকে সেই অ্যাগ্রেসনের মূল্য চোকাতে হচ্ছে।
কথা হচ্ছে হাউথি মিলিশিয়া নিয়ে, ইয়েমেনের এই সন্ত্রাসবাদী দল যা শুরু করেছে, তাতে আইসিস আর আল কায়দাও লজ্জা পেয়ে যাবে। কিন্তু, ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে অনেকেই এখনও বিশেষ কিছু বলছেন না, রাজনীতির এই নিয়ম। আসলে দুনিয়ার ঘুম উড়ে গেছে। যাই হোক, জিওপলিটিক্স নিয়ে ছোটখাটো কিছু লিখতে গেলেও অনেকটা বড় গল্প হয় যায়, আর এই ঘটনা প্রায় তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে চলছে। ধৈর্য না থাকলে না পড়াই ভালো।
ইয়েমেন দেশটা বহুকাল ধরে দুটো আলাদা আলাদা দেশে বিভক্ত ছিল। সবচেয়ে জনবহুল জায়গায় চিরকাল জায়দি মুসলিমদের শাসন ছিল, এরা শিয়া মুসলিমের একটা গোষ্ঠী। ছয়ের দশকে একটা মিলিটারি ক্যুপ হয়ে জায়দি সাম্রাজ্য ধ্বসে পড়ে, উত্তর ইয়েমেনে নতুন শাসকদলের আবির্ভাব হয়। এদের মধ্যেও মারামারি চলতেই থাকত, ইনফ্যাক্ট প্রথম দিকের অনেক শাসককেই খুন করা হয়েছিল। কিন্তু সাতের দশকের শেষের দিকে আলী আব্দুল্লাহ সালাহ বলে একজন কর্নেল শত্রুদের দমিয়ে নর্থ ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠেন। সালাহ ছিলেন জায়দি, কিন্তু এই গোষ্ঠীর আদর্শ বিশ্বাস পূর্ব সংস্কারের সঙ্গে তার দূর-দূর অব্দি কোনও সম্পর্ক ছিল না। ১৯৯০ আসতে আসতে সালাহ দক্ষিণ আর উত্তর ইয়েমেনের একীকরণ করে নতুন দেশের পত্তন করেন, কিন্তু এই বিশাল দেশের হাল হকিকত তাঁর কিছুই জানা ছিল না। ইয়েমেনের অধিকাংশ শক্তি ছিল সুন্নিদের কাছে, জায়দিদের সেটা পছন্দ ছিল না। উত্তরের পাহাড়ে মানুষ সুযোগ সুবিধা কিছু পেত না, তাদের সাহায্য করতে একটা নন প্রফিট আর এস এস এনজিও মার্কা ধার্মিক-সামাজিক সংগঠন গড়ে ওঠে, তারা সামাজিক কাজকর্ম করত, খাদ্য পানীয় স্বাস্থ্য সুবিধা নিয়ে সভাসমিতি বসাত, কিন্তু রাজনৈতিক অভিসন্ধি তাদের ছিল না। তবে এটা সত্যিই যে জায়দি গোষ্ঠীর একজন লোক দেশের হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে বসেছে আর নিজের লোকদেরই পাত্তা দিচ্ছে না, এই ঘটনার ফলে সালাহ অনেকের চোখের বালি হয়ে উঠেছিলেন। যাই হোক, সালাহর নিজের ক্যাবিনেটেই এক পলিটিশিয়ান ছিলেন, তার নাম হোসেন আল- হাউথি, তিনি নিজেও জায়দি, এবং এই মানুষটি বারবার সালাহের কাছে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছিলেন যে জায়দির প্রতি একটু সদয় হওয়া দরকার, সৌদি সরকারের কথায় না নেচে বরং দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের ওপর অ্যাকশন নেওয়া হোক, সঙ্গে তাদের নিজেদের লোককে একটু বেশি অধিকার দেওয়া হোক, টাকাপয়সা রোজগার এর ব্যবস্থা হোক, উত্তরের জনতা আর ক্যাবিনেটের অনেকেই খুব একটা খুশি নেই, বিদ্রোহ হতে পারে।
কিন্তু সালাহ তাঁকে পাত্তা দেননি। উল্টে কানের কাছে এই বকবক শুনে তাঁকে বারবার অপমান করেছেন, চোখ রাঙিয়েছেন, কড়া কড়া কথা শুনিয়েছেন, (শোনা যায় গায়ে হাতও তুলেছিলেন) এমনকি এ-ও বলেছেন, ওই পাহাড়ি অশিক্ষিত গুণ্ডাদের তিনি মোটেও কেয়ার করেন না। তারা চুলোয় যাক, সঙ্গে ইচ্ছে হলে হাউথিও সেখানে চলে যেতে পারেন। ক্যাবিনেটে তাঁর প্রয়োজন নেই।
সালাহ বেচারি জানতেন না, তার এই অদূরদর্শী মনোভাব গোটা ইয়েমনকে এমন এক চিরকালীন হিউম্যানিটেরিয়ান ক্রাইসিসে ঠেলে দেবে যেখান থেকে বেরোনোর কোনও আশাই থাকবে না। হাউথি অপমানিত হয়ে তাই করলেন, যা অন্য কোনও মাথা গরম জায়দি লিডার হলেও করত। তিনি সরকার থেকে আলাদা হয়ে সাদ্দায় একটা নিজস্ব পলিটিকাল উইং খুলে বসলেন আর নর্থের সেই ধার্মিক-সামাজিক 'বিলিভার্স ইউথ'-কে গরমাগরম ভাষণ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুললেন। এতদিন ধরে যারা শুধুই মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে কাজ করছিল, তারা আচমকা মনে করতে শুরু করল, এসব করে কিস্যু হবে না, এই একরোখা সরকারকে তাড়াতে না পারলে তাদের মুক্তি নেই, কিছুই ঠিক হবে না। ফলে দু এক বছরের মধ্যেই ছাত্রদের জন্য সামার ক্যাম্প বদলে গেল মিলিশিয়া ক্যাম্পে, খাবারের জায়গায় বিতরণ হতে লাগল রাইফেল, ইরানের ইসলামিক বিল্পবের মতো করে একটা নতুন ইয়েমেনিক বিপ্লবের রূপরেখা তৈরি হতে লাগল। দশ বছরও হল না, দেখা গেল উত্তর ইয়েমেন জুড়ে সালাহর বিরোধীরা তাণ্ডব শুরু করেছে, পাহাড়ি অঞ্চলে নিজেদের চেকপোস্ট লাগিয়েছে, হাজার হাজার লোক অস্ত্র হাতে স্লোগান দিচ্ছে।
এমন সময় ৯/১১ এর ঘটনা ঘটে গেল। ইয়েমেনে লুকিয়ে থাকা আল কায়দার সন্ত্রাসীদের খুঁজে বার করার জন্য আমেরিকা সালাহর ওপর চাপ দিতে লাগল। সালাহ আর কী করেন, সৌদির হাত আছে তার ওপর, আর ইউ এস আর সৌদি অ্যালাই। তিনি অনুমতি দিলেন, আমেরিকান ম্যারিনরা ইয়েমেনে এসে সন্ত্রাসীদের কচুকাটা করতে লাগল, সন্দেহের বশে সাধারণ মানুষের ওপরেও টর্চার শুরু হল, ইয়েমেনের মিলিটারিও তাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। এসব দেখে জায়দিরা রেগে আগুন, তারা শিয়া সেক্ট, সৌদির সুন্নি মুসলমানদের ওপর তাদের আগে থেকেই রাগ। আর আমেরিকার ওপর তো রাগ চিরকালের। দুই শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সালাহ নিজের দেশের শিয়াদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছেন দেখে তারা উত্তর ইয়েমেন জুড়ে একেবারে সশস্ত্র বিপ্লব করে বসল। অল-হৌথি নিজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাষণ দিচ্ছেন, আঠ থেকে আশি সবাই ঝপাঝপ র্যাশনালাইজ হচ্ছে। ধর্মের গার্নিশিং করলেই অল্পশিক্ষিত লোকজন একদম যুক্তিবুদ্ধি হারিয়ে 'মার মার কাট কাট' করে, ততদিনে অল-হাউথি জেনে গেছেন।
এইবার টনক নড়ল সালাহর। কিন্তু তিনি হলেন রাজা, ডিপ্লোম্যাসি দেখাবেন কেন? অন্যদের অপমান করতে পারেন, তাই বলে নিজের অপমান সইবেন কেন? সেই মানুষটার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন যাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, এই গুণ্ডাদের দাবির সামনে মাথা নত করবেন? কভি নেহি। ফলে সালাহ করলেন কি, সোজা সিআইএ স্টাইলে অল-হাউথির উপর একটা 'বাউন্টি' ঘোষণা করলেন, সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে যথেচ্ছ ভাবে রেবেল-নন রেবেল নির্বিশেষে সবাইকে কচুকাটা করলেন আর ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বললেন, "অল হাউথি ইজ অ্যান্টিন্যাশনাল!" এর এক সপ্তাহের মধ্যেই মিলিটারি অ্যাকশন করে অল হাউথিকে একটা গুহা থেকে খুঁজে বার করা হল আর যমের বাড়ি পাঠানো হল।
সালাহ ভেবেছিলেন, কাম খতম। এই ভায়োলেন্স দেখে বিদ্রোহীরা ভয়ে সিঁটিয়ে যাবে। কিন্তু, ওই একটা বুড়ো লোক কবে বলে গেছিল না, অ্যান আই ফর অ্যান আই মেকস দ্য হোল ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড!
সালাহ ভাবতেও পারেননি, অল হাউথির হত্যা আগুনে ঘি-এর কাজ করবে! হাউথি সরকার থেকে বেরিয়ে জায়দিদের অধিকার দেওয়ার জন্য কাজ করছেন (এমনটা তাদের বলে বোঝানো হয়েছিল, আসলে তিনি নিজেও ক্ষমতালোভীই ছিলেন), তাঁকে দেশদ্রোহী বলাটা লোকেদের পছন্দ হয়নি। ফলে অল হাউথির সমস্ত ফলোয়াররা একাট্টা হয়ে নিজেদের 'হাউথি-রেবেল' বলে সরকারের বিরুদ্ধে ফুল ফ্লেজড যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল। এতদিন ধরে যারা দোনামনা করছিল, এইবার তারাও হাতিয়ার তুলে নিল! একটা মাঝারি আকারের সেপারেটিস্ট আন্দোলন কখন একটা বিশাল মিলিশিয়া গ্রুপ হয়ে উঠল, কেউ বুঝতেও পারল না।
২০০৪ সাল আসতে আসতে হাউথি সন্ত্রাস সালাহের সেনাকে তাদের স্ট্রংহোল্ড থেকে তাড়িয়ে দিয়ে জায়গা অধিকার করতে শুরু করল। স্থানীয় সমর্থন ছিলই, উত্তর মধ্য ইয়েমেনের ভূদৃশ্যের সঙ্গে তারা পরিচিত, দরকার পড়লে পাহাড়ের গিরিখাত আর গুহায় লুকিয়ে পড়ার জন্য ঘাঁটি তৈরি হয়ে গেছে। ফলে একেবারে গুরিল্লা স্টাইল ক্যাম্পেন চালিয়ে সালাহের আর্মিকে জবাই করা হতে লাগল। ইয়েমেনি আর্মি সার্চ পার্টি নিয়ে বেরোলে। তারা কিছুতেই হাউথিদের খুঁজে পায় না। গ্রামবাসীদের উপর জোরাজুরি করে তাদের ঘাঁটির খবর জানার চেষ্টা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হল, একের পর এক পাহাড়ি আদিবাসীরা, অত্যাচারিত গ্রামের লোকজন রেগেমেগে হাতে অস্ত্র তুলে হাউথিদের সঙ্গে যোগ দিতে লাগল। সালাহ উপায়ান্তর না দেখে এইবার সৌদির কাছে সাহায্য চাইলেন, যদি শত্রুদের ঘাঁটিয়ে এয়ারস্ট্রাইল করে লাভ হয়, অস্ত্রও দরকার। সৌদি সাহায্য করল বটে, কিন্তু তখন তারা নিজেরাও জানত না এই একটা পদক্ষেপ ইয়েমেনের এই পাহাড়ি যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক করে তুলবে। এয়ারস্ট্রাইকের ফলে হাউথিদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, তারা উত্তরে সীমানা পেরিয়ে সৌদির শহরে হামলা চালাতে লাগল, তাদের নাগরিকদের হোস্টেজ রেখে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে দিল।
এদিকে, ইরান এতদিন বসে বসে এই সব ঘটনার উপর নজর রাখছিল। হাউথিরা এখন সৌদিকে থাপ্পড় মারছে, আর মধ্যপ্রাচ্যের আরব জগতে সৌদি ইরানের সবচেয়ে বড় শত্রু, তাদের সর্বনাশ করতে মদদ তো দিতেই হয়। ফলে ইরান এইবার রেড সি-এর রাস্তা দিয়ে হাউথি মিলিশিয়ার জন্য অস্ত্র আর অর্থ পাঠাতে শুরু করল, বিনিময়ে তারাও রেগুলার ইন্টারভালে সৌদিতে হামলা চালিয়ে গেল, মাঝেমধ্যে ইজরায়েলেও মিসাইল ছুঁড়ে মারতে লাগল। এদিকে সৌদি পড়েছে মহা বিপদে, একদিকে দক্ষিণে হাউথিরা ঝামেলা পাকাচ্ছে, অন্যদিকে অল কায়দার একটা শাখা এসে দেশে ডেরা বেঁধেছে। হাউথিদের পরে মজা দেখাব ভেবে তারা আগে এই অল কায়দার শাখাকে টার্গেট করল। অল কায়দার সৌদি ব্রাঞ্চও কম যায় না, তারা ওখান থেকে পালিয়ে ইয়েমনে থাকা অল কায়দা ব্রাঞ্চের সঙ্গে জোট পাকিয়ে একটা খতরনাক দল বানিয়ে ফেলল, সেটার নাম অল কায়দা ইন আরাবিয়ান পেনিনসুলা কাম এ কিউ এ পি। গত দশ বছরে বোঝা গেছে, নেটওয়ার্ক আর ফান্ডিং এর দিক থেকে এই দলটির মতো বিপজ্জনক সন্ত্রাসী দল আর মধ্যপ্রাচ্য দূর, সম্ভবত দুনিয়াতেও নেই। যাই হোক, এ কিউ এ পি এর লক্ষও আইসিসের মতো একটা বিশাল ইসলামিক স্টেট বানানো, কিন্তু এই পূণ্য কাজে অন্য দল এসে ভাগ বসাবে, সেটা হতে দিতে তারা নারাজ। তাই ব্যাটাচ্ছেলেরা একদিকে হাউথি, অন্যদিকে সালাহের আর্মির সঙ্গে লড়াই শুরু করে দিল। (যারা ভাবছেন আইসিস নিজে কোথায়, সবুর করুন, এখন সবে ২০১০ সাল)
২০১১ সালে আরব বসন্তে কী হয়েছিল সবাই জানে। একের পর এক দেশে বিপ্লব শুরু হল, জনতা দুর্নীতিবাজ সরকারকে সরে যাওয়ার জন্য পথে নেমে পড়ল। একদিকে কেওস, অন্যদিকে আশা। ইরান আর সৌদি দুজনেই দেখল, সুযোগটা কাজে লাগানো যাক। এই মওকায় এমন সব দেশে অ্যালাই বানানো যাক যারা পরে দরকার পড়লে সাহায্য করতে পারবে। প্রথমেই নজর পড়ল ইয়েমেনের উপর। ইয়েমেনেও মিছিল আর জনবিদ্রোহ চলছে, হাউথিরা আগেই সরকারকে ঘোল খাওয়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে আছে, এই সময়টা কাজে লাগিয়ে রেজিম চেঞ্জ করে নিজেদের একটা লোককে সরকারে বসানো হোক। কিন্তু সালাহ যেমন গোঁয়ার ছিলেন তেমন গোঁয়ার আছেন। কিছুতেই তিনি গদি ছাড়বেন না। তাতে জনারোষ আরো বেড়ে গেল। সৌদি বুঝল, এইটাই লাস্ট চান্স। তাদের দক্ষিণ সীমান্তে এসে হৌথিরা যা শুরু করেছে, সেটাকে সামাল দিতে হলে ইয়েমেনে নিজের কন্ট্রোল চাইই চাই। তারা গিয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য ইউনাইটেড নেশনসকে ধরল। ইউ এন আর সৌদির সম্মিলিত চাপে পড়ে সালাহ গররাজি হলেন, তাছাড়া প্রাণের ভয়ও ছিল, বিপ্লবীদের হাতে পড়লে মেরে হালুয়া বানিয়ে দেবেন। তিনি গদি ছেড়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদার মনসুর হাদিকে রাষ্ট্রপতি বানালেন, কিন্তু যেতে যেতে এতদিনে সঞ্চয় করা কয়েক বিলিয়ন ডলার নিয়ে যেতে ভুললেন ন, আর্মি আর ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও টাকাপয়সা দিয়ে নিজের দিকে টেনে আনলেন। ওদিকে হাদি প্রথমদিকে হাউথিদের সঙ্গে সন্ধি করতে চাইলেন, কিন্তু বছরখানেক টানাটানি করেও কিছুই হল না, হাউথিরাও বুঝে গেল এ ব্যাটা শুধুই নাটক করতে এসেছে, ডিরেক্টর আসলে রিয়াদে বসে কাবাব খাচ্ছে। "ন্যাশনাল ডায়ালগ-এর নিকুচি" বলে তারা বেরিয়ে গেল, এতদিন সময় নষ্ট হয়েছে, সংগঠন দুর্বল করাই এর উদ্দেশ্য ছিল। তারা আবার দ্বিগুন উৎসাহে ইরানের সাহায্য নিয়ে অসমাপ্ত কাজ শেষ করায় মন দিল।
২০১৪ সাল আসতে আসতে হাউথিরা যে কোনও আধুনিক সৈন্যদলের সমকক্ষ হয়ে উঠল, একের পর এক জায়গা সরকারের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে তারা। ড্রোন, মিসাইল, রকেট, বোমা, অধ্যানুনিক রাইফেল, মাইন… ট্রেনিং ক্যাম্প দেখে বোঝার উপায় নেই এরা একটা সন্ত্রাসী দল। এদিকে হাদ্দির অবিবেচনায় দেশের অবস্থা আরো খারাপ, লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এমন সময় তেলের দাম বাড়তে শুরু করল, জনারোষ দেখে হাউথিরা বুঝল এটাই সুযোগ। তারা এইবার দক্ষিণ ইয়েমনের দিকে এগোতে শুরু করল। মজার কথা হল, এই সময়ে হাউথিদের চিরশত্রু সালাহ, বিলকুল নীতিশ কুমার স্টাইলে পালটি মারলেন, তিনি ভাবলেন, হাদ্দিকে ভাগিয়ে হাউথিদের সঙ্গে হাত মেলালে আবার গদি পাওয়া যেতে পারে! ফলে তাঁর প্রভাবে থাকা সামরিক আধিকারিকরা হাউথিদের সাহায্য করতে লাগল, কয়েকদিনের মধ্যেই রাজধানী সানা হাউথিদের নিয়ন্ত্রণে চলে এল। হাদ্দি তাঁর মন্ত্রী ফন্ত্রী নিয়ে আরো দক্ষিণে পালালেন, কিন্তু হাউথি দস্যুরা তাড়া করছে। উপায় না দেখে তিনি সৌদি আরবে পালালেন৷ ২০১৫ আসতে আসতে হাউথিরা রাজধানী সহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে কব্জা করে স্বৈরশাসন চালাতে লাগল। যে বিলিভার্স ইউথ একসময় স্কুলে গিয়ে সামার ক্যাম্প করত, খাবার আর পোশাক দিত, স্বাস্থ্যসেবার জন্য চেষ্টা করত, তারাই এখন অপ্রেসিভ রেজিম চালাচ্ছে। কারো কথা পছন্দ না হলেই শুলে চড়ানো হবে! বাচ্চাদের স্কুল থেকে সরিয়ে এনে হাতে রাইফেল ধরিয়ে দেওয়া হল, মেয়েদের লাথি মেরে ঘরে বন্ধ করা দেওয়া হল, সিভিল সোসাইটির যে ক'জন হতভাগ্য এই দেশে রয়ে গিয়েছিল, তারা স্বাভাবিক নিয়মেই জেলে পচতে থাকল বা মারা পড়ল। বাচ্চারা তখন রাইফেল হাতে সাউথ দখল করবে বলে মার্চ করছে।
এদিকে সৌদি আরব তখন নার্ভাস হয়ে গেছে। সাদার্ন নেবারের দেশে এরকম কাণ্ড হলে কে আর শান্তিতে ঘুমাতে পারে? তারপর হাউথিদের উপর ইরানের হাত আছে, কাল হয়তো এরা রিয়াদেই চড়াও হবে। সৌদিরা নিজেদের বেশ অভিজাত ধনী মনে করে, এইসব ফালতু ঝামেলায় অয়েল বিজনেস ক্ষতিগ্রস্ত হলেই হয়েছে! তা ভয় পেলে কী করতে হয়? কী আবার, ভয় পেলেও মারতে হয়, রাগ হলেও মারতে হয়, দুঃখ বা অপমান হলেও মারতে হয়, আর আনন্দ হলে তো মারতেই হয়! ভায়োলেন্স ইজ অলওয়েজ দ্য বেস্ট অপশন। ফলে সৌদি মিলিশিয়া-সিভিলিয়ান- হাউথি-আল কায়দা- বাচ্চা- বুড়ো নির্বিশেষে শয়ে শয়ে বোমা ফেলে ইয়েমনকে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিল। ক্রাউন প্রিন্স আর রক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সলমান নতুন নতুন এসেছেন, একটা উল্লেখযোগ্য কাজ না করলে সিভি খারাপ হয়ে যাবে!
এয়ারস্ট্রাইকের পর অস্ত্র কম পড়তে এইবার তিনি বন্ধুর দিকে, মানে আমেরিকার দিকে চাইলেন। আমেরিকা ইরাকে গিয়ে বহুত ভুগেছে, নিজে আর ওই পাগলা আরবদের দুনিয়ায় ঢুকে অপমানিত হতে চায় না, তবে বন্ধু চেয়েছে বলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওবামা কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠানোর অনুমতি দিলেন, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নিষিদ্ধ ক্লাস্টার মিউনিশনও পাঠিয়ে দিলেন। ২০১৫ থেকে ২০১৯, সৌদি আমেরিকার সব চেয়ে বড় আর্মস ইম্পোর্টার হয়ে রইল। সেই ২০১৫ থেকেই সৌদি আরব আর আরব কোয়ালিশনের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ইয়েমেনের যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। মাঝ থেকে অল কায়দার সেই গ্রুপ এসে জায়গা হড়প করছে, বাজারের নতুন মিলিশিয়া হিরো আইসিসও এসে পড়েছে। মার মার কাট কাট! এদিকে আমেরিকা বলল, হাউথিরা চুলোয় যাক আমার কি, কিন্তু আইসিস আর আল কায়দাকে তো দমন করতেই হবে। এই বলে তারা এই ইয়েমেনে এই দুটো সন্ত্রাসী দলের ডেরায় বোমা ফেলতে শুরু করল। কতজন সন্ত্রাসী মরল জানি না, কয়েক হাজার সিভিলিয়ান যে এয়ারস্ট্রাইকে মরল, তার প্রমাণ অবশ্যই পাওয়া গেছে। হাউথিরাও চুপ করে বসার পাত্র না, তারা সৌদিতে ঢুকে একের পর এক ঘটনা ঘটাতে লাগল। সেই দেখে রক্ষামন্ত্রী সলমান রেগে গেলেন, এত বড় সাহস! পরদিনই ইয়েমেনে একশো তিরিশটা এয়ারস্ট্রাইক হল, স্কুল হাসপাতাল বাড়িঘর ওয়াটার প্লান্ট সব খতম! কল থেকে যদি বা বেরোয়, কালো জল বেরোয়। সবুজের চিহ্ন নেই। বাতাস ভারী হয়ে থাকে। রেড সি-তে সৌদি নৌবহরের পাহারা, যাতে অস্ত্র না আসতে পারে৷ কিন্তু ইরানও কম যায় না। এদিকে হাজার্নালিস্টরা ওয়ার ক্রাইমের দোহাই দিচ্ছে, সলমান ভাই নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছেন। এই প্রক্সি ওয়ারের মাধ্যমে যে তিনি চিরশত্রু ইরানকেই মজা দেখাচ্ছেন, তাতে তার সন্দেহ নেই। ওদিকে ইরানের সরকারও আনন্দে আছে, তার পাঠানো অস্ত্র যে হাউথিরা সউদিতে ব্যবহার করছে, এটা ভেবেই মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ছে।
২০১৭ সালে সৌদি আর ইউএই ভাবল, সালাহকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনলে পরিস্থিতিতে কিছুটা উন্নতি হতে পারে! সালাহ তো সেই জন্য জিভ বাড়িয়েই ছিলেন! হাউথিদের বিরুদ্ধে গেলেই তাঁকে ক্ষমতায় বসানো হবে শুনেই তিনি অবিকল ইয়েমেনিজ নীতিশ কুমার স্টাইলে রাজি হয়ে গেলেন, তাঁর নিজেদের সেনাপ্রধানরা এইবার হাউথিদের বিপক্ষে লড়তে শুরু করল। কিন্তু দুদিন পরই দেখা গেল সালাহ হাউথিদের হাতে খুন হয়েছেন। এদিকে তখন বাজারে এক সোনালি চুল ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে। তিনি আমেরিকার গদিতে বসেই বললেন, "ওয়ার ক্রাইমের নিকুচি! নিকেশ কর সব শালাকে।" এতদিন যা আসছিল, তার চেয়েও দ্বিগুণ অস্ত্র আসতে লাগল, এয়ারস্ট্রাইক বেড়ে গেল আরো বেশি! কে যে কাকে মারছে, কেন মারছে, তখন সে সব খতিয়ে দেখার সময় নেই।
২০১৮ সালে এই কনফ্লিক্ট নতুন মোড় নিল। ইউনাইটেড আরব এমিরেটস এতদিন সৌদির কোয়ালিশনে ছিল, এইবার সে বেঁকে বসল। ইউ এ ই জানাল, সে এই দলের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস হারিয়েছে। কিন্তু ইয়েমনে রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করার শখ তাদের এখনও ষোল আনা। ফলে দেখা গেল, ইউ এ ই কোয়ালিশন ছেড়ে দক্ষিণ ইয়েমনে সক্রিয় এক অন্য দল সাদার্ন ট্রাঞ্জিশনাল কাউন্সিল আব এস টি সি কে সহায়তা করতে লাগল। এই দলটার সঙ্গে সৌদি ব্যাকড সরকার বা হাউথিদের সম্পর্ক ছিল না, তারা আসলে এক স্বতন্ত্র দেশ চাইছিল। ইউ এ ই খুব চালাক ভাবে দক্ষিণ থেকে তাদের সৈন্যসামন্ত সরিয়ে নিল, যাতে এসটিসির রাস্তা পরিষ্কার করে দেওয়া যায়। এক বছরের মধ্যেই তারা দক্ষিণ ইয়েমনে নিজেদের সরকার গঠন করে ফেলল, ইউ এ ই সেই সরকারকে সমর্থনও দিল। দিনে দিনে ইউ এ ই সাপোর্টেড এসটিসি আর সৌদি সাপোর্টেড সরকার হাত মিলিয়ে হাউথিদের রুখতে চেষ্টা করল, কিন্তু হাউথিরা ততদিনে অসম্ভব শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা ইরানিয়ান মিসাইল তাক করে একবার সৌদির অয়েল ফ্যাক্টরি, একবার ইজরায়েলকে নিশানা করছে। ২০২১ সাল আসতে আসতে হাউথিরা দেশের ৭০% জনসংখ্যাকে ভুলিয়ে বুঝিয়ে জোর করে বা মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে নিজেদের সঙ্গে করে নিয়েছিল, এই গোটা সময় ধরে এল কিউ এ পি আর আইসিস ইয়েমনের বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রভাব বাঁচানোর জন্য লড়াই চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষের অবস্থা কহতব্য নয়। দু কোটি মানুষকে প্রতিদিন জল আর খাবার পৌঁছে দিতে হচ্ছে। বাড়ি নেই ঘর নেই, পানীয় জল নেই, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নের কথা বলা হাস্যকরই বটে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, রোজ মরছেও, এর মধ্যেও কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললে শুট আউটের নির্দেশ আছে, সে সরকার হাউথির হোক, সৌদি সমর্থিত সরকারের হোক, এসটিসির হোক… প্রায় নয় বছর যুদ্ধ চলার পর যখন বন্দুকবাজরাও একটু হাঁফিয়ে উঠেছে, তখন ইউএন এর মধ্যস্থতায় একটা সিজফায়ার করা হয়, ইরান ও সৌদির মধ্যেও ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন বহাল হয়, তাতেও চিনেরও ভূমিকা ছিল। এই ধ্বসে যাওয়া, দুমড়ে যাওয়া দেশে গিয়ে আমানা আল সারিফ, আসামা ওয়াগুইহ, মাত্তা ভেলাতি প্রভৃতিরা যে ছবি তুলে এনেছে, রিপোর্ট করেছে, সে সব দেখলে নিজেদের ভাগ্যশালী বলেই মনে হয়। সব কিছু হারিয়েও মানুষরা বলছেন, "এখনও বাঁচতে পারি! শুধু যদি এই লোকগুলো রাগ সামলে রাখে! কথায় কথায় মারামারি না করে!" এই লোকগুলো বলতে কোন লোকগুলো, সে কথার উত্তর কেউ দিতে চায়নি, সে লিস্ট অনেক বড়।
সিজফায়ার এক বছরও টেকেনি। ইজরায়েল গাজার ওপর হামলা শুরু করতেই হাউথিরা শাসানি দিয়েছিল, এই বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তারা রেড সি থেকে যাওয়া জাহাজগুলোকে নিশানা বানাতে শুরু করেছে। আঠেরো ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ জাহাজ এম ভি রুবি মার ডুবিয়ে যে উন্মাদনা শুরু হয়েছিল, তা দিন দিন আরো বেড়েছে। মার্কিন জাহাজ, ইউরোপিয়ান জাহাজ, এশিয়ান জাহাজ… কিছুই ছাড়া পাচ্ছে না। ভারতে আসতে থাকা অয়েল ট্যাঙ্কারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইন্ডিয়ান নেভি রিলিফ ওয়ার্কের জন্য কাজ করছে, এদিকে ব্রিটেন, আমেরিকারা ফের হাউথিদের ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। এমনিতেও এই জায়গাটা অসম্ভব সেনসিটিভ, চারিদিকে যত দেশ, সবগুলো ফেইল্ড স্টেট। সিভিল ওয়ার, মিলিটারি ক্যুপ, সোমালি পাইরেট, জিবুতি আর ইথিওপিয়া নিয়ে তো একটা অন্য পোস্ট লেখা যায়। দুনিয়া জুড়ে ত্রাস, কারণ রেড সি সাপ্লাই চেনের জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, তারপর ইন্টারনেটের সমস্ত কেবল এখান দিয়েই গেছে, হাউথিরা বেশিদিন এরকম চালালে গ্লোবাল ইকোনমিতে মেল্টডাউন আসতে পারে! গাজায় যুদ্ধ গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ইরান, সৌদি সবাই আবার মাঠে নেমে এসেছে, আবার সেই যুদ্ধ, সেই এয়ারস্ট্রাইক, সেই সিভিল ওয়ার, সেই হাজার হাজার মানুষের প্রাণ হারানো…
কী জানি, সালাহ যদি তিরিশ বছর আগে অল-হাউথির কথা শুনতেন! পছন্দ না করলেও তাকে যদি যথেচ্ছ অপমান না করতেন, লাথি মেরে না তাড়াতেন, তাহলে হয়তো ভবিষ্যৎটা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু জানি, ৯৯.৯৯℅ মানুষ এই সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেওয়ার কাউন্টার লজিক ইতিমধ্যেই ভেবে ফেলেছেন। সুতরাং, চলুক যুদ্ধ! দেশে দেশে! লড়াই হাতে, কাস্তে হাতে (না'হলে চড় থাপ্পড় তো আজকাল খুবই জনপ্রিয়) মানুষে মানুষে! টিভি আর খবরের কাগজে! ফেসবুকের কমেন্টে! দ্য ওয়ার মাস্ট গো অন!








বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০২৪

টুইন্স সেভেন সেভেন-- এক 'স্পিরিট-এড' শিল্পী


ইয়োরুবা সংস্কৃতিতে বাবালাওদের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আছে। বাবালাও হল ইফা ওরাকলের সেই সমস্ত প্রিস্ট বা ধার্মিক পূজারী, যাঁরা ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেয়ে স্পিরিচুয়ালি হাইয়ার লেভেলে চলে গেছে, মহাবিশ্বের অজানা রহস্য এখন তাঁদের জানা। ইয়োরুবা ভাষায় এই কথাটার মানেই হল ফাদার অফ সিক্রেটস। কিন্তু ইফাটা কী বস্তু! ইফা আর কিছুই নয়, একটা স্প্রিচুয়াল প্রফেসি বা দৈববাণীর সিস্টেম, এই সিস্টেম ইয়োরুবার সুপ্রিম ডেইটি ওলোরুন বা ওলাদুমার দেবতাকে নিবেদিত, কিন্তু ইকার কোর হল মেধার দেবতা (উরিষ্যা) ওরিশ্যা ওরুনমিলার শিক্ষা। সেই শিক্ষার ফাউন্ডেশন নিয়েই ইফা কালচার আর বাবালাওদের বিবর্তন ঘটেছে। 













বাবালাওরা তন্ত্রমন্ত্র, জাদু, আত্মার আগমন ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করেন এবং আগে থেকেই দুনিয়ার সমস্ত জীবজগতের ভবিষ্যৎ জেনে ফেলতে পারেন বলে বিশ্বাস আছে। সব ইফা পুরোহিত অবশ্য বাবালাও হতে পারেন না, সে জন্য 'ইকবাল' চাই। মানে, সেই ব্যক্তি কসমিক আশীর্বাদের অধিকারী না হতে পারলে বাবালাও হতে পারবেন না। 

এইবার এইসব শুনে যদি কারো কুসংস্কার মনে হয়, তাহলে বলতে হয়, ইয়োরুবা সংস্কৃতির এই প্র‍্যাক্টিস শুধু পশ্চিম আফ্রিকার গ্রামেগঞ্জে টিকে নেই, লন্ডন প্যারিস নিউইয়র্কের এলিট মহলেও নিয়মিত উড়িষ্যাদের পুজো করা হয়, মন্ত্রোচ্চারণ সহ সুপারন্যাচারাল প্র‍্যাক্টিসও চলে। গত বছর ভিয়েনাও এমন একটা বাবালাও ইভেন্টের আয়োজন চোখে পড়েছিল। এসব ভূতপ্রেত ঝাড়ফুঁক করে কী সত্যি কোনও লাভ হয়? হয় না বলাই যুক্তিসঙ্গত, কিন্তু তবু এক একটা ঘটনা ঘটে, যেগুলো আমার মতো লোকজনকে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় মেরে বলে যায়, তুমি কিস্যু জানো না বাছা। 

এই ভূমিকার প্রয়োজন ছিল না হয়তো, কারণ ইয়োরুবার তন্ত্রসাধনা বা জাদুটোনা নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। বলার ছিল এক শিল্পীর অবিশ্বাস্য জীবনের কথা, যিনি একাধারে গায়ক, কম্পোজার, নৃত্যশিল্পী, ভাস্কর্য ও পেইন্টার। নাইজিরিয়ার আর্ট ওয়ার্ল্ডকে সারা দুনিয়ায় জনপ্রিয় করতে এই মানুষটির যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তা অস্বীকার করা চলে না। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আশ্চর্য হল তাঁর জীবন কাহিনি।

আজকাল পপ কালচার জগতে 'ডোপ' বলে একটা স্ল্যাং ব্যবহার করা হয়। আফ্রিকা হল সেই ডোপ। এই মহাদেশের শিল্প সংস্কৃতি রাজনীতি সমাজ নিয়ে বেশি মাথা ঘামালে নেশা হয়ে যায়। তার কারণটাও সহজে অনুমেয়। আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সৃজনশীলতা উঠে আসে, তার অধিকাংশের কোনও রেফারেন্স পয়েন্ট আমাদের কাছে নেই। এ এক আলাদাই দুনিয়া। গত বছর আফ্রিকান আর্ট আর আর্টিস্ট সম্পর্কে কিছু কিছু লেখা পোস্ট করার কথা ভেবেছিলাম, দু একটার পর আর হয়ে ওঠেনি। যাই হোক, আরো কয়েকটা লিখে রাখা ছিল। তাই টুইন্স সেভেন সেভেনের একটা ছবি যখন ইন্সটাগ্রামে চোখের সামনে চলে এল, ভাবলাম এই পুরোনো লেখাটা পোস্ট করে দেওয়া যাক।

নামের কী বাহার! টুইন্স সেভেন সেভেন! তবে কিনা তাঁর আসল নাম এটা নয়, সেটা হল ওমোবা তাইও ওলানিয়ি ওয়েওয়ালে তোয়েজে ওয়েলালে ওসুনতোকি। নাইজিরিয়ার সবচেয়ে নামকরা বৈপ্লবিক শিল্পী তো বটেই, কিন্তু গানের জগতেও তাঁর নামডাক কিছু কম নেই। ইউনেস্কোর পিস প্রাইজ পেয়েছেন, নাইজিরিয়া সহ গোটা দুনিয়ায় সম্মানিত হয়েছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন রাস্তায় রাস্তায়, না খেতে পেয়ে শীতের রাত্রে ঘুরে বেরিয়েছেন, চোর ডাকাতের হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন, দুর্ঘটনায় মরতে মরতে শেষ পর্যন্ত মরেননি, কিন্তু ভাঙা কোমর আর হিপ নিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ, এই মানুষটার মধ্যে কিনা দৈব বাস করত বলে অনেকের বিশ্বাস।

টুইন্স সেভেন সেভেনের জীবন নিয়ে নাইজিরিয়ার বাইরে তেমন আলোচনা হয় না, উইকিতে বা ইন্টারনেটে কোথাও এসব ডিটেলে লেখা নেই। কিন্তু তাঁর জীবন যতটা চিত্তাকর্ষক, ততোটাই অভাবনীয়। 

বলছি, মুসলমান বাবা আর ক্রিশ্চান মায়ের সন্তান হলে কী হয়?এমনিতে কিছুই হয় না, কিন্তু ব্যাপারটা যখন চল্লিশের দশকে ঘটে, আর তাও ঘটে নাইজিরিয়ার ওগিডি বলে এক অনামা জায়গায়, তখন অনেক কিছুই হয়। প্রথমেই যা হয়, সমাজের লোক আপনাকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে। দু দলের ধর্মগুরুরাই আপনাকে নিয়ে হেলাফেলা করে, অনেকে স্রেফ অভিশাপ দেয়। সেই অভিশাপের ফলে হয়তো নয়, কিন্তু ঘটনা এটাই যে মারির গর্ভে সাত সাতবার জমজ বাচ্চার আগমন হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া কেউই বাঁচেনি। (প্রসঙ্গত, নাইজিরিয়ায় জমজ বাচ্চার জন্মের হার সবচেয়ে বেশি) 

মারির স্বামী আইতোয়েজে নিজেও প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে তার ওপর অভিশাপ লেগেছে, কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। বরং গিয়ে হত্য দিয়েছিল পাশের গাঁয়ের বাবলাওয়ের কাছে। সৌভাগ্যবশত, বাবলাওরা মুসলমান ক্রিশ্চান পরোয়া করেন না, মৃত্যু পরবর্তী আর জন্মের আগের দুনিয়া নিয়েই তাঁদের কাজকারবার বেশি, জ্যান্ত মানুষের চেয়ে বেশি আড্ডা হয় সম্ভবত আত্মার সঙ্গেই। মারিকে দেখেই তিনি বলে দিয়েছিলেন, কেস গড়বড়। অনেক কাজ করতে হবে। 

তা গুনেটুনে দেখে তাঁর বিধান এল, ওসুন দেবীকে নিবেদিত নদীর জল ছাড়া জল খেলে মারির গর্ভের সন্তান সারভাইভ করবেন না। তখন মারি আবার প্রেগন্যান্ট, আর অজন্মা বাচ্চার জন্য সব কিছু করতে তইয়ার। ফলে আনুষ্ঠানিক পুজোপাঠ ছাড়া যেটা হল, মারিকে সেই পবিত্র নদীর জল খাওয়ানো হতে লাগল। পুর্বপুরুষদের আশীর্বাদের জন্যও ভয়ানক সব যজ্ঞফজ্ঞ হল, কিন্তু বাবলাও এরইমধ্যে একদিন বলে দিলেন, সন্তান যদি বেঁচেও যায়, মনে রেখো, সে মানুষ নয়, মনুষ্য রূপে নিয়ে আসা এক দৈব আত্মা। বেশি ঝামেলা করলেই মানুষের রূপ ছেড়ে আত্মা হয়ে পালাবে। দ্বিতীয়ত, এই ছেলে যে কাজে হাত দেবে, সেই কাজেই এক্সেল করবে। কিন্তু, মানুষের মতো করে বাঁচার বিদ্যা তাঁর জানা নেই, সে আসলে মানুষ নয়। তাই যত বড় ইঞ্জিনিয়ার হোক না কেন, অর্থোপার্জন করতে পারবে না। যত বড় নেতা হোক না কেন, রাজ্য ধরে রাখতে পারবে না। যত বড় সেলেব হোক না কেন, খ্যাতি ধরে রাখতে পারবে না। সময়ের আগে সে মরবে না, কারণ পুর্বপুরুষ আর ওরুনমিলার আশীর্বাদ আছে তাঁর ওপর, কিন্তু এই দুনিয়ায় কাজ ফুরোনো হয়েছে জানতে পারলেই তাঁকে স্পিরিট ওয়ার্ল্ডে ফিরে যেতে হবে।

মারি আর আইতোয়েজে, দুজনেই মেনে নিয়েছিলেন। না মেনে উপায়ও নেই। অবশেষে মারির ছেলে হল, আর আশ্চর্যভাবে সে ছেলে বেঁচে গেল। আগে সাত বার জমজ ছেলে মারা গিয়েছে, তাই ছেলের অল্টারনেট নাম হয়ে গেল টুইন্স সেভেন সেভেন। তাঁর রূপ ধরে নাকি তাঁর ঠাকুরদাই ফিরে এসেছিলেন। 

যাই হোক, টুইন্স সেভেন সেভেনের জীবন যেভাবে গড়িয়েছে, তাতে ওই বাবালাওয়ের ভবিষ্যৎবাণীর কথাই মনে পড়ে। সবাই বলে, ছোটবেলায় সে মাকে বহুত জ্বালিয়েছে। বকা খেলেই বলত, ওসব দোষ আমি বুঝি না, বেশি বকলে নিজের জগতে ফিরে যাব। তবে ধীরে ধীরে তাঁর অন্যান্য জিনিসে আগ্রহ জাগে, তখন আর ফিরে যাওয়ার কথা মাথায় আসত না। 

এই ছেলে ছেলেবেলা থেকে যে জিনিস করতে গেছে, সেখানে গিয়েই কেরামতি দেখিয়েছে। ইয়োরুবা সংস্কৃতির উৎসবে নাচ করতে করতে তার নাচের শখ হয়, তারপর সে এমন নৃত্যচর্চা শুরু করে যে সবাই অবাক। উৎসবের সময় তাকে নাচতে দেখার জন্য কয়েক গ্রাম লোক এসে হাজির হত। একসময় এমনও গেছে, অর্থাভাবে রাস্তায় নেচে নেচে পয়সা চাইতেন, লোকে আধুলি ছুঁড়ে দিত। 

এরপর এল গান। শুধু গান গাওয়া নয়, গান বাঁধাও। সেই চর্চা সারাজীবন ধরে করেছেন। পড়াশোনাতেও ব্রাইট ছিলেন, কিত স্কুল কলেজের ধরাবাঁধা নিয়ম তাঁর পছন্দ হয়নি। গান নিয়েই দিন কাটত। নানা জায়গায় নাটকে গান করতে যেতেন, শহরের বাইরে বাইরেও নানান সঙ্গীতানুষ্ঠানেও যেতেন। সেরকম একটা জায়গাতে নাচগান করতে গিয়েই উল্লি বেইয়ার এর সঙ্গে দেখা। প্রসঙ্গত, এই উল্লি বেইয়ার এক নমস্য ব্যক্তি, নাইজিরিয়া আর পাপুয়া নিউগিনির আধুনিক সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতিকে গড়ে তুলতে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনিই নাইজিরিয়ায় ওসোগবো স্কুল অফ আর্ট এর পত্তন করেন, নাইজিরিয়ার আর্ট ওয়ার্ল্ডের তীর্থস্থান এই স্কুল। সবচেয়ে মজার কথা হল, ওসোগবা সেখানে কাউকে আঁকার ট্রেনিং দেওয়া হত না, বরং তাঁদের জীবন আর কল্পনাকে নিজের মতো করে ম্যানিফেস্ট করে কাগজে ফুটিয়ে তোলার জন্য এনকারেজ করা হত। টুইন্স সেভেন সেভেন উল্লি বেইয়ার এর সঙ্গে সেই স্কুলের একটা ওয়ার্কশপে গিয়ে পড়লেন। বাকিটা ইতিহাস।

দীর্ঘ কেরিয়ারে টুইন্স সেভেন সেভেন এমন সব অসামান্য ছবি এঁকে গেছেন, যা আর কেউ চেষ্টা করলেও আঁকতে পারবে না। আর্ট ক্রিটিকরাও হার মেনে গেছেন, কিন্তু একসুরে বিশ্লেষণ করতে পারেননি।

তাঁর ছবি জুড়ে ইয়োরুবা সংস্কৃতি, মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, আর দেবতা। কিন্তু একটা কিছু যেন অন্যরকম। আসলে, তিনি স্পিরিটস ওয়ার্ল্ডের ছবি এঁকেছেন, ওয়ার্ল্ড বিয়ন্ড হিউমান গ্রাস্প। এই দুনিয়াটাকে যেন তিনি চোখের সামনে দেখতে পেতেন। উল্লি বেইয়ার নিজে বলেছিলেন, "এই ছেলেটার চোখ মানুষের মতো নয়। ও সব কিছু অন্যভাবে দেখতে পায়।"

একসময় তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ে, ইউরোপের নানান দেশে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। কিন্তু টুইন্স সেভেন সেভেন অন্যান্য শিল্পীদের মতো সেই খ্যাতিকে ধরে রাখতে চাননি, বরং অবসর সময়ে একের পর এক কম্পোজিশন তৈরি করেছেন, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন, বাস্কারদের সঙ্গে পথে পথে নেমেছেন। অন্য শিল্পীদের ছবি দেখা নিয়েও তাঁর উৎসাহ ছিল না। পিকাসোর এক্সিবিশনে যাওয়ার দিন লুকিয়ে পড়েছিলেন। পরে জিজ্ঞেস করাতে জানিয়েছিলেন, "ওইসব ভালো ভালো ছবি দেখে ইন্সপায়ার্ড হয়ে গেলে আমার নিজের ছবি আঁকতে ভুলেই যাব।" বরং প্রিয় বই 'মাই লাইফ ইন দু বুশ অফ গোস্টস' পড়তেন বারবার, তাঁর অনেক ছবির মূল ইন্সপিরেশন হয়তো এই বইটাই।

সত্যিই হয়তো তাই। তবে কিনা পিকাসোর আঁকার শৈলি নিয়ে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে, হচ্ছে, তার একাংশও টুইন্স সেভেন সেভেনের ছবি নিয়ে হয়নি। অথচ, তাঁর মতো একটা ছবি আঁকতে গেলে সবাই নাকানিচোবানি খেয়ে যায়। এত সময় লাগে যে বলার নয়! এদিকে টিএসএস স্বল্প সময়ে এতগুলো কাজ করে গেছেন যে তাজ্জব হতে হয়। 

হয়তো বাবলাওর কথাই ঠিক, ইনি সাধারণ মানুষ ছিলেন না। যখুনি আর চারটে সফল শিল্পীদের মতো কিছু করতে গেছেন, ডাহা ফেল মেরেছেন। ইয়োরুবা আর্ট নিয়ে একটা থিম পার্ক নির্মাণ এর ইচ্ছে ছিল তাঁর, হয়নি। সব টাকা জলে গেছে। আমেরিকায় শিক্ষকতা করতে গেছেন, বেশিদিন পড়াতে পারেননি। একটা দুর্ঘটনায় মরতে মরতে বেঁচে যান, চিকিৎসকরা অবাক হয়ে গেছিলেন! 'মিরাকল, মিরাকল' বলা ছাড়া আর কিছুই বোঝেননি! 

মরেননি বটে, কিন্তু কোমর ভেঙ্গে কয়েক বছর বিছানায় পড়ে থাকেন। তাঁর জীবনে হাজাররকম সমস্যা ছিল, সে সব কোনোদিনই যায়নি। নাইজিরিয়ায় রাজনৈতিক গুণ্ডারা উত্যক্ত করছিল বলে আমেরিকায় গিয়েই শেষ জীবন কাটাবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে চোর জোচ্চোরদের হাতে সব খুইয়েছেন, ঘর থেকে বেদখল হয়েছেন, পুলিশের হাতে হেনস্থা হয়েছে, পেট চালাতে কখনও বাসন মেজেছেন, কখনও বাথরুম পরিষ্কার করেছেন। 
আর এসব তখন ঘটেছে, যখন তিনি খ্যাতির চূড়ায়। ২০০০ সালের কথা, তখন টুইন্স সেভেন সেভেন গ্লোবালি সেলিব্রেটেড আর্টিস্ট, কয়েকদিন আগেই নাইজিরিয়ায় চিফ উপাধি পেয়েছেন, আফ্রিকান ডায়াস্পোরা নিয়ে কাজ করার জন্য ইউনেস্কো আর ইউএন এর মতো সংগঠনরা তাঁকে সম্মান দেওয়ার কথা ভাবছেন, এদিকে তখন তিনি আমেরিকার রাস্তায় ঝাঁট দিচ্ছেন। ব্যাটা বাবলাও ঠিকই বলেছিল, এই ছেলেটা তাজ্জব সব ঘটনা ঘটাবে, কিন্তু মানুষের মতো করে বাঁচতে পারবে না। হয়তো পৃথিবীতে তাঁর কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল, ২০১১ সালে নাইজিরিয়ার এই শিল্পী ফের স্প্রিরিট ওয়ার্ল্ডে ফিরে যান। 

(যাঁরা ভদ্রলোকের কাজ মিস করে গেছেন, তাঁদের জন্য ক'টা স্যাম্পল রেখে গেলাম।)

শুক্রবার, ৭ জুন, ২০২৪

সৌম্যদীপ সিনহার পলিটিকাল কার্টুন


দ্য হিন্দুর অ্যাসিস্টান্ট এডিটর আর চিফ ইলাস্ট্রেটর সৌম্যদীপ সিনহার কিছু কাজ। কলকাতার এই শিল্পী কোনোরকম ফর্মাল ট্রেনিং না নিয়ে আঁকতে শুরু করেছিলেন বলে পড়েছিলাম। অনেকদিন ধরেই তাঁর কাজ দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি।

একের পর এক দুর্দান্ত ছবি, স্যাটায়ারে পলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপের ছোটখাটো কন্ট্রাডিকশন খুঁজে পাওয়া! বিশেষ করে গত কয়েক মাসে স্যার একদম কাঁপিয়ে দিয়েছেন। এই বছর তিনি যা করে দিয়ে গেলেন, পলিটিকাল কার্টুনিং এর জগতে তাঁকে বাদ দিয়ে কোনও আলোচনা আর করা সম্ভব রইল না।
 








বুধবার, ৫ জুন, ২০২৪

শোগুন, নোহ আর কাবুকি কথা

 

শোগুন টিভি সিরিজ

যাঁরা সিরিয়াসলি লং ফর্ম্যাট কাজ মানে সিরিজ/লিমিটেড সিরিজ নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাঁদের অনেকের মতে এই বছরের সেরা কাজ হল 'শোগুন'। জাপানের শেনগোকু পিরিয়ড (১৪৬৭-১৬০০) এর এই গল্পে জাপানের সমাজ, রাজপরিবার, চার্চ আর ওয়ারলর্ডদের ইন্টারনাল কনফ্লিক্টকে হুবহু তুলে আনা হয়েছে। জেমস ক্লাভেলের এশিয়ান সাগার এই উপন্যাস নিয়ে আগেও ভিস্যুয়াল মিডিয়ামে কাজ হয়েছে, কিন্তু এইবার যেভাবে জাপানের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে, তেমন সম্ভবত আগে কোনও ওয়েস্টার্ন প্রোডাকশনেই হয়নি। (ও, ব্লু আই সামুরাই বাদ। অ্যানিমে জগতে ও জিনিসটা লেজেন্ড হয়ে থাকবে) অ্যাপল টিভি আর এইচবিও ম্যাক্স এখন হাত কামড়াচ্ছে, কেন এটা তাঁরা আগে কমিশন করল না? ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টরাও নড়েচড়ে বসেছে, কিন্তু কিছুতেই কেউ সিক্রেটটা বুঝে উঠতে পারছে না। এফ এক্স নেটওয়ার্ক আর ক্রিয়েটর র‍্যাচেল কন্ডো-জাস্টিন মার্ক্স জুটি ঠিক কী আলাদা করল? আর দশটা সিরিজকে পিছনে ফেলে এই সিরিজটা এনসিয়েন্ট জাপানকে এত সূক্ষ্মভাবে ধরল কী করে? হোয়াট হ্যাভ দে ডান ডিফারেন্ট?

কিছুদিন আগে সে রহস্য খোলসা হয়েছে। আর কিছুই নয়, শোগুনকে অথেন্টিক বানানোর জন্য যে রেফারেন্স পয়েন্ট ধরে ধরে এক একটা করে সিন ব্লক করা হয়েছে, যেভাবে গল্পের ট্রিটমেন্ট আর স্টোরিবোর্ড ডিজাইন হয়েছে, তার সবটাই এসেছে জাপানের ট্রাডিশনাল থিয়েটার, বিশেষ করে নোহ আর কাবুকি থিয়েটার থেকে। সে জন্য ক্রিয়েটররা নোহ থিয়েটারের এক মহারথীকে প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে টিমে নিয়ে এসেছিলেন, যাঁর নাম মাস্টার কোজুফুসা হোসো। হোশো স্কুল অফ নোহ থিয়েটারের এই 'মাস্টার' শুধু কন্সাল্টেশন দেননি, তিনি গোটা সিরিজটাকেই একটা নো পারফর্ম্যান্সের মতো করে প্রেজেন্ট করার কথা বলেছিলেন। 'শোগুন' এর ছয় নম্বর এপিসোডে একটা সত্যি নাটকের দৃশ্যও মঞ্চস্থ হচ্ছে, আর এই নাটকটাই অভিনীত হচ্ছে গোটা সিরিজ জুড়ে, মানে, গল্প ইজ সেম, বাকিটা টেক ইট অ্যাজ আ মেটাফর। 

প্রশ্ন হল, কাবুকি আর নোহ থিয়েটার নিয়ে এত মাতামাতি কেন? জাপানি থিয়েটার নিয়ে এমনিতে জাপানের বাইরে খুব একটা কিছু শোনা যায় না, কিন্তু শিন্টো ধর্ম ( ইয়ে, মানে জাপানে শিন্টোইজমটাই প্রধান ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম দু নম্বরে আসে৷ ব্যাপারটা অনেকেই জানেন না, শিন্টোইজম কথাটাই অনেকে শোনেনি) আর শোগুনেতে সমাজে এই নাটকগুলো এত গুরুত্বই বা পেল কেন? আর তাদের মধ্যেও বুনরাকু (জাপানিজ পাপেট শো), কিওজেন প্রভৃতিকে পিছনে ফেলে নোহ আর কাবুকি এগিয়ে গেল কেন? আর সেই নিয়ে এত লাফালাফিই বা কেন?

কারণটা বলতে হলে আগে ভূতের গল্পই ফাঁদতে হবে। কারণ, উত্তরটার সঙ্গে সুপারন্যাচারাল এলিমেন্টের একটা প্রচ্ছন্ন যোগাযোগ তো আছেই। কিন্তু, তার আগে, খুব সংক্ষেপে একটু ইতিহাসের ওপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক!

প্রথমে নোহ (Noh) এর কথাই হোক। নোহ একেবারে যাকে বলে ক্লাসিকাল জাপানিজ নৃত্যনাট্য, তাতে নাচ গান কবিতা আবৃত্তি ড্রামা সবই থাকে, কিন্তু সংলাপ থাকে না, এ হল সিরিয়াস মিউজিকাল ড্রামা। ড্রামা  (কিওজেন বা নোহ-কিওজেনে অবশ্য সংলাপ থাকে, আর প্রায় একই ধারার শিল্প হলেও কিওজেনে গল্পটা কিছুটা কমিকাল স্টাইলে বলা হয়। মাঝেমধ্যে একই স্টেজে দুই ফর্মের দেখা পাওয়া যায়) চতুর্দশ আর পঞ্চদশ শতাব্দীতে নাট্যকর কানামি আর তাঁর ছেলে জিয়ামির হাত ধরে এই ফর্ম অফ নাটকের সূত্রপাত, সে যুগেই তাঁরা তিনশোটার কাছাকাছি নাটক লিখেছিলেন, পরিচালনা, অভিনয় আর আর্ট প্রোডাকশন নিয়েও সমস্ত খুঁটিনাটি লিখে গেছিলেন। আসলে অবশ্য এই ধারার সূত্রপাত আরো আগে, খুব ছোট করে বলতে হলে স্ট্রিট থিয়েটার 'সারাগাকু' আর ধান রোপণ উৎসবের ড্রামা মিলেমিশে একাকার হয়ে নতুন এক আর্ট ফর্মের সৃষ্টি হয়েছিল। যাই হোক, মিলিটারি লিডার থুড়ি শোগুন আশিকাগা য়োশিমিতসু নোহ নাটক দেখে একদম ফিদা হয়ে গেছিলেন, তাঁর রাজত্বে নোহ থিয়েটার একদম ফুলেফেঁপে উঠেছিল। 

নোহ নাটকে সাধারণত দুটো সিন থাকে, আর প্রায়ই সেখানে একটা ভূত, একটা শয়তান রাক্ষস কিংবা একটা অত্যাচারিত মানুষের দেখা মেলে। গদ্য পদ্য মিশিয়ে লেখা ন্যারেটিভ, পুরোটাই সুর করে অভিনয় হয়, শেষে একটা দীর্ঘ ডান্স। একটায় অবশ্য চলত না, শুরু হলে প্রায় চার পাঁচটা নাগাড়ে অভিনয় হত, আট ঘণ্টার আগে শেষও হত না।

১৬০৩ থেকে ১৮৬৮ এর মাঝে এদো পিরিয়ডেও মিলিটারি শাসকদের ফেভারিট ছিল নোহ, রাজত্বের অফিশিয়াল আর্টফর্ম বলতে আর কিছুর কথাই মনে পড়ত না। শিন্টো শ্রাইনে পারফর্ম্যান্স হত, সামুরাই আর নোবল ফ্যামিলির লোকজন এসে সমবেত হত। এর পর মেইজি পিরিয়ডে অবশ্য অবস্থা পাল্টায়, রয়্যাল পেট্রোনেজ সরে যায়, তবে আর্টিস্ট অ্যাক্টরদের ফ্যামিলিরা ফর্মটাকে কোনওমতে বাঁচিয়ে রাখে। 

এইবার আসা যাক কাবুকি থিয়েটারের কথায়। কাবুকির ইতিহাস আরো বেশি ইন্টারেস্টিং, আর তাতে অনেক ওঠানামাও আছে। এর উদ্ভব প্রায় চারশো বছর আগে কিয়োটোতে ওকুনি বলে এক মহিলার হাত ধরে। সময়টা তোকুগাপা শোগুনাতের, মানে ওই ১৬০৩-১৮৬৮ হবে হয়তো। কাবুকি কথাটা এসেছে 'কাবুকু' থেকে, তার মানেই হল অদ্ভুত পোশাক পরে উল্টোপাল্টা কাণ্ড করা। ক্রমে কিয়োটো থেকে কাবুকি ইদোর রেড লাইট ডিসট্রিক্টে ছড়িয়ে পড়ে, সে জায়গার নাম দেওয়া হয়েছিল উকিও মানে ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড। ট্রি হাউসে গেইশাদের পাশাপাশি কাবুকি শিল্পীদেরও দেখা যেত সে সময়।

তা কাবুকি আর নোহের মধ্যে মূল পার্থক্য হল, নোহ সামুরাই দর্শকদের মাথায় রেখে পারফর্ম করা হত, মার্শাল আর্টের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি আর দার্শনিক কথা বেশি থাকত, প্রপের ব্যবহার কম, ইম্যাজিনেশনের ওপরেই জোর বেশি। এদিকে কাবুকি শ্রাইনের জায়গায় আমজনতার জন্য রাস্তাঘাটে করা হত, সাধারণ মানুষকে নিয়ে গল্প, চরিত্রদের ওপর জোর থাকত, হাজার ধরনের রঙচঙে কিমোনো আর প্রপ এর ব্যবহার হত। দরকারে ইরোটিকা আর মজার মজার সিকোয়েন্সও ঢোকাত। জাপানি থিয়েটারের এক শিক্ষক তফাত বোঝাতে লিখেছিলেন, "Noh is austere, Kabuki flamboyant. Noh ritual, Kabuki spectacle, Noh offers spiritual consolation, Kabuki physical excitement; Noh seeks chaste models, Kabuki delights in the eccentric, the extravagant and the willfully perverse; Noh is gentle, Kabuki cruel; Noh is concerned with the hereafter, Kabuki bound bu here-and-now."

মুশকিল হল, মেয়েরা কাবুকি বলে নতুন এক আর্টফর্ম করছে বলে কোথায় সবাই বাহবা দেবে, তা না, সমাজ উচ্ছন্নে গেল বলে মেয়েদেরই কাবুকি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। মানে, ইলন মাস্ক নিজেই আউট অফ টেসলা। যাই হোক, ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ডের টি হাউসে (মানে ওই জাপানি হীরামণ্ডি আর কি) কাবুকি না হলে চলে না, তাই ছেলে অল্পবয়সী ছেলে প্রস্টিটিউটরাই মেয়ে সেজে নাটক করত। তাদেরকেও একই কথা ভলে ভাগানো হল, সমকামিতা নিয়েও আইন ফাইন পাস হল। ছেলে আবার মেয়ে সেজে নেচে নেচে নাটক করবে কি! দেশটা গোল্লায় গেল! 

তারপর থেকে পুরুষরাই কাবুকি (যারা মেয়েদের চরিত্র করছে, তাদের বলা হয় ওনাগাতা অ্যাক্টর) করছে, এখনও মেয়েরা কাবুকিতে অ্যালাউড নয়। তবে কাবুকি থেকে বিতাড়িত হয়ে মেয়েরা নিজের মতো একটা ডান্স ফর্ম তৈরি করে, সেই 'নিহান বুশি' ডান্স এখনও রয়ে গেছে, আমরা সবাই সেই হাতপাখা ঘোরানো নেত্য দেখেছি। কালে কালে নোহ থিয়েটার এর মতো কাবুকির অবস্থাও খারাপ হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসবের চিহ্নই ছিল না, স্টেজগুলোও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে একটু একটু করে আবার এই দুই ধারার নাটক মূলধারায় ফিরেছে, ইউনেস্কোর রেকগনিশন পেয়েছে। কাবুকি থিয়েটারে তো কার্টেন রেইজ থেকে স্টেজ ঘুরে যাওয়া, 'হানামিচি' বা ফ্লাওয়ার ওয়ের মতো নানান টেকনিক এসেছে, থ্রি ডি সিনেমার মতো ব্যাপার স্যাপার। এই দুই ধারার অভিনেতারাই কিন্তু কাজ নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস, সারাজীবন ধরে নিজেকে ইম্প্রুভ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। 

এইবার আসল প্রশ্ন? হোয়াই অন আর্থ দিস নাটকস আর সো সিগ্নিফিকেন্ট? কী এমন আছে যে একটা সময়কে ধরার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শেষমেশ নাটকের এক্সপার্টকে বোর্ডে আনতে হল, ভালো কোনও প্রোডাকশন ডিজাইনার দিয়ে কাজ চলছিল না? 

না, চলছিল না। কারণ দুটো। প্রথম হল, অন্য সমাজ থেকে এসে জাপানকে পর্দায় তুলে ধরতে হলে যে অ্যাস্থেটিকসের ধারণা থাকতে হয়, জাপানে সেটা অন্য কোনও ফর্ম থেকে পাওয়া মুশকিল। দুটো বিকল্প আছে আইডিয়া পাওয়ার জন্য, সাহিত্য আর জাপানিজ আর্ট, মূলত উডব্লক প্রিন্ট। কিন্তু যখন জীবন্ত একটা আর্টফর্ম ছ'শো বছর আগের সমাজকে আজও হুবহু, উইথ অল ডিটেলিং, তুলে আনতে সক্ষম, তাহলে সেকেন্ডারি সোর্সের কাছে কে যায়? 

দ্বিতীয় কারণটা অবশ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল, সমাজের সঙ্গে নোহ আর কাবুকির সংয়োগ আর সাধারণ মানুষের ওপর সেই গল্পের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। যেমন, কাবুকির শেক্সপিয়ার হলেন চিকামাতসু, তিনি নাটক লিখতেন খবরের কাগজ পড়ে, নিষিদ্ধ প্রেম বা হনার কিলিং এর যে ঘটনা সত্যিই ইমপেরিয়ালিস্ট জাপানে ঘটেছে, সে সব আরেকটু নাটুকে ভাবে কাবুকি থিয়েটারে উঠে এসেছে। এখানে মনে রাখা দরকার, শোগুনের প্লটেও এরকম একটা নিষিদ্ধ প্রেমের ছায়া আছে যেখানে এক সামুরাইয়ের স্ত্রী এক ইংরেজ বণিকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য আমাদের সিরিজে নোহ থিয়েটার এর রিফ্লেকশানই বেশি, কারণ শোগুনের গল্প আর নোহ থিয়েটারে অভিনীত পাঁচ ধরনের নাটকের বিষয়বস্তু প্রায় সেম টু সেম। 

কী এই পাঁচটা প্লে? কামি মোনো (শিন্টো শ্রাইনের এক ধার্মিক গল্প), শুরা মোনো (যোদ্ধাদের গল্প, যেমন যোদ্ধা আতসুমোরি নিয়ে বেশ কিছু নাটক আছে), কাতাসুরো মোনো (যেখানে ছেলেরা উইগ পরে মেয়ে হয়ে অভিনয় করে, মানে ছদ্ম পরিচয়ের গল্প), গেন্ডাই মোনো (ন্যাচারালিস্টিক স্টোরি) আর কিয়োজো মোনো (এই নাটকে প্রেমিকার সন্তানকে হারিয়ে এক মা উন্মাদ হয়ে উল্টোপাল্টা কাণ্ড শুরু করে)। যাঁরা সিরিজটি দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন এই পাঁচটা এলিমেন্টই 'শোগুন' এর প্রাণ, এরাই স্টোরিলাইনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর ক্রিয়েটররা যেভাবে গল্পকে বুনেছে, তার পুরোটাই এসেছে নোহ নাটকের সিকোয়েন্সকে মাথায় রেখে। জাপানের জনতার মনন ও দর্শনে এই এলিমেন্টগুলো এমন ভাবে বাসা বেঁধে আছে যে এগুলো ছাড়া এনসিয়েন্ট জাপানের কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু তার চেয়েও বেশি যে জিনিসটা কাবুকি আর নোহ সম্পর্কে মানুষের সম্মোহনী আকর্ষণ ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে, সেটা হল এই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সুপারন্যাচারাল মিথগুলো। 

জাপানে অনেকেই বিশ্বাস করে, নোহ আর কাবুকি থিয়েটারে যখন কেউ শিন্টো ধর্মের দেবতা কিংবা অপদেবতার অভিনয় করে, তখন সে আর নিজের মধ্যে থাকে না, সুপ্রিম পাওয়ারের বশবর্তী হয়েই তারা মঞ্চে অভিনয় করে। আমাকে কেউ তুলোধনা না করে, তাই আগেই দু একটা উদাহরণ দিয়ে দিলাম। 

'ফ্যান্টম অফ জিয়ামি' নাটকটা লিখেছিলেন খোদ জিয়ামি মতোকিয়ো। অনেকের বিশ্বাস, এই নাটকটা অভিনীত হলেই তাঁর আত্মা এসে মঞ্চে আসন গ্রহণ করে। নারা আর কিয়োতোয় শো করার সময় শিল্পীরা বলেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই একটা অদৃশ্য শক্তিকে অনুভব করেন, সেই অদৃশ্য এন্টিটি তাঁদের গাইড করে, শাসন করে, মাঝেমধ্যে তাঁদের মুখ দিয়ে যে সংলাপ বেরোয়, সে কথা পরে আর অভিনেতারা মনে করতে পারে না। 'হন্টেড মাস্ক অফ ওকিনা' নাটকে একটা বিশেষ মাস্ক ব্যবহার করা হয়, সেটা নিয়ে আসা হয় কিয়োটোর একটা মন্দির থেকে। এই মাস্কটা যে ভূতুড়ে, সবাই একবাক্যে সে কথা স্বীকার করেছে। মাস্কটা মঞ্চে আনলেই অনেক সময় অদ্ভুত ঘটনা শুরু হয়, মুখোশটা নিজে নিজে হাওয়ায় উঠে যায়, পারফর্ম্যারদের কানে কানে ফিসফিস করে কে কথা বলে! এখানেই শেষ নয়, কাবুকি থিয়েটারে 'য়োতসুয়া কাইদান' নিয়ে তো এমন বদনাম রটেছে যে কেউ ওই নাটকটা করতেই চায় না। একটু এদিক ওদিক হলেই নাকি অভিনেতা আর অন্যান্য শিল্পীদের মাথা ঝিমঝিম করে, শরীর খারাপ হয়ে লোকে মারা গেছে বলেও জানা যায়। অনেকের মতে, ওকুনির প্রেতাত্মা আজও কাবুকির মঞ্চায়নের সময় সাদা কিমোনো পরে ঘুরে বেড়ায়। অনেক দর্শক মঞ্চে সাদা কিমোনো পরা এক মহিলাকে দেখতে পায়, কিন্তু আসলে তার কোনও অস্তিত্ব নেই, টিমের কেউই এরকম কোনও চরিত্রের কথা পরিকল্পনা করেনি। 

এসব গুজব হতে পারে, কিন্তু শিন্টো ডেইটিজের এই প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যায় না। শিন্টোইজম বিশ্বাস করে দুনিয়ার প্রতিটা সজীব বা নির্জীব বস্তুর মধ্যে দিয়েই স্পরিচুয়ালিটিকে হার্নেস আর ম্যানিফেস্ট করা যায়, আর প্রকৃতির মধ্যে যে সমস্ত মেটাফিজিকাল ফর্ম বা আধিভৌতিক বা দৈব এন্টিটি থাকে, তারা মাঝে মাঝে মানুষদের বশীভূত করে তাদের মধ্যে দিয়ে কথা বলে। মঞ্চ, বেশভুষা, আলো, সবকিছুই তখন দৈবের অংশ হয়ে ওঠে। যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আগেই 'কেগারে' মানে অপবিত্র জিনিসকে পিউরিফিকেশন করার জন্য পুজোপাঠ হয়, আর তার সবচেয়ে বেশি আয়োজন হয় নোহ থিয়েটারেই। ফলে, দর্শক আর শিল্পীদের বিশ্বাস, নাটকটা একটা সময়ের পর তারা নিজেরা করে না, করে 'কামি' নামের এই সুপারন্যাচারাল এন্টিটি। তাই নোহ নাটক শুধু বিনোদনের মিডিয়াম নয়, এইগুলোর সঙ্গে জাপানি সমাজের একটা দীর্ঘ ধার্মিক বিশ্বাস জড়িয়ে আছে।

শোগুন যে সময়টার কথা বলছে, সে সময় ব্যাপারটা আরো বেশি প্রবল ছিল, সামুরাইরা মাঝেমধ্যেই যাদুবলে কামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধ বিজয় এর জন্য আশীর্বাদ নেওয়ার চেষ্টা চালাতেন। সে জন্যে অনেক পুরুত ফুরুতও ছিল, আজও আছে। সেই বিলিফ সিস্টেমের লেগাসিও হারিয়ে যায়নি। 

ও, জাপানি উডব্লক প্রিন্টের মাস্টার শিল্পীরা নোহ আর কাবুকি নিয়ে প্রচুর এঁকে গিয়েছেন, সে সব দেখলে তাজ্জব হতে হয়। মাস্টার উতাগাওয়া কুনিয়োশির কিছু ছবি স্যাম্পল হিসেবে সঙ্গে দিলাম।












সোমবার, ৩ জুন, ২০২৪

সিভিল ওয়ার


প্রতিবার পঞ্চায়েত রিলিজ হলেই যখন সবাই সে নিয়ে লাফালাফি শুরু করে, ঠিক সেই সময় আমি একটা অন্য সিনেমা বা সিরিজ রেকামেন্ড করি। নাহ, দুনিয়াটা ফুলেরার মতো অত সহজ নয়!

অ্যালেক্স গারল্যান্ডের এই সিনেমা নিয়ে ট্রেলার আসার পর থেকেই হল্লা চলছে। যারা জিওপলিটিক্স এর বিন্দুমাত্র খবর রাখেন, তাঁরা সিনেমাটা দেখলেই জেনে যাবেন ইউ এস পলিটিক্সের সমসাময়িক ঘটনা কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে? ইচ্ছে করেই খুব শাটল রেখেছে, কোনও পক্ষই নেয়নি, ফলে দুই পক্ষই সিনেমা দেখে নারাজ। ইতিমধ্যে ওটিটি রিলিজের পর হইচই ফের তুঙ্গে, কারণ ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে।

যখন আমাদের দেশে ইলেকশন (ধুর!) নিয়ে মিডিয়া উত্তাল, লোকজন সরব, সেই সময় নীরবে এক একটা ছোট ঘটনা এসে ওয়ার্ল্ড পলিটিক্সকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। যারা জানেন না, ডোনান্ড ট্রাম্পকে হাশ মানি মামলায় অভিযুক্ত করে সাজা দেওয়ার কথা চলছে, কোর্ট রায় দেবে এগারো জুলাই। ইতিমধ্যে ইউ এস ইলেকশন এর তোড়জোড় একেবারে শেষ পর্যায়ে, আর শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আর পলিটিকাল অ্যানালিস্টদের প্রেডিকশনকে লাথি মেরে ট্রাম্প বাবাজি রিপাবলিকান পার্টির সবচেয়ে বড় ক্যান্ডিডেট হয়ে উঠেছেন। সেই একই ভঙ্গিতে, একই স্টুপিডিটির পরিচয় দিয়ে মারকাটারি হেট স্পিচ চালাচ্ছেন আর জনতা হো হো করে উঠছে৷ এরপর তিনি কনভিক্টেড হলে উল্টে সোনায় সোহাগা, মানুষের সিমপ্যাথি উথলে পড়ছে, জেলে গেলে তিনি জেল থেকেও প্রেসিডেন্ট ইলেকশন লড়তে পারেন, আর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও আছে ভালোই। 

এদিকে বিডেনের অবস্থা ক্রমে কোণঠাসা, তিনি ইউক্রেনকে গোপনে রাশিয়ার অন্যান্য শহরে ইউ এস মিসাইল ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন, সেই খবর সম্মুখে আসার পর রাশিয়া 'ঘর মে ঘুসকর ইউরোপ কো মারেঙ্গে' বলে দিয়েছে, চীনও সম্মতি দিয়েছে সেই কথায়। আমেরিকার অবস্থা খুব একটা কাজের নয়, তাই তারা অবশেষে চেষ্টা শুরু করেছে গাজায় যুদ্ধ থামানোর জন্য! কিন্তু ইজরায়েলের গুণ্ডা সরকার কোনও কথাই শুনতে রাজি নয়! এদের মধ্যে এক বিশ্বগুরু দেশও ছিল, যারা আজকাল চোখ রাঙানি ছাড়া কথাই বলে না, ডিপ্লোম্যাসি ভুলেই গেছে (যদিও তাতে ক্ষতিই হয়। কিন্তু হলেও কি! ইলেকশনে জিতলেই হল!) তারা কলার তুলে বাতেলা মারছিল, রাশিয়া তাদের সামনে হুঁ হাঁ করে পাকিস্তানকে একগাদা অস্ত্র দিয়ে দিয়েছে। 

এদিকে আরব দুনিয়ায় অন্য ঝামেলা, ইজরায়েল প্যালেস্তাইন যুদ্ধ (জেনোসাইড বলাই ঠিক) এখন যে জায়গায় আছে, অনেকের মতে যুদ্ধ না থামালে ট্রাম্পই জিতছেন, আর যুদ্ধ থামা বা না থামা, দুই পরিস্থিতিতেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সেই যুদ্ধের চেহারা অবশ্যই ভিন্ন হবে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। আসল রাজনীতি আর নির্বাচনকে অনেক আগেই প্রযুক্তি টেকওভার করে নিয়েছে, আমাদের চোখের সামনে যেটুকু আসে, সেটুকু শুধুই টিপ অফ দ্য আইসবার্গ। এইসবের মধ্যে ট্রাম্প কুটিল বুদ্ধি ব্যবহার করে এই সমস্যাগুলো লঙ্কানুন মাখিয়ে জনতাকে গেলাচ্ছেন, আর একের পর এক উদ্ভট সিভিল ওয়ার টাইপ উপায় বাতলাচ্ছেন। সে সব হলে কী হবে, কী হতে পারে, সিভিল ওয়ার সেই কথাই বলে। কিন্তু আসলে কিছুই বলে না, কারণ সিনেমায় সংলাপ বলতে প্রায় কিছুই নেই। সবটাই দর্শকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আমি সিনেমাটা দেখতে বসেছি একটাই কারণে, পুরো গল্পটাই ওয়ার ফোটোগ্রাফারদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ধরা হয়েছে। অক্টোবার থেকে গাজায় পঞ্চাশজনেরও বেশি ফোটোজার্নালিস্ট মারা গেছে, রিপোর্টাররাও মারা পড়েছেন কম নয়। প্রতি বছর দুনিয়ায় যত জার্নালিস্ট মারা যান, তাদের সিংহভাগই চিত্রসাংবাদিক। অনেক সময় এদের নাম স্ট্যাটেও আসে না, কারণ অনেক ফোটোগ্রাফারই প্রেস কার্ড নিয়ে ঘোরেন না, বরং ছদ্ম পরিচয় ব্যবহার করে ওয়ার জোনে কাজ করে যান।

একটা ওয়ারজোনে গিয়ে রিপোর্টিং করতে গেলে কী হয়, তার এমন বাস্তবযোগ্য বয়ান সাম্প্রতিক কোনও সিনেমায় পাওয়া যায়নি। হয়তো পারফেক্ট সিনেমা নয়, কিন্তু পৌনে দু ঘণ্টা ধরে চোখ সরানো যায় না। এ টোয়েন্টিফোর এই প্রথম বড় বাজেটের সিনেমা করছে, আর প্রথম সিনেমাতেই জানিয়ে দিয়েছে তাদের সিনেমা এত আলাদা হয় কেন? কার্স্টান ডান্সটকে নিয়ে বিশেষ কথা হয় না, এই সিনেমায় তিনি অসামান্য। সংলাপ প্রায় নেই, কিন্তু যুদ্ধ কভার করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ধরা পড়ে এক একটা চাহনিতে, এক একটা সংলাপে। আর হ্যাঁ, মাঝে পাঁচ মিনিটের জন্য জেসি প্লামেন্স একটা সিনে এসে যা করে দিয়ে গেল, তার কোনও তুলনা নেই। 

কেউ আগ্রহী হলে দেখতে পারেন।