বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

শিফটার্স-- The Animal Espionage

Shifters cover

আন্তর্জাতিক গুপ্তচরবৃত্তি আর এসপিওনাজ নিয়ে কিছু সিরিয়াস কাজ করেছি বলেই হয়তো সিক্রেট সার্ভিসের গোপন কাজকর্ম নিয়ে খানিক আগ্রহ রয়ে গিয়েছে এখনও। মাঝেমধ্যেই ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট লিক হয় নানা জায়গা থেকে, সে সবের নোটিফিকেশন সোজা মেলে চলে আসে। অপারেশন ব্ল্যাক অ্যারো লেখার আগে গাঁটের কড়ি খরচ করে বছর পাঁচেকের জন্য মেম্বারশিপ নিয়েছিলাম অনেক জায়গাতেই, সে সদস্যপদ এখনও সক্রিয় আছে। যাই হোক, এই পোস্টটা অবশ্য বইয়ের প্রচার বা স্পাই কাহিনি নিয়ে নয়, বরং একটা বই নিয়ে। বই না বলে ব্যাপারটাকে একটা এপিক লেভেলের জনরা ডিফাইনিং প্রোজেক্ট বললেই হয়তো সঠিক হবে। প্রথম থেকেই বলা যাক।

আচ্ছা, আপনাদের কী মনে হয়, আমাদের সমাজ বা পৃথিবীতে জীবজন্তুদের গুরুত্ব ঠিক কতটা? মানে, বলতে চাইছি, এই গ্রহের ইতিহাস কি শুধু মানব সমাজের জীবনযাত্রার নিরিখেই বিবেচনা করা হবে? হাজার হাজার প্রাণীদের মধ্যে মানুষ একটা প্রজাতি মাত্র, তারা নিজেকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে প্রতিপন্ন করেছে বলেই কি বাদবাদি সবাইকে বাদ দিতে হবে? ভাবনাটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে? আসলে ততটাও অদ্ভুত নয়। ফরাসি ঐতিহাসিক এরিক বারাতে গোটা জীবনই প্রায় এই নিয়ে চর্চা করেছেন, তাঁর মতে মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন জীবজন্তুর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও পৃথিবীর ইতিহাস রচনা ও বিশ্লেষণ করার একটা সম্ভাবনা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু সেটা হবে কী করে? মানুষ সমস্ত জীবকে তার মতোই ভাবে, এই অ্যান্থ্রোপোসেন্ট্রিক মনোভাব বিসর্জন দিয়ে অন্য প্রাণীদের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক তৈরি করার কোনো বৈজ্ঞানিক উপায় এতকালে আবিষ্কার করা যায়নি, পরেও হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সেটা না হলে ব্যাপারটা একপেশে হয়েই থাকে। বিখ্যাত পক্ষীবিদ ও নেচর রাইটার এস্থার উল্ফসন তাঁর বই 'বিটউইন নেচর অ্যান্ড স্টর্ম'-এ বলেছেন, "মানুষ আসলে জীবজন্তুদের মধ্যে নিজেদের প্রতিকৃতিই দেখতে চায়। কথা বলা, পড়াশুনা করা, বিজ্ঞান বোঝা... ইত্যাদি ইত্যাদি।" এই মনোভাব শুধু জীবজগত নিয়ে নয়, আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে মহাকাশ বিজ্ঞান, সব জায়গাতেই মানুষ ভেবে বসেছে, সে যা জেনেছে, সেটাই ঠিক, সেটাই শ্রেষ্ঠ, সেটাই সভ্যতার প্রতীক। মনুষ্য সমাজে এই অহংকার জন্মগত, আর তা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়ও নেই। উল্ফসন বলেছেন, "There should be effort to understand the cognitive abilities of other species with an open mind as this is an unfinished and never-ending quest.”

খুব বেশি কেউই এই ব্যতিক্রমী লেখক বা বৈজ্ঞানিকদের কথা বা কাজ নিয়ে মাথা ঘামাননি, কিন্তু  মার্তা বোগদান্সকা বলে এক শিল্পী ও ফোটোগ্রাফারের কাছে কথাগুলো যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। উল্ফসন বা বারাতে বলেছিলেন, একটা টিয়াপাখি মানুষের ভাষা শিখে গান করতে পারে, একটা হাতি বা বাঘ মানুষের কথা বুঝে সার্কাসে খেলা দেখাতে পারে, ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুকে ট্রেনিং দিলে অনেক রকম কাজ করানো হয়, তাতে প্রমাণিত হয় জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীরা ভিন্ন প্রজাতির এক জীবের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু মানুষ কি হালুম হালুম করে সিংহদের ভাষায় কথা বলতে পারে? ডল্ফিনের গানের মানে বুঝতে পারে? পরিয়ায়ী পাখিদের সমস্ত ব্যবহার বুঝতে পারে, কিছুটা হলেও আয়ত্ত করতে পারে তাদের বিদ্যা? পারে না। কিন্তু আমাদের গুমোর কম নয়। তাই মানুষ স্রেফ বলে দেয়, জীবজন্তুরা ডাকে বটে, কিন্তু ওটা কোনো ভাষা নয়। ওরা অপরিণত মগজ নিয়ে এসেছে, খাওয়া জোগানো মানে সার্ভাইভাল ছাড়া আর কিছুই বোঝে না ব্যাটাচ্ছেলেরা। জীবজগতের কগনিটিভ অ্যাবিলিটি সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ ভাবে অজ্ঞ... আর সে নিয়ে আমাদের গর্বও বড় কম নয়।

যাই হোক, ব্যাপারটা মার্তা বোগদান্সকা ভাবিয়েছিল। তিনি অনুমান করেছিলেন, মানুষ ভিন অন্য প্রাণীদের গ্রাস্পিং পাওয়ার অনেক বেশি। এমন সময় ভারত আর ইজিপ্টের খবরের কাগজে পোষা পায়রা বা উট সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই মাঝেমধ্যে যা হয় আর কি! পায়রাদের দিয়ে চিঠি পাঠানো হত, কুকুর মনিবের প্রাণ বাঁচিয়েছে, ভাল্লুক পা দিয়ে অক্ষত লিখতে পারে... অধিকাংশত এই ধরনের খবরগুলো স্থানীয় খবরের কাগজ বা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তারপর বিবিসি বা এল এ টাইমস সে নিয়ে বেশ চটুল একটা এন্টারটেনমেন্ট পিস বার করে। সেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় না, পুরো ব্যাপারটা হাসিঠাট্টা আর মজার ছলে প্রকাশিত হয়। 

এই নিগেটিভ অ্যাপ্রোচ দিয়ে কাজের কাজ কিছু হয় না, কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে সারা দুনিয়ায় প্রাচীন কাল থেকে জীবজন্তুদের কাজে লাগানো হয়েছে। এখনও হচ্ছে। আধুনিক কালে এ কাজে সবচেয়ে এগিয়ে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স আর সিক্রেট সোসাইটিরা। ইন্টারন্যাশনাল এসপিওনাজের প্রয়োজনে নানাভাবে নানান জন্তুজানোয়ারকে ব্যবহার করা হয়েছে। আর কাজে লাগানো মানে শুধু তাদের মাথায় যন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় তাদের গিনিপিগ করার কথা হচ্ছে না, কথা হচ্ছে জীবজন্তুর কগনিটিভ অ্যাবিলিটিকে কাজে লাগিয়ে কাজ উদ্ধার করা নিয়ে। 

আশ্চর্যভাবে এ সম্পর্কে প্রচুর গল্প আর গুজব থাকলেও এভিডেন্সিয়াল রেকর্ড বা সরকারি তথ্য প্রায় কিছুই নেই। মার্তা ছাড়ার পাত্র নন। তিনি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। রেড ক্রসের কর্তাদের থেকে প্রথম ও বিশ্ব যুদ্ধের মিলিটারি আর্কাইভ, অসংখ্য অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, সিক্রেট এজেন্ট, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, সাংবাদিক ও ফোটোজার্নালিস্টদের সাক্ষাৎকার... কিছুই বাদ রাখেননি। ডেটা সাইন্সের অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে অজস্র আধিকারিক নথিপত্র বের করে এনেছেন, এমনকি ২০১৯ সালে সি আই এ-এর কাছ থেকে লিক হওয়া বিশাল পরিমাণ ক্লাসিফায়েড ইনফরমেশন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্টাডি করেছেন। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মার্তা একটু একটু করে একটা প্যাটার্ন তৈরি করে মডেল তৈরি করেছেন এসপিওনাজ জগতে জীবজন্তুর ভূমিকা নিয়ে। এই প্রজেক্টের নাম দিয়েছেন 'শিফটার্স'। দীর্ঘ এই তদন্তের ফলে যে সব চমকপ্রদ ঘটনার কথা জানা গিয়েছে আর যে সব তথ্য উঠে এসেছে, সেই সবই সম্বলিত হয়েছে এই ফোটো রিপোর্টাজে। বই হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার আগে শিফটার্সের ফোটো এক্সিবিশন হয়েছে সারা দুনিয়ায়, সেখানে মার্তা এই গবেষণা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানিয়েছেন। সে সব থাক আপাতত।

বইয়ে চোদ্দটা চ্যাপ্টার আছে। প্রতিটা চ্যাপ্টার একজন প্রাণীর পার্সপেক্টিভ থেকে লেখা। তার এক একটা ঘটনা পড়লে মাথা ঘুরে যায়। এছাড়াও অসংখ্য ফোটোগ্রাফ তো আছেই। ইজরায়েলের মোসাদ কবে ডলফিনকে দিয়ে শত্রুকে খুন করিয়েছিল, পাকিস্তানের পায়রারা কীভাবে শত্রুপক্ষের খবর এনে দিত, সি আই এ মাছ ও ডলফিনদের আন্ডারওয়াটার মাইনিংয়ে ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছিল...কী নেই? পোল্যান্ডের সেনাবাহিনী একসময় ওয়োজটেক বলে এক বিশাল ভাল্লুককে সৈনিকদের ইউনিফর্ম দিয়ে ভর্তি করিয়েছিল। ভারী ওয়পেনারি সাপ্লাই করা এই পাঁচশো পাউন্ড ওজনের ভাল্লুকের কাছে ছেলেখেলা ছিল প্রায়। ওয়োজটেক সেনাবাহিনীর তাঁবুতে বসে অন্যদের সঙ্গে বিয়ার আর সিগারেট খেত, কমব্যাট মিশনে যেতে হত বলে তার মিলিটারি র‍্যাংকও ছিল। রিটায়ার করার পর এডিনব্রা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে, অনেকেই তখন তার সঙ্গে ছবি তুলিয়েছে। 

সন্দেহ নেই এই কাজে ব্যবহার করা জীবজন্তুরা খুব আরামের জীবন পায়নি। তাদের যে সমস্ত কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, তা করা মানুষের অসাধ্য ছিল। তাদের জেদ, সহ্যশক্তি, কমান্ড বোঝা ও ইমপ্লিমেন্ট করার অসামান্য স্কিল ছাড়া এ সব সম্ভব হত কি? না। সবাই ভালো করেই জানত, এই জীবগুলোর তুখোড় মানসিক ক্ষমতা না থাকলে অনেক মিশন ফেল করত। অথচ পরবর্তী কালে সে নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি, পুরো ব্যাপারটা 'ভালো ট্রেনিংয়ের আউটপুট' বলে একটু পিঠ চাপড়ে দেওয়া হয়েছে ঘোড়া, কুকুর বা অন্যান্য নিয়োগ করা প্রাণীদের।

বইয়ের শেষ চ্যাপ্টারের নাম 'ডেডবডিজ'। গুপ্তচরবৃত্তি, পুলিশ আর ডিফেন্স সার্ভিসে নিয়োগ জন্তু জানোয়ারের অনেকেই যে এই কাজ করতে গিয়ে মারা পড়েছে, তারই মর্মস্পর্শী আখ্যান এই চ্যাপ্টারটি। সন্দেহ নেই, ট্রেনিং চলাকালীন তাদের বেশ যত্নেই রাখা হত, কিন্তু প্রয়োজনে মানুষের জীবনের তুলনায় একটা চারপেয়ের জীবনের গুরুত্ব কোনটুকু, সে নিয়ে মানুষদের মনে কোনোকালেই কোনো দ্বিধাভাব ছিল না। হলফ করে বলতে পারি, জন্তুজানোয়ারদের ভালোবাসলে পড়তে পড়তে চোখে জল চলে আসবে। আসতে বাধ্য। যাই হোক, এই এপিক লেভেল কাজের জন্য মার্তা বোগদান্সকাকে কুর্নিশ করলাম। কোনো প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ট নয়। আশা করি, বইটা সম্পর্কে তাঁর বলা এই কথাগুলো মানুষকে ভাবাবে।

"I felt that the book would give me this very material way of showing the weight of this issue. I wanted to show how, in this really small amount of time, we have already gathered so much material and so many examples of animals being used, working for us, suffering, all these emotions that they felt. I wanted to make it somehow visible and tangible.”

শিফটার্স এখনও সব জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নিজেও একটা প্রাইভেট লিংকের মাধ্যমেই পেয়েছি। তবে শীঘ্রই পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। যারা জন্তুজানোয়ার সম্পর্কে ফোটো রিপোর্টাজ পড়তে আগ্রহী, বইটা মিস করবেন না। কয়েকটা ছবি দিলাম আপাতত।











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন