সাগরের জল আর আমাদের জিন্দেগী একই সুতোয় বাঁধা। কোন ঢেউ তাদের কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানে না! আসমানী রঙের মেঘেরা যখন হাতছানি দেয়, তখন আয়নার অপর প্রান্তে হয়ত অতীতের হাসিভরা মুখটা ভেসে ওঠে। কাঁটাতারের ওপর যখন ভোরের শিশির ঝিলমিলিয়ে ওঠে তখন বর্তমান যেন হারিয়ে যায়, আসন্ন মৃত্যুর জমাট অন্ধকারে ঠেস দিয়ে বসে বসন্তের স্বপ্ন দেখে শুকনো চোখগুলি। মনের গহীন কোন থেকে উঠে আসা আনন্দের স্মৃতিগুলো জাপটে ধরে আতঙ্কে থমকে থাকা আজকের দিনটাকে।
দু' হাত দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে জেনাব। প্রাণভরে ঘ্রাণ নেয় ভেজা মাটির, হয়ত অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে কোবানি শহর, ইউফ্রাতেস নদীর ভেজা হাওয়ার গন্ধ নাকে লাগে। দু' চোখ ভোরে ঘুমন্ত দুটো শিশুর দিকে তাকে জেনাব। একজন নয়, অন্যজন পাঁচ। দেশের মাটি আর কাব্রিস্তান তাদের জন্যে এক। বহতা নদীতে ভেসে যাওয়া ছেলেবেলা আর আম্মির ছিন্নভিন্ন শরীর ছাড়া কিছুই মনে থাকবে না তোদের, বদকিস্মতির দাস্তান! তোদের দেশ তোদের পনাহ দিতে পারল না! তোদের শোনাতে পারলো না কুর্দিশ গান...
“নাইসিকেনে দানেরি টোপি জেমেন”...
লোকটার নাম জেনাব আব্বাস। যখন সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে ঝাঁঝরা শরীরগুলো মাটিতে মিশে যায়, বোমার ঘায়ে বাড়িঘর বেজান খাণ্ডাহার হয়ে যায় কোবানি শহরে, তখন সে চুপকে সে উঠিয়ে আনে বেওয়ারিশ বাচ্চাদের, তাদের চড়িয়ে দেয় তুর্কিগামী বোটগুলোয়। কয়েকজন পৌঁছে যায় বোদ্রাম বন্দরে, কয়েকজন তলিয়ে যায় ভূমধ্য সাগরের অতল জলে। কিন্তু জেনাব তাতে কিছু মনে করে না। এই মুল্কে সব ইনসান জিন্দা লাশ, কেউ আগে মরে কেউ পরে... কাউকে কাউকে দফন অব্দি করা যায় না। বোমায় ছিন্নভিন্ন শরীরগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায় রাস্তায়। হাজার হাজার বাচ্চা ইয়াতীম হচ্ছে রোজ, না মা আছে না বাপ...শুধু আছে ব্যাকুল চোখের চাহনি আর বাঁচার আকুল চাহিদা।
ইয়াসিন উঠে বসলো চোখ কচলাতে কচলাতে। জড়ানো গলায় বললো, “ওপারে কী আছে জেনাব?”
জেনাব হেসে জবাব দিলো, “জন্নত আছে ওপারে। এই যে সমন্দর আছে মেরি জান, এটা হচ্ছে খোয়াবো কা সমন্দর। ওইদিকে যেতে পারলেই জন্নত।”
ইয়াসিনের বয়স কম, সে জন্নত বোঝে না। ধরা গলায় বললো, “জন্নতে কী থাকে জানাব?”
জেনাব আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “আল্লাহ জানে! তবে শুনেছি জন্নতে সব রকম রুটি আর মিঠাই পাওয়া যায়। আর ওখানে একটা বিশাল ঝর্ণা আছে যার পানি মিঠা থাকে সারা বছর, কখনও শুকোয় না। সেই পানি একবার খেলে ইনসান অমর হয়ে যায়।”
ইয়াসীন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। একমাস আগেই আম্মি, আব্বাজান, খালাকে হারিয়েছে সে, কিন্তু তাদের কথা আর মনে পড়ে না। এই একমাস ধরে যেটা তার সবচেয়ে বেশি মানে পরে সেটা হচ্ছে আম্মিজানের হাতের রুটি আর সেওবাই।
স্বপ্ন দেখলেও সেই রুটি গোল চাঁদের মত হাত নাড়ে তার দিকে। জেনাবের কথা শুনে আবার তার চোখের সামনে চলে এলো একটা গোল সাদা ফোলা ফোলা নরম রুটি। কবে সে জন্নতে যাবে? এরকম অনেক রুটি পাবে সেখানে গেলে! জেনাব তার মাথায় হাত বুলোতে লাগলো।
অনেক দূর থেকে কানে আসে বন্দুকের গুলির শব্দ। আকাশের কালো রঙ ঘোলা হয়ে থাকে আগুনের আঁচে। আগুন জ্বলছে সারা দেশে। দোকানপাট লুট হচ্ছে কোবানিতে। আজকে এই দুজন পৌঁছে গেলে সে অন্য শহরে চলে যাবে। এখানে আর কিছু বাকি নেই। সব জিন্দা মানুষ হয় তুরস্কে পালিয়ে গেছে হয় অন্য শহরে পাড়ি দিয়েছে। যারা আছে তারা তৈরি হয়ে আছে নিজেদের মৃত্যুর জন্যে। কিন্তু অত সহজে মানুষে মুক্তিও পায় না, থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার জিনিস নেই, বাচ্চারা মা-বাবার চোখের সামনে অনাহারে ধুঁকতে থাকে, বোবা চোখের ভাষা নিয়ে ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। এ জীবন জাহান্নাম এর সমান, এখানে রোজ মৃত্যু তিল-তিল করে গিলে নেয় জিন্দা ইনসানকে।
লাটাকিয়া পোর্টের সীমান্তে কড়া নজর, তাই মূল পোর্টের থেকে বেশ কিছুদূরে এসে দাঁড়ায় তুরস্কগামী বোটগুলো। এক একটা জায়গার জন্যে সওদা চলে ঘন্টার পর ঘন্টা। মাথাপিছু পাঁচ হাজার ডলার দিয়ে ইয়াসিন আর আয়েশার জায়গা পেয়েছে জেনাব। তার মৃত স্ত্রীর শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে যা পেয়েছিলো সব শেষ হয়ে গেছে এ কয়েকদিনে। থাকলেও কী করত জেনাব? ফিরিয়ে আনতে পারতো কাউকে?
জেবান চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস নেয় বুকে। বোট তৈরি। আয়েশা আর ইয়াসিনকে বুকে টেনে জেনাব বলে, “আমি তোদের সঙ্গেই আছি। ভয় পাস না। ইনশাআল্লাহ!”
আয়েশা নিচু স্বরে তার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি আসবে না। আমি জানি। আম্মি চলে গেছে, আব্বা চলে গেছে, সবাই চলে যায়। তুমিও চলে যাবে।”
জেনাব হাঁটু গেড়ে বসে আয়েশা আর ইয়াসিনের সামনে। গাঢ় স্বরে বলে, “ঠিক বলেছিস বেটি। কেউ সঙ্গে থাকে না। সবাই চলে যায়। কিন্তু একজন ছাড়া। জানিস কে?”
আয়েশা চুপ করে থাকে। ইয়াসিন আস্তে আস্তে আঙ্গুল ওপর দিকে প্রসারিত করে বলে, “আল্লাহ!”’
জেনাব বিষণ্ণ হাসে। ইয়াসিনকে কাছে টেনে বলে, “ঠিক বলেছিস ইয়াসিন। আল্লাহ। কিন্তু আল্লাহ ওখানে থাকে না।”
ইয়াসিনের আকাশের দিকে প্রসারিত আঙ্গুলটাকে তার বুকে ঠকিয়ে বলে, “আল্লাহ থাকে এখানে। হামেশা। আর কোথাও না। কোনও মসজিদে না, মন্দিরে না, আমাদের বুকের ভিতর। কাভি মত ভুলনা।”
দুজনকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খায় জেনাব।
বোটের চালক ডাকছে সকলকে। ইয়াসিন আর আয়েশাকে বোটে তুলে দেয় জেনাব। ঘন অন্ধকার ভেদ করে বোট সমুদ্রে হারিয়ে যায় আস্তে আস্তে।
কেউ আলভিদা জানায় না। জেনাব হাটু গেড়ে বসে তারায় গুঞ্জরিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ গর্জে ওঠে বন্দুক। চিৎকার করতে করতে ছুতে আসছে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। কোনো বোট যেন না যেতে পারে এখান থেকে। জেবানকে দেখতে পেয়ে উদ্ধত বন্দুকের নল থেকে শিষে উগরে দেয় সামনের কিশোর ছেলেটা। তার রক্তাক্ত দেহের ওপর বুট চাপিয়ে গর্জন করে ওঠে, “নাইসিকেনে দানেরি টোপি জেমেন। কুর্দিশদের কোন অস্ত্র দিয়ে হারানো যায় না...”
অন্ধকারে সিতারাদের দিকে তাকিয়ে জন্নত দেখতে পায় জেবান। বিশাল একটা ঝর্ণা যার পানি মিঠা।
শান্তিতে শেষ নিশ্বাস নিতে নিতে জেবানও আওড়ায়, “নাইসিকেনে দানেরি টোপি জেমেন...কুর্দিশদের কোন অস্ত্র দিয়ে হারানো যায় না..”
২
ভেজা বালির ওপর পড়ে আছে বছর তিনেকের ছোট্ট ছেলেটার দেহ। নিষ্প্রাণ, স্থির। ছোট ছোট হাতগুলো বালির ওপর মুঠো হয়ে আছে, লাল টিশার্ট পড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আয়লান। বোদ্রাম শহরের সমুদ্রসৈকতে উপচে পড়েছে বহু মানুষ, তুরস্কের পুলিশ তাদের ঠেকাতে পারছে না। চোখের জল সামলাতে সামলাতে ছবি তুলে চলেছে নিলুফের। সিরিয়া যুদ্ধ আর শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে লেখালেখি শুরু করার পর থেকে শত শত মৃত্যু দেখেছে নিলুফের, প্রথমদিকে বিচলিত হলেও একসময় সয়ে গেছে সবই। যুদ্ধ হলে আর কী আশা করা যেতে পারে? কিন্তু আজকের এই মর্মভেদী দৃশ্য সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। বুকের ভিতরটা যেন ফেটে যাচ্ছে কষ্টে! চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি।
সিরিয়া থেকে পালিয়ে একের পর এক পরিবার আসার চেষ্টা করছে তুরস্কে। বেশিরভাগই এখানে পৌঁছতে পারে না, মারা পড়ে তার আগেই। যারা কোনক্রমে চলেও আসে, তাদেরও যাওয়ার কোন জায়গা নেই। রিফিউজি ক্যাম্প ভর্তি, রেড ক্রসের খাদ্য আর ওষুধ কম পড়ছে! অর্থ সম্বল থাকলে অনেকে ইউরোপে চলে যেতে চাইছে, কিন্তু সে সুযোগও দ্রুত কমে আসছে। আয়লান কুর্দির বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি পরিবার সহ আটকে গিয়েছিলেন এই শহরে, কোবানি থেকে পালিয়ে এলেও কিছুতেই তারা ইউরোপে যাওয়ার অনুমতি জোগাড় করতে পারেননি। অবশেষে বেআইনি ভাবে একটা নৌকোয় উঠে কাল রাতে গ্রিসের কোস দ্বীপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। বলা বাহুল্য, মুনাফার তাগিদে দেশের সীমানা পার করানো বোটে নিরাপত্তার ব্যবস্থা কিছুই ছিল না। বোদ্রাম ছেড়ে কিছুদূর যেতেই নৌকাডুবি হয়, আরো অনেকের সঙ্গে তিন বছরের শিশু আয়লান ডুবে যায় ভূমধ্য সাগরের কালো জলে।
একরকম জোর করেই আয়লানের সামনে থেকে সরে গেল নিলুফের। আবদুল্লাহ বুকফাটা আর্তনাদ করছেন সন্তানের মৃত্যুতে, সেই শব্দ সহ্য করা যায় না। পুলিশ আর সামরিক বাহিনীর পাশে মিডিয়ার লোকজন জড় হয়েছে প্রতিদিনের মতোই। রোজই একাধিক নৌকা ডুবে যায়, সিরিয়া থেকে তুরস্কের উদ্দেশ্যে আসা নৌকাগুলো ও অবশ্য বেশি। সমুদ্র সৈকতের কালো বালিতে মৃতদেহের সারি পড়ে থাকে, দুপুরের পর সব তুলে নিয়ে যায় সরকারি কর্মচারীরা। এই মৃত্যু লীলা মানুষের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, মৃত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে সামরিক বাহিনীর লোকজনের কোন অস্বস্তি হয় না।
দু একজন যারা নিরাপদে বোদ্রামে পৌঁছে যায়, তাদেরও অদৃষ্ট নিশ্চিত থাকে না। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্যে আন্তর্জাতিক সীমানা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে কথা চলছে, এদের অনেকেই হয়ত পরবর্তী দশ কুড়ি বছর রিফিউজি ক্যাম্পে কাটিয়ে দেবে জীবন। শিশুরা যুবক হয়ে উঠবে অবহেলায়, যুবকরা হবে বৃদ্ধ। বৃদ্ধদের অবশ্য এই নরক যন্ত্রণা বেশিদিন সইতে হবে না। ছিন্নমূল জীবনের বেদনার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।
হাঁটতে হাঁটতে রেজিস্ট্রেশন অফিসের দিকে চলে এল নিলুফের। দুটো অল্প বয়সি ছেলেমেয়ে ভয়ার্ত চোখে একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে লাইনে, তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নিলুফের। ছেলেটা একেবারেই ছোট, তার সরল মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
বুকটা আবার মূচড়ে উঠল নিলুফেরের। এই দুটো কচি প্রাণকে সে অদৃষ্টের ওপর ভরসা করে ছেড়ে দিতে পারবে না, অন্তত আজকে নয়। আরো একটা আয়লান কুর্দি হতে দিতে পারবে না সে। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে। সাংবাদিকদের খানিকটা প্রভাব এখনও আছে মাইগ্রেশন কাউন্সিলের দপ্তরে।
বিকেলে যখন আয়েশা আর ইয়াসিনকে এক পরিচিতের বাড়িতে পৌঁছে দিল, দুজনের ওপর মায়া পড়ে গেছে নিলুফেরের। দুজনেই খুব মিষ্টি করে কথা বলে, বিশেষ করে ইয়াসিনের মায়া জড়ানো মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরানো যায় না। ইয়ানিনা কে খুব ভাল করে চেনে নিলুফের, অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত তাদের নিজের সন্তানের মতোই আগলে রাখবে সে। ইয়ানিনা স্বেচ্ছায় অনাথ শরণার্থী বাচ্চাদের দেখাশুনা করে, নিলুফেরের সঙ্গে তার চেনা আছে প্রথম থেকেই। এরকম কয়েকজন মানুষ এখনও রয়ে গেছে বলেই বেঁচে থাকতে সাধ হয়, আশান্বিত থাকা যায় ভবিষ্যতের জন্যে।
সবুজ রঙের আসন পেতে তাদের খাবার পরিবেশন করা হল। কতদিন পর! এক একটা করে ফুলকো রুটি আসছে, সঙ্গে মাংসের স্টু। হাসিমুখে খাবার নিয়ে লাজুক বাচ্চা দুটোকে সাধাসাধি করছে নিলুফের ও ইয়ানিনা।
“কী হল ইয়াসিন? খাচ্ছ না কেন?” জিজ্ঞেস করল নিলুফের।
ইয়াসিন বড় বড় চোখ করে গোল রুটিটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর দু হাতে রুটিটা তুলে নিয়ে গন্ধ শুঁকল সে। একটা মিষ্টি হাসি খেলে গেল তার মুখে। বোনের দিকে আরচোখে তাকিয়ে সে বলল, “জন্নত! আল্লাহ আমাদের জন্নতে পাঠিয়ে দিয়েছে!”
আয়েশা হাসে। ইয়াসিন হাসে। নিলুফেরের চোখ আবার ভিজে ওঠে। সে চোখের জল মুছে নিয়ে হাসে।
(পঞ্চালিকা ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশিত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন