সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দ্য ট্রেজার্স অফ তোলেদো - দ্বিতীয় পর্ব


Toledo Old Town Street

২) সূর্য পশ্চিমদিগন্তে মিলিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অন্ধকারে তোলেদোর আলোগুলো দেওয়ালির প্রদীপের মতন লাগছে। তাগুস নদী, তোলেদো শহর ও স্নিগ্ধ আকাশের সন্ধিক্ষণে আবিষ্ট হয়ে বসেছিলাম। একসময় খেয়াল হতে ফেরার পথ ধরলাম। বেশ রাত হয়েছে। প্লাজা জোকোডোভার এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। হাঁটতে শুরু করলাম। ভাগ্য সহায় ছিল, খানিকটা হাঁটতেই শহরগামী বাস পিছন থেকে আমাদের সামনে এসে ব্রেক কসলো। আরোহী মাত্র চারজন, বাস চালাচ্ছেন শেষ বিকেলের সেই একই মহিলা। আমাদের দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। হাতের ইশারায় উঠতে বলে বাস এগিয়ে চলল শহরের দিকে।   

প্লাজা জোকোডোভারে যখন পৌঁছলাম, ঐতিহাসিক শহরে গ্রীষ্মের উত্সব শুরু হয়ে গেছে। প্লাজার কাছেই প্রচুর আলোকিত ক্যাফে রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে ফুটবল খেলা দেখার সঙ্গে পানাহার চলছে। কয়েকদল নাচের মহড়া দিচ্ছে প্লাজার মাঝখানে, কয়েকজন আবার ‘নাইট ওয়াক’এ বেড়িয়েছেন। মনে মনে এখানকার বিখ্যাত খাবার 'পের্দিজ এস্তফাদা' খাওয়ার শখ হয়েছিল বটে কিন্তু দুপুরে ভেন্টা দে আইরেস রেস্তোঁরায় দাম দেখে সেই লোভ জীবনের মত বিসর্জন দিয়েছি। এক সময় বিশ্ববিখ্যাত সুরিয়েলিস্ট সালভাদোর গালি আর লুই বুনুয়েল এসে অর্ডার অফ তোলেদোর পত্তন করেছিলেন এই শহরে, তখন মাংসের এই সুস্বাদু ব্যঞ্জনটি প্রতিদিনই উদরাস্ত করতেন তারা। আমাদের পকেট আগেই বিপদগ্রস্ত,  চুপচাপ ম্যাকডোনাল্ড-এ গিয়ে স্যালাড আর বার্গার খেয়ে নিলাম।  

হস্টেলে এসে অ্যালেনের সাথে দেখা হলো। ফ্লোরিডার ছেলে হলেও অ্যালেন  জার্মানিতে থাকে কাজের সূত্রে, ছুটিতে স্পেনে ঘুরতে এসেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যে কোন দেশের লোক পরিচয় পত্র নিয়েই যে কোন দেশে চলে যেতে পারে, আমাদের ভিসা নেওয়ার নাকানিচোবানির অভিজ্ঞতা শুনে বেচারা আন্তরিক ভাবে আমাদের সমবেদনা জানালো। টুকটাক গল্প চলছে। তোলেদো দেখে অ্যালেনের অবস্থাও আমাদের মতন শোচনীয়।

কথায় কথায় অ্যালেন বলল, “আমি এই মহাদেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছি। বেশিরভাগ পশ্চিম ইউরোপের দেশে ঐতিহাসিক স্থাপত্য থেকে অন্য ধর্মের ছাপ সযত্নে মুছে ফেলা হয়েছে, সেই দিক থেকে তোলেদো অবশ্যই ব্যতিক্রম। প্রাচীন কাল থেকেই 'হোলি তোলেদো' ধর্ম কে আঁকড়ে ধরে আছে, কিন্তু অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভিন্নধর্মী মানুষদের এখানে খানিক বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। হাজার বছর আগে মুর আর ভিসিগথদের তাড়িয়ে সম্রাট আলফনসো যখন সিংহাসন দখল করেন, অন্য ধর্মের বিশ্বাসীদের জন্যে তিনি খুব একটা কঠোর পন্থা অবলম্বন করেননি।”

গল্প করতে করতে রাত একটা বেজে গেল। পরের দিন গির্জা এবং বাকি শহরটা ঘুরে দেখার কথা। বিছানায় পড়তেই নিদ্রাদেবী চোখে উপবিষ্ট হলেন। 

 

৩) 'যীশুর মসজিদ' বলে কোন নির্দেশন এর কথা যদি কেউ শোনে তাহলে মাথা খারাপ হওয়া অবাক কিছু নয়। ঘাবড়াবেন না, এরকম উদ্ভট নাম ইউরোপের নানান ঐতিহাসিক শহরে পাবেন। 'মস্ক অফ ক্রাইস্ট অফ লাইট' একাধারে মসজিদ, সিনাগগ এবং গির্জা। 


TOLEDO
Mosque of Christ of Light

এককালে মুররা এসে এইখানে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু ক্রিশ্চানরা তোলেদো দখল করার পর এইখানে গির্জা তৈরী করা হয়। প্রায় প্রতিটা এরকম স্থাপত্যের সঙ্গেই একটা করে কাল্পনিক কিংবদন্তি জুড়ে দেওয়া হয়, এই জায়গাটাও তার ব্যতিক্রম নয়। একবার রাজা এবং গির্জার আর্চবিশপদের শোভাযাত্রার সময় ঘোড়া নাকি এখানে পা মুড়ে বসে পড়েছিল, কিছুতেই এগোতে পারেনি। জায়গাটা খুঁড়ে সেখান থেকে যীশুর ক্রস বেরোয় এবং তারপর মসজিদটি গির্জাতে রূপান্তরিত করা হয়। স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের যুগ তখনও শুরু হয়নি,  বিত্তবান ইহুদিদের খুশি রাখতে গির্জাটি তৈরী হয় অনেকটাই সিনাগগের মতন করে। হরেক রকম ক্রস দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় এই গির্জা। 


এমন একের পর এক চিত্তাকর্ষক গল্প শুনতে শুনতে ওয়াকিং ট্যুরে হেঁটে চলেছি। তোলেদো শহরটা ছোট হলে কি হবে,  উঁচু নীচু ছোট ছোট পাথুরে রাস্তা শহরটিকে কয়েক স্তরে বিভক্ত করেছে। দু চার দিনে পুরোটা হেঁটে হেঁটে দেখে ফেলা অসম্ভব। এই গলিগুলোতে বাস চলে না, অতএব পায়ের ওপর ভরসা করেই এগোতে হবে। 


স্যামুয়েল আমাদের গাইড আজ। ভদ্রলোক পেশায় ‘আর্কিটেক্ট’, কথাবার্তাতেও সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। কি সহজেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন নির্মাণকলার খুঁটিনাটি! এক এক যুগের নির্মাণের ওপরে পরবর্তী যুগের নির্মাণ হয়েছে এই পার্বত্য শহরে, তাই পুরাতত্ববিদরা আজও অনেক অজানা ইতিহাস খুঁজে পাচ্ছেন খোঁড়াখুঁড়ি করে। অনেক বাড়ির দেওয়ালেই হিব্রূতে লেখা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়।


Old City

এদিকে আমার মাথায় কালকের ভুতের আলোচনা ঘুরছে। হাঁটতে হাঁটতে একসময়ে স্যামুয়েলকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “আচ্ছা, এত পুরোনো শহর? গুপ্তধন অথবা ভূতপ্রেত নিয়ে গল্প নেই?"


স্যামুয়েল হেসে বলল, “ওইসবের কি অভাব আছে নাকি? ইউরোপের লোকেরা সেকালে প্রচন্ড অন্ধবিশ্বাসী ছিল। তোলেদো শহরটা তো পুরোনো ভগ্নাবশেষ-এর ওপরেই তৈরী। রোমানদের শহর ভেঙে তার ওপর ভিসিগথরা বাড়িঘর বানিয়েছে। ভিসিগথএর শহরের ওপরে তৈরী হয়েছে মুরদের রাজ্য। মুরদের রাজ্যের ভাঙাচোরা ধ্বংসের ওপর আলফোন্সো সাম্রাজ্যের ভিত পড়েছে। সেই চলছে এখনো। কত কিছুই যে মাটির তলায় চাপা রয়ে গেছে সেগুলোর সন্ধান পাওয়াও যায়নি। কয়েক শতাব্দী আগে এই নানা দেশ থেকে লোকজন এসে সুড়ঙ্গ তৈরী করে করে গুপ্তধনের সন্ধান করে গেছে।” 


-"তেমন মূল্যবান কিছু কি পাওয়া গেছে সন্ধান করে?" আমি বেশ উত্সাহ পেয়ে জিগ্গেস করলাম।


-"সেটা কি আর কেউ জানতে পারে। তবে রহস্যের কোন শেষ নেই। কিংবদন্তি আছে কিং সলোমনের হারিয়ে যাওয়া সোনার টেবিল আর চাবি লুকিয়ে রাখা ছিল তোলেদোতে। সেইসব খুঁজতে কম লোকে হানা দেয়নি। পুরাতত্ববিদরাও বহু ঘাম ঝরিয়েছেন।” 


শুনে বেশ রোমাঞ্চিত বোধ করলাম। কিং সলোমনের জাদু টেবিল আর চাবির কথা কোনও গল্পে পড়েছিলাম। আরব পুঁথিতে লেখা জিনদের গল্পগাথায় আছে যে সলোমন বাহাত্তরটি প্রেতাত্মাকে বন্দি করে তার কোষাগার পাহারা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। স্যামুয়েলকে জিজ্ঞেস করলাম, “সলোমনের গুপ্তধন নিয়ে তো শুনেছি নানা ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার আছে। সেই জিনিসগুলো গেল কোথায় ?"


স্যামুয়েল বলল, “ইতিহাস মতে তো উমায়্যাদ রাজ্যের আক্রমণের সময় তারেক ইব্ন জিয়াদ ঐসব টেবিল চেয়ার ধন দৌলত সব লুট করে নিয়ে পালায়। তখন ভিসিগথদের রাজত্ব চলছিল। আগে তো স্পেনে একটা রাজা ছিল না, ছোট ছোট নানান রাজ্য। একে অপরের ওপর যখন তখন আক্রমণ করতো। কিন্তু ইতিহাসকারদের তোয়াক্কা কে করছে? আগের শতাব্দীতে চারিদিকে সোনা, রুপোর খনি আবিষ্কৃত হচ্ছে। কয়েজন অভিযাত্রী আর ট্রেজার হান্টার মিশর, পেরু,  আমেরিকাতে গুপ্তধন পেয়ে বড়লোক হয়ে গেছে কয়েকদিনের মধ্যে। সেই সময় গুপ্তধন খোঁজার হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো। দুঃসাহসী ইতিহাসবিদ, ব্যবসায়ী, নাবিক সকলে হন্য হয়ে গুপ্তধনের খোঁজে পাড়ি জমাতে লাগলো তোলেদোতে। সলোমনের গুপ্তধন ছাড়াও একটা গুজব ছিল গির্জা তৈরী করার সময় কয়েকশ টন সোনা নাকি আর্চবিশপরা লুকিয়ে রেখেছে কোন গুপ্তস্থানে। সেইসব খুঁজতে দলে দলে লোক এসে জড় হল এখানে।” 


-"তারপর?" এতক্ষণে আমার সঙ্গিনী স্প্যানিশ দিদিমনিরও আগ্রহ বেড়েছে দেখছি।


-"তারপর আর কি? গরুখোঁজা করেও কিছুই মেলেনি। অনেকে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে মরেছে, অনেকে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। গুজবে কান দিলে শুনবে গুপ্তধনের অভিশাপে আর ভূত প্রেতের খপ্পরেও অনেকে প্রাণ দিয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি শেষ পর্যন্ত।” 


সত্যি হোক অথবা গুজবই হোক, ব্যাপারটা জেনে বেশ ভালোই লাগলো। কয়েকটা অজানা রহস্য এখনো রয়ে গেছে পৃথিবীতে, সেটা বেশ আশার কথা। হয়ত সত্যি কোন গুপ্তধন লুকিয়ে আছে তোলেদোর মাটির তলায়! কেল্লার দেওয়াল দেখে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ততক্ষণে পৌঁছে গেছি তোলেদো গির্জার সামনে। 


Cathedral of El Toledo

Cathedral closeup


স্পেনের সবচেয়ে বিশাল এবং নামকরা গির্জার মধ্যে একটা। ‘কয়ের রুম’ থেকে টাওয়ার অব্দি প্রতিটা ঘরেই সোনার বাসনকোসন, সোনার জল করা গ্রেকো আর অন্যান্য শিল্পীদের চিত্রকলা আছে। অষ্টভুজাকার গম্বুজটা বিশেষ ভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। কারুকার্য করা উঁচু গির্জাটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে সন্দেহ হল যে আর্চবিশপদের সোনা লুকিয়ে রাখার কথাটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এককালে রোমান ক্যাথলিকরা সারা দুনিয়া থেকে জিনিসপত্র লুট করে এনে নিজেদের গির্জা, রাজপ্রাসাদ, জাদুঘর সাজিয়েছে। কয়েকশো টন সোনা আর এমন কি?


গির্জা দেখে আমরা ‘জিউস কোয়ার্টার’ অর্থাৎ ইহুদি পাড়া দিয়ে এল গ্রেকো মিউজিয়ামের দিকে এগোতে শুরু করলাম। সেন্ট তোমে গির্জার দিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যায় যে চোদ্দ আনা নির্মাণ মুরদের করা। শুধু স্থাপত্যই নয়, আরবদের সাহিত্য আর সংস্কৃতির অনেক নির্দেশনও রয়ে গেছে তোলেদোতে। বিশেষ করে আরব কবি য়েহুদা হেলাভির লেখালিখি নিয়ে তো অনেকেই গবেষণা করছে। অনেকে গির্জার প্রধান অংশটিকে মুদেহার টাওয়ার বলে থাকে। মুররা ইঁট দিয়ে বাড়ি ঘর তৈরী করতো,  সেই ইঁট গেঁথে উঁচু টাওয়ারটি তৈরি। মার্বেলের ছোট্ট একটি গোষ্ঠী মধ্যভাগে অবস্থিত।


Plaza Zocodover

Cathedral

স্যামুয়েল একের পর এক নির্দেশন দেখিয়ে চলেছে, সঙ্গে হালকা ইতিহাসের গল্প এবং হাসিঠাট্টাও চলছে। কাঠের ফ্রেম করা কয়েক শতাব্দী পুরোনো মাঞ্চেগান বাড়িঘরে আজও তখনকার লোকজনের উত্তরপুরুষরা থাকে শুনে বেশ অবাকই হলাম। প্লাজাতে ইতিমধ্যে এক দক্ষিণ ভারতীয় লোকের সাথে আলাপ, ভদ্রলোক নিজেই এসে কথা বললেন। এরকম ছোট্ট একটা জায়গায় প্রবাসী ভারতীয় দেখে আমরাও অবাক। জিগ্গেস করলাম, “আপনি একাই বুঝি?” ভদ্রলোক ছেলেকে নিয়ে আইসক্রিম কিনছিলেন। হেসে বললেন, “না। আরো চল্লিশ পঞ্চাশটা ভারতীয় পরিবার নিয়ে আছেন এই ছোট্ট শহরে। ছোট বড় সব শহরেই কাজ পাওয়ার সুযোগ আছে এখানে, অনেকে অবশ্য চাকরি করতে মাদ্রিদেও যায়। আমিও প্রায় কুড়ি বছর ধরে এখানে আছি, কাজকর্ম চলে যাচ্ছে।” পৃথিবীটা যে সত্যিই ছোট হয়ে আসছে, তারই আরেক প্রমাণ পেলাম। কিছুক্ষণ ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করে আমরা আবার এগিয়ে চললাম। 


সান্টিয়াগো দেল আরাবেল গির্জা আর এল গ্রেকোর পুরোনো বাড়ি দেখার পর স্যামুয়েলের কাছ থেকেও বিদায় নিলাম। পেটে ইঁদুর কামড়াচ্ছে। রাস্তা ভুল করতে করতে একসময় প্লাজা জোকোডোভারে পৌঁছেই গেলাম শেষমেশ। পেট ঠান্ডা করে ‘মেকানিক্যাল স্টেয়ারস’ অর্থাৎ চলমান সিঁড়ি ধরে পাহাড় থেকে নেমে পুয়েন্তা দে আলকান্তারা সেতুর দিকে চললাম। এই ব্রিজ কালকে দেখা পুয়েন্তে দে সান মার্টিনের উল্টো দিকে। 


এখানে নদী অনেক বেশি চওড়া। জলও অনেক বেশি স্বচ্ছ। বেশ ভালো হাওয়া দিচ্ছে রোদ্দুর থাকা সত্ত্বেও। সেতুর আর্কের নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নদীর ধারে নেমে এলাম। নদীর জলে হাঁসের দল খেলা করছে। ঝোপ ঝাড় পরিষ্কার করে খানিক বাগানের মত করা আছে। সেখানে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তোলেদো শহর আমাদের মাথার ওপর। এল গ্রেকোর আঁকা তোলেদোর পেইন্টিংটা হয়ত কালই আঁকা হয়েছিল। 


TOLEDO
Santiago del Arabel Cathedral

Related image
Puente de Alcantara

el_greco_view_of_toledo
Painting of El Toledo by El Greco

ক্রমশ 
যাত্রা শুরু 

প্রথম পর্ব এখানে

বই কিনতে হলে 

দ্য ট্রেজার্স অফ তোলেদো-প্রথম পর্ব

গির্জা, গ্রেকো, ও গুপ্তধনের গল্প– তিন সংস্কৃতির সঙ্গম

Image result for toledo hd
Toledo-Old City

একটা সাদা চুল গজিয়েছে মাথায়

হ্যাঁচকা টানে সেটা উপড়ে ফেললাম

সে বলল, “ আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘরছাড়া করলে

আমার সৈন্যরা যখন ধেয়ে আসবে কি করবে?

~য়েহুদা হেলাভি


১) “স্পেনে মৃতরা অন্য কোন দেশের মৃতের চেয়ে অনেক বেশী জীবিত"

“বটে? কার লাইন ঝেড়েছিস শুনি?” 

বিরক্ত চোখে হাতের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বললাম, “লোরকা”

সঙ্গিনী একটা মাফিন কেকে কামড় দিয়ে বললেন, “তোলেদোতে তাহলে ভূতেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বলছিস! ভালো, ভালো।”

ভূতেদের সঙ্গে দেখা না হলেও যে জনপ্রিয় স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার এই উক্তি একেবারেই সঠিক, তার প্রথম প্রমাণ আমাদের দিলো তোলেদো। মাদ্রিদ থেকে মাত্র সত্তর কিলোমিটার দূরে তাগুস নদীর কিনারায় অবস্থিত এই প্রাচীন পার্বত্য নগরী যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। এককালে স্পেনের রাজধানী থাকা এই শহরের অধিকার কখনো রোমান,  কখনো ভিসিগথ কখনো মুরদের হাতে থেকেছে। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তোলেদোতে নতুন নতুন ইতিহাসের পাতা যোগ হয়েছে ঠিকই কিন্তু পুরোনো পাতাগুলো মুছে যায়নি কোনদিনই,  বরং সময়ের সাথে সাথে তাদের অস্তিত্ব আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।  


স্পেনে এক শহর থেকে কাছাকাছি অন্য শহরে যেতে হলে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বাস। 'আলসা' কোম্পানি সস্তায় সারা দেশে বাস চালায়, ট্রেনের চেয়ে ঢের সস্তা বাসের টিকিট। উপরি পাওনা হলো স্পেনের ভূখণ্ডের বৈচিত্র এবং বিস্তার সচক্ষে দেখা। একদিন সকালে মাদ্রিদের প্লাজা এলিপ্টিকা থেকে বাসে উঠে বসলাম। শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাস। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহর ছাড়িয়ে খোলা প্রান্তরে এসে পড়লো। এক ঘন্টাও লাগলো না। পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে তোলেদো বাসস্টপে নেমে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সিটি বাসে করে এসে উপস্থিত হলাম শহরের মধ্যবিন্দু প্লাজা জোকোদোভারে। সিটি বাস পাঁচ মিনিটে আমাদের সমতল থেকে পাহাড়ের মাথায় তুলে দিয়েছে। 


শহরের বিস্তার পাহাড়ের ওপরেই। বাস থেকে আসার সময় অনেক নীচে তাগুস নদীর নয়নবিহঙ্গম দৃশ্য দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম কিন্তু তখনও আন্দাজ ছিল না কোন রূপকথার দেশ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে?


প্লাজা জোকোডোভারে নেমে হস্টেলে ব্যাগ ফেলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লোরকার সেই উক্তি আমার মাথায় চক্কর কাটতে লাগলো। তোলেদোতে নেমে যে মনের ভাব কিরকম হয় সেটা বোঝানোর জন্যে যে কলমের জোর দরকার, সেই কলম আমার নয়। শুধু এইটুকুই বলব যে একধাক্কায় সময়ের  কাঁটা পিছনে ঘুরে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় প্রাচীন ইতিহাসের সম্মুখে। এই মনোভাব জোর করে আসে না, ইতিহাসকে কল্পনা করতে হয় না, শহরের খোয়া বাঁধানো পাকা গলির মধ্যে, মুদেহার স্থাপত্যের বাড়িঘরে, উঁচুনিচু সিঁড়ি দিয়ে গির্জার দিকে এগোনো রাস্তায় এই ইতিহাসের বুনন অভিক্ষিপ্ত। 


ছোট্ট শহর, মাদ্রিদ অথবা লন্ডনের চোখধাঁধানো আধুনিকতার জোয়ার এখানে নেই। এখানে আছে পাথর। জীবন্ত পাথর দিয়ে ধাপে ধাপে তৈরী করা রূপকথার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে এক একবার এক এক অভিনেতা আত্মপ্রকাশ করেছেন,  আবার কালের নিয়মে বিদায় জানিয়েছেন মঞ্চকে।   


তোলেদো শহরকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে তাগুস নদী। আমাদের হস্টেল থেকে বেরিয়েছি পঞ্চাশ ধাপ সিঁড়ি উঠেই রাস্তার ডান পাশে আলকাজার দে তোলেডো। রোমান কালে রাজপ্রাসাদ থাকলেও উচ্চতার জন্যে মুররা তোলেদোর সবচেয়ে উচ্চতায় থাকা এই ইমারতকে কেল্লা এবং সেনাবাহিনীর প্রধান দপ্তর করে তুলেছিল। আজ এখানেই আছে মিলিটারি মিউজিয়াম এবং কাস্তিয়া লা মানচা পুস্তকালয়। আলকাজারের দিকে এগিয়ে গেলেই পাথর বাঁধানো রাস্তা শেষ হয়ে তাগুস নদী আর নদীর অপর পারের বিস্তার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শহরের কোথাও কোন নতুন নির্মাণকার্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। ক্রিশ্চান, মুসলমান এবং ইহুদি সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের যুগপৎ অবস্থানকে রক্ষা করতে তোলেদোকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ করে দেওয়া হয়েছে। ‘সিটি অফ থ্রি কালচার’ এবং ‘ইম্পেরিয়াল সিটি’ সংজ্ঞা পাওয়া এই শহরে একসময় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র তৈরী করা হত। সেই সব ঢাল তলোয়ার আজকাল লোকে স্যুভেনির হিসেবে কিনে নিয়ে যায়। 

Image result for plaza zocodover
Plaza Zocodover

সঙ্গে একটা ম্যাপ নিয়েছিলাম। বিশেষ কোন রাস্তা ধরে এগোনার দরকার নেই,  প্রায় সব রাস্তাই এঁকেবেঁকে একে অপরের সঙ্গে মিলেছে খানিক পর পর। শুধু দিকটা ঠিক রাখতে হবে। এল গ্রেকো অর্ধেক জীবন কাটিয়েছেন এখানে,  তার বিখ্যাত ছবি ‘বিউরিয়াল অফ কাউন্ট অফ অরগাজ’ রাখা আছে এখানকার গির্জা ইগলেশিয়া দে সানতো তোমেতে। আমরা গলির গোলকধাঁধা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলেছি। কোন কোন গলিতে সুসজ্জিত অ্যান্টিক ও স্যুভেনিরের দোকান,  সঙ্গে ক্যাফে, রেস্তরাঁ, জামাকাপড়, গয়নার দোকান সাজানো। কয়েকটি গলি আবার একেবারে নির্জন। পাথরের রাস্তার দুপাশে উঁচু উঁচু প্রাচীন বাদামী রঙের পাথরের বাড়ি, বেশ কয়েকটা খোলা প্লাজা, স্কয়ার, গির্জাও চোখে পড়ল। এই গলি সেই গলি করে এগিয়ে চলেছি। পাশে পড়লো তোলেদো বিশ্ববিদ্যালয়, ইহুদিদের পাড়া। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে বাড়িগুলো ভালো করে দেখতে।

Image result for toledo streets hd
Old Town Streets




ঘড়ির কাঁটা বলছে বিকেল হয়ে গেছে অতএব গির্জা এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব আমরা চললুম শহরের অন্য প্রান্তে থাকা তাগুস নদীর ওপরে তৈরী মধ্যকালীন সেতু পুয়েন্তে দে সান মার্টিনের দিকে। গলির মধ্যে অনবরত নজরে পড়ছে গির্জা, সিনাগগ, মসজিদ। মুরদের সময়কার বেশিরভাগ মসজিদ পুনর্নির্মাণ করা হলেও স্থাপত্যশৈলী দেখে আসল নির্মাণকাল সহজেই বোঝা যায়। অনেক গির্জা হাজার বছরেরও আগে তৈরী, আবার অনেকগুলো ষোড়শ শতাব্দীর চিহ্ন বহন করছে। বাঁদিকে জিউস কোয়ার্টারকে পাশ কাটিয়ে কাসা দেল হুদিও আর মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে যখন আমরা সান মার্টিন সেতুর দিকে পৌঁছলাম,  বিকেল সাতটার কড়া রোদে গা মাথা পুড়ে যাচ্ছে রীতিমত। সেতুর মাঝামাঝি একজায়গায় খানিকটা ছায়া মতন রয়েছে, সেখানে গিয়ে নদীর দিকে চাইতেই চোখ জুড়িয়ে গেল।

Related image

নদীর দুইদিকে ফুলের ঝোপ হলুদ আর গোলাপি রঙের পুটুস ফুলে বোঝাই,  অনেক নীচে তাগুস নদীর ঘোলা জলের চওড়া রেখা এগিয়ে চলেছে। আমরা যেদিক দিকে হেঁটে এসেছি, সেদিকটা শহরের 'ওল্ড টাউন’। ডান দিকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে পাকা রাস্তা এঁকে বেঁকে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। সেতু পেরিয়ে গেলে রাস্তা পড়বে হাইওয়েতে। এই রাস্তায় বাস চলাচল করে নতুন শহরের দিকে। ম্যাপ হাতে নিয়ে দেখলাম প্রায় চার কিলোমিটার দূরে মিরাদোর দেল ভাইয়ে বলে একটা জায়গা আছে পাহাড়ের ওপর, সেখান থেকে নাকি পুরো ওল্ড টাউনটা দেখা যায়। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা পেরিয়েছে, গুগল বলছে সূর্যাস্ত হবে রাত দশটায়। ম্যাপ দেখে ঠিকঠাক জায়গা খুঁজে বের করা আর সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমার, স্প্যানিশ দিদিমণি তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে একের পর ছবি তুলেই সময়ের সদ্ব্যবহার করে। 


সূর্যাস্ত দেখার লোভ সামলানো কঠিন, অতএব সান মার্টিন সেতু ছাড়িয়ে বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু দাঁড়ানোই সার। বাস কিছুতেই আসে না। প্রায় আধ ঘন্টা পর উল্টো দিক থেকে এসে একটা বাস এলো। বাসের ড্রাইভার মহিলা আমাদের দেখে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন। বেশ বুঝতে পারলাম এই পাহাড়ের রাস্তায় একটাই বাস চলে। ওই বাসটাই হয়ত আবার মিনিট তিরিশ পর ঘুরে এদিকে আসবে। কিন্তু ক্যাবলার মত রোদে অপেক্ষা করার কোন মানেই হয় না। সুতরাং 'জয় মা' বলে হাঁটা দিলাম। ব্যাকপ্যাকিং করতে এসে হাঁটা অবশ্যম্ভাবী, পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটা খুব একটা কঠিন কাজও নয়, কিন্তু মাথার ওপর রোদ না থাকলেই ভালো হত। তার ওপরে এই রাস্তায় লোকজন পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করে না বলে ফুটপাথ বলে কিছু নেই। সাঁই সাঁই করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। 


গুগল ম্যাপ দেখে দেখে চলেছি। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য হাইওয়ে ছেড়ে নদীর ধার দিয়ে যাওয়া একটা নির্জন রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। ততক্ষণে রোদের তেজ কমে আসতে শুরু করেছে। রাস্তার দু ধারে সবুজের আধিক্য। দূরে তোলেদোর ওল্ড টাউন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। নদীর জল দেখতে পাচ্ছি বহু নীচে। বেশ কয়েকজন সাইকেল চালাতে অথবা দৌড়তে আসে এই রাস্তায়, ছেলে মেয়ে বাচ্চা বুড়ো কেউ বাদ নেই। আমরাও মনের সুখে হাঁটছি। মাঝে মাঝে পুরোনো কোন বাড়ি অথবা ফার্মহাউসের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তারপর আবার পড়ছে ফাঁকা নির্জন রাস্তা। পাখির ইতিউতি ডাক কানে আসছে। কিছুদূর পর পর রাস্তার ধারে বাঁধানো বসার বেঞ্চি আছে, অনেকেই বসে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। পথ চলতে চলতে আমরা এক সময় এসে পৌঁছলাম মিরাডোর্ দে ভাইয়েতে। 


On way-Mirador de Valle
কাছেই একটা রেস্তরাঁতে লোকে সূর্যাস্ত দেখবে বলে ভিড় জমিয়েছে। আকাশের গায়ে ঘন কমলার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। দূরে তোলেদো শহরের ওল্ড টাউন সূর্যাস্তের অপেক্ষায় সাজতে শুরু করেছে এক একটা করে আলোর টিপ পরে। তাগুস নদী এখানে বাঁ দিকে বেঁকেছে। অনেক নীচে নদীর পাড় দিয়ে কয়েকজন জলের ধারে গিয়ে মাছ ধরছে। রাস্তার ধরে উঁচু পাঁচিলের ওপর বসে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের কালস্থায়ী, আবহমান জীবনদৃশ্যের দিকে। সূর্যাস্ত হচ্ছে। আলোহিত আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে বাসায় ফিরে চলেছে পাখির দল।  নদীর গর্ভে হয়ত মাছেরাও ঘুমোনোর তোড়জোড় শুরু করবে এইবার। দূরে তোলেদো শহর অনন্তকাল ধরে এই সায়াহ্নের সাক্ষী। আমার চোখের সামনে এই মুহূর্তে ইতিহাস, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক ফ্রেমে। নিজের অজান্তেই এই মুহূর্ত আমাদেরও ইতিহাসের পাতায় বন্দী করে রাখলো, চিরকালের জন্যে।
Mirador del valle
Image result for toledo mirador del valle sunset

Related image

ক্রমশ:-- পরের পর্ব এখানে পড়ুন

বই কিনতে হলে