সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দ্য ট্রেজার্স অফ তোলেদো-প্রথম পর্ব

গির্জা, গ্রেকো, ও গুপ্তধনের গল্প– তিন সংস্কৃতির সঙ্গম

Image result for toledo hd
Toledo-Old City

একটা সাদা চুল গজিয়েছে মাথায়

হ্যাঁচকা টানে সেটা উপড়ে ফেললাম

সে বলল, “ আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘরছাড়া করলে

আমার সৈন্যরা যখন ধেয়ে আসবে কি করবে?

~য়েহুদা হেলাভি


১) “স্পেনে মৃতরা অন্য কোন দেশের মৃতের চেয়ে অনেক বেশী জীবিত"

“বটে? কার লাইন ঝেড়েছিস শুনি?” 

বিরক্ত চোখে হাতের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বললাম, “লোরকা”

সঙ্গিনী একটা মাফিন কেকে কামড় দিয়ে বললেন, “তোলেদোতে তাহলে ভূতেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বলছিস! ভালো, ভালো।”

ভূতেদের সঙ্গে দেখা না হলেও যে জনপ্রিয় স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার এই উক্তি একেবারেই সঠিক, তার প্রথম প্রমাণ আমাদের দিলো তোলেদো। মাদ্রিদ থেকে মাত্র সত্তর কিলোমিটার দূরে তাগুস নদীর কিনারায় অবস্থিত এই প্রাচীন পার্বত্য নগরী যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। এককালে স্পেনের রাজধানী থাকা এই শহরের অধিকার কখনো রোমান,  কখনো ভিসিগথ কখনো মুরদের হাতে থেকেছে। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তোলেদোতে নতুন নতুন ইতিহাসের পাতা যোগ হয়েছে ঠিকই কিন্তু পুরোনো পাতাগুলো মুছে যায়নি কোনদিনই,  বরং সময়ের সাথে সাথে তাদের অস্তিত্ব আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।  


স্পেনে এক শহর থেকে কাছাকাছি অন্য শহরে যেতে হলে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বাস। 'আলসা' কোম্পানি সস্তায় সারা দেশে বাস চালায়, ট্রেনের চেয়ে ঢের সস্তা বাসের টিকিট। উপরি পাওনা হলো স্পেনের ভূখণ্ডের বৈচিত্র এবং বিস্তার সচক্ষে দেখা। একদিন সকালে মাদ্রিদের প্লাজা এলিপ্টিকা থেকে বাসে উঠে বসলাম। শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাস। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহর ছাড়িয়ে খোলা প্রান্তরে এসে পড়লো। এক ঘন্টাও লাগলো না। পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে তোলেদো বাসস্টপে নেমে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সিটি বাসে করে এসে উপস্থিত হলাম শহরের মধ্যবিন্দু প্লাজা জোকোদোভারে। সিটি বাস পাঁচ মিনিটে আমাদের সমতল থেকে পাহাড়ের মাথায় তুলে দিয়েছে। 


শহরের বিস্তার পাহাড়ের ওপরেই। বাস থেকে আসার সময় অনেক নীচে তাগুস নদীর নয়নবিহঙ্গম দৃশ্য দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম কিন্তু তখনও আন্দাজ ছিল না কোন রূপকথার দেশ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে?


প্লাজা জোকোডোভারে নেমে হস্টেলে ব্যাগ ফেলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লোরকার সেই উক্তি আমার মাথায় চক্কর কাটতে লাগলো। তোলেদোতে নেমে যে মনের ভাব কিরকম হয় সেটা বোঝানোর জন্যে যে কলমের জোর দরকার, সেই কলম আমার নয়। শুধু এইটুকুই বলব যে একধাক্কায় সময়ের  কাঁটা পিছনে ঘুরে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় প্রাচীন ইতিহাসের সম্মুখে। এই মনোভাব জোর করে আসে না, ইতিহাসকে কল্পনা করতে হয় না, শহরের খোয়া বাঁধানো পাকা গলির মধ্যে, মুদেহার স্থাপত্যের বাড়িঘরে, উঁচুনিচু সিঁড়ি দিয়ে গির্জার দিকে এগোনো রাস্তায় এই ইতিহাসের বুনন অভিক্ষিপ্ত। 


ছোট্ট শহর, মাদ্রিদ অথবা লন্ডনের চোখধাঁধানো আধুনিকতার জোয়ার এখানে নেই। এখানে আছে পাথর। জীবন্ত পাথর দিয়ে ধাপে ধাপে তৈরী করা রূপকথার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে এক একবার এক এক অভিনেতা আত্মপ্রকাশ করেছেন,  আবার কালের নিয়মে বিদায় জানিয়েছেন মঞ্চকে।   


তোলেদো শহরকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে তাগুস নদী। আমাদের হস্টেল থেকে বেরিয়েছি পঞ্চাশ ধাপ সিঁড়ি উঠেই রাস্তার ডান পাশে আলকাজার দে তোলেডো। রোমান কালে রাজপ্রাসাদ থাকলেও উচ্চতার জন্যে মুররা তোলেদোর সবচেয়ে উচ্চতায় থাকা এই ইমারতকে কেল্লা এবং সেনাবাহিনীর প্রধান দপ্তর করে তুলেছিল। আজ এখানেই আছে মিলিটারি মিউজিয়াম এবং কাস্তিয়া লা মানচা পুস্তকালয়। আলকাজারের দিকে এগিয়ে গেলেই পাথর বাঁধানো রাস্তা শেষ হয়ে তাগুস নদী আর নদীর অপর পারের বিস্তার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শহরের কোথাও কোন নতুন নির্মাণকার্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। ক্রিশ্চান, মুসলমান এবং ইহুদি সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের যুগপৎ অবস্থানকে রক্ষা করতে তোলেদোকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ করে দেওয়া হয়েছে। ‘সিটি অফ থ্রি কালচার’ এবং ‘ইম্পেরিয়াল সিটি’ সংজ্ঞা পাওয়া এই শহরে একসময় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র তৈরী করা হত। সেই সব ঢাল তলোয়ার আজকাল লোকে স্যুভেনির হিসেবে কিনে নিয়ে যায়। 

Image result for plaza zocodover
Plaza Zocodover

সঙ্গে একটা ম্যাপ নিয়েছিলাম। বিশেষ কোন রাস্তা ধরে এগোনার দরকার নেই,  প্রায় সব রাস্তাই এঁকেবেঁকে একে অপরের সঙ্গে মিলেছে খানিক পর পর। শুধু দিকটা ঠিক রাখতে হবে। এল গ্রেকো অর্ধেক জীবন কাটিয়েছেন এখানে,  তার বিখ্যাত ছবি ‘বিউরিয়াল অফ কাউন্ট অফ অরগাজ’ রাখা আছে এখানকার গির্জা ইগলেশিয়া দে সানতো তোমেতে। আমরা গলির গোলকধাঁধা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলেছি। কোন কোন গলিতে সুসজ্জিত অ্যান্টিক ও স্যুভেনিরের দোকান,  সঙ্গে ক্যাফে, রেস্তরাঁ, জামাকাপড়, গয়নার দোকান সাজানো। কয়েকটি গলি আবার একেবারে নির্জন। পাথরের রাস্তার দুপাশে উঁচু উঁচু প্রাচীন বাদামী রঙের পাথরের বাড়ি, বেশ কয়েকটা খোলা প্লাজা, স্কয়ার, গির্জাও চোখে পড়ল। এই গলি সেই গলি করে এগিয়ে চলেছি। পাশে পড়লো তোলেদো বিশ্ববিদ্যালয়, ইহুদিদের পাড়া। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে বাড়িগুলো ভালো করে দেখতে।

Image result for toledo streets hd
Old Town Streets




ঘড়ির কাঁটা বলছে বিকেল হয়ে গেছে অতএব গির্জা এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব আমরা চললুম শহরের অন্য প্রান্তে থাকা তাগুস নদীর ওপরে তৈরী মধ্যকালীন সেতু পুয়েন্তে দে সান মার্টিনের দিকে। গলির মধ্যে অনবরত নজরে পড়ছে গির্জা, সিনাগগ, মসজিদ। মুরদের সময়কার বেশিরভাগ মসজিদ পুনর্নির্মাণ করা হলেও স্থাপত্যশৈলী দেখে আসল নির্মাণকাল সহজেই বোঝা যায়। অনেক গির্জা হাজার বছরেরও আগে তৈরী, আবার অনেকগুলো ষোড়শ শতাব্দীর চিহ্ন বহন করছে। বাঁদিকে জিউস কোয়ার্টারকে পাশ কাটিয়ে কাসা দেল হুদিও আর মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে যখন আমরা সান মার্টিন সেতুর দিকে পৌঁছলাম,  বিকেল সাতটার কড়া রোদে গা মাথা পুড়ে যাচ্ছে রীতিমত। সেতুর মাঝামাঝি একজায়গায় খানিকটা ছায়া মতন রয়েছে, সেখানে গিয়ে নদীর দিকে চাইতেই চোখ জুড়িয়ে গেল।

Related image

নদীর দুইদিকে ফুলের ঝোপ হলুদ আর গোলাপি রঙের পুটুস ফুলে বোঝাই,  অনেক নীচে তাগুস নদীর ঘোলা জলের চওড়া রেখা এগিয়ে চলেছে। আমরা যেদিক দিকে হেঁটে এসেছি, সেদিকটা শহরের 'ওল্ড টাউন’। ডান দিকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে পাকা রাস্তা এঁকে বেঁকে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। সেতু পেরিয়ে গেলে রাস্তা পড়বে হাইওয়েতে। এই রাস্তায় বাস চলাচল করে নতুন শহরের দিকে। ম্যাপ হাতে নিয়ে দেখলাম প্রায় চার কিলোমিটার দূরে মিরাদোর দেল ভাইয়ে বলে একটা জায়গা আছে পাহাড়ের ওপর, সেখান থেকে নাকি পুরো ওল্ড টাউনটা দেখা যায়। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা পেরিয়েছে, গুগল বলছে সূর্যাস্ত হবে রাত দশটায়। ম্যাপ দেখে ঠিকঠাক জায়গা খুঁজে বের করা আর সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমার, স্প্যানিশ দিদিমণি তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে একের পর ছবি তুলেই সময়ের সদ্ব্যবহার করে। 


সূর্যাস্ত দেখার লোভ সামলানো কঠিন, অতএব সান মার্টিন সেতু ছাড়িয়ে বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু দাঁড়ানোই সার। বাস কিছুতেই আসে না। প্রায় আধ ঘন্টা পর উল্টো দিক থেকে এসে একটা বাস এলো। বাসের ড্রাইভার মহিলা আমাদের দেখে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন। বেশ বুঝতে পারলাম এই পাহাড়ের রাস্তায় একটাই বাস চলে। ওই বাসটাই হয়ত আবার মিনিট তিরিশ পর ঘুরে এদিকে আসবে। কিন্তু ক্যাবলার মত রোদে অপেক্ষা করার কোন মানেই হয় না। সুতরাং 'জয় মা' বলে হাঁটা দিলাম। ব্যাকপ্যাকিং করতে এসে হাঁটা অবশ্যম্ভাবী, পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটা খুব একটা কঠিন কাজও নয়, কিন্তু মাথার ওপর রোদ না থাকলেই ভালো হত। তার ওপরে এই রাস্তায় লোকজন পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করে না বলে ফুটপাথ বলে কিছু নেই। সাঁই সাঁই করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। 


গুগল ম্যাপ দেখে দেখে চলেছি। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য হাইওয়ে ছেড়ে নদীর ধার দিয়ে যাওয়া একটা নির্জন রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। ততক্ষণে রোদের তেজ কমে আসতে শুরু করেছে। রাস্তার দু ধারে সবুজের আধিক্য। দূরে তোলেদোর ওল্ড টাউন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। নদীর জল দেখতে পাচ্ছি বহু নীচে। বেশ কয়েকজন সাইকেল চালাতে অথবা দৌড়তে আসে এই রাস্তায়, ছেলে মেয়ে বাচ্চা বুড়ো কেউ বাদ নেই। আমরাও মনের সুখে হাঁটছি। মাঝে মাঝে পুরোনো কোন বাড়ি অথবা ফার্মহাউসের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তারপর আবার পড়ছে ফাঁকা নির্জন রাস্তা। পাখির ইতিউতি ডাক কানে আসছে। কিছুদূর পর পর রাস্তার ধারে বাঁধানো বসার বেঞ্চি আছে, অনেকেই বসে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। পথ চলতে চলতে আমরা এক সময় এসে পৌঁছলাম মিরাডোর্ দে ভাইয়েতে। 


On way-Mirador de Valle
কাছেই একটা রেস্তরাঁতে লোকে সূর্যাস্ত দেখবে বলে ভিড় জমিয়েছে। আকাশের গায়ে ঘন কমলার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। দূরে তোলেদো শহরের ওল্ড টাউন সূর্যাস্তের অপেক্ষায় সাজতে শুরু করেছে এক একটা করে আলোর টিপ পরে। তাগুস নদী এখানে বাঁ দিকে বেঁকেছে। অনেক নীচে নদীর পাড় দিয়ে কয়েকজন জলের ধারে গিয়ে মাছ ধরছে। রাস্তার ধরে উঁচু পাঁচিলের ওপর বসে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের কালস্থায়ী, আবহমান জীবনদৃশ্যের দিকে। সূর্যাস্ত হচ্ছে। আলোহিত আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে বাসায় ফিরে চলেছে পাখির দল।  নদীর গর্ভে হয়ত মাছেরাও ঘুমোনোর তোড়জোড় শুরু করবে এইবার। দূরে তোলেদো শহর অনন্তকাল ধরে এই সায়াহ্নের সাক্ষী। আমার চোখের সামনে এই মুহূর্তে ইতিহাস, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক ফ্রেমে। নিজের অজান্তেই এই মুহূর্ত আমাদেরও ইতিহাসের পাতায় বন্দী করে রাখলো, চিরকালের জন্যে।
Mirador del valle
Image result for toledo mirador del valle sunset

Related image

ক্রমশ:-- পরের পর্ব এখানে পড়ুন

বই কিনতে হলে 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন