সোমবার, ১৮ মে, ২০২০

আমি নিরুদ্দেশ হতে চেয়েছিলাম --- দ্য ম্যাজিক অফ মাদ্রিদ (১)

সের্ভান্তেস, সাঙরিয়া ও স্প্যানিশ সামার্সস্পেনের উল্লাস

Related image
Madrid

যদি মরে যাই, জানলাটা খুলে রেখো
শিশুটির মুখে কমলালেবু, জানলা থেকে দেখতে পাই 
গম পেষাই করছে এক চাষা, জানলা থেকে শুনতে পাই
যদি মরে যাই, জানলাটা খোলা রেখো

~ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা

১) ওজন বড়জোর একশ গ্রাম। আকারে হয়তো একটা পায়রার মতো। সাদা পেট, লাল ঠোঁট আর আসমানি রঙের ডানা দেখে মনে হয়, পাখি নয়, বরং রঙিন উলের বল। অথবা পেঁজা তুলো দিয়ে তৈরি এক টুকরো মেঘ। নরম হাতে তুলে নিয়ে উড়িয়ে দাও, পালকের মতো ভেসে বেড়াতে দাও হাওয়ায় ভর করে, তারপর আবার লুফে নাও এক ঝটকায়। নিজেকে জানান দিতে ডানা ফরফর করতে দাও তাকে। প্রমাণ করতে দাও সে সত্যিই পাখি। 

পাখি হলেও কী? কুছ পরোয়া নেহি! এইটুকুন তো জীব! ঠিক যেন পুতুল। তাকে বন্দি করে রাখো হাতের মুঠোয়। খাঁচায় আটকে রাখো, অথবা পায়ে বেঁধে দাও সুতো, করুণ স্বরে ডাকতে দাও। মাঝেমধ্যে এনে দাও খাবার। দুই সপ্তাহ চলুক এই বন্দিদশা! না হলে তিন। ব্যস! তারপর পাখি তোমার আজ্ঞাবহ দাস। খাঁচা থেকে মুক্তি দিলেও আর ডানা মেলে আকাশে উড়বে না। ফরফর করবে ছাদের মাথায়, না হয় পঁচিলে গিয়ে বসবে। হাঁটবে দু’ এক পা। তারপর গুটি গুটি ফিরে আসবে খাঁচার কাছে। প্রাণের ভয় নেই নাকি? একশ গ্রাম ওজন যার, তার সাহস আর কোনটুকু হবে? ঠিক কিনা?

আজ্ঞে না। হিসেবে একটু ভুল আছে। কারণ, পাখিটার নাম আর্কটিক টার্ন। ওজন সত্যিই একশ গ্রাম, কমও হতে পারে। কিন্তু সাহসের দিক থেকে এই পরিযায়ী পাখি দুনিয়ার সমস্ত পাখিকে টেক্কা দেবে। প্রতি বছর প্রায় সত্তর হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এই পাখি। কিন্তু আর চারটে পরিযায়ী পাখির মতো একই পথ ধরে উড়ে চলে না এরা। অনেকে আফ্রিকার উপকূল ধরে এগিয়ে যায়, বাকিরা অতলান্তিক সাগর অতিক্রম করে দক্ষিণ আমেরিকার গিয়ে উপস্থিত হয়। ফেরার সময় কিন্তু একই পথ দিয়ে ফেরে না তারা। বৈজ্ঞানিকরা দেখেছেন আর্কটিক টার্ন পাখিরা ফিরতি পথে অতলান্তিক সাগরের ওপর একটা ‘এস’ প্যাটার্ন অনুসরণ করে। এই অদ্ভুত যাত্রাপথের জন্য পাখিগুলোকে অনেকটা অতিরিক্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এর কারণ কী, কেউ জানে না। পক্ষীবিশারদদের মতে, হয়তো ‘গ্লোবাল উইন্ড সিস্টেম’-এর সুবিধা নেওয়ার জন্য এমন করে থাকে পাখিগুলো। কিন্তু নিশ্চিত ভাবে কিছুই বোঝা যায়নি। একটা কথাই শুধু জানা গিয়েছে, মহাবিশ্বের অন্যতম ভ্রমণকারী হল এই সামুদ্রিক পাখি। একটা আর্কটিক টার্ন জীবনকালে যতটা পথ উড়ে  কাটায়, তাতে তিন বার পৃথিবী থেকে চাঁদে গিয়ে ফিরে আসা যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই পরিযাণ শুধু তাদের জীবন নয়, তাদের ভবিতব্যও। কোনও  পাখিকে যদি জোর করে আটকে রাখা হয়, তাহলে তারা কয়েক বছরের বেশি বাঁচে না। 

আর্কটিক টার্নের মতো না হলেও সুটি শিয়ারওয়াটার বলে একটি পাখি প্রায় তেষট্টি হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ফি বছর। শর্ট টেইল্ড শিয়ারওয়াটার আবার পাখিদের দুনিয়ার গ্লোবট্রটার হিসেবে বিখ্যাত। এই পুঁচকে পাখি দুনিয়ার সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়, কোনও বিশেষ জায়গায় গিয়ে ডেরা জমায় না। আবার গান গাওয়া নর্দার্ন হুইটিয়ারের কথাই বা থাকে কেন? সাহারা মরুভূমি হোক বা তুন্দ্রা অঞ্চল, গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল হোক বা বরফাবৃত প্রদেশ, কোনও জায়গায় যেতেই এদের আপত্তি নেই। ওড়ার জন্য তৈরি হয়েই আছে। বেড়ানোর নাম শুনেই ব্যাগ গুছিয়ে থুড়ি ডানা মেলে রেডি। ডানা থাকার লাভ আছে, স্বীকার করতেই হবে। 

পাখির গল্প থেকে এইবার মানুষের গল্পে ফেরা যাক। সংকোচ হচ্ছে যদিও, কারণ নিজেকে মানুষ বলতে কেন জানি একটু কিন্তু কিন্তু ভাব থাকে। মোদ্দা কথা হল, আমার ডানা নেই ঠিকই, কিন্তু উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের চেয়ে কম নয়। আর্কটিক টার্নের মতো শারীরিক ক্ষমতা না থাকতে পারে, কিন্তু শর্ট টেইল্ড শিয়ারওয়াটার আর নর্দার্ন হুইটিয়ারের মতো অ্যাটিটিউড আছে ষোলআনা। তাই গন্তব্য যাই হোক না কেন, যাত্রার গুরুত্বকে হেয় করা আমার ধাতে নেই। উল্টে পথে কাটানো সময়টুকুই আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে শান্তির। ওই পথচলাটুকুই  আমার জীবনের সঞ্চয়। আমার বাড়ি, আমার দেশ, আমার মুক্তির জায়গা। এই নিরুদ্দেশ যাত্রাই আমার নিয়তি, আমার মুক্তির পথ। 

সেই পাগলপারা নিরুদ্দেশ যাত্রার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই উড়ে চলেছি এই মুহূর্তে। প্লেনটা ঘুরে ঘুরে নামতে শুরু করেছে। জানলার পাল্লা তুলে দেখলাম, স্পেনের মাটিতে আলোর রোশনাই আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। মাদ্রিদের বারাজাস এয়ারপোর্টে যখন পা রাখলাম, ঘড়িতে রাত বারোটা। সূর্যাস্ত হয়েছে ঘন্টাখানেক আগে। রাত দশটার সময় আমাদের ফ্লাইট যখন গ্রীসের ওপর থেকে উড়ে আসছে, বাইরে সূর্যাস্তের কমলা রং দেখে ভয়ানক অবাক হয়ে পড়েছিলাম। অচিরেই মনে পড়লো এ আমাদের প্রাচ্যদেশ নয়, খাস ইউরোপিয়ান পেনিনসুলা। ‘সামার্স’ মানে গ্রীষ্মকালে ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই সূর্যাস্ত হতে হতে রাত দশটা। যত পশ্চিমে যাবে, সূর্যাস্ত হবে তত দেরিতে। ফলে গ্রীষ্মের উল্লাস চলে আঠেরো ঘন্টা ধরে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, তিনমাস ব্যাপী গ্রীষ্মকালীন উৎসবের এই মেজাজ পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্তে দেখতে পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। অনেক দেশের মানুষই স্বভাবে ইউরোপিয়ানদের চেয়ে বেশি তুখোড়,  আমুদে আর হল্লাবাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু ইউরোপের এই নামহীন উৎসবের মধ্যে যেন একটা মুক্তির আমেজ লুকিয়ে থাকে। ‘সামার্স’ এখানে শুধু একটা ঋতু নয়, জীবনকে উপভোগ করার একটা দর্শনও বটে। 

Image result for madrid  airport night
Madrid Barazas Airport

আমাদের এই ব্যাকপ্যাকিং সফরের মেয়াদও এই গ্রীষ্মের কয়েক মাস। লং টার্ম ব্যাকপ্যাকিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে গেলে এই দীর্ঘ সময় আসলে মোটেই দীর্ঘ নয়, আর ইউরোপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে হলেও আড়াই তিন মাস নস্যি। সেই আন্দাজ আমরা পরিকল্পনা করার সময়েই পেয়েছিলাম। কিন্তু কী আর করা! সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যে তফাত থাকে, সে কথা আর কে না জানে?

দেশ দেখার নেশা একবার পেয়ে বসলে সেই নেশা কাটাবার কোনও উপায় নেই। অথচ সময়ের নিয়মে ছোটবেলার বেড়ানোর ছবিটা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে আজ। আরব্য বেদুইদের মতো উঁটের পিঠে বসে সাহার মরুভূমিতে পাড়ি দেওয়ার রোমাঞ্চ আর আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে ডেভিড লিভিংস্টোনের অভিযানের পথে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নও পাল্টে গেছে নতুন যুগে। এখন স্মার্টফোন হাতে ছবিশিকারি টুরিস্টের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। মরুভূমি হোক বা মাউন্ট এভারেস্টে, সর্বত্র দাপাদাপি করছে মানুষ। একমাত্র উগ্রপন্থীদের আক্রমণ ছাড়া কোনও কিছুতেই আর ভয় নেই, পথের ঝুঁকিও নেই আগের মতো। অতএব অ্যাডভেঞ্চারের পরিভাষাও গেছে পাল্টে।

রুদ্ধ্বশ্বাস কোনো অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হলে আজ অরণ্যে পাড়ি দেওয়া জরুরি নয়। পৃথিবীর যে কোনও শহরে, যে কোনও প্রান্তে সেই অভিজ্ঞতা হয়তো অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্যে। নতুন যুগে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষেরা বিশ্ব পারাপার করছে আসলে কয়েকটি মুহূর্তের সন্ধানে। কয়েকটি মুহূর্ত, যখন জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেও বর্তমান আবছা হয়ে আসে, সব কিছু মুছে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইতিহাসের এক একটা দৃশ্য। হারিয়ে যাওয়া কিছু ঘটনা। কথা। ছবি। গান। স্মৃতিসৌধ। কিছু মুখচ্ছবি। সাধারণ এবং অসাধারণ মানুষের জীবন। তাদের গল্প। আচমকাই এক নিমেষে মহাবিশ্বের বিশালতা আমাদের আবিষ্ট করে তোলে, অপ্রত্যাশিত ভাবে অনুভূত হয় প্রকৃতির আসল স্বরূপ। অল্পবিদ্যার অহংকার খসে পড়ে বিস্ময় আর শ্রদ্ধায়। যুগ আর মানুষের আবহমান পরিবর্তনের উর্ধ্বেও যে এই মহাবিশ্বে কিছু কিছু জিনিস একই রকম থেকে যায়, এরকম এক একটা মুহূর্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়।  

ইউরোপের ছাব্বিশটি দেশে প্রবেশ করতে হলে সেনগেন ভিসা নিলেই চলে। আগের মত পৃথক ভাবে প্রতিটা দেশের জন্যে ভিসা নিতে হয় না বলে ইউরোপ ঘুরে আসা অনেক সহজ হয়ে গেছে। মাদ্রিদ এয়ারপোর্টে ইম্মিগ্রেশন নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি আমার চোখে পড়ল না। এক পলক দেখেই ইম্মিগ্রেশানের লোকজন স্ট্যাম্প মেরে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলেন আমাদের। ব্যাগেজ কাউন্টার থেকে জিনিসপত্র তুলে বেরিয়ে পড়লাম। 

এয়ারপোর্ট থেকে রুকস্যাক পিঠে বেরিয়ে পড়লাম। নতুন দেশের মাটিতে পা পড়েছে বলে মনে ফূর্তির অভাব নেই। আমাদের যেতে হবে প্লাজা মেওরের কাছে, দিন কয়েকের জন্যে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ার কথা। গুগল ম্যাপ দেখে বিশেষ সুবিধে হল না, ইন্টারনেটও ঠিক মত আসছে না। কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। ভাগ্যক্রমে আমার সঙ্গিনী স্প্যানিশ ভাষা বিশারদ। স্প্যানিশ ভাষা বলা নিয়ে তার কোনও জড়তাও নেই। মুচকি হেসে বললাম, “সেনিওরিতা, আপনি এবার দায়িত্ব নিন তো দেখি। আমি অবোধ বালক, এই বিদেশ বিভুঁইয়ে যে কিছুই বুঝছি না রে ভাই!”

ঠোঁট উল্টে গট গট করে সিকিওরিটির লোকের কাছে চলে গেলেন, ফিরেও এলেন চটপট। তাবড় স্প্যানিশে কথোপকথন চালিয়ে দিদিমণি সব খবরাখবর নিয়ে এসেছেন। রুকস্যাক পিঠে তুলে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী চললাম। খুঁজেপেতে বাসেও উঠে পড়া হল। আমাদের কাছে ইউরো ভাঙানো ছিল কিছু, কিন্তু পাঁচ ইউরো করে টিকিট দিতে বেশ গায়ে লাগল। তা যাকগে! প্রথম প্রথম ওরকম লাগেই। বাস চলল। চকচকে বাস, ঝকঝকে রাস্তাঘাট। ইউরোপের সব জায়গাতেই রোডওয়েজ অসম্ভব ভালো। প্রায় সারা ইউরোপ জুড়ে পাকা রাস্তা জাল বিস্তার করে আছে। অসংখ্য ব্রিজ, ফ্লাইওভার, সাবওয়ে, টানেলের ছড়াছড়ি। খুব একটা অবাক হলাম না। 

পালাসিও দে সিবেলেস-এর কাছে সিবেলেস স্কোয়ারে এসে বাস থামল। এখান থেকে মেট্রো ধরতে হবে। মাঝে অবশ্য হাঁটা থামিয়ে স্প্যানিশ ‘সামারস’-এর জীবনযাত্রায় কয়েক মুহুর্তের জন্যে চোখ রাখতে বাধ্য হলাম। এই স্কোয়ারের চারিদিকে অবস্থিত টাউন হল, মিউজিয়াম, প্যালেস। রাত একটা বাজলে কি হবে, আলোয় জগমগ করছে সব কিছু। 

রাস্তায় প্রচুর লোকজন। দেখে মনে হচ্ছে বিকেল সাতটা। সাইকেল,  প্যাডেল স্কুটার, স্কেটবোর্ড নিয়ে চলেছে যুবক-যুবতীর দল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার রওনা দেওয়া হল গন্তব্যের উদ্দেশে। বানকো দে এসপান্যা মেট্রো স্টেশন থেকে টিকিট কাটলাম দু' দিনের জন্যে। বাস, মেট্রো যাতে খুশি তাতে উঠে পড়া যাবে এই টিকিট দেখিয়ে। মেট্রোতে দুটো স্টেশন। সোল স্টেশনে নেমে আমাদের হাঁটতে হবে সিধে প্লাজা মেওরের দিকে। এখানেই অবস্থিত মাদ্রিদের বিখ্যাত প্লাজা পুয়ের্তা দেল সোল। সে দিকে আর পা বাড়ালাম না আজ। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে চলেছি রুকস্যাক কাঁধে। চারিদিকে দেওয়ালির মত রোশনাই। জায়গাটা শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। ব্যাকপ্যাকার হোক বা প্যাকেজ ট্যুরের টুরিস্ট,  সকলেই এখানে ঘোরাফেরা করে। আলোকিত রেস্তোরাঁ, সুশোভিত বিপণিকেন্দ্র। শয়ে শয়ে লোক বিয়ার অথবা ওয়াইন নিয়ে রাস্তায় সাজানো টেবিলে বসে হাসাহাসি করছে, আড্ডা দিচ্ছে। তাদের পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হস্টেলের দিকে। 

প্লাজা মেওরের ঠিক পাশের গলিতে মার্কাদো দে সান মিগুয়েলের কাছে পুরোনো একটা বাড়ির তিন তলায় আমাদের হস্টেল। গরম ভালোই পড়েছে। হাট করে জানলা খুলে স্প্যানিশ সামারের প্রথম রাতের উল্লাস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে তখনও অপেক্ষা করে আছে গ্রীষ্মের বাকি রাতগুলো। 

Image result for iberian peninsula
Iberian Peninsula

Image result for madrid night cibeles square
Palacia de Cibeles

Related image
Marcado de san miguel

Image result for madrid night summers
Madrid Night

২)
১৪৬৯ সাল। স্পেনের নানা এলাকায় তখন ছোট ছোট ক্রিশ্চান রাজ্য গড়ে উঠেছে। প্রায় তিনশ বছর ধরে শাসন করেছে আফ্রিকার মুর সম্রাটরা, তারা ইসলাম ধর্মের অনুযায়ী। কিন্তু এখন তাদের অবস্থা অনেকটা পড়তির দিকে, ক্রিশ্চানরা আবার একটু একটু করে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। এমন সময় কাস্তিয়া রাজ্যের মহারানী ইসাবেলা প্রথম আর আরাগনের মহারাজ ফার্দিনান্দ দ্বিতীয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। এই বিয়ের পিছনে দীর্ঘ আলোচনা আর স্পেনের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ক্রিশ্চান রাজারা ঠিক করলেন যে কোনোক্রমেই স্পেনকে ক্রিশ্চান সাম্রাজ্য থেকে বেরোতে দেওয়া চলবে না। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ না করে এই বিবাহের মাধ্যমে বরং কাস্তিয়া এবং আরাগন এক হয়ে সম্মিলিত ভাবে গ্রানাদায় আক্রমণ করুক সম্রাট মুহাম্মদের ওপর। সেনার সম্মিলিত শক্তির সামনে গ্রানাদার শেষ মুসলমান রাজা টিকতে পারবেন না। 

Image result for spanish inquisition infographic

নিঁখুত প্ল্যানিং। হলও তাই। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রানাদা আর আন্দালুসিয়ার আশেপাশের অঞ্চল থেকে শেষ মুসলমান শাসকদের পরাজিত করে গোটা স্পেনে আধিপত্য বিস্তার করল ক্রিশ্চানরা। মুররা অবশ্য রাজা হিসেবে মোটেই জনপ্রিয় ছিলেন না। রাজ্যে ভিন্ন ধর্মালম্বী অন্যান্য নাগরিকদের অনেক বেশি কর দিতে হত। ইহুদি আর ক্রিশ্চানরা মুখ বুজে সব সহ্য করত। নতুন সম্রাট আসায় সাধারণ মানুষের মনে আশা দেখা দিল। এবার হয়তো স্বস্তিতে থাকা যাবে! তাদের মাথার ওপরে যে দুর্ভাগ্যের কালো মেঘ আরো বেশি করে ঘনাতে শুরু করেছে সেটা তখনও তারা বুঝতে পারেনি। 

ইতিহাসে এই পর্ব 'স্প্যানিশ ইনকুইজিশন' নামে কুখ্যাত। সেই সময়ে লক্ষ লক্ষ লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে বিনা কারণে। গ্রানাদায় ১৪৯১ সালে সুলতান মুহম্মদ ফার্দিনান্দ আর ইসাবেলার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন যে ক্রিশ্চানরা অধিকার পেলে অন্য ধর্মের লোকেদের ওপর অত্যাচার করা চলবে না। এখানে যে অন্য ধর্মের মানুষ বলতে যে মুসলমানদের কথা বলা হয়েছিল, সে বলাই বাহুল্য। ইহুদিদের দু’দলের কেউই মানুষ বলে গণ্য করত না। তা চুক্তি থাকে চুক্তির জায়গায়, শাসন হয় শাসকের মনমর্জিতে। কয়েক বছরের মধ্যেই চুক্তির শর্ত ধুলোয় মিশিয়ে শুরু হয়ে গেল নাগরিকদের বিচার। ক্যাথোলিক মোনার্করা আদেশ দিলেন, স্পেনে থাকতে গেলে মুসলমানদের ধর্ম পরিবর্তন করে ক্রিশ্চান হতে হবে। তা যদি না হতে চাও দেশ থেকে বেরিয়ে যাও। শুধু স্পেনের সীমানার ভিতরেই নয়, দেশের বাইরে অবস্থিত অন্য স্প্যানিশ কলোনিগুলোতেও এই আদেশ পৌঁছে দেওয়া হল। দলে দলে লোকে দেশ ছাড়তে লাগল। অনেকে প্রাণ বাঁচানোর খাতিরে ধর্ম পরিবর্তন করে ক্রিশ্চান হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে ধর্মাচার চালাতে লাগল। এত দিনের সংস্কার ভুলে যাওয়া সহজ নয়। এই আশঙ্কা ক্যাথলিক পাদ্রীরা আগেই করেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনার সাহায্য নিয়ে নির্বিচারে নিরীহ মানুষের ওপর শুরু হল অত্যাচার। হাজার হাজার লোককে ধরে নিয়ে নিপীড়ন করতে শুরু করল  রাজামশাইয়ের সৈন্যসামন্তরা। 

ইহুদিরা, মুসলমান আর ক্রিশ্চান দুই দলেই ছিল না। প্রাচীন কাল থেকেই তারা পড়ালেখা জানত, ঘরদোর পরিষ্কার রাখত। চোখ বুজে ধর্মকে অনুসরণ করাতে তাদের মতি ছিল না। সংক্ষেপে, যুক্তি আর ‘কমন সেন্স’ ব্যাপারটাকে তারা একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিল। আর যুক্তিবাদীরা যে প্রথমেই সকলের চক্ষুশূল হবে, সে কথা আর নতুন কী? সেবারও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। ক্রিশ্চান অথবা মুসলমান, দুই দলের কাছেই তারা ছিল ব্রাত্য। ইনকুইজিশন শুরু হওয়ার ফলে ইহুদিরা পড়ল মহা ফাঁপরে। দেশে থাকলে উৎপীড়নকারীরা খুন করছে, দেশ ছেড়ে পালাতে গেলেও নিস্তার নেই। সৈনিকরা ওঁত পেতে আছে, রাজ্যের সীমানা থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলেই ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে ইহুদীদের কচুকাটা করছে তারা। যারা সত্যি সত্যিই অবশেষে ধর্ম পরিবর্তন করে ক্রিশ্চান হয়ে গিয়েছিল, শেষমেশ তাদের কথাও কেউই বিশ্বাস করেনি। অকথ্য অত্যাচার করে হাজার হাজার ইহুদিদের মৃত্যর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। 

“তারপর?” সঙ্গিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিগ্গেস করলাম আমি। স্প্যানিশ ভাষা নিয়ে পড়তেই প্রধানত দিদিমণির স্পেনে আবির্ভাব, এই ফাঁকে দেশের ইতিহাস ঝালিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি যে একেবারে অজ্ঞ তা নয়, কিন্তু এখন শুনে-শুনে ঘটনাগুলো জেনে নিতে খারাপ লাগছে না। 
“তারপর আর কি? কয়ামত! বা বলতে পারিস সাড়ে সর্বনাশ। কোই নেহি বচা।”

“কিঁউ? ত্রিবেদী তো বচ গয়া হোগা!” আমি চোখ মটকালাম। প্রসঙ্গত বলা ভালো দিন কয়েক আগেই নেটফ্লিক্সে ‘স্যাকরেড গেমস’ সিরিজটি রিলিজ করেছে আর আমরা দুজনেই বেড়ানোর ফাঁকে সেটায় মজে আছি। যারা ত্রিবেদীকে চিনতে পারেননি, তাদের সময় করে সিরিজটি দেখে ফেলতে হবে।

দিদিমণি আমার বোকা বোকা বাতেলায় কান না দিয়ে বললেন, “একদিকে যখন স্পেনের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায় লেখা হচ্ছে, সেই একই সময়ে স্পেনের শিল্প জগতের সবচেয়ে সোনালি সময় শুরু হচ্ছে— বুঝলি। স্প্যানিশ রেনেসাঁর ফলে শিল্প, চিত্রকলা, সাহিত্যে নতুন নতুন কাজ শুরু হয়েছে পুরোদমে। অনেক জায়গায় নতুন করে সাজানো হচ্ছে শহর, গির্জা আর রাজমহলের কাজ চলছে পুরোদমে।”

“বটে?” আমি মাথা চুলকে বললাম, “তা এই প্লাজা-ফ্লাজা বানালো কে রে ভাই?”

“ওসব তোকে অ্যালেক্স বলে দেবে। মন দিয়ে শুনে নে।” 

অ্যালেক্স কে, সেটা জানার আগে বরং তার বলা গল্পটা শেষ হয়ে যাক।

১৫৭৭ সালে রাজা ফিলিপ তৃতীয় ডেকে পাঠালেন স্থাপত্যশিল্পী হুয়ান দে হেরেরাকে। হেরেরা তখন নানান কাজে ব্যস্ত। কিন্তু রাজার আহ্বানে তাঁকে রাজদরবারে গিয়ে হাজিরা দিতেই হল। রাজা ফিলিপের ফরমাইশ করলেন, মাদ্রিদের মাঝখানে অবস্থিত প্লাজা ডেল আরাবেলকে ফের নতুন করে সাজানো হোক। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি তলব করেছেন হেরেরাকে। হেরেরা কিছুক্ষণ রাজমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলেই বুঝলেন, পরিকল্পটা খুব ছোটোখাটো নয়। প্রয়োজনে বিপুল পরিমাণ অর্থ মঞ্জুর করতেও রাজামশাই রাজি। হেরেরা আন্দাজ করতে পারলেন, এই কাজই ভবিষ্যতে মাদ্রিদ শহরকে পরিচিতি দেবে। হয়তো এই কাজের জন্যেই তাঁর নামটাও মনে রেখে দেবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। রাজামশাইকে সম্মতি দিতে বেশিক্ষণ সময় নিলেন না তিনি।
 
নকশা বানানো শুরু করলেন হেরেরা, একসময় সে নকশা শেষও হল। মাঝে অবশ্য অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু অর্থাভাব আর নানা বাধাবিঘ্ন পড়ার ফলে ১৬১৭ সাল অব্দি কাজ শুরুই হল না। ১৬১৭ সালে অবশেষে যখন আবার কাজ শুরু হল প্লাজার, হেরেরা পটল তুলেছেন। রাজা ফিলিপ তৃতীয়ও মঞ্চের বাইরে। নতুন শিল্পী হুয়ান গোমেজ দে মোরা নতুন উদ্যমে পরিকল্পনা শুরু করলেন, কিন্তু তিনি জানতেন না এই প্লাজার সঙ্গে দুর্ভাগ্য জড়িয়ে পড়েছে। ১৭৯০ সালের আগুনে অসম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্লাজা দে আরাবেল। এতদিন ধরে চলা নির্মাণকার্য প্রায় পুরোটাই মায়ের ভোগে চলে গেছে। হুয়ান দে ভিলানুয়েভা আবার প্রথম থেকে শুরু করেন পুনর্নিমাণের কাজ। প্লাজার চারিদিকে বাড়িগুলোর উচ্চতা কমিয়ে আনেন। যুক্ত করেন নতুন ব্যালকনি। ২৩৭টি ব্যালকনি যুক্ত সেই প্লাজাই আজ প্লাজা মেওর নামে বিখ্যাত সারা পৃথিবীতে। মোট তিন বার অগ্নিকাণ্ড  ঘটলেও দমে যায়নি স্থাপত্য শিল্পীরা। আজ এই প্লাজা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। 

অ্যালেক্স-এর গল্প শেষ। আমাদের হাতে ধরা কফির কাপও শুন্য। প্লাজা মেওরের দুর্দান্ত চত্বর আমাদের চোখের সামনে। ওয়াকিং ট্যুরের অন্য ছেলেমেয়েরা অ্যালেক্সকে ছেঁকে ধরেছে নানা প্রশ্নে, তাতে তার চওড়া হাসি একটুও ক্ষীণ হয়নি। আমাদের ‘ফ্রি মাদ্রিদ ওয়াকিং ট্যুর’ এর গাইড এই হাসিখুশি ছেলেটির নামই হল অ্যালেক্স।

(ক্রমশ)

পরের পর্ব এখানে পড়ুন

বই কিনতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন



রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

দ্য ম্যাজিক অফ মাদ্রিদ (তৃতীয় পর্ব)



Bernabeu Stadium: Fast-track Santiago Bernabéu - Visit to the Real ...
Real Madrid Stadium

১) ফুটবল নিয়ে ইউরোপের সব দেশেই মাতামাতি। লা লিগা থেকে ইউরো কাপ... সবেতেই দেশের মানুষ ফুটবলের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। মাদ্রিদের রয়্যাল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের বিশ্বজোড়া খ্যাতি, এখানে ছোটবেলায় প্রায় প্রত্যেকেই সেখানে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমরা যখন মাদ্রিদে, ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে পুরোদমে। বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই মজে আছে বিশ্বকাপে। আমাদের দেশে ছোটবেলায় ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেতে দেখেছি, এখানে সেই দৃশ্যটা একেবারেই আলাদা। টিভির পর্দা নয়, বেশিরভাগ লোকে খেলা দেখতে ভিড় করে প্লাজাগুলোতে। সেখানে ঢাউস ঢাউস স্ক্রিন টাঙিয়ে খেলা চলছে। যাকে বলে কমিউনিটি ভিউইং। প্রতিটা পাব ভর্তি, ওপেন এয়ার স্ক্রিনের সামনে হাজার হাজার মানুষ। পানাহারও চলছে সঙ্গে। সে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। বল পায়ে আসতে না আসতেই উদঘোষ শুরু হয়, হিল্লোল ওঠে ঢেউয়ের মতোই। খেলা জিতে গেলে মানুষজন নাচানাচি শুরু করে দেয়, হুল্লোড় চলে রাতভর। সে সময় পাবে অথবা রেস্তোঁরায় গেলে হয়তো বিনা পয়সায় খাদ্য বা পানীয়ও জুটে যেতে পারে। 

মোট কথা ২০১৮ সালে স্পেন যদি বিশ্বকাপ জিতে যেত, আমাদের স্পেনের দিনগুলো হয়তো আরো অনেক বেশি রঙিন হতে পারত। কিন্তু সে হওয়ার ছিল না। রাশিয়ার সঙ্গে ম্যাচে পেনাল্টিতে হেরে স্পেন বিশ্বকাপ থেকেই বেরিয়ে গেল। রেস্তোরাঁতে বসে বিশাল বার্গারে কামড় দিতে দিতে খেলা দেখছিলাম আমরাও, খেলা শেষে উদাস মনে চললাম টেম্পলো দে দেবোদের উদ্দেশ্যে। মেজাজ বিগড়ে গেছে। সকলেই বিমর্ষ মুখে পথ হাঁটছে। সঙ্গিনীর অবশ্য হেলদোল নেই। সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, পরপর ছবি তুলছেন আর সুযোগ পেলেই স্প্যানিশে বকর-বকর করতে শুরু করে দিচ্ছেন। কী জ্বালা রে বাবা!  

টেম্পলো দে দেবোদে পৌঁছে মাথাটা খানিক ঠান্ডা হল। ইজিপ্সিয় এই মন্দির নির্মাণ করে ইজিপ্টের সরকার উপহার দিয়েছিলেন স্পেন সরকারকে। মন্দিরটি সাদামাঠা কিন্তু পিছনের সুন্দর বাগানের ওপর থেকে পার্ক কাসা দে কামপোর অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এই পার্ক নাকি নিউয়র্কের বিখ্যাত সেন্ট্রাল পার্কের পাঁচগুণ। টেম্পলো দে দেবোদ থেকে সেই বিস্তার দেখে মনে হয় আধুনিক মাদ্রিদের মধ্যে জাদুবলে এই বিস্তীর্ণ অরণ্য উপত্যকা এসে উপস্থিত হয়েছে। 

বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল ঢেউ খেলানো ঘাসের বিছানার ওপর শুয়ে বসে। ভয়ঙ্কর রোদের তেজ, গাছপালার মধ্যে বেশ আরামই লাগছিলো। ম্যাচ দেখে এসে অনেকেই শুয়ে বসে আছে। একজন বৃদ্ধ আপন মনে গিটার বাজিয়ে চলেছেন। সামনের টুপিতে হয়তো কেউ কেউ খুচরো টাকা দিয়ে যাচ্ছে। ঘড়িতে দেখি সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। সূর্য এখনও মধ্যগমনে বিরাজমান, খাঁ-খাঁ করছে রোদ্দুর। আমাদের দেশে বারোমাস সকালের পর বিকেল, বিকেলের পর সন্ধ্যে, সন্ধ্যের পর রাত্তির দেখে এসেছি। মাদ্রিদের গ্রীষ্মে সেইসবের বালাই নেই। রাত পৌনে এগারোটার সময় যখন সূর্য অস্ত হল, তার আগে সন্ধ্যের কোনও চিহ্ন দেখলাম না। দিনের পর কোনও কমা দাঁড়ি সেমিকোলন ছাড়াই ঝুপ করে অন্ধকার। ভড়কে গিয়েছিলাম বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।  

দিন কয়েক পর অবশ্য ব্যাপারটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মুশকিল হয়েছিল রাতের খাওয়া নিয়ে। অন্ধকার না হলে মস্তিষ্ক কিছুতেই ডিনার করতে রাজি হচ্ছে না। অতএব খাওয়াদাওয়া হতে রাত সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা। ভাগ্যিস মাদ্রিদ ছাড়া অন্য জায়গায় এরকম হয়নি। দেরি করে সূর্য অস্ত গেলেও সন্ধ্যের কোমলতার একটা প্রচ্ছন্ন আভাস পেয়েছি অন্য সব জায়গাতেই। 

ঘড়ির কাঁটার হিসেবে দেখতে গেলে অবশ্য বিকেলের পর থেকেই জনস্রোত উপচে পড়ছে রাস্তায়। হস্টেলে ফেরার পথে দেখি সিটি সেন্টারের কাছের ফাঁকা রাস্তাগুলো ভোজবাজির মতো আলোকিত রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়েছে। কোথাও স্প্যানিশ পায়েলা পরিবেশন হচ্ছে, কোথাও কলকল করতে করতে ছেলেমেয়েরা চলেছে 'তাপাস বার ক্রল'-এ। আমাদের হস্টেলের সামনে স্যান মিগেল মার্কেটের ভিতরে উপচে পড়া লোক। ওয়াইন,  বিয়ার, শ্যাম্পেন, হুইস্কির পাশাপাশি চলছে স্পেনের ফল দিয়ে তৈয়ার ড্রিংক 'সাঙরিয়া'। কোথাও সি ফুডের রমরমা, কোথাও আবার চুরোসের সঙ্গে চকোলেট আইসক্রিমের সৌরভ মাতোয়ারা করে তুলেছে বাতাস। অন্ধকার হওয়ার পর নানারঙের আলোর রোশনাইতে পথে নেমেছে জনস্রোত। হাসির কলরব শুনতে পাওয়া যাচ্ছে বারবার। খাওয়াদাওয়া সেরে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই গলিতে গলিতে। একটা রেস্তোরাঁ খালি নেই, প্রতিটা দোকানেই ভর্তি লোক। আমরা একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে এই গলি সেই গলি করে হেঁটে চলেছি, প্রতিটা মোড়ে মুরিশ কোয়ার্টারের আনকোরা সাজ চমকে দিচ্ছে বারবার। রাস্তায় রাস্তায় ‘লাইভ মিউজিক’-এর অনুষ্ঠান। গিটার থেকে বেহালা কিছুই বাদ নেই। রাত বারোটা বা একটা তো কিছুই নয়। এক ফোঁটা অ্যাল্কোহল মুখে না ঠেকিয়েও পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। স্প্যানিশ সামার্স আমাদের রেহাই দেয়নি।   

Related image
Templo de Debod
Puerta del Sol Protest
Buskers music
Plaza Mayor at 10:30 PM
Crowd in Evening

২)১৫৫৫ সালের আলাকালা শহর। শহরের এক প্রান্তে এক বয়স্ক মানুষ কয়েকজন বালককে গল্প বলছেন। স্পেনের সেনাবাহিনীর গল্প। ষোড়শ শতাব্দী স্পেনের মানুষের জন্যে গৌরবময়। ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছে, মুরদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুদূর আফ্রিকায়। পৃথক রাজ্যগুলো মিলিত হয়ে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের পত্তন করেছে। গোটা ইউরোপে এমন কেউ নেই যারা এই সেনাবাহিনীকে ভয় পায় না। স্পেনের নাইটদের নিয়ে কত কত বীরগাথা, কত শৌর্যকাহিনি। সেই কাহিনিই শুনছে আলাকালার শিশুর দল। তাদের মধ্যে একজন গল্প শুনতে শুনতে তন্ময় হয় গেছে। সাত বা আট বছর বয়স তার। তার কল্পনাপ্রবণ চোখে স্বপ্ন! ভবিষ্যতে সেও একদিন নাইট হয়ে বীরত্বের প্রদর্শন করবে। 

ছেলেটির নাম মিগেল। বয়স কম হলে কী হবে, তার কল্পনার ঘোড়া আকাশ স্পর্শ করে। বাড়িতে থাকলে সে ছটফট করে দেশে দেশে ঘোরার নেশায়। কবে এই চার দেওয়াল থেকে মুক্তি পাবে সে? কিন্তু সুযোগ এল তাড়াতাড়িই। একদিন মিগেলের বাবা বের হলেন ভাগ্যন্বেষণে, সঙ্গে নিলেন ছেলেকেও। একের পর এক শহর, পাহাড়, নদী, গ্রাম, নতুন মানুষজন। স্পেনের বাস্তব চেহারা ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগল বালক মিগেলের কাছে। 

সময় থেমে থাকে না। বয়স বাড়তে লাগল মিগেলেরও। একসময় যখন তাদের পরিবার থিতু হল মাদ্রিদে, মিগেলের বয়স উনিশ। এই কয় বছরে সে বিভিন্ন শহরে থেকেছে, নানান জায়গায় বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছে। সে কবিতা লিখতে ভালোবাসে, নতুন শহরে এসে সেই নেশা আরো বেড়ে উঠল। মাদ্রিদে তার কবিতার সুনামও হল। যুবরাজ ডন কার্লোর মৃত্যুর পর তখন দেশে শোকের ছায়া। কাজকর্ম পাওয়া যাচ্ছে না, ক্রমে বাড়ির আর্থিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। ভেবেচিন্তে মিগেল ঠিক করল সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। পোপের দূত জুলিয়ার সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলল সে ইতালিতে, তারপর সময়ের নিয়মে অনেক ঘাটের জল খেয়ে একসময় ইতালিতে স্পেনের সেনাপতি ডন হুয়ানের সঙ্গে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেনাদলে নাম লেখাল। লেপান্তরের যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের প্রমাণও দিল সে। 

তার সৈনিক জীবন চলেছে বেশ কয়েক বছর। একটা সময়ের পর মিগেল ভাবল এবার দেশে ফিরে যাওয়া যাক, অনেক হয়েছে। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না তার। দেশে ফেরার সময় তুর্কিদের হাতে বন্দি হল মিগেল। এরপর দীর্ঘ দশ বছর অসহ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাকে। বার বার চেষ্টা করেও পালানোর পথ পায়নি। অবশেষে ছাড়া পেয়ে যখন মাদ্রিদে এল মিগেল, তার আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এরই মধ্যে সে লেখালিখির চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু বেশিদিনের জন্যে নয়। মাদ্রিদে অর্থাভাব কিছুতেই যাচ্ছে না। তার বিয়েও টেকেনি, পূর্ব সৈনিক হিসেবে যেই পদের আশা করেছিল রাজসভায় সেই আশাও গেছে ভেঙে। ওদিকে তার ছাপা গ্রন্থ 'গ্যালেটিয়া'-ও কেউ কিনছে না। 

শেষমেশ সে মাদ্রিদের বাইরে নৌবাহিনীর খাদ্য বিভাগে ছোট একটা কাজ পেল। প্রচন্ড খাটুনি, টাকা এত কম যে খাওয়াও চলে না। তাও কোনোরকমে চালাচ্ছিল মিগেল। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি এখানেও। খাদ্য বিভাগে কী একটা গন্ডগোলের জন্যে তাকে অন্যায়ভাবে জেলে পাঠালেন কর্তারা। বাঁচার সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়ে মিগেল সে সময়ে জেলে বসে উপন্যাস লিখতে শুরু করল। লিখছে তো লিখছেই। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার যখন সে পুরোনো চাকরিতে বহাল হল, সেই উপন্যাস তখনও লেখা চলছে। ১৬০৩ সালে তাঁর সুবিশাল উপন্যাস 'অ্যাডভেঞ্চার্স অফ ইনজিনিয়াস নাইট ডন কিহোতে দ্য লা মাঞ্চা' প্রকাশিত হয়। খানিক টাকা পেয়েই মিগেল খুশি। কিন্তু অর্থাভাব গেল না। শেষ জীবনে ভীষণ অর্থাভাব নিয়েও লেখালিখি চালিয়ে গিয়েছেন মিগেল সের্ভান্তেস।  

আজ চারশ বছর পর মিগেল সের্ভান্তেসের লেখা 'ডন কিহোতে'-কে নিয়ে সারা পৃথিবীতে গবেষণা হচ্ছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রচনা বলে সম্মান দেওয়া হয়েছে এই উপন্যাসকে। স্পেনের বিখ্যাত 'ইনস্টিটিউটো সের্ভান্তেস'-এর বিশ্বজোড়া নাম। আমরা এখন সেখানেই দাঁড়িয়ে সের্ভান্তেষের কথা ভেবে যাচ্ছি। 'ইনস্টিটিউটো সের্ভান্তেস' হিস্প্যানিক সাহিত্যের পীঠস্থান, ভাষাচর্চা ছাড়াও নানা ধরনের ওয়ার্কশপ, কোর্স চলে সারাবছর। আমার সঙ্গিনীর কাজের জায়গাও এখানেই, অতঃপর কিছুটা খবর তো রাখতেই হয়।

ম্যান্ডারিনের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখলাম আমরা। সের্ভান্তেসের পরবর্তীকালে স্পেনে অসংখ্য নামকরা সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছে। ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা, রাফায়েল আলবের্তি, গুস্তাভো বেকের, ভেগা, রোসালিয়া দে কাস্ত্র ইত্যাদি... সে সূচি শেষ হওয়ার নয়। সমসাময়িক কবি, লেখকদের পরিচিতিও কম নয়। কয়েক বছর আগেই মাদ্রিদকে 'ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল'-এর সম্মান দেওয়া হয়েছে। 

গত কয়েকদিনে এখানকার ব্যাপার স্যাপার ভালোই বুঝে গেছি আমরা। সিবেলেস স্কোয়ার থেকে শহরতলির টাউনশিপ, গ্র্যান ভিয়া থেকে মানাজানারেস নদী পর্যন্ত, এই রাস্তা সেই রাস্তা সব চষে ফেলেছি। এ হল পরিকল্পনাহীন ভ্রমণ। এই ধরুন, বাসে বসে দু’দিকে দেখতে দেখতে যাচ্ছি এমন সময় হয়তো হঠাৎ কোনও অপূর্ব নাম না জানা স্থাপত্য বা ছিমছাম কোনও পাড়া চোখে পড়ল। ব্যস! টুক করে পরের স্টপে নেমে জায়গাটা এক্সপ্লোর করা শুরু হল। কাফের লোকের সঙ্গে গল্প জুড়লাম, রকের আড্ডাবাজ বা ফুটবল ক্লাবের ট্রেনিদের সঙ্গে আলাপ জমালাম। একসময় আবার উঠে পড়লাম অন্য বাসে। মেট্রো আর বাসের নেটওয়ার্ক বেশ ভালো, অডিও ভিজ্যুয়াল ব্যবস্থা আছে। প্রতিটা স্টপের নাম আগেই দেখানো হয়। রাস্তা হারানোর কোনও ভয় নেই, এমনকি সুযোগও নেই। তাই মাঝে মাঝে গুগল ম্যাপ বন্ধ করে উল্টোপাল্টা রাস্তাতে চলে যাই ইচ্ছে করেই। তখন বেশ একটা ‘হারিয়ে গেছি, হারিয়ে গেছি’ ভাব হয়। 

পুয়ের্তা দেল সোল শহরের কেন্দ্রে প্রকাণ্ড প্লাজা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের পর প্রায় প্রতিদিনই মিউজিক কনসার্ট হয়। কিন্তু বড় কনসার্টের চেয়েও প্লাজা ও রাস্তার ধারে বসা স্ট্রিট মিউজিশিয়ান বা বাস্কার্সদের বাজনা শুনে চমকিত হতে হয়। এর মধ্যে একদিন হাঁটতে হাঁটতে রেটিরো পার্কে গিয়ে পড়েছি। হ্রদের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পালাসিও দ্য ভ্যালেনকুয়েজ মিউজিয়ামের মডার্ন আর্ট সংগ্রহ দেখে ক্রিস্টাল প্যালেসের দিকে এগোচ্ছি বনবীথিকার পথ দিয়ে, এমন সময় নাম না জানা একটি বাদ্যযন্ত্রের সুর কানে এসে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটি যুবক অবিকল উড়ন্তচাকির মত দেখতে একটা যন্ত্র বাজিয়ে চলেছে তবলার মত। অপূর্ব সেই সুর। ক্রিস্টাল প্যালেস দেখে এসেও সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকেই বিভোর হয়ে সেই সুরের ঝংকার উপভোগ করছে। এক ইউরো তার বক্সে ঢেলে গুগল বাবার শরণাপন্ন হলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই জানা গেল বাদ্যযন্ত্রের নাম ‘হ্যাঙ’ বা ‘হ্যাঙড্রাম’। মাত্র বছর দশেক আগে সুইডেন আর সুইজারল্যান্ডে এই যন্ত্রের উদ্ভব, তারপর কয়েক বছরের মধ্যেই ছড়িয়ে গেছে সারা ইউরোপে। পড়ে ভারী অদ্ভুত ভাব এল মনে। কী আশ্চর্য! এখনও নতুন বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে, লোকে শিখছে, বাস্কার সমাজের স্বীকৃতিও আদায় করে নিচ্ছে! নতুন নোটেশন, নতুন সুর, নতুন নেশা... নতুন বাদ্যযন্ত্রকে কেন্দ্র করেই হয়তো কত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, হ্যাংয়ের সুরের প্রেক্ষাপটে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, বদলে গিয়েছে কত মানুষের জীবন! কত গল্প ছড়িয়ে থাকে এক একটা বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে! আমরা আর কোনটুকু খবর রাখি? তখনও সেই মন কেড়ে নেওয়া সুর আমাদের কানে এসে লাগছে। 

Related image
Instituto Servantes
Image result for don quixote best book

Image result for puerta del sol summers
Puerta del Sol
Related image
Crystal Palace
Hang drum halo en Madrid - Instrumentos Musicales | 247862
Hang Drum

৩)আমাদের  ব্যাকপ্যাকিং-এর খানিকটা সময় নির্বিঘ্নে কেটেছে। বহু দেশের বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, আড্ডাও মেরেছি দেদার। আমাদের দেশের বাইরে ভ্রমণকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় জীবনে, অনেকে জীবনের এক তৃতীয়াংশ পথেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু ভ্রমণ মানে শুধু শখের টুরিস্ট নয়। এখানে ব্যাকপ্যাকিং সংস্কৃতির উল্লেখ করা প্রয়োজন। ব্যাকপ্যাকাররা সাধারণ টুরিস্ট নয়, শুধুমাত্র সাইটসিইং করতেই তারা পথে বেরোয়নি। ব্যাকপ্যাকার কথার শাব্দিক অর্থ এখনও বাংলায় হয়তো লেখা হয়নি। ভারতের শ্রেষ্ঠ ভবঘুরে রাহুল সাংকৃত্যয়নের লেখা বই ‘অথাতো ঘুমাক্কড় জিজ্ঞাসা’ পড়লে ঘুমাক্কাড়দের সঙ্গে ব্যাকপ্যাকারদের মিল ও অমিল সম্পর্কে খানিকটা জানা যেতে পারে। 

ব্যাকপ্যাকিং-এর উদ্ভব ষাটের দশকে হলেও এর পত্তন বিখ্যাত ইতালিয়ান অভিযাত্রী জিওভানি ফ্রান্সেস্কো কেরেরির হাত ধরে। বস্তুতপক্ষে ব্যাকপ্যাকিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্য বিনোদন নয়, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এবং শিক্ষা। একসময়ের বিখ্যাত অভিযাত্রীদের যে ভ্রমণ কাহিনীগুলো পড়ে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছি তারা পেশাগত ভাবেই সকলেই বিশেষ কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শুধু দেশ দেখতে তারা পথে নামেননি, সঙ্গে বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য ছিল। হয়তো নতুন কোনও দেশের সন্ধান, বা ধর্মপ্রচার, নয়তো ব্যবসাপত্তর... কিন্তু লাভ লোকসানের প্রশ্নটা সর্বদাই জড়িয়ে থাকত যাত্রায়। কিন্তু ব্যাকপ্যাকিং লাভ লোকসানের চিরাচরিত কনসেপ্টের উর্ধ্বে।

ব্যাকপ্যাকিং সংস্কৃতি ধর্ম, দেশ, জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ ও তার সংস্কৃতিকে সম্মান জানায়। পথে অন্য দেশের, অন্য পরিবেশের লোকের সঙ্গে যখন কথোপকথন হয়, বন্ধুত্ব হয়, বোঝা যায় হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা মানুষেরা আসলে অনেকেরই আমাদের মতন। দেশ, ধর্ম, কাল, শিক্ষা, পরিবেশ ভিন্ন হলেও আমরা আসলে একই বন্ধনে জড়িয়ে আছি। এই সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি আর পরস্পরকে নির্বিশেষে বন্ধু ভেবে পথে এগিয়ে চলাই ব্যাকপ্যাকারদের লক্ষ্য। আইনকে গুরুত্ব দিলেও মনের দিক থেকে আমরা একই পৃথিবীর বাসিন্দা। সীমানা বলতে আমরা মনের সীমানাই বুঝি, কাঁটাতারের বেড়া নয়। আজকে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে, তরুণ যুবক বৃদ্ধ পিঠে রুকস্যাক নিয়ে পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে। যত কম খরচে যত বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়, এই তাদের উদ্দেশ্য। নিজের অজান্তেই চিরাচরিত ভাবনাচিন্তাকে ভেঙে তারা পৃথিবীর লোকজনকে কাছাকাছি এনে দিচ্ছে। 

গত কয়েক দশকে ব্যাকপ্যাকিংয়ে আগ্রহী মানুষজনদের একটা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ভাবে এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়। ইন্টারনেট, ক্যামেরা, স্মার্টফোন নিয়ে আজকাল নতুন যুগে 'ফ্ল্যাশপ্যাকিং' কথাটা চলনে এসে গেছে। কাউচসার্ফিং হল এরকমই একটা প্রোগ্রাম। ইন্টারনেটে কাউচসার্ফিংয়ের মাধ্যমে কোনও ব্যাকপ্যাকার পৃথিবীর যে কোনো শহরের উৎসাহী স্থানীয় লোককে অনুরোধ করতে পারে তাকে থাকতে দেওয়ার জন্যে। এইজন্যে কোনো পয়সাকড়ি দিতে হয় না। নতুন লোকেদের সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখা,  বোঝা ও নতুন বন্ধু পাতানোর জন্যেই এই অভিনব ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। কাউচসার্ফিং হোস্টরা ব্যাকপ্যাকারদের আশ্রয় দেওয়া ছাড়াও নানা ‘মিট আপ’ করতে পারে তাদের শহরে, সেখানে গিয়ে নানান দেশের নানান লোকের সঙ্গে দেখা হয়, গল্প হয়, অনেকেই বন্ধু হয়ে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখে পরবর্তী কালে। 

এহেন সেদিন আমার কাউচসার্ফিং অ্যাকাউন্ট খুলে দেখি ফ্রান্সিসকো রদ্রিগেজ বলে একজন আমায় সেরকম একটা কাউচসার্ফিং মিটআপে আসতে অনুরোধ করেছে। নির্দিষ্ট সময় গুগল ম্যাপ ধরে জায়গাটায় পৌঁছালাম। জাহারা দে অসবর্ন বলে একটা ব্যস্ত পাব। প্রচুর ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ফ্রান্সিসকো কিন্তু আমাকে দেখেই চিনেছে। ডেকে আমাদের আলাপ করিয়ে দিল অন্য কয়েকজন ব্যাকপ্যাকারের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ জমাটি আড্ডা শুরু হয়ে গেল। কয়েকজন জার্মানি থেকে এসেছে স্প্যানিশ ভাষাটা ঝালিয়ে নিতে, কয়েকজন মাদ্রিদেই ভলান্টিয়ার করছে। কিউবার একটি ছেলে বেশ কয়েক বছর ধরে স্পেনে কাজ করছিলো, তার সঙ্গে প্রচুর কথা হল। এর মধ্যে চায়না থেকে কিম, হংকং থেকে কেজ আর এস্টোনিয়া থেকে ডেভিড এসে যোগ দিয়েছে। এক গ্লাস সাঙরিয়া নিয়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প চলতে লাগল। কিছুক্ষণ আগেই কেউ কাউকে চিনত না, এখন সেখানে কথার বন্যা বইছে। ভাষার ব্যবধান মিটিয়ে চাহনি বিনিময়, তারপর সম্যক ভাবের আদানপ্রদান। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধুত্বের পেয়ালা ছলকে পড়ে। গল্প বয়ে যায় শহরের মতোই। পরস্পরের গল্প শুনতে শুনতে আবিষ্কারের আনন্দ ঝিলিক দেয় চোখে। রেশমি সবুজ পানীয় আর অ্যাম্বর লিফ তামাকের নরম ধোঁয়ায় আবিষ্ট হয়ে বসে থাকে পথের যাত্রীরা। আন্তরিক হাসির ফোয়ারায় ভর দেওয়া হাইফাইভ, বাম্প ফিস্টের পিঠে সওয়ার নির্ভেজাল আড্ডা। ছুটির আমেজে নাম পতাকার পার্থক্য অবান্তর হয়ে ওঠে। শুধু গল্প বয়ে যায়। গল্প ফিরে আসে। গল্পের পিঠে গল্প। স্মার্টফোনে সঞ্চয় করা নতুন বন্ধুত্বের চিহ্ন নিয়ে যখন ফিরছি, মাদ্রিদের আলোকোৎসব তখনও পুরোদমে চলছে।   

Image result for zahara de osborne party
Couchsurfing meet


ব্যাকপ্যাকিং নিয়ে লেখা এই বইটা কিনতে ক্লিক করুন 
https://joydhakbooks.in/product/anhc/

মাদ্রিদ প্রথম পর্ব থেকে
মাদ্রিদ প্রথম পর্ব

যাত্রার পরের অংশ
তোলেদো - প্রথম পর্ব


দ্য ম্যাজিক অফ মাদ্রিদ (দ্বিতীয় পর্ব)

Diego Velázquez's Equestrian Portrait of the Count-Duke of Olivares

ঝকঝকে সকাল। এখনও রোদের তেজ বাড়েনি, মিঠে বাতাস বইছে। ট্যুরের আগে আমরা হস্টেল থেকে বেরিয়ে হাঁটাহাটি করছিলাম এদিক সেদিক। স্পেনে টমেটোর কাঁচা পিউরি দিয়ে টোস্ট চিবোনোর অভ্যেস আছে লোকজনের, সেই স্থানীয় জলখাবার খেতে গেলে ওয়াক উঠতে বাধ্য। সব জায়গায় এক্সপেরিমেন্ট সইবে না, প্রথম দিনেই এই জরুরি শিক্ষা হল। চুপচাপ কফি দিয়ে পাউরুটি শেষ করে হাঁটা দিলাম। ইউরোপের বেশিরভাগ শহরেই ‘টিপ বেসড ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর’-এর ব্যবস্থা আছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হল নিউ ইউরোপ স্যান্ডম্যান ট্যুর। আগে থেকেই নেটে বুক করে রেখেছিলাম। পায়ে পায়ে হাজির হয়ে দাঁড়িয়েছি প্লাজা মেওর চত্বরে। ফুটফুটে রোদে নানা দেশের লোকের আনাগোনা, দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। আমাদের সদাহাস্যমান গাইড অ্যালেক্স এসে হাজির হয়েছে আগেই। আয়ারল্যান্ডের ছেলে, বছর দুয়েক মাদ্রিদে এসে রয়েছে। ইউরোপে অনেকেই, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রী আর চাকুরিজীবীরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করতে পারে। অনেকে আবার কলেজের গ্যাপ ইয়ারে ভলান্টিয়ার করতে দূর দেশে পাড়ি দেয় অথবা নতুন অভিজ্ঞতার খোঁজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। স্কুল কলেজের গন্ডির বাইরের এই অভিজ্ঞতা জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সাহায্য করে। অ্যালেক্সও তাদের একজন। ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা আছে মাদ্রিদে। কলেজের ক্লাস আর সকার প্র্যাক্টিসের পাশাপাশি গাইডের কাজ করতে আর নতুন লোকজনের সঙ্গে মিশতে তার ভালো লাগে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ইতিহাসে ডুব দিলাম। নীরস ইতিহাসের ক্লাস নয়, আড্ডার মেজাজে বলা গল্প। সঙ্গে ‘হিউমার’-এর অনবদ্য মিশেল আছে। ওয়াকিং ট্যুরের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরাই প্রখর বুদ্ধিমান, নিজের দেশের মন্দ জিনিস চাপা দেওয়ার কোনও চেষ্টা করতে দেখিনি তাদের। পূর্বপুরুষের ভালো কাজের জন্য যেমন গর্ববোধ করে, অন্যায়ের জন্যে লজ্জা প্রকাশ করতেও দু’বার ভাবে না। কলোনিয়ালিজমের প্রসঙ্গ উঠলে কয়েকজনকে রীতিমত লজ্জিত হতে দেখেছি, অনেকে পূর্বপুরুষের দোষের জন্য সরাসরি ক্ষমা চায়। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, কিন্তু আমার অন্তত এই ব্যবহারটা মেকি বলে মনে হয়নি। 

গল্পের ফাঁকে প্লাজা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি কাটলেরি স্ট্রিটের দিকে। পুরোনো গলির গোলকধাঁধা দিয়ে চলেছি রাস্তার নাম পড়তে পড়তে। কাইয়ে মেওর, কাইয়ে দে আরেনাল, কাইয়ে সান ক্রিস্টোবাল। অনেক বাড়িঘরেই আগেকার মুরিশ স্থাপত্যের ছাপ দৃশ্যমান। ক্রিশ্চানরা ক্ষমতায় আসার পর সেইসব বাড়িঘর বদলে ফেলা হয়েছে বলে মুরিশ বা ‘মুদেহার’ স্থাপত্যের পাশাপাশি বারোক অথবা স্প্যানিশ রেনেসাঁর ছাপও দেখতে পাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এসে পৌঁছালাম সোবরিনো দে বোটিন এর সামনে।
Image result for sobrino de botín madrid
Sobrino de Botin
পৃথিবীর প্রথম রেস্তোঁরা হিসেবে বিখ্যাত সোবরিনো দে বোটিনকে নিয়ে বেশ মজার মজার গল্প আছে। অ্যালেক্সের কাছ থেকে তেমনই একটা গল্প জানতে পারলাম। ফ্রান্স থেকে হিয়ান বোটিন বলে একজন ভদ্রলোক মাদ্রিদে এসে ১৭২৫ সালে এখানে একটা সরাইখানা খুলে বসেন, নাম দেন কাসা বোটিন। কিন্তু তখন এখানে আরো একগাদা সরাইখানা ছিল,  কারণ কাছেই আছে রয়্যাল প্যালেস। ব্যবসার জন্যে নানা জায়গা থেকে নানা লোকে আসছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যে বোটিন ঠিক করলেন সরাইখানায় যাত্রীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও করা হবে। শুরু হল রান্না। রান্না শুরু হতেই টম্যাটো পাউরুটি খাওয়া পাবলিক যেন অমৃতের সন্ধান পেল। কিছুদিনের মধ্যেই কাঠের আগুনে সেঁকা পোর্ক আর মাছের উপাদেয় পদ খেতে লোকজন ফিরে ফিরে আসতে লাগল। বোটিনবাবুর মুখে হাসি আর ধরে না। 

কালের নিয়মে কয়েক বছর পর কাসা বোটিনের মালিকানা উঠে এল বোটিনের ভাইপোর হাতে। ভাইপোকে স্প্যানিশে বলে সোবরিনো। সেই সুবাদে আস্তে আস্তে জায়গার নামই হয়ে গেল সোবরিনো দে বোটিন। ভাইপো চালু মাল, এসেই সে দেখল পয়সা আসছে আসলে রান্নাঘরকে কেন্দ্র করে। আস্তে আস্তে সরাইখানার জায়গা কমিয়ে বসে খাওয়ার জায়গা বাড়াতে শুরু করল সে। বছর কয়েকের মধ্যেই তাদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। আগের শতকে নানা সাহিত্যিকের আড্ডা মারার জায়গা ছিল এই রেস্তোঁরা। এমনকি রয়্যাল একাডেমি অফ আর্টস-এ সুযোগ পাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর ফ্রান্সিসকো দে গোয়া এখানে বেয়ারার কাজ করতেন। শোনা যায় এখানকার বিখ্যাত স্প্যানিশ পায়েলা(স্প্যানিশ পোলাও, সঙ্গে সবজি, মাংস, পেস্তাবাদাম, সি- ফুড যা খুশি দেওয়া যায়) খেয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লেখা ছেড়ে রাঁধুনি হওয়ার কথা ভেবেছিলেন। সে কথা বলেওছিলেন তার বন্ধু এমিলো গঞ্জালেজকে। হেমিংওয়ে রান্নাবান্নার চেষ্টা করেছিলেন কি না ঠিক জানা নেই, কিন্তু পাঠকদের অশেষ সৌভাগ্য যে তিনি শেষমেশ লেখাতেই মনোনিবেশ করেছেন। 

ক্যামেরার সদ্ব্যবহার করার পর গুটিগুটি পায়ে এগোলাম সান ক্রিস্টোবাল স্কোয়ারের দিকে। এখান থেকে খানিকটা এগোলেই ক্যাথেড্রাল দে আলমুদেনা। মাদ্রিদের সবচেয়ে নামকরা গির্জা। তার পাশেই পালাসিও রিয়্যাল অর্থাৎ রয়্যাল প্যালেসের বিশাল চত্বর। ১৫৬১ সালে যখন স্প্যানিশ শাসকেরা দেশের রাজধানী তোলেদো থেকে মাদ্রিদে নিয়ে আসেন তখন কিন্তু এখানে কোনও গির্জাই ছিল না। কিন্তু গির্জা ছাড়া কি রাজধানী শোভা পায়? অতএব নির্মাণ করা হল নিও গথিক স্থাপত্যে মোড়া এই চোখ ধাঁধানো ক্যাথেড্রাল। যদিও কাজ শেষ হতে কয়েক শতাব্দী লেগে গিয়েছিল। আজ অবশ্য গির্জার দিকে তাকালে পর্যটকরা চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। 

Image result for madrid cathedral
Almudena Cathedral
পালাসিও রিয়্যাল আর গির্জার মাঝখানের অনেকটা খোলা চত্বর রেখে দেওয়া হয়েছিল। বিবাহের সময় রাজা অথবা রানী রাজমহল থেকে বেরিয়ে এই চত্বর দিয়ে হেঁটে এসে গির্জায় প্রবেশ করতেন। সদর রাস্তার অপর প্রান্তে থাকা উঁচু পার্ক থেকে শহরের লোকজন দাঁড়িয়ে সেই উৎসব দেখতে ভিড় করত। চত্বরের পিছনে লা কাসা দে কামপো পার্কের বিস্তার। এই প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যান একসময় রাজরানীর নিজস্ব বিচরণভূমি ছিল, আজ এই সুবিশাল এলাকা জুড়ে একটা অরণ্য তৈরি করা হয়েছে শহরের আমজনতার জন্যে। অনেকেই সেখানে গিয়ে খেলাধুলো করে, সাইকেল চালায়। মাদ্রিদ শহরের কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির সন্নিবেশে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসে নির্ভাবনায়। সূর্যাস্তের সময় প্যালেসের পশ্চাতপটে আকাশে রঙের খেলা দেখতে শহরের বাসিন্দারা আজও আগের মতো জটলা করে এখানে। 

Related image
Palacio Real 
Related image
Royal Opera

ইতিহাসের তথ্য। তথ্যে ইতিহাস। এমনিতে তথ্য জিনিসটা অতিশয় বোরিং, সাল তারিখের ঝুটঝামেলা কাটিয়ে ইতিহাসের খেই পেতে পেতে ঘুম পেয়ে যায়। এখানে কিন্তু তেমনটা মনে হয়নি। দিব্যি বৈঠকী গল্পের মেজাজে কথাবার্তা হচ্ছে, হাসি আর কথার মাঝে টুকটাক ইতিহাস গুঁজে দিচ্ছে অ্যালেক্স। যেন গল্পদাদুর ঠেক। ভারী চমৎকার গল্প বলে এই ছেলেটি।   গল্প চলতে চলতেই আমরা এসে দাঁড়িয়েছি রয়্যাল অপেরার সামনে থিয়েটরো রিয়ালের সামনে ওরিয়েন্টে স্কোয়ারে। ইতিমধ্যে এক রাউন্ড ড্রিংক ব্রেক হয়ে গেছে। 

“কী খাবি বল দিকিনি?” বিনীত প্রশ্ন করলাম সঙ্গিনীকে।

“কমলালেবুর রস।” চটজলদি জবাব এল। 

উরিব্বাস! ঠিক তো। দেদার কমলালেবু রাখা আছে। কী বাহার তাদের। লেবু না ট্যাঞ্জরিন জানি না, কিন্তু আগুন রঙের সেই ফল দেখেই জিভে জল চুকচুক করে। স্পেনে যে মারকাটারি কমলালেবু পাওয়া যায়, সেই কথাটা একদম খেয়াল ছিল না। আর সেই লেবুর কী স্বাদ। শুভানাল্লাহ! রস খেয়ে প্রাণটা একদম জুড়িয়ে গেল। খাওয়াদাওয়ার পাট মিটিয়ে আবার হাঁটা। এইবার আমরা উপস্থিত ওরিয়েন্টে স্কোয়ারে। ওরিয়েন্টে স্কোয়ার অজস্র ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো, বাহারি কালো সিংহের মাঝে অবস্থিত প্রস্রবণ প্রতিমা থেকে জল পড়ছে। বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন যে এত সুন্দর একটা জায়গায় এক সময় হাজার হাজার লোককে প্রাণ দিতে হয়েছিল।

১৯৩০ সালের পর থেকেই স্পেন মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দেশের হাল তখন রিপাবলিকদের হাতে। রিপাবলিকরা মূলত রাইট উইং সমর্থক অর্থাৎ দক্ষিণপন্থী। অনেক বিত্তশালী মানুষ, ক্যাথোলিক গির্জার গন্যমাণ্য ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছিলেন এই দলে। কিন্তু অন্যদিকে একটু একটু করে লেফট উইং সমর্থক ন্যাশনালিস্ট পার্টির শক্তি ক্রমেই বাড়ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। জার্মানির নাজিরা নানা ভাবে রিপাবলিকনদের সাহায্য করছে, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মেক্সিকোর গোপন সাহায্য নিয়ে ন্যাশনালিস্ট দলের নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কো নিজেকে দেশের প্রতিনিধি বলে ভাবতে শুরু করেছেন। 

১৯৩৬ সালের একদিন আচমকা ন্যাশনালিস্টদের বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে জলে, স্থলে, আকাশে। সুদূর জার্মানি আর সোভিয়েত দেশ থেকে লড়াকু জাহাজের এসে বোমাবর্ষণ শুরু করে স্পেনে। একদিকে সরকারের লোকেরা ন্যাশনালিস্ট সন্দেহ করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষকে, অন্যদিকে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর দলও তাদের রেহাই দিচ্ছে না, যদি সরকারের চর হয়? মানুষের শক্তি দখলের এই উন্মত্ত লড়াইয়ে অচিরেই লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ হারাতে শুরু করল। খাওয়াদাওয়ার কষ্ট শুরু হল, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রিপাবলিকানরা পালিয়ে আশ্রয় নিলেন ভ্যালেন্সিয়াতে। প্রায় তিন বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের পর জেনারেল ফ্রাঙ্কো নিজেকে দেশের শাসক ঘোষিত করে বসলেন। ন্যাশনালিস্টদের জয় হল। 

কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েই চলে যুগ যুগ ধরে। বামপন্থী পার্টির সমর্থক জেনারেল ফ্রাঙ্কো ক্ষমতাসীন হয়েই ঘোষণা করেন, গৃহযুদ্ধে যারা আগের সরকারের সমর্থক ছিল তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে। শুরু হল লোকেদের ধরপাকড়। রাস্তাঘাট থেকে কারণে অকারণে লোকেদের তুলে নির্যাতন শুরু হয়ে গেল। একের পর এক লোক অদৃশ্য যেতে লাগল স্পেনের শহরগুলো থেকে। ত্রাসের সঞ্চার হল জনসাধারণের মনে। ফ্রাঙ্কোর কড়া আদেশ, তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারবে না। শিল্পী, সাহিত্যিকরা দেশ ছেড়ে পালাতে লাগল। এই বন্ধ আবহাওয়ায় প্রায় চল্লিশ বছর কেটেছে স্পেনের মানুষদের। ১৯৭৮ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর তিন বছর পর রেফারেন্ডাম করে কন্সটিনিউশনাল মোনার্কি অর্থাৎ সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়ে স্পেনে। ধীরে ধীরে আবার গণতন্ত্র মজবুত হতে শুরু করে। আশির দশকের শেষের দিকে স্পেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হয়ে ওঠে। 

অ্যালেক্সের সঙ্গে গল্প চলছিল টুকটাক। কথায় কথায় সে জানাল তাপাসের কথা। স্পেনের বেশ কিছু শহরে 'তাপাস বার' দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাপা আসলে যে কোনও পানীয়ের সঙ্গে পরিবেশন করা শুকনো খাবার। তাপাস বারে যে কেউ একটা পানীয় অর্ডার করে বিনিপয়সায় এক প্লেট স্ন্যাক্স পেয়ে যেতে পারে। বুলফাইটিং আর ফ্লামাঙ্কো নাচকে পাঁচ গোল দিয়ে 'তাপাস বার ক্রল'-এর উন্মাদনা যে তুঙ্গে সেটা আমরা পরবর্তী কয়েক দিনে ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। যাই হোক, একসময় অ্যালেক্সকে বিদায় জানাতেই হল। এরকম কত মানুষের সঙ্গেই আলাপ হয় পথে। কয়েক ঘন্টার আড্ডা, প্রত্যাশাহীন কথোপকথন। হাসিঠাট্টা। সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডল বিনিময়। হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি। পরে কি এদের সঙ্গে কোনোদিন দেখা হবে? না হওয়াই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণের বন্ধুত্ব, কিন্তু এই আন্তরিকতায়  কোনও  ভেজাল নেই। 


Image result for prado museum
Prado Museum

২)১৫৭০ সালের এক দুপুরে ইতালির রোম শহরে বোঁচকা হাতে এক যুবকের আবির্ভাব হল। প্লাজা ফার্নেসের সামনে এসে এদিক ওদিক চেয়ে সে দোনামোনা করতে লাগল। এত দূরে এসে কি ঠিক হল? সাহসী বলে তার নামডাক আছে। কিন্তু ভিনশহরে সাহস দেখিয়ে আর কী হবে? কোন সাফল্যের সন্ধানে সে এক শহর থেকে আরেক শহর পাড়ি দিচ্ছে কে জানে! কিন্তু ঘরেও যে মন বসে না। 

বাড়ির কর্তা আলেসান্দ্রো ওপর থেকে তাকে লক্ষ করছিলেন। ধীর পায়ে নিচে নেমে এসে ছেলেটির সামনে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম হে তোমার? মতলব কী এখানে?"

ছেলেটি থতমত খেয়ে বলল, “আজ্ঞে ডোমিনিকোস। ছবি আঁকি। শুনেছি এই জায়গাটাতে শিল্পীরা থাকতে পারে। তাই, মানে..."

আলেসান্দ্রো যুবকটির আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে বললেন, “ভেনিস থেকে আসছ বুঝি?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ। “

ঘাড় নাড়লেন আলেসান্দ্রো। ছেলেটির কথা তাঁর এক পরিচিত তাঁকে বলেছিলেন। ক্রেট-এর ছেলে, আঁকার হাত নাকি মন্দ নয়। ভেনেসিয়ান শৈলী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে বছরকয়েক, নামডাকও হয়েছে খানিক। কিন্তু ভেনিস আর রোম তো এক নয়। গির্জার সুনজরে না পড়লে অনেক তাবড় তাবড় শিল্পীকেও অদৃষ্টের কাছে পরাজিত হয়ে সরে পড়তে হয়েছে। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, “শোনো হে ছোকরা, আমার নাম আলেসান্দ্রো কার্ডিনাল। তোমাকে এখানে থাকতে দিচ্ছি ঠিকই কিন্তু কাজ জোগাড় করার দায়িত্ব নিতে পারব না বলে দিলাম।” 
যুবক ঘাড় নাড়ল। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আলেসান্দ্রো বুঝতে পারলেন এই ছেলের হাত অন্য। বাইবেলের ধার্মিক ছবি আঁকতে আর চারটে শিল্পীর মতোই দক্ষ, কিন্তু অন্য এক মাত্রা যোগ করে দেয় প্রতিটি ছবিতেই। ম্যানেরিজম চমৎকার, নতুন স্টাইল ধরে ফেলতেও সময় লাগে না। শুধু একটাই অসুবিধে। ছোকরা বড্ড গোঁয়ার। জিজ্ঞাসাবাদ করে চার্চের ফ্রেস্কো আঁকার কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন, নবাবপুত্তুরের তা পছন্দ হল না। ক্যানভাস ছাড়া ছবি আঁকা নাকি ছোকরার পছন্দ নয়! এদিকে পকেট তো ঢনঢনে। এত তেজ আসে কোত্থেকে?  

যেমন তেমন করে সময় কাটতে লাগল। এদিকে ডোমিনিকোসও বুঝতে পারছে রোম আর ভেনিস এক নয়। সংস্কৃতির পার্থক্য অনেকটাই। টিটিয়ান,  তিনতোরেত্তো, বাসানোদের যে ন্যারেটিভ স্টাইল সে পছন্দ করে সেই নিয়ে রোমের গির্জায় ফ্রেস্কো আঁকা চলে না। এখানে গির্জার নিয়মকানুন বড় কড়া, স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলেই বাবুদের কপাল কুঁচকে যায়। প্রথম প্রথম আলেসান্দ্রো তার প্রতি সহায় ছিলেন ঠিকই কিন্তু রাজপ্রাসাদে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় তাঁর সেই ভাব উধাও হয়েছে। ডোমিনিকোস ঠিক করল, আর না। উনিশ মাস হয়ে গেছে, এবার রোমকে বিদায় জানানোই ভালো। 

১৫৭৭ সালে মাদ্রিদ হয়ে ডোমিনিকোস এসে পৌঁছাল স্পেনের তোলেদোতে। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত তোলেদো সম্রাটের রাজধানী ছিল, এখনও প্রধান গির্জা আছে সেখানেই। ধর্মের বাড়াবাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু লোকজন রোমের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। আমোদ আর উৎসব চলতে থাকে সারাক্ষণ। ডোমিনিকোস বুদ্ধিমান। সে ছবি আঁকার পাশাপাশি ব্যবসাও ফেঁদে বসল তোলেদোতে। ব্যবসায়ী হিসেবে যখন সে পসার জমিয়ে ফেলেছে, সম্ভ্রান্ত বর্গের বিত্তশালী মানুষের কাছেও পরিচিত হয়ে গিয়েছে, তখন সে শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল মঞ্চে। শুধু আত্মপ্রকাশই করল না, বরং বলা যায় ওপেনিং ব্যাট করতে নেমেই চালিয়ে খেলতে শুরু করে দিল। 

ডোমিনিকোস একের পর এক কাজ করে যেতে লাগল এই সময়। যাবতীয় চিন্তা তার মাথা থেকে দূর হয়ে গেছে, তার তুলি চলছে অবাধ গতিতে। ফর্ম ভেঙে বেরিয়ে আসতে তাকে দু’বার ভাবতে হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই এক নতুন স্টাইলের জন্ম দিয়েছে সে। মান্যিগণ্যি ব্যক্তিরা ভালো দাম দিয়ে তার ছবি কিনে নিয়ে যেতে চায়, রাজপ্রাসাদেও আকছার ডাক পড়ে তার। ‘ট্রিনিটি আর এসাম্পসন অফ দ্য ভার্জিন’ ছবিটি আঁকার পর সে এক লাফে জনপ্রিয় শিল্পীদের তালিকায় চলে এসেছে। কিন্তু খ্যাতি যখন আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে ভোগান্তিও। অনুরাগীদের সংখ্যা বাড়লে শত্রুবৃদ্ধি হয় দ্বিগুণ গতিতে। ডোমিনিকোস আশা করেছিল রাজার অনুগ্রহ হলে সে মাদ্রিদে গিয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু তার আঁকা কয়েকটি ছবি রাজা ফিলিপের মনঃপুত হয়নি। এর পিছনে অবশ্য কারণও ছিল। রাজার তোষামোদকারীদের মধ্যে অনেকেই ডোমিনিকাসের ত্বরিত জনপ্রিয়তায় খাপ্পা হয়েছিল। তাদের প্ররোচনায় তার বিরুদ্ধে নানান গুজব রটিয়ে দেওয়া হল। এই শিল্পী যে ধরা কে সরা জ্ঞান করছে, রাজামশাইকেও সে পাত্তা দেয় না, এই কথা নানাভাবে কিং ফিলিপকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। 

মাদ্রিদে যাওয়া ডোমিনিকোসের হল না। ১৫৮৬ সালে সব চিন্তা ভুলে সে এঁকে ফেলল আরেকটি ছবি, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। ‘বিউরিয়াল অফ কাউন্ট অফ অরগাজ’... শেষ জীবনে সে আরো বেশি করে নতুন নতুন ফর্মের ছবি আঁকতে শুরু করল। নাওয়াখাওয়া ভুলে সে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে তুলি আর রঙ নিয়ে। লোকে আড়ালে বলে পাগলা ডোমিনিকাস। তখনও সে জানে না, স্পেনের শিল্প ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে সোনালি অক্ষরে। 

প্রাদো মিউজিয়ামে এল গ্রেকোর আঁকা ‘নোবলম্যান উইথ হিস হ্যান্ড অন দ্য চেস্ট’ ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে এই গল্পটা আমার মনে পড়ে গেল। ছবির নিচে শিল্পীর খানিকটা পরিচয় দেওয়া ছিল। 

Image result for Nobleman with his Hand on his Chest
Nobleman with his Hand on his Chest

স্পেনের অনেক শিল্পীই ইতালি আর ফ্রান্স-এ গিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এককালে। কিন্তু খুব বেশিসংখ্যক শিল্পী নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে উঠতে পারেননি। সেদিক দিকে ডোমিনিকোস ওরফে এল গ্রেকো সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। এমনিতে আমাদের মত সাধারণ মানুষ, যারা আর্ট ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না, তাদের কাছে ক্লাসিকাল আর্ট বিষয়টা ভীষণ জটিল। বাইবেলের গল্পযুক্ত ধার্মিক ছবি পর পর কয়েকটা দেখলেই আমাদের একঘেয়ে মনে হতে থাকে। গল্পের ভিতরে লুকিয়ে থাকা রেফারেন্স বোঝা যায় না বলে ঘনঘন হাই ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে এল গ্রেকো অবশ্যই অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী। কার সাধ্য তাঁর আঁকা ক্লাসিকাল আর্ট দেখে হাই তুলবে! তাঁর ফর্ম ভাঙ্গা মানুষজনের আকৃতি, তাঁর রঙের ব্যবহার অন্যদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। একের পর এক ছবি দেখলেও চোখ অথবা মন ক্লান্ত হয় না। শোনা যায় পিকাসো প্রথম জীবনে প্রাদোতে এসে গ্রেকো আর ভ্যালেনকুইজের ছবি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। ফর্ম ভেঙ্গে তোলার মূল অনুপ্রেরণা পিকাসো গ্রেকোর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। 

প্রাদোতে অবশ্য এল গ্রেকো ছাড়াও বহু শিল্পীর কাজ আছে। কারাভাজ্জিও, পিকাসো, গোয়া সকলেই মজুদ। প্রকাণ্ড মিউজিয়াম, চার তলা জুড়ে নানান শিল্পের নিদর্শন। একদিনের টিকিট কাটা হয়েছে মাত্র,  হুড়মুড় করলে কিছুই ভালো করে দেখা হবে না। যতটা ঠিকঠাক সময় নিয়ে দেখা যায়! তার মাঝে কোথাও কোথাও পা নিজেই আটকে যায় অপূর্ব এক একটা পেইন্টিং দেখে। সেরকমই একটা কাজ হল ‘দ্য গার্ডেন অফ আর্লি ডেলাইটস’, শিল্পী হিয়েরনিমস বস। তিনটে ভিন্ন ক্যানভাস জুড়ে এই বিশাল চিত্রে একই সঙ্গে পৃথিবীর ভালো-মন্দ-সুন্দর-বীভৎস যা আছে তা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। চোখ ফেরানো যায় না। 

The Garden of Earthly Delights - Wikipedia
The Garden of Early Delights

আর একটা ছবি গোয়ার ‘থার্ড অফ মে, ১৮০৮’। এই দিনেই নেপোলিয়ানের সৈন্যের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল স্পেনের মানুষ। তার দাম অবশ্য বন্দুকের গুলি খেয়ে চুকোতে হয়েছিল প্রত্যেককেই। অপূর্ব সুন্দর ভাবে সে ঘটনার খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন শিল্পী। 

হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে একসময় বেরিয়ে পড়াই স্থির করলাম। মাদ্রিদের মিউজিয়াম কোয়ার্টারে আরো বেশ কয়েকটা নামকরা মিউজিয়াম আছে। টিকিটের দাম আর প্রাদোর বিহ্বল করা অভিজ্ঞতা, দুই নিয়ে সেগুলোতে যাওয়ার সাহস হল না। একদিনে কতটাই বা দেখা যায়! ঘন্টা পাঁচেকের বেশি হাঁটা অসম্ভব। আমাদের কাছে এত সময়ও নেই। অতঃপর চল যেদিকে দু’ চোখ যায়। সব কিছুই দেখার। চোখ থাকলেই হল।

Image result for Third of May, 1808
Third of May, 1808




(ক্রমশ )

মাদ্রিদ - তৃতীয় পর্ব

প্রথম থেকে পড়তে হলে এখানে পড়ুন