সের্ভান্তেস, সাঙরিয়া ও স্প্যানিশ সামার্স— স্পেনের উল্লাস
Madrid |
যদি মরে যাই, জানলাটা খুলে রেখো
শিশুটির মুখে কমলালেবু, জানলা থেকে দেখতে পাই
গম পেষাই করছে এক চাষা, জানলা থেকে শুনতে পাই
যদি মরে যাই, জানলাটা খোলা রেখো
~ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা
১) ওজন বড়জোর একশ গ্রাম। আকারে হয়তো একটা পায়রার মতো। সাদা পেট, লাল ঠোঁট আর আসমানি রঙের ডানা দেখে মনে হয়, পাখি নয়, বরং রঙিন উলের বল। অথবা পেঁজা তুলো দিয়ে তৈরি এক টুকরো মেঘ। নরম হাতে তুলে নিয়ে উড়িয়ে দাও, পালকের মতো ভেসে বেড়াতে দাও হাওয়ায় ভর করে, তারপর আবার লুফে নাও এক ঝটকায়। নিজেকে জানান দিতে ডানা ফরফর করতে দাও তাকে। প্রমাণ করতে দাও সে সত্যিই পাখি।
পাখি হলেও কী? কুছ পরোয়া নেহি! এইটুকুন তো জীব! ঠিক যেন পুতুল। তাকে বন্দি করে রাখো হাতের মুঠোয়। খাঁচায় আটকে রাখো, অথবা পায়ে বেঁধে দাও সুতো, করুণ স্বরে ডাকতে দাও। মাঝেমধ্যে এনে দাও খাবার। দুই সপ্তাহ চলুক এই বন্দিদশা! না হলে তিন। ব্যস! তারপর পাখি তোমার আজ্ঞাবহ দাস। খাঁচা থেকে মুক্তি দিলেও আর ডানা মেলে আকাশে উড়বে না। ফরফর করবে ছাদের মাথায়, না হয় পঁচিলে গিয়ে বসবে। হাঁটবে দু’ এক পা। তারপর গুটি গুটি ফিরে আসবে খাঁচার কাছে। প্রাণের ভয় নেই নাকি? একশ গ্রাম ওজন যার, তার সাহস আর কোনটুকু হবে? ঠিক কিনা?
আজ্ঞে না। হিসেবে একটু ভুল আছে। কারণ, পাখিটার নাম আর্কটিক টার্ন। ওজন সত্যিই একশ গ্রাম, কমও হতে পারে। কিন্তু সাহসের দিক থেকে এই পরিযায়ী পাখি দুনিয়ার সমস্ত পাখিকে টেক্কা দেবে। প্রতি বছর প্রায় সত্তর হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এই পাখি। কিন্তু আর চারটে পরিযায়ী পাখির মতো একই পথ ধরে উড়ে চলে না এরা। অনেকে আফ্রিকার উপকূল ধরে এগিয়ে যায়, বাকিরা অতলান্তিক সাগর অতিক্রম করে দক্ষিণ আমেরিকার গিয়ে উপস্থিত হয়। ফেরার সময় কিন্তু একই পথ দিয়ে ফেরে না তারা। বৈজ্ঞানিকরা দেখেছেন আর্কটিক টার্ন পাখিরা ফিরতি পথে অতলান্তিক সাগরের ওপর একটা ‘এস’ প্যাটার্ন অনুসরণ করে। এই অদ্ভুত যাত্রাপথের জন্য পাখিগুলোকে অনেকটা অতিরিক্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এর কারণ কী, কেউ জানে না। পক্ষীবিশারদদের মতে, হয়তো ‘গ্লোবাল উইন্ড সিস্টেম’-এর সুবিধা নেওয়ার জন্য এমন করে থাকে পাখিগুলো। কিন্তু নিশ্চিত ভাবে কিছুই বোঝা যায়নি। একটা কথাই শুধু জানা গিয়েছে, মহাবিশ্বের অন্যতম ভ্রমণকারী হল এই সামুদ্রিক পাখি। একটা আর্কটিক টার্ন জীবনকালে যতটা পথ উড়ে কাটায়, তাতে তিন বার পৃথিবী থেকে চাঁদে গিয়ে ফিরে আসা যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই পরিযাণ শুধু তাদের জীবন নয়, তাদের ভবিতব্যও। কোনও পাখিকে যদি জোর করে আটকে রাখা হয়, তাহলে তারা কয়েক বছরের বেশি বাঁচে না।
আর্কটিক টার্নের মতো না হলেও সুটি শিয়ারওয়াটার বলে একটি পাখি প্রায় তেষট্টি হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ফি বছর। শর্ট টেইল্ড শিয়ারওয়াটার আবার পাখিদের দুনিয়ার গ্লোবট্রটার হিসেবে বিখ্যাত। এই পুঁচকে পাখি দুনিয়ার সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়, কোনও বিশেষ জায়গায় গিয়ে ডেরা জমায় না। আবার গান গাওয়া নর্দার্ন হুইটিয়ারের কথাই বা থাকে কেন? সাহারা মরুভূমি হোক বা তুন্দ্রা অঞ্চল, গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল হোক বা বরফাবৃত প্রদেশ, কোনও জায়গায় যেতেই এদের আপত্তি নেই। ওড়ার জন্য তৈরি হয়েই আছে। বেড়ানোর নাম শুনেই ব্যাগ গুছিয়ে থুড়ি ডানা মেলে রেডি। ডানা থাকার লাভ আছে, স্বীকার করতেই হবে।
পাখির গল্প থেকে এইবার মানুষের গল্পে ফেরা যাক। সংকোচ হচ্ছে যদিও, কারণ নিজেকে মানুষ বলতে কেন জানি একটু কিন্তু কিন্তু ভাব থাকে। মোদ্দা কথা হল, আমার ডানা নেই ঠিকই, কিন্তু উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের চেয়ে কম নয়। আর্কটিক টার্নের মতো শারীরিক ক্ষমতা না থাকতে পারে, কিন্তু শর্ট টেইল্ড শিয়ারওয়াটার আর নর্দার্ন হুইটিয়ারের মতো অ্যাটিটিউড আছে ষোলআনা। তাই গন্তব্য যাই হোক না কেন, যাত্রার গুরুত্বকে হেয় করা আমার ধাতে নেই। উল্টে পথে কাটানো সময়টুকুই আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে শান্তির। ওই পথচলাটুকুই আমার জীবনের সঞ্চয়। আমার বাড়ি, আমার দেশ, আমার মুক্তির জায়গা। এই নিরুদ্দেশ যাত্রাই আমার নিয়তি, আমার মুক্তির পথ।
সেই পাগলপারা নিরুদ্দেশ যাত্রার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই উড়ে চলেছি এই মুহূর্তে। প্লেনটা ঘুরে ঘুরে নামতে শুরু করেছে। জানলার পাল্লা তুলে দেখলাম, স্পেনের মাটিতে আলোর রোশনাই আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। মাদ্রিদের বারাজাস এয়ারপোর্টে যখন পা রাখলাম, ঘড়িতে রাত বারোটা। সূর্যাস্ত হয়েছে ঘন্টাখানেক আগে। রাত দশটার সময় আমাদের ফ্লাইট যখন গ্রীসের ওপর থেকে উড়ে আসছে, বাইরে সূর্যাস্তের কমলা রং দেখে ভয়ানক অবাক হয়ে পড়েছিলাম। অচিরেই মনে পড়লো এ আমাদের প্রাচ্যদেশ নয়, খাস ইউরোপিয়ান পেনিনসুলা। ‘সামার্স’ মানে গ্রীষ্মকালে ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই সূর্যাস্ত হতে হতে রাত দশটা। যত পশ্চিমে যাবে, সূর্যাস্ত হবে তত দেরিতে। ফলে গ্রীষ্মের উল্লাস চলে আঠেরো ঘন্টা ধরে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, তিনমাস ব্যাপী গ্রীষ্মকালীন উৎসবের এই মেজাজ পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্তে দেখতে পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। অনেক দেশের মানুষই স্বভাবে ইউরোপিয়ানদের চেয়ে বেশি তুখোড়, আমুদে আর হল্লাবাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু ইউরোপের এই নামহীন উৎসবের মধ্যে যেন একটা মুক্তির আমেজ লুকিয়ে থাকে। ‘সামার্স’ এখানে শুধু একটা ঋতু নয়, জীবনকে উপভোগ করার একটা দর্শনও বটে।
Madrid Barazas Airport |
আমাদের এই ব্যাকপ্যাকিং সফরের মেয়াদও এই গ্রীষ্মের কয়েক মাস। লং টার্ম ব্যাকপ্যাকিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে গেলে এই দীর্ঘ সময় আসলে মোটেই দীর্ঘ নয়, আর ইউরোপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে হলেও আড়াই তিন মাস নস্যি। সেই আন্দাজ আমরা পরিকল্পনা করার সময়েই পেয়েছিলাম। কিন্তু কী আর করা! সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যে তফাত থাকে, সে কথা আর কে না জানে?
দেশ দেখার নেশা একবার পেয়ে বসলে সেই নেশা কাটাবার কোনও উপায় নেই। অথচ সময়ের নিয়মে ছোটবেলার বেড়ানোর ছবিটা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে আজ। আরব্য বেদুইদের মতো উঁটের পিঠে বসে সাহার মরুভূমিতে পাড়ি দেওয়ার রোমাঞ্চ আর আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে ডেভিড লিভিংস্টোনের অভিযানের পথে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নও পাল্টে গেছে নতুন যুগে। এখন স্মার্টফোন হাতে ছবিশিকারি টুরিস্টের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। মরুভূমি হোক বা মাউন্ট এভারেস্টে, সর্বত্র দাপাদাপি করছে মানুষ। একমাত্র উগ্রপন্থীদের আক্রমণ ছাড়া কোনও কিছুতেই আর ভয় নেই, পথের ঝুঁকিও নেই আগের মতো। অতএব অ্যাডভেঞ্চারের পরিভাষাও গেছে পাল্টে।
রুদ্ধ্বশ্বাস কোনো অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হলে আজ অরণ্যে পাড়ি দেওয়া জরুরি নয়। পৃথিবীর যে কোনও শহরে, যে কোনও প্রান্তে সেই অভিজ্ঞতা হয়তো অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্যে। নতুন যুগে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষেরা বিশ্ব পারাপার করছে আসলে কয়েকটি মুহূর্তের সন্ধানে। কয়েকটি মুহূর্ত, যখন জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেও বর্তমান আবছা হয়ে আসে, সব কিছু মুছে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইতিহাসের এক একটা দৃশ্য। হারিয়ে যাওয়া কিছু ঘটনা। কথা। ছবি। গান। স্মৃতিসৌধ। কিছু মুখচ্ছবি। সাধারণ এবং অসাধারণ মানুষের জীবন। তাদের গল্প। আচমকাই এক নিমেষে মহাবিশ্বের বিশালতা আমাদের আবিষ্ট করে তোলে, অপ্রত্যাশিত ভাবে অনুভূত হয় প্রকৃতির আসল স্বরূপ। অল্পবিদ্যার অহংকার খসে পড়ে বিস্ময় আর শ্রদ্ধায়। যুগ আর মানুষের আবহমান পরিবর্তনের উর্ধ্বেও যে এই মহাবিশ্বে কিছু কিছু জিনিস একই রকম থেকে যায়, এরকম এক একটা মুহূর্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়।
ইউরোপের ছাব্বিশটি দেশে প্রবেশ করতে হলে সেনগেন ভিসা নিলেই চলে। আগের মত পৃথক ভাবে প্রতিটা দেশের জন্যে ভিসা নিতে হয় না বলে ইউরোপ ঘুরে আসা অনেক সহজ হয়ে গেছে। মাদ্রিদ এয়ারপোর্টে ইম্মিগ্রেশন নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি আমার চোখে পড়ল না। এক পলক দেখেই ইম্মিগ্রেশানের লোকজন স্ট্যাম্প মেরে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলেন আমাদের। ব্যাগেজ কাউন্টার থেকে জিনিসপত্র তুলে বেরিয়ে পড়লাম।
এয়ারপোর্ট থেকে রুকস্যাক পিঠে বেরিয়ে পড়লাম। নতুন দেশের মাটিতে পা পড়েছে বলে মনে ফূর্তির অভাব নেই। আমাদের যেতে হবে প্লাজা মেওরের কাছে, দিন কয়েকের জন্যে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ার কথা। গুগল ম্যাপ দেখে বিশেষ সুবিধে হল না, ইন্টারনেটও ঠিক মত আসছে না। কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। ভাগ্যক্রমে আমার সঙ্গিনী স্প্যানিশ ভাষা বিশারদ। স্প্যানিশ ভাষা বলা নিয়ে তার কোনও জড়তাও নেই। মুচকি হেসে বললাম, “সেনিওরিতা, আপনি এবার দায়িত্ব নিন তো দেখি। আমি অবোধ বালক, এই বিদেশ বিভুঁইয়ে যে কিছুই বুঝছি না রে ভাই!”
ঠোঁট উল্টে গট গট করে সিকিওরিটির লোকের কাছে চলে গেলেন, ফিরেও এলেন চটপট। তাবড় স্প্যানিশে কথোপকথন চালিয়ে দিদিমণি সব খবরাখবর নিয়ে এসেছেন। রুকস্যাক পিঠে তুলে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী চললাম। খুঁজেপেতে বাসেও উঠে পড়া হল। আমাদের কাছে ইউরো ভাঙানো ছিল কিছু, কিন্তু পাঁচ ইউরো করে টিকিট দিতে বেশ গায়ে লাগল। তা যাকগে! প্রথম প্রথম ওরকম লাগেই। বাস চলল। চকচকে বাস, ঝকঝকে রাস্তাঘাট। ইউরোপের সব জায়গাতেই রোডওয়েজ অসম্ভব ভালো। প্রায় সারা ইউরোপ জুড়ে পাকা রাস্তা জাল বিস্তার করে আছে। অসংখ্য ব্রিজ, ফ্লাইওভার, সাবওয়ে, টানেলের ছড়াছড়ি। খুব একটা অবাক হলাম না।
পালাসিও দে সিবেলেস-এর কাছে সিবেলেস স্কোয়ারে এসে বাস থামল। এখান থেকে মেট্রো ধরতে হবে। মাঝে অবশ্য হাঁটা থামিয়ে স্প্যানিশ ‘সামারস’-এর জীবনযাত্রায় কয়েক মুহুর্তের জন্যে চোখ রাখতে বাধ্য হলাম। এই স্কোয়ারের চারিদিকে অবস্থিত টাউন হল, মিউজিয়াম, প্যালেস। রাত একটা বাজলে কি হবে, আলোয় জগমগ করছে সব কিছু।
রাস্তায় প্রচুর লোকজন। দেখে মনে হচ্ছে বিকেল সাতটা। সাইকেল, প্যাডেল স্কুটার, স্কেটবোর্ড নিয়ে চলেছে যুবক-যুবতীর দল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার রওনা দেওয়া হল গন্তব্যের উদ্দেশে। বানকো দে এসপান্যা মেট্রো স্টেশন থেকে টিকিট কাটলাম দু' দিনের জন্যে। বাস, মেট্রো যাতে খুশি তাতে উঠে পড়া যাবে এই টিকিট দেখিয়ে। মেট্রোতে দুটো স্টেশন। সোল স্টেশনে নেমে আমাদের হাঁটতে হবে সিধে প্লাজা মেওরের দিকে। এখানেই অবস্থিত মাদ্রিদের বিখ্যাত প্লাজা পুয়ের্তা দেল সোল। সে দিকে আর পা বাড়ালাম না আজ। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে চলেছি রুকস্যাক কাঁধে। চারিদিকে দেওয়ালির মত রোশনাই। জায়গাটা শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। ব্যাকপ্যাকার হোক বা প্যাকেজ ট্যুরের টুরিস্ট, সকলেই এখানে ঘোরাফেরা করে। আলোকিত রেস্তোরাঁ, সুশোভিত বিপণিকেন্দ্র। শয়ে শয়ে লোক বিয়ার অথবা ওয়াইন নিয়ে রাস্তায় সাজানো টেবিলে বসে হাসাহাসি করছে, আড্ডা দিচ্ছে। তাদের পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হস্টেলের দিকে।
প্লাজা মেওরের ঠিক পাশের গলিতে মার্কাদো দে সান মিগুয়েলের কাছে পুরোনো একটা বাড়ির তিন তলায় আমাদের হস্টেল। গরম ভালোই পড়েছে। হাট করে জানলা খুলে স্প্যানিশ সামারের প্রথম রাতের উল্লাস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে তখনও অপেক্ষা করে আছে গ্রীষ্মের বাকি রাতগুলো।
প্লাজা মেওরের ঠিক পাশের গলিতে মার্কাদো দে সান মিগুয়েলের কাছে পুরোনো একটা বাড়ির তিন তলায় আমাদের হস্টেল। গরম ভালোই পড়েছে। হাট করে জানলা খুলে স্প্যানিশ সামারের প্রথম রাতের উল্লাস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে তখনও অপেক্ষা করে আছে গ্রীষ্মের বাকি রাতগুলো।
Iberian Peninsula |
Palacia de Cibeles |
Marcado de san miguel |
Madrid Night |
২)১৪৬৯ সাল। স্পেনের নানা এলাকায় তখন ছোট ছোট ক্রিশ্চান রাজ্য গড়ে উঠেছে। প্রায় তিনশ বছর ধরে শাসন করেছে আফ্রিকার মুর সম্রাটরা, তারা ইসলাম ধর্মের অনুযায়ী। কিন্তু এখন তাদের অবস্থা অনেকটা পড়তির দিকে, ক্রিশ্চানরা আবার একটু একটু করে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। এমন সময় কাস্তিয়া রাজ্যের মহারানী ইসাবেলা প্রথম আর আরাগনের মহারাজ ফার্দিনান্দ দ্বিতীয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। এই বিয়ের পিছনে দীর্ঘ আলোচনা আর স্পেনের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ক্রিশ্চান রাজারা ঠিক করলেন যে কোনোক্রমেই স্পেনকে ক্রিশ্চান সাম্রাজ্য থেকে বেরোতে দেওয়া চলবে না। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ না করে এই বিবাহের মাধ্যমে বরং কাস্তিয়া এবং আরাগন এক হয়ে সম্মিলিত ভাবে গ্রানাদায় আক্রমণ করুক সম্রাট মুহাম্মদের ওপর। সেনার সম্মিলিত শক্তির সামনে গ্রানাদার শেষ মুসলমান রাজা টিকতে পারবেন না।
নিঁখুত প্ল্যানিং। হলও তাই। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রানাদা আর আন্দালুসিয়ার আশেপাশের অঞ্চল থেকে শেষ মুসলমান শাসকদের পরাজিত করে গোটা স্পেনে আধিপত্য বিস্তার করল ক্রিশ্চানরা। মুররা অবশ্য রাজা হিসেবে মোটেই জনপ্রিয় ছিলেন না। রাজ্যে ভিন্ন ধর্মালম্বী অন্যান্য নাগরিকদের অনেক বেশি কর দিতে হত। ইহুদি আর ক্রিশ্চানরা মুখ বুজে সব সহ্য করত। নতুন সম্রাট আসায় সাধারণ মানুষের মনে আশা দেখা দিল। এবার হয়তো স্বস্তিতে থাকা যাবে! তাদের মাথার ওপরে যে দুর্ভাগ্যের কালো মেঘ আরো বেশি করে ঘনাতে শুরু করেছে সেটা তখনও তারা বুঝতে পারেনি।
ইতিহাসে এই পর্ব 'স্প্যানিশ ইনকুইজিশন' নামে কুখ্যাত। সেই সময়ে লক্ষ লক্ষ লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে বিনা কারণে। গ্রানাদায় ১৪৯১ সালে সুলতান মুহম্মদ ফার্দিনান্দ আর ইসাবেলার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন যে ক্রিশ্চানরা অধিকার পেলে অন্য ধর্মের লোকেদের ওপর অত্যাচার করা চলবে না। এখানে যে অন্য ধর্মের মানুষ বলতে যে মুসলমানদের কথা বলা হয়েছিল, সে বলাই বাহুল্য। ইহুদিদের দু’দলের কেউই মানুষ বলে গণ্য করত না। তা চুক্তি থাকে চুক্তির জায়গায়, শাসন হয় শাসকের মনমর্জিতে। কয়েক বছরের মধ্যেই চুক্তির শর্ত ধুলোয় মিশিয়ে শুরু হয়ে গেল নাগরিকদের বিচার। ক্যাথোলিক মোনার্করা আদেশ দিলেন, স্পেনে থাকতে গেলে মুসলমানদের ধর্ম পরিবর্তন করে ক্রিশ্চান হতে হবে। তা যদি না হতে চাও দেশ থেকে বেরিয়ে যাও। শুধু স্পেনের সীমানার ভিতরেই নয়, দেশের বাইরে অবস্থিত অন্য স্প্যানিশ কলোনিগুলোতেও এই আদেশ পৌঁছে দেওয়া হল। দলে দলে লোকে দেশ ছাড়তে লাগল। অনেকে প্রাণ বাঁচানোর খাতিরে ধর্ম পরিবর্তন করে ক্রিশ্চান হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে ধর্মাচার চালাতে লাগল। এত দিনের সংস্কার ভুলে যাওয়া সহজ নয়। এই আশঙ্কা ক্যাথলিক পাদ্রীরা আগেই করেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনার সাহায্য নিয়ে নির্বিচারে নিরীহ মানুষের ওপর শুরু হল অত্যাচার। হাজার হাজার লোককে ধরে নিয়ে নিপীড়ন করতে শুরু করল রাজামশাইয়ের সৈন্যসামন্তরা।
ইহুদিরা, মুসলমান আর ক্রিশ্চান দুই দলেই ছিল না। প্রাচীন কাল থেকেই তারা পড়ালেখা জানত, ঘরদোর পরিষ্কার রাখত। চোখ বুজে ধর্মকে অনুসরণ করাতে তাদের মতি ছিল না। সংক্ষেপে, যুক্তি আর ‘কমন সেন্স’ ব্যাপারটাকে তারা একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিল। আর যুক্তিবাদীরা যে প্রথমেই সকলের চক্ষুশূল হবে, সে কথা আর নতুন কী? সেবারও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। ক্রিশ্চান অথবা মুসলমান, দুই দলের কাছেই তারা ছিল ব্রাত্য। ইনকুইজিশন শুরু হওয়ার ফলে ইহুদিরা পড়ল মহা ফাঁপরে। দেশে থাকলে উৎপীড়নকারীরা খুন করছে, দেশ ছেড়ে পালাতে গেলেও নিস্তার নেই। সৈনিকরা ওঁত পেতে আছে, রাজ্যের সীমানা থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলেই ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে ইহুদীদের কচুকাটা করছে তারা। যারা সত্যি সত্যিই অবশেষে ধর্ম পরিবর্তন করে ক্রিশ্চান হয়ে গিয়েছিল, শেষমেশ তাদের কথাও কেউই বিশ্বাস করেনি। অকথ্য অত্যাচার করে হাজার হাজার ইহুদিদের মৃত্যর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়।
“তারপর?” সঙ্গিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিগ্গেস করলাম আমি। স্প্যানিশ ভাষা নিয়ে পড়তেই প্রধানত দিদিমণির স্পেনে আবির্ভাব, এই ফাঁকে দেশের ইতিহাস ঝালিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি যে একেবারে অজ্ঞ তা নয়, কিন্তু এখন শুনে-শুনে ঘটনাগুলো জেনে নিতে খারাপ লাগছে না।
“তারপর আর কি? কয়ামত! বা বলতে পারিস সাড়ে সর্বনাশ। কোই নেহি বচা।”
“কিঁউ? ত্রিবেদী তো বচ গয়া হোগা!” আমি চোখ মটকালাম। প্রসঙ্গত বলা ভালো দিন কয়েক আগেই নেটফ্লিক্সে ‘স্যাকরেড গেমস’ সিরিজটি রিলিজ করেছে আর আমরা দুজনেই বেড়ানোর ফাঁকে সেটায় মজে আছি। যারা ত্রিবেদীকে চিনতে পারেননি, তাদের সময় করে সিরিজটি দেখে ফেলতে হবে।
দিদিমণি আমার বোকা বোকা বাতেলায় কান না দিয়ে বললেন, “একদিকে যখন স্পেনের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায় লেখা হচ্ছে, সেই একই সময়ে স্পেনের শিল্প জগতের সবচেয়ে সোনালি সময় শুরু হচ্ছে— বুঝলি। স্প্যানিশ রেনেসাঁর ফলে শিল্প, চিত্রকলা, সাহিত্যে নতুন নতুন কাজ শুরু হয়েছে পুরোদমে। অনেক জায়গায় নতুন করে সাজানো হচ্ছে শহর, গির্জা আর রাজমহলের কাজ চলছে পুরোদমে।”
“বটে?” আমি মাথা চুলকে বললাম, “তা এই প্লাজা-ফ্লাজা বানালো কে রে ভাই?”
“ওসব তোকে অ্যালেক্স বলে দেবে। মন দিয়ে শুনে নে।”
অ্যালেক্স কে, সেটা জানার আগে বরং তার বলা গল্পটা শেষ হয়ে যাক।
১৫৭৭ সালে রাজা ফিলিপ তৃতীয় ডেকে পাঠালেন স্থাপত্যশিল্পী হুয়ান দে হেরেরাকে। হেরেরা তখন নানান কাজে ব্যস্ত। কিন্তু রাজার আহ্বানে তাঁকে রাজদরবারে গিয়ে হাজিরা দিতেই হল। রাজা ফিলিপের ফরমাইশ করলেন, মাদ্রিদের মাঝখানে অবস্থিত প্লাজা ডেল আরাবেলকে ফের নতুন করে সাজানো হোক। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি তলব করেছেন হেরেরাকে। হেরেরা কিছুক্ষণ রাজমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলেই বুঝলেন, পরিকল্পটা খুব ছোটোখাটো নয়। প্রয়োজনে বিপুল পরিমাণ অর্থ মঞ্জুর করতেও রাজামশাই রাজি। হেরেরা আন্দাজ করতে পারলেন, এই কাজই ভবিষ্যতে মাদ্রিদ শহরকে পরিচিতি দেবে। হয়তো এই কাজের জন্যেই তাঁর নামটাও মনে রেখে দেবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। রাজামশাইকে সম্মতি দিতে বেশিক্ষণ সময় নিলেন না তিনি।
নকশা বানানো শুরু করলেন হেরেরা, একসময় সে নকশা শেষও হল। মাঝে অবশ্য অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু অর্থাভাব আর নানা বাধাবিঘ্ন পড়ার ফলে ১৬১৭ সাল অব্দি কাজ শুরুই হল না। ১৬১৭ সালে অবশেষে যখন আবার কাজ শুরু হল প্লাজার, হেরেরা পটল তুলেছেন। রাজা ফিলিপ তৃতীয়ও মঞ্চের বাইরে। নতুন শিল্পী হুয়ান গোমেজ দে মোরা নতুন উদ্যমে পরিকল্পনা শুরু করলেন, কিন্তু তিনি জানতেন না এই প্লাজার সঙ্গে দুর্ভাগ্য জড়িয়ে পড়েছে। ১৭৯০ সালের আগুনে অসম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্লাজা দে আরাবেল। এতদিন ধরে চলা নির্মাণকার্য প্রায় পুরোটাই মায়ের ভোগে চলে গেছে। হুয়ান দে ভিলানুয়েভা আবার প্রথম থেকে শুরু করেন পুনর্নিমাণের কাজ। প্লাজার চারিদিকে বাড়িগুলোর উচ্চতা কমিয়ে আনেন। যুক্ত করেন নতুন ব্যালকনি। ২৩৭টি ব্যালকনি যুক্ত সেই প্লাজাই আজ প্লাজা মেওর নামে বিখ্যাত সারা পৃথিবীতে। মোট তিন বার অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও দমে যায়নি স্থাপত্য শিল্পীরা। আজ এই প্লাজা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়।
অ্যালেক্স-এর গল্প শেষ। আমাদের হাতে ধরা কফির কাপও শুন্য। প্লাজা মেওরের দুর্দান্ত চত্বর আমাদের চোখের সামনে। ওয়াকিং ট্যুরের অন্য ছেলেমেয়েরা অ্যালেক্সকে ছেঁকে ধরেছে নানা প্রশ্নে, তাতে তার চওড়া হাসি একটুও ক্ষীণ হয়নি। আমাদের ‘ফ্রি মাদ্রিদ ওয়াকিং ট্যুর’ এর গাইড এই হাসিখুশি ছেলেটির নামই হল অ্যালেক্স।
(ক্রমশ)
পরের পর্ব এখানে পড়ুন