মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২০

বোহেমিয়ান বুডাপেস্ট

আলো, উৎসব এবং ইতিহাস ড্যানিয়ুবের আমোদনগরী
Budapest at night

আমার কোনও মা নেই বাবা নেই

কোন ঈশ্বর অথবা রাষ্ট্রও নেই

শয্যা নেই, কফিনও নেই

প্রেমিকা নেই, চুম্বনও নেই


তিন ধরে কিছুই খাইনি আমি

এক টুকরো খাবার বা ভোজ নেই

আছে শুধু আমার বিশ বছরের উদ্যম

এই বিশ বছর আমি বেচে দেব


যদি কেউ না নিতে চায় তবে

শয়তানকেই নিতে হবে আমায়

মন দিয়ে আমি চুরি করব 

দরকারে খুনও করব বইকি


ধরাও পড়ব ঠিক, ফাঁসিও হবে

কবর দেবে পবিত্র পৃথিবীর নিচে

আমার হৃদয় থেকে গজাবে সোনালি ঘাস

তারা মৃত্যুকে ভয় পায় না।


~অত্তিলা জোসেফ

১) সব যাত্রাই কোনও না কোনও জায়গায় গিয়ে শেষ হয়। যখন মাস কয়েক আগে পিঠে রুকস্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম দেশ ভ্রমণের নেশায়, ফিরে আসার কথা মনে উঁকি মারেনি একবারের জন্যেও। নানা দেশের নানা দৃশ্য, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, বন্ধুদের মুখ ঝিলিক দিয়ে গেছে, হাত ধরে নিয়ে চলেছে এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক শহর থেকে অন্য শহর। পথের নেশায় কোথা থেকে সময় কেটেছে অনুভবও করিনি। কিন্তু বুডাপেস্টে পৌঁছানো মাত্র আমার মনে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে। এই দীর্ঘ পথের পরবর্তী শুন্যতাকে কল্পনা করে আমি সত্যিই ভয় পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি বাস্তবতার মুখোশকে। যে মুখোশ পরে আমাকে আবার এমন সব কাজে জড়িয়ে পড়তে হবে যা আমার জীবনে একান্তই অপ্রাসঙ্গিক। অদরকারি। অবান্তর। 

পথ শেষ হবে হয়তো, কিন্তু মনের যাত্রা এ জীবনে শেষ হওয়ার নয়। এই সত্যিটুকু আমি অনেক আগেই জেনে গিয়েছি। দীর্ঘশ্বাসের ঝড় সামলে আসন্ন বুডাপেস্টের পথে দৃষ্টি দিলাম। কিছুক্ষণ আগেই পেরিয়ে এসেছি স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভা। বাস দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে হাঙ্গেরির রাজধানী বুডাপেস্টের দিকে। আমাদের শেষ গন্তব্য। 

ব্যাকপ্যাকার সার্কিটে বুডাপেস্টকে নিয়ে যতটা মাতামাতি আমি দেখেছি, ততটা ইউরোপের অন্য কোনও শহর নিয়েই দেখিনি।  কোনও  সময়ে যদি কেউ জিগ্গেস করে 'সুযোগ পেলে ইউরোপের কোন শহরে ফিরে যেতে চাও?' একশ জনের মধ্যে নব্বইজন বুডাপেস্টের নাম বলতে থাকে। বুডাপেস্ট অবশ্যই ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর শহরের মধ্যে একটি, ড্যানিয়ুব নদীর ধারের সবচেয়ে জনপ্রিয় শহরও বটে। খানিকটা সস্তাও। কিন্তু এরকম তো অন্য কত শহরই আছে! তাহলে এই উন্মাদনার কারণটা কী? বুডাপেস্ট না গেলে সেটা বোঝা যাবে না। যাই হোক, এ সূত্রে মনে পড়ল হাঙ্গেরির কথা উঠলেই বাঙালিদের বালাটন হ্রদের কথা মনে পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুদিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। সময়ের অভাবে এই যাত্রায় আর সেখানে যাওয়া হবে না। 

হাঙ্গেরির ইতিহাসও ইস্টার্ন ব্লকের অন্যান্য দেশের মতন। একসময় নানা উপজাতির যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত এই অঞ্চলে প্রথমে রোমান, তারপর অটোমান সাম্রাজ্য এসে দখল নেয়। মধ্যযুগের শেষের দিকে হাপ্সবুর্গ বংশের কাছে চলে আসে এই অঞ্চল। সেই সময় থেকে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল হাঙ্গেরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রো-হাঙ্গেরি রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার পর হাঙ্গেরি স্বাধীন দেশ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে থাকার মূল্য দিতে বহু মানুষের প্রাণহানি হয় হাঙ্গেরিতে। সোভিয়েত সৈন্যেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগেই হাঙ্গেরি দখল করে নেয় এবং জার্মানদের তাড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক (পড়ুন কমিউনিস্ট) রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের কাজ শুরু করে। সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও খুব একটা সুখের হয়নি, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে অনেক দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে আসতে হয়েছে হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষকে।

বুডাপেস্ট বাস স্টেশনে নেমে আমরা মেট্রো ধরব বলে এগিয়ে গেলাম। এইখানে আবার হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্ট চলে, সেই টাকা তুলে মেশিনে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি কিছুই বুঝতে পারছি না। টাকার মতো ভাষাও হাঙ্গেরিয়ান। অল্পবয়সী একটি মেয়েকে সমস্যাটা বোঝাতে গিয়েই আমাদের মাথা ধরে গেল। মেয়েটি মনে হয় সদ্য কাজ শুরু করেছে, আমাদের আগে কেউই ইংরেজিতে প্রশ্ন করে ওকে বিরক্ত করেনি। সে একবর্ণ ইংরেজি জানে না, আমাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হব-হব করছে দেখে আমরাই তাকে মুক্তি দিলাম। দেশটা অস্ট্রিয়া বা সুইটজারল্যান্ড নয়, নিজের বুদ্ধি খরচ করাই ভালো। 

দেখেশুনে মেশিনে টাকা দিয়ে টিকিট কেটে মেট্রো করে আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় চলে এলাম। মেট্রো স্টেশন থেকে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি চওড়া-চওড়া রাস্তা, একগাদা বাস, গাড়ি, মোটরসাইকেল চলছে। স্থানীয় হোমস্টেতে সস্তার একটা ঘর ঠিক করা ছিল, খুঁজে খুঁজে সেটা বের করা হল। বাড়িটা খুব বড় না হলেও খারাপ না, রান্নাঘর আছে। বাড়িওয়ালা সেখানে থাকে না, অন্য দুটো ঘরেও অতিথিরা আছে বলে মনে হল। 

স্নান-টান সেরে কফি মেশিন থেকে কফি খেয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমাদের পাশের ঘরে থাকা কোরিয়ান দম্পতির সঙ্গে। দুজনেই অল্পবয়সী, হেসে হেসে কথা বলে। তারা এক বছর ধরে ইউরোপে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বুডাপেস্ট এসেছে এক সপ্তাহ আগে। জিনিসপত্র নাকি এখানে কোরিয়া থেকে ঢের সস্তা, সেই আনন্দেই দু'হাতে খরচ করছে। এখান থেকেই তারা কোরিয়ায় ফিরবে। আমাদের তারা বুডাপেস্ট-এর হাল-হকিকত বুঝিয়ে দিল, একটা ভালো হাঙ্গেরিয়ান রেস্তোরাঁর খোঁজও দিল। কফি খেয়ে, তাদের হাত নেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

রাস্তায় নেমে সঙ্গিনী বললেন, "দেখলি, ওরাও এখান থেকেই দেশে ফিরছে। বুডাপেস্ট তাহলে জনপ্রিয় ব্যাকপ্যাকিং রুটে শেষ পয়েন্ট।"

ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিকই বটে। ইস্টার্ন ব্লকে প্রাগ আর বুডাপেস্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা, অনেকে অবশ্য পোল্যান্ডের শহর ক্রাকো থেকেও ফেরার প্লেন ধরে। কাছেই স্লোভেনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়ার মত অসম্ভব সুন্দর দেশ থাকলেও ভিসার ঝামেলার কারণে অনেকেই সেইখানে যেতে পারে না। বিত্তশালী দেশের নাগরিকদের অবশ্য বেশিরভাগ দেশেই 'ফ্রি-ভিসা'। আমাদের আপাতত সেই সৌভাগ্য হয়নি, ভবিষ্যতে হবে বলে মনেও হয় না, অতএব বুডাপেস্ট আমাদের যাত্রার শেষ সঙ্গী।

রাস্তা পেরিয়ে আমরা চলেছি ড্যানিয়ুব নদীর দিকে। বুডাপেস্ট আসলে দুটো শহরের সন্ধিস্থল। আমরা যেদিকে আছি সেটা পেস্ট, নদীর অপর প্রান্তে বুডা। বুডা আর পেস্টের মাঝে ড্যানিয়ুব নদীর জনপ্রিয় সেতু 'সেনচেই চেইন ব্রিজ'।

এই সেতুর দুদিকেই অজস্র চোখধাঁধানো নিদর্শন আছে। সেতু পেরিয়ে গেলেই যে উঁচু পাহাড়টি চোখে পড়ে, তার নাম 'কাসল হিল'। পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত দুই বুডাপেস্ট শহরের দুই প্রতীক 'বুডা কাসল' এবং 'ফিশরম্যান ব্যাসটন'। এই দুটি দুর্গপ্রাসাদ ছাড়াও আরো বহু জায়গা আছে, সেগুলোর কথা এখন আর লিখছি না। পেস্টের দিকে আবার নানা ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশাপাশি নানা সরকারি দপ্তর। বুদাপেস্টের সংসদ অথবা 'পার্লিয়ামেন্ট'-এর বিশাল ভবনটি এদের মধ্যে অসামান্য সুন্দর। রাতে আলো জ্বললে সোনার প্রাসাদের মতন মনে হয়। 

চওড়া গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যুবক যুবতীদের হাসি দেখতে পাচ্ছি। অনেকে পার্টি করতে চলেছে, কয়েকজন স্কেট বোর্ড নিয়ে সাঁই-সাঁই করে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। পাড়াগুলো যে খুব অভিজাত সেরকম মনে হয় না, কিন্তু পরিবেশে বেশ একটা ফুর্তির ভাব আছে। দেওয়ালের ওপর নানাধরনের রংচঙে স্ট্রিট আর্টের নমুনা চোখে পড়ে আর চোখে পড়ে বহুদেশীয় রেস্তোরাঁ।

একসময় আমরা নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। হাঁটতে মিনিট তিরিশ লেগেছে। দূর থেকে আলোকিত সেনচেই চেইন সেতুর খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু নদীর সামনে এসে আমি সত্যি সত্যিই প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রতিটা নতুন দ্রষ্টব্য দেখে এরকম বাড়াবাড়ি রকম বিশেষণ দেওয়া অনেকের কাছে একঘেয়ে মনে হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে এমন সুন্দর রাতের দৃশ্য আমি সত্যিই আগে কোনোদিন দেখিনি। ড্যানিয়ুব নদী আর দু'দিকের অঞ্চলগুলো যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো। নদী এখানে বেশ চওড়া। হাঁটতে হাঁটতে আমরা চেইন সেতুর ওপর দিয়ে মাঝামাঝি গিয়ে দাঁড়ালাম। 

দূরে পার্লিয়ামেন্ট ভবনের আলোটা এমন ঝকমক করছে যে নদীর ধারের বাকি জায়গাগুলোর আকর্ষণ ম্লান হয়ে গেছে। সেতুর অন্যদিকে পাহাড়ের ওপরে দুর্গের আলো দেখা যাচ্ছে। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রূজগুলোর ওপরেই উদ্দাম পার্টি চলছে, তার রেশ ভেসে আসছে এখানেও। দূরের লিবার্টি ব্রিজ আর এলিজাবেথ সেতুর ওপর গাড়ির আনাগোনা আবছা ভাবে চোখে পড়ছে। নদীর দুই পাড়ের সোনালি আলোকরেখার প্রতিবিম্ব দ্যানিয়ুবের জলে এসে পড়ছে আর আমরা ভ্যাবলাকান্তের মত বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি সেদিকে। সত্যি, চোখের পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না। 

অনেকক্ষণ সময় কাটলে ধাতস্থ হলাম। সব সুন্দর দৃশ্যই একসময় চোখে সয়ে যায়। তখন সেটা না দেখতে পেলেই বরং বিস্ময় হয়। এদিকে রাতও হয়েছে। আমাদের পেটে বহুক্ষণ ধরেই ছুঁচোরা ডন মারছে। ফিরেই যখন যাচ্ছি, শেষ ক'দিন আর রান্নাবান্না করে কী হবে? আলোচনা করে ঠিক হল ওই রেস্তোরাঁতেই যাওয়া যাক, কোরিয়ান ছেলেমেয়ে দুটো যেটার  বলেছিল। জায়গাটার নাম লিখে রাখা হয়েছিল- ফ্রিচি পাপা। খাস হাঙ্গেরিয়ান স্থানীয় খাবার পাওয়া যাবে, দামও নাকি আয়ত্তের মধ্যে। 

খুঁজে খুঁজে চললাম পাপার কাছে। দলে-দলে ছেলেমেয়েরা রাস্তা দিয়ে চলেছে। বুডাপেস্টের 'নাইটলাইফ'-এর রমরমা আছে। খুব সস্তায় ভালো পানীয় এবং খাবারসহ সন্ধ্যাযাপনের ব্যবস্থা। এখন এমনিতেও গ্রীষ্মকাল চলছে, উৎসবেরই সময়। শীতকালে এরাই সব গিয়ে সেঁধোবে বাড়ির ভিতর, এ শহরে বরফের রাজত্ব চলবে। তখন নাইটলাইফ থাকে কি? থাকলে যে ঠিক কী রকম থাকে সেটা দেখার একটা সুপ্ত বাসনা রয়ে গেল মনে!

হাঁটাহাঁটি করলে জায়গাটার মেজাজ বুঝতে অনেকটাই সুবিধে হয়। গত তিনঘন্টা ধরে ক্রমাগত হাঁটছি, এইবার ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি বুডাপেস্ট বেশ 'দিলখুশ' কিসিমের জায়গা। এখানে কিছুই নিষিদ্ধ নয়, সব ধরনের মানুষের জন্য অবারিত দ্বার। এই খোলামেলা ভাবটা এখনকার মানুষের মধ্যেও খেয়াল করছি। পাশাপাশি শহরের পাড়াগুলোর মধ্যে বেশ একটা নতুন যৌবনের লাবণ্য আছে, কিসমিসের গন্ধ মাখানো প্রেম প্রেম ভাব আছে। মেটাল রক আছে, কান্ট্রি মিউজিক আছে, বালকান সঙ্গীত আছে, আবার ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালের সমঝদারও কম নেই। অসামান্য নিসর্গ আর বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ যেমন আছে, আয়ত্তের মধ্যে থাকা অগুনতি পাব, রেস্তোরাঁ আর রকবাজির আমুদে আড্ডারও অভাব নেই। এই তোয়াক্কাহীন বা 'দিলফেঁক' আমেজ যে ব্যাকপ্যাকারদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠবে, সে আর আশ্চর্য কি! ক্যাফেগুলোর বাইরে তুমুল আড্ডা চলছে, অনেকে খোলা গলায় (বা খালি গায়ে) গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে চলেছে। কেউ বারণ করে না। মিনিট কুড়ির মধ্যে কতবার যে অচেনা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে 'ফিস্ট বাম্প' করলাম, ফ্লাইং কিস বিনিময় করলাম, হাত তুলে অভিবাদন জানালাম বা নীরব হাসি ছুঁড়ে এগিয়ে গেলাম, তার কোনও হিসেব নেই। 

এই গলি ওই গলি করে শেষে ফ্রিচি পাপার কাছে চলে এলাম। দোকানের যে নামডাক আছে, সেটা ভিড়ের বহর দেখেই বুঝতে পারছি। এরা আবার খুচরো টাকা না হলে নেয় না, সুতরাং আমাদের আবার কিছুটা হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্ট বার করতে হল এটিএম থেকে। রেস্তোরাঁয় গিয়ে মেনু দেখে মাশরুম গুলাশ আর পাস্তার অর্ডার দিলাম। দিব্যি জায়গাটা। একদম স্থানীয় মানুষদের ঠেক যেমন হয়, তেমনই। টেবিলে টেবিলে জোর আলোচনা চলছে। উত্তপ্ত আলোচনা থেকে চুটকি হাসি, সব কিছুই আছে। বিজাতীয় ভাষার কথাবার্তা যদিও কিছুই বুঝলাম না, কিন্তু আড্ডার উষ্ণতার অনুভব করতে কষ্ট হল না। খাবারও চলে এল একসময়। ফ্রিচি পাপার রান্না সত্যিই ভালো। দারুণ ক্ষিদে পেয়েছিল। একদম সাপটে খেয়ে বাটি পরিষ্কার করে চেয়ার ছাড়লাম, তারপর সকলের দেখাদেখি হেঁড়ে গলায় গান করতে করতে বাড়ির পথ ধরলাম।


২) পরদিন সকাল সকাল আমাদের মোলাকাত হল বুডাপেস্টের সুলতানের সঙ্গে। ওহঃ! দুঃখিত! সুলতান নয়, নাম তার জুলতান। সাতসকালে সঙ্গিনী ভুল করে একটা দামি জায়গায় স্যালাদের মত কীসব হাবিজাবি খাইয়ে মেজাজ গরম করে দিয়েছিলেন, তেনার মতে অবশ্য সবটাই গুগল ম্যাপের চক্রান্ত। কিন্তু জুলতানের মুচকি হাসি আর গল্পের বহরে মেজাজ ভালো হতে খুব একটা সময় লাগল না। বুডাপেস্ট শহরে তারা কয়েকজন মিলে অন্যান্য শহরের মত ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর শুরু করেছে, খুবই আন্তরিক ভাবে শহরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় নবাগন্তুকদের। জুলতান খুব একটানা ইতিহাসের কচকচিতে যায় না, বরং স্থানীয় মানুষের স্বভাব চরিত্রের কথা বলে আড্ডা জমিয়ে রাখে জম্পেশ।

কথায়-কথায় জুলতান আমাদের জিগ্গেস করল, "ভেবে দেখ তো সারা দুনিয়ার লোক চেনে এমন কয়েকজন হাঙ্গেরিয়ান মানুষের নাম বলতে পারো কিনা?"

এই মরেছে। প্রেস্টিজে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার মতলব করছে জুলতান ব্যাটা! অত্তিলা জোসেফ এখানকার বিখ্যাত কবি সেটা জানি। তাঁর লেখা বিবিধ ভাষায় অনুবাদ হয়েছে; কিন্তু তাঁকে ঠিক সেলেব্রিটি বলা যায় না। ঔপন্যাসিক ইমরে কার্তেজ আর ম্যাগদা সাবোকে নিয়েও সেই একই ঝামেলা। মাথা চুলকোচ্ছি, এদিকে লোকজন দেখি পটাপট নাম বলছে। মার্কিন পরিচালক টনি কার্টিস, অভিনেত্রী রেচেল ওয়াইস, কেট হাডসন, এর্নো রুবিক। যাচ্চলে! এরা যে হাঙ্গেরির মানুষ আমি সেটাই জানতাম না। ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল পুরো। আচমকা চিড়িক করে একটা নাম এসে গেল মাথায়। বললাম," হুডিনি। ম্যাজিশিয়ান হ্যারি হুডিনি।"

জুলতান মাথা নেড়ে বলল,"হুমম। ঠিক হ্যায়। ম্যাজিশিয়ান ব্যাটা এখানে জন্মেছিল ঠিকই, কিন্তু কয়েকদিন পরেই ফুটে যায়। জীবনে কোনোদিন এখানে থাকেনি হুডিনি।" আমার চুপসে যাওয়া মুখটা তখন একেবারে পোড়া বেগুনভাজার মত হয়ে গেছে।

বুডাপেস্টের প্রধান রাস্তা আন্দ্রেসি অ্যাভেনিউ ধরে আমরা ওল্ড টাউনের গির্জার দিকে চলেছি। রাস্তার দু' ধারে নিও-গথিক শৈলীর বাড়ি এবং শৈল্পিক সমারোহের জন্যে এই রাস্তাটাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট করে দেওয়া হয়েছে, সেই সূত্রে অনেকেই দেখি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিমা করে একের পর এক ছবি তুলে চলেছে। গির্জাটি অবশ্য মোটের ওপর সাদামাঠাই। এই সফরে তাবড় তাবড় গির্জা দেখেছি, ভালো লাগার মাপকাঠি অনেক ওপরে উঠে গেছে। শুধু সুন্দর দেখলেই পুরো নম্বর দিই না। যতক্ষণ না একেবারে মাথা ঘুরে যায়, 'ব্রাউনি পয়েন্ট' দেওয়ায় কৃপণতাই করে চলি আজকাল। জুলতানকে সে কথা বলতে সে একগাল হেসে বলল, "ঠিক বলেছ। তবে জানো কি, বুডাপেস্টে গির্জা না দেখে বরং সিনাগগ দেখা উচিৎ। ইউরোপের সর্ববৃহৎ সিনাগগ হল এখানে। রঙের বাহার দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। মুশকিল হল কাজ হচ্ছে বলে সিনাগগটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে, তাও বাইরে থেকে দেখলে খানিকটা আন্দাজ পাবে।"

হাই তুলে বললাম, "জুলতান স্যার, সময়ের বড় অভাব। আর পকেটও হাতখাড়া করে দিয়েছে। এত-এত জায়গা দেখাও হবে না। একটা জায়গা দেখতে হলে কী দেখব বল দেখি?"

জুলতান মাথা নেড়ে বলল, "একটা জিনিস দেখতে হলে তোমরা স্নানঘরগুলো ঘুরে এস। অটোমান সাম্রাজ্যের সময় অনেকগুলো থার্মাল বাথ তৈরি করা হয়েছিল, অনেকটা টার্কিশ বাথের মতন। ও জিনিস একমাত্র ইস্তাম্বুল ছাড়া কোথাও পাবে না।"

আমি বললাম, "সে কী হে! সবগুলো দেখতে গেলে আমাদের এয়ারপোর্ট যাওয়ার টাকা ফুরিয়ে যাবে হে! দেখতে পাচ্ছ না ফ্রি ওয়াক করছি, তোমার বরাদ্দ টিপও দিতে পারব কি না সন্দেহ আছে। একটা সস্তার বাথহাউসের খবর দাও সোনা।"

জুলতান একগাল হেসে আমার কাঁধে একটা রামপ্রসাদী চাপড় মেরে বলল, "বটে! তাই সই। তোমরা তাহলে গ্যালার্ট বাথ থেকে ঘুরে এস। সেনচেই থার্মাল বাথ সবচেয়ে বড় ঠিকই কিন্তু গ্যালার্ট হিলের স্নানাগারটার একটা আলাদা জৌলুস আছে। দেখে ভড়কে যাবে নিশ্চিত।"

এইবার আমি আনাচে কানাচে দেখে নিয়ে বললাম, "জুলতান, এখানে শুনেছি বহু ভুতের বাড়ি আছে? সেখানে নাইটক্লাব হয়ে গেছে? সেখানে গেলে ভূত-ফুত দেখার চান্স মিলবে নাকি?"

"তোমার ভাগ্য সদয় থাকলে মিলতেও পারে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আসলে ভূত।" জুলতান খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, "ওই নাইটক্লাবগুলোকে বলে রুইন বার। কিন্তু সত্যিকারের ভূত আজকাল উবে গিয়েছে। তবে জানো তো বুডাপেস্ট বহু ভুতুড়ে কাণ্ড হয়েছে এককালে। তিরিশের দশকে পিয়ানোবাদক রেজসো সেরেস 'গ্লুমি সানডে' বলে একটা গান রচনা করেছিলেন, সেটা শুনেই লোকে আত্মহত্যা করত। গানের নামই হয়ে গিয়েছিল সুইসাইড সঙ। মোট এগারোটা আত্মহত্যার সঙ্গে ওই গানের সংযোগ পাওয়া যায়। তারপর সরকারি আদেশে সেই গানটা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। ভয়ানক কেস। "

"উরিব্বাস! তারপর!"

"তারপর আর কি? সেই দুঃখে রেজসো সেরেস বেচারা নিজেও আত্মহত্যা করেন।" জুলতানের মহানন্দে বলল।

কী সর্বনেশে কেস রে ভাই! ঠিকঠাক করে ঝাড়তে পারলে নির্ঘাত একটা বাংলা উপন্যাস হয়ে যাবে। রেজসো সেরেস ঠিক কী গান গাইতেন জানি না, তবে এখন এক জনপ্রিয় ইউটিউব গায়িকার জ্বালাময়ী গান শুনে আমার নিজেরই আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়। শ্রোতাদের অবশ্য হেলদোল নেই। আজকালকার মানুষের ক্যালি আছে। টিকটকে মাঝে মাঝে যে ধরনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে হুড়োহুড়ি হয়, সেসব শুনিয়ে দিলে রেজসো সেরেস থেকে মোৎসার্ট, প্রত্যেকেই তল্পিতল্পা নিয়ে দেশান্তরী হতেন। 

গির্জা দেখে, অপেরা হাউসে উঁকি মেরে, সেনচেই ব্রিজ পার করে অন্যদিকে চলে এলাম। এর মাঝে দু ঘন্টা চলে গেছে। হেঁটে হেঁটে অনেকের পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে বলে জুলতান মিনিট কুড়ির জন্যে বিশ্রাম দিল। এরপর পাহাড়ের চড়াই আছে। আমরা সকলে কাসল হিলের কাছে অবস্থিত ছোট্ট পার্কে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। 

একটা হাই তুলে সঙ্গিনীকে বললাম, "কী ঠিক করলি? ভূতের বাড়িতে নাচতে যাবি না স্নান করতে যাবি? নাকি দুটোতেই যাবি?"

সঙ্গিনীও হাই তুলে প্রশ্ন করলেন, "নাকি ডাক্তারের কাছে যাবি? মাথার অবস্থাটা তো ভালো বুঝছি না।"

ধুত্তোর! আমি একটা গভীর আলোচনা করতে চাইছি, তার মধ্যে এইসব ইয়ার্কি ভালো লাগে? না হয় মাথায় একটু ছিট আছে,  কিন্তু সেটা চাউর করার কী আছে রে ভাই? নাচতে না যাস না যাবি, অত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কী দরকার? বুডাপেস্টে দারুণ দারুণ 'রুইন বার' আছে, সে কথা অনেক আগেই শুনেছি। পুরোনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষে সারিয়ে-সুরিয়ে দিব্যি নাইটক্লাব করে দেওয়া হয়েছে। রোজ রাতে ভূতুড়ে বাড়িগুলোতে দেদার নাচগান হয়, সেখানে না গেলে নাকি বুডাপেস্টে আসাই ব্যর্থ। চুলোয় যাক! না গেলে আমি না হয় একাই গিয়ে শিবের নেত্য নেচে আসব।

পাহাড়ে উঠতে উঠতে আমার মাথায় আবার জিওপলিটিক্সের পোকা নড়ে উঠল। জুলতানকে জিগ্গেস করলাম, "তোমাদের দেশে যে রাজনৈতিক আদর্শের এমন পরিবর্তন হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, সেটা নিয়ে সাধারণ মানুষের কী ধারণা?"

জুলতান জিগ্গেস করল, "পরিবর্তন বলতে?"

আমি উত্তর দিলাম, "এই ধরো হাঙ্গেরি তো জার্মানির পক্ষে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেইসময় তো এখানে গণহত্যায় লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে। তারপর সোভিয়েত রাশিয়ার দখলে আসার পর সাম্যবাদী ব্যবস্থা চলে আসে। সেটাও যে খুব সুখকর ছিল না, সেটা তো ১৯৫৬ সালের বিপ্লবেই বোঝা গিয়েছিল। তারপর হাঙ্গেরির রাজনীতিবিদরা পুঁজিবাদ আর তথাকথিত সমাজতন্ত্রের মাঝামাঝি একটা জায়গা পেতে চেয়েছিল। আজকাল তো মনে হয় কমিউনিজম মাথায় উঠেছে, পুরোপুরি পশ্চিমী কায়দায় অর্থনীতি চলছে। তাই জিগ্গেস করছি যে যারা এই সময়টা পেরিয়ে এসেছেন, তাদের এ নিয়ে মতামত কী?"

জুলতান মন দিয়ে শুনছিল। সে বলল, "অনেকগুলো ব্যাপার আছে। আসল কথা হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাঙ্গেরির সামনে হিটলারের কথা স্বীকার করা ছাড়া  কোনও  উপায়ই ছিল না। গরীব দেশ, সব অস্ত্রই আসত জার্মানি থেকে। তাও অনেকে চেষ্টা করেছিল মাঝামাঝির একটা রাস্তা বের করতে। হিটলার তাদের এমন ভয় দেখায় যে বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত বেচারাদের যুদ্ধে সেনা পাঠাতে হয়। এর ফলও তারা ভোগ করেছিল হাতেনাতেই। স্টালিনের সৈন্যরা সে সময় প্রায় কচুকাটা করেছে হাঙ্গেরির সৈন্যদের। নাজিরা মহা ঘোড়েল, বিপদ বুঝে আগেই পিটটান দিয়েছিল, এগিয়ে দিয়েছিল এই ভাড়াটে সৈনিকদের। স্বভাবতই সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন দেশ উদ্ধার করে দাদাগিরি শুরু করল, কেউই ভয়ে তাদের কিছু বলতে পারেনি। সে যুগে বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক ঋণ ছিল দেশের মাথায়, ভূখণ্ডের অনেকটা দিতে হয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়াকে। এই অবস্থায় সোশ্যালিস্ট আর কমিউনিস্ট বিচারধারা যে ক্ষমতা নিতে আসবে, সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু সে ব্যবস্থায় যে মানুষের খুব লাভ হয়েছিল সে তো নয়। পাসপোর্ট পর্যন্ত পাওয়া যেত না। দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি ছিল। আরো নানান নিয়মকানুন ছিল, যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। কিন্তু জীবনধারণের জন্যে প্রতিদিনের জিনিসপত্র যা লাগে, সেইসব কিন্তু সস্তা ছিল খুব। শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যবস্থাও খুব একটা দুর্মূল্য ছিল না। সেই নিয়ে খানিকটা হলেও পুরোনো আমলের মানুষদের মধ্যে 'সফ্ট স্পট' আছে। আজকাল তো পুরো উল্টো গঙ্গা বইছে। বুডাপেস্ট দিন দিন দামী জায়গা হয়ে উঠছে। আর্থিক প্রতিস্পর্ধায় নিম্নস্তরের মানুষেরা পিছিয়ে পড়ছে, শ্রেণীবিভেদ বাড়ছে চড়চড়িয়ে। তোমরা বরং কালকে দুপুরের কমিউনিজম ওয়াকে চলে যেও। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবে।"

অনেকটা রাস্তা চড়াই উঠে তারপর সিঁড়ি পাওয়া গেল। বাসে করেও আসা যায় কিন্তু আমরা ওয়াকিং ট্যুর করছি বলেই হেঁটে আসা। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ফিশরম্যান ব্যাসটন-এর বৈভবশালী প্রাসাদ। ফাউ হল এখান থেকে দেখতে পাওয়া চেইন ব্রিজ এবং পেস্ট শহরের দিকের অসামান্য দৃশ্য। এত ওপর থেকে প্রায় সারা শহরটাই দেখা যায়। সেই ছবি তুলতে লোকে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পাঁচিলের গায়ে। প্রাসাদটি যেরকম ছবিতে দেখেছিলাম, হুবহু সেরকম। নিও গথিক ও রোমান্টিক শৈলীর সঙ্গে খানিকটা মডার্ন আর্ট মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। একাধিক ভবন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সময় নিয়ে দেখতে হয়, স্থাপত্যকলা নিয়ে আগ্রহ থাকলে এই ভবনগুলো প্রায় শিক্ষাকেন্দ্রের সমান।  

প্রাসাদের পিছন দিকে একটা ছায়াঘেরা উদ্যান। সেখানে এসে সকলে ছায়ায় বসল। ওয়াকিং ট্যুর এখানেই শেষ হবে, জুলতান বিদায় জানানোর আগে অনেকগুলো তথ্য দিয়ে দিল অন্যান্য জায়গা সম্পর্কে। এও জানা গেল যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রুইন বার হল গিয়ে 'সিমপ্লা কার্ট'। শুধুমাত্র একটা জায়গাতেই যেতে হলে ওই জায়গাটা নির্বাচিত করাই বেস্ট।

জুলতানকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাসে করে আমরা নেমে এলাম পাহাড়ের নিচে। বেশ রোদ হয়েছে। আমাদের পাড়ার ওদিকে একটা বাংলাদেশী রেস্তোরাঁ দেখে এসেছি, ওখানেই যাওয়া হবে। আজকে আমাদের বাঙালি খাবার খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। জায়গাটা খুঁজে বার করতে অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ ইউরোপে থাকেন, ব্যবসাপত্তর করেন। এই দোকানের মালিকও সেরকম একজন মানুষ। তবে বাংলাদেশের রেস্তোরাঁ বলে যে কাচ্চি বিরিয়ানি পাওয়া যাবে তা নয়! স্থানীয় মানুষের চাহিদা অনুযায়ীই রান্না হয় সাধারণত। যাই হোক, আমাদের ভাত ডাল হলেও ক্ষতি নেই।  বাংলায় অর্ডার দিতে কি ভালই না লাগল! খাবারের স্বাদও খারাপ নয়, খেয়েদেয়ে পাশের সুপারমার্কেট থেকে চকোলেট কিনে দেওয়ালে আঁকা স্ট্রিট আর্টের নমুনা দেখতে দেখতে বাড়ির দিকে চললাম। পথে অনেকগুলো বইয়ের দোকান, সেখানে একমনে বসে বই পড়ছে ছেলেমেয়েরা। দেখেও ভালো লাগে। 

হাঙ্গেরির মানুষজন সাহিত্যপ্রেমিক সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কঠোর সরকারি আইন ও দমনমূলক শাসন ব্যবস্থায় এত বছর কাটিয়েও যে পরিমাণ বিশ্বমানের সাহিত্য ও শিল্প এরা রচনা করেছে, তাকে ব্যতিক্রমই বলতে হবে। ভাষার সীমানার জন্যে এখানকার বহু সাহিত্যিকের রচনার কথা বাইরের লোকে জানতে পারে না। কিন্তু একটু খোঁজখবর নিলেই জানা যাবে যে ইউরোপিয়ান প্রকাশনার বাজারে তাঁদের যথেষ্ট সমীহ করা হয়। এখানকার একজনের সাহিত্যিকের অবশ্য সকলেই জানে, তিনি কবি অত্তিলা জোসেফ। তাঁর কবিতা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যদিও হাঙ্গেরির এই কবি মারা গিয়েছিলেন মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে। লা মুয়েদেত অথবা অভিশপ্ত কবিদের উল্লেখ আগেও করেছি, তাঁদের আরেকজন হলেন কবি অত্তিলা জোসেফ। অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা সত্ত্বেও সারা জীবন তিনি কাটিয়েছেন চরম দারিদ্র্য আর দুর্ভাগ্য নিয়েই। বাবা ছোটবেলাতেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, মা তাঁকে সহ্য করতে পারতেন না। সাত বছর বয়সে সেই কচি ছেলেকে দত্তক সন্তান নিতে আগ্রহী এক পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাতেও খুব একটা সুবিধা হয়নি। দুঃখকষ্টের মধ্যেই বড় হয়েছেন, পড়াশুনা করেছেন। বুডাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন একসময়। কিন্তু শয়তানের পক্ষ নিয়ে একটি বিতর্কিত কবিতা লেখার দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার ফলে কলেজের পড়াও এগোয়নি। অত্তিলা জীবনে বহু ধরনের কাজ করেছেন, দেখেছেন চরম অন্নকষ্ট। মাঝেমধ্যেই খেতে পেতেন না, শীতের কাপড়ও সম্বল ছিল না। রাতে কাঁপতেন থরথর করে, জ্বরজ্বারি লেগেই থাকত। এরই মধ্যে লিখে গিয়েছেন অবিরাম। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছিল যৌবনেই। ১৯৩৭ সালে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে অসুস্থ অবস্থায় ট্রেনের সামনে গিয়ে আত্মহত্যা করেন জোসেফ। তাঁর দীর্ঘ কবিতা 'সেভেন্থ' পড়লে সম্ভবত তার মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। গেবর তজসের ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন 




If you write and can afford it,

let seven men write your poem.

One, who builds a marble village,

one, who was born in his sleep,

one, who charts the sky and knows it,

one, whom words call by his name,

one, who perfected his soul,

one, who dissects living rats.

Two are brave and four are wise;

You yourself must be the seventh


And if all went as was written,

you will die for seven men.

One, who is rocked and suckled,

one, who grabs a hard young breast,

one, who throws down empty dishes,

one, who helps the poor win;

one, who worked till he goes to pieces,

one, who just stares at the moon.

The world will be your tombstone:

you yourself must be the seventh

অত্তিলা জোসেফ অবশ্য একা নন, গত পঞ্চাশ বছরেও হাঙ্গেরিতে অসংখ্য ভালো সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ করেছেন। ইমরে কার্তেজ নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। বুকারজয়ী লাজলো ক্রাসনাওহোরকের লেখা পড়ে বিখ্যাত প্রবন্ধকার ও আলোচক সুসান সোনট্যাগ তাঁকে 'মাস্টার অফ দ্য অ্যাপোক্লিপ্স' আখ্যা দিয়েছিলেন। পিটার নাদাসের উচ্চাকাঙ্খী প্রজেক্ট 'আ বুক অফ মেমোয়ার্স',  ম্যাগদা সাবোর 'দ্য ডোর' আর আতিলা বার্টিসের 'ট্র্যাঙ্কুয়ালিটি' সহ বেশ কিছু বই অন্যান্য ভাষার পাঠকদের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠেছে। সমসাময়িক কবি লেখকদের মধ্যে ডেনিস ক্রুসভস্কি, রেকা মান-ভারহেজ, ক্রিস্টিয়ান গ্রেস্কো, এদিনা ভোরেন, আত্তিলা ভেরেসরাও যথেষ্ট সাড়া ফেলেছেন। 

Related image
Random Shot from Castle Hill

Shoes on Danube Bank

বিকেলে কোথায় যাব, সেই পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল। সিমপ্লা কার্ট-এর রুইন বার। কিন্তু তার আগে ড্যানিযুবের সঙ্গে আরো খানিকটা পরিচিতি বাড়ানো দরকার। নদীর ধার দিয়ে ট্রাম যায় সোজা পার্লিয়ামেন্ট পর্যন্ত, আমরাও সেই ট্রামে উঠে চললুম। বাঁ দিকে ড্যানিয়ুবের কোবাল্ট ব্লু জল আর ডানদিকে গথিক আর বারোক শৈলীর নিদর্শন দেখতে দেখতে একসময় পার্লিয়ামেন্ট চত্বরে পৌঁছে গেলাম। বারোক শৈলীর এই সুবিশাল স্থাপত্যের অলঙ্করণ দেখলে যেমন মুগ্ধ হতে হয়, তেমনই মুগ্ধ হতে হয় এই চত্বরের পরিবেশ দেখলে। নদীর ঠিক ধরে অবস্থিত এই চত্বরে অনেকগুলো বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে গাছের সারি। শেষ বিকেলের সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্যানিয়ুবের বুকে সূর্য ডুবে যাবে। নদীর দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেই ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়।

একসময় সত্যি সূর্যাস্ত হল। আলো জ্বলে উঠলো চারিদিকে। কাল দূর থেকে দেখা সোনালি আলোর অট্টালিকা আজ আমাদের চোখের সামনে, আলোর দ্যুতিতে অপূর্ব দেখাচ্ছে তাকে। নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চললাম চেইন সেতুর দিকে। মাঝের একটা জায়গায় অনেকগুলো জুতো পড়ে আছে। আসল জুতো নয়, জুতোর প্রতিকৃতি। জায়গাটার কথা আমাদের বলেছিল জুলতান। ১৯৪৪-৪৫ সালে অ্যারো ক্রস পার্টি অসংখ্য মানুষকে গুলি করেছিল এই স্থানে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন ইহুদি। গুলি খেয়ে তারা উল্টে পড়ত ড্যানিয়ুব নদীতে। রক্তে লাল হয়ে উঠত নদীর রং। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি থেকেই নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতিসৌধ। খেয়াল করলে দেখা যায় বাচ্চাদের জুতোও আছে এদের মধ্যে। শিশুরাও এই মৃত্যুকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি সেই সময়ে। সেই ঘটনার কথা ভাবলে আজও বুক কেঁপে ওঠে। 

ব্রিজ পেরিয়ে পায়ে হাঁটা আলোআঁধারি চড়াই রাস্তা দিয়ে উঠে বুডা কাসলের চত্বরে চলে এলাম। এখান থেকে চেইন  সেতুর দুই প্রান্তই দেখা যাচ্ছে, সঙ্গে দেখা যাচ্ছে সোনালি আলোয় স্নান করে থাকা পেস্ট অঞ্চল। এমন অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য গত কয়েকমাসেও বার দুয়েক দেখেছি হয়তো। কোন-কোন দৃশ্য অমলিন স্মৃতি হয়ে মনে রয়ে যায় চিরকালের জন্যে। যতটা সম্ভব চোখের সামনের পৃথিবীটা মনের ক্যামেরায় বন্দী করে রাখার চেষ্টা করি তখন। এই সঞ্চয়ের কোনও দাম হয় না। 

অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার নেমে এলাম। পরবর্তী গন্তব্য সিমপ্লা কার্ট। সেখানে গিয়েও আরেকপ্রস্থ তাজ্জব হতে হল। সঙ্গিনী সকালে মুখ ভেটকালে কী হবে, তিনিও সঙ্গে এসেছেন ঠিকই। এমন ভাঙাচোরা ভূতুড়ে বাড়িকে আলো আঁধারি পরিবেশ আর ডিস্কোলাইট সহ গান চালিয়ে যে রূপ দেওয়া হয়েছে তাতে তাবড়-তাবড় পাঁচতারা হোটেলের নাইটক্লাবরাও লজ্জা পাবে। তিনতলা জুড়ে ডিস্কো লাইট, অনেকগুলো কাউন্টার আছে। কোথাও খাবার, কোথাও ওয়াইন, কোথাও স্থানীয় পানীয় পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে মানানসই গানের সুরও বাজছে, তালে তালে নাচছে লোকজন। সত্যিই ধাঁধা লেগে যায়। ওয়াইন হাতে আমরাও সেই দলে ভিড়ে গেলাম। তারপর কী হল, সেটা বরং উহ্য থাক। পাঠকরা বরং যা ইচ্ছে ভেবে নিন।  কল্পনার উড়ান বলেও তো একটা জিনিস আছে। 


৩) হাতে মাত্র একদিনই ছিল। পরের দিন সাতসকালে বাসে করে চলে এলাম গ্যালার্ট হিলের বাথহাউস অর্থাৎ স্নানাগারে। নামেই স্নানাগার, আসলে দেখে মনে হয় রাজবাড়ি অথবা বিলাসবহুল অট্টালিকা। ঝাঁ চকচকে সোনালি মেঝে, বড় বড় শৌখিন ঝারণবাতি ঝুলছে উঁচু সিলিং থেকে। ছাদে নানাধরনের শৈল্পিক অলঙ্করণ করা। 

ব্যবস্থা বেশ ভালো। নিজস্ব লকার পাওয়া যায়। সেখানে জামাকাপড় রেখে সাঁতারের পোশাক পরে ভিতরে যেতে হয়। অনেকগুলো সুইমিং পুল অথবা স্নানাগার আছে, কয়েকটা ভিতরে কয়েকটা বাইরে। এদের মধ্যে অনেকগুলো 'থার্মাল বাথ' অর্থাৎ উষ্ণ প্রস্রবণ। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত করা আছে। যেখানে খুশি নেমে পড়লেই হল। ভিতরের স্নানাগারগুলো বেশি সুন্দর, ছাদের দিকে মাথা তুললেই মনে হয় রাজবাড়ির নিজস্ব স্নানাগারে স্নান করছি। দেওয়ালের জৌলুসও কম নয়। আঁকিবুঁকির জৌলুস আছে ভালোই, সঙ্গে রঙিন টাইলে খোদাই করা শিল্পাকৃতি। 

ঘুরে ঘুরে সবগুলো স্নানাগারেই স্নান হল। মনে মনে ভাবলাম, অনেক পুণ্য করেছি বলে এখানে আসা। আবার অন্যদিক থেকেও দেখা যায়। গত কয়েকমাসের যত পাপ, ধুয়ে নিলাম এই রাজকীয় স্নানে। এরকম আরো বহু স্নানাগার আছে বুডাপেস্ট শহরে। সেগুলো না হয় পরেরবারের জন্যে তোলা রইল। দুপুরবেলা আমরা জুলতানের কথা মতো কমিউনিজম ওয়াক করব বলে ঠিক করেছিলাম। সেইমতো নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি সময়মতো। গাইডের নাম মার্ক, বয়স অল্প। আমাদের সঙ্গে সেই যাবে। ইতিহাসের নানা পরিচিত ও অপরিচিত ঘটনা নিয়ে আমাদের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল সে দিন। ঘটনাগুলো অনেকের কাছে জানা হলেও আমি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করে রাখছি।

মার্কো ব্যাগে করে কয়েকটা ছবি নিয়ে এসেছিল। তার প্রথম দুটি ছবি ছিল মাত্যাস রাকোসী এবং ইমরে নেগীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক পার্টির দায়িত্ব নিয়েছিলেন মাত্যাস রাকোসী। তাঁর চাপিয়ে দেওয়া কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা মানতে গিয়ে সাধারণ মানুষের প্রায় প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। ১৯৫৩ সালে স্টালিন মারা যান এবং ইস্টার্ন ব্লক-এর দেশগুলোর সাহায্য চেয়ে ১৯৫৫ সোভিয়েত ইউনিয়ন ওয়ারশ প্যাক্ট-এর চুক্তি করে। এদিকে সাধারণ মানুষের ওপর হতে থাকা জোরজুলুমে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছিল। ১৯৫৬ সালে ছাত্রসংঘ ষোলটি আবেদন জানিয়ে সরকারকে চিঠি পাঠায় এবং রেডিওর দপ্তরে ঢুকে তাদের বক্তব্য সম্প্রচার করার চেষ্টা করে। সে চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের সকলকেই ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনার জেরই বিপ্লব ডেকে আনল। সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। বিক্ষোভসৃষ্টিকারীরা সত্যি বলতে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি, রাজনৈতিক আদর্শের বিশেষ ভূমিকা ছিল না এই বিপ্লবে। মোদ্দা কথা হল, দেশের সরকারের স্বৈরশাসক মনোভাব আর দাদাগিরি তাদের সহ্য হয়নি। বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে এসে মিছিল করতে শুরু করে দিনের পর দিন ধরে। সরকারও নাছোড়বান্দা। তারা বিক্ষোভ দমন করার জন্য সোজা গুলি চালাতে নির্দেশ দেয়। সরকারের পক্ষের অনেকেই আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতের পুতুল ছিলেন, তাদের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি কতটা ছিল তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গিয়েছে আজও। 

বিক্ষোভ কিন্তু থামেনি। এই ঘটনার পর ৫৬ সালের বিপ্লব আরো ভয়ানক চেহারা নেই। ছাত্রদের সঙ্গে এসে জোটে কৃষক এবং সাধারণ মানুষেরা। ইমরে নেগীকে ডেকে নিয়ে আসা হয় বিপ্লবে নেতৃত্ব করার জন্যে। আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরে নেগী, কমিউনিস্ট মতে বিশ্বাসী হলেও তিনি  ছিলেন মুক্তমনা, নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা তার স্বভাবে ছিল না। সমাজতন্ত্র বলে যে দেশের মানুষকে শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে নির্যাতন করা হবে, কোনোরকম সুযোগসুবিধে দেওয়া হবে না, এই মানসিকতাকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন প্রথম থেকেই। বিপ্লব শুরু হতে তিনি এই আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। 

এই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে হাঙ্গেরির গ্রামে গ্রামে। একসময় বিপ্লবীরা দখল করে নেয় বুডাপেস্টের সরকারি দপ্তরগুলো। কমিউনিস্ট সৈন্যরা পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু এই সাফল্যও খুব বেশিদিন থাকেনি। প্রথমদিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন কয়েকদিনের মধ্যে পেল্লায় বাহিনী পাঠিয়ে আবার কব্জা করে নেয় বুডাপেস্ট। শত-শত বিপ্লবীকে শুলে চড়ানো হয়। অনেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান দেশ থেকে। ইমরে নেগীও পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ভাগ্য সহায় হয়নি। রাজনৈতিক চক্রান্তের অপরাধে তাঁকে মৃত্যদন্ড দেওয়া হয়।


আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ১৯৫৬ সালের এই গণবিপ্লবের কথা বহুদিন পৃথিবীর মানুষ জানতে পারেনি। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী সংবাদপত্রে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। লোকে জানতে পারে যে এই বিপ্লব নিছকই সমাজতান্ত্রিক বিরোধীদের চক্রান্ত ছিল। দেশের সাধারণ মানুষ যে সরকারের নিরঙ্কুশ ব্যবহার আর কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সে খবর চাপা পড়ে থাকে বহুবছর। এর পর অবশ্য হাঙ্গেরির সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেকটাই শিথিল হতে থাকে ধীরে ধীরে। কঠোর নিয়ম তুলে নিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। হাঙ্গেরির ইতিহাসে এই মিশ্র ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে 'গুলাশ কমিউনিজম'।

মার্ক আমাদের ঘুরে ঘুরে ১৯৫৬ সালের বিপ্লবের নানান চিহ্ন দেখাল। সেই রেডিও হাউস, সংসদ চত্বরের দেওয়ালে মিছিলের ওপর চালানো গুলির চিহ্ন আজও একইরকম আছে। শহরের অচেনা গলিঘুঁজিতে নিয়ে যাওয়ার সুবাদে এমন সমস্ত কাহিনি শোনা হল, যা এমনিতে জানা আমাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল।  


Related image

Related image
Szimpla Kert-Budapest Ruin Bar
Image result for budapest gellert bath
Gallart Bath

ঘন্টাদুয়েক পর মার্ককে বিদায় জানালাম। সন্ধ্যে হতে আর দেরি নেই। সামনেই ড্যানিয়ুব নদী দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম। সেই বিদায় মুহূর্ত সত্যিই চলে এল। স্মৃতির সঞ্চয়ে কতই না সূর্যাস্ত আছে।  কোনও  কোন দিন রোমাঞ্চিত হয়েছি, আবদ্ধ হয়েছি বিস্ময়ে। ভালো লাগার আবেশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু আজ প্রথম ড্যানিয়ুবের বুকের এই সূর্যাস্ত একটা মনকেমন করা আবেগ নিয়ে এসেছে। গোলাপি আলো ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে জলে। স্নিগ্ধ পরিবেশে উড়ে যাচ্ছে ঘরে ফেরা পাখির দল। আমার গলার কাছটা আবার ভারী ভারী লাগে। আবার চোখ ভিজে যায় নিয়ম মেনে। আর কি কোনোদিন ফেরা হবে?

হয়তো বহু বছর পড়ে হঠাৎ করে এই মুহুর্তটা জেগে উঠবে চোখের সামনে। ঠিক বাস্তবের মতো! হাতছানি দিয়ে ডাকবে ফিরে আসতে। আমি মনে মনে হাসব। এই সম্পর্কটা বড় অদ্ভুত। ফিরে তাকালে শুধু পথটুকু মনে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত জীবনের গল্প অথবা সাদাকালো স্মৃতি। কয়েক বছর পর সেই স্মৃতিও আবছা হয়ে আসে। গতিশীল ঘটনাগুলো মুছে গিয়ে কয়েকটা ফ্রেম পড়ে থাকে। সেই নামহীন ফ্রেম নিয়ে আবার এগিয়ে যাই। অন্য  কোনও  দেশের পথে, অন্য কোনও গল্পের খাতিরে, নিরুদ্দেশের যাত্রায়। এই স্বপ্নটাই বেঁচে থাক। বেঁচে থাক গন্তব্যহীন পথ। শুধু সেইটুকুই তো চাই। শুধু সেইটুকুই তো চেয়েছিলাম। আমি সত্যিই নিরুদ্দেশ হতে চেয়েছিলাম। 


-সমাপ্ত-

আগের পর্ব এখানে পড়ুন 

যাত্রার শুরু থেকে পড়তে হলে 
যাত্রা শুরু-মাদ্রিদ 

বই কিনতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন



রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২০

পরিবর্তনশীল প্রাগ

কাফকা, কাসল এবং কল্পনাইস্টার্ন ব্লক থেকে চেক রিপাবলিক
Charles Bridge Prague

স্মৃতিরা আবদ্ধ করে রাখে মাঝে মাঝে

কাঁচি দিয়ে কাটা যায় না কঠিন বুনন

সুতো হোক অথবা দড়ি!


শিল্পীদের বাড়ির পাশের সেতুটি দেখছেন?

সেই সেতুরই কাছে ছেলেটিকে গুলি করেছিল পুলিশ

সে হেঁটে আসছিল আমারই দিকে


কিন্তু আজও হেঁটে গেলে স্মৃতিটুকু ফিরে আসে

হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাই পাশাপাশি

আমার তখন কতই বা বয়স? মাত্র কুড়ি! 


ইহুদী কবরখানার শুনশান গলিপথে

যেখানে তাদের রাইফেলের হাত থেকে বাঁচতে

আমি ছুটে গিয়েছিলাম ফটকের অভিমুখে


অনিশ্চিত পদক্ষেপে বছর এগিয়ে যায়

সঙ্গে আমিও চলি, শুধু মেয়াদ ফুরিয়ে যায়

তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়...সময়! 

~জারোস্লাভ সেইফের্ত

১) “আর কত বাকি আছে রে?" নাক মুখ কুঁচকে জিগ্গেস করলাম সঙ্গিনীকে।

মোবাইল ঘেঁটে তিনি উত্তর দিলেন, “কুড়িয়ে-কাচিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তোর কথা যদি ভুল হয় তাহলে সোজা ভাল্টাভা নদীতে লাফিয়ে পড়িস।”

“মানে?” আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ই আবার কী কাণ্ড ভাই?টাকা কম হলে খুব বড়জোর না খেয়ে রাত কাটাতে হবে। নদীর জলে লাফাব ক্যানে? ব্যাকপ্যাকারদের শাস্ত্রে ওই সব পাগলামির নিধান নেই। তাও যদি আমরা মারিজুয়ানা- ফুয়ানা নিয়ে ঘুরতাম।

সঙ্গিনী নিশ্চিন্ত মুখে বললেন, “খুব তো কনফিডেন্স দেখাচ্ছিলি ইস্টার্ন ব্লক সস্তা বলে। সব জিনিসপত্র নাকি জলের দরে পাওয়া যাবে। ভুল হলে বুঝব তোর মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল বলেও ওইসব আট-ভাট বকছিলি। তাই নদীতে লাফালে জল খেয়ে পেটও ভরবে, মাথাও ঠান্ডা হবে।” 

এইবার আমি একটা অবজ্ঞার হাসি দিলাম। ইল্লি আর টকের আলু? হুঁহ! যত্তসব! আমি সেই হাফপ্যান্ট পরা বয়স থেকে বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা করছি? আমার ইনফরমেশনে ভুল হবে? কভি নেহি। আর প্রাগ? প্রাগ তো আমার নিজের শহর। মনে মনে কতবার আমি এই শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেরিয়েছি। ভাল্টাভা নদীর ধারে অবস্থিত পার্কের বেঞ্চে বসে বিষণ্ণনয়না মহিলাদের সঙ্গে গল্প করেছি, শীতের রাতে ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় দাঁড়িয়ে নীল বরফের কুচি হাতে নিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি, তারপর বেসমেন্ট বিয়ার হাউস আর স্থানীয় 'হোস্পদা'-য় গিয়ে বিয়ার হাতে রাত্রি কাটিয়েছি। কারেল হিনেক মারওয়া আর কাফকার সাহিত্য নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা করেছি চেক বন্ধুদের সঙ্গে, জানুয়ারির হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে মরুভূমির উষ্ণতা অনুভব করেছি, মাল্স্ত্রদার ক্যাফেতে বসে বোজেনা নেমকোভার উপন্যাস 'গ্র্যান্ডমাদার' পড়েছি আর জিরি ওয়াইসের পরিচালিত সিনেমা 'রোমিও জুলিয়েট অ্যান্ড ডার্কনেস' দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। সময় আর দূরত্বের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে এই শহর কখন যে আমার নিজের শহর হয়ে উঠেছে, সে আমারও জানা নেই। কী করে? সেই রহস্য ফাঁস করব, কিন্তু তার আগে খানিক গৌর চন্দ্রিকা সেরে নেওয়া যাক। 

ইউরোপের পূর্বদিক অথবা চলিত ভাষায় 'ইস্টার্ন ব্লক'-এর দেশগুলো নিয়ে আমার মনে আগ্রহ প্রথম থেকেই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত দেশের 'রেড আর্মি' এসে চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গরি, পোল্যান্ড সহ বেশ কিছু রাষ্ট্রকে নাজিদের কবল থেকে মুক্ত করে। এই প্রত্যেকটা দেশেই যুদ্ধের পর কমিউনিজম ঘাঁটি গেড়েছিল, ইস্টার্ন ব্লক-এর দেশগুলো সোভিয়েত রাশিয়ার পরিপূরক হয়ে ছিল বহু বছর। সোভিয়েত ইউনিয়নের হর্তাকর্তারা খাতায় কলমে মস্কোয় থাকলেও গুপ্তচর সংগঠন কেজিবির স্পাইরা গিজগিজ করত প্রাগে। কমিউনিস্ট সরকারের বিপক্ষে গিয়েছো কি মরেছ! স্নায়ুযুদ্ধের সময় চেকোলোভাস্কিয়া বা রোমানিয়া থেকে কেউ প্যারিস, লন্ডন বা কোপেনহেগেনে গেলে সকলেই ট্যারা চোখে তাকাত। বিড়বিড় করে বলত, "ফ্রম প্রাগ? ইউ মিন... বিহাইন্ড দ্য আয়রন কার্টেইন?"যে কথাটা ওপরে না বলে মনে মনে বলত, সেটা হল"ব্লাডি কমিউনিস্টস!"

পরে অবশ্য সময় বদলেছে, পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে লোহার পর্দায়। সশস্ত্র এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলস্বরূপ এখনকার মানুষ সাম্যবাদের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। কয়েকটি রাষ্ট্র হয়তো পুরোপুরি পশ্চিম ইউরোপের পদচিহ্ন অনুসরণ করেছে, প্রতিরক্ষার কথা ভেবে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে, বাকিরা পুঁজিবাদ আর সাম্যবাদের মাঝামাঝি  কোনও একটা গন্তব্য ঠিক করতে চেয়েছে। সে যাই হোক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক বৈচিত্রের দিক থেকে দেখতে গেলে কিন্তু ইস্টার্ন ব্লকের দেশগুলো সর্বদাই প্রথম সারিতে থাকবে। পরিকাঠামো এবং জীবনধারণ ইউরোপের আর চারটে দেশের মতো হলেও এখানকার সংস্কৃতি, খাবারদাবার, রাজনীতি অথবা মানসিকতা যেমন পশ্চিমের অন্যান্য দেশের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। মুশকিল হল ইস্টার্ন ব্লকের অধিকাংস দেশে যেতে গেলে আলাদা করে ভিসা নিতে হয়, শুধু সেনগেন ভিসা থাকলে চলে না। কয়েকটা দেশে অবশ্য যাওয়া যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম হল চেক রিপাবলিক এবং এর রাজধানী প্রাগ। আমাদের মতো ব্যাকপ্যাকারের কাছে যে প্রাগ এবং বুডাপেস্ট-এর মত শহরগুলো যে একটা বিশেষ জায়গা দাবী করে তার আরেকটা কারণ হল, জিনিসপত্রের দাম এখানে ওয়েস্ট ইউরোপের তুলনায় অনেক কম। 

প্রাগ যে বর্তমানে ইউরোপের অন্যতম সুন্দর শহরের মধ্যে একটি, সে কথা আমরা এই সফরেও আগে অনেকবার শুনেছি। ভাল্টাভা নদীর তীরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক নগরী প্রথমদিকে বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়া রাজত্বের অংশ ছিল। এখানে বলে রাখা ভালো যে বোহেমিয়া আসলে চেক রাজ্যের একটি অঞ্চল, এই রাজ্যের অধিবাসীদের বলা হত বোহেমিয়ান। বোহেমিয়ান রাজ্য একসময় প্রবল শক্তিশালী ছিল, বহু বছর তারা এই দেশে রাজত্ব করেছে। আমাদের পরিচিত শব্দ 'বোহেমিয়ান' এর উত্পত্তিও এই দেশেই, স্বাধীনচেতা এবং শিল্পমনস্ক ব্যক্তিদের চরিত্র বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহার সেই যুগ থেকেই হয়ে আসছে।

মধ্যযুগের শেষ দিকে প্রথমে হাপ্সবুর্গ সাম্রাজ্য, তারপর অস্ট্রো-হাঙ্গরি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল চেক রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রো-হাঙ্গরি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, চেকোস্লোভাকিয়া নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তা নতুন দেশের আনন্দ খুব বেশিদিন থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাজি বাহিনী এসে প্রাগের দখল নেয়। এই অঞ্চলে সে যুগে প্রচুর ইহুদি আর মুক্তমনা শিল্পী ও সাহিত্যিকরা বসবাস করত। ফলে হিটলারের অধীনে প্রাগে কী ঘটেছিল, সেটা হয়তো সকলেই অনুমান করতে পারবে। তা হিটলার খুড়োও বেশিদিন রাজত্ব বজায় রাখতে পারেননি, যুদ্ধ শেষের মুখে সোভিয়েত সৈন্যরা একেবারে রে রে করে এসে তাদের তাড়িয়ে দেয়। চেকরা হিটলারকে মোটেও পছন্দ করত না, সোভিয়েত সৈনিকরা জয়ী হতে তারা খুশিই হয়েছিল। সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়ে ১৯৪৬ সালে সাম্যবাদী চেকোস্লোভাকিয়া সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নির্বাচনে বিজয়ী হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে পুরোপুরি ভাবে দখল নেয় দেশের। এরপর পরবর্তী একচল্লিশ বছর ধরে সোভিয়েত সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার একাধিকার করে ছিল চেকোস্লোভাকিয়ায়।

তা প্রথম দিকে লোকজন দিব্যি আনন্দেই ছিল। সাম্যবাদী শাসকেরা যে রাষ্ট্রের মঙ্গলের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে, সেই সম্পর্কে তাদের কোনও ধারনাই ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেলে কে কমিউনিস্ট, আর কে ক্যাপিটালিস্ট? ফরাসি মার্ক্সবাদী নেতা উলস গুয়েসে নাকি একবার স্বয়ং কার্ল মার্ক্সকেই অভিযুক্ত করেছিলেন যে তিনি মোটেও মার্ক্সবাদের নিয়ম মেনে চলছেন না। তা কার্ল মার্ক্স দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলেছিলেন, "ce qu'il y a de certain c'est que moi, je ne suis pas marxiste." এর মানে, যা বুঝছি, তাতে একট কথা নিশ্চিত। আমি মোটেও মার্কক্সিস্ট নই।" 

রাজনৈতিক মতাদর্শ আর রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। যুগে যুগে যা ঘটেছে, প্রাগে তার ব্যতিক্রম হবে কী করে? ফলে যা হওয়ার তাই হল। সাম্যবাদী সরকারের স্বৈরাচারী শাসনে বাকস্বাধীনতা ধুলোয় মিশে গেল, রাষ্ট্রবিরোধী বা মার্কিন গুপ্তচরের তকমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে টপাটপ তুলে নিয়ে যেতে লাগল সরকার। গল্প, কবিতা, উপন্যাসের ওপর তাদের কড়া দৃষ্টি, কেউ যাতে সরকারের বিরুদ্ধে একটা কথাও না বলতে পারে। টুঁ শব্দটি করেছ কি কেজিবি লেলিয়ে দেওয়া হবে মস্কোর ইশারায়। 

পঞ্চাশের দশকের পর স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয় আমেরিকার সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার। দুই পক্ষের মধ্যে পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, ব্যালিস্টিক মিসাইল নির্মাণ ও সামরিক এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। ইস্টার্ন ব্লকের সাম্যবাদী মানসিকতার সুযোগ নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া 'ওয়ারশ প্যাক্ট'-এর চুক্তি করে ইস্টার্ন ব্লক-এর আটটি রাষ্ট্রের সঙ্গে। যুক্তি অনুযায়ী তারা প্রত্যেকে পরস্পরকে অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দেবে দরকার পড়লে এবং স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত দেশের সাহায্য করবে। এর কাট হিসেবে পশ্চিমের দেশগুলো ন্যাটো চুক্তি করে। ব্যস! আর যায় কোথায়? যুযুধান দুই পক্ষ সেই যে মুখোমুখি হল, সেই ঘটনার জের এখনও চলছে পূর্ব ইউরোপে।  

চেকোস্লোভাকিয়া তখন সোভিয়েতে প্রধান সঙ্গী। তারা প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইউরোপে। গোপনে খবর সরবরাহ হচ্ছে মস্কোতে। সে একটা যুগ ছিল। কোনও চেক শিল্পী আমেরিকান কবিতার সুখ্যাতি করলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে জেলে পাঠানোর বিধান। বাকিদের কথা বাদই দিলাম, জারোস্লাভ সেইফের্ত-এর মতো নোবেলজয়ী সমাজতান্ত্রিক কবিকেও এরকম ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি একসময় ভাক্লাভ হাভেল বলে একজন লেখকই চেক রাজ্যের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন। মিলন কুন্দেরা পাকাপাকি ভাবে প্যারিসে চলে গিয়েছেন, জোসেফ স্করেস্কি কানাডায় পালিয়ে গেছেন, নিষিদ্ধ সাহিত্য লেখার মূল্য দিতে অনেকে লেখা থেকেই অবসর নিয়েছেন। তাজ্জব ব্যাপার হল এই পরিস্থিতিতেও চেক সাহিত্যে উচ্চমানের কাজ হয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। হ্যাঁ, হতে পারে সে সাহিত্য সরাসরি সমসাময়িক সরকারের বিরোধিতা করেনি কিন্তু 'হিউম্যান স্টোরি' তুলে ধরতে পিছপা হয়নি। তবে চেকরা যে এই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করেনি তা নয়। ছুটকো-ছাটকা আন্দোলন চলছিল অনেক বছর ধরেই, কিন্তু সে আন্দোলন পরিবর্তন আনতে পারেনি। আলেকজান্ডার ডুবাকের নেতৃত্বে ১৯৬৮ সালের 'প্রাগ স্প্রিং' আন্দোলন অনেকের মনে আশার সঞ্চার করেছিল কিন্তু শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন সশস্ত্র সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সেই আন্দোলন থামিয়ে দেয়।

অবশেষে পরিবর্তন এল ঠিকই। সেই পরিবর্তন আনল ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভোলিউশন'। ততদিনে অবশ্য অনেক কিছু বদলেই গেছে। ওয়ারশ প্যাক্ট ভেঙ্গে গিয়েছে, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি পুনরায় এক হওয়ার মুখে। প্রাগেও এই বদলের ছায়া পড়ল। সেই অহিংস বিপ্লবে গোটা দেশের ছাত্রদের সঙ্গে একজোট হয়ে সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ মিছিল ও হড়তাল শুরু করেছিল। কিছুতেই তাদের থামানো যায়নি। একসময় সরকার বরখাস্ত হয়, লোটাকম্বল নিয়ে বিদায় নেয় কমিউনিস্টরা। ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া বিভাজিত হয় এবং চেক রিপাবলিক এবং স্লোভাকিয়া দুটি ভিন্ন রাষ্ট্র হয়ে পৃথিবীর মানুষের সম্মুখে আসে। এই হল ইতিহাস। উইকিপিডিয়াতেও আছে। তাই না বললেও চলত। কিন্তু তাও বলতে হল, কারণ এই প্রেক্ষাপট না জানা থাকলে প্রাগের গলিতে ঘোরার অনুভূতিটা বোঝানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি, একজন মানুষের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে না। তাঁর কথা যথাসময়ে জানাব। আপাতত ব্যাক টু বেসিকস। 

ভিয়েনা থেকে ফ্লিক্সবাস করে প্রাগে আসতে আমাদের সময় লেগেছে মোটামুটি পাঁচ ঘন্টা। এইদিকের ভূদৃশ্য অন্যরকম, দেখলেই বোঝা যায়। ঘন সবুজের বদলে রংমিলান্তির খেলা। ফিকে সবুজ আর কমলা রঙের উঁচু নিচু প্রান্তরে ফসল ফলানো হচ্ছে। শুকনো খড় বোঝাই করে রাখা ক্ষেতের মাঝে এক একটা ফার্মহাউস, আনারস রঙা বাড়ি। মাঝে মাঝে ইট রঙের ঘরবাড়ি-গির্জা নিয়ে ছোট ছোট জনপদ। মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। প্রাগে নামলাম যখন, গরম অনেকটাই কমে গেছে।

আমাদের থাকার কথা প্রিস্তাভিস্তে অঞ্চলের একটি হোমস্টেটে। হুড়োহুড়ি থেকে দূরে অবস্থিত শান্ত পাড়া, খানিক দূরেই নদীর ধার দিয়ে ট্রাম লাইন চলে গেছে। বাড়িওয়ালার নাম পেত্র, সময়াভাবে তার সঙ্গে বেশিক্ষণ আড্ডা দেওয়া গেল না। সে নিজেই দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে, সেইজন্যে আমাদের সব বুঝিয়ে দিয়েই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ল। আমরাও কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখেমুখে জল দিয়ে, সেজেগুজে ট্রাম স্টেশনের দিকে চললাম। নতুন শহরে এসে কে ঘরে বসে থাকে? 

প্রিস্তাভিস্তে থেকে ট্রাম ধরে শহরের দিকে চলেছি। আমাদের বাঁদিক দিয়ে বয়ে চলেছে ভাল্টাভা নদী। আজ বিকেলের গন্তব্য প্রাগের অনন্য চার্লস ব্রিজ। বোহেমিয়ার রাজা এবং সেকালের রোমান সম্রাট চার্লস চতুর্থ এই সেতুটির নির্মাণ কার্য শুরু করার আগে রীতিমত সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছিলেন। ১৩৫৭ সালের জুলাই মাসের 9 তারিখে সকাল পাঁচটা একত্রিশ মিনিটে রাজামশাই সেতুর গোড়াপত্তন করেছিলেন। মুহূর্তটি দীর্ঘ ভাবনাচিন্তার পর ঠিক করা হয়েছিল যাতে একটা প্যালিনড্রম তৈরি হয়  (১৩৫৭-৯-৭-৫-৩১)। তিরিশটি বারোক শৈলীর প্রতিমা দিয়ে সজ্জিত এই সেতু আজ প্রাগের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ এবং সময়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে আজও চার্লস ব্রিজ সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। 

মজলিশি নদীর স্রোত। অ্যালবাট্রস মেঘ। লাপিস লাজুলি আকাশ। লাল পাড় সাদা শাড়ি ট্রাম। ঘটাং ঘটাং শব্দটা সত্যিই মিস করি।  নদীর কাছেই অবস্থিত রঙচঙে বাড়িগুলো দেখতে দেখতে যখন চার্লস ব্রিজের কাছে পৌঁছেছি, সূর্যাস্ত হতে খুব বেশি দেরি নেই। সেতুটা সুন্দর তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা এখানকার পরিবেশ। এমন জমজমাট সেতু হয়তো আর কোথাও নেই। চার্লস ব্রিজ আজকাল বোহেমিয়ান শিল্পী আর বাস্কার্সদের অন্যতম ঠেক, প্রায় মেলা বসে যায় বিকেলের দিকে। নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজছে, শিল্পীরা ছবি আর পেইন্টিং নিয়ে বসে আছেন। কয়েকজন দেখি মানুষের মুখের স্কেচ করছেন। একজন অপেরা গাইছে। একটা ম্যাজিশিয়ানেরও দেখা পেলাম। পথচারীরা  কোনও  না  কোনও  শিল্পীর সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে, বাকিরা নদী ও নদীর অপর প্রান্তে পাহাড়ের ওপর থাকা প্রাসাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে ভাল্টাভা নদীর জলে। অনেকগুলো নৌকো আর যাত্রীবাহী ক্রুজ এগিয়ে যাচ্ছে জল কেটে। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ সরানো কঠিন হয়ে পড়ে। কাছেই নদীর ওপর কাম্পা দ্বীপ আছে, সেখানে ততক্ষণে নদীর ধারের রেস্তোরাঁয় আমুদে সঙ্গীত আর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। এমন সময় আমার আবার মনে হল, এ দৃশ্য তো আমার খুব পরিচিত। ওই যে দূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, ওখানে স্পরুস আর হর্নবিম গাছের তলায় একটা বেঞ্চি আছে। দূরের গির্জায় ঠিক সতেরো মিনিট পর ঘণ্টা বাজবে। আমি এখানে আগেও ঘুরে গিয়েছি বহুবার। 

কেন বার বার এরকম মনে হওয়া? তার কারণ আর কিছু নয়, একজন মানুষ। যার কলম পড়ে আমি এই শহরকে চিনেছি, বুঝেছি, ভালোবেসেছি। না, কাফকা নন, ইয়ান নেরুদা বা কুন্দেরাও নন, বরং আমাদের দেশেরই এক মানুষ। হিন্দি সাহিত্য যার হাতে পড়ে বদলে গিয়েছে বরাবরের মতো। নির্মল বর্মা। ষাটের দশকে প্রায় দশ বছর এই দেশে থেকেছেন তিনি। এখানকার সাহিত্য, পরিবর্তনশীল রাজনীতি, ছাত্রজীবন, বিপ্লব ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর যে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তা বার বার তাঁর সাহিত্যে দৃশ্যমান হয়েছে। তাঁর লেখা গল্প, ভ্রমণসাহিত্য আর উপন্যাস পড়লে পাঠকের মনে যে প্রাগকে ঘিরে যে ছবি গড়ে ওঠে, সে ছবি আজীবনের মতো তাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। নির্মল বর্মার কলমে এমন একটা মায়াবী ব্যাপার আছে, একটা যাদুজড়ানো নির্লিপ্ততা আছে, যা প্রথম লাইন থেকে পাঠকদের সম্মোহিত করে রাখে। তাঁর গভীর জীবনবোধ ও সমাজদর্শন তাঁর সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে, একইসঙ্গে প্রাধান্য পেয়েছে চেক সাহিত্য ও প্রাগের উদারমনা মানুষদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, নির্মল বর্মা কোনোদিন ভারতীয় মূল্যবোধের নিরিখে এখানকার সমাজকে বিচার করেতে চেষ্টা করেননি। ভুলে গেলে চলবে না, ষাটের দশকের প্রাগ আর আজকের প্রাগ এক নয়। বিহাইন্ড দ্য আয়রন কার্টেনে অবস্থিত বলে প্রাগকে লোকে এড়িয়েই চলত। কিন্তু নির্মল বর্মা অন্য ধরনের মানুষ ছিলেন। তিনি সমস্ত ইউরোপে ভ্রমণ করেছেন, নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। হোস্পাদায় রাতের পর রাত বিয়ার হাতে ছাত্রদের সঙ্গে আড্ডা মেরেছেন, ধ্রুপদ সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি সজগ দৃষ্টি রেখেছেন, সমকালীন সাহিত্যিকদের লেখা গুলে খেয়েছেন, আবার পেট চালাতে সামার ও উইন্টার হলিডেতে পার্ট টাইম জবও করেছেন। চেক সাহিত্যকে অন্যান্য ভাষায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন নির্মল। ফলে চেক ভাষাও শিখেছেন, প্রাগ সাহিত্যের বিভিন্ন লেখা হিন্দিতে অনুবাদ করতেও পেছপা হননি। পরবর্তী কালে হিন্দি সাহিত্যের 'ট্রেলব্লেজার' হয়ে উঠেছিলেন নির্মল। সমকালীন কবি লেখকদের মধ্যে অনেকেই নির্মল বর্মার লেখা পড়ে সাহিত্যের প্রেমে পড়েছেন। বলা বাহুল্য, আমিও তাঁর একজন ক্ষুদ্র পাঠক। ফলে প্রাগ নিয়ে আমার আলাদা আবেগ তো থাকবেই। নির্মল বর্মার লেখা 'ওয়ে দিন' পড়ে প্রাগের প্রেমে পড়বে না, এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া কঠিন। গল্প অবশ্য খুবই সহজ। এক ভারতীয় ছাত্র(নির্মল নিজে) প্রাগে থাকে। শীতের ছুটিতে আচমকা সে একটা কাজের সন্ধান পায়, অস্ট্রিয়ান এক মহিলার ইন্টারপ্রেটার হতে হবে কিছুদিনের জন্যে। সেই কাজের সূত্রে পরিচয় হয় রাইনার সঙ্গে, একটা সম্পর্কও তৈরি হয়। তারপর বইয়ের পাতা জুড়ে বরফ, কুয়াশা, বিষাদ, আর প্রেম। প্রাগের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দু'জন, ল্যাম্পপোস্টের ধোঁয়া ধোঁয়া আলো কুয়াশার সৃষ্টি করেছে।

একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি অনেকক্ষণ আগে থেকেই পড়ছিল, কেউ গায়ে মাখেনি। কিন্তু এইবার টনক নড়েছে অনেকের। চটপট বড় বড় ছাতা বাহারি ছাতা অথবা রেনকোট বেরিয়ে পড়ল। আমাদের কাছেও খাস মধ্যবিত্ত বাঙালি কালো রঙের জোড়া ছাতা আছে, মাথার ওপর খুলে শান বাঁধানো পাথরের রাস্তা দিয়ে সেতুর অন্য দিকে এগিয়ে চললাম। 

শান বাঁধানো রাস্তার ওপর বৃষ্টির জল পড়েছে বলে দোকানের জগমগে আলো প্রতিফলিত করছে। প্রাগের অলিগলি সব জায়গাতেই গথিক স্থাপত্যের দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায়, সেইসব দেখতে দেখতে চলেছি। ক্যাফে আর রেস্তোরাঁগুলো থেকে বেরিয়ে আসা সুবাসে মন চনমন করে। প্রাগে গুলাস আর ডার্ক বিয়ারের নামডাক আছে, সেইসবও চেখে চেখে দেখতে হবে। একজন মানুষ প্রতিমার মত অনড় হয়ে কোমর মুড়ে বসে আছে, সামনে টুপি। যদি কেউ খুচরো পয়সা দেয়! ভিক্ষে চাওয়ারও রকমারি 'স্টাইল' দেখতে পাওয়া যায় দেশে দেশে ঘুরলে। আমাদের কাছে খুচরো থাকলে না হয় দেওয়া যেত। প্রাগে আবার ইউরোর চলন নেই। এখানকার স্থানীয় টাকা চেক কোরুনা, এটিএম থেকে সেই টাকা বের করতে হবে।

সেই দিন সন্ধ্যেবেলা ওল্ড টাউনের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে কেটে গেল। এক একটা গলিতে ঢুকি আর এক একটা গল্প চোখের সামনে উন্মোচিত হয়। কতবার যে রাস্তা হারালাম তার ঠিক নেই। তবে নতুন শহরে রাস্তা হারানোর মতো মজা আর কিছুতেই নেই। প্রতিটা শহরের যে নিজস্ব একটা সত্তা থাকে, সেটা বুঝতে হলে এই নিরুদ্দেশ ভ্রমণ জরুরি হয়ে পড়ে। কোনও  নির্দিষ্ট গন্তব্য অথবা দ্রষ্টব্যের সন্ধান না করলে বহু খুঁটিনাটি চোখে পড়ে, যা সেখানকার প্রতিদিনের জীবনের অংশ। যেমন প্রথম দিন ঘুরেই আমরা বুঝতে পারলাম প্রাগে চাইনিজ আর থাই খাবারের ব্যাপক চাহিদা। থাইল্যান্ডের লোকজনও আছে অনেক। ছোট ছোট মনিহারী দোকানে ঢেলে থাই নুডলসের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে, লোকে কিনছেও দেদার। এরকম তথ্য কোনও গাইড বুকে পাওয়া যাবে কি না কে জানে?


২) পরের দিন সকালে নীলের সঙ্গে আলাপ। প্রাগের স্যান্ডেম্যান ওয়াকিং ট্যুরের গাইড নীল যতটা রোগা, ততোটাই লম্বা। জাতে ইহুদি এবং জন্ম থেকেই প্রাগের বাসিন্দা। ওল্ড টাউন স্কোয়ার আদতে প্রাগের হৃদয়কেন্দ্র। ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো বহু অজানা গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে চত্বরেই। সেন্ট ভিতাস গির্জা, অ্যাস্ট্রনমিকাল ক্লকের পাশাপাশি আর্ট গ্যালারি, নবীন এবং প্রাচীন সৌধ, প্রস্তর প্রতিমাগুলো দেখা হয়ে যায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেই, কিন্তু গল্পগুলো অজানাই থাকে। নীলের সুবাদে আমাদের অনেকগুলো গল্পই জানা হল। ক্যাথোলিক ও প্রোট্যাসটেন্টদের রেষারেষি, বিদ্রোহে শহরের কর্তাদের দপ্তরের জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, ধর্মসুধারক জান হুসকে আগুনে পুড়িয়ে মারার বর্বর ইতিহাস, সবই চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।

ওল্ড টাউনের একদিকে নতুন শহর, অন্য প্রান্তে ইহুদি পাড়া। প্রাগের ইহুদি পাড়া যে হিটলারের খুবই পছন্দের জায়গা ছিল, সে তথ্য এখন জানে।  শেষ জীবনটা এখানেই কাটাবেন এমন একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন ফুয়েরার। তাই বলে এখানকার ইহুদিদের নরম চোখে দেখতেন না মোটেও। উল্টে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় থাকতে হত প্রাগের ইহুদিদের। মৃতদেহ সমাধিস্থ করার জন্যও জায়গা পাওয়া যেত না।  কবরখানার জন্যে নতুন জায়গার অনুমতি না পেয়ে পুরোনো কবরের ওপরে মাটি ফেলে মৃতদেহদের সমাধিস্থ করতে হত তাদের। হিটলার আসলে চেয়েছিল পাড়াটা তার কৃতিত্বের চিহ্ন হয়ে রয়ে যাবে পৃথিবীতে! লোকে সেখানে এসে দেখবে হিটলারের হাতে পড়ে সিধে হয়ে যাওয়া এই নিকৃষ্ট জাতি ঠিক কী করে জীবনধারণ করত! তার এই অমানবিক পরিকল্পনা সত্যি হয়নি ঠিকই, কিন্তু ইহুদি পাড়ায় আজও অতৃপ্ত আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস অনুভব করা যায়। 

এই অঞ্চলে অজস্র কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে। ভূত আর দৈত্যের মজাদার গল্পের পাশাপাশি নীল আমাদের আরো একটি গল্পের হদিস দিল, সিনেমার মতো মনে হলেও যা সত্যি ঘটনা। অনেকেই অবশ্য এখন ঘটনাটার কথা জেনে গিয়েছে, কিন্তু তাতে তার প্রভাব কমে যায়নি মোটেও।

সিনাগগ দেখে কবরখানার পাশের সংকীর্ণ নিচু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছে নীল বলল, "সিন্ডেলার্স লিস্ট ছবিটা কি তোমরা সকলে দেখেছ?"

আমরা দুজন তো সিনেমার পোকা। কিন্তু স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত 'সিন্ডেলার্স লিস্ট' ছবিটি দেখেনি, এমন চলচিত্রপ্রেমী পাওয়া মুশকিল। এই ছবিটি অস্কার সিন্ডেলারের কাহিনি নিয়ে করা, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্ট চলাকালীন অসংখ্য পলিশ ইহুদিদের তাঁর কারখানায় কাজ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন । 

নীল বলল, "অস্কার সিন্ডেলার্সের জীবন সম্পর্কে এখন সবাই জেনে গিয়েছে। কিন্তু আরেকজন মানুষ আছেন যিনি নিজের জীবনের পরোয়া না করে প্রাগ থেকে ছশোরও বেশি অনাথ ইহুদি ছেলেমেয়েদের উদ্ধার করেছিলেন, তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন ব্রিটেনে। তাঁর নাম নিকোলাস ওয়ান্টান। তিনি না থাকলে বাচ্চাগুলো তাদের মা-বাবার মতনই  কোনও  না  কোনও  কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মারা যেত।"

ধীরে ধীরে ঘটনাটা জানা গেল। ১৯৩৮ সাল। ইহুদিদের ওপর যে ধরনের অমানুষিক অত্যাচার হচ্ছিল, সেই খবর পেয়ে ব্রিটেন ইহুদি শিশু শরণার্থীদের জায়গা দিতে রাজি হয় এই শর্তে যে তাদের থাকার জন্যে  কোনও  না  কোনও  পরিবার ঠিক করতে হবে এবং মাথাপিছু প্রত্যেকটি বাচ্চার জন্যে একটা নির্দিষ্ট মূল্য ধরে দিতে হবে। সে সময় যুদ্ধ চরমে, জার্মানির নাজি সৈন্য আর কয়েকদিনের মধ্যেই প্রাগ অধিকার করে নেবে। এমন সময় সমাজকর্মী মার্টিন ব্লেকের আহ্বানে নিকোলাস উইন্টান এসে পৌঁছোন প্রাগে, জানতে পারেন অনাথ ইহুদি শিশুদের কথা। ব্লেক নানা কাজে ব্যস্ত, অতএব দায়িত্বটা পুরোপুরি নিজের ঘাড়ে তুলে নেন ওয়ান্টান। সেই অরাজক পরিস্থিতিয়ে একটা নতুন সংগঠন দাঁড় করিয়ে প্রতিটা ছেলেমেয়ের জন্যে ব্রিটিশ মুলুকে ফস্টার হোমের সন্ধান করা, নথিপত্র যোগাড় করা, হল্যান্ড থেকে দরকারি অনুমতি আনানো... কাজ বড় কম ছিল না। কিন্তু ওয়ান্টান একবারের জন্যও দমে জাননি। নানা অসুবিধে সত্ত্বেও ৬৬৯ জন ইহুদি ছেলেমেয়েকে তিনি সুরক্ষিত ভাবে পাঠিয়ে দেন ব্রিটেনে। 

এই ঘটনার কথা পৃথিবীর মানুষ জানতেই পারেনি। বহু বছর পড়ে বাড়ির চিলেকোঠা থেকে ওয়ান্টানের স্ত্রী একটি ডায়েরি খুঁজে পান, সেখানে প্রতিটা ছেলেমেয়ের কথা বিস্তারে লিখে রেখেছিলেন তিনি। গ্রেটে ওয়ান্টান সে ডায়েরি পড়ে স্তম্ভিত হয়ে যান। এরপর একে একে কয়েকজন এই ঘটনার কথা জানতে থাকে। ক্রমে ঘটনার কথাটা জানাজানি হয়, সংবাদমাধ্যমেও লেখালিখি হয়। এই ঘটনার কথা জানানোর জন্যে নিকোলাস ওয়ান্টানকে একটি মিডিয়া প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বৃদ্ধ ওয়ান্টান জানতেন না যে দর্শকদের সকলেই বাস্তবে সেই ছশো উনত্রিশ জন এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম। এক সময়ে যখন জিগ্গেস করা হয় কতজন মানুষ নিকোলাস ওয়ান্টানের জন্যে জীবন পেয়েছেন, প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ উঠে দাঁড়ায়। এই ঘটনার পর থেকেই নিকোলাস ওয়ান্টানের গল্প পরিচিত হয়ে ওঠে বৃহত্তর সমাজে। সেই ভিডিও দেখলে একদিকে গায়ে কাঁটা দেয়, অন্যদিকে চোখে জল চলে আসে। তাঁকে সম্মান দেওয়ার জন্যে প্রাগের ট্রেন স্টেশনে ওয়ান্টানের একটি প্রতিমাও স্থাপন করা হয়েছে।  

ইহুদি পাড়া থেকে ফ্র্যাঙ্ক কাফকার বাড়ি, সেখান থেকে অপেরা হাউস আর ওল্ড টাউনের গলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে নিউ টাউনের ওয়েনসেসলাস স্কোয়ার। ওয়েনসেসলাস স্কোয়ারে গেলেই ভেলভেট বিপ্লবের কথা মনে পড়ে, পাবলিক প্রোটেস্টের জন্যে এই জায়গাটা আজও ব্যবহার করা হয়। ভাবলে অবাক লাগে যে এই পথ দিয়ে এককালে সোভিয়েত সৈন্যরা এখানে রীতিমত সামরিক ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘোরাঘুরি করেছে। ইতিহাস আর সমসাময়িক ঘটনার চর্চার মধ্যে দিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেল। কাছেই একটা জায়গায় হাজার হাজার ধাতুর পাট দিয়ে নির্মিত কাফকার মুখের একটা অটোমেটিক রেপ্লিকা আছে, মুখটা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে। সেটা আমরা দেখে নিয়েছি। ইচ্ছে ছিল কাফকা মিউজিয়ামে যাওয়ার কিন্তু সেখানে আর যাওয়া হল না। প্রাগের মানুষেরা কাফকার জটিল মনস্তাত্ত্বিক কাহিনীর যত ভক্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি ভক্ত মোৎসার্ট-এর কম্পোজিশনের। বলাবলি করা হয় ভিয়েনার চেয়েও বেশি মানুষে প্রাগে মোৎসার্টকে নিয়ে মাতামাতি করে, তাঁর মৃত্যুর পর এখানে টানা কয়েকদিন ধরে শোক পালন করা হয়েছিল। তুলনায়, তিরিশ বছর অ প্রাগে কাফকাকে অধিকাংশ মানুষ চিনত না। বিপ্লব পরবর্তী কালে দেশ স্বাধীন হতে মার্কিন টুরিস্টরা এসে যখন কাফকা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে, এখানকার লোকজন তাঁকে আমেরিকান ঠাউরেছিল। তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। কাফকা ছিলেন প্রাগের ইহুদি, কিন্তু লিখতেন জার্মানে। সেই লেখা তাঁর মৃত্যুর পর ইংরেজিতে অনূদিত হয়। চেক সাহিত্যে তাঁকে নিয়ে কোনও উন্মাদনা ছিল না।  

কাফকার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি সকলেই জানে। সে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। বরং এই সুযোগে অন্য একজনের কথা জানিয়ে যাই, যিনি চিরকাল অন্ধকারে থেকে গিয়েছেন। অথচ, কাফকার অধিকাংশ লেখাই এই মানুষটি না থাকলে জনসমক্ষে আসত না। জানি, পাঠকদের অনেকেই কাফকার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের কথা ভাবছেন। বন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করে সমস্ত লেখা প্রকাশিত করার জন্য আমরা ম্যাক্সের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কৃতজ্ঞ থাকব কাফকার ছোট বোন ওতলার কাছে। 

হ্যাঁ, কাফকার এক বোন ছিল। আসলে বোন ছিল তিনটে। গ্যাব্রিয়েল, ওয়ালি আর ওতলা। কিন্তু বয়সে প্রায় নয় বছর ছোট ওতলাকে প্রথম থেকেই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন কাফকা। ওতলাও কাফকা বলতে অজ্ঞান ছিলেন। কাফকা বরাবর চাপা স্বভাবের ছিলেন, তাঁর সমস্ত দুঃখ কষ্ট চিন্তা ভাবনা জটিলতার আন্দাজ কেউই পেত না, কিন্তু বোন ওতলার কাছে তাঁর এই গাম্ভীর্য উধাও হয়ে যেত। দেখা হলে নির্দ্বিধায় কথা বলে যেতেন কাফকা, ওতলা শুনতেন মন দিয়ে। দেখা না হলে চিঠি লিখতেন পরস্পরকে। ওতলাই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কাফকার প্রতিভাকে বুঝেছিলেন। তিরিশ বছর বয়সে কাফকা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার পর ওতলা ভাইকে বোহেমিয়ায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে জান। ছোট্ট টাউন, নাম জুরাউ। সেখানে ওতলা মেয়ে ভেরা আর হেলেনাকে নিয়ে থাকতেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভাইয়ের সেবা করে গিয়েছেন ওতলা, তাঁকে লিখতে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। সন্ধ্যের পর কাফকা বোনকে প্লেটো পড়ে শোনাতেন, ওতলা পিয়ানো বাজাতেন ভাইয়ের জন্য। এই সময়টার কথা কাফকার লেখায় বার বার উঠে এসেছে। হয়তো বোনের জন্য শেষ জীবনে কিছুটা শান্তি পেয়েছিলেন তিনি। শেষের দিকে কাফকার কলম এতটাই পরিণত হয়ে উঠেছিল যে তাঁর লেখা প্রতিটা বাক্য মানব সভ্যতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করত। তাঁর শেষ গ্রন্থ 'জুরাউ অ্যাফোরিজম' এই কথার সত্যতা প্রতিপাদন করে গিয়েছে। 

কাফকা মারা গিয়েছিলেন চল্লিশ বছর বয়সে। ওতলার লড়াই কিন্তু থামেনি। এমনিতেও প্রথম থেকেই জেদি স্বভাবের ছিলেন ওতলা, শত বারণ করা সত্ত্বেও ফার্ম চালাবেন জন্য কৃষিকার্যের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, বাবার আপত্তিকে আমল না দিয়ে ইহুদি হয়েও ক্যাথোলিক প্রেমিকের সঙ্গে ঘর পেতেছিলেন। ১৯৪২ সালে যখন হিটলার ইহুদি হত্যার যজ্ঞে মেতে উঠেছে, ওতলার চরিত্রের এক অন্য দিক উন্মোচিত হয়। স্বামী আর মেয়েদের বাঁচানোর জন্য তিনি ইচ্ছে করে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করেন। ওতলা খুব ভালো করেই জানতেন যে তাঁর সঙ্গে থাকলে ভেরা আর হেলেনাকে বাঁচানো অসম্ভব, ফলে মেয়েদের শত কান্নাতেও তিনি মনকে শক্ত করে রেখেছিলেন। এর কয়েকদিনের মধ্যেই নাজিরা তাঁকে টেরেজিন কনশেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তাঁর কাজ ছিল পোল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা ইহুদি বাচ্চাদের স্নান করানো, তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। বাচ্চাগুলোর চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, লিকলিকে হাত পা। সবাই জানে বেশিদিন তারা বাঁচবে না। কিন্তু ওতলা তাদের সাহস দিতেন, গল্প বলতেন। মাঝে মাঝে ট্রাকে করে আরো ছেলেমেয়ে আসে, তারাও যোগ দেয় এই ক্যাম্পে। একসময় ওতলা জানতে পারেন সমস্ত বাচ্চাকে একসঙ্গে আউসউইৎজ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। শোনামাত্র তিনি সবটাই বুঝে যান। ওতলা টেরেজিন ক্যাম্পের কতৃপৃক্ষকে অনুরোধ করেন তাঁকেও বাচ্চাদের সঙ্গে পাঠানোর জন্য। এই অনুরোধ শুনে কতৃপৃক্ষ বাঁকা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "তুমি জানো না?"

ওতলা জবাব দিয়েছিলেন, "জানি।"

"তাহলে?"

ওতলা মৃদুহেসে বলেন, "আমি ওদের মরার আগে মরতে দেব না।" 

ওতলা অনুমতি পেয়েছিলেন। শেষযাত্রায় বাচ্চাগুলোকে ভুলিয়ে রেখেছিলেন হাসি আর গল্পে। ভাইয়ের মতো করে আগলে রেখেছিলেন প্রতিটা বাচ্চাকে। আউসউইৎজ ক্যাম্পে যাওয়া মাত্র ওতলা সহ সমস্ত বাচ্চাকে হত্যা করা হয়। ওতলার সঙ্গে ওতলার গল্পও হারিয়ে যায় চিরকালের মতো।  

একসময় ট্যুর শেষ হল। নীলকে বিদায় দিয়ে আমরাও অন্যদিকে এগোলাম। বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেছে। স্টিক, গুলাশ আর প্রাগের মিষ্টি কালো রঙের বিয়ার সহযোগে লাঞ্চ করে ধড়ে প্রাণ এল। প্রাগের 'বিয়ার কালচার' খানিকটা বেলজিয়ামের মতোই, মাথাপিছু কত হাজার লিটার বিয়ার যে এরা একবছরে পেটে ঢালে ভাবলেই মাথা ঝিমঝিম করে।

ওল্ড টাউন চত্বরটা এত সুন্দর যে ঘুরে ঘুরে দেখেও মন ভরে না। নানা ধরনের দোকানপাট, থিয়েটার, ম্যাজিক, ক্যাফে ইত্যাদি তো আছেই, তাছাড়াও বিকেলের দিকে মেন স্কোয়ারে অদ্ভূত অদ্ভুত খেলা দেখানো হয়। কেউ আগুন নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে, কেউ পুতুল নাচাচ্ছে, কেউ উদ্ভট  কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছে। প্রত্যেকেই বেশ ভালো, খেলা শেষে তালি বাজিয়ে খুচরো দিয়ে আসে উৎসাহী লোকে। দিব্যি প্রাণবন্ত পরিবেশ।

এদিকে বৃষ্টি হয়ে বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। রোদ্দুর পড়ে গেলে শীত শীত করে। তারপর হুটহাট বৃষ্টি। 'ট্রাদেলনিক' বলে একরকম স্থানীয় মিষ্টি পাওয়া যায়, লম্বা লম্বা কাঠিতে লাগিয়ে ঘোরানো সেঁকা একটা জিনিস, মাথায় চিনি ছড়ানো থাকে, এরকম পরিবেশে গরম কফি দিয়ে খেতে মন্দ লাগে না। আমরা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। আমার মাথায় নির্মল বর্মা ভর করে থাকেন সবসময়। নিউ টাউনের রাস্তাঘাট, স্থানীয় বাজার, ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাঁফিয়ে পড়লে মেট্রো অথবা বাসে উঠে পড়ি। সন্ধ্যে নামার আগে হাঁটতে হাঁটতে আবার যাই চার্লস ব্রিজের কাছে। একই রকম মায়াবন্ধনী পরিবেশ। অনেকক্ষণ বসে থাকা হয়।

পরের দিন প্রাগ কাসল দেখতে চললাম। পাহাড়ের মাথার ওপর এই দুর্গ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দুর্গের তকমা পেয়ে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছে। হাজার বছরেরও আগে নির্মিত এই দুর্গের প্রাসাদের রক্ষনাবেক্ষণও হয় সেইভাবেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠে উঠে যেতে হয়। দুর্গের নিচের তলায় প্রকাণ্ড উদ্যান করা হয়েছে, সেখানে ঘুরে বেড়ালেই সময় কেটে যায়। আরো ওপরে বিরাট গথিক গির্জা, রাজপ্রাসাদের নানা মহল, জাদুঘর, একদিনে দেখে শেষ করা অসম্ভব। আমরা সব জায়গায় ভিতরে যাই না। আমাদের আগ্রহ দুর্গের মাথা থেকে দেখতে পাওয়া শহরের দৃশ্যের দিকে। এত ওপর থেকে ভাল্টাভা নদীর অনেকগুলো সেতু দেখা যাচ্ছে, কাম্পা দ্বীপ ও বাড়িঘরের ঢালু ইট রঙের ছাদ ছাপিয়ে দেখা যাচ্ছে ওল্ড টাউনের বিস্তার। ক্যামেরা নিয়ে মানুষের দৌড়াদৌড়ি, এমন দৃশ্যের হদিস পেলে কয়েক দশক আগে যে শান্তি পাওয়া যেত, ডিজিটাল ক্যামেরার দৌলতে সেই শান্তি উধাও হয়েছে। খুঁজে খুঁজে একটা নীরব কোণে গিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে যাই। 'কাসল হিল' এর কাছেই 'পেট্রিন হিল' বলে আরেকটা পাহাড় আছে। সমস্ত পাহাড়টা একটা উদ্যানে পরিণত করা হয়েছে আজকাল। ফার্নেকুলার করে পাহাড়ের মাথায় চলে যাওয়া যায়। সেখানে আইফেল টাওয়ারের আদলে নির্মিত পেট্রিন টাওয়ারের লাল নীল আলো রাতে বহুদূর থেকে দেখা যায়। একটা তারামন্ডল আছে, কয়েকটা রেস্তোরাঁও করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের হাতে তাড়া নেই, ধীরে সুস্থে ঘুরে ঘুরে দেখলাম পাহাড়টা। ইউরোপিয়ান মেট্রোপলিটান শহরগুলোতেও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার কোনও  না  কোনও  উপায় রাখা হয়েছে, স্থানীয় লোকেরা ইচ্ছে করলেই যখন তখন এখানে চলে আসতে পারে। এইসব দেখে কংক্রিট জঙ্গলে থাকা আমার মতো বহু মানুষই দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। 

Gulliver Airship

Troubled eyes of Kafka

এরকম করেই দু' তিনদিন কেটে গেল। একদিন সকালে আমরা ট্রামে করে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় নামব ঠিক করিনি, ট্রাম চলছে, আমরাও চলেছি বাইরে দৃষ্টি রেখে। ট্রামের পথের ওপরেই একটা বাড়ি পড়ে, নাম 'ডান্সিং হাউস'। বাড়িটার নকশাটা এমন মনে হয় কোমর বেঁকিয়ে নাচছে। রোজই নজরে পড়ে আর আমার হাসি পেয়ে যায়। চার্লস ব্রিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে ভাল্টাভা নদী ডান দিকে ঘুরে গিয়েছে, সেই নদী পেরিয়ে গিয়ে নিউ টাউনের যেই জায়গাটায় নামলাম তার খুব কাছেই ম্যাপে দেখি একটা মিউজিয়াম। ডকস সেন্টার অফ কনটেম্পরারি আর্টস। বাস ধরে চলে এলাম সেখানে। নানা ধরনের শিল্পাকৃতি আছে কিন্তু জায়গাটার বিশেষত্ব হল মিউজিয়ামের ছাদ জুড়ে তৈরি করা প্রকাণ্ড এক আকাশযানের মডেল। কাঠ আর অন্যন্য জিনিস দিয়ে তৈরি এই আকাশযানের নাম 'গুলিভার এয়ারশিপ'। বহু বছর ধরে একটু একটু করে শিল্পীরা গড়ে তুলেছে এই অসামান্য প্রতিকৃতি। প্রথম দেখায় বিশ্বাস হতে চায় না।

প্রাগ ছাড়ার আগের দিন বিকেলে শেষবারের মত চার্লস ব্রিজে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রাচীন ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। জোরে হাওয়া দিচ্ছে আজও। পেট্রিন টাওয়ারের মাথা থেকে বিচ্ছুরিত আলোর রেখাও ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। ভাল্টাভা নদীর জলে অন্ধকারের ছায়া। কুড়মুড়ে হাওয়ায় লালনউড়ান চুল। এর মধ্যেই চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকি। গোধুলির দৃশ্য দেখে মন ভারী হয়ে আসে। চলে তো যেতেই হবে! কত মানুষ চলে গিয়েছেন, নির্বাসন নিয়েছেন, স্বয়ং নির্মলও চলে গিয়েছিলেন প্রিয় শহর ছেড়ে। আবার চোখে জল আসে। চোখের জল মুছে নদীর দিকে তাকাই, এমন সময় মাথায় চিড়িক করে ওঠে কয়েকটা লাইন। একটা কবিতা। একটা দৃশ্য। শুনশান রাস্তা, কয়েকটা ভারী বুট পরা সৈনিক, তাদের হাতে রাইফেল এবং চার্লস ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক যুবক। হঠাৎ রাইফেলের শব্দ হল, কয়েক রাউন্ড গুলি চলল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল যুবকটি। ভারী বুট এগিয়ে আসতে লাগল। সেদিনটাও এমনই মায়াময়ী ছিল। সেদিনটাও গোধূলি আছড়ে পড়েছিল মৃত যুবকটির গায়ে। 


সেইফের্ত কিছুই ভুল বলেননি। মানুষ আর সীমানার গন্ডি ছাড়িয়ে কিছু দৃশ্য একই থেকে যায়। বছর ঘোরে, কিন্তু সময় দাঁড়িয়ে থাকে স্থির।


ভাল্টাভা নদীর ওপর তখন অন্ধকার নেমে আসছে।


ক্রমশঃ
পরের পর্ব এখানে পড়ুন
আগের পর্ব এখানে পড়ুন 

যাত্রার শুরু থেকে পড়তে হলে 
যাত্রা শুরু-মাদ্রিদ