আমার কোনও মা নেই বাবা নেই
কোন ঈশ্বর অথবা রাষ্ট্রও নেই
শয্যা নেই, কফিনও নেই
প্রেমিকা নেই, চুম্বনও নেই
তিন ধরে কিছুই খাইনি আমি
এক টুকরো খাবার বা ভোজ নেই
আছে শুধু আমার বিশ বছরের উদ্যম
এই বিশ বছর আমি বেচে দেব
যদি কেউ না নিতে চায় তবে
শয়তানকেই নিতে হবে আমায়
মন দিয়ে আমি চুরি করব
দরকারে খুনও করব বইকি
ধরাও পড়ব ঠিক, ফাঁসিও হবে
কবর দেবে পবিত্র পৃথিবীর নিচে
আমার হৃদয় থেকে গজাবে সোনালি ঘাস
তারা মৃত্যুকে ভয় পায় না।
~অত্তিলা জোসেফ
১) সব যাত্রাই কোনও না কোনও জায়গায় গিয়ে শেষ হয়। যখন মাস কয়েক আগে পিঠে রুকস্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম দেশ ভ্রমণের নেশায়, ফিরে আসার কথা মনে উঁকি মারেনি একবারের জন্যেও। নানা দেশের নানা দৃশ্য, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, বন্ধুদের মুখ ঝিলিক দিয়ে গেছে, হাত ধরে নিয়ে চলেছে এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক শহর থেকে অন্য শহর। পথের নেশায় কোথা থেকে সময় কেটেছে অনুভবও করিনি। কিন্তু বুডাপেস্টে পৌঁছানো মাত্র আমার মনে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে। এই দীর্ঘ পথের পরবর্তী শুন্যতাকে কল্পনা করে আমি সত্যিই ভয় পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি বাস্তবতার মুখোশকে। যে মুখোশ পরে আমাকে আবার এমন সব কাজে জড়িয়ে পড়তে হবে যা আমার জীবনে একান্তই অপ্রাসঙ্গিক। অদরকারি। অবান্তর।
পথ শেষ হবে হয়তো, কিন্তু মনের যাত্রা এ জীবনে শেষ হওয়ার নয়। এই সত্যিটুকু আমি অনেক আগেই জেনে গিয়েছি। দীর্ঘশ্বাসের ঝড় সামলে আসন্ন বুডাপেস্টের পথে দৃষ্টি দিলাম। কিছুক্ষণ আগেই পেরিয়ে এসেছি স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভা। বাস দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে হাঙ্গেরির রাজধানী বুডাপেস্টের দিকে। আমাদের শেষ গন্তব্য।
ব্যাকপ্যাকার সার্কিটে বুডাপেস্টকে নিয়ে যতটা মাতামাতি আমি দেখেছি, ততটা ইউরোপের অন্য কোনও শহর নিয়েই দেখিনি। কোনও সময়ে যদি কেউ জিগ্গেস করে— 'সুযোগ পেলে ইউরোপের কোন শহরে ফিরে যেতে চাও?' একশ জনের মধ্যে নব্বইজন বুডাপেস্টের নাম বলতে থাকে। বুডাপেস্ট অবশ্যই ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর শহরের মধ্যে একটি, ড্যানিয়ুব নদীর ধারের সবচেয়ে জনপ্রিয় শহরও বটে। খানিকটা সস্তাও। কিন্তু এরকম তো অন্য কত শহরই আছে! তাহলে এই উন্মাদনার কারণটা কী? বুডাপেস্ট না গেলে সেটা বোঝা যাবে না। যাই হোক, এ সূত্রে মনে পড়ল হাঙ্গেরির কথা উঠলেই বাঙালিদের বালাটন হ্রদের কথা মনে পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুদিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। সময়ের অভাবে এই যাত্রায় আর সেখানে যাওয়া হবে না।
হাঙ্গেরির ইতিহাসও ইস্টার্ন ব্লকের অন্যান্য দেশের মতন। একসময় নানা উপজাতির যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত এই অঞ্চলে প্রথমে রোমান, তারপর অটোমান সাম্রাজ্য এসে দখল নেয়। মধ্যযুগের শেষের দিকে হাপ্সবুর্গ বংশের কাছে চলে আসে এই অঞ্চল। সেই সময় থেকে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল হাঙ্গেরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রো-হাঙ্গেরি রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার পর হাঙ্গেরি স্বাধীন দেশ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে থাকার মূল্য দিতে বহু মানুষের প্রাণহানি হয় হাঙ্গেরিতে। সোভিয়েত সৈন্যেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগেই হাঙ্গেরি দখল করে নেয় এবং জার্মানদের তাড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক (পড়ুন কমিউনিস্ট) রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের কাজ শুরু করে। সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও খুব একটা সুখের হয়নি, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে অনেক দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে আসতে হয়েছে হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষকে।
বুডাপেস্ট বাস স্টেশনে নেমে আমরা মেট্রো ধরব বলে এগিয়ে গেলাম। এইখানে আবার হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্ট চলে, সেই টাকা তুলে মেশিনে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি কিছুই বুঝতে পারছি না। টাকার মতো ভাষাও হাঙ্গেরিয়ান। অল্পবয়সী একটি মেয়েকে সমস্যাটা বোঝাতে গিয়েই আমাদের মাথা ধরে গেল। মেয়েটি মনে হয় সদ্য কাজ শুরু করেছে, আমাদের আগে কেউই ইংরেজিতে প্রশ্ন করে ওকে বিরক্ত করেনি। সে একবর্ণ ইংরেজি জানে না, আমাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হব-হব করছে দেখে আমরাই তাকে মুক্তি দিলাম। দেশটা অস্ট্রিয়া বা সুইটজারল্যান্ড নয়, নিজের বুদ্ধি খরচ করাই ভালো।
দেখেশুনে মেশিনে টাকা দিয়ে টিকিট কেটে মেট্রো করে আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় চলে এলাম। মেট্রো স্টেশন থেকে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি চওড়া-চওড়া রাস্তা, একগাদা বাস, গাড়ি, মোটরসাইকেল চলছে। স্থানীয় হোমস্টেতে সস্তার একটা ঘর ঠিক করা ছিল, খুঁজে খুঁজে সেটা বের করা হল। বাড়িটা খুব বড় না হলেও খারাপ না, রান্নাঘর আছে। বাড়িওয়ালা সেখানে থাকে না, অন্য দুটো ঘরেও অতিথিরা আছে বলে মনে হল।
স্নান-টান সেরে কফি মেশিন থেকে কফি খেয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমাদের পাশের ঘরে থাকা কোরিয়ান দম্পতির সঙ্গে। দুজনেই অল্পবয়সী, হেসে হেসে কথা বলে। তারা এক বছর ধরে ইউরোপে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বুডাপেস্ট এসেছে এক সপ্তাহ আগে। জিনিসপত্র নাকি এখানে কোরিয়া থেকে ঢের সস্তা, সেই আনন্দেই দু'হাতে খরচ করছে। এখান থেকেই তারা কোরিয়ায় ফিরবে। আমাদের তারা বুডাপেস্ট-এর হাল-হকিকত বুঝিয়ে দিল, একটা ভালো হাঙ্গেরিয়ান রেস্তোরাঁর খোঁজও দিল। কফি খেয়ে, তাদের হাত নেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় নেমে সঙ্গিনী বললেন, "দেখলি, ওরাও এখান থেকেই দেশে ফিরছে। বুডাপেস্ট তাহলে জনপ্রিয় ব্যাকপ্যাকিং রুটে শেষ পয়েন্ট।"
ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিকই বটে। ইস্টার্ন ব্লকে প্রাগ আর বুডাপেস্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা, অনেকে অবশ্য পোল্যান্ডের শহর ক্রাকো থেকেও ফেরার প্লেন ধরে। কাছেই স্লোভেনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়ার মত অসম্ভব সুন্দর দেশ থাকলেও ভিসার ঝামেলার কারণে অনেকেই সেইখানে যেতে পারে না। বিত্তশালী দেশের নাগরিকদের অবশ্য বেশিরভাগ দেশেই 'ফ্রি-ভিসা'। আমাদের আপাতত সেই সৌভাগ্য হয়নি, ভবিষ্যতে হবে বলে মনেও হয় না, অতএব বুডাপেস্ট আমাদের যাত্রার শেষ সঙ্গী।
রাস্তা পেরিয়ে আমরা চলেছি ড্যানিয়ুব নদীর দিকে। বুডাপেস্ট আসলে দুটো শহরের সন্ধিস্থল। আমরা যেদিকে আছি সেটা পেস্ট, নদীর অপর প্রান্তে বুডা। বুডা আর পেস্টের মাঝে ড্যানিয়ুব নদীর জনপ্রিয় সেতু 'সেনচেই চেইন ব্রিজ'।
এই সেতুর দুদিকেই অজস্র চোখধাঁধানো নিদর্শন আছে। সেতু পেরিয়ে গেলেই যে উঁচু পাহাড়টি চোখে পড়ে, তার নাম 'কাসল হিল'। পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত দুই বুডাপেস্ট শহরের দুই প্রতীক 'বুডা কাসল' এবং 'ফিশরম্যান ব্যাসটন'। এই দুটি দুর্গপ্রাসাদ ছাড়াও আরো বহু জায়গা আছে, সেগুলোর কথা এখন আর লিখছি না। পেস্টের দিকে আবার নানা ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশাপাশি নানা সরকারি দপ্তর। বুদাপেস্টের সংসদ অথবা 'পার্লিয়ামেন্ট'-এর বিশাল ভবনটি এদের মধ্যে অসামান্য সুন্দর। রাতে আলো জ্বললে সোনার প্রাসাদের মতন মনে হয়।
চওড়া গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যুবক যুবতীদের হাসি দেখতে পাচ্ছি। অনেকে পার্টি করতে চলেছে, কয়েকজন স্কেট বোর্ড নিয়ে সাঁই-সাঁই করে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। পাড়াগুলো যে খুব অভিজাত সেরকম মনে হয় না, কিন্তু পরিবেশে বেশ একটা ফুর্তির ভাব আছে। দেওয়ালের ওপর নানাধরনের রংচঙে স্ট্রিট আর্টের নমুনা চোখে পড়ে আর চোখে পড়ে বহুদেশীয় রেস্তোরাঁ।
একসময় আমরা নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। হাঁটতে মিনিট তিরিশ লেগেছে। দূর থেকে আলোকিত সেনচেই চেইন সেতুর খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু নদীর সামনে এসে আমি সত্যি সত্যিই প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রতিটা নতুন দ্রষ্টব্য দেখে এরকম বাড়াবাড়ি রকম বিশেষণ দেওয়া অনেকের কাছে একঘেয়ে মনে হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে এমন সুন্দর রাতের দৃশ্য আমি সত্যিই আগে কোনোদিন দেখিনি। ড্যানিয়ুব নদী আর দু'দিকের অঞ্চলগুলো যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো। নদী এখানে বেশ চওড়া। হাঁটতে হাঁটতে আমরা চেইন সেতুর ওপর দিয়ে মাঝামাঝি গিয়ে দাঁড়ালাম।
দূরে পার্লিয়ামেন্ট ভবনের আলোটা এমন ঝকমক করছে যে নদীর ধারের বাকি জায়গাগুলোর আকর্ষণ ম্লান হয়ে গেছে। সেতুর অন্যদিকে পাহাড়ের ওপরে দুর্গের আলো দেখা যাচ্ছে। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রূজগুলোর ওপরেই উদ্দাম পার্টি চলছে, তার রেশ ভেসে আসছে এখানেও। দূরের লিবার্টি ব্রিজ আর এলিজাবেথ সেতুর ওপর গাড়ির আনাগোনা আবছা ভাবে চোখে পড়ছে। নদীর দুই পাড়ের সোনালি আলোকরেখার প্রতিবিম্ব দ্যানিয়ুবের জলে এসে পড়ছে আর আমরা ভ্যাবলাকান্তের মত বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি সেদিকে। সত্যি, চোখের পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না।
অনেকক্ষণ সময় কাটলে ধাতস্থ হলাম। সব সুন্দর দৃশ্যই একসময় চোখে সয়ে যায়। তখন সেটা না দেখতে পেলেই বরং বিস্ময় হয়। এদিকে রাতও হয়েছে। আমাদের পেটে বহুক্ষণ ধরেই ছুঁচোরা ডন মারছে। ফিরেই যখন যাচ্ছি, শেষ ক'দিন আর রান্নাবান্না করে কী হবে? আলোচনা করে ঠিক হল ওই রেস্তোরাঁতেই যাওয়া যাক, কোরিয়ান ছেলেমেয়ে দুটো যেটার বলেছিল। জায়গাটার নাম লিখে রাখা হয়েছিল- ফ্রিচি পাপা। খাস হাঙ্গেরিয়ান স্থানীয় খাবার পাওয়া যাবে, দামও নাকি আয়ত্তের মধ্যে।
খুঁজে খুঁজে চললাম পাপার কাছে। দলে-দলে ছেলেমেয়েরা রাস্তা দিয়ে চলেছে। বুডাপেস্টের 'নাইটলাইফ'-এর রমরমা আছে। খুব সস্তায় ভালো পানীয় এবং খাবারসহ সন্ধ্যাযাপনের ব্যবস্থা। এখন এমনিতেও গ্রীষ্মকাল চলছে, উৎসবেরই সময়। শীতকালে এরাই সব গিয়ে সেঁধোবে বাড়ির ভিতর, এ শহরে বরফের রাজত্ব চলবে। তখন নাইটলাইফ থাকে কি? থাকলে যে ঠিক কী রকম থাকে সেটা দেখার একটা সুপ্ত বাসনা রয়ে গেল মনে!
হাঁটাহাঁটি করলে জায়গাটার মেজাজ বুঝতে অনেকটাই সুবিধে হয়। গত তিনঘন্টা ধরে ক্রমাগত হাঁটছি, এইবার ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি বুডাপেস্ট বেশ 'দিলখুশ' কিসিমের জায়গা। এখানে কিছুই নিষিদ্ধ নয়, সব ধরনের মানুষের জন্য অবারিত দ্বার। এই খোলামেলা ভাবটা এখনকার মানুষের মধ্যেও খেয়াল করছি। পাশাপাশি শহরের পাড়াগুলোর মধ্যে বেশ একটা নতুন যৌবনের লাবণ্য আছে, কিসমিসের গন্ধ মাখানো প্রেম প্রেম ভাব আছে। মেটাল রক আছে, কান্ট্রি মিউজিক আছে, বালকান সঙ্গীত আছে, আবার ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালের সমঝদারও কম নেই। অসামান্য নিসর্গ আর বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ যেমন আছে, আয়ত্তের মধ্যে থাকা অগুনতি পাব, রেস্তোরাঁ আর রকবাজির আমুদে আড্ডারও অভাব নেই। এই তোয়াক্কাহীন বা 'দিলফেঁক' আমেজ যে ব্যাকপ্যাকারদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠবে, সে আর আশ্চর্য কি! ক্যাফেগুলোর বাইরে তুমুল আড্ডা চলছে, অনেকে খোলা গলায় (বা খালি গায়ে) গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে চলেছে। কেউ বারণ করে না। মিনিট কুড়ির মধ্যে কতবার যে অচেনা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে 'ফিস্ট বাম্প' করলাম, ফ্লাইং কিস বিনিময় করলাম, হাত তুলে অভিবাদন জানালাম বা নীরব হাসি ছুঁড়ে এগিয়ে গেলাম, তার কোনও হিসেব নেই।
এই গলি ওই গলি করে শেষে ফ্রিচি পাপার কাছে চলে এলাম। দোকানের যে নামডাক আছে, সেটা ভিড়ের বহর দেখেই বুঝতে পারছি। এরা আবার খুচরো টাকা না হলে নেয় না, সুতরাং আমাদের আবার কিছুটা হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্ট বার করতে হল এটিএম থেকে। রেস্তোরাঁয় গিয়ে মেনু দেখে মাশরুম গুলাশ আর পাস্তার অর্ডার দিলাম। দিব্যি জায়গাটা। একদম স্থানীয় মানুষদের ঠেক যেমন হয়, তেমনই। টেবিলে টেবিলে জোর আলোচনা চলছে। উত্তপ্ত আলোচনা থেকে চুটকি হাসি, সব কিছুই আছে। বিজাতীয় ভাষার কথাবার্তা যদিও কিছুই বুঝলাম না, কিন্তু আড্ডার উষ্ণতার অনুভব করতে কষ্ট হল না। খাবারও চলে এল একসময়। ফ্রিচি পাপার রান্না সত্যিই ভালো। দারুণ ক্ষিদে পেয়েছিল। একদম সাপটে খেয়ে বাটি পরিষ্কার করে চেয়ার ছাড়লাম, তারপর সকলের দেখাদেখি হেঁড়ে গলায় গান করতে করতে বাড়ির পথ ধরলাম।
২) পরদিন সকাল সকাল আমাদের মোলাকাত হল বুডাপেস্টের সুলতানের সঙ্গে। ওহঃ! দুঃখিত! সুলতান নয়, নাম তার জুলতান। সাতসকালে সঙ্গিনী ভুল করে একটা দামি জায়গায় স্যালাদের মত কীসব হাবিজাবি খাইয়ে মেজাজ গরম করে দিয়েছিলেন, তেনার মতে অবশ্য সবটাই গুগল ম্যাপের চক্রান্ত। কিন্তু জুলতানের মুচকি হাসি আর গল্পের বহরে মেজাজ ভালো হতে খুব একটা সময় লাগল না। বুডাপেস্ট শহরে তারা কয়েকজন মিলে অন্যান্য শহরের মত ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর শুরু করেছে, খুবই আন্তরিক ভাবে শহরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় নবাগন্তুকদের। জুলতান খুব একটানা ইতিহাসের কচকচিতে যায় না, বরং স্থানীয় মানুষের স্বভাব চরিত্রের কথা বলে আড্ডা জমিয়ে রাখে জম্পেশ।
কথায়-কথায় জুলতান আমাদের জিগ্গেস করল, "ভেবে দেখ তো সারা দুনিয়ার লোক চেনে এমন কয়েকজন হাঙ্গেরিয়ান মানুষের নাম বলতে পারো কিনা?"
এই মরেছে। প্রেস্টিজে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার মতলব করছে জুলতান ব্যাটা! অত্তিলা জোসেফ এখানকার বিখ্যাত কবি সেটা জানি। তাঁর লেখা বিবিধ ভাষায় অনুবাদ হয়েছে; কিন্তু তাঁকে ঠিক সেলেব্রিটি বলা যায় না। ঔপন্যাসিক ইমরে কার্তেজ আর ম্যাগদা সাবোকে নিয়েও সেই একই ঝামেলা। মাথা চুলকোচ্ছি, এদিকে লোকজন দেখি পটাপট নাম বলছে। মার্কিন পরিচালক টনি কার্টিস, অভিনেত্রী রেচেল ওয়াইস, কেট হাডসন, এর্নো রুবিক। যাচ্চলে! এরা যে হাঙ্গেরির মানুষ আমি সেটাই জানতাম না। ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল পুরো। আচমকা চিড়িক করে একটা নাম এসে গেল মাথায়। বললাম," হুডিনি। ম্যাজিশিয়ান হ্যারি হুডিনি।"
জুলতান মাথা নেড়ে বলল,"হুমম। ঠিক হ্যায়। ম্যাজিশিয়ান ব্যাটা এখানে জন্মেছিল ঠিকই, কিন্তু কয়েকদিন পরেই ফুটে যায়। জীবনে কোনোদিন এখানে থাকেনি হুডিনি।" আমার চুপসে যাওয়া মুখটা তখন একেবারে পোড়া বেগুনভাজার মত হয়ে গেছে।
বুডাপেস্টের প্রধান রাস্তা আন্দ্রেসি অ্যাভেনিউ ধরে আমরা ওল্ড টাউনের গির্জার দিকে চলেছি। রাস্তার দু' ধারে নিও-গথিক শৈলীর বাড়ি এবং শৈল্পিক সমারোহের জন্যে এই রাস্তাটাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট করে দেওয়া হয়েছে, সেই সূত্রে অনেকেই দেখি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিমা করে একের পর এক ছবি তুলে চলেছে। গির্জাটি অবশ্য মোটের ওপর সাদামাঠাই। এই সফরে তাবড় তাবড় গির্জা দেখেছি, ভালো লাগার মাপকাঠি অনেক ওপরে উঠে গেছে। শুধু সুন্দর দেখলেই পুরো নম্বর দিই না। যতক্ষণ না একেবারে মাথা ঘুরে যায়, 'ব্রাউনি পয়েন্ট' দেওয়ায় কৃপণতাই করে চলি আজকাল। জুলতানকে সে কথা বলতে সে একগাল হেসে বলল, "ঠিক বলেছ। তবে জানো কি, বুডাপেস্টে গির্জা না দেখে বরং সিনাগগ দেখা উচিৎ। ইউরোপের সর্ববৃহৎ সিনাগগ হল এখানে। রঙের বাহার দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। মুশকিল হল কাজ হচ্ছে বলে সিনাগগটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে, তাও বাইরে থেকে দেখলে খানিকটা আন্দাজ পাবে।"
হাই তুলে বললাম, "জুলতান স্যার, সময়ের বড় অভাব। আর পকেটও হাতখাড়া করে দিয়েছে। এত-এত জায়গা দেখাও হবে না। একটা জায়গা দেখতে হলে কী দেখব বল দেখি?"
জুলতান মাথা নেড়ে বলল, "একটা জিনিস দেখতে হলে তোমরা স্নানঘরগুলো ঘুরে এস। অটোমান সাম্রাজ্যের সময় অনেকগুলো থার্মাল বাথ তৈরি করা হয়েছিল, অনেকটা টার্কিশ বাথের মতন। ও জিনিস একমাত্র ইস্তাম্বুল ছাড়া কোথাও পাবে না।"
আমি বললাম, "সে কী হে! সবগুলো দেখতে গেলে আমাদের এয়ারপোর্ট যাওয়ার টাকা ফুরিয়ে যাবে হে! দেখতে পাচ্ছ না ফ্রি ওয়াক করছি, তোমার বরাদ্দ টিপও দিতে পারব কি না সন্দেহ আছে। একটা সস্তার বাথহাউসের খবর দাও সোনা।"
জুলতান একগাল হেসে আমার কাঁধে একটা রামপ্রসাদী চাপড় মেরে বলল, "বটে! তাই সই। তোমরা তাহলে গ্যালার্ট বাথ থেকে ঘুরে এস। সেনচেই থার্মাল বাথ সবচেয়ে বড় ঠিকই কিন্তু গ্যালার্ট হিলের স্নানাগারটার একটা আলাদা জৌলুস আছে। দেখে ভড়কে যাবে নিশ্চিত।"
এইবার আমি আনাচে কানাচে দেখে নিয়ে বললাম, "জুলতান, এখানে শুনেছি বহু ভুতের বাড়ি আছে? সেখানে নাইটক্লাব হয়ে গেছে? সেখানে গেলে ভূত-ফুত দেখার চান্স মিলবে নাকি?"
"তোমার ভাগ্য সদয় থাকলে মিলতেও পারে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আসলে ভূত।" জুলতান খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, "ওই নাইটক্লাবগুলোকে বলে রুইন বার। কিন্তু সত্যিকারের ভূত আজকাল উবে গিয়েছে। তবে জানো তো বুডাপেস্ট বহু ভুতুড়ে কাণ্ড হয়েছে এককালে। তিরিশের দশকে পিয়ানোবাদক রেজসো সেরেস 'গ্লুমি সানডে' বলে একটা গান রচনা করেছিলেন, সেটা শুনেই লোকে আত্মহত্যা করত। গানের নামই হয়ে গিয়েছিল সুইসাইড সঙ। মোট এগারোটা আত্মহত্যার সঙ্গে ওই গানের সংযোগ পাওয়া যায়। তারপর সরকারি আদেশে সেই গানটা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। ভয়ানক কেস। "
"উরিব্বাস! তারপর!"
"তারপর আর কি? সেই দুঃখে রেজসো সেরেস বেচারা নিজেও আত্মহত্যা করেন।" জুলতানের মহানন্দে বলল।
কী সর্বনেশে কেস রে ভাই! ঠিকঠাক করে ঝাড়তে পারলে নির্ঘাত একটা বাংলা উপন্যাস হয়ে যাবে। রেজসো সেরেস ঠিক কী গান গাইতেন জানি না, তবে এখন এক জনপ্রিয় ইউটিউব গায়িকার জ্বালাময়ী গান শুনে আমার নিজেরই আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়। শ্রোতাদের অবশ্য হেলদোল নেই। আজকালকার মানুষের ক্যালি আছে। টিকটকে মাঝে মাঝে যে ধরনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে হুড়োহুড়ি হয়, সেসব শুনিয়ে দিলে রেজসো সেরেস থেকে মোৎসার্ট, প্রত্যেকেই তল্পিতল্পা নিয়ে দেশান্তরী হতেন।
গির্জা দেখে, অপেরা হাউসে উঁকি মেরে, সেনচেই ব্রিজ পার করে অন্যদিকে চলে এলাম। এর মাঝে দু ঘন্টা চলে গেছে। হেঁটে হেঁটে অনেকের পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে বলে জুলতান মিনিট কুড়ির জন্যে বিশ্রাম দিল। এরপর পাহাড়ের চড়াই আছে। আমরা সকলে কাসল হিলের কাছে অবস্থিত ছোট্ট পার্কে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম।
একটা হাই তুলে সঙ্গিনীকে বললাম, "কী ঠিক করলি? ভূতের বাড়িতে নাচতে যাবি না স্নান করতে যাবি? নাকি দুটোতেই যাবি?"
সঙ্গিনীও হাই তুলে প্রশ্ন করলেন, "নাকি ডাক্তারের কাছে যাবি? মাথার অবস্থাটা তো ভালো বুঝছি না।"
ধুত্তোর! আমি একটা গভীর আলোচনা করতে চাইছি, তার মধ্যে এইসব ইয়ার্কি ভালো লাগে? না হয় মাথায় একটু ছিট আছে, কিন্তু সেটা চাউর করার কী আছে রে ভাই? নাচতে না যাস না যাবি, অত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কী দরকার? বুডাপেস্টে দারুণ দারুণ 'রুইন বার' আছে, সে কথা অনেক আগেই শুনেছি। পুরোনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষে সারিয়ে-সুরিয়ে দিব্যি নাইটক্লাব করে দেওয়া হয়েছে। রোজ রাতে ভূতুড়ে বাড়িগুলোতে দেদার নাচগান হয়, সেখানে না গেলে নাকি বুডাপেস্টে আসাই ব্যর্থ। চুলোয় যাক! না গেলে আমি না হয় একাই গিয়ে শিবের নেত্য নেচে আসব।
পাহাড়ে উঠতে উঠতে আমার মাথায় আবার জিওপলিটিক্সের পোকা নড়ে উঠল। জুলতানকে জিগ্গেস করলাম, "তোমাদের দেশে যে রাজনৈতিক আদর্শের এমন পরিবর্তন হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, সেটা নিয়ে সাধারণ মানুষের কী ধারণা?"
জুলতান জিগ্গেস করল, "পরিবর্তন বলতে?"
আমি উত্তর দিলাম, "এই ধরো হাঙ্গেরি তো জার্মানির পক্ষে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেইসময় তো এখানে গণহত্যায় লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে। তারপর সোভিয়েত রাশিয়ার দখলে আসার পর সাম্যবাদী ব্যবস্থা চলে আসে। সেটাও যে খুব সুখকর ছিল না, সেটা তো ১৯৫৬ সালের বিপ্লবেই বোঝা গিয়েছিল। তারপর হাঙ্গেরির রাজনীতিবিদরা পুঁজিবাদ আর তথাকথিত সমাজতন্ত্রের মাঝামাঝি একটা জায়গা পেতে চেয়েছিল। আজকাল তো মনে হয় কমিউনিজম মাথায় উঠেছে, পুরোপুরি পশ্চিমী কায়দায় অর্থনীতি চলছে। তাই জিগ্গেস করছি যে যারা এই সময়টা পেরিয়ে এসেছেন, তাদের এ নিয়ে মতামত কী?"
জুলতান মন দিয়ে শুনছিল। সে বলল, "অনেকগুলো ব্যাপার আছে। আসল কথা হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাঙ্গেরির সামনে হিটলারের কথা স্বীকার করা ছাড়া কোনও উপায়ই ছিল না। গরীব দেশ, সব অস্ত্রই আসত জার্মানি থেকে। তাও অনেকে চেষ্টা করেছিল মাঝামাঝির একটা রাস্তা বের করতে। হিটলার তাদের এমন ভয় দেখায় যে বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত বেচারাদের যুদ্ধে সেনা পাঠাতে হয়। এর ফলও তারা ভোগ করেছিল হাতেনাতেই। স্টালিনের সৈন্যরা সে সময় প্রায় কচুকাটা করেছে হাঙ্গেরির সৈন্যদের। নাজিরা মহা ঘোড়েল, বিপদ বুঝে আগেই পিটটান দিয়েছিল, এগিয়ে দিয়েছিল এই ভাড়াটে সৈনিকদের। স্বভাবতই সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন দেশ উদ্ধার করে দাদাগিরি শুরু করল, কেউই ভয়ে তাদের কিছু বলতে পারেনি। সে যুগে বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক ঋণ ছিল দেশের মাথায়, ভূখণ্ডের অনেকটা দিতে হয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়াকে। এই অবস্থায় সোশ্যালিস্ট আর কমিউনিস্ট বিচারধারা যে ক্ষমতা নিতে আসবে, সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু সে ব্যবস্থায় যে মানুষের খুব লাভ হয়েছিল সে তো নয়। পাসপোর্ট পর্যন্ত পাওয়া যেত না। দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি ছিল। আরো নানান নিয়মকানুন ছিল, যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। কিন্তু জীবনধারণের জন্যে প্রতিদিনের জিনিসপত্র যা লাগে, সেইসব কিন্তু সস্তা ছিল খুব। শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যবস্থাও খুব একটা দুর্মূল্য ছিল না। সেই নিয়ে খানিকটা হলেও পুরোনো আমলের মানুষদের মধ্যে 'সফ্ট স্পট' আছে। আজকাল তো পুরো উল্টো গঙ্গা বইছে। বুডাপেস্ট দিন দিন দামী জায়গা হয়ে উঠছে। আর্থিক প্রতিস্পর্ধায় নিম্নস্তরের মানুষেরা পিছিয়ে পড়ছে, শ্রেণীবিভেদ বাড়ছে চড়চড়িয়ে। তোমরা বরং কালকে দুপুরের কমিউনিজম ওয়াকে চলে যেও। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবে।"
অনেকটা রাস্তা চড়াই উঠে তারপর সিঁড়ি পাওয়া গেল। বাসে করেও আসা যায় কিন্তু আমরা ওয়াকিং ট্যুর করছি বলেই হেঁটে আসা। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ফিশরম্যান ব্যাসটন-এর বৈভবশালী প্রাসাদ। ফাউ হল এখান থেকে দেখতে পাওয়া চেইন ব্রিজ এবং পেস্ট শহরের দিকের অসামান্য দৃশ্য। এত ওপর থেকে প্রায় সারা শহরটাই দেখা যায়। সেই ছবি তুলতে লোকে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পাঁচিলের গায়ে। প্রাসাদটি যেরকম ছবিতে দেখেছিলাম, হুবহু সেরকম। নিও গথিক ও রোমান্টিক শৈলীর সঙ্গে খানিকটা মডার্ন আর্ট মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। একাধিক ভবন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সময় নিয়ে দেখতে হয়, স্থাপত্যকলা নিয়ে আগ্রহ থাকলে এই ভবনগুলো প্রায় শিক্ষাকেন্দ্রের সমান।
প্রাসাদের পিছন দিকে একটা ছায়াঘেরা উদ্যান। সেখানে এসে সকলে ছায়ায় বসল। ওয়াকিং ট্যুর এখানেই শেষ হবে, জুলতান বিদায় জানানোর আগে অনেকগুলো তথ্য দিয়ে দিল অন্যান্য জায়গা সম্পর্কে। এও জানা গেল যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রুইন বার হল গিয়ে 'সিমপ্লা কার্ট'। শুধুমাত্র একটা জায়গাতেই যেতে হলে ওই জায়গাটা নির্বাচিত করাই বেস্ট।
জুলতানকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাসে করে আমরা নেমে এলাম পাহাড়ের নিচে। বেশ রোদ হয়েছে। আমাদের পাড়ার ওদিকে একটা বাংলাদেশী রেস্তোরাঁ দেখে এসেছি, ওখানেই যাওয়া হবে। আজকে আমাদের বাঙালি খাবার খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। জায়গাটা খুঁজে বার করতে অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ ইউরোপে থাকেন, ব্যবসাপত্তর করেন। এই দোকানের মালিকও সেরকম একজন মানুষ। তবে বাংলাদেশের রেস্তোরাঁ বলে যে কাচ্চি বিরিয়ানি পাওয়া যাবে তা নয়! স্থানীয় মানুষের চাহিদা অনুযায়ীই রান্না হয় সাধারণত। যাই হোক, আমাদের ভাত ডাল হলেও ক্ষতি নেই। বাংলায় অর্ডার দিতে কি ভালই না লাগল! খাবারের স্বাদও খারাপ নয়, খেয়েদেয়ে পাশের সুপারমার্কেট থেকে চকোলেট কিনে দেওয়ালে আঁকা স্ট্রিট আর্টের নমুনা দেখতে দেখতে বাড়ির দিকে চললাম। পথে অনেকগুলো বইয়ের দোকান, সেখানে একমনে বসে বই পড়ছে ছেলেমেয়েরা। দেখেও ভালো লাগে।
হাঙ্গেরির মানুষজন সাহিত্যপ্রেমিক সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কঠোর সরকারি আইন ও দমনমূলক শাসন ব্যবস্থায় এত বছর কাটিয়েও যে পরিমাণ বিশ্বমানের সাহিত্য ও শিল্প এরা রচনা করেছে, তাকে ব্যতিক্রমই বলতে হবে। ভাষার সীমানার জন্যে এখানকার বহু সাহিত্যিকের রচনার কথা বাইরের লোকে জানতে পারে না। কিন্তু একটু খোঁজখবর নিলেই জানা যাবে যে ইউরোপিয়ান প্রকাশনার বাজারে তাঁদের যথেষ্ট সমীহ করা হয়। এখানকার একজনের সাহিত্যিকের অবশ্য সকলেই জানে, তিনি কবি অত্তিলা জোসেফ। তাঁর কবিতা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যদিও হাঙ্গেরির এই কবি মারা গিয়েছিলেন মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে। লা মুয়েদেত অথবা অভিশপ্ত কবিদের উল্লেখ আগেও করেছি, তাঁদের আরেকজন হলেন কবি অত্তিলা জোসেফ। অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা সত্ত্বেও সারা জীবন তিনি কাটিয়েছেন চরম দারিদ্র্য আর দুর্ভাগ্য নিয়েই। বাবা ছোটবেলাতেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, মা তাঁকে সহ্য করতে পারতেন না। সাত বছর বয়সে সেই কচি ছেলেকে দত্তক সন্তান নিতে আগ্রহী এক পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাতেও খুব একটা সুবিধা হয়নি। দুঃখকষ্টের মধ্যেই বড় হয়েছেন, পড়াশুনা করেছেন। বুডাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন একসময়। কিন্তু শয়তানের পক্ষ নিয়ে একটি বিতর্কিত কবিতা লেখার দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার ফলে কলেজের পড়াও এগোয়নি। অত্তিলা জীবনে বহু ধরনের কাজ করেছেন, দেখেছেন চরম অন্নকষ্ট। মাঝেমধ্যেই খেতে পেতেন না, শীতের কাপড়ও সম্বল ছিল না। রাতে কাঁপতেন থরথর করে, জ্বরজ্বারি লেগেই থাকত। এরই মধ্যে লিখে গিয়েছেন অবিরাম। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছিল যৌবনেই। ১৯৩৭ সালে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে অসুস্থ অবস্থায় ট্রেনের সামনে গিয়ে আত্মহত্যা করেন জোসেফ। তাঁর দীর্ঘ কবিতা 'সেভেন্থ' পড়লে সম্ভবত তার মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। গেবর তজসের ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন—
If you write and can afford it,
let seven men write your poem.
One, who builds a marble village,
one, who was born in his sleep,
one, who charts the sky and knows it,
one, whom words call by his name,
one, who perfected his soul,
one, who dissects living rats.
Two are brave and four are wise;
You yourself must be the seventh
And if all went as was written,
you will die for seven men.
One, who is rocked and suckled,
one, who grabs a hard young breast,
one, who throws down empty dishes,
one, who helps the poor win;
one, who worked till he goes to pieces,
one, who just stares at the moon.
The world will be your tombstone:
you yourself must be the seventh
অত্তিলা জোসেফ অবশ্য একা নন, গত পঞ্চাশ বছরেও হাঙ্গেরিতে অসংখ্য ভালো সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ করেছেন। ইমরে কার্তেজ নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। বুকারজয়ী লাজলো ক্রাসনাওহোরকের লেখা পড়ে বিখ্যাত প্রবন্ধকার ও আলোচক সুসান সোনট্যাগ তাঁকে 'মাস্টার অফ দ্য অ্যাপোক্লিপ্স' আখ্যা দিয়েছিলেন। পিটার নাদাসের উচ্চাকাঙ্খী প্রজেক্ট 'আ বুক অফ মেমোয়ার্স', ম্যাগদা সাবোর 'দ্য ডোর' আর আতিলা বার্টিসের 'ট্র্যাঙ্কুয়ালিটি' সহ বেশ কিছু বই অন্যান্য ভাষার পাঠকদের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠেছে। সমসাময়িক কবি লেখকদের মধ্যে ডেনিস ক্রুসভস্কি, রেকা মান-ভারহেজ, ক্রিস্টিয়ান গ্রেস্কো, এদিনা ভোরেন, আত্তিলা ভেরেসরাও যথেষ্ট সাড়া ফেলেছেন।
Random Shot from Castle Hill |
Shoes on Danube Bank |
বিকেলে কোথায় যাব, সেই পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল। সিমপ্লা কার্ট-এর রুইন বার। কিন্তু তার আগে ড্যানিযুবের সঙ্গে আরো খানিকটা পরিচিতি বাড়ানো দরকার। নদীর ধার দিয়ে ট্রাম যায় সোজা পার্লিয়ামেন্ট পর্যন্ত, আমরাও সেই ট্রামে উঠে চললুম। বাঁ দিকে ড্যানিয়ুবের কোবাল্ট ব্লু জল আর ডানদিকে গথিক আর বারোক শৈলীর নিদর্শন দেখতে দেখতে একসময় পার্লিয়ামেন্ট চত্বরে পৌঁছে গেলাম। বারোক শৈলীর এই সুবিশাল স্থাপত্যের অলঙ্করণ দেখলে যেমন মুগ্ধ হতে হয়, তেমনই মুগ্ধ হতে হয় এই চত্বরের পরিবেশ দেখলে। নদীর ঠিক ধরে অবস্থিত এই চত্বরে অনেকগুলো বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে গাছের সারি। শেষ বিকেলের সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্যানিয়ুবের বুকে সূর্য ডুবে যাবে। নদীর দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেই ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়।
একসময় সত্যি সূর্যাস্ত হল। আলো জ্বলে উঠলো চারিদিকে। কাল দূর থেকে দেখা সোনালি আলোর অট্টালিকা আজ আমাদের চোখের সামনে, আলোর দ্যুতিতে অপূর্ব দেখাচ্ছে তাকে। নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চললাম চেইন সেতুর দিকে। মাঝের একটা জায়গায় অনেকগুলো জুতো পড়ে আছে। আসল জুতো নয়, জুতোর প্রতিকৃতি। জায়গাটার কথা আমাদের বলেছিল জুলতান। ১৯৪৪-৪৫ সালে অ্যারো ক্রস পার্টি অসংখ্য মানুষকে গুলি করেছিল এই স্থানে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন ইহুদি। গুলি খেয়ে তারা উল্টে পড়ত ড্যানিয়ুব নদীতে। রক্তে লাল হয়ে উঠত নদীর রং। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি থেকেই নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতিসৌধ। খেয়াল করলে দেখা যায় বাচ্চাদের জুতোও আছে এদের মধ্যে। শিশুরাও এই মৃত্যুকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি সেই সময়ে। সেই ঘটনার কথা ভাবলে আজও বুক কেঁপে ওঠে।
ব্রিজ পেরিয়ে পায়ে হাঁটা আলোআঁধারি চড়াই রাস্তা দিয়ে উঠে বুডা কাসলের চত্বরে চলে এলাম। এখান থেকে চেইন সেতুর দুই প্রান্তই দেখা যাচ্ছে, সঙ্গে দেখা যাচ্ছে সোনালি আলোয় স্নান করে থাকা পেস্ট অঞ্চল। এমন অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য গত কয়েকমাসেও বার দুয়েক দেখেছি হয়তো। কোন-কোন দৃশ্য অমলিন স্মৃতি হয়ে মনে রয়ে যায় চিরকালের জন্যে। যতটা সম্ভব চোখের সামনের পৃথিবীটা মনের ক্যামেরায় বন্দী করে রাখার চেষ্টা করি তখন। এই সঞ্চয়ের কোনও দাম হয় না।
অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার নেমে এলাম। পরবর্তী গন্তব্য সিমপ্লা কার্ট। সেখানে গিয়েও আরেকপ্রস্থ তাজ্জব হতে হল। সঙ্গিনী সকালে মুখ ভেটকালে কী হবে, তিনিও সঙ্গে এসেছেন ঠিকই। এমন ভাঙাচোরা ভূতুড়ে বাড়িকে আলো আঁধারি পরিবেশ আর ডিস্কোলাইট সহ গান চালিয়ে যে রূপ দেওয়া হয়েছে তাতে তাবড়-তাবড় পাঁচতারা হোটেলের নাইটক্লাবরাও লজ্জা পাবে। তিনতলা জুড়ে ডিস্কো লাইট, অনেকগুলো কাউন্টার আছে। কোথাও খাবার, কোথাও ওয়াইন, কোথাও স্থানীয় পানীয় পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে মানানসই গানের সুরও বাজছে, তালে তালে নাচছে লোকজন। সত্যিই ধাঁধা লেগে যায়। ওয়াইন হাতে আমরাও সেই দলে ভিড়ে গেলাম। তারপর কী হল, সেটা বরং উহ্য থাক। পাঠকরা বরং যা ইচ্ছে ভেবে নিন। কল্পনার উড়ান বলেও তো একটা জিনিস আছে।
৩) হাতে মাত্র একদিনই ছিল। পরের দিন সাতসকালে বাসে করে চলে এলাম গ্যালার্ট হিলের বাথহাউস অর্থাৎ স্নানাগারে। নামেই স্নানাগার, আসলে দেখে মনে হয় রাজবাড়ি অথবা বিলাসবহুল অট্টালিকা। ঝাঁ চকচকে সোনালি মেঝে, বড় বড় শৌখিন ঝারণবাতি ঝুলছে উঁচু সিলিং থেকে। ছাদে নানাধরনের শৈল্পিক অলঙ্করণ করা।
ব্যবস্থা বেশ ভালো। নিজস্ব লকার পাওয়া যায়। সেখানে জামাকাপড় রেখে সাঁতারের পোশাক পরে ভিতরে যেতে হয়। অনেকগুলো সুইমিং পুল অথবা স্নানাগার আছে, কয়েকটা ভিতরে কয়েকটা বাইরে। এদের মধ্যে অনেকগুলো 'থার্মাল বাথ' অর্থাৎ উষ্ণ প্রস্রবণ। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত করা আছে। যেখানে খুশি নেমে পড়লেই হল। ভিতরের স্নানাগারগুলো বেশি সুন্দর, ছাদের দিকে মাথা তুললেই মনে হয় রাজবাড়ির নিজস্ব স্নানাগারে স্নান করছি। দেওয়ালের জৌলুসও কম নয়। আঁকিবুঁকির জৌলুস আছে ভালোই, সঙ্গে রঙিন টাইলে খোদাই করা শিল্পাকৃতি।
ঘুরে ঘুরে সবগুলো স্নানাগারেই স্নান হল। মনে মনে ভাবলাম, অনেক পুণ্য করেছি বলে এখানে আসা। আবার অন্যদিক থেকেও দেখা যায়। গত কয়েকমাসের যত পাপ, ধুয়ে নিলাম এই রাজকীয় স্নানে। এরকম আরো বহু স্নানাগার আছে বুডাপেস্ট শহরে। সেগুলো না হয় পরেরবারের জন্যে তোলা রইল। দুপুরবেলা আমরা জুলতানের কথা মতো কমিউনিজম ওয়াক করব বলে ঠিক করেছিলাম। সেইমতো নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি সময়মতো। গাইডের নাম মার্ক, বয়স অল্প। আমাদের সঙ্গে সেই যাবে। ইতিহাসের নানা পরিচিত ও অপরিচিত ঘটনা নিয়ে আমাদের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল সে দিন। ঘটনাগুলো অনেকের কাছে জানা হলেও আমি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করে রাখছি।
মার্কো ব্যাগে করে কয়েকটা ছবি নিয়ে এসেছিল। তার প্রথম দুটি ছবি ছিল মাত্যাস রাকোসী এবং ইমরে নেগীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক পার্টির দায়িত্ব নিয়েছিলেন মাত্যাস রাকোসী। তাঁর চাপিয়ে দেওয়া কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা মানতে গিয়ে সাধারণ মানুষের প্রায় প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। ১৯৫৩ সালে স্টালিন মারা যান এবং ইস্টার্ন ব্লক-এর দেশগুলোর সাহায্য চেয়ে ১৯৫৫ সোভিয়েত ইউনিয়ন ওয়ারশ প্যাক্ট-এর চুক্তি করে। এদিকে সাধারণ মানুষের ওপর হতে থাকা জোরজুলুমে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছিল। ১৯৫৬ সালে ছাত্রসংঘ ষোলটি আবেদন জানিয়ে সরকারকে চিঠি পাঠায় এবং রেডিওর দপ্তরে ঢুকে তাদের বক্তব্য সম্প্রচার করার চেষ্টা করে। সে চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের সকলকেই ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনার জেরই বিপ্লব ডেকে আনল। সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। বিক্ষোভসৃষ্টিকারীরা সত্যি বলতে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি, রাজনৈতিক আদর্শের বিশেষ ভূমিকা ছিল না এই বিপ্লবে। মোদ্দা কথা হল, দেশের সরকারের স্বৈরশাসক মনোভাব আর দাদাগিরি তাদের সহ্য হয়নি। বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে এসে মিছিল করতে শুরু করে দিনের পর দিন ধরে। সরকারও নাছোড়বান্দা। তারা বিক্ষোভ দমন করার জন্য সোজা গুলি চালাতে নির্দেশ দেয়। সরকারের পক্ষের অনেকেই আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতের পুতুল ছিলেন, তাদের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি কতটা ছিল তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গিয়েছে আজও।
বিক্ষোভ কিন্তু থামেনি। এই ঘটনার পর ৫৬ সালের বিপ্লব আরো ভয়ানক চেহারা নেই। ছাত্রদের সঙ্গে এসে জোটে কৃষক এবং সাধারণ মানুষেরা। ইমরে নেগীকে ডেকে নিয়ে আসা হয় বিপ্লবে নেতৃত্ব করার জন্যে। আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরে নেগী, কমিউনিস্ট মতে বিশ্বাসী হলেও তিনি ছিলেন মুক্তমনা, নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা তার স্বভাবে ছিল না। সমাজতন্ত্র বলে যে দেশের মানুষকে শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে নির্যাতন করা হবে, কোনোরকম সুযোগসুবিধে দেওয়া হবে না, এই মানসিকতাকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন প্রথম থেকেই। বিপ্লব শুরু হতে তিনি এই আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন।
এই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে হাঙ্গেরির গ্রামে গ্রামে। একসময় বিপ্লবীরা দখল করে নেয় বুডাপেস্টের সরকারি দপ্তরগুলো। কমিউনিস্ট সৈন্যরা পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু এই সাফল্যও খুব বেশিদিন থাকেনি। প্রথমদিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন কয়েকদিনের মধ্যে পেল্লায় বাহিনী পাঠিয়ে আবার কব্জা করে নেয় বুডাপেস্ট। শত-শত বিপ্লবীকে শুলে চড়ানো হয়। অনেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান দেশ থেকে। ইমরে নেগীও পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ভাগ্য সহায় হয়নি। রাজনৈতিক চক্রান্তের অপরাধে তাঁকে মৃত্যদন্ড দেওয়া হয়।
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ১৯৫৬ সালের এই গণবিপ্লবের কথা বহুদিন পৃথিবীর মানুষ জানতে পারেনি। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী সংবাদপত্রে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। লোকে জানতে পারে যে এই বিপ্লব নিছকই সমাজতান্ত্রিক বিরোধীদের চক্রান্ত ছিল। দেশের সাধারণ মানুষ যে সরকারের নিরঙ্কুশ ব্যবহার আর কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সে খবর চাপা পড়ে থাকে বহুবছর। এর পর অবশ্য হাঙ্গেরির সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেকটাই শিথিল হতে থাকে ধীরে ধীরে। কঠোর নিয়ম তুলে নিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। হাঙ্গেরির ইতিহাসে এই মিশ্র ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে 'গুলাশ কমিউনিজম'।
মার্ক আমাদের ঘুরে ঘুরে ১৯৫৬ সালের বিপ্লবের নানান চিহ্ন দেখাল। সেই রেডিও হাউস, সংসদ চত্বরের দেওয়ালে মিছিলের ওপর চালানো গুলির চিহ্ন আজও একইরকম আছে। শহরের অচেনা গলিঘুঁজিতে নিয়ে যাওয়ার সুবাদে এমন সমস্ত কাহিনি শোনা হল, যা এমনিতে জানা আমাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল।
Szimpla Kert-Budapest Ruin Bar |
Gallart Bath |
ঘন্টাদুয়েক পর মার্ককে বিদায় জানালাম। সন্ধ্যে হতে আর দেরি নেই। সামনেই ড্যানিয়ুব নদী দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম। সেই বিদায় মুহূর্ত সত্যিই চলে এল। স্মৃতির সঞ্চয়ে কতই না সূর্যাস্ত আছে। কোনও কোন দিন রোমাঞ্চিত হয়েছি, আবদ্ধ হয়েছি বিস্ময়ে। ভালো লাগার আবেশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু আজ প্রথম ড্যানিয়ুবের বুকের এই সূর্যাস্ত একটা মনকেমন করা আবেগ নিয়ে এসেছে। গোলাপি আলো ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে জলে। স্নিগ্ধ পরিবেশে উড়ে যাচ্ছে ঘরে ফেরা পাখির দল। আমার গলার কাছটা আবার ভারী ভারী লাগে। আবার চোখ ভিজে যায় নিয়ম মেনে। আর কি কোনোদিন ফেরা হবে?
হয়তো বহু বছর পড়ে হঠাৎ করে এই মুহুর্তটা জেগে উঠবে চোখের সামনে। ঠিক বাস্তবের মতো! হাতছানি দিয়ে ডাকবে ফিরে আসতে। আমি মনে মনে হাসব। এই সম্পর্কটা বড় অদ্ভুত। ফিরে তাকালে শুধু পথটুকু মনে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত জীবনের গল্প অথবা সাদাকালো স্মৃতি। কয়েক বছর পর সেই স্মৃতিও আবছা হয়ে আসে। গতিশীল ঘটনাগুলো মুছে গিয়ে কয়েকটা ফ্রেম পড়ে থাকে। সেই নামহীন ফ্রেম নিয়ে আবার এগিয়ে যাই। অন্য কোনও দেশের পথে, অন্য কোনও গল্পের খাতিরে, নিরুদ্দেশের যাত্রায়। এই স্বপ্নটাই বেঁচে থাক। বেঁচে থাক গন্তব্যহীন পথ। শুধু সেইটুকুই তো চাই। শুধু সেইটুকুই তো চেয়েছিলাম। আমি সত্যিই নিরুদ্দেশ হতে চেয়েছিলাম।
-সমাপ্ত-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন