১)মন্দিরের সিঁড়িতে বসে রোজকার মতো সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল শীতল।বিকেলবেলায় মন্দিরে গিয়ে লোকজন দেখা শীতলের পছন্দের কাজ। তার ওপর সে মা দুর্গার প্রচন্ড ভক্ত। বিকেল হতেই চাদরটা গায়ে দিয়ে সটান দূর্গা মন্দিরে গিয়ে বসে পড়ে।কত লোকে পুজো দিতে যায়,কত লোকে প্রসাদের থালা হাতে বাড়ি ফেরে।কয়েকজন অবশ্য পুজো দেয় না,কিন্তু রোজ মন্দিরে এসে একবার প্রণাম ঠুকে যায় ঠাকুরকে।বুড়ো হাবড়াদের একটা দল মন্দিরের চাতালে বসে খোশগল্প করে।শীতলের বেশ লাগে।প্রসাদের বোঁদে চিবোতে চিবোতে সকলের দিকে নজর রাখে সে।শীতকালের বিকেল,ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে পড়ে।শীতটা এবারে বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে।শীতল নৈবিদ্যর থালা থেকে টুক করে কয়েক মুঠো বোঁদে আর মুড়ি তুলে নেওয়ার তালে ছিল এমন সময় বুড়ো পুরুত চক্কোত্তিমশাই তাকে দেখতে পেয়ে রে রে করে তেড়ে আসে।শীতল তাকে দেখতে পেয়ে তিন লাফে সিঁড়ি পেরিয়ে পগার পার হয়ে যায়।বুড়োর বেশি বেশি,এতো বয়স হলো,ঠাকুরের থালা থেকে কেউ দুটো বোঁদে নিলে তোমার অতো লাফালাফি কিসের বাপু?মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় শীতলের। ওই বুড়োটার জন্যে আজও সে ডেরা বাঁধতে পারছে না মন্দিরে।সকাল বিকেল সেই ভুষুন্ডির মাঠ থেকে গনেশতলার এই মন্দিরে আসা যে কি অসুবিধে,পাক্কা ৮ মাইল।আরে,একাভোগা মানুষ একটু মন্দিরের কোনায় পড়ে থাকলে তোমার এত রাগ কেন বাপু?কয়েক খাবলা প্রসাদ দুবেলা আর দুটো কম্বল,তাও রাখা আছে এককোনে ডাঁই করে।আর তো কেউ কিছু বলতে আসে না।যত হাঙ্গামা বুড়ো চক্কোত্তির।নিজে তো পঞ্চাশ বছর ধরে মন্দিরের কামরায় ঘাঁটি গেড়েছে।থাকার জায়গার অসুবিধে বুঝবে কি করে?উপায় থাকলে কি এমন মানুষের সংস্পর্শে থাকতে চাইতো শীতল?রেগেমেগে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে যেতে শীতল ভেবে নিল,একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়।
২)ধনরাজ সাঁপুই দেখতে যতটা মানুষ,আসলে ততটাই প্রাচীন ভূত।আসলে এই লাইনে থাকতে গেলে একটু আধটু মানুষমুখো হয়ে থাকতে হয়।নাহলে সে কদাচিৎ মানুষের মত পাপ কাজ করে।ভূতের রাজার দয়া না থাকলে কোনো ভূতের পক্ষে সশরীরে গিয়ে মানুষকে ভয় দেখানো সম্ভব নয়।ধনরাজ মানুষ হয়ে মানুষদের মধ্যে মিশতে পারে,আবার অন্য কোনো রূপ ধরে তাদের ভয় দেখাতেও সেরা।সে একমাত্র এই ক্ষমতার অধিকারী,তাই ভূতের সমাজের ভালোর জন্যে তাকে কাজ করতেই হয়।এই তো সেবার,নিমতলার গজুভূত এসে ধরলো পানিহাটির পুরোনো বাড়িতে ডেরা খালি করে দেওয়ার জন্যে।মানুষের উৎপাত যা বেড়েছে,পোড়ো বাড়িতে অব্দি সারাদিন ধরে তাসের আসর লাগিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে।তা ধনরাজ হলো সমঝদার ব্যবসায়ী।একটা আস্ত পাঁঠা আর তিনশো গিনি না নিয়ে সে পারতপক্ষে কাজে হাত দেয় না।দরাদরি করে গজু শেষপর্যন্ত পাঁঠার জায়গায় ১০টা মুরগি দিতে রাজি হলো।তা গজুরা হলো গিয়ে পুরোনো ক্লায়েন্ট,তার বাবা ঠাকুরদা সব মরে ভূত হয়ে ডেরার জন্যে ধনরাজের কাছে এসে ওঠে।সে আর না করেনি।অমাবস্যার রাতে শাঁকচুন্নি বোনকে সঙ্গে করে নরকঙ্কাল রূপ ধরে হানা দিয়েছিলো পানিহাটিতে।সেই সময় জনাদশেক লোক মিলে তাশ পেটাচ্ছে আর নেশা করছে।ভয় পাবে কি,তারা যে আসলে ভূত এই কথাটা বোঝাতেই বেগ পেতে হয়েছিল যথেষ্ট।শেষপর্যন্ত ধনরাজ আর তার বোন মিলে তেঁতুলের জল করে সবাইকে খাইয়ে নেশা ছাড়ালো সকলের।এতো কাজের পর একটু শান্তিতে ধনরাজ যেই বসেছে ভয় দেখাবে বলে অমনি জ্ঞান ফিরে পেয়ে লোকেরা এমনি চিল চিৎকার করে দৌড় লাগালো যে মুড অফ হয়ে গেলো ধনরাজের। ইচ্ছে করলে কি আর এক দুজনের ঘাড় মটকে দিতে পারতো না সে?কিন্তু সাঁপুইরা হলো বনেদি ভূতের বংশ।দরকার না পড়লে ওইসব সস্তার কাজ করে না।আরেকবার অ্যাকশন নিতে হলো পরের দিন।গজুকে ভালোভাবে ডেরায় সেট করিয়ে এসে,বোনকে একশো গিনি ধরিয়ে তারপর মুরগির কাবাব খেতে বসেছিল।কাস্টোমার সাটিসফেকশন না হলে কি আর বিজনেস চলে?তাই ইচ্ছে না থাকলেও এঁদো খেঁদো,মিচকে ফচকে সব ভূতের কথাই শুনতে হয়।তা এখন কাজ কারবার একটু হালকা,শীতকাল কি না,মানুষেরা নিজেদের মধ্যেই গুঁজোগুঁজি করে আছে,কেউ আর পারতপক্ষে পুরোনো বাড়ি,শ্মশান বা গাছতলায় গিয়ে ভূতেদের বিরক্ত করছে না।ধনরাজ আরাম সে বসে বেহ্মদৈত্যির ক্লাসিকাল ফিউসন শুনছিলো।এমন সময় এসে হাজির হলো শীতল।
৩)বুড়ো চক্কোত্তি মশাই আজকাল মহা ঝামেলায় পড়েছেন।সারা জীবন দুর্গামন্দিরের পুরুতের কাজ করে গেছেন।একা মানুষ।ঠাকুরের সঙ্গেই ঘর করেছেন বলা চলে।সাতসকালে উঠে থেকে গঙ্গাস্নান করে এসে পুজোর তোড়জোড়,তারপর আরতি,দুপুরে ঠাকুরকে খেতে দেওয়া,বিকেলের সন্ধ্যারতি,বুধবার ও রবিবার আবার কীর্তন হয়,তার ব্যবস্থাও তাকেই দেখতে হয়।ভক্ত মানুষ,হাসিমুখেই সব করেন।কিন্তু কিছুদিন ধরে তার মাথা খারাপের্ জোগাড়।মন্দিরের মধ্যে কোত্থেকে একটা আস্ত ভূত এসে জুটেছে।দেখতে হতচ্ছাড়া মানুষের মত ফিচকে মনে হলেও সে সত্যি সত্যিই ভূত।প্রথম দিন তাকে প্রসাদের থালা থেকে কলাচুরি করতে দেখে রে রে করে লাঠি বাগিয়ে তেড়ে গেছিলেন তিনি,কিন্তু লোকটা পালাবার চেষ্টাও করলো না।ঘা কতক লাগাবেন বলে চুলের মুঠি ধরতে গিয়ে চক্কোত্তি মশাই হাঁ হয়ে গেলেন,লোকটার মাথার ভিতর দিয়ে তার হাত চলে যাচ্ছে অথচ তিনি তাকে ধরতে পারছেন না।লোকটা একগাল হেসে বললো,"ঠাকুর!মারবেন কাকে?শরীরটা কি আর আছে?কবে মরেছি।পাক্কা দু বছর।"ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চক্কোত্তি মশাই জিজ্ঞেস করলেন,"মানে?তুই কি ভূত নাকি?"লোকটা কান চুলকে বললো,"পমাণ দিতে পারবো না ঠাকুর মশাই তবে মনে তো সেরকমই হয়।"বলে কলা খেতে খেতে চলে গেছিলো লোকটা। চক্কোত্তি মশাই এতই অবাক হয়ে গেছিলেন যে পুজোর থালা থেকে কলাচুরির কথা ভুলেই গেছিলেন।ভূতই যদি হয় তাহলে মন্দিরে এলো কি করে রে বাবা?ভয়ডর নেই?না না...এটা বড় অনিয়ম।ঠাকুর আর ভূত একসঙ্গে থাকলে যে কালের নিয়ম পরিবর্তন হয়ে যাবে।সারারাত ঘুম এলো না তার,বিছানায় শুয়ে ছটপট করতে লাগলেন।সকাল হতেই উঠে পড়লেন।কাজকর্মে মন দিতে হবে,কালকে নিশ্চয়ই কিছু ভুলভাল দেখেছেন।কিন্তু বিকেল হতে না হতেই সেই লোকটা,থুড়ি ভূতটা এসে হাজির।একগাল হেসে হাতজোড় করে তাকেই বললো,"পেন্নাম ঠাকুর মশাই।"তারপর ঠাকুরকেও প্রণাম করলো।নির্দ্বিধায় থালা থেকে একখাবলা বোঁদেমুড়ি তুলে নিলো লোকটা,তারপর চিবোতে লাগলো।দেখে তো চক্কোত্তি মশাইর মাথা গেলো গরম হয়ে,তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,"এই বুধিয়া,এই ভূতটাকে ধরে তো,একে ওঝার কাছে নিয়ে যাবো।"বুধিয়া মোটাসোটা পালোয়ান,সে দৌড়ে এসে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।ভূতটা বোঁদে চিবোতে চিবোতে বললো,"আরে ঠাকুরমশাই!ও কি আমাকে দেখতে পাবে?সবাই যদি অশরীরীদের দেখতে পেত তাহলে আর ভূত হয়ে কি লাভ?আপনার পুণ্যি আছে,এলেম আছে,তাই আপনার চোখে ধরা দিতে পেরেছি।"সেই শুনে আরো চটে চক্কোত্তি মশাই বললেন,"তোমার মতলবটা কি হে?ভূত হয়েছ তো গোরস্থান বা নিমগাছে গিয়ে থাকতে পারো না?রোজ রোজ ঠাকুর দেবতাদের মন্দিরে হানা দেওয়া কেন বাপু?কোনোরকম সহবত নেই!"ভূতটা মাথা চুলকে বললো,"সেই তো হয়েছে প্রবলেম।বড্ডো ভক্তি ছিল তো,মায়ের সঙ্গে রোজ মন্দিরে আসতাম।না এলে বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।তাই ভাবছি এখানেই ডেরা বানাবো।একটু সাহায্য করুন না ঠাকুরমশাই।"ভূতের কান্ড দেখে তো চক্কোত্তিমশাই থঃ।ব্যাটা বলে কি,ঠাকুরভক্ত ভূত,মন্দিরে থাকবে?এমন কথা বাপের জন্মে শুনেছে কেউ?না কোনো শাস্ত্রে লেখা আছে।তার ওপর তিনি বা এমন কি পাপ করেছেন যে এই হতচ্ছাড়া তাকে দেখা দিচ্ছে।এতো ভক্তি শ্রদ্ধার পর শেষপর্যন্ত একটা ভূতের দর্শন?ছি ছি। চক্কোত্তি মশাই রেগে মেগে চলে এলেন সেখান থেকে।তারপর থেকে রোজ ভূতটা এসে তাকে নাজেহাল করছে তাকে,তাকে মন্দিরে থাকতে দিতে হবে।এই কথাটা শুনলেই তেলেবেগুনে জলে ওঠেন তিনি,ভূত থাকবে ভগবানের সঙ্গে?ভূতের নাম আবার শীতল।যত তিনি তাড়িয়ে দিতে যান,তত সে ফিরে ফিরে আসে।আর কেউ তাকে দেখতে পায় না বলে ভূতটা ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। চক্কোত্তি মশাই তাকে গালাগাল দিলে অথবা তেড়ে গেলে বাকি লোকেরা অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।তিনি শুনেছে মন্দিরের কমিটির কাছে নালিশ গেছে যে বুড়ো হয়ে পুরুত গৌর চক্কোত্তির মাথা বিগড়ে গেছে।এরকম চললে তাকিয়ে সরিয়ে দেওয়া হবে।সেই শুনে মহাচিন্তায় পড়েছেন তিনি।রাতে ঘুম হয় না। আজকেও রাতে উঠে বসে আছেন মন্দিরের চাতালে,এমন সময়ে ঘুট্ঘুটে অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা আবছায়া তার দিকে এগিয়ে এলো।সামনের লোকটা তার কাছে এসে হাত জোর করে বললো,"পেন্নাম নেবেন ঠাকুর মশাই। আমার নাম ধনরাজ সাঁপুই "ডেরাওয়ালা।"
৪)শীতল লুকিয়ে আছে মন্দির থেকে খানিক দূরে গাছের আড়ালে।ধনাদা মানে মানে কাজটা করতে পারলে হয়।আসলে ভয় দেখিয়ে আর ঘাড় মটকে ডেরা ছিনিয়ে নেওয়ার কাজ করছে ধনাদা অনেক বছর ধরে কিন্তু এরকম ঠান্ডা মাথায় কোনও মানুষকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভূতের সঙ্গে থাকতে বলা তো একেবারেই আনকোরা এসাইনমেন্ট।প্রথমে তো শুনেই ধমকেছিল তাকে,মাথায় হয়ত গাঁট্টাও পড়তো শুধু মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই বলেই এই কাজ করতে রাজি হয়েছে।আসলে ব্যাপারটা হলো,ডেরা তো অনেক আছে কিন্তু শীতলের যে মন্দিরে না থাকলে রেহাই নেই।মনটা উদাস হয়ে থাকে,ভূতের নেত্যতে মন বসে না,গাছে চড়তে ইচ্ছে করে না শুধু মা দুর্গার মুখটা মনে পড়ে।প্রথমে সে ভেবেছিলো তার বুঝি মানুষের মত কোনো ব্যারাম হয়েছে,ভূতেদের আবার অত ঠাকুর দেবতার ভক্তি হয় নাকি?কিন্তু বুড়ো বেহ্মদৈত্য চরণবাবা বললো এ নাকি শুভলক্ষণ।মানুষ দেহ ছাড়ার সময় ভালো নক্ষত্র থাকলে ভূতজন্মে এরম হয়,এই ভূতেরা নাকি মুক্তিও পায় তাড়াতাড়ি।মাত্র হাজার বছরেই মুক্তি পেয়ে সোজা বৈকুন্ঠধামে,শর্ত খালি ওই,ভক্তি ভাব টিকিয়ে রাখতে হবে,কুসঙ্গে পড়ে লোকেদের ঘাড় মটকেছো আর নিমগাছে উল্টো হয়ে ঘুমোনো আরম্ভ করেছো কি মওকা হাত থেকে ফস্কে যাবে।তাই শুনে শীতল স্থির করেছে সে মন্দিরেই মা দুর্গার সঙ্গে ঘাঁটি গাড়বে।পথের কাঁটা খালি ওই বুড়ো চক্কোত্তি।কি করে যে বুড়ো ওকে দেখতে পায় কে জানে?কিন্তু বুড়োকে ভয় দেখালে পাপ হবে।তাই শীতল ঘনাদার কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ে।হাজার ছয়েক বছর বয়েস হলো ঘনাদার,একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বুড়ো কে রাজি করাতে পারলেই তার মুক্তির পথ তা সরল হয়ে যায়।চারটে পাঁঠা আর ভাইয়ের সম্পর্কের জন্যে শেষ মেশ ধনাদা রাজি হলো বটে কিন্তু কনফার্মেশন দেয়নি।তাই দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি?আকাশের দিকে তাকিয়ে শীতল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,"মা দূর্গা!একটু দেখো।"
৫)চক্কোত্তি মশাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন,"না বাপু,মানছি তুমি জ্ঞানী ভূত।কিন্তু ভূতেদের মন্দিরে থাকতে দিলে লোকেরা আমার ছাল চামড়া তুলে নেবে।না হে,তুমি বরং তোমার ভূত ভাইকে বোলো কোনো পুরোনো বাড়িতে ডেরা বাঁধতে।চুঁচুড়াতে কয়েকটা পোড়ো বাড়ি নজরে পড়েছিল দরকার থাকলে বোলো,ঠিকানা দিয়ে দেব।"ধনরাজ সাঁপুই পড়েছে মহাবিপদে।বুড়ো কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।ভূতের সঙ্গে সহ-বাস এক ছাদের তলায়,এই কথা শুনলে কার না আক্কেল গুড়ুম হবে।ব্যাটার ঘাড় মটকে দিলে ঝামেলা চুকে যেত।কিন্তু শেতলোটা পই পই করে বলে দিয়েছে বুড়োর ক্ষতি না করতে। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না,ডেরার ব্যবস্থা করে দিতে তার ১০০% সাকসেস রেট,একটা কেস ফেল হলেই মার্কেটে নাম খারাপ হয়ে যাবে।সে দ্বিগুন উৎসাহে নতুন যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।হাতজোড় করে বললো,"ঠাকুরমশাই,আপনি বুঝতে পারছেন না।পোড়ো বাড়িতে যেতে পারলে তো আপনার কাছে আসার দরকারই পড়ত না।কিন্তু আমাদের গুরু বেহ্মদৈত্যি তাকে এই মায়ের মন্দিরে থাকতেই বলেছে।আর আপনার তো কোনো অসুবিধে হচ্ছে না,আপনি থাকবেন আপনার মত,শীতল থাকবে নিজের মত।শুধু মাঝে মাঝে তাকে দেখতে পাবেন এই যা।"
"মানে একটা অপোগন্ড ভূত আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে যাবে আর আমাকে তাকে দেখেও না করে যেতে হবে। "
"সে ওকে বলে দেব আপনার সামনে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে।শুধু দু মুঠো নৈবিদ্য দু বেলা যদি পেত,কিছু মনে করবেন না।"
"শোনো বাপু!ভূতেরা মন্দিরে থাকলে তাদের ভূতযোনিতে পাপ হয়।দু মুঠো নৈবিদ্য না হয় নিল কিন্তু লোকেরা কি বলবে হে আমাকে।এই বয়সে কি না আমি একটা ভূতের সঙ্গে ঘর করছি। "
"হাসলেন ঠাকুরমশাই!লোকেরা কি দেখতে পাচ্ছে নাকি ওকে।আপনি বরং ওকে না দেখার ভান করে থাকবেন,তাহলেই কেউ কিছু বলবে না।"
"শেষে কি ভূতের সঙ্গে থেকে পাপের ভাগী হবো হে!এতো দিন পুজো আচ্চা করে।তোমরা এঁটোকাঁটা মানো না,মাংস দেখলে জিভে জল আসে,না বাপু।এতো ঝক্কি আমি নিতে পারবো না। "
"দয়া করুন ঠাকুরমশাই,এতো নিষ্ঠুর হবেন না।সেই যে আছে 'জীবে সেবা করে যেই জন,সেই জন সেবিছে ঈশ্বর '...হয়ত মা দুর্গা এই বেচারা শীতলের ভালোর জন্যেই আপনাকে তার কাছে পাঠিয়েছেন,নাহলে তো আপনি তাকে দেখতেই পেতেন না।"
"হাসালে বাবা।জীবের সেবা করা আর ভূতের সেবা করা কি এক নাকি হে?ওতে বরং হিতে বিপরীত হয়।আর স্পেশাল কেস বলছো ওকে দেখতে পাওয়া,তা বাবা আমি তো তোমাকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।তুমিও তো ভূত নাকি হে,নাকি মানুষ হয়ে ভূতেদের দালালি করছ!"
আলোচনা চলছে তো চলছেই।চক্কোত্তিমশাইও মানবেন না,ধনরাজও ছাড়বে না।একসময় বুড়ো রেগে মেগে উঠে পড়লো।বাজখাঁই গলায় বললো,"দেখো ভূত বাবাজী,অনেক হয়েছে।তোমার ভূত ভাইকে বোলো হয় ভূতের মত বেঁচে থাকতে,না হয় আবার মরে মানুষ হতে।আমি চললুম।"
চক্কোত্তিমশাই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।ধনরাজ ব্যাজার মুখে বসে রইলো মন্দিরের চাতালে।
৬)সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে গজগজ করছিলেন চক্কোত্তিমশাই।উটকো কয়েকটা ভূত শেষে তাকে নাকাল করে চলেছে এইভাবে।কোথায় ঠাকুরের জায়গায় এসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে তা না বুক ছিটিয়ে মন্দিরে থাকার জন্যে যুক্তি দিচ্ছে।যত্তোসব।ঘরের দরজার সামনে এসে কোমরের কশি থেকে চাবির গোছা নিয়ে কামরার চাবিটা খুলতে যাবেন এমন সময় তার চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো।তার সামনে দাঁড়িয়ে আলোর বৃত্তের মধ্যে কাকে দেখতে পাচ্ছেন তিনি।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।এ যে স্বয়ং মা দূর্গা।মা দশভুজা তার দিকেই তাকিয়ে আছেন জ্বলজ্বলে চোখে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন চক্কোত্তিমশাই মায়ের সামনে। অস্ফুটে বলতে লাগলেন,"মা মা।"মা দূর্গা রাগী গলায় বললেন,"ওঠ।ওঠ।তুই একটা মহাপাপী।"চক্কোত্তিমশাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,"কি পাপ করেছি মা আমি?"মা দূর্গা গমগমে স্বরে বললেন ,"একটা নিষ্পাপ অশরীরী আমার সাধনা করতে তোর কাছে একটু সাহায্য চাইলো,আর তুই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলি।তারপর আমার নামে দোষ দিচ্ছিস।আমি কি ভক্তদের মধ্যে ভেদাভেদ করতে বলেছি কোনোদিন?ধনী,গরীব,মানুষ,পশু সকলেই আমার কাছে সমান।আর তুই নিজেকে আমার উপাসক বলিস।তোর লজ্জা করে না?"চক্কোত্তিমশাই তোতলাতে তোতলাতে বললেন,"কিন্তু ওই শীতলটা তো মানুষই নয় মা।ভূতেদের বেলায় কি একই নিয়ম খাটে ?"মা দুর্গার কণ্ঠস্বর গমগম করেউঠলো চুপ,"চুপ।মানুষই মরে ভূত হয়।এই সব জীবনের চক্র।মানুষ আর ভূত আসলে একই।আমার শ্বশুরবাড়িতে ভূতে,দেবতায় একসঙ্গে থাকে।সেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই।তুই পাপী,তুই নির্বোধ।তাই এরকম বলতে পারলি।ভালো চাস তো প্রায়শ্চিত্ত্ব কর।"চক্কোত্তিমশাই মায়ের পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,"ক্ষমা করে দাও মা।ভুল হয়ে গেছে।আমি শীতলকে আমার সঙ্গে রাখবো।আমার ঘরে রাখবো।ক্ষমা করো।"কাঁদতে কাঁদতে তিনি দেখলেন মা দুর্গার মূর্তি আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
৭)শীতল দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছিলো গাছতলায়।কাঁধে টোকা পড়তে দেখলো ধনাদা মুলোর মত দাঁতগুলো বের করে হাসছে।বললো,"যাহ..তোর কাজ হয়ে গেছে।পুরুত মশাই তোকে মন্দিরে থাকতে দেবেন বলেছেন,কিন্তু আমি কিছুই করিনি।আমার কথা শুনে উনি মোটেই রাজি হননি।"শীতল ক্যাবলার মত জিজ্ঞেস করলো,"তাহলে?"ধনাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,"সবই মায়ের লীলা শেতল,মা দুর্গার লীলা।তুই এখন যা।পুরুত মশাই তোকে সব বলবেনক্ষণ।"শীতল বোকার মত ঘাড় হেঁট করে এগিয়ে গেলো মন্দিরের দিকে। ধনাদা হাতজোড় করে মনে মনে বললো,"ক্ষমা করে দিও মা।কিন্তু তোমার রূপ না ধরে উপায় ছিল না।মানুষেরা ভূতের চেয়েও বেশি গোঁয়ার,সহজ কথা সহজ করে বুঝতে পারে না।আমি না হয় আরো একটু পাপ করলাম।"শীতল তখন হাসিমুখে এগিয়ে চলেছে মা দুর্গার প্রতিমার দিকে।
১)মন্দিরের সিঁড়িতে বসে রোজকার মতো সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল শীতল।বিকেলবেলায় মন্দিরে গিয়ে লোকজন দেখা শীতলের পছন্দের কাজ। তার ওপর সে মা দুর্গার প্রচন্ড ভক্ত। বিকেল হতেই চাদরটা গায়ে দিয়ে সটান দূর্গা মন্দিরে গিয়ে বসে পড়ে।কত লোকে পুজো দিতে যায়,কত লোকে প্রসাদের থালা হাতে বাড়ি ফেরে।কয়েকজন অবশ্য পুজো দেয় না,কিন্তু রোজ মন্দিরে এসে একবার প্রণাম ঠুকে যায় ঠাকুরকে।বুড়ো হাবড়াদের একটা দল মন্দিরের চাতালে বসে খোশগল্প করে।শীতলের বেশ লাগে।প্রসাদের বোঁদে চিবোতে চিবোতে সকলের দিকে নজর রাখে সে।শীতকালের বিকেল,ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে পড়ে।শীতটা এবারে বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে।শীতল নৈবিদ্যর থালা থেকে টুক করে কয়েক মুঠো বোঁদে আর মুড়ি তুলে নেওয়ার তালে ছিল এমন সময় বুড়ো পুরুত চক্কোত্তিমশাই তাকে দেখতে পেয়ে রে রে করে তেড়ে আসে।শীতল তাকে দেখতে পেয়ে তিন লাফে সিঁড়ি পেরিয়ে পগার পার হয়ে যায়।বুড়োর বেশি বেশি,এতো বয়স হলো,ঠাকুরের থালা থেকে কেউ দুটো বোঁদে নিলে তোমার অতো লাফালাফি কিসের বাপু?মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় শীতলের। ওই বুড়োটার জন্যে আজও সে ডেরা বাঁধতে পারছে না মন্দিরে।সকাল বিকেল সেই ভুষুন্ডির মাঠ থেকে গনেশতলার এই মন্দিরে আসা যে কি অসুবিধে,পাক্কা ৮ মাইল।আরে,একাভোগা মানুষ একটু মন্দিরের কোনায় পড়ে থাকলে তোমার এত রাগ কেন বাপু?কয়েক খাবলা প্রসাদ দুবেলা আর দুটো কম্বল,তাও রাখা আছে এককোনে ডাঁই করে।আর তো কেউ কিছু বলতে আসে না।যত হাঙ্গামা বুড়ো চক্কোত্তির।নিজে তো পঞ্চাশ বছর ধরে মন্দিরের কামরায় ঘাঁটি গেড়েছে।থাকার জায়গার অসুবিধে বুঝবে কি করে?উপায় থাকলে কি এমন মানুষের সংস্পর্শে থাকতে চাইতো শীতল?রেগেমেগে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে যেতে শীতল ভেবে নিল,একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়।
২)ধনরাজ সাঁপুই দেখতে যতটা মানুষ,আসলে ততটাই প্রাচীন ভূত।আসলে এই লাইনে থাকতে গেলে একটু আধটু মানুষমুখো হয়ে থাকতে হয়।নাহলে সে কদাচিৎ মানুষের মত পাপ কাজ করে।ভূতের রাজার দয়া না থাকলে কোনো ভূতের পক্ষে সশরীরে গিয়ে মানুষকে ভয় দেখানো সম্ভব নয়।ধনরাজ মানুষ হয়ে মানুষদের মধ্যে মিশতে পারে,আবার অন্য কোনো রূপ ধরে তাদের ভয় দেখাতেও সেরা।সে একমাত্র এই ক্ষমতার অধিকারী,তাই ভূতের সমাজের ভালোর জন্যে তাকে কাজ করতেই হয়।এই তো সেবার,নিমতলার গজুভূত এসে ধরলো পানিহাটির পুরোনো বাড়িতে ডেরা খালি করে দেওয়ার জন্যে।মানুষের উৎপাত যা বেড়েছে,পোড়ো বাড়িতে অব্দি সারাদিন ধরে তাসের আসর লাগিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে।তা ধনরাজ হলো সমঝদার ব্যবসায়ী।একটা আস্ত পাঁঠা আর তিনশো গিনি না নিয়ে সে পারতপক্ষে কাজে হাত দেয় না।দরাদরি করে গজু শেষপর্যন্ত পাঁঠার জায়গায় ১০টা মুরগি দিতে রাজি হলো।তা গজুরা হলো গিয়ে পুরোনো ক্লায়েন্ট,তার বাবা ঠাকুরদা সব মরে ভূত হয়ে ডেরার জন্যে ধনরাজের কাছে এসে ওঠে।সে আর না করেনি।অমাবস্যার রাতে শাঁকচুন্নি বোনকে সঙ্গে করে নরকঙ্কাল রূপ ধরে হানা দিয়েছিলো পানিহাটিতে।সেই সময় জনাদশেক লোক মিলে তাশ পেটাচ্ছে আর নেশা করছে।ভয় পাবে কি,তারা যে আসলে ভূত এই কথাটা বোঝাতেই বেগ পেতে হয়েছিল যথেষ্ট।শেষপর্যন্ত ধনরাজ আর তার বোন মিলে তেঁতুলের জল করে সবাইকে খাইয়ে নেশা ছাড়ালো সকলের।এতো কাজের পর একটু শান্তিতে ধনরাজ যেই বসেছে ভয় দেখাবে বলে অমনি জ্ঞান ফিরে পেয়ে লোকেরা এমনি চিল চিৎকার করে দৌড় লাগালো যে মুড অফ হয়ে গেলো ধনরাজের। ইচ্ছে করলে কি আর এক দুজনের ঘাড় মটকে দিতে পারতো না সে?কিন্তু সাঁপুইরা হলো বনেদি ভূতের বংশ।দরকার না পড়লে ওইসব সস্তার কাজ করে না।আরেকবার অ্যাকশন নিতে হলো পরের দিন।গজুকে ভালোভাবে ডেরায় সেট করিয়ে এসে,বোনকে একশো গিনি ধরিয়ে তারপর মুরগির কাবাব খেতে বসেছিল।কাস্টোমার সাটিসফেকশন না হলে কি আর বিজনেস চলে?তাই ইচ্ছে না থাকলেও এঁদো খেঁদো,মিচকে ফচকে সব ভূতের কথাই শুনতে হয়।তা এখন কাজ কারবার একটু হালকা,শীতকাল কি না,মানুষেরা নিজেদের মধ্যেই গুঁজোগুঁজি করে আছে,কেউ আর পারতপক্ষে পুরোনো বাড়ি,শ্মশান বা গাছতলায় গিয়ে ভূতেদের বিরক্ত করছে না।ধনরাজ আরাম সে বসে বেহ্মদৈত্যির ক্লাসিকাল ফিউসন শুনছিলো।এমন সময় এসে হাজির হলো শীতল।
৩)বুড়ো চক্কোত্তি মশাই আজকাল মহা ঝামেলায় পড়েছেন।সারা জীবন দুর্গামন্দিরের পুরুতের কাজ করে গেছেন।একা মানুষ।ঠাকুরের সঙ্গেই ঘর করেছেন বলা চলে।সাতসকালে উঠে থেকে গঙ্গাস্নান করে এসে পুজোর তোড়জোড়,তারপর আরতি,দুপুরে ঠাকুরকে খেতে দেওয়া,বিকেলের সন্ধ্যারতি,বুধবার ও রবিবার আবার কীর্তন হয়,তার ব্যবস্থাও তাকেই দেখতে হয়।ভক্ত মানুষ,হাসিমুখেই সব করেন।কিন্তু কিছুদিন ধরে তার মাথা খারাপের্ জোগাড়।মন্দিরের মধ্যে কোত্থেকে একটা আস্ত ভূত এসে জুটেছে।দেখতে হতচ্ছাড়া মানুষের মত ফিচকে মনে হলেও সে সত্যি সত্যিই ভূত।প্রথম দিন তাকে প্রসাদের থালা থেকে কলাচুরি করতে দেখে রে রে করে লাঠি বাগিয়ে তেড়ে গেছিলেন তিনি,কিন্তু লোকটা পালাবার চেষ্টাও করলো না।ঘা কতক লাগাবেন বলে চুলের মুঠি ধরতে গিয়ে চক্কোত্তি মশাই হাঁ হয়ে গেলেন,লোকটার মাথার ভিতর দিয়ে তার হাত চলে যাচ্ছে অথচ তিনি তাকে ধরতে পারছেন না।লোকটা একগাল হেসে বললো,"ঠাকুর!মারবেন কাকে?শরীরটা কি আর আছে?কবে মরেছি।পাক্কা দু বছর।"ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চক্কোত্তি মশাই জিজ্ঞেস করলেন,"মানে?তুই কি ভূত নাকি?"লোকটা কান চুলকে বললো,"পমাণ দিতে পারবো না ঠাকুর মশাই তবে মনে তো সেরকমই হয়।"বলে কলা খেতে খেতে চলে গেছিলো লোকটা। চক্কোত্তি মশাই এতই অবাক হয়ে গেছিলেন যে পুজোর থালা থেকে কলাচুরির কথা ভুলেই গেছিলেন।ভূতই যদি হয় তাহলে মন্দিরে এলো কি করে রে বাবা?ভয়ডর নেই?না না...এটা বড় অনিয়ম।ঠাকুর আর ভূত একসঙ্গে থাকলে যে কালের নিয়ম পরিবর্তন হয়ে যাবে।সারারাত ঘুম এলো না তার,বিছানায় শুয়ে ছটপট করতে লাগলেন।সকাল হতেই উঠে পড়লেন।কাজকর্মে মন দিতে হবে,কালকে নিশ্চয়ই কিছু ভুলভাল দেখেছেন।কিন্তু বিকেল হতে না হতেই সেই লোকটা,থুড়ি ভূতটা এসে হাজির।একগাল হেসে হাতজোড় করে তাকেই বললো,"পেন্নাম ঠাকুর মশাই।"তারপর ঠাকুরকেও প্রণাম করলো।নির্দ্বিধায় থালা থেকে একখাবলা বোঁদেমুড়ি তুলে নিলো লোকটা,তারপর চিবোতে লাগলো।দেখে তো চক্কোত্তি মশাইর মাথা গেলো গরম হয়ে,তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,"এই বুধিয়া,এই ভূতটাকে ধরে তো,একে ওঝার কাছে নিয়ে যাবো।"বুধিয়া মোটাসোটা পালোয়ান,সে দৌড়ে এসে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।ভূতটা বোঁদে চিবোতে চিবোতে বললো,"আরে ঠাকুরমশাই!ও কি আমাকে দেখতে পাবে?সবাই যদি অশরীরীদের দেখতে পেত তাহলে আর ভূত হয়ে কি লাভ?আপনার পুণ্যি আছে,এলেম আছে,তাই আপনার চোখে ধরা দিতে পেরেছি।"সেই শুনে আরো চটে চক্কোত্তি মশাই বললেন,"তোমার মতলবটা কি হে?ভূত হয়েছ তো গোরস্থান বা নিমগাছে গিয়ে থাকতে পারো না?রোজ রোজ ঠাকুর দেবতাদের মন্দিরে হানা দেওয়া কেন বাপু?কোনোরকম সহবত নেই!"ভূতটা মাথা চুলকে বললো,"সেই তো হয়েছে প্রবলেম।বড্ডো ভক্তি ছিল তো,মায়ের সঙ্গে রোজ মন্দিরে আসতাম।না এলে বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।তাই ভাবছি এখানেই ডেরা বানাবো।একটু সাহায্য করুন না ঠাকুরমশাই।"ভূতের কান্ড দেখে তো চক্কোত্তিমশাই থঃ।ব্যাটা বলে কি,ঠাকুরভক্ত ভূত,মন্দিরে থাকবে?এমন কথা বাপের জন্মে শুনেছে কেউ?না কোনো শাস্ত্রে লেখা আছে।তার ওপর তিনি বা এমন কি পাপ করেছেন যে এই হতচ্ছাড়া তাকে দেখা দিচ্ছে।এতো ভক্তি শ্রদ্ধার পর শেষপর্যন্ত একটা ভূতের দর্শন?ছি ছি। চক্কোত্তি মশাই রেগে মেগে চলে এলেন সেখান থেকে।তারপর থেকে রোজ ভূতটা এসে তাকে নাজেহাল করছে তাকে,তাকে মন্দিরে থাকতে দিতে হবে।এই কথাটা শুনলেই তেলেবেগুনে জলে ওঠেন তিনি,ভূত থাকবে ভগবানের সঙ্গে?ভূতের নাম আবার শীতল।যত তিনি তাড়িয়ে দিতে যান,তত সে ফিরে ফিরে আসে।আর কেউ তাকে দেখতে পায় না বলে ভূতটা ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। চক্কোত্তি মশাই তাকে গালাগাল দিলে অথবা তেড়ে গেলে বাকি লোকেরা অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।তিনি শুনেছে মন্দিরের কমিটির কাছে নালিশ গেছে যে বুড়ো হয়ে পুরুত গৌর চক্কোত্তির মাথা বিগড়ে গেছে।এরকম চললে তাকিয়ে সরিয়ে দেওয়া হবে।সেই শুনে মহাচিন্তায় পড়েছেন তিনি।রাতে ঘুম হয় না। আজকেও রাতে উঠে বসে আছেন মন্দিরের চাতালে,এমন সময়ে ঘুট্ঘুটে অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা আবছায়া তার দিকে এগিয়ে এলো।সামনের লোকটা তার কাছে এসে হাত জোর করে বললো,"পেন্নাম নেবেন ঠাকুর মশাই। আমার নাম ধনরাজ সাঁপুই "ডেরাওয়ালা।"
৪)শীতল লুকিয়ে আছে মন্দির থেকে খানিক দূরে গাছের আড়ালে।ধনাদা মানে মানে কাজটা করতে পারলে হয়।আসলে ভয় দেখিয়ে আর ঘাড় মটকে ডেরা ছিনিয়ে নেওয়ার কাজ করছে ধনাদা অনেক বছর ধরে কিন্তু এরকম ঠান্ডা মাথায় কোনও মানুষকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভূতের সঙ্গে থাকতে বলা তো একেবারেই আনকোরা এসাইনমেন্ট।প্রথমে তো শুনেই ধমকেছিল তাকে,মাথায় হয়ত গাঁট্টাও পড়তো শুধু মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই বলেই এই কাজ করতে রাজি হয়েছে।আসলে ব্যাপারটা হলো,ডেরা তো অনেক আছে কিন্তু শীতলের যে মন্দিরে না থাকলে রেহাই নেই।মনটা উদাস হয়ে থাকে,ভূতের নেত্যতে মন বসে না,গাছে চড়তে ইচ্ছে করে না শুধু মা দুর্গার মুখটা মনে পড়ে।প্রথমে সে ভেবেছিলো তার বুঝি মানুষের মত কোনো ব্যারাম হয়েছে,ভূতেদের আবার অত ঠাকুর দেবতার ভক্তি হয় নাকি?কিন্তু বুড়ো বেহ্মদৈত্য চরণবাবা বললো এ নাকি শুভলক্ষণ।মানুষ দেহ ছাড়ার সময় ভালো নক্ষত্র থাকলে ভূতজন্মে এরম হয়,এই ভূতেরা নাকি মুক্তিও পায় তাড়াতাড়ি।মাত্র হাজার বছরেই মুক্তি পেয়ে সোজা বৈকুন্ঠধামে,শর্ত খালি ওই,ভক্তি ভাব টিকিয়ে রাখতে হবে,কুসঙ্গে পড়ে লোকেদের ঘাড় মটকেছো আর নিমগাছে উল্টো হয়ে ঘুমোনো আরম্ভ করেছো কি মওকা হাত থেকে ফস্কে যাবে।তাই শুনে শীতল স্থির করেছে সে মন্দিরেই মা দুর্গার সঙ্গে ঘাঁটি গাড়বে।পথের কাঁটা খালি ওই বুড়ো চক্কোত্তি।কি করে যে বুড়ো ওকে দেখতে পায় কে জানে?কিন্তু বুড়োকে ভয় দেখালে পাপ হবে।তাই শীতল ঘনাদার কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ে।হাজার ছয়েক বছর বয়েস হলো ঘনাদার,একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বুড়ো কে রাজি করাতে পারলেই তার মুক্তির পথ তা সরল হয়ে যায়।চারটে পাঁঠা আর ভাইয়ের সম্পর্কের জন্যে শেষ মেশ ধনাদা রাজি হলো বটে কিন্তু কনফার্মেশন দেয়নি।তাই দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি?আকাশের দিকে তাকিয়ে শীতল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,"মা দূর্গা!একটু দেখো।"
৫)চক্কোত্তি মশাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন,"না বাপু,মানছি তুমি জ্ঞানী ভূত।কিন্তু ভূতেদের মন্দিরে থাকতে দিলে লোকেরা আমার ছাল চামড়া তুলে নেবে।না হে,তুমি বরং তোমার ভূত ভাইকে বোলো কোনো পুরোনো বাড়িতে ডেরা বাঁধতে।চুঁচুড়াতে কয়েকটা পোড়ো বাড়ি নজরে পড়েছিল দরকার থাকলে বোলো,ঠিকানা দিয়ে দেব।"ধনরাজ সাঁপুই পড়েছে মহাবিপদে।বুড়ো কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।ভূতের সঙ্গে সহ-বাস এক ছাদের তলায়,এই কথা শুনলে কার না আক্কেল গুড়ুম হবে।ব্যাটার ঘাড় মটকে দিলে ঝামেলা চুকে যেত।কিন্তু শেতলোটা পই পই করে বলে দিয়েছে বুড়োর ক্ষতি না করতে। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না,ডেরার ব্যবস্থা করে দিতে তার ১০০% সাকসেস রেট,একটা কেস ফেল হলেই মার্কেটে নাম খারাপ হয়ে যাবে।সে দ্বিগুন উৎসাহে নতুন যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।হাতজোড় করে বললো,"ঠাকুরমশাই,আপনি বুঝতে পারছেন না।পোড়ো বাড়িতে যেতে পারলে তো আপনার কাছে আসার দরকারই পড়ত না।কিন্তু আমাদের গুরু বেহ্মদৈত্যি তাকে এই মায়ের মন্দিরে থাকতেই বলেছে।আর আপনার তো কোনো অসুবিধে হচ্ছে না,আপনি থাকবেন আপনার মত,শীতল থাকবে নিজের মত।শুধু মাঝে মাঝে তাকে দেখতে পাবেন এই যা।"
"মানে একটা অপোগন্ড ভূত আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে যাবে আর আমাকে তাকে দেখেও না করে যেতে হবে। "
"সে ওকে বলে দেব আপনার সামনে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে।শুধু দু মুঠো নৈবিদ্য দু বেলা যদি পেত,কিছু মনে করবেন না।"
"শোনো বাপু!ভূতেরা মন্দিরে থাকলে তাদের ভূতযোনিতে পাপ হয়।দু মুঠো নৈবিদ্য না হয় নিল কিন্তু লোকেরা কি বলবে হে আমাকে।এই বয়সে কি না আমি একটা ভূতের সঙ্গে ঘর করছি। "
"হাসলেন ঠাকুরমশাই!লোকেরা কি দেখতে পাচ্ছে নাকি ওকে।আপনি বরং ওকে না দেখার ভান করে থাকবেন,তাহলেই কেউ কিছু বলবে না।"
"শেষে কি ভূতের সঙ্গে থেকে পাপের ভাগী হবো হে!এতো দিন পুজো আচ্চা করে।তোমরা এঁটোকাঁটা মানো না,মাংস দেখলে জিভে জল আসে,না বাপু।এতো ঝক্কি আমি নিতে পারবো না। "
"দয়া করুন ঠাকুরমশাই,এতো নিষ্ঠুর হবেন না।সেই যে আছে 'জীবে সেবা করে যেই জন,সেই জন সেবিছে ঈশ্বর '...হয়ত মা দুর্গা এই বেচারা শীতলের ভালোর জন্যেই আপনাকে তার কাছে পাঠিয়েছেন,নাহলে তো আপনি তাকে দেখতেই পেতেন না।"
"হাসালে বাবা।জীবের সেবা করা আর ভূতের সেবা করা কি এক নাকি হে?ওতে বরং হিতে বিপরীত হয়।আর স্পেশাল কেস বলছো ওকে দেখতে পাওয়া,তা বাবা আমি তো তোমাকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।তুমিও তো ভূত নাকি হে,নাকি মানুষ হয়ে ভূতেদের দালালি করছ!"
আলোচনা চলছে তো চলছেই।চক্কোত্তিমশাইও মানবেন না,ধনরাজও ছাড়বে না।একসময় বুড়ো রেগে মেগে উঠে পড়লো।বাজখাঁই গলায় বললো,"দেখো ভূত বাবাজী,অনেক হয়েছে।তোমার ভূত ভাইকে বোলো হয় ভূতের মত বেঁচে থাকতে,না হয় আবার মরে মানুষ হতে।আমি চললুম।"
চক্কোত্তিমশাই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।ধনরাজ ব্যাজার মুখে বসে রইলো মন্দিরের চাতালে।
৬)সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে গজগজ করছিলেন চক্কোত্তিমশাই।উটকো কয়েকটা ভূত শেষে তাকে নাকাল করে চলেছে এইভাবে।কোথায় ঠাকুরের জায়গায় এসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে তা না বুক ছিটিয়ে মন্দিরে থাকার জন্যে যুক্তি দিচ্ছে।যত্তোসব।ঘরের দরজার সামনে এসে কোমরের কশি থেকে চাবির গোছা নিয়ে কামরার চাবিটা খুলতে যাবেন এমন সময় তার চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো।তার সামনে দাঁড়িয়ে আলোর বৃত্তের মধ্যে কাকে দেখতে পাচ্ছেন তিনি।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।এ যে স্বয়ং মা দূর্গা।মা দশভুজা তার দিকেই তাকিয়ে আছেন জ্বলজ্বলে চোখে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন চক্কোত্তিমশাই মায়ের সামনে। অস্ফুটে বলতে লাগলেন,"মা মা।"মা দূর্গা রাগী গলায় বললেন,"ওঠ।ওঠ।তুই একটা মহাপাপী।"চক্কোত্তিমশাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,"কি পাপ করেছি মা আমি?"মা দূর্গা গমগমে স্বরে বললেন ,"একটা নিষ্পাপ অশরীরী আমার সাধনা করতে তোর কাছে একটু সাহায্য চাইলো,আর তুই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলি।তারপর আমার নামে দোষ দিচ্ছিস।আমি কি ভক্তদের মধ্যে ভেদাভেদ করতে বলেছি কোনোদিন?ধনী,গরীব,মানুষ,পশু সকলেই আমার কাছে সমান।আর তুই নিজেকে আমার উপাসক বলিস।তোর লজ্জা করে না?"চক্কোত্তিমশাই তোতলাতে তোতলাতে বললেন,"কিন্তু ওই শীতলটা তো মানুষই নয় মা।ভূতেদের বেলায় কি একই নিয়ম খাটে ?"মা দুর্গার কণ্ঠস্বর গমগম করেউঠলো চুপ,"চুপ।মানুষই মরে ভূত হয়।এই সব জীবনের চক্র।মানুষ আর ভূত আসলে একই।আমার শ্বশুরবাড়িতে ভূতে,দেবতায় একসঙ্গে থাকে।সেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই।তুই পাপী,তুই নির্বোধ।তাই এরকম বলতে পারলি।ভালো চাস তো প্রায়শ্চিত্ত্ব কর।"চক্কোত্তিমশাই মায়ের পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,"ক্ষমা করে দাও মা।ভুল হয়ে গেছে।আমি শীতলকে আমার সঙ্গে রাখবো।আমার ঘরে রাখবো।ক্ষমা করো।"কাঁদতে কাঁদতে তিনি দেখলেন মা দুর্গার মূর্তি আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
৭)শীতল দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছিলো গাছতলায়।কাঁধে টোকা পড়তে দেখলো ধনাদা মুলোর মত দাঁতগুলো বের করে হাসছে।বললো,"যাহ..তোর কাজ হয়ে গেছে।পুরুত মশাই তোকে মন্দিরে থাকতে দেবেন বলেছেন,কিন্তু আমি কিছুই করিনি।আমার কথা শুনে উনি মোটেই রাজি হননি।"শীতল ক্যাবলার মত জিজ্ঞেস করলো,"তাহলে?"ধনাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,"সবই মায়ের লীলা শেতল,মা দুর্গার লীলা।তুই এখন যা।পুরুত মশাই তোকে সব বলবেনক্ষণ।"শীতল বোকার মত ঘাড় হেঁট করে এগিয়ে গেলো মন্দিরের দিকে। ধনাদা হাতজোড় করে মনে মনে বললো,"ক্ষমা করে দিও মা।কিন্তু তোমার রূপ না ধরে উপায় ছিল না।মানুষেরা ভূতের চেয়েও বেশি গোঁয়ার,সহজ কথা সহজ করে বুঝতে পারে না।আমি না হয় আরো একটু পাপ করলাম।"শীতল তখন হাসিমুখে এগিয়ে চলেছে মা দুর্গার প্রতিমার দিকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন