শনিবার, ২ মে, ২০১৫

এক পা-এক পা করে এগিয়ে চলেছে মিছিলটা।সামনে  McCormick Harvesting Machine কোম্পানির মস্ত গেট দেখা যাচ্ছে।স্লোগান দিতে দিতে গলা চিরে গেলেও কেউ শান্ত হয়নি।শ্রমিকের  দল তারা,এত সহজে ক্লান্ত হয় না।
ভিতরের  ড্রয়িং রুমে বসে টিভির স্ক্রিনএ সবই  দেখতে পাচ্ছেন ম্যানেজমেন্ট  এর লোকেরা।কিন্তু তাদের তেমন কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।পুলিশ  আর  সিকিউরিটির  কড়া  ব্যবস্থা  আছে।শ্রমিকদের দাবির কোনো ভিত্তিই  নেই।লাটসাহেবের  দল!ওদের দিয়ে নাকি বেশি কাজ করানো হচ্ছে।সেই মতো টাকাপয়সা,সুযোগসুবিধে দেওয়া হচ্ছে না।কোনোমতেই তারা দিনে ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করবে না।গত পরশু ১মে শিকাগো শহরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শ্রমিক মিছিলে একসঙ্গে যোগ দিয়েছে Federation of Organized Trades and Labor Unions এর প্রথম শ্রেণীর সব নেতারা।পারসন,ফিল্ডেনদের মতো anarchist খবরের কাগজের লোকেদের উস্কানিতে শিকাগো,নিউইয়র্ক সহ আরও নানা জায়গায় মে ডে প্যারেড করেছে শ্রমিকেরা।৪০০০০ এর বেশি লোক এরই মধ্যে strike করেছে।এদের তোল দিলে আরও বিপদ। দরকার পড়লে এদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।
ধীরে ধীরে বাইরের গন্ডগোলটা বাড়তে লাগলো।শ্রমিকদের সংখ্যায় ক্রমশই বৃদ্ধি হচ্ছে।গেটের  কাছ থেকে সার্জেন্ট এসে কোম্পানি ডিরেক্টর এর কানে কানে কিছু বলল ।তিনি সায় দিলেন।৫ মিনিটের মধ্যেই বাইরে থেকে শোনা গেল ফায়ারিংএর  আওআজ।পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে ত্রাস তৈরী হলো শ্রমিকদের মধ্যে।নেতা স্পাইস এর কথামত তারা সম্পূর্ণ অহিংসভাবে বিরোধ করছিল।দুএকজন অবশ্য বলেছিল হিংস্র বোমাবাজি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করার কথা,সবাই তাদের ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।এরকমভাবে যে তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে পুলিশ,তারা স্বপ্নেও ভাবেনি।ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে সবাই।আড়াল ঠেলে বৃদ্ধ সায়মন দেখল,কিশোর ছেলে অগাস্টিন এর মৃতদেহ কোলে করে বসে আছে তাদের দলনেতা অগাস্ট স্পাইস।এক চোখে জল,অন্য চোখে আগুন।
পরের দিন। ৪ মে ১৮৮৬।শিকাগো শহরের হেমারকেট স্কয়ার।অগাস্ট স্পাইস,আলবার্ট পারসন আর স্যামুয়েল ফিল্ডেন এর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে প্রায় ৬০০০ মানুষ।শিকাগো পুলিশ আর ক্যাপাটিলিস্টদের অন্যায় আর মেনে নেওয়া হবে না।দেখতে দেখতে হেমারকেট স্কয়ার গমগম করে উঠলো হাজার হাজার লোকের উদঘোষে।স্পাইস মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল,""পুলিশএর দিক থেকে প্রচার করা হচ্ছে,এই সভাটা একটি দাঙ্গার শামিল,আর সামরিক ভাবে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি হিসেবে আমরা এতে যোগ দিয়েছি।কিন্তু এই প্রচার মিথ্যে! শুরুতেই  আপনাকে বলছি,এই সভার উদ্দেশ্য আপনাদের জানানো যে চারপাশে কি হচ্ছে?আমাদের জীবন আর আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে কে ছিনিমিনি খেলছে?"ধীরে ধীরে জনস্রোত বেড়ে চলে। রাত ১০টা বেজে গেছে।চারপাশ থেকে খবর আসছে আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবার এর পক্ষে জনসাধারণের সমর্থন বেড়েই চলেছে। রাত ১০টা বাজতেই সামনের জনতার ওপর চড়াও হল পুলিশ।শুরু হলো লাঠিচার্জ। কিন্তু লেবাররাও আজ ছাড়বে না ঠিক করেছে।কেউ একচুল নড়ল না জায়গা থেকে।লাঠিচার্জএর সামনে পড়েও কেউ পালাচ্ছে না। এমন সময় বিকট শব্দ করে ফেটে উঠলো কয়েকটা বোম। চারিদিকে ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে গেছে।লোকে দৌড়ে যাচ্ছে।কে যেন বোমাবাজি করেছে,অথচ শ্রমিকরা কিছুই জানে না।পুলিশ এবার ফায়ারিং করছে।একঘন্টা পর হেমারকেট স্কয়ার এর রাস্তায় পরে রইলো ৭৭টি মৃতদেহ।সাতটি পুলিশম্যান আর ৭০জন সাধারণ মানুষ।প্রচুর মানুষ আহত।
পরের দিন খবরের কাগজে বিস্তারে ছাপা হলো এই ঘটনা।শ্রমিকদের তরফ থকে করা বোমাবাজি আর ফায়ারিঙে নিহত ১০জন।আনার্কিস্ট নেতারাই এর জন্যে দায়ী।কিছু সংবাদপত্রে মিনমিন করে বলা হলো,পুলিশ গুলি চালিয়েছে সাধারণ পালাতে থাকা জনতার ওপর,শাষনপক্ষের শাসানিতে তারাও চুপ করে গেল। এরতরফা জুডিশিয়াল সিস্টামে দোষী হলো,অগাস্ট স্পাইস,আলবার্ট পারসন আর স্যামুয়েল ফিল্ডেন।এদের জন্য বরাদ্দ মৃত্যদন্ড।বাকিদের আজীবন সশ্রম কারাবাস। ফাঁসির কাঠের সামনে এসে স্পাইস  চেঁচিয়ে উঠলো,"the day will come when our silence will be more powerful than the voices you strangle today."
হেমারকেট স্কয়ার ম্যাসাকার এর পরের দিনই লেবার ইউনিয়ন দের মেম্বারশিপ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই ঘটনা আগুনে ঘি দেয় সারা আমেরিকার শ্রমিকদের ক্রোধে। স্ট্রাইক,প্রতিরোধ  আর কথাবার্তা চলতে থাকে বছরের পর বছর। অতঃপর ১৮৯০ সালে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয় সরকার।দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার জন্যে পুরো বেতন দেওয়া হবে তাদের।শ্রমিকদের  অধিকার আছে বেঁচে থাকার,আনন্দ করার,প্রতিরোধ করার,কথা বলার।
১মে  ১৮৮৬ সালের মে প্যারেডের দিনটাকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকার করা হয়।
লোকে আজ ভুলে গেছে লেবার লিডারদের।anarchist  লিডারদেই বা কে চেনে।anarchist  বলতে লোকে অরাজকতাবাদীই বোঝে।কিন্তু anarchist লিডারদের আসল উদ্দেশ্য ছিল,without  archons.আমাদের শাসনকর্তা আমরাই,অন্য কেউ নয়। হেমারকেট স্কয়ার আজও রয়ে গেছে।রয়ে গেছে অগাস্ট স্পাইস এর বলা সেই শেষ কথা....The day will come when our silence will be more powerful than the voices you strangle today..



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন