#দিনযাপন
প্রতিবছর এপ্রিল এলেই আমার মনে রাজ্যের ভুলভাল কথা এসে ভিড় করে। বসন্তের রংমিলান্তি সোনারোদ আর ঝকঝকে নীল আকাশ, এরই মাঝে হুট করে এক একদিন মনখারাপের মেঘ উড়ে এসে জুড়ে বসে। বিকেলে হাঁটতে গিয়ে পুষ্পবিলাসী বাতাস গায়ে লাগে, পশমিনা ঘাসের গালচেতে পিকনিক করতে করতে বল খেলে অল্পবয়সীরা, ভ্যানিলা-চকোলেট স্কুপ হাতে এশিয়ান তরুণীরা হেঁটে যায়, তখন সেদিকে চেয়ে শুধু মনে হয়, জাপানে এখন চেরি ব্লসমের মরসুম৷ সাকুরা স্প্রিংগস। আরো একটা বছর কেটে গেল, জাপান যাওয়া হল না। কেন জানি বারবার 'ইন দ্য মুড ফর লাভ'-এর আবহসঙ্গীতটা কানে বেজে যায়।
ভিয়েনায়, এপ্রিলের সময় কেউ মুখভার করে থাকে না। অস্ট্রিয়া কস্মিনকালেও জার্মানি নয়, এখানে শীতকালেও ফুটফুটে রোদ্দুর ওঠে। একের পর এক পাবলিক ইভেন্ট, মেলা, অনুষ্ঠান চলতেই থাকে। কথায় আছে, ইন ইউরোপ, হ্যাপিনেস স্টপস অ্যাট ভিয়েনা। তবুও, প্রতিটা সুখের সঙ্গে আইসিং সুগারে মতো কিছুটা বিষাদ লেগে থাকে ঠিকই।
In her eyes, the sadness sings—of one who was destined, for better things.
হাঁটা ছাড়া আমার বিশেষ কোনও কাজ নেই বাইরে এলে। তাই হাঁটতে থাকি। দশ মিনিট হোক বা দু ঘন্টা, ওইটুকু সময়ের মধ্যেই চোখ আর মনের কসরত হয়। এক একটা চেরি গাছ (ফুলে বোঝাই হলে কি ভরন্ত গাছ বলা যায়?) সেদিকে তাকালে আর সত্যি সত্যিই চোখ ফেরানো যায় না, বোকার মতো গোলাপি ফুল দেখে যাই... বা বীথি চট্টোপাধ্যায়ের মতো করে বলা যায়...
'গোলাপি ফুল, সবুজ পাতা, সদ্যোজাত কমলা জবা, ম্যাগনেলিয়ায়
অল্প আলো চুঁইয়ে পড়ছে, একটু ঠান্ডা হাওয়া
পাঁচিলের ওপর মাধবীলতা, চোখ বুজে যায়'...
কিন্তু এরই মধ্যে মনে পড়ে যায়, কিছু পাওয়া হয়নি, সঙ্গে কিছু হারিয়েও এসেছি। যে এপ্রিলগুলো ফেলে এসেছি, সে আর ফিরে আসবে না। শুধু আমার জন্য নয়, কারো জন্যই সেই সময়টা আর বসে নেই।
ছোটবেলায় আমার এপ্রিল মাসটা ছিল ছুটির প্রথম মাস। জীবনের অনেক কিছু আমি এপ্রিল মাসের ছুটিতেই আবিষ্কার করেছি। সন্তু কাকাবাবু থেকে হ্যারি পটার, ক্রিকেট ফিল্ড থেকে সাঁতার, নতুন অভিজ্ঞতার জন্য স্কুল ছুটির পর এই মাসটাই উইশিলিস্ট করা হিসেবের খাতায় ধরা থাকত। রোদের তাপ সে সময় এপ্রিল মাসে এত চড়া হত না, দশ বা পনেরো এপ্রিল অব্দি ছাদে গিয়ে দিন কাটানো আমাদের দিনলিপির মধ্যেই পড়ত।
সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়তে আবিষ্কার করলাম, বা উপলব্ধি হল বলা যায় যে, বেনারসে থাকাকালীন আমার জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় মনে হয় ছাদেই কেটেছে। ছাদ নিয়ে এত অভিজ্ঞতা জমে আছে যে 'আমার ছাদ জীবন' বলে একটা পাণ্ডুলিপি হয়ে যায়। শুধু আমিই কেন, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বা তারপরও অনেকের কাছে সোশালাইজিং এর প্রধান জায়গাই ছিল ছাদ, এখন এই প্র্যাক্টিস আগের চেয়ে অনেক কমে এলেও লুপ্ত হয়ে যায়নি।
সরু গলির মধ্যে বাড়ি, উঠোন ফুঠোন বা লাগোয়া রকের বালাই নেই, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা আমরা ছাদেই কাটিয়ে দিতাম। গরম পড়লে তো রাতেও ছাদেই শোয়া হত, কারণ লোডশেডিং হওয়া ছিল অবধারিত। মাদুর কাঁথা চাদর নিয়ে সন্ধ্যার পরেই সবাই ছাদে চলে যেত, তার আগে বালতি বালতি জল ফেলে ঠান্ডা করা হত ছাদটা। রাতে শুয়ে শুয়ে চশমাবিহীন চোখে তারাদের দিকে তাকিয়ে থাকা আর মাঝেমধ্যেই শব্দ হলে ধড়ফড় করে উঠে বসা! মুঁহনোচওয়া এল নাকি? (যাঁরা মুঁহনোচওয়ার কথা জানেন না, গুগল বাবার শরনাপন্ন হোন। এই অদ্ভুত জীব বাঁদর ভূত এলিয়েন একসময় অর্ধেক উত্তর ভারতের মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল)
মার্চ এপ্রিল অব্দি পেয়ারা লেবু মাখা নিয়ে খাওয়াদাওয়ার পর ছাদেই গুলতুনি চলত, ব্যাটবল নিয়ে মাঝেমধ্যে আমাদের ছাদ থেকেই অন্যদের ছাদেও চলে যেতাম। এপ্রিল মাসে পাড়াপড়শিদের ছেলেদেরও স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, সবাই মিলে জমে যেত ম্যাচ। তবে মুশকিল হল, বল প্রায়ই চলে যেত অন্যদের ছাদে। তখন এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ঝুঁকি নিয়ে কার্নিশ বেয়ে যেতে হত, কাজটায় আমার প্রবল উৎসাহ ছিল সন্দেহ নেই। ছাদে বড়ি আর পাঁপর দেওয়া হয়েছে, আচার মজছে, কাপড় শোকাচ্ছে, বাঁদরের উৎপাত আছে বলে আমরা অনেকেই একটা ইয়া বড় ডান্ডা নিয়ে ঘুরতাম। (যদিও বাঁদর মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এলে সেই অস্ত্র কোনও কাজেই লাগত না)। রোদ চড়া হলে সেই ডান্ডা বা লাঠি ছাদের কোণে পাঁচিলের ওপর রেখে একটা চাদর নিয়ে ঢেকে দিব্যি একটা তাঁবু টাইপস ঘর করতাম, সেখানে মাদুর বিছিয়ে বই পড়ার মজাই ছিল আলাদা। মাঝেমধ্যে বিস্কুট গুঁড়ো করে পায়েস বানিয়ে সেখানে বসে খেয়েছি, সেই স্মৃতি এখনও আমার উবে যায়নি। বাবা জেঠু বা অন্যরা খবরের কাগজ নিয়ে বসত ছুটির দিনে, মাঝেমধ্যে দেশোদ্ধারও চলত রাজনীতিক বিশ্লেষণ সহ।
এরই মধ্যে আবিষ্কার করতাম, ছাদের ওপর লাগানো লোহার জালতির ওপারে, কোণার এক মুঠো মাটিতে গজিয়ে ওঠা নয়নতারার গাছে কুঁড়ি থেকে নতুন ফুল আসছে। বসন্ত পঞ্চমী কেটে গেছে দেড় মাস আগেই, কিন্তু বসন্ত এখনও তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নেয়নি আমাদের জীবন থেকে। সেই বসন্তে কোনও চেরিফুল ছিল না, কিন্তু চড়ুইপাখি ছিল। তারা এসে ছাদে বসত, চাল আর জল খেত। বাসা করত একতলার ঘুলঘুলিতে, বারান্দার টঙে। শত গরম লাগলেও তখন বিকেলের পর পাখা চালাতাম না আমরা, ঘরে ফিরে আসার সময় যদি পাখার ধাক্কা খেয়ে মরে যায় চড়ুইগুলো? সেই বসন্তে ফড়িং ছিল, যাদের আমি ভীষণভাবে উত্যক্ত করেছি। এমনকি, প্রজাপতিও ছিল। ভাবলে অবাক হতে হয়, কিন্তু কংক্রিটের সেই ভিড়েও প্রজাপতিরা আমাদের দেখা দিতে এসেছে সেই সব বসন্তে। খুব বেশি সময় তো কাটেনি, কিন্তু সব কিছুই আমূল বদলে গেছে মনে হয়।
এখনকার ছেলেমেয়েরা কি প্রজাপতি আর ফড়িং নিয়ে ভাবে, চড়ুইপাখির বাসা নিয়ে চিন্তা করে? তারা কি জানে, বসন্ত বলে একটা ঋতু আছে? সত্যিই আছে, বইয়ের পাতার বাইরেও?
এইসব হাবিজাবি ভাবি আর হাঁটি। স্ট্রাউসের প্রতিমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কালীঠাকুর মনে আসে, এপ্রিলের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে সেপ্টেম্বরে চলে যাই। তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার পা চালাই, মনে মনে ভাবি, একদিন শালা জাপান যাবই। ফের কিছুক্ষণ পর গাছ আর ফুল দেখে আনমনা হয়ে যাওয়া... এই করেই চলে। প্রতিদিনের বেত্তান্ত। মাঝেমধ্যে ছবি তোলার চেষ্টাও হয়, কিন্তু স্মার্টফোনে কিছুই ভালো করে ধরা যায় না। তখন মনে হয়, ধুরছাই, পিংকি রঙের স্টিল ক্যামেরাটাই ভালো ছিল। কোথায় যে হারিয়েছে, সে আর কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না।