শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

লুমিনিয়াস রিপাবলিক

 


আন্দ্রেস বার্বা স্পেনে জন্মেছেন, আপাতত বেশ কয়েক বছর ধরে আর্জেন্টিনায় থাকছেন। সাহিত্য জগতে তাঁর খাতির আছে। ইংরেজি পাঠকরা যদি তাঁর নাম না শুনে থাকেন, তাহলে তাঁর বিশেষ কিছু আসে যাবে না। কারণ, টু কাট দ্য লং স্টোরি শর্ট, এই সময়ে দুনিয়ায় হিস্প্যানিক জগতেই 'আর্গুয়েবলি' সবচেয়ে ভালো আর বৈচিত্র্যময় কাজকর্ম হচ্ছে। সে উপন্যাস হোক, ছোটগল্প বা গ্রাফিক নভেল। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিকরা যেভাবে চালিয়ে ব্যাট করছেন, যাকে বাংলায় বলে 'আনঅ্যাপলোজেটিক'। বুম সাহিত্যের ভালো জিনিসগুলো সযত্নে আলাদা করে রেখেছেন, অথচ সেই নস্টালজিয়ায় ব্যাগেজটা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। গত কয়েক বহরের মধ্যে নতুন মুখরা এসে যা পারফর্ম্যান্স দিয়েছেন, তাতে লোকজন নড়েচড়ে বসতে বাধ্য। পরপর অনুবাদ করা সত্ত্বেও এই গুপ্তধনের অনেকটাই এখনও ইংরেজি মেনস্ট্রিম দুনিয়ায় আসেনি, সে সম্ভবও নয়। অনুবাদ যতই হোক, সব তো করা সম্ভব নয়।

ধান ভানতে শিবের গীত অনেক হল। এই সব বলার প্রধান কারণ, রিসেন্টলি পড়ে শেষ করা আন্দ্রেস বার্বার একটা ছোট্ট বই... দ্য লুমিনিয়াস রিপাবলিক। মাত্র ১২৯ পাতার এই নভেলা উপন্যাসে তিনি যে খেল দেখালেন, তাতে আমি ফিদা।

গল্প খুব ছোট্ট। সান ক্রিস্টোবাল একটা কাল্পনিক শহর, বর্ণনা শুনে আমাজনের জঙ্গল এর লাগোয়া কয়েকটা ছোট ছোট শহরের কথা মনে পড়ে যায়। সেখানে কয়েক দশক আগে এক সোশ্যাল সেক্টরে কর্মরত ব্যক্তির অভিজ্ঞতাটুকু লেখা হচ্ছে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে। নয়ের দশকে সেই মফস্বলি শহরে বত্রিশজন বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দেখা পাওয়া যায়, মূলত যারা স্ট্রিট কিডস। তারা কোত্থেকে আসে, কোথায় যায়, কেউ জানে না। কিন্তু বয়সে অল্প হলেও সেই বাচ্চাগুলো এমন একটা বীভৎস ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে, যে শহরের মানুষের বিশ্বাসের ভিত নড়ে যায়। ধীরে ধীরে এই সোজাসাপ্টা গল্প এমন জটিল হিউমান স্টোরি হয়ে ওঠে যে পাঠক থ মেরে যায়। অল্পবয়সীদের প্রতি প্রাপ্তমনস্ক সমাজের যে মনোভাব, আর একটা ক্রাইসিসের পর সমাজ ব্যাপারটা যেভাবে ডিল করে, তা অসামান্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। এই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কোথাও লেখার গতিকে শ্লথ করে না, কারণ লেখার শৈলী অসম্ভব স্মার্ট আর ফ্লুইড, আবার একইসঙ্গে অসম্ভব গভীর। সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেশন আর অ্যালাগরিক দৃশ্যকল্প ব্যবহার করার মুনশিয়ানা চোখে পড়ার মতো। বইটা যে কেন খুব বেশি পাঠকের চোখে পড়েনি, সেটা বলা মুশকিল। ছোটদের দুনিয়া বলেই যে সহজ সরল আদুভুঁদু নরম গুলুমুলু টাইপ্স, এই মানসিকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে নতুন কিছু পড়তে চাইলে এই বইটা পড়ে ফেলুন। ঠকবেন না।

সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪

দিনযাপন (বসন্ত ২০২৪) -৩


নতুন বছরের আসে, চলেও যায়। এতই তাড়াতাড়ি চলে যায়, যে বছরটা যে আদৌ এসেছিল কিনা, সেই নিয়েই মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় আমার। যাই হোক, নতুন বছর আসছে, আজকাল এই কথাটা দু একদিন আগে কেউ না কেউ আমাকে মনে করিয়ে দেয় বলে জানতে পারি। আগে ভাবতাম, যাহ, আরেকটা বছর জলে গেল! 

এখন ভাবনা বা দুর্ভাবনা কিছুই হয় না, শুধু মনে হয়, অ, নতুন বছর এসে গেছে! শারদীয় আনন্দমেলার বিজ্ঞাপন এল বলে!

তা আমি নতুন বছরের উইকেন্ড কী করে কাটালাম! শনিবার দেখলাম, কাউচসার্ফিং এর ছেলেমেয়েরা সিটি হাইক করছে, তিন নম্বর রুট শহরের একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে বন জঙ্গল পাহাড়পর্বত চড়াই-উৎরাই  দিগন্তজোড়া সবুজ বিস্তারের ভিউপয়েন্ট দেখিয়ে আবার সেই একই জায়গায় ফিরে আসবে, ম্যাপ অনুয়ায়ী আট নয় কিলোমিটার পথ। একটা থেকে ছটা, চড়াইয়ের পর অবশ্য রেস্টপয়েন্টও পাওয়া যাবে! চললুম দুজনে কোমর বেঁধে। অনেকেই এসেছে। এদেশীয় মানুষ, এদেশীয় কেন, ইউরোপ আমেরিকার অধিকাংশ মানুষের জীবনেই আউটডোর অ্যাক্টিভিটিটা একটা বাধ্যতামূলক ব্যাপার, ঘরে বসে থাকা এদের স্বভাবেই নেই। কেউ ছুটছে, কেউ সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ কায়াক নিয়ে নদীতে নেমে পড়ছে, শীত পড়লে স্কি করতে  চলল, গরম পড়লে সাঁতার কাটতে নামল... অনেকটা বাঙালির চৈত্র সেলে গিয়ে বইপত্র জামা জুতো কেনার মতোই ব্যাপার। হাইকিং তো বারোমাসই চলছে, আর হাইকিং ট্রেলও বানিয়েছে বটে! গোটা ইউরোপ জুড়ে হাঁটতে থাকো সারাজীবন, শেষ হবে না। যাই হোক, এই যাত্রায় বেশ কয়েকজন চমৎকার বন্ধু হল। ফিনল্যান্ডের এক ছেলে এসেছে, সে পাখিপাগল, টিটি পাখির ডাক শুনে পাখির বাপ ঠাকুরদার নামও বলে দিতে পারে। আর একটা ছেলে অ্যালেক্স, তাকে দেখতে গ্যারি ওল্ডম্যানের মতো, সে স্কেটিং আর সাইকেল নিয়ে পড়ে থাকে। ইউনিভার্সিটি থেকেও একটা দল এসে যোগ দিয়েছে, অঙ্কুশ বলে একটা ঢাকার ছেলের সঙ্গে পরিচয় হল, টেলিকম নিয়ে পড়ছে, চরকির সিনেমার কথা বলতে বলল সিনেমা নিয়ে ইন্টারেস্ট নেই, বই পড়ে মাঝেমাঝে। আমি ফুলে ফুচকা হয়ে জিগোলাম কী পড়েছে শেষ? তাতে সে বলল মানিক বন্দোপাধ্যায় আর হুমায়ুন আহমেদ, নতুনদের লেখা বিশেষ পোষায় না! হুমম!

মরিয়ম বলে একটা আরবের মেয়েও চলেছে, তাকে দুজন মিলে ক্রমাগত হাবিবি হাবিবি করে ভেঙাচ্ছে, মেয়েটাও ব্যাপারটা বেশ এনজয় করছে মনে হল। আরেক ভারতীয় ছেলে ছিল, নাম নরেশ, থাকে কোপেনহেগেনে। প্রায় কুড়ি পঁচিশজন ছেলেমেয়ে, সবাইকে একাট্টা করে নিয়ে চলেছে আমাদের লিডার মার্টিন, সে ব্যাটা ভিয়েনার সিএস অ্যাম্বাসাডর, প্রতি সপ্তাহে লুক চেঞ্জ করে ফেলে। এই সপ্তাহে একটা গাব্দা গোঁফ রেখেছে।

তবে সবচেয়ে ভালো লাগল, এই হাইকে একটা অন্ধ ছেলেও ছিল, মূলত পলিশ, চড়াই-উতরাই গোটা রাস্তাটাই অ্যালেক্সের হাত ধরে চলল সে, বাড়তি কোনও সাহায্য চাইল না, কেউ আগ বাড়িয়ে বাড়তি সাহায্য করার কথা ভাবলও না। ছেলেটা একবারে লেভেলের ইন্টেলিজেন্ট, কথাবার্তা শুনে যা বুঝলাম, তাতে মনে হল ভাষাবিজ্ঞান থেকে টেকনলজি, সব কিছুতেই সে বাকিদের টেক্কা দিতে পারে। বাদাম চিবুতে চিবুতে মনে হল, ছুটির দিনগুলো এইভাবে হাইল করলে মন্দ হত না! ব্যাঙ্গালোরে থাকতে যত ফালতু লেখালিখি করে সময় নষ্ট করেছি, ওসব মিডিওকার লেখা লেখার চেয়ে শনিবার রবিবার ট্রেক করলে হত! অবশ্য ট্রাফিকের জ্বালায় বাইরে বেরোতে ভয় হত, সে কথাও সত্যি।

ঝকঝকে রোদ উঠেছিল, চমৎকার আবহাওয়া, চার পাঁচ ঘণ্টা গল্পগুজব করে হাঁটতে হাঁটতেই কেটে গেল, মাঝে একটা খোলা মাঠে ঘাসের ওপর বসে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া হল। ছ'টা নাগাদ ফিরে দেখি, গা অব্দি ঘামেনি।  নববর্ষ উৎসব হোক না হোক, অন্যান্য উৎসব চলতেই থাকে এ শহরে। ফ্লি মার্কেট, আর্ট এক্সিবিশন, সিনেমা... ফেরার সময়ে দেখি বালকান ফুড ফেস্টিভ্যাল চলছে। হুড়ুমদুড়ুম গান, বিয়ারের ফোয়ারা, মাংস গ্রিল হওয়ার গন্ধে মাথা গরম হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়! এসব জায়গায় গিয়ে আমি পিপল ওয়াচিং করি! জনজোয়ার, ঠিক হুজুগে বাঙালির মতোই মেলাত গিয়ে বেশি দাম দিয়ে রোল চাউমিন খাওয়ার লোক, এখানে দুরুম পরোটা আলুভাজা খায় আর কি! আর আইসক্রিম। আইসক্রিম না খেলে বলে বসন্ত পালন হয়  না, এমন পাপ করলে ঠাকুর গোঁসা হয়। আমি এদিকে ঘাসের জাজিমে বসে বসে লোকজনকে দেখে যাই। কোন ছোঁড়া দুষ্টুমি করছে, কোন জুটি নতুন প্রেমে পড়েছে, কোন ছেলে একমনে আলুভাজা খাচ্ছে বা সাইকেল চালাচ্ছে, মাঝেমধ্যে ব্র‍্যাড পিট বা জেনিফার কনেলিরও দেখা পাওয়া যায়। একা বসে আছে। তখন মনে হয়, ধুস, বছর পনেরো আগে হলে আমি নিজেই একটা বিফোর দ্য সানরাইজ বানিয়ে ফেলতে পারতাম। 

রবিবার আমাদের বাঁধা প্রোগ্রাম। গুরুদ্বারা গিয়ে ভুরিভোজ। সেখানেও অবশ্যি পিপল ওয়াচিং কম হয় না। তবে মাঝেমধ্যে খানিক ডিটোর নিয়ে টুলিপ গার্ডেন বা বার্ড পার্কে ঢুকে পড়ি। গত সপ্তাহে একটা প্রকাণ্ড গ্লাসহাউজে ঢুকে পড়েছিলাম না জেনেই। গিয়ে দেখি, কৃত্তিমভাবে ট্রপিকাল ক্লাইমেট তৈরি করে রেখেছে। ৩৫ ডিগ্রি গরম, ক্রান্তীয় এলাকার গাছপালা, ফুল, নানারকম পাখি, গিরগিটি, ফড়িং নাচানাচি করছে। এত পাখি দেখে এমন লাফালাফি করলাম, ভুলেই গেছি যে অন্য বাচ্চারাও সেখানে ঘুরতে এসেছে। তাদের অনেকেই আমাদের দেখে ভুরু কুঁচকে ভাবছে, আদেখলাপনা দেখো! শালোরা আগে কোনোদিন পাখি দেখেনি! কে বোঝাবে, সত্ত্যিই তো দেখিনি! দেখি না! কোথায় পাখি? কাক চড়ুই পায়রা বাদে বিশেষ কিছু চোখে পড়ত না দেশে থাকতে, কেরলে প্রথম লেজ ঝোলা পাখি দেখতে গিয়ে আমি প্রায় খাদে পড়ে যাচ্ছিলাম। এই সব করে দিন কাটাতে কাটাতে মনে হয়, মন্দ কি! নতুন বছর ভালোই তো কাটল! তারপর এ-ও মনে হল, শুভনন্দন কথাটা তো শুনতে ভালোই!

















 

মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০২৪

দিনযাপন (বসন্ত ২০২৪)- ২

 


#দিনযাপন

প্রতিবছর এপ্রিল এলেই আমার মনে রাজ্যের ভুলভাল কথা এসে ভিড় করে। বসন্তের রংমিলান্তি সোনারোদ আর ঝকঝকে নীল আকাশ, এরই মাঝে হুট করে এক একদিন মনখারাপের মেঘ উড়ে এসে জুড়ে বসে। বিকেলে হাঁটতে গিয়ে পুষ্পবিলাসী বাতাস গায়ে লাগে, পশমিনা ঘাসের গালচেতে পিকনিক করতে করতে বল খেলে অল্পবয়সীরা, ভ্যানিলা-চকোলেট স্কুপ হাতে এশিয়ান তরুণীরা হেঁটে যায়, তখন সেদিকে চেয়ে শুধু মনে হয়, জাপানে এখন চেরি ব্লসমের মরসুম৷ সাকুরা স্প্রিংগস। আরো একটা বছর কেটে গেল, জাপান যাওয়া হল না। কেন জানি বারবার 'ইন দ্য মুড ফর লাভ'-এর আবহসঙ্গীতটা কানে বেজে যায়।  

ভিয়েনায়, এপ্রিলের সময় কেউ মুখভার করে থাকে না। অস্ট্রিয়া কস্মিনকালেও জার্মানি নয়, এখানে শীতকালেও ফুটফুটে রোদ্দুর ওঠে। একের পর এক পাবলিক ইভেন্ট, মেলা, অনুষ্ঠান চলতেই থাকে। কথায় আছে, ইন ইউরোপ, হ্যাপিনেস স্টপস অ্যাট ভিয়েনা। তবুও, প্রতিটা সুখের সঙ্গে আইসিং সুগারে মতো কিছুটা বিষাদ লেগে থাকে ঠিকই। 

In her eyes, the sadness sings—of one who was destined, for better things.

হাঁটা ছাড়া আমার বিশেষ কোনও কাজ নেই বাইরে এলে। তাই হাঁটতে থাকি। দশ মিনিট হোক বা দু ঘন্টা, ওইটুকু সময়ের মধ্যেই চোখ আর মনের কসরত হয়। এক একটা চেরি গাছ (ফুলে বোঝাই হলে কি ভরন্ত গাছ বলা যায়?) সেদিকে তাকালে আর সত্যি সত্যিই চোখ ফেরানো যায় না, বোকার মতো গোলাপি ফুল দেখে যাই... বা বীথি চট্টোপাধ্যায়ের মতো করে বলা যায়...

'গোলাপি ফুল, সবুজ পাতা, সদ্যোজাত কমলা জবা, ম্যাগনেলিয়ায়

অল্প আলো চুঁইয়ে পড়ছে, একটু ঠান্ডা হাওয়া

পাঁচিলের ওপর মাধবীলতা, চোখ বুজে যায়'... 

কিন্তু এরই মধ্যে মনে পড়ে যায়, কিছু পাওয়া হয়নি, সঙ্গে কিছু হারিয়েও এসেছি। যে এপ্রিলগুলো ফেলে এসেছি, সে আর ফিরে আসবে না। শুধু আমার জন্য নয়, কারো জন্যই সেই সময়টা আর বসে নেই। 

ছোটবেলায় আমার এপ্রিল মাসটা ছিল ছুটির প্রথম মাস। জীবনের অনেক কিছু আমি এপ্রিল মাসের ছুটিতেই আবিষ্কার করেছি। সন্তু কাকাবাবু থেকে হ্যারি পটার, ক্রিকেট ফিল্ড থেকে সাঁতার, নতুন অভিজ্ঞতার জন্য স্কুল ছুটির পর এই মাসটাই উইশিলিস্ট করা হিসেবের খাতায় ধরা থাকত। রোদের তাপ সে সময় এপ্রিল মাসে এত চড়া হত না, দশ বা পনেরো এপ্রিল অব্দি ছাদে গিয়ে দিন কাটানো আমাদের দিনলিপির মধ্যেই পড়ত। 

সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়তে আবিষ্কার করলাম, বা উপলব্ধি হল বলা যায় যে, বেনারসে থাকাকালীন আমার জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় মনে হয় ছাদেই কেটেছে। ছাদ নিয়ে এত অভিজ্ঞতা জমে আছে যে 'আমার ছাদ জীবন' বলে একটা পাণ্ডুলিপি হয়ে যায়। শুধু আমিই কেন, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বা তারপরও অনেকের কাছে সোশালাইজিং এর প্রধান জায়গাই ছিল ছাদ, এখন এই প্র্যাক্টিস আগের চেয়ে অনেক কমে এলেও লুপ্ত হয়ে যায়নি। 

সরু গলির মধ্যে বাড়ি, উঠোন ফুঠোন বা লাগোয়া রকের বালাই নেই, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা আমরা ছাদেই কাটিয়ে দিতাম। গরম পড়লে তো রাতেও ছাদেই শোয়া হত, কারণ লোডশেডিং হওয়া ছিল অবধারিত। মাদুর কাঁথা চাদর নিয়ে সন্ধ্যার পরেই সবাই ছাদে চলে যেত, তার আগে বালতি বালতি জল ফেলে ঠান্ডা করা হত ছাদটা। রাতে শুয়ে শুয়ে চশমাবিহীন চোখে তারাদের দিকে তাকিয়ে থাকা আর মাঝেমধ্যেই শব্দ হলে ধড়ফড় করে উঠে বসা! মুঁহনোচওয়া এল নাকি? (যাঁরা মুঁহনোচওয়ার কথা জানেন না, গুগল বাবার শরনাপন্ন হোন। এই অদ্ভুত জীব বাঁদর ভূত এলিয়েন একসময় অর্ধেক উত্তর ভারতের মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল) 

মার্চ এপ্রিল অব্দি পেয়ারা লেবু মাখা নিয়ে খাওয়াদাওয়ার পর ছাদেই গুলতুনি চলত, ব্যাটবল নিয়ে মাঝেমধ্যে আমাদের ছাদ থেকেই অন্যদের ছাদেও চলে যেতাম। এপ্রিল মাসে পাড়াপড়শিদের ছেলেদেরও স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, সবাই মিলে জমে যেত ম্যাচ। তবে মুশকিল হল, বল প্রায়ই চলে যেত অন্যদের ছাদে। তখন এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ঝুঁকি নিয়ে কার্নিশ বেয়ে যেতে হত, কাজটায় আমার প্রবল উৎসাহ ছিল সন্দেহ নেই। ছাদে বড়ি আর পাঁপর দেওয়া হয়েছে, আচার মজছে,  কাপড় শোকাচ্ছে, বাঁদরের উৎপাত আছে বলে আমরা অনেকেই একটা ইয়া বড় ডান্ডা নিয়ে ঘুরতাম। (যদিও বাঁদর মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এলে সেই অস্ত্র কোনও কাজেই লাগত না)। রোদ চড়া হলে সেই ডান্ডা বা লাঠি ছাদের কোণে পাঁচিলের ওপর রেখে একটা চাদর নিয়ে ঢেকে দিব্যি একটা তাঁবু টাইপস ঘর করতাম, সেখানে মাদুর বিছিয়ে বই পড়ার মজাই ছিল আলাদা। মাঝেমধ্যে বিস্কুট গুঁড়ো করে পায়েস বানিয়ে সেখানে বসে খেয়েছি, সেই স্মৃতি এখনও আমার উবে যায়নি। বাবা জেঠু বা অন্যরা খবরের কাগজ নিয়ে বসত ছুটির দিনে, মাঝেমধ্যে দেশোদ্ধারও চলত রাজনীতিক বিশ্লেষণ সহ। 

এরই মধ্যে আবিষ্কার করতাম, ছাদের ওপর লাগানো লোহার জালতির ওপারে, কোণার এক মুঠো মাটিতে গজিয়ে ওঠা নয়নতারার গাছে কুঁড়ি থেকে নতুন ফুল আসছে। বসন্ত পঞ্চমী কেটে গেছে দেড় মাস আগেই, কিন্তু বসন্ত এখনও তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নেয়নি আমাদের জীবন থেকে। সেই বসন্তে কোনও চেরিফুল ছিল না, কিন্তু চড়ুইপাখি ছিল। তারা এসে ছাদে বসত, চাল আর জল খেত। বাসা করত একতলার ঘুলঘুলিতে, বারান্দার টঙে। শত গরম লাগলেও তখন বিকেলের পর পাখা চালাতাম না আমরা, ঘরে ফিরে আসার সময় যদি পাখার ধাক্কা খেয়ে মরে যায় চড়ুইগুলো? সেই বসন্তে ফড়িং ছিল, যাদের আমি ভীষণভাবে উত্যক্ত করেছি। এমনকি, প্রজাপতিও ছিল। ভাবলে অবাক হতে হয়, কিন্তু কংক্রিটের সেই ভিড়েও প্রজাপতিরা আমাদের দেখা দিতে এসেছে সেই সব বসন্তে। খুব বেশি সময় তো কাটেনি, কিন্তু সব কিছুই আমূল বদলে গেছে মনে হয়।

এখনকার ছেলেমেয়েরা কি প্রজাপতি আর ফড়িং নিয়ে ভাবে, চড়ুইপাখির বাসা নিয়ে চিন্তা করে? তারা কি জানে, বসন্ত বলে একটা ঋতু আছে?  সত্যিই আছে, বইয়ের পাতার বাইরেও?

এইসব হাবিজাবি ভাবি আর হাঁটি। স্ট্রাউসের প্রতিমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কালীঠাকুর মনে আসে, এপ্রিলের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে সেপ্টেম্বরে চলে যাই। তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার পা চালাই, মনে মনে ভাবি, একদিন শালা জাপান যাবই। ফের কিছুক্ষণ পর গাছ আর ফুল দেখে আনমনা হয়ে যাওয়া... এই করেই চলে। প্রতিদিনের বেত্তান্ত। মাঝেমধ্যে ছবি তোলার চেষ্টাও হয়, কিন্তু স্মার্টফোনে কিছুই ভালো করে ধরা যায় না। তখন মনে হয়, ধুরছাই, পিংকি রঙের স্টিল ক্যামেরাটাই ভালো ছিল। কোথায় যে হারিয়েছে, সে আর কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না।