বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

ইম্যাজিন- আ লাভ স্টোরি



সম্প্রতি বিবিসি ওয়ান 'ইম্যাজিন' বলে একটা সিরিজ করেছে, তার একটা এপিসোড দেখতে গিয়ে একজন শিল্পীর কথা জানতে পারলাম। শুধু জানতে পারলাম না, বলা উচিত জেনে বোমকে গেলাম। বর্তমান সময়ে পারফরম্যান্স আর্ট জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং একইসঙ্গে সবচেয়ে বিতর্কিত শিল্পী ও তারকাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মারিনা আব্রামভিচ। গত পঞ্চাশ বছরে তিনি শিল্প জগতে যে ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করছেন, তার হিসেব করতে হলে ইয়া মোটকা বই হবে। এমনিতেও পারফরম্যান্স আর্ট বিষয়ে আমাদের ধ্যানধারণা খুবই সীমিত, মঞ্চানুষ্ঠান বা থার্ড থিয়েটার (সেটা পারফর্মিং আর্ট) বাদেও যে শিল্পের একাধিক ফর্ম হতে পারে, এক্সপ্রেশনকে ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন মাত্রায় গিয়ে সেলিব্রেট করা যায়, সেরকম কোনও শিক্ষা আমরা পাইনি। মোমা বা অন্যান্য দেশের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে গিলে কিছুক্ষণের জন্য চক্ষু উন্মোচন হয় ঠিকই, কিন্তু সার্বিকভাবে দেখতে গেলে অনেকটাই না জানা থেকে যায়।

ভাগ্য ভালো বলতে হবে, লন্ডনে থাকাকালীন আমার এ বিষয়ে খানিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ইউকের সরকারকে আমার শত কোটি প্রণাম, যারা আমাহেন দরিদ্র কিন্তু উৎসাহী জনতার জন্য সমস্ত মিউজিয়ামে দ্বার অবারিত ভাবে খুলে রেখেছেন। ফলে একদিন পর পর গিয়ে উপস্থিত হতাম টেমসপাথের কাছে অবস্থিত টেট মডার্ন মিউজিয়ামে। প্রায় রোজই এক একটা ওয়াকিং ট্যুর করানো হত বিনামূল্য, একমাসে প্রায় আঠেরো-কুড়িটা ট্যুর করার ফলে একটা ধারণা হয়েছিল ঠিকই। তখনই জানতে পেরেছিলাম পারফরম্যান্স আর্ট নিয়ে কী দারুণ দারুণ কাজ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে।
ওয়াফা বিলাল মিসাইল অ্যাটাকের ফলে তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে টানা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে নিজের পিঠে ট্যাটু করায়। সবাই দেখে, তার পিঠে ফুটে উঠেছে একটা সীমানাহীন ইরাকের ম্যাপ। প্রতিটা রক্তবিন্দু এক একজন মার্কিন সৈনিকের মৃত্যুর প্রতীক। গুনে দেখা যায়, ৫০০০টা লাল বিন্দু আছে তার ট্যাটুতে। কিন্তু আসল খেলা শুরু হয় রাত গড়ালে। বিলাল বসে আছে, তার পিঠে ব্ল্যাকলাইট ফ্ল্যাশ করছে একজন। মিডিয়ার লোকেরা অবাক হয়ে দেখে, সেখানে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে অজস্র সোনালি বিন্দু। সেগুলো এমনিতে অদৃশ্য। দেখা যায়, সারা পিঠ জুড়ে সোনালি ফুলের মতো একটা আকৃতি ফুটে উঠেছে। প্রায় এক লক্ষ অগ্নিবিন্দু জ্বলজ্বল করছে। তারা সবাই আসলে ইরাকের নিরীহ মানুষ, যারা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন।
মারিনার কথাই ধরুন। 'রিদম জিরো' বলে একটা পারফরম্যান্স করার সময়ে তিনি ঠিক করলেন, একটা জীবিত বা মৃত বস্তুর সামনে চুপ করে 'প্যাসিভলি' বসে থাকবেন। এই অব্জেক্ট মানুষ হোক, গোলাপফুল হোক, আনারস হোক, যা খুশি হোক! তিনি নড়বেন না। ব্যাপারটা হবে ওপেন স্পেসে। দেখা গেল দর্শকরা কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই তার গায়ে চিমটি কেটে দেখছে, মাথায় চাঁটি মারছে। মেয়েটা নড়ছে না কেন? সময় যত কাটতে লাগল, লোকজন তত আগ্রাসী হয়ে উঠল। একজন মারিনার গায়ে পিন ফোটাল, একজন তার জামাকাপড় ছিঁড়ে দিল, একজন ছুরি দিয়ে আঘাত করল তাকে। মারিনা তাও অনড়। একসময় মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর, চড় লাথি ঘুষি পড়তে লাগল। একজন কোত্থেকে একটা লোডেড বন্দুক নিয়ে তার মাথায় ঠেকাল। বেগতিক দেখে পুলিশ ও প্রসাশনকে পদক্ষেপ নিতে হয়। বোঝা গেল, সাধারণ মানুষ কোনও 'প্যাসিভ হিউমান বিইং'-কে সহ্য করতে পারে না বেশিক্ষণ। একসময় তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। সামাজিক বা রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন, ব্যাপারটাকে শুধু আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশনের দিক থেকে ভেবে দেখলে চমকে উঠতে হয়। যদিও এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে পারফরম্যান্স আর্টিস্টরা চিরকালই শিল্পকে ব্যবহার করেছেন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। মঞ্চে বা মঞ্চের বাইরে নানারকম হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, সমাজের দ্বিচারিতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে শিল্পের মাধ্যমে। সে নিয়ে লিখতে গেলে জল অনেক দূর গড়াবে। যাই হোক, মারিনার কথায় ফিরি।
ব্যাপারটা হল, পারফরম্যান্স আর্টের কথা বলার জন্য এই পোস্টটা করার দরকার ছিল না। আসল কথা হল মারিনার সম্পর্কে পড়তে গিয়ে এমন একটা আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান পেলাম, যা আমাকে নাড়িয়ে দিল। না, রোমাঞ্চ বা বিস্ময়কর কিছু নয়। এই গল্পও প্রেমের। নিখাদ প্রেমের। ওয়ান অফ দ্য অ্যামেজিং স্টোরি আই এভার কাম থ্রু। দু'জন শিল্পীর লাভ স্টোরি। মারিনা আর উলে। হয়তো অনেকেই জানেন। আমিই জানতাম না আগে।
মারিনা যেখানে ছিলেন সার্বিয়ার শিল্পী, উলে ছিলেন জার্মানির। তাঁর আসল নাম অবশ্য ফ্র্যাঙ্ক উওয়ে লাইজপিন, কিন্তু পারফরম্যান্স আর্ট এর জগতে লোকে তাকে উলে বলেই চিনত। পোলেরয়েড আর্ট আর কোলাবরেটিভ আর্ট প্রোজেক্ট করার ফলে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। মারিনাও সেই সময়ে একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট করছেন। কাকতালীয় কিনা জানি না, কিন্তু দু'জনের জন্মদিনও ছিল এক। ৩০ নভেম্বর।
১৯৭৬ সালে পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয় উলে আর মারিনার। প্রথম সাক্ষাতেই ম্যাজিক। উলের মনে হয়, মারিনা আসলে এক কুহকিনী মহিলা, এই জগতের বাসিন্দা সে নয়। মারিনার মনে হয়, এই আধপাগলা সুন্দর বোহেমিয়ান যুবকের জন্যই তিনি পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন। তারপর আর কি! ইয়ে দিল বেচারা, পেয়ার কা মারা! নতুন প্রেমের স্ফুলিঙ্গ যখন স্তিমিত হল, একে অপরের শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হলেন তারা। ভাগ্যিস হয়েছিলেন। পরবর্তী দেড় দশকে মারিনা-উলে জুটি শিল্প জগতে যা করেছেন, তা ইতিহাস তৈরি করেছে। একের পর এক যুগান্তকারী প্রজেক্ট, একের পর এক অসামান্য এক্সপেরিমেন্ট... মারিনা আর উলে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। পরস্পরের প্রতি অসীম স্নেহ ও বিশ্বাস ছিল তাদের, এই পারস্পরিক বিশ্বাস তাদের পারফর্ম্যান্স আর্টেও ফুটে বেরোত।
'রিলেশন ওয়ার্ক' বলে তাদের যে প্রজেক্ট ছিল, সে নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে। মারিনা আর উলে নিজেদের বলত 'টু হেডেড বডি'। কাজের সূত্রে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হত তাদের, একটা ভ্যান নিয়ে সমস্ত ইউরোপ চষে বেরিয়েছে তারা। দর্শকদের কাছে এই জুটির 'ফ্যান্টম আইডেন্টিটি' ছিল বিস্ময়কর। তার একটা কারণ তাদের রিলেশন ওয়ার্ক প্রজেক্টও বটে। 'আর্ট ভাইটাল' অর্থাৎ নিরন্তর গতি অথবা স্থিতিকে কেন্দ্র করে এক একটা পরীক্ষা করত তারা। এই ধরুন গোটা এক দিন একে অপরের চুল বেঁধে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, অথবা মুখোমুখি ধনুষে তীর পরিয়ে ছিলা টেনে প্রস্তুত রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একজনের মনসংয়োগ যদি এক চুল নড়ে যায়, তীর যদি বেরিয়ে যায় ধনুষ থেকে, অপরজনের মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তেমনটা হত না। তাদের নিজের কথায় বলতে গেলে এর রহস্য হল--
'উই বিকম দ্য আদার!'
পারফর্ম্যান্সের সময়ে উলে মারিনা হয়ে উঠত, মারিনা হয়ে উঠত উলে। উভয়ের শরীর দিয়ে একটাই শক্তি স্রোত বয়ে যেত, দু'জন ভিন্ন মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মুছে যেত সেই সময়ে। মারিনার কথায়, "Our individual identities became less accessible. It revealed a way of having the artistic self made available for self scrutiny."
মারিনা-উলে জুটি নিয়ে তখন শিল্প জগত উত্তাল। সবাই বার বার একই প্রশ্ন করে, বিয়ে করছ কবে? মারিনা আগে বিবাহিতা ছিলেন, যদিও উলের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আগের সম্পর্ক টেকেনি। দীর্ঘ সাত বছর একসঙ্গে থাকার পর আর একের পর এক আর্ট প্রজেক্ট করার পর তারা সিদ্ধান্ত নিল, বিয়েটা তাহলে সেরেই ফেলা যাক। কিন্তু সাধারণ বিয়ে! ছোঃ! ওইসব হবে না! বিয়ের জন্য যে ভাবনা তাদের মাথা থেকে বেরোল, সেরকম কেউ কোনোদিন শোনেনি। মারিনা আর উলে ঠিক করল তার গ্রেট ওয়াল অফ চাইনা অর্থাৎ চিনের দেওয়ালের দুই প্রান্ত থেকে হাঁটতে শুরু করবে। মাঝামাঝি দেখা হবে, তারপর হবে বিয়ে। মাস তিনেক লাগবে। এই অতিমানবিক আর্ট প্রজেক্টে তারা নিজেরাই প্রেমিক, নিজেরাই দর্শক, নিজেরাই শিল্পী। মিডিয়ার লোকজন তো শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এরকম কেউ কস্মিনকালেও দেখেনি।
যাই হোক, ১৯৮৩ সালে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হল না। হবেও বা কী করে, চিনের আধিকারিকরা তো ব্যাপারটা বুঝেই উঠতে পারেনি। গ্রেট ওয়াল অফ চাইনার উপর দিয়ে ক্যাবলা কাত্তিকের মতো হেঁটে যাবে, এ আবার কেমন ধারা আর্ট প্রজেক্ট? নিশ্চয়ই অন্য কোনও ব্যাপার আছে! অনেক কাণ্ড করে যখন অনুমতি পাওয়া গেল, পাঁচ বছর কেটে গেছে। ১৯৮৮ সাল। যাই হোক, ৩০শে মার্চ মারিনা আর উলে হাঁটা শুরু করল। মারিনা ইয়েলো সি-র কাছ থেকে হাঁটবে, উলে শুরু করেছে গোবি মরুভূমি থেকে। প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার হেঁটে আসার পর তারা মিলিত হবে। যাত্রা শুরু হল।
মারিনা আর উলে হাঁটছে। চিনের প্রাচীন শহর, দুর্গম গিরিপ্রান্তর, ছোট ছোট গ্রাম। গ্রেট ওয়ালের অনেকটাই গিয়েছে লোকালয়হীন জনপ্রান্তর দিয়ে। রোজ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার করে হাঁটে তারা, মাঝে মাঝে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ইতিহাসের কথা ভাবে, ভাবে পরস্পরের কথা। কোনোদিন ঝোপঝাড়, কোনোদিন গুহা বা কন্দরে শুয়ে কাটাতে হয়। মাঝেমাঝে অবশ্য গ্রামে আশ্রয় পায়। একদম ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুর মার্কা গ্রাম, আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন। সেখানে অশীতিপর বৃদ্ধরা তাদের গল্প বলে। ড্রাগনের গল্প। গ্রেট ওয়াল অফ চাইনা আসলে তাদের কাছে ঘুমন্ত ড্রাগন। আগুনের আঁচের কাছে বসে এই গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। দিন কাটতে লাগল এইভাবেই। বিপদও কম হয়নি। শরীর খারাপ হয়েছে, দুর্ঘটনা হয়েছে, ডাকাতের পাল্লায় পড়েছে। একজায়গায় এসে মারিনা দেখে যতদূর চোখ যায় নরকঙ্কাল। মারিনাকে বেশ কিছুটা রাস্তা হেঁটে আসতে হল সেই অস্থিসড়কের উপর দিয়েই।
একসময় এই দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি হল। মিং বংশের সময়ে নির্মিত মন্দির প্রাঙ্গণেই এসে একে অপরকে দেখতে পেল তারা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরল দুজনে। মারিনা বলল, "এইবার?"
উলে বলল, "তুমি বলো!"
মারিনা বলল, "আমি এক্ষুনি বাড়ি যেতে চাই। "
উলে হেসে বলল, "আমি কিন্তু অনন্তকাল ধরে এই রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে চেয়েছিলাম।"
মারিনা কাঁদতে শুরু করে। ব্যাপার আর কিছুই নয়, এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে, তাদের জীবনে নতুন মানুষ এসেছে। উলে একটু প্রাচীনপন্থী ছিল, অন্যদিকে মারিনা ছিল প্রবল ভাবে বিপ্লবী আর্টিস্ট। কিন্তু সব জেনেশুনেও এই যাত্রাটা করতে বদ্ধপরিকর ছিল দুজনেই। একসময় যে যাত্রা তাদের মিলনের প্রতীক হওয়ার জন্য ঠিক হয়েছিল, সেটা না হয় তাদের বিচ্ছেদের প্রতীক হয়েই থাকুক। কিন্তু, থাকুক।
প্রেসের লোক কিছুই জানত না। তারা বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিল নিজেরাই। সে সব রইল পড়ে। দু'জনে সংক্ষেপে প্রেস কনফারেন্স করে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিল। ম্লান হেসে একে অপরকে বিদায় জানাল, তারপর স্বতন্ত্র ভাবে ফিরে গেল নিজের নিজের দেশে।
সেই ঘটনার পর বাইশ বছর কেটে গেছে। উলে মারিনার মতো বিপ্লবী আর্টিস্ট হতে পারেননি, তিনি হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু রিলেশন ওয়ার্ক প্রজেক্টের কথা কেউই ভোলেনি। এদিকে মারিনা পারফরম্যান্স আর্ট জগতের সবচেয়ে বড় নাম হয়ে উঠেছেন দু' দশকে।
২০১০ সালে নিউয়র্কের মোমা মানে মিউজিয়াম অড মডার্ন আর্টস-এ একটা অনুষ্ঠান করছিলেন মারিনা। অনেকটা রিদম-এর মতোই, কিন্তু ফরম্যাটে সামান্য তফাত আছে। এতে মারিনা একটা চেয়ারে বসে থাকবেন, তার সামনে থাকবে একটা টেবিল। টেবিলের অপর প্রান্তে এসে বসত একটা অপরিচিত ব্যক্তি। দু'জনের মাঝে দুই মিটারের দূরত্ব। মারিনা অপলক তাকে দেখতেন যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি নিজেই উঠে যাচ্ছে। নিয়ম হল, কেউ কাউকে স্পর্শ করবে না, কেউ কথা বলবে না। নতুন কেউ আসার আগে মারিনা কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করতেন, তারপর আবার অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত নবাগন্তুকের চোখের দিকে। এই অনুষ্ঠান চলেছিল প্রায় চার মাস। সাড়ে সাতশো ঘণ্টা মারিনা কাটিয়েছিলেন এই চেয়ারে বসে। এই আর্ট প্রজেক্টের নাম ছিল -- 'দ্য আর্টিস্ট ইজ প্রেজেন্ট।"
সেইদিনও সব নিয়ম মতো চলছিল। একজন অতিথি উঠে চলে গিয়েছেন, মারিনা ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করেছেন। চোখ খুলে দেখেন, তার সামনে বসে আছেন উলে। কাঁচাপাকা দাড়ি, মুখে বলিরেখা। কিন্তু মারিনার চোখে সে সব অদৃশ্য। তিনি দেখছেন তার পুরোনো সঙ্গীকেই। ঠিক যেন বাইশ বছর আগের সেই চেহারা। উলের চোখে দুষ্টুমির হাসি। মারিনার মুখেও আবছা এক হাসির রেখা ফুটে উঠল, তার চোখ ভিজে গেছে। চোখের কোল থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে পড়বে করেও পড়েনি। সহসা প্রবল পেশাদার শিল্পী বলে খ্যাত মারিনা নিজের নিয়ম নিজেই ভুলে গেলেন, একটু ঝুঁকে উলের হাতটা জড়িয়ে ধরলেন তিনি। দু'জনের চোখের আড়ালে অনেক না বলা কথা। কিন্তু কেউই কথা বলছে না। বাইশ বছর পর দেড় মিনিটের জন্য পৃথিবীর মানুষ আবারও দেখল এই 'টু হেডেড বডি'-কে। এত বছরের দূরত্বও যাদের আলাদা করতে পারেনি।
এই দেড় মিনিটে ঠিক কী হল, সেটা বোঝানোর ক্ষমতা পৃথিবীর সেরা কলমের কাছেও নেই। ইচ্ছে হলে ভিডিওটা কমেন্ট বক্সের লিংক থেকে দেখে নিন।
উলে মারা গিয়েছেন ২০২০ সালে। শেষ জীবনে মারিনা তার সঙ্গেই থেকে গিয়েছিলেন।
কৃতজ্ঞতা:- বিবিসি ওয়ান, অশোক পান্ডে, গার্ডিয়ানসম্প্রতি বিবিসি ওয়ান 'ইম্যাজিন' বলে একটা সিরিজ করেছে, তার একটা এপিসোড দেখতে গিয়ে একজন শিল্পীর কথা জানতে পারলাম। শুধু জানতে পারলাম না, বলা উচিত জেনে বোমকে গেলাম। বর্তমান সময়ে পারফরম্যান্স আর্ট জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং একইসঙ্গে সবচেয়ে বিতর্কিত শিল্পী ও তারকাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মারিনা আব্রামভিচ। গত পঞ্চাশ বছরে তিনি শিল্প জগতে যে ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করছেন, তার হিসেব করতে হলে ইয়া মোটকা বই হবে। এমনিতেও পারফরম্যান্স আর্ট বিষয়ে আমাদের ধ্যানধারণা খুবই সীমিত, মঞ্চানুষ্ঠান বা থার্ড থিয়েটার (সেটা পারফর্মিং আর্ট) বাদেও যে শিল্পের একাধিক ফর্ম হতে পারে, এক্সপ্রেশনকে ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন মাত্রায় গিয়ে সেলিব্রেট করা যায়, সেরকম কোনও শিক্ষা আমরা পাইনি। মোমা বা অন্যান্য দেশের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে গিলে কিছুক্ষণের জন্য চক্ষু উন্মোচন হয় ঠিকই, কিন্তু সার্বিকভাবে দেখতে গেলে অনেকটাই না জানা থেকে যায়।
ভাগ্য ভালো বলতে হবে, লন্ডনে থাকাকালীন আমার এ বিষয়ে খানিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ইউকের সরকারকে আমার শত কোটি প্রণাম, যারা আমাহেন দরিদ্র কিন্তু উৎসাহী জনতার জন্য সমস্ত মিউজিয়ামে দ্বার অবারিত ভাবে খুলে রেখেছেন। ফলে একদিন পর পর গিয়ে উপস্থিত হতাম টেমসপাথের কাছে অবস্থিত টেট মডার্ন মিউজিয়ামে। প্রায় রোজই এক একটা ওয়াকিং ট্যুর করানো হত বিনামূল্য, একমাসে প্রায় আঠেরো-কুড়িটা ট্যুর করার ফলে একটা ধারণা হয়েছিল ঠিকই। তখনই জানতে পেরেছিলাম পারফরম্যান্স আর্ট নিয়ে কী দারুণ দারুণ কাজ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে।
ওয়াফা বিলাল মিসাইল অ্যাটাকের ফলে তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে টানা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে নিজের পিঠে ট্যাটু করায়। সবাই দেখে, তার পিঠে ফুটে উঠেছে একটা সীমানাহীন ইরাকের ম্যাপ। প্রতিটা রক্তবিন্দু এক একজন মার্কিন সৈনিকের মৃত্যুর প্রতীক। গুনে দেখা যায়, ৫০০০টা লাল বিন্দু আছে তার ট্যাটুতে। কিন্তু আসল খেলা শুরু হয় রাত গড়ালে। বিলাল বসে আছে, তার পিঠে ব্ল্যাকলাইট ফ্ল্যাশ করছে একজন। মিডিয়ার লোকেরা অবাক হয়ে দেখে, সেখানে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে অজস্র সোনালি বিন্দু। সেগুলো এমনিতে অদৃশ্য। দেখা যায়, সারা পিঠ জুড়ে সোনালি ফুলের মতো একটা আকৃতি ফুটে উঠেছে। প্রায় এক লক্ষ অগ্নিবিন্দু জ্বলজ্বল করছে। তারা সবাই আসলে ইরাকের নিরীহ মানুষ, যারা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন।
মারিনার কথাই ধরুন। 'রিদম জিরো' বলে একটা পারফরম্যান্স করার সময়ে তিনি ঠিক করলেন, একটা জীবিত বা মৃত বস্তুর সামনে চুপ করে 'প্যাসিভলি' বসে থাকবেন। এই অব্জেক্ট মানুষ হোক, গোলাপফুল হোক, আনারস হোক, যা খুশি হোক! তিনি নড়বেন না। ব্যাপারটা হবে ওপেন স্পেসে। দেখা গেল দর্শকরা কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই তার গায়ে চিমটি কেটে দেখছে, মাথায় চাঁটি মারছে। মেয়েটা নড়ছে না কেন? সময় যত কাটতে লাগল, লোকজন তত আগ্রাসী হয়ে উঠল। একজন মারিনার গায়ে পিন ফোটাল, একজন তার জামাকাপড় ছিঁড়ে দিল, একজন ছুরি দিয়ে আঘাত করল তাকে। মারিনা তাও অনড়। একসময় মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর, চড় লাথি ঘুষি পড়তে লাগল। একজন কোত্থেকে একটা লোডেড বন্দুক নিয়ে তার মাথায় ঠেকাল। বেগতিক দেখে পুলিশ ও প্রসাশনকে পদক্ষেপ নিতে হয়। বোঝা গেল, সাধারণ মানুষ কোনও 'প্যাসিভ হিউমান বিইং'-কে সহ্য করতে পারে না বেশিক্ষণ। একসময় তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। সামাজিক বা রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন, ব্যাপারটাকে শুধু আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশনের দিক থেকে ভেবে দেখলে চমকে উঠতে হয়। যদিও এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে পারফরম্যান্স আর্টিস্টরা চিরকালই শিল্পকে ব্যবহার করেছেন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। মঞ্চে বা মঞ্চের বাইরে নানারকম হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, সমাজের দ্বিচারিতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে শিল্পের মাধ্যমে। সে নিয়ে লিখতে গেলে জল অনেক দূর গড়াবে। যাই হোক, মারিনার কথায় ফিরি।
ব্যাপারটা হল, পারফরম্যান্স আর্টের কথা বলার জন্য এই পোস্টটা করার দরকার ছিল না। আসল কথা হল মারিনার সম্পর্কে পড়তে গিয়ে এমন একটা আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান পেলাম, যা আমাকে নাড়িয়ে দিল। না, রোমাঞ্চ বা বিস্ময়কর কিছু নয়। এই গল্পও প্রেমের। নিখাদ প্রেমের। ওয়ান অফ দ্য অ্যামেজিং স্টোরি আই এভার কাম থ্রু। দু'জন শিল্পীর লাভ স্টোরি। মারিনা আর উলে। হয়তো অনেকেই জানেন। আমিই জানতাম না আগে।
মারিনা যেখানে ছিলেন সার্বিয়ার শিল্পী, উলে ছিলেন জার্মানির। তাঁর আসল নাম অবশ্য ফ্র্যাঙ্ক উওয়ে লাইজপিন, কিন্তু পারফরম্যান্স আর্ট এর জগতে লোকে তাকে উলে বলেই চিনত। পোলেরয়েড আর্ট আর কোলাবরেটিভ আর্ট প্রোজেক্ট করার ফলে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। মারিনাও সেই সময়ে একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট করছেন। কাকতালীয় কিনা জানি না, কিন্তু দু'জনের জন্মদিনও ছিল এক। ৩০ নভেম্বর।
১৯৭৬ সালে পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয় উলে আর মারিনার। প্রথম সাক্ষাতেই ম্যাজিক। উলের মনে হয়, মারিনা আসলে এক কুহকিনী মহিলা, এই জগতের বাসিন্দা সে নয়। মারিনার মনে হয়, এই আধপাগলা সুন্দর বোহেমিয়ান যুবকের জন্যই তিনি পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন। তারপর আর কি! ইয়ে দিল বেচারা, পেয়ার কা মারা! নতুন প্রেমের স্ফুলিঙ্গ যখন স্তিমিত হল, একে অপরের শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হলেন তারা। ভাগ্যিস হয়েছিলেন। পরবর্তী দেড় দশকে মারিনা-উলে জুটি শিল্প জগতে যা করেছেন, তা ইতিহাস তৈরি করেছে। একের পর এক যুগান্তকারী প্রজেক্ট, একের পর এক অসামান্য এক্সপেরিমেন্ট... মারিনা আর উলে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। পরস্পরের প্রতি অসীম স্নেহ ও বিশ্বাস ছিল তাদের, এই পারস্পরিক বিশ্বাস তাদের পারফর্ম্যান্স আর্টেও ফুটে বেরোত।
'রিলেশন ওয়ার্ক' বলে তাদের যে প্রজেক্ট ছিল, সে নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে। মারিনা আর উলে নিজেদের বলত 'টু হেডেড বডি'। কাজের সূত্রে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হত তাদের, একটা ভ্যান নিয়ে সমস্ত ইউরোপ চষে বেরিয়েছে তারা। দর্শকদের কাছে এই জুটির 'ফ্যান্টম আইডেন্টিটি' ছিল বিস্ময়কর। তার একটা কারণ তাদের রিলেশন ওয়ার্ক প্রজেক্টও বটে। 'আর্ট ভাইটাল' অর্থাৎ নিরন্তর গতি অথবা স্থিতিকে কেন্দ্র করে এক একটা পরীক্ষা করত তারা। এই ধরুন গোটা এক দিন একে অপরের চুল বেঁধে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, অথবা মুখোমুখি ধনুষে তীর পরিয়ে ছিলা টেনে প্রস্তুত রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একজনের মনসংয়োগ যদি এক চুল নড়ে যায়, তীর যদি বেরিয়ে যায় ধনুষ থেকে, অপরজনের মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তেমনটা হত না। তাদের নিজের কথায় বলতে গেলে এর রহস্য হল--
'উই বিকম দ্য আদার!'
পারফর্ম্যান্সের সময়ে উলে মারিনা হয়ে উঠত, মারিনা হয়ে উঠত উলে। উভয়ের শরীর দিয়ে একটাই শক্তি স্রোত বয়ে যেত, দু'জন ভিন্ন মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মুছে যেত সেই সময়ে। মারিনার কথায়, "Our individual identities became less accessible. It revealed a way of having the artistic self made available for self scrutiny."
মারিনা-উলে জুটি নিয়ে তখন শিল্প জগত উত্তাল। সবাই বার বার একই প্রশ্ন করে, বিয়ে করছ কবে? মারিনা আগে বিবাহিতা ছিলেন, যদিও উলের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আগের সম্পর্ক টেকেনি। দীর্ঘ সাত বছর একসঙ্গে থাকার পর আর একের পর এক আর্ট প্রজেক্ট করার পর তারা সিদ্ধান্ত নিল, বিয়েটা তাহলে সেরেই ফেলা যাক। কিন্তু সাধারণ বিয়ে! ছোঃ! ওইসব হবে না! বিয়ের জন্য যে ভাবনা তাদের মাথা থেকে বেরোল, সেরকম কেউ কোনোদিন শোনেনি। মারিনা আর উলে ঠিক করল তার গ্রেট ওয়াল অফ চাইনা অর্থাৎ চিনের দেওয়ালের দুই প্রান্ত থেকে হাঁটতে শুরু করবে। মাঝামাঝি দেখা হবে, তারপর হবে বিয়ে। মাস তিনেক লাগবে। এই অতিমানবিক আর্ট প্রজেক্টে তারা নিজেরাই প্রেমিক, নিজেরাই দর্শক, নিজেরাই শিল্পী। মিডিয়ার লোকজন তো শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এরকম কেউ কস্মিনকালেও দেখেনি।
যাই হোক, ১৯৮৩ সালে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হল না। হবেও বা কী করে, চিনের আধিকারিকরা তো ব্যাপারটা বুঝেই উঠতে পারেনি। গ্রেট ওয়াল অফ চাইনার উপর দিয়ে ক্যাবলা কাত্তিকের মতো হেঁটে যাবে, এ আবার কেমন ধারা আর্ট প্রজেক্ট? নিশ্চয়ই অন্য কোনও ব্যাপার আছে! অনেক কাণ্ড করে যখন অনুমতি পাওয়া গেল, পাঁচ বছর কেটে গেছে। ১৯৮৮ সাল। যাই হোক, ৩০শে মার্চ মারিনা আর উলে হাঁটা শুরু করল। মারিনা ইয়েলো সি-র কাছ থেকে হাঁটবে, উলে শুরু করেছে গোবি মরুভূমি থেকে। প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার হেঁটে আসার পর তারা মিলিত হবে। যাত্রা শুরু হল।
মারিনা আর উলে হাঁটছে। চিনের প্রাচীন শহর, দুর্গম গিরিপ্রান্তর, ছোট ছোট গ্রাম। গ্রেট ওয়ালের অনেকটাই গিয়েছে লোকালয়হীন জনপ্রান্তর দিয়ে। রোজ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার করে হাঁটে তারা, মাঝে মাঝে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ইতিহাসের কথা ভাবে, ভাবে পরস্পরের কথা। কোনোদিন ঝোপঝাড়, কোনোদিন গুহা বা কন্দরে শুয়ে কাটাতে হয়। মাঝেমাঝে অবশ্য গ্রামে আশ্রয় পায়। একদম ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুর মার্কা গ্রাম, আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন। সেখানে অশীতিপর বৃদ্ধরা তাদের গল্প বলে। ড্রাগনের গল্প। গ্রেট ওয়াল অফ চাইনা আসলে তাদের কাছে ঘুমন্ত ড্রাগন। আগুনের আঁচের কাছে বসে এই গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। দিন কাটতে লাগল এইভাবেই। বিপদও কম হয়নি। শরীর খারাপ হয়েছে, দুর্ঘটনা হয়েছে, ডাকাতের পাল্লায় পড়েছে। একজায়গায় এসে মারিনা দেখে যতদূর চোখ যায় নরকঙ্কাল। মারিনাকে বেশ কিছুটা রাস্তা হেঁটে আসতে হল সেই অস্থিসড়কের উপর দিয়েই।
একসময় এই দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি হল। মিং বংশের সময়ে নির্মিত মন্দির প্রাঙ্গণেই এসে একে অপরকে দেখতে পেল তারা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরল দুজনে। মারিনা বলল, "এইবার?"
উলে বলল, "তুমি বলো!"
মারিনা বলল, "আমি এক্ষুনি বাড়ি যেতে চাই। "
উলে হেসে বলল, "আমি কিন্তু অনন্তকাল ধরে এই রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে চেয়েছিলাম।"
মারিনা কাঁদতে শুরু করে। ব্যাপার আর কিছুই নয়, এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে, তাদের জীবনে নতুন মানুষ এসেছে। উলে একটু প্রাচীনপন্থী ছিল, অন্যদিকে মারিনা ছিল প্রবল ভাবে বিপ্লবী আর্টিস্ট। কিন্তু সব জেনেশুনেও এই যাত্রাটা করতে বদ্ধপরিকর ছিল দুজনেই। একসময় যে যাত্রা তাদের মিলনের প্রতীক হওয়ার জন্য ঠিক হয়েছিল, সেটা না হয় তাদের বিচ্ছেদের প্রতীক হয়েই থাকুক। কিন্তু, থাকুক।
প্রেসের লোক কিছুই জানত না। তারা বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিল নিজেরাই। সে সব রইল পড়ে। দু'জনে সংক্ষেপে প্রেস কনফারেন্স করে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিল। ম্লান হেসে একে অপরকে বিদায় জানাল, তারপর স্বতন্ত্র ভাবে ফিরে গেল নিজের নিজের দেশে।
সেই ঘটনার পর বাইশ বছর কেটে গেছে। উলে মারিনার মতো বিপ্লবী আর্টিস্ট হতে পারেননি, তিনি হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু রিলেশন ওয়ার্ক প্রজেক্টের কথা কেউই ভোলেনি। এদিকে মারিনা পারফরম্যান্স আর্ট জগতের সবচেয়ে বড় নাম হয়ে উঠেছেন দু' দশকে।
২০১০ সালে নিউয়র্কের মোমা মানে মিউজিয়াম অড মডার্ন আর্টস-এ একটা অনুষ্ঠান করছিলেন মারিনা। অনেকটা রিদম-এর মতোই, কিন্তু ফরম্যাটে সামান্য তফাত আছে। এতে মারিনা একটা চেয়ারে বসে থাকবেন, তার সামনে থাকবে একটা টেবিল। টেবিলের অপর প্রান্তে এসে বসত একটা অপরিচিত ব্যক্তি। দু'জনের মাঝে দুই মিটারের দূরত্ব। মারিনা অপলক তাকে দেখতেন যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি নিজেই উঠে যাচ্ছে। নিয়ম হল, কেউ কাউকে স্পর্শ করবে না, কেউ কথা বলবে না। নতুন কেউ আসার আগে মারিনা কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করতেন, তারপর আবার অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত নবাগন্তুকের চোখের দিকে। এই অনুষ্ঠান চলেছিল প্রায় চার মাস। সাড়ে সাতশো ঘণ্টা মারিনা কাটিয়েছিলেন এই চেয়ারে বসে। এই আর্ট প্রজেক্টের নাম ছিল -- 'দ্য আর্টিস্ট ইজ প্রেজেন্ট।"
সেইদিনও সব নিয়ম মতো চলছিল। একজন অতিথি উঠে চলে গিয়েছেন, মারিনা ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করেছেন। চোখ খুলে দেখেন, তার সামনে বসে আছেন উলে। কাঁচাপাকা দাড়ি, মুখে বলিরেখা। কিন্তু মারিনার চোখে সে সব অদৃশ্য। তিনি দেখছেন তার পুরোনো সঙ্গীকেই। ঠিক যেন বাইশ বছর আগের সেই চেহারা। উলের চোখে দুষ্টুমির হাসি। মারিনার মুখেও আবছা এক হাসির রেখা ফুটে উঠল, তার চোখ ভিজে গেছে। চোখের কোল থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে পড়বে করেও পড়েনি। সহসা প্রবল পেশাদার শিল্পী বলে খ্যাত মারিনা নিজের নিয়ম নিজেই ভুলে গেলেন, একটু ঝুঁকে উলের হাতটা জড়িয়ে ধরলেন তিনি। দু'জনের চোখের আড়ালে অনেক না বলা কথা। কিন্তু কেউই কথা বলছে না। বাইশ বছর পর দেড় মিনিটের জন্য পৃথিবীর মানুষ আবারও দেখল এই 'টু হেডেড বডি'-কে। এত বছরের দূরত্বও যাদের আলাদা করতে পারেনি।
এই দেড় মিনিটে ঠিক কী হল, সেটা বোঝানোর ক্ষমতা পৃথিবীর সেরা কলমের কাছেও নেই। ইচ্ছে হলে ভিডিওটা দেখে নিন।

উলে মারা গিয়েছেন ২০২০ সালে। শেষ জীবনে মারিনা তার সঙ্গেই থেকে গিয়েছিলেন।
কৃতজ্ঞতা:- বিবিসি ওয়ান, অশোক পান্ডে, গার্ডিয়ান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন