সৈকতদা মানে সাহিত্যিক সৈকত মুখোপাধ্যায় একটা পোস্ট দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে, তাতে একটা লোকের কথা ছিল। মাঝেমাঝে রাতের একান্তে বারান্দায় একা চেয়ার টেনে বসেন। কানে হেডফোন, দুই আঙুলের মধ্যে সিগারেট নিয়ে একটা গান শুনে যান... একটাই গান।
আজ যানে কি জীদ না করো...
সৈকতদার অনেক লেখা পড়েই মনের ভিতর আবেগী বাতাস উমড়ে আসে, মনে পড়ে যায় হারিয়ে যাওয়া কোনও স্মৃতি। কিন্তু এই পোস্টটা আমার কাছে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে রইল। কারণ, এই পোস্টটা পড়ার কিছুক্ষণ আগেই আমি আবিষ্কার করেছি, এই গানটার পিছনে থাকা অনেক কথা। এই গান, এই কম্পোজিশন তৈরি হওয়ার পিছনে দীর্ঘদিনের অপেক্ষা আছে, ঐশ্বরিক কোনও উপায়ে বহু মানুষের জীবনও জড়িয়ে গিয়েছে এই গানের সৃষ্টির সঙ্গে। ঘটনাগুলো হয়তো অনেকের কাছে গুরুত্ব পাবে না, কিন্তু যে দু'জন এই গানটাকে ম্যাজিকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, যাদের দৌলতে একজন মানুষ সারা জীবন এই একটা গান শুনেই কাটিয়ে দিতে পারে, সেই ফরিদা খানম আর ফাইয়াজ হাশমি যখন এই কথা বলেন, তখন অস্বীকার করার উপায় থাকে না।
ইতিহাসের একটা আশ্চর্য দিক হল, যতদিন না তুমি সেটা জানছ, সেটা তোমার কাছে নতুন বলেই মনে হয়। দিন কয়েক আগে আমি একটা হিন্দি বই পড়ে শেষ করেছি—রাজকুমার কেশওয়ানির লেখা 'কশকোল'—তাতে মন্টো সহ সে যুগের বহু আফসানা-গর, শায়র আর শিল্পীদের কথা আছে। বোম্বাইয়ের ফিল্ম জগতের কিছু কিছু প্রসঙ্গও এসেছে। ইন্টারেস্টিং বই। এমনিতেও প্রাক স্বাধীনতা যুগের শিল্পী সমাজ ও সিনেমা নিয়ে আমার খানিকটা আগ্রহ আছে, বিশেষ করে ১৯১০ সাল থেকে ১৯৫০-এর সময়টা... নানান চিত্তাকর্ষক কিসসা কাহিনি আছে, অনেক কিছু জানা যায়। তাই মাঝেমধ্যে সময় পেলে ইউটিউব আর স্পটিফাই নেড়েচেড়ে দেখি, যদি কিছু পাওয়া যায়। সেইদিন সন্ধ্যেবেলাও এই মতলবে ইউটিউব খুলেছি, পাকিস্তানের গায়ক আলি শেঠির সঙ্গে ফরিদা খানমের একটা পুরোনো ইন্টারভিউ দেখছি। দেখতে দেখতে মনে হল আমি স্ট্রেট একশো বছর পিছিয়ে গিয়েছি। আমার চোখের সামনে একটা সিনেমা চলছে। এই সিনেমায় প্রচুর চরিত্র আছে, তাদের অনেকের সঙ্গে আমাদের আলাপও আছে। ফরিদা খানম আর ফাইয়াজ হাশমিও আছেন, কিন্তু গল্প শুরু হয়েছে আরো আগে। বিংশ শতাব্দীর প্রায় গোড়ায়, কলকাতায়।
১৯০২ সালে মদন বলে একজন পারসি ভদ্রলোক ময়দানে বায়েস্কোপ দেখানোর ব্যবসা শুরু করেন। ট্রাভেলিং সিনেমার সে যুগে রমরমা ছিল, যদিও আধুনিক চলচ্চিত্র তৈরি হতে তখন অনেক দেরি। ময়দানে স্টেজও তৈরি করা হত, বিনোদনের জন্য গাইয়ে-বাজিয়েরাও থাকত। একদিকে সিনেমা, অন্যদিকে নাটক। কম্বো অফার। ভিড় উপচে পড়ত। বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবসায় কিছুটা আকাল পড়লেও পরে সেটা পুষিয়ে যায়। ১৯১৭ সালে 'রাজা হরিশচন্দ্র'-এর গল্পের উপর নির্ভর স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করে হইচই ফেলে দেয় তারা। ১৯১৯ সালে স্থাপনা করা হয় মদন থিয়েটার লিমিটেড। সেই সালেই তৈরি হয় বাংল ছবি 'বিল্লমঙ্গল', রিলিজ করা হয় কর্নওয়ালিস থিয়েটারে। পরের বছর আসে 'নল দময়ন্তী', তার পরের বছর 'ধ্রুব চরিত্র'। আশ্চর্যের কথা হল এই ছায়াছবিগুলো পরিচালনা করতেন বিদেশিরা। কেউ ইটালিয়ান, কেউ ব্রিটিশ। ইউজিনিও দে লিগুওরো তো ভারতীয় ছবি পরিচালনা করে কীসব পুরস্কার ফুরস্কারও পেয়েছেন। বাংলা নাটকের দুনিয়াতেও অগ্রসর হয় মদন থিয়েটার, বোম্বাইয়ের ভিক্টোরিয়া ফিল্ম কোম্পানিকেও কিনে নেয়। বর্মা, সিলোন আর লন্ডনেও তাদের সিনেমার প্রিন্ট রপ্তানি করা হয়। ক্রমে মদন থিয়েটারের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯২৩ সালে এই ফিল্ম কোম্পানির দায়িত্ব নেন জমশেদজি ফ্রামজি মদন ওরফে জে যে মদন। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যায়, সারা ভারতে মদন থিয়েটারের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। একশো সাতাশটা থিয়েটার নির্মাণ করেছে এই কোম্পানি, পাশাপাশি সারা ভারতের শিল্পী-অভিনেতা-গায়ক- চিত্রকর-লেখকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে।
মদন থিয়েটারকে কেন্দ্র করেই একটা গোটা বই লিখে ফেলা যায়, তার ঐতিহাসিক মূল্য বড় কম হবে না। কিন্তু এখানে সে নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ নেই। বরং আমরা এইবার গল্প এগিয়ে নিয়ে যাই। ফিরে আসি সেখানে, যেখান থেকে গল্প শুরু হয়েছিল। কলকাতায়।
একশো বছর আগের কলকাতা মানে শিল্পীদের স্বপ্নের জায়গা। একে তো কলকাতা ছিল সাহেবদের পছন্দের জায়গা, তারপর শিল্প-সঙ্গীতের সমঝদার এখানে কম ছিল না। আর ধ্রুপদ সঙ্গীতের দুনিয়ায় তো কলকাতার নাম রোশন অনেক আগে থেকেই। গৌহর জান সে যুগেও স্টেজ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন, মানদাসুন্দরী দাসীর কদরদানও কম নেই। মলিকা জান আর জোহরা বাই আগ্রা থেকে প্রোগ্রাম করতে আসছেন, বেনারস থেকে আসছেন হুসন জান, ওয়াজিরি জান... দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে শায়র, শিল্পী, কবি, লেখক, স্থপতি, গায়ক, বাজিয়ে, যাদুকররা ভিড় করছেন এখানে। সবাই জানে, শিল্পের পরখ করতে হলে, দর্শকদের চোখে নিজের প্রমাণ করতে হলে আসতে হবে কলকাতায়। একবার যদি কলকাতায় গুণী মহলে ইজ্জত মেলে, তাহলে আর কিছুই চাই না। (কিন্তু কলকাতা যত তাড়াতাড়ি শিল্পীকে মাথায় বসায়, ততই তাড়াতাড়ি তাদের বিস্মৃতির আঙিনায় ঠেলে দেয়। বহু প্রতিভাবান শিল্পী এই শহরে নিজেকে এস্ট্যাবলিশ করে শেষ জীবনে বিস্মৃতির গর্তে হারিয়ে গিয়েছেন। সে কথা এখন থাক।) মদন থিয়েটার আসার পর এই 'ক্রেজ' আরো বেড়ে উঠল। দলে দলে লোক আসতে শুরু করল কলকাতায়। বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সংস্কৃতির লোকজন এসে জুটল এই শহরে। কলকাতার কারিগরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠল পারসী বিজনেসম্যানদের, লাহোরের শায়রের সঙ্গে ভাব হল হিন্দুস্থানী গায়িকার, চিনা পাড়ার ডাক্তার আর ইহুদী বেকাররা জোট বাঁধলেন একসঙ্গে, উচ্চবিত্ত সমাজের চায়ের আসরে ঢুকে পড়ল কসমোপলিটান কেওস। কলহ ও বিবাদও হল, কিন্তু তাই বলে প্রেমালাপও কম হল না। ক্রস কালচারাল কনফারেন্সের এই সমারোহ যে ভবিষ্যতে কত কত গুণী মানুষকে পৃথিবীতে এনেছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ঠিক এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল আগা হশ্র কাশ্মিরী আর মুখতার বেগমের মধ্যে। আগা হশ্র কাশ্মিরী সে যুগে ভারতের শেক্সপিয়ার বলে জনপ্রিয় ছিলেন, পারসী নাটককে যে উচ্চতায় তিনি নিয়ে গিয়েছেন তার কোনো তুলনা হয় না। পাশাপাশি শেক্সপিয়ারের বহু নাটকের হিন্দি ও পারসী রূপান্তরণ করেছেন, লিখেছেন অজস্র শেরোশায়রী। প্রথমে বেনারস, তারপর বোম্বাইয়ে তার জীবন কাটলেও সারা ভারতে তিনি এক পরিচিত নাম। মন্টো, কৃশ্নচন্দর, ইসমত চুগতাই সহ অনেকেই তার প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, আগা সাহেবও অনুজদের স্নেহ করতেন প্রাণ দিয়ে। একবার কে যেন বলেছিল, সিনেমায় কাজ করে আর বোম্বাইতে থেকেও ভদ্রলোক শুধু উর্দুতে লেখেন কেন? উত্তরে আগা সাহেব হিন্দি লিখে ফেললেন এক নাটক, নাম দিলেন 'সীতা বনবাস'। এই নাটক প্রকাশ্যে আসতেই হইচই পড়ে গেল দর্শকদের মধ্যে। আগা সাহেব এ কী লিখেছেন? এই নাটকে রাম সেই সমস্ত জনতাকেই অভিযুক্ত করছেন, উল্টে প্রশ্ন করছেন যারা সীতার পবিত্রতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। আগা হশ্র কাশ্মিরী নির্বিকার।
অন্যদিকে মুখতার বেগম তখন প্রবল জনপ্রিয়। দাদরা, ঠুমরির পাশাপাশি গজল গায়েকিতেও তার খ্যাতি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মুখতার তখন ভাইবোনদের নিয়ে অমৃতসর থেকে কলকাতায় চলে এসেছেন, তাদের মুখ চেয়েই গজলের দিকে মনযোগী হয়েছেন। এতগুলো পেট চালাতে হবে, টাকা তো চাই! দর্শকদের রুচি বদলাচ্ছে, সিনেমার আকর্ষণ বেড়েছে, কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চাহিদা আগের চেয়ে কমেছে। জনপ্রিয়তা বেড়েছে গজলের। মুখতার এই বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন আগেই, কিন্তু তখন গজল খুব একটা গাইতেন না। কিন্তু এখন কলকাতার আয়োজকেরা গজলের অনুষ্ঠান করতেই ইচ্ছুক। আয়ও মন্দ নয়। মুখতার সারা দেশে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করতে লাগলেন, শ্রোতারা তার গলা শুনে সম্মোহিত হয়ে পড়ে। তাঁর কাছে একের পর এক ফিল্মের অফার আসছে, কিন্তু মুখতার বেগম কলকাতা ছেড়ে যাবেন না।
এমন সময় মদন থিয়েটার আগা হশ্র কাশ্মিরীর বোম্বাইয়ের থিয়েটার কোম্পানিকে কিনে নেন। ফলে আগাসাহেব কাজ নিয়ে আলোচনা করতে এসে উপস্থিত হন কলকাতায়। এখানে এসে তো তিনি তাজ্জব। এ এক আজব শহর! যত দেখেন, ততো চমকে যান। ঘুরে ঘুরে বেড়ান অলিগলিতে, মুশায়রা আর সঙ্গীতের মহফিলে। তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত এই শহরেও কম নেই। যেখানে যান, লোকজন ছেঁকে ধরেন। যেতে চাইলেই তারা বলে ওঠে, "জীদ মত কিজিয়ে আগাসাহেব। আজ আপ নেহি যা সকতে!"
এরকম ঘুরতে ঘুরতে একটা মেহফিলে আগা সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মুখতার বেগমের। ব্যাস! প্রথমে চাউনিতেই যে ইশক হল, সারা জীবন সেই ইশক তার পিছু ছাড়ল না। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে মুখতারকে ভালোবেসে ফেললেন আগাসাহেব, তার সমস্ত জীবন মুখতার বেগমের চারপাশে ঘুরতে লাগল। মুখতারের চেয়ে বয়সে প্রায় আঠাশ বছরের বড় ছিলেন আগাসাহেব, কিন্তু বয়সের ফারাক তাদের নিকাহে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মুখতার বুঝেছিলেন, এই মানুষটার মতো কেউই তাকে ভালোবাসতে পারবে না। আগাসাহেব নিকাহের আগে মুখতারের কাছে আসতেন, মুখতার তাকে যেতে দিতেন না। বার বার বলতেন, "আজ জানে কি জীদ না কিজিয়ে! আগাসাহেব ফিরতেন না, মুখতারের কোলে শুয়ে রাত কেটে যেত। প্রায় প্রতিদিন এই হত।
নিকাহের পর যখন তারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলেন, এই ভালোবাসা একটুও কমেনি। দুজনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে জিনিয়াস, কিন্তু বাড়িতে থাকার সময় সে কথা বোঝা যেত না। আগাসাহেব এমনিতে বেশ বদমেজাজি ছিলেন, কিন্তু মুখতারের সামনে তিনি শিশুর মতো হয়ে যেতেন। এমনকি মদের নেশাও ত্যাগ করেছিলেন সম্পূর্ণভাবে। মন্টো তাঁর স্মৃতিকথায় মজা করে লিখেছেন, " বুড়াপে কা ইশক কাতিল হোতা হ্যায়।" তাঁর ধারণা, মদ না ছাড়লে তিনি আরো বহুদিন বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকতেন। সে অন্য কথা।
এইবার কাহিনিতে প্রধান চরিত্রের প্রবেশ হবে। আর কেউ নয়, মুখতার বেগমের ছোট বোন ফরিদা খানম। ফরিদা মুখতারের সঙ্গেই থাকতেন আর গান গাওয়ায় তার সহজাত প্রতিভা ছিল। তারপর আগাসাহেব- মুখতার বেগমের বাড়িটাই তো সাহিত্য আর সঙ্গীতের তীর্থস্থান ছিল, সারা দেশের তাবড় তাবড় লেখক আর সঙ্গীতশিল্পীরা আসতেন সেখানে। এই কালচার কিছুটা তো প্রতিফলিত হবেই। হয়েওছিল। ফরিদা সাত বছরে পড়তে মুখতার বুঝলেন, অসামান্য গায়িকা হয়ে ওঠার সব গুণই ফরিদার আছে। একদিন বেগম আখতার বাড়িতে এসেছেন, ফরিদার গলা শুনে তো তিনি ফিদা হয়ে গেলেন। মুখতার বুঝলেন বেশি দেরি করা উচিত হবে না। তড়িঘড়ি তিনি বড়ে গুলাম আলির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ফরিদাকে গান শেখানোর জন্য। গুলাম আলি সাহেব শুনেটুনে বললেন, ফরিদার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক হবেন ওস্তাদ আশিক আলি খাঁ। আশিক অলি খাঁ তখন পটিয়ালা ঘরানার নামী গায়ক, বয়স খুব বেশি না হলেও তার চালচলন দরবেশের মতো। তার কাছেই ফরিদার সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হল।
ফরিদা খানমের কথা শুনে বোঝা যায়, কাজটা খুব সহজ হয়নি। ওস্তাদ আশিক আলি খাঁ বড্ড কঠিন শিক্ষক ছিলেন, গাফিলতি দেখলে বেতের বাড়িও খেতে হয়েছে। সাত বছরের ফরিদার যে কী করে এত কঠিন নিয়ম মেনে গান শেখা চালিয়ে গেছেন, সেটাই আশ্চর্য। প্রথমেই দাদরা, ঠুমরি আর খেয়ালে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। ভোরবেলায় ভৈরবীর অভ্যেস করতে হত, বিকেলে ভীমপলাশি। সুরে একচুল এদিক ওদিক হলেই বকা খেতে হত, যদিও পরে তাকে ডেকে আদর করে দিতেন ওস্তাদ সাহেব। ফরিদার ইচ্ছে করত অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলতে, ছুটোছুটি করতে, কিন্তু তার কোনও উপায় ছিল না। ফরিদা পরে বলেছেন তার গায়কির সমস্ত ক্রেডিত ওস্তাদ আশিক আলি খাঁয়ের। সঙ্গীত প্রতিভা থাকলেই হয় না, অনেক সাধনা, অনেক পরিশ্রম দিয়ে তাকে আয়ত্তে আনতে হয়। প্রতিভা হয়তো একটা দীঘির জল, কিন্তু সাধনা হল পাথর কেটে সেই জলকে নদীতে রুপান্তরিত করা। তাই হয়তো ফরিদা খানমের গায়েকি শুনলে মনে হয়, অবাধে জল বয়ে চলেছে নদী দিয়ে।
হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকে প্রধানত চারটে ধারায় বিভাজিত করা হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ( ধ্রুপদ, ধমার, খেয়াল), উপ-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ( ঠুমরি, কজরি, চৈতি, হোরি ইত্যাদি), সুগম সঙ্গীত ( গজল, ভজন, গীত ইত্যাদি) আর লোক সঙ্গীত। প্রতিটা ধারার নিজস্ব ইতিহাস আর ঐতিহ্য আছে, গায়ক আর কদরদানও কম নেই। ফরিদা যে কোনও ধারাতেই গাইতে পারতেন, কিন্তু শেষে তিনি বেছে নিয়েছিলেন গজলকেই। এর জন্য অবশ্য দায়ী মুখতার বেগম আর বেগম আখতার। এদের নিজের গান শুনে তিনি বড় হয়েছেন, তাছাড়া কলকাতায় থাকতে গজল গায়েকির সেরা শিল্পীদের শোনার ও দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিল তার। এমনিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বাদে অন্য ধারায় গায়েকির গুরুত্ব একটু একটু করে কমতে আসে, লিরিক্সের উপর নজর দেওয়া হয় বেশি। কিন্তু ফরিদা তার জীবনে এই মান্যতাকে চুরমার করে দিয়েছেন। গজল যে গায়েকি আর শায়রির যুগলবন্দি, একটা ছাড়া অন্যটা বাঁচে না, সেই কথাটা বারে বারে প্রমাণ করেছেন। ফারিদা খানম, বেগম আখতার, মেহদি হাসান, জগজীত সিং প্রভৃতি আর্টিস্টরা শব্দের ভিতর নিবদ্ধ ভাবটাকে আত্মস্থ করতে যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তাতে গজল গায়েকির চেহারাই পাল্টে গেছে। কিন্তু সে অনেক পরের কথা! তখনও ফরিদা গজল গায়িকা ফরিদা খানম হননি, বাচ্চা মেয়েটি তখন ওস্তাদজির কাছে সুরের সাধনা করে চলেছেন।
ফরিদা জানতেন না, তার জীবন কোনদিকে মোড় নিতে চলেছে। সঙ্গীত সাধনাতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন পুরোপুরি। এদিকে ১৯৩৫ সালে আগা হশ্র কাশ্মিরী মারা গিয়েছেন, মুখতার বেগম একা হয়ে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছেন। সুরের দুনিয়া অবশ্য থেমে নেই। বেগম আখতার 'কুইন অফ গজল'-এর শিরাপো পেয়ে গিয়েছেন, টকি সিনেমার যুগে ফিল্ম মিউজিকের জনপ্রিয়তা হুড়হুড় করে বাড়ছে। হলিউডের একটা স্টুডিওর সঙ্গে চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার ফলে মদন থিয়েটার দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে ১৯৩৭ সালে, তার জায়গায় জাঁকিয়ে বসেছে অন্যান্য কোম্পানি। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গিয়েছে বলে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। যুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন, আবার কেউ কেউ সর্বস্ব হারাচ্ছেন। তেতাল্লিশের মতন্ত্বরের পর কলকাতার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে, বম্বে ইন্ডাস্ট্রির রোশনাই তখনও নিভে যায়নি। কেউ জানত না, এর পর কী হতে চলেছে!
চার বছর পর ভারতের শিল্পী সমাজ উপলব্ধি করল, তাদের অনেকেই অস্তিত্বহীন অবস্থায় দেশছাড়া হয়েছেন। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব, শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি ছেড়ে তারা যেখানে এসে উঠেছেন, সেই জায়গাটাই নাকি তাদের নতুন দেশ! কিন্তু, এ কেমন দেশ? এই দেশের কিছুই তো তাদের চেনা নয়। ধর্মের বামে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নাম যে দুটো ভুখন্ড ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানকার বাসিন্দারদের কাছ থেকে স্বদেশ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দেশভাগের এই আগুন স্পর্শ করল ফরিদাকেও। অমৃতসর ছেড়ে আসার সময় মন খারাপ হলেও ধীরে ধীরে কলকাতাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন, কিন্তু এইবার লাহোর যাওয়ার সময়ে ফরিদার চোখ ফেটে জল এল। এ তো আর এক শহর থেকে অন্য শহর যাওয়া নয়, এতদিন যে জীবনটাকে নিয়ে সে বেঁচেছিল, সেটাকেই এখানে ফেলে রেখে যাচ্ছে সে। আর কোনোদিন কলকাতা বা অমৃতসরে কি ফিরতে পারবে সে?
ফরিদা পারেননি ফিরতে। মন্টোও না। একান্তে সারাজীবন স্মৃতিচারণা করে গেছেন। বহুদিন পর যখন পুরোনো বাড়ির খোঁজে ফিরে আসেন অমৃতসরের গলিতে, তখন তিনি আর ছোটটি নন। একা একা শহরে ঘুরে বেরিয়েছেন, নিভৃতে চোখের জল ফেলেছেন। কিন্তু হারানো সময় ফিরে আসে না।
পাকিস্তানে গিয়েও ফরিদার পরিবার প্রথমে থিতু হতে পারেনি। একটা ভয় তাদের তাড়া করে বেড়াত, বাড়ির ছেলেমেয়েরা দুঃস্বপ্ন দেখত। করাচি, পেশাওয়ার, রাওয়ালপিন্ডি হয়ে অবশেষ লাহোরে গিয়ে পড়লেন ফরিদা। সময় কাটতে লাগল। তখন তিনি পূর্ণ যুবতী। ছোটবেলায় আগাসাহেব আর মুখতার আপাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, তার নিজেরও একটা গোপন বাসনা ছিল, এমন একজন প্রেমিক পাবেন। যাকে আটকে রাখবেন, যাকে সঙ্গে করে হারিয়ে যাওয়া ঘরে ফিরবেন। যার কাছে আবদার করবেন। দিদির মতো করে বলবেন, "আজ জানে কী জীদ মত কিজিয়ে।"
একসময় বিয়ে হল ফরিদার। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বুঝে গেলেন, সব শৌহর আগাসাহেব নন। একঘেয়ে জীবন কাটতে লাগল। সংসারের কাজে গানের কথা ভুলেই গেলেন। রিয়াজও করতেন না। তখন মেহদি হসন আর ইকবাল বেগম গজলে নাম করতে শুরু করেছেন, কিন্তু ফরিদা তখনও আড়ালে। বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর করাচিতে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাকে জোর করে মঞ্চে তুলে দিলেন কয়েকজন। ফরিদা গাইলেন। মন উজাড় করে গাইলেন। শ্রোতারা শুনল। তাদের মুখে কথা নেই। গান শেষ হওয়ার পর অনেকক্ষণ কেউ কথা বলতে পারল না। তারপর হাততালির বন্যা বয়ে গেল।
এরপর থেকে ফরিদাকে রেহাই দেয়নি গজল। চাপে পড়ে একটু একটু করে রেডিও প্রোগ্রাম করতে শুরু করলেন। শায়র অতর নফীসের এই গজল দারুণ জনপ্রিয় হল...
"উও ইশক যো হমসে রুঠ গয়া অব উসকা হাল বাতায়ে
কোই মেহর নেহি, কোই কহর নেহি ফির সচ্চা শের শুনায়ে কেয়া!"
ধীরে ধীরে তিনি গজল গায়েকির পরিচিত চেহারা হয়ে উঠলেন। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি আসতে আসতে ফরিদা খানমের শ্রোতারা তাকে মন দিয়ে বসেছে। এমন সময় ফরিদার সঙ্গে আলাপ হল হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধুর। তার চেয়ে নয় বছর বড় একটি ছেলে, যে শৈশবে তাদের বাড়িতে আসত মাঝে মাঝে। তিনিও যেতেন। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ইনিই হলেন গল্পের দ্বিতীয় নায়ক শায়র ফাইয়াজ হাশমী।
ফাইয়াজ হাশমীর বাড়ি ছিল কলকাতায়। আর কলকাতার কোথায়? সেই আগা হশ্র কাশ্মিরীর বাড়ির ঠিক পাশে। যেখানে বুলবুলে পাঞ্জাব মুখতার বেগম রিয়াজ করতেন, ফরিদা কচি গলায় হাসত। বয়সে খানিকটা বড় হলেও তার সঙ্গে ফরিদার ভাব ছিল। আগাসাহেব আর আপার কিসসা তাকে গল্পের মতো করে বলতেন ছোট্ট ফরিদা। ফাইয়াজ কবি মন নিয়েই জন্মেছিলেন, সেই গল্প তার কিশোর মনে ঘর করে থাকত। এই স্মৃতিগুলোই পরে নজম হয়ে কাগজে ফুটে বেরিয়েছিল। হিন্দি ও উর্দু ফিল্ম জগতের বহু গায়ক ফাইয়াজ হাশমীর লিরিক্সে গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার অন্যতম হলেন একজন নায়কোচিত চেহারার যুবক, যার কাঁপা কাঁপা গলায় গান দেখে প্রথম প্রথম হাসির রোল উঠত। পরে সেই যুবক শ্রোতাদের হার্টথ্রব হয়ে ওঠেন। তার নাম তলত মেহমুদ।
কিন্তু ফাইয়াজ হাশমী আগা হশ্র কাশ্মিরীর লাগোয়া বাড়িতে থাকতেন কেন? দেখতে গেলে আগাসাহেব আর মুখতার সে যুগের টপ সেলেব, তাদের লাগোয়া বাড়ি কেনা সকলের কম্মো নয়। একেই বোধহয় কসমিক কানেকশন বলে। ফাইয়াজ হাশমীর বাবাও মদন থিয়েটারে কাজ করতেন, আগাসাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা থাকত তার। ফলে আগাসাহেবই বাসাটা ঠিক করে দিয়েছিলেন। দেশভাগের সময় ফরিদার মতো ফাইয়াজ হাশমীও ছিটকে যান তার শিকড় থেকে, চলে আসেন পাকিস্তানে। সিনেমার জগতের সঙ্গে সম্পর্ক কিন্তু ছিন্ন হয়নি, গানের কথা লিখে জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। কিন্তু ফাইয়াজ মনে মনে জানতেন, তার সেরা কাজ এখনও বাকি। একটা গান, যাতে তিনি নিজের গল্প বলে যাবেন। তার শৈশব, তার যৌবন, তার দেশভাগের হতাশা, তার আজীবন খুঁজে চলা 'ঘর'-এর প্রতীক হিসেবে এই গানটা রয়ে যাবে... কিন্তু তিনি যদি লেখেনও, কে গাইবে এই গান? কে বুঝবে শব্দের অন্তরালে থাকা সেই অব্যাক্ত কাহিনি? এমন তো কেউই নেই।
এমন সময় ফরিদার সঙ্গে ফাইয়াজ হাশমীর দেখা। ফরিদা দেখলেন, সেই কিশোর ছেলেটা আজ নামকরা শায়র। তিনি অবুঝের মতো যে সব কথা বলে যেতেন অনর্গল, ছেলেটা কাগজে লিখে রাখত সে সব কথা। ফাইয়াজ দেখলেন, তার অতীত জীবন্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সারাজীবন যা লিখেছেন, তার সূত্রপাত হয়তো হয়েছিল ফরিদার গল্প শুনেই। সেই কচি মেয়েটা এখন আর কচি নেই, তার সংসার আছে। আর আছে গান।
ফরিদার সঙ্গে গল্প হল, আড্ডা গড়াল বহুদূর। ফরিদা গান গেয়ে শোনালেন, ফাইয়াজ মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। ততক্ষণে তিনি বুঝে গেছেন, তার গায়িকাকে তিনি পেয়ে গেছেন। ফরিদাকে তিনি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন তক্ষুনি। তার জন্য একটা গান লিখবেন তিনি। একটা গজল। ফরিদাকে গাইতে হবে সেটা। কাগজে নতুন করে লেখা হবে ঠিকই, কিন্তু আসলে এই গজল অনেক আগেই লেখা হয়ে গেছে। ফরিদাও জানেন,ফাইয়াজও। ফরিদা শুনলেন কয়েকটা লাইন। তার চোখ বেয়ে জল নেমে এল।
১৯৭৩ সালে প্রকাশ্যে এল সেই গান। বাকিটা ইতিহাস।
"ওয়াক্ত কি ক্যায়েদ মে জিন্দেগী হ্যায় মগর,
চন্দ ঘড়িয়াঁ য়েহি হ্যায় জো আজাদ হ্যায়
ইনকো খো কে মেরি জাঁ
উম্র ভর না তরসতে রহো...
ফির ভি পেহলু মে ব্যায়ঠে রহো
আজ যানে কি জীদ না করো..."
এই সেই গান, যা লেখার আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। বেঁচে থাকার জন্য জরুরি একটাই গান, যা বার বার শুনে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়।