শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

"ইতনা ব্যাকুল নেহি হোনা হ্যায়!"

 


লেখকরা অনেকেই নিজেদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে। তাদের সাধনা ও সাহিত্যচর্চা যে একটা সময়ের ইতিহাসকে ধরে রাখছে, এই সাবকনশিয়াস সেন্টিমেন্ট প্রকাশ না পেলেও তাদের অবচেতনে লুকিয়ে থাকে। দেশ কাল ভাষা নির্বিশেষে এটা সত্যি, এবং স্বাভাবিকও বটে। আসলে ব্যতিক্রম বাদে ইনফাইনাইট টাইমলাইনে লেখকদের কদর বরাবরই কম, তাদের কেউ বিশেষ আমলও দেয় না (এমনকি একশ তিরিশ কোটির দেশে পেগাসাস সফটওয়্যার দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার সময়েও একটাও লেখককে টার্গেট করা হয়নি, লেখকদের লেখা বা বলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ নিজেরাই বুঝে দেখুন) তাই নিজেদের অত গুরুত্ব দেওয়ার কোনও মানেই নেই। আসল কথা হল জনপ্রিয়তা বাড়লে লেখার সংখ্যাও বাড়ে, পড়া হয় অনেক কম। হয়, কিন্তু সে পড়া লেখার জন্য পড়া, আনন্দে পড়ার স্বভাবটা ধীরে ধীরে কমে আসে।

কাল রবিশ কুমারের টাইমলাইনে সোমনাথ জুথসি সম্পর্কে কিছু কথা জানতে পারলাম। ভদ্রলোক যে কাশ্মিরী, ইংরেজি ও উর্দু সাহিত্য নিয়ে কাজ করেছেন, এই ওয়ান লাইনার ছাড়া আগে আমার কিছুই জানা ছিল না। পোস্টটা পড়ে কাল একটু খোঁজখবর করলাম। যত পড়ি, ততই বিস্ময় বাড়তে থাকে।

সোমনাথ জুথসির বাবা ছিলেন কাশ্মিরী, মা বাঙালি। কাশ্মীরের বাইরে তাঁর অনেকটা সময় কেটেছে বাংলাতেই, কলকাতার বাড়িতেই মারা যান। একইসঙ্গে লেখক, অনুবাদক ও নাট্যকার হিসেবে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, ভাষাগত দক্ষতা ও সাহিত্যিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেও তার কোনও জুড়ি ছিল না। প্রথম জীবনে সোমনাথনাবু কাশ্মীরের প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনে যুক্ত ছিলেন, তার লেখা ছোটগল্প 'ইয়ে ফুলগাশ' ভারতীয় সাহিত্য জগতে আলোরণ ফেলে দেয়। রাজেন্দ্র সিং বেদি, খ্বাজা আহমেদ আব্বাস, নবতেজ সিংদের সঙ্গে প্রায়ই আলোচনা হত তাঁর, বলরাজ সাহনী, এস রাজা আর অন্যান্য প্রগতিশীল লেখকদের সান্নিধ্যে দিন কাটতে থাকে। 'ভিজি ভাও' বলে লেখা তাঁর রেডিও ড্রামা শুনে প্রধানমন্ত্রী নেহরু নিজে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তী জীবনে ইবসেন, কাফকা ও গোগোলের অনুবাদ করেছেন। সোমনাথ হোড়, মৃণাল সেন আর বনফুলের অনেক বাংলা লেখাও অনুবাদ হয়েছে তাঁর কলম ধরেই, সেগুলো প্রকাশিত করেছে সিগাল বুকস।

কিন্তু অসামান্য প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সোমনাথ জুথসি তেমন ভাবে লেখালিখি করেননি, বরং এগিয়ে রেখেছিলেন তাঁর পাঠকসত্তাকে। তাঁর বাড়িতে হাজার হাজার বই। রবিশ কুমারের টাইমলাইন থেকে নেওয়া এই বইয়ের ছবিগুলো শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞানের। বিশ্বসাহিত্যে নিয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম। মার্কিন সাইবারপাঙ্কের কোন বইয়ের গল্পের সঙ্গে কোন পলিশ ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসের মিল আছে অথবা নব্য যুগের কোন চিলিয়ান লেখক রাশিয়ার কোন লেখকের স্টোরিটেলিং পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে তার কোনো বইয়ের দরকার হত না। ব্র‍্যাডবেরির কোন গল্পের দু' লাইনের উপর ভিত্তি করে বছর তিরিশ পর কোন দেশে একটা নাটক লেখা হয়েছে এবং তার গুরুত্ব ঠিক কোথায়, এ সব মনে করে শ্রোতাকে জানাতে ন্যানোসেকেন্ডেরও কম সময় নিতেন সোমনাথ জুথসি। এ তো হল কল্পবিজ্ঞান, অন্যান্য জনরাতেও তাঁর একই রকম আগ্রহ ও মেধা ছিল। সিনেমা, শিল্প, ইতিহাস, নাটক তো বটেই, ফিকশন আর নন ফিকশনের বিশাল সংগ্রহ ছিল তাঁর। অনেক দুর্লভ বই নাকি সিগাল বুকস তাঁর মৃত্যুর পর ছাড়সহ বিক্রি করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, এখনও সেই বই আছে কিনা জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।

সোমনাথবাবুর কথা জানতে পেরে আরো একবার উপলব্ধি হল, একজন লেখকের চেয়ে একজন পাঠকের মূল্য চিরকালই বেশি। কয়েক শতাব্দীতে কত লেখক এলেন, কালের নিয়মে চলেও গেলেন। তাদের লেখা নিয়ে চাপা অহংকার, লেখার ভাবনাচিন্তা, বিষয়বস্ত হাওয়া হয়ে গেল। যারা রয়ে গেলেন, তাঁদের বাঁচিয়ে রাখলেন পাঠকরাই। 

প্রার্থনা করি, লেখক না হই না সই, কোনও এক সময় যেন ভালো পাঠক হয়ে উঠতে পারি। আজকে থেকে নিজের জন্য একটা র‍্যাঞ্চো টাইপ বাণী বের করেছি। লেখা হোক না হোক, বই প্রচার পাক না পাক, পাঠক গালাগাল দিক না দিক, বই বিক্রি হোক না হোক, বুকে হাত দিয়ে বলে যাব। হয়তো কাজ করলেও করতে পারে। ( এই বাণীটাও ঝেড়েছি। কার কাছ থেকে সেটা আর বললাম না।)

"ইতনা ব্যাকুল নেহি হোনা হ্যায়!"







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন