রবিবার, ২ আগস্ট, ২০২০

'মগ- মোগল- পর্তুগিজ- ব্রিটিশ- ওলন্দাজ- বাঙালি' : এক ঐতিহাসিক ভুরাজনৈতিক উপন্যাস


আন্দালুসিয়ার শহরে একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে কয়েকটা বই নজরে পড়েছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের ভারতবর্ষে আসা নিয়ে লেখা, বিশেষত বাংলা ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের নানা দেশ আর রাজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করার কাহিনী। মুর রাজাদের জাহাজ ব্যবহার করে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা ভারতে পাড়ি দিয়েছিল, এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল জলদস্যু হিসেবে। স্বাভাবিকভাবেই বইগুলো ছিল স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষায় লেখা।

যাই হোক, বাংলার এই ইতিহাস নিয়ে স্পেনের দোকানে সারি সারি বই দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। সেই যুগের ইতিহাস ও পর্তুগিজ শাসকদের বাংলা ঔপনিবেশবাদ গড়ে তোলা নিয়ে বাংলায় খুব কম লেখাই চোখে পড়েছে। সমসাময়িক কালে এই প্রথম একটা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস এসে সেই জায়গাটা ভরাট করল।

‘পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর’ এক নিশ্বাসে পড়ে ওঠার জন্যে লেখা হয়নি। মগ, পর্তুগিজ, আরাকান, মোগলরা যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সেই সময়টাকে পুঙ্খানুুঙ্খভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন রাজর্ষি। বিভিন্ন চরিত্র ও বহুস্তরীয় দৃষ্টিকোণ ফুটে উঠেছে কাহিনীর আঁকেবাঁকে। নন লিনিয়ার ন্যারেটিভকে দক্ষ ভাবে ব্যবহার করেছেন লেখক, ফলে বিভিন্ন কাহিনীর মাঝে বুনে তোলা সূত্র জুড়ে গেছে একে অপরের সঙ্গে, সময়ের ফাটলগুলো ভরাট হয়ে গেছে সাবলীলভাবে।

লেখাটা পড়তে আমার বেশ সময় লেগেছে, তার প্রধান কারণ এর ব্যাপ্তি ও ডিটেইটিং। এই আখ্যানের ভাঁজে ভাঁজে সূক্ষ্ম কারুকাজ আছে, নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রতিটা পরিসর, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সামাজিক জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি। বস্তুত এই বিন্দুগুলো এই লেখার স্ট্রং পয়েন্ট, আগ্রহ থাকলে এই জায়গাগুলো দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায়, তথ্যের খুঁটিনাটি ও সত্যতা সম্পর্কে লেখক কতটা যত্নবান! রাজর্ষি কোথাও ভাষাকে অযথা জটিল করেননি, কিন্তু বিষয়বস্তুর স্পষ্টতা আর পরিবেশ তৈরি করার ক্ষমতা নিয়ে কোন কথা হবে না।

'পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর' কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যেতেই পারে, আবার সামাজিক অথবা প্রেমের উপন্যাস বললেও ভুল হবে না। এই বহুকৌণিক কাহিনীতে যেমন টিবাও, ভিশকু আর কাবালহোর মতন পর্তুগিজ দস্যু আছে, সেরকমই আছে নগেনের মত ভাগ্যান্বেষী বাঙালি, ধনী পরিবারের ছেলে শ্যামল, আধা ফিরিঙ্গি ওফেলিয়া। এমনকি জলার পেত্নী কর্পূর্মঞ্জরীও আছে। (এরকম বাস্তবভিত্তিক লিটারারি উপন্যাসে পেত্নী দেখে সত্যিই ভড়কে গিয়েছিলাম, ব্যাপারটা মেটাফর কি না বোঝার চেষ্টা করছি, ইতিমধ্যে আবিষ্কার করলাম এই অলৌকিক আখ্যান সহজ ভাবে জুড়ে গেছে মূল কাহিনীর সঙ্গে, কোথাও খাপছাড়া মনে হয়নি। সুতরাং সেই চিন্তায় অব্যাহতি দিলাম )

যাই হোক, আমার মতে, পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক উপন্যাস। আরো ভাল করে বলতে গেলে ভূরাজনৈতিক উপন্যাস। সপ্তদশ শতাব্দীতে জিও পলিটিকাল ফিকশন লেখা হত না নিশ্চয়ই, সে অর্থে এই কাহিনী বিরল। ক্ষমতা লাভ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্ক, যুদ্ধের পরিকল্পনা, স্ট্র্যাটেজিক ওয়ারফেয়ার, কূটনীতি, ধর্মবিশ্বাস ও প্রতিশোধ... সব মিশে গেছে এই কাহিনীতে। এখানে বলে রাখা ভাল, বইয়ের শেষের দিকে সামুদ্রিক ঝড় এবং নৌযুদ্ধের একটা সিকোয়েন্স আছে, এমন রুদ্ধশ্বাস এবং ডিটেইলড বর্ননা আমি কোনদিন পড়িনি মনে হয়। রান্নাবান্না হোক অথবা ভাষা, নৌবিদ্যা হোক অথবা আলাপচারিতার ভাষা - কোথাও কোন খুঁত নজরে পড়ল না।

শেষে বলি, চারিত্রিক বিশ্লেষণ না করলেও বোঝা যায়, এই গল্পে প্রতিটা চরিত্রের একটা যাত্রা আছে। এই যাত্রা একান্তভাবে ব্যক্তিগত, কিন্তু কাহিনীর মূলস্রোতের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে ঠিকই। জীবন প্রতিটা চরিত্রকে বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ফলে তারা প্রায় রক্তমাংসের চরিত্রের মতোই জীবন্ত বলে মনে হয়েছে। সাদা হাতি পেগু অথবা পেত্নী করপূর্মঞ্জরী ও ব্যতিক্রম নয়। এই ক্যারেকটার আর্ক এই উপন্যাসকে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে।

প্রায় তিনশ পাতার এই উপন্যাস আদতে আবহমান ইতিহাসের একটা জানলা ( ওয়ার্মহোল বলাটা কি বাড়াবাড়ি?)  যেখান থেকে খুব সহজেই চলে যাওয়া যায় চারশ বছর আগের একটা সময়ে। সচক্ষে দেখে আসা যায় সন্দ্বীপ, সেগ্রাম, রোসাঙ্গা অথবা চাটিগাঁকে। মগ মোগল পর্তুগিজ ব্রিটিশ ওলন্দাজ বাঙালিদের জীবন অনুভব করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না।

পাঠকদের কাছে কাম্য, বইটাকে সময় দেবেন। এই বই আপনার মনোযোগ দাবি করে। আমার বিশ্বাস, পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর আপনাদের হতাশ করবে না।

পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর
রাজর্ষি দাস ভৌমিক
সৃষ্টিসুখ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন