সোমবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১

দ্য আয়রনি অফ লিবার্টি


Charlie Chaplin

১৯১৮ সালের ছবি। চার্লি চ্যাপলিন ওয়াল স্ট্রিটের সাবট্রেজারি বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে লিবার্টি লোন বা লিবার্টি বন্ডের প্রচার চালাচ্ছেন। তখনও চ্যাপলিন নিজে সিনেমা পরিচালনা শুরু করেননি সেভাবে, দ্য কিড আসতে আরো তিন বছর বাকি। কিন্তু সিনেমায় তাঁর 'ট্র‍্যাম্প' অবতার ( ট্রাম্প নয় রে বাবা!) দেখে জনতা তাঁকে নায়কের আসনে বসিয়েছে ইতিমধ্যেই। আসল চ্যাপলিনকে কেউ না চিনলেও 'ট্র‍্যাম্প'-কে সারা দুনিয়ার লোক চেনে, তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছে। এমন সময় মার্কেটে এল লিবার্টি লোন। মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে এই ফিনান্সিয়াল বন্ড লঞ্চ করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই। উদ্দেশ্যে মিত্রশক্তি বা 'অ্যালাইড পাওয়ার্স' এর জন্য অতিরিক্ত অর্থের জোগান দেওয়া। কিন্তু সাধারণ মানুষ আর খামোখা সে নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন, কষ্ট করে সঞ্চিত অর্থ নিয়ে এই লিবার্টি বন্ড কিনতেই বা যাবে কেন? প্রথম দিকে কেউই গ্যাঁটের টাকা খরচ করে এই পেপার বন্ড কিনতে যায়নি। উপায়ান্তর না দেখে সরকার লিবার্টি লোন নিয়ে বিপুল প্রচার শুরু করে। দেশ জুড়ে মিডিয়া ক্যাম্পেন শুরু হয়, পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায় শহরের রাস্তা। লিবার্টি লোনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় দেশপ্রেম। বড় বড় স্লোগান পড়ে। 


"হামারে জাওয়ান সীমা পে লড় রহে হ্যায়! ইউ ক্যান সেভ দেম!"

"ইউ লেন্ড অ্যাজ দে ফাইট!"

"ইওর ডিউটি টু বাই লিবার্টি বন্ড। ইউ এস এ মিন্স ইউ সাবস্ক্রাইব অ্যাট ওয়ান্স!"


"বিট ব্যাক দ্য হুন উইথ লিবার্টি বন্ডস!"

টিপিকাল ন্যাশনালিস্ট স্টাইলের প্রচার। দেশপ্রেমের চাটনি মাখিয়েও অবশ্য লিবার্টি লোনের বিশেষ গ্রাহক পাওয়া যায়নি। এরপর সরকার নিয়োগ করে জনপ্রিয় অভিনেতা, নায়ক, গায়কদের। ডগলাস ফেয়ারব্যাংকস,  ম্যারি পিকফোর্ডদের নিয়ে তুমুল ক্যাম্পেন চালানো হয়, চ্যাপলিন 'দ্য বন্ড' বলে একটা দেশাত্মবোধক (এবং ভুলভাল ইনফরমেশনে ঠাসা, প্রোপাগাণ্ডা ফিল্ম বলাই ঠিক) তথ্যচিত্র নামিয়ে দেন। চার্লি চ্যাপলিনকে সামনে রেখে লিবার্টি লোনের মার্কেট বেশ ফুলেফেঁপে ওঠে। অনেকের কাছে চ্যাপলিন হয়ে ওঠেন ক্যাপিটালিস্ট আমেরিকার প্রতীক। 'ট্র‍্যাম্প' এর বেশে প্রচার করতে এসে ওয়াল স্ট্রিটে কত লোক হয়েছিল আর সেদিন ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে কী কী করা হয়েছিল সে সব আর বলে লাভ নেই।

কে জানত এই চ্যাপলিনকেই একদিন আমেরিকা থেকে নির্বাসিত করা হবে? দ্য কিড, দ্য উম্যান অফ প্যারিস, মডার্ন টাইমস, সিটিলাইটস... একের পর এক সিনেমাতে গরীবগুর্বো মানুষদের কথা বলে গিয়েছেন চ্যাপলিন, হিটলারকে নিয়ে স্যাটায়ার করতেও দু' বার ভাবেননি। দ্য গ্রেট ডিক্টেটর প্রকাশ্যে আসার পর জার্মানির রাজনৈতিক মহলে হইচই পড়ে গিয়েছিল, নাজি পার্টির জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। জার্মানিতে হলিউডে মাহাত্ম্য আগেও ছিল, হিটলার খোদ গোয়েলেসের সঙ্গে বসে গ্রেটা গার্বোর সিনেমা দেখেন মোহিত হয়ে, তিনি নাকি গার্বোর প্রেমেও পড়েছিলেন। গার্বোকে সরকারিভাবে নিমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন হিটলার জার্মানিতে আসার জন্য, গার্বো সরাসরি সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। পরে অবশ্য এই মহীয়সী মহিলা জানিয়েছিলেন, হিটলারের কথা শুনে জার্মানি গিয়ে তাঁকে হত্যা করে আসলেই ভালো হত। 

যাই হোক, চ্যাপলিন যে আসলে শোষিত বর্গের সমব্যাথী আর চোরা কমিউনিস্ট, সেই অভিযোগ তদন্ত করা শুরু করে এফবিআই। চারের দশকে একের পর এক ট্রায়ালে জড়িয়ে পড়েন তিনি, আমজনতার চোখে তাঁর ইমেজ কলুষিত করার সব চেষ্টাই চলছিল পুরোদমে। চ্যাপলিন সিভিল লিবার্টি আন্দোলনে শরিক ছিলেন কিন্তু নিজেকে কমিউনিস্ট বলতে তাঁর আপত্তি ছিল। বরং নিজেকে 'পিসমংগারার' বলতেন তিনি। 

আয়রনি আর কাকে বলে? ছিলেন ক্যাপিটালিস্ট আমেরিকার দেশপ্রেমের ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, হয়ে গেলেন কমিউনিস্ট কন্সপিরেসির অপরাধী! কেন যে সাধারণ মানুষের পক্ষ টেনে কথা বলতে গিয়েছিলেন?

লাভ কিছুই হয়নি। এফবিআই আর মার্কিন সরকারির বাড়াবাড়িতে আমেরিকা ছেড়ে সুইটজারল্যান্ড চলে যান চ্যাপলিন, যদিও তাঁর অধিকাংশ সম্পত্তিই রয়ে গিয়েছিল আমেরিকাতে। প্রায় চার দশক আমেরিকায় থেকেও এই বিপুল জনপ্রিয় অভিনেতা আমেরিকার নাগরিকতা পাননি। ইউরোপে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, কিন্তু আমেরিকায় আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ৮৮ বছর বয়সে সুইটজারল্যান্ডেই মারা যান তিনি।