ঘুম ভাঙে। স্বপ্ন হারিয়ে যায়। ভোর হয়। সূর্য ওঠে। আকাশের রং বদলায়। বেলা শেষে পাখিরা ঘরে ফেরে। সন্ধে নেমে আসে। দিন যায়...
১
দুর্গা,
আজ তিরিশ বছর হয়ে গেল। কিছুই তো বদলায়নি। সকাল থেকে সন্ধে। কাজের ব্যস্ততা, ছুটির দিন। আমি একরকমই আছি। সকালের এক কাপ চা, খবরের কাগজ, কয়েক পলক তাকিয়ে থাকা বাইরের দিকে, কয়েক পাতা লেখা। জীবন কেটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হয়তো ঘুম ভেঙে যায় রাত্রে। কখনও-সখনও দরজার ছিটকিনি বন্ধ করতে ভুলে যাই। কোনও-কোনোদিন চায়ে চিনি কম হয়ে যায়। নতুন কাগজ আনতে বলার কথা মনে থাকে না। মনে থাকে না জীবনের কত ছুটকো-ছাটকা ঘটনা। প্রথম দেখতে পাওয়া সমুদ্র, প্রথম লেখা কবিতা। স্কুলের প্রথম দিন। ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসছে বুঝি! বয়সের জন্যেই কি? কিন্তু এখনও তো সময় হয়নি। বিদায় নিতে দেরি আছে। তাহলে কি জীবনের খাতা থেকে পাতাগুলো নিজে-নিজেই মুছে যাচ্ছে?
থাক! সে চিন্তা আমার নেই। আজ সপ্তমী। চণ্ডীমণ্ডপে পুজো আরম্ভ হয়ে গেছে। গোঁসাইজ্যাঠা এবার ঠাকুর গড়তে পারেননি। বয়স হয়েছে। অত ধকল নিতে পারেন না। ওঁর মন খুব খারাপ। এতদিনের অভ্যেস। তিনি না থাকলে মনে হয় পুবণিগুদামের পুজো উঠেই যেত। কিন্তু কী আর করা? পুরনো গাছ। ছালবাকল তো খসে পড়বেই। আমাকেই দেখো না! তোমার মুখের আদলটাও মনে হয় আবছা হয়ে আসছে। কিন্তু জেদটা এখনও যায়নি। প্রতিবছরই ছেলেরা সাধাসাধি করে পুজোয় যেতে। যাই না। কোনোদিন যাব না। বলেই তো ছিলাম। কিছুই বদলায়নি। আজ তিরিশ বছর হয়ে গেল। শুধু মাঝে মাঝে তোমার নামের আয়নাটা ভেঙে যায়।
ইতি
সত্যচরণ
২
দুর্গা,
আজ অষ্টমী। তোর কথা বড্ড মনে পড়ছে। আগেরবার তো জামাইকে নিয়ে পুজোর সময়ে তুই এসেছিলি। প্রতিবার তো আসা সম্ভব নয় আমিও বুঝি। কিন্তু মনকে কি আটকানো যায় রে মা! অন্যান্য বার তো তাও আমি মূর্তি গড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এবার তো সেটাও নেই, বুড়ো হাতের জোর কমে গেছে যে! জানিস তো, আমি আর কিছুই পারি না। সারাবছর ছোটোখাটো কাজে আটকা পড়ে থাকলেও মনটা পড়ে থাকত পুজোর কয়েকটা দিনের জন্যে। আমাদের নগাঁওয়ের পুবণিগুদামের মাহাত্ম্য তো আসলে বজায় রেখেছে এই পুজোই। একমাত্র আমাদের গ্রামেই মায়ের মূর্তি তৈরি হত বেলে কাঠ দিয়ে, তৈরি করতেন লোকশিল্পী লেরেলবাবু। আর দশমীর দিন সেই মূর্তি ডুবিয়ে দেওয়া হত জলে। বেলে কাঠ তো জলে ডোবে না, তাই পাথর দিয়ে বেঁধে মাকে ডুবিয়ে দেওয়া হত বিসর্জনের সময়। সেই দেখে কাঁদতে থাকতেন লেরেলবাবু। প্রতিবার তিনি গ্রামের লোকের ওপর অভিমান করে চলে যেতেন গ্রাম ছেড়ে, কিন্তু ঠিক ফিরে আসতেন কয়েকদিন পর। তাই গাঁয়ের লোকেরা শেষমেশ ঠিক করল, বেলে কাঠের মূর্তি আর বিসর্জন দেওয়া হবে না। তার পরিবর্তে একটা কলাগাছ বিসর্জিত হবে। সেই একই মূর্তি রং করে পুজো করা হবে পরের বছর। তার সঙ্গে থাকবে মাটিতে গড়া মায়ের মূর্তি। সেই প্রথমবার। প্রায় সতের বছর আগের কথা। তার সঙ্গে বসে মূর্তি গড়া শিখেছিলাম। লেরেলবাবু একসময় চলে গেলেন। আমি নিলাম সেই দায়িত্ব। আজ সেই দায়ও নেমে গেল। জীবনটা বড়ো বেশি ফাঁকা মনে হচ্ছে। যখন মানুষের কোনও কাজ আচমকা শেষ হয়ে যায়, পিছনপানে চেয়ে মনটা উদাসীন হয়ে যায়। স্মৃতি আর বিষাদের কাতর হাসি লেগে থাকে ঠোঁটে। মন খারাপে বুকটা টনটন করে ওঠে। এইবার মূর্তি গড়েছে শানু মাঝির ছেলে বলাই। ছেলেটার বয়স কম, কিন্তু উত্সাহের অভাব নেই। পড়ালেখাও করে অবিনাশবাবুর ছোট স্কুলটায়। অবিনাশবাবুও সাহায্য করছেন খুব। ছেলেমেয়েগুলো চণ্ডীমণ্ডপে দুরন্তপনা করছে সারাদিন। অষ্টমীর অঞ্জলিও হয়ে গেল। পরের বছর পারলে আসিস। আমি আর কতদিন? এই পুবণিগুদামে কত ফুল ঝরে যাবে, শিউলি ফুলের গন্ধে মাখা কাঁচা রাস্তাটা নির্জনতার গন্ধ মেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে, কত ছেলেমেয়ে বড়ো হয়ে যাবে, সুখে দুঃখে পথ হাঁটবে জীবনের, শুধু আমি আর থাকব না। অথবা হয়তো থাকব, সন্ধে তারা হয়ে, বকুলগাছের গন্ধ হয়ে, আরতির ধুনোর সুবাস হয়ে। এর চেয়ে বেশি আর কী চাই। ভালোবাসা নিস।
ইতি
বাবা
সদানন্দ গোঁসাই
৩
দুর্গা,
আজ নবমী। তোমার কথা বারে বারে মনে পড়ে। কেন পড়ে? তার উত্তর তো জানা নেই। তবুও মনে পড়ে। তোমায় চিঠি লিখি। কেন লিখি? জানি চিঠিগুলো তুমি হাতে পাবে না, তবুও লিখি। হয়তো কৈশোরের স্মৃতি হাতছানি দেয় তোমার কথা ভাবলে। তোমার সঙ্গে কাটানো দিনগুলি সঙ্গে নিয়ে সংসার করি। ভালো আছি। তোমায় ছেড়ে, তোমায় নিয়ে, বাড়ি থেকে দূরে এসে। এই জায়গাটার নাম বোধহয় তোমাকে লিখিনি। লোকে বলে পুবণিগুদাম। কেউ কেউ কেয়ানপত্তিও বলে। কোলং নদী বয়ে গেছে পাশ দিয়ে। আজকাল আর ওই নদীতে বেশি জল থাকে না, তবুও ভালো লাগে। মায়া লাগে। ঠিক যেমন আমাদের নিজের বাড়ি দেখে মনে হয়। মনে পড়ে আমাদের শহরের বাড়ির কথা। তোমার কথা। আর একটা দিনের কথা। পাঁচ বছর আগেকার পুজো। সেদিনটাও নবমী ছিল। আগের দিন সারারাত বৃষ্টি হয়ে ভোরে অবশেষে থেমেছিল। রাত ফুরিয়ে এসেছিল। ভোরের নরম আলোর সূচনায় দেখতে পাওয়া গলির শেষে দাঁড়িয়ে থাকা হালকা কচি কলাপাতা রঙের বাড়িটা। গাড়িবারান্দায় ভিজে পাতার গালচে মাড়িয়ে উঠে যেতে হয় ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে। ছোটো একফালি বাগান। লতাপাতার ঝোপ, অর্কিড। শুকিয়ে যাওয়া কিছু পুরনো ফুলগাছ। দোতলা কাঠের বাড়ি। গোছানো নয়, আবার অগোছালোও বলাও যায় না। ভালো লাগার মতো বলতে গেলে কীই বা ছিল? কিন্তু তাও ভালো লাগত। মায়া লাগত। হয়তো ভুলই হবে, কিন্তু অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল যে! ভালোলাগার অভ্যেস, টেবিলের ওপর পরে থাকা একচিলতে রোদের, কাগজের ওপর রাখা কলমের খোলা খাপের, গানের সুর, বইয়ের আলমারি, নিজস্ব মনখারাপের অভ্যেস, বেঁচে থাকার অভ্যেস। সেদিন যেন আরও ভালো লাগছিল সব। তুমি এসেছিলে। বৃষ্টি থামেনি।
তুমি এগিয়ে গেছ। আমি থমকে গেছি। কখনও বা এলোমেলো পদক্ষেপে এগিয়ে গেছি মানুষের ভিড় ঠেলে। উষ্ণতার আশ্লেষের খোঁজে। বঞ্চিত হৃদয়ে নিজেকে সমবেদনা জানিয়েছি, তোমাকে দোষীও ঠাউরেছি বহুবার। কিন্তু অবশেষে ভুল ধরা পড়েছে। তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে তোমাকে নিচু করতে চাই না, কিন্তু মনে ভাবের উদ্রেক হলে তো বলতেই হবে। তাই লিখলাম। বেঁচে থাকার জন্যে মনে হয় অন্য কাউকেই দরকার হয় না, একমাত্র নিজেকে ছাড়া। আমি ছিলাম বলেই তুমি ছিলে, তুমি ছিলে বলে আমি ছিলাম না। দায়িত্বই ভাবো অথবা স্বার্থপরতা, নিজের সঙ্গে সম্পর্কটাই মনে হয় সবচেয়ে জরুরি। নিজেকে না জানলে অন্যকে জানবে কী করে? আজকাল সেই চেষ্টাই করছি। পুজোর কাজে মেতে আছি। স্কুলের পড়ুয়ারা, গোঁসাইজ্যাঠা, শানু মাঝি, বলাই। আরও একজনের কথা বলতে ইচ্ছে করে। সত্যকাকা। ভদ্রলোক বড়ো চাকুরে ছিলেন। তিরিশ বছর আগে স্ত্রীকে হারিয়েছেন নৌকাডুবিতে। শানু মাঝির কাছে শুনেছি, পুজোর সময়ে স্ত্রীকে নিয়ে গঞ্জের পুজো দেখতে যাচ্ছিলেন সত্যকাকা। হঠাৎ ঝড় ওঠে, নদীর জল তোলপাড় হয়ে বান আসে। নৌকো উলটে যায়। তাঁকে পাওয়া গেছিল, কাখৃগাঁও এলাকার নদীর চরে পড়ে থাকতে। স্ত্রীর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই থেকে ভদ্রলোক কোনোদিন কথা বলেননি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে থাকেন। কাজকর্ম করেন। নিজের মনে থাকেন। কিন্তু কথা বলেন না। আরেকটা কথা জানলাম কিছুদিন আগে, তিনি কোনোদিন দুর্গাপুজোয় আসেন না। শানু মাঝি বলল, তাঁর স্ত্রীর নামও নাকি দুর্গা ছিল। এমনটাও কি সম্ভব? এরকম করে কি জীবন কাটানো যায়? স্মৃতি এত অভিমানী কেন? তাকে আলিঙ্গন না করলে কি সে সঙ্গে থাকতে রাজি হয় না? আমি বুঝতে পারি না। নির্বাসন কার কাছ থেকে? যে চলে গেছে, না যে রয়ে গেছে! তুমি কি জানো?
ইতি
অবিনাশ
8
দূগ্গা ঠাকুর,
আজকে তো বিজয়া দশমী। তুমি আজকে চলে যাবে। আমার মন ভালো নেই। তোমার বেল কাঠের মূর্তিটাকে তো আমরা ভাসাই না, কিন্তু ওই যে ওই কলাগাছটাকে ভাসাই ‘দুর্গামাই কি জয়’ বলে, তখন আমার কান্না পেয়ে যায়। তাই আমি আজকে তোমার কাছে যাব না। আমাকে বাবা বলেছিল মন খারাপ না করতে, কিন্তু আমি কী করব? আমার তো তোমার ওখানে গেলেই বুকটা ভারী হয়ে যায়। তাই আমি তোমাকে মনে মনে চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি ঠিক বুঝতে পেরে যাবে। বলাইদাদা তোমার মূর্তি গড়েছে। তোমার ডান হাতটা আর সিংহটাকে তো আমিই রং করেছি। তুমি জানো দুগ্গা ঠাকুর, আমি পরের বছর স্কুলে ভর্তি হব। তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো, আমি যেন ভালো করে পড়াশুনা করতে পারি। আমাকে আর বলাইদাদাকে বাবা বলেছে, ভালো করে পড়লে আমাদের শহরের স্কুলে ভর্তি করে দেবে। কিন্তু আমি শহরের স্কুলে যেতে চাই না। আমার বাবা তো নৌকো চালায়, আমার তো মা নেই। আমি আর দাদা চলে গেলে বাবার কাছে কে থাকবে? জানো দুগ্গা ঠাকুর, বাবা না আজকাল কেমন কেমন করে। বাবার খুব শরীর খারাপ। রাত্তির বেলা ভালো করে ঘুমায় না। ঘুমের মধ্যে ছটফট করে। একেকদিন বিড়বিড় করে ঘুমের মধ্যে। একদিন আমি শুনলাম বাবা ঘুমের মধ্যে ভুলভাল বকছে, ‘দুগ্গা বোন, আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি ভুল কইরেছিলাম। তোর গয়না দেখে লোভ সামলাইতে পাইরিনি। তোরে বাঁচাইতে পাইরতাম, ইচ্ছে কইরে... সেই পাপেই আমার বৌডাও... মাফ কইরে দে!’ বাবা ছটফট করছিল ঠাকুর। আমি ভয় পেয়ে বলাইদাদাকে ডেকে এনেছিলাম। বলাইদাদা এসে জলের ঝাপটা দিতে বাবা জেগে উঠল, তারপর গুম মেরে বসে রইল। বাবাকে ভালো করে দাও ঠাকুর। আমার তো মা নেই। আমি তোমার কাছে মানত করলাম। বাবাকে ভালো করে দিলে পরের বছর তোমাকে আলাদা করে পুজো দিতে যাব গারামুরের মন্দিরে। আজকে আমার বন্ধুরা সবাই মেলায় গেছে। আমিও মেলায় যাব বিকেলবেলায়। বলাইদা আমাকে নিয়ে যাবে বলেছে। পরের বছর তুমি তাড়াতাড়ি এসো দুগ্গা ঠাকুর। আমি পরের বছর তোমার চোখে রং দেব। তখন তো আমি বড় হয়ে যাব, আমি শাড়ি পরে তোমায় পুজো দিতে যাব।
ইতি
দুর্গা
দুর্গারা বড়ো হয়ে যায়। অবিনাশরা বাঁচতে শেখে, গোঁসাই ঠাকুররা হারিয়ে যায়, সত্যবাবুরা স্মৃতি হাতড়ে বৃদ্ধ হন। পুবাণিগুদামে দুর্গা পুজো চলতে থাকে ....
ঘুম ভাঙে। স্বপ্ন হারিয়ে যায়। ভোর হয়। সূর্য ওঠে। আকাশের রং বদলায়। বেলা বয়ে যায়। পাখিরা ঘরে ফেরে। সন্ধে নেমে আসে। দিন যায়। জীবন গড়িয়ে চলে। শরতের গন্ধ ফের ফিরে আসে হাওয়ায়। আবার বেজে ওঠে ঢাকের বোল । নীল মেঘ, কাশবন, ছেলেবেলা আর কৈশোরের স্বপ্ন নিয়ে দুর্গা ফিরে আসে বারবার।