মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ, ২০১৮

এডিনব্রার (এডিনবার্গ) কয়েকটা দিন


Related image
Edinburgh 

আগে থেকেই মনস্থির করে রেখেছিলাম, লন্ডন সফরে যখন এসেছি,স্কটল্যান্ডে গিয়ে হামলা করবই।মনমাতানো সিনারি, এডিনব্রার ইতিহাস,হাইল্যান্ডস এর লোককথা, লকনেস এর নেসি জলদৈত্য রহস্য,স্কটল্যান্ড না গেলে চলবে না। অতএব ধুমধাড়াক্কা টিকিট বুক করে ফেললাম লন্ডন থেকে এডিনব্রার। যাওয়া আসা একসঙ্গে করলে বেশ খানিকটা সস্তা পড়ে।আগে ভেবেছিলাম ট্রেনেই যাবো।সাঁ করে পৌঁছে যাবো ঘন্টা চারেকের মধ্যে।বিদেশে দূরপাল্লার হাইস্পীড ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা এখনো হয়নি। তারপর টিকিট কিনতে গিয়ে দেখি সস্তার সব টিকিট বুক হয়ে গেছে। এখানে সব  জায়গাতেই ভেরিয়েবল টিকিট সিস্টেম,আগে থেকে কিনে রাখলে টিকিট সস্তা পড়ে। এই ধরুন আমি পুজোর সময় একটা ব্যাঙ্গালোরে থেকে কলকাতা যাওয়া আসার টিকিট কেটে রাখলাম,তাহলে সেই মাসে যখন ইচ্ছে একবারের জন্যে আমি যাওয়া আসা করতেই পারি।টিকিটের দাম পড়লো মাথাপিছু হাজার টাকা।কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে সেই টিকিট হয়ে উঠবে দশ হাজার টাকা।না,বেশি হিসেব করবেন না।আমাদের দেশে এই জিনিস চলা মুশকিল কেননা আমাদের সব মাসেই সব সিট ভর্তি থাকে।ওখানে সারা বছর ট্রেন বারআনা ফাঁকাই যায়।এখানে দুর্গাপুজোর রিটার্ন টিকিট দিলে দেখবেন সিট আছে চারশ,টিকিট বিক্রি হয়েছে চার লক্ষ্য।তাই সেই আশা করে লাভ নেই।এডিনবার্গের যাওয়া আসার ওপেন রিটার্ন টিকিট ১৭০ পাউন্ড দেখে সুড়সুড় করে মেগাবাস থেকে চোদ্দ পাউন্ড মাথাপিছু যাওয়া আসার টিকিট কেটে ফেললাম।

ইউরোপে যাচ্ছেন।কিন্তু পকেট গড়ের মাঠ।চেপেচুপে তিন বছর ধরে টাকা জমিয়েছেন অথচ লিস্টিতে একগাদা শহর।ঘাবড়াবেন না।ব্যাগপ্যাকিঙ কথাটা এমনি এমনি আরম্ভ হয়নি।সব জিনিসের জোগাড় আছে।মেগাবাস নামটা মুখস্থ করে নিন।একশোর বেশি শহরে চলে এই প্রচন্ড সস্তা অথচ আরামদায়ক ক্রস কান্ট্রি বাস।টিকিটের দাম শুনলে ভিরমি খাবেন।না না,বেশি নয়,কম বলে।ভাবুন ২০০ কিলোমিটার যাচ্ছেন,দাম পড়লো ২ পাউন্ড।১৬০ টাকায় ২০০ কিলোমিটার যাওয়া ভারতেও সম্ভব নয়।লন্ডন থেকে এডিনবার্গ চোদ্দ পাউন্ড।প্রায় নয় ঘন্টার পথ।বিরাট বিরাট কাঁচের জানলা সহ আরামদায়ক ব্যবস্থা,গড়িয়েও নেওয়া যায়।বাথরুম ও আছে।ব্যাস,আর কি চাই।  

অতএব একদিন সকালে বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে টাকডুমাডুম করতে করতে বেরিয়ে পড়লাম।ভিক্টরিয়া কোচ স্টেশন থেকে দুরপাল্লার সব বাস ছাড়ে।আমরা ন্যালাভোলা টাইপ এদিক সেদিক চক্কর কেটে শেষ মেশ যখন বাসের কাছে পৌঁছলাম,বাস ছাড়বে ছাড়বে করছে।ঘড়িতে বাজে নটা।রুকস্যাক ভিতরে রেখে বিশাল জানলার কাছে গিয়ে সীট কব্জা করে ফেললাম।সর্বসাকুল্যে ছয়জন।রাস্তায় নিশ্চয়ই উঠবে।বাস রওনা দিলো। 

এডিনবার্গ  যুক্তরাজ্যের অনেকটাই উত্তরে।তাই সেখানে যে ঠান্ডা ভালোই হবে সেটা আগেই জানা ছিল।ইয়র্কশায়ার আর নিউক্যাসেল এর ম ভালো করা সবুজের প্রলেপ দেখে আমরা এগিয়ে চলেছি আরো উত্তরে।পথে উঁচু নিচু সবুজ ভেলভেটের কাশ্মীরি শাল যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে।মাঝে মাঝে আসছে ছোট ছোট শহর,গ্রাম,ভেড়ার পাল চরছে।ক্যালেন্ডারের দৃশ্য যে শুধু কল্পনার উদ্রেক নয়,ছবির মত একলা কয়েকটা ছিমছিমে কটেজ দেখে বোঝা যায়।গ্রাম নেই,শহর নেই,দিগন্ত প্রসারিত প্রকৃতির মধ্যে ছোট ছোট কাঠের বাংলোয় থাকছে কয়েকজন।নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি আর লাইব্রেরি দেখে চোখ কপালে উঠেছিল।ব্যস্ত ছাত্র ছাত্রীর দল হাতে কফিকাপ হাতে লাইব্রেরিতে ঢুকছে,বেরোচ্ছে। দুপুরের রোদ পড়ে এসেছে।গুগল ম্যাপে দেখে বুঝতে পারলাম যে স্কটল্যান্ডে ঢুকে গেছি।সীমানা বলতে একটা  নদী।চোখে খানিকটা তফাৎ ধরা পড়লো খানিকটা।প্রকৃতি এখানে আরো সুন্দর,কিন্তু কিছুটা এলোমেলো।সেই সাজিয়ে রাখা ল্যান্ডস্কেপ পরিণত হয়েছে স্কটিশ মেজাজ ছড়ানো তৃণভূমিতে।ততক্ষণে ছোট ছোট গ্রাম ছাড়িয়ে আমরা পৌঁছে গেছি নর্থ সির কাছে।রাস্তার একদিকে সমুদ্র,অন্যদিকে দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন খানিক পর পরই।এই সমুদ্র  আমাদের চেনা নয়,কেননা প্রায় বেলাভূমি বলে কিছু নেই।হাজারফুট ক্লিফের গায়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে অসমান জলরাশি।গাঢ় নীল রঙের সেই সমুদ্র কখনো আমাদের কাছে চলে আসছে,আবার কখনো দূরে সরে যাচ্ছে।এই সমুদ্রের ঐদিকে নরওয়ে। রাস্তা এঁকে বেঁকে চলেছে সামনের দিকে।সূর্যের পড়ন্ত আলোয় হঠাৎ দেখতে পেলাম দূরে পর্বতশ্রেণী।এডিনবার্গ বেশি দূরে নয়।ঘন্টাখানেক পথ বাকি।,কিন্তু আসল ম্যাজিকটা তখন বাকি ছিল।ছোট ছোট কয়েকটা শহর পেরিয়ে সমুদ্রকে ডানদিকে রেখে এগিয়ে চললাম স্কটল্যান্ডের ভিতর দিয়ে।এরপর বাসটা বাঁদিকে ঘুরতেই বুঝতে পারলাম,সামনের পাহাড়টায় বরফ চকচক করছে।কিন্তু এতো কম উচ্চতায় বরফ এলো কি করে,তারপর চট করে মনে পড়ে গেল।ও হরি,উচ্চতায় কি আসে যায়,আর্কটিক রেখার লাইনে পৌঁছে গেছি প্রায়।এখানে তো বরফ পড়বেই।এমনিতেও শুনেছিলাম হাড়কাঁপানো ঠান্ডা পড়েছে স্কটল্যান্ডে।সূর্যের নিভে যাওয়া আলো তখন খেলা শুরু করেছে তুষারাবৃত পাহাড়শ্রেণীর সঙ্গে।আকাশের রং দেখে বাসের লোকেরা ক্যামেরা হাতে লাফালাফি শুরু করেছে।পাহাড়টা আরো সামনে এগিয়ে আসছে আমাদের।খানিকপরেই অন্ধকার হয়ে যাবে।আমি শেষমেশ বুঝে গেছি এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা আমার মতো আনাড়ির কাজ নয়,একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যামেরা পকেটস্থ করে তাকিয়ে থাকলাম সামনের দিকে। 

এডিনবার্গ আসতে আরো মিনিট পনেরো লাগলো।লন্ডনের মত লাইটের জাঁকজমক নেই,দোকানের আধিক্য নেই কিন্তু একটা মায়াময়তা জড়িয়ে আছে সারা সন্ধ্যে জুড়ে।বাস থেকে নেমে বোচকাবুঁচকি কাঁধে ফেলে বাইরে আসতেই হাড় হি হয়ে গেলো।ভয়ে নয়,ঠান্ডায়।কি ঠান্ডা রে বাবা।

হোটেলে যাওয়ার টাকা নেই,ইচ্ছেও ছিল না।পাকা ব্যাগপ্যাকারের মতো সেন্ট ক্রিস্টোফার ইন হোস্টেলে ডরমিটরি বুক করে রেখেছি।যতদূর মনে আছে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পৌঁছে যাবো।কিন্তু শীতের চোটে লেজ গুটিয়ে আবার বাস টার্মিনাসে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে।কিন্তু সঙ্গে একজন থাকলে কি ওইসব ভাবনা দেখাতে আছে?তাই বুক চিতিয়ে বললাম,"ধুৎ! এ আর কি শীত?আমি তো ভেবেছিলাম ভালো ঠান্ডাই হবে।"এই বলে পিঠে বোঁচকা নিয়ে এগোতে লাগলাম ওয়েভারলি স্টেশনের দিকে।স্টেশনের সামনে দিয়ে হেঁটে ব্রিজ ক্রস করে বাঁ দিকে গেলেই রাস্তার ওপরে জনপ্রিয় হোস্টেল সেন্ট ক্রিস্টোফার ইন।

St. Christopher Inn Hostel

সারা ইউরোপে এদের শাখা আছে।ডরমিটরি মাথা পিছু দশ থেকে পনেরো পাউন্ড।হোস্টেলওয়ার্ল্ড থেকে বুক না করে হোস্টেলের নিজস্ব সাইট থেকে বুক করলে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট পাওয়া যায়।বেশ জমজমাট বার আর রেস্টুরেন্ট আছে নিজেদের।

Hostel Bar
হুল্লোড় মাঝেমাঝেই সারারাত চলে।সকার এর ম্যাচ টিভি তে হলে তো কথাই নেই।ভিতরে এসে বেশ স্বস্তি হলো।বাইরে হাড়কাঁপানো হাওয়া থেকে মুক্তি।পাঁচতলায় পৌঁছে নিজেদের নির্দিষ্ট বেড খুঁজে জিনিসপত্র ডাম্প করেই বেরিয়ে পড়লাম।এর মাঝে অবশ্য নানা দেশের নানা ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে।টাকা বাঁচাতে বেশিরভাগ লোকেই সুপারস্টোর থেকে খাবার কিনে হোস্টেলে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নেয়।কেটলিতে চা করে নেওয়া যায়।ফ্রিজ আছে,সেখানে জিনিসপত্র রাখা।(আপনার রাখা কেক অন্য কেউ খেয়ে নিতেই পারে।সবাই তো ধোয়া তুলসীপাতা নয়।আবার আপনিও অন্যের হ্যামে কামড় বসাতে পারেন।বেশি বাছবিচার থাকলে হোস্টেলে না এসে হোটেলে থাকবেন।)

শীতের দেশের নিয়ম মেনে গলার চারদিকে মাফলার জড়িয়ে পুরো শার্লক সেজে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।ঠান্ডা তো এডিনব্রাতে পড়বেই।তা বলে কি  আর হাঁটতে বেরবো না?হোটেলের পাশেই রাস্তা চলে গেছে "দ্য রয়েল মাইল" এর।
The Royal Mile

বিশ্ববিখ্যাত এই রয়েল মাইল চলে গেছে কাসল রকের ওপর অবস্থিত এডিনবার্গ ক্যাসল থেকে হলিরুড প্যালেস অব্দি।মনে রাখতে হবে এই মাইল হলো স্কট মাইল,তাই এই মাইলের চেয়ে এর দূরত্ব বেশি।
The Royal Mile

ওল্ড টাউনের নানান নির্দেশন আর ইতিহাস অনুভব করতে হলে এই রাস্তায় হাঁটাই যথেষ্ট।রাস্তার দুপাশে গথিক স্ট্রাকচারের ছড়াছড়ি,তার মধ্যে জগমগ  করা দোকানপাট,হুইস্কি শপ,ক্যাফে,রেস্টুরেন্ট আর বাস্কারদের দল।
Whisky Shops around Royal Mile

বাস্কার অর্থাৎ যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পারফর্ম করে লোকেদের জন্যে।আমরা আমল না দিলেও ইউরোপে বাস্কিং একটা আর্টের পর্যায় চলে গেছে।

অন্ধকার হয়ে গেছিলো।শীতের মধ্যে দুধারের ভিক্টরিয়ান স্ট্রিট ল্যাম্প গুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।আটটার পরে এখানে অনেক দোকানই বন্ধ হয়ে যায়।সেই হুড়মুড়ি ভাব নেই,লোকজন কমে এসেছে।পাঁচ মিনিটে রয়েল মাইল আমাদের বুঝিয়ে দিলো,এটা লন্ডন না,এডিনবার্গ।এখানে ইতিহাস রাত্রে জীবন্ত হয়ে ওঠে।"গোস্ট ওয়াক" চলছে চারিদিকে।একসময় এখানে উইচক্রাফট নিয়ে নানা ঘটনা হয়েছে।জাদুবিদ্যা,ভূত প্রেত ডাইনি নিয়ে কত কথাই যে আছে স্কটল্যান্ডের ইতিহাসে তার ইয়ত্তা নেই।হ্যারি পটারের বইও জে কে রাউলিং লিখেছেন এই রয়েল মাইলের কাছে "দ্য এলিফ্যান্ট হাউস" ক্যাফে তে বসে।ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় যেন উইজার্ডদের দেশে এসে পড়েছি।নাক বরাবর এগিয়ে গেলাম কাস্টারলি রকের দিকে।রাতে ক্যাসল বন্ধ থাকবে ঠিকই কিন্তু সামনের চত্ত্বর থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়।

ক্যাসলের সামনে এসে যথারীতি মুখে তালা লেগে গেলো।আমরা যে ঠিক কোথায় আছি তার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে।এডিনবার্গ শহরের ওল্ড টাউন আর নিউ টাউন এর আলোগুলো দেখা যাচ্ছে,আর দূরে আভাস পাওয়া যাচ্ছে সেই পাহাড়ের যা আসার সময় আমরা পিছনে ফেলে এসেছি।

ঠান্ডা ক্রমশই বাড়ছে।গুটি গুটি পায়ে রয়েল মাইল হয়েই ফিরে চললাম হোস্টেলের দিকে।কালকে আমরা এডিনবার্গ চষে ফেলবো।ঈশ্বর অসীম সহায়,প্রতি শহরে আমাদের মতো হাড়হাভাতাদের জন্যে ফ্রি ওয়াক এর ব্যবস্থা রেখেছেন।জয় স্যান্ডম্যান ট্যুরের জয়।বেশিদিন সময় নেই।ইনভার্নেস আর হাইল্যান্ডস ঘুরে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি।হোস্টেলে ফিরে চিকেন স্যালাড আর স্যান্ডউইচ খেয়ে বিছানায় বডি ফেলতেই ঘুম। 

Related image
St. Giles Church
-------------------------------------------------------------------------------
১৬৩৮ সাল।স্কটল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় বছর।এই বছরেই স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা পাস করেছিল ন্যাশনাল কোভেন্যান্ট।স্বাধীনচেতা স্কটরা চার্চের ওপর রাজার আধিপত্য কোনদিনই ভালো ভাবে নেয়নি।নতুন স্বাক্ষরপত্রে তারা বলে যে চার্চের প্রধান শুধু ক্রাইস্ট,দেশের রাজা নয়।বাইবেলের কথাই শেষ কথা,রাজার তাতে মত থাক বা না থাক।হাজার হাজার লোকে সই করেছিল এই রেফারেন্ডামে।কিন্তু কয়েক বছর পরেই চরম অব্যবস্থা শুরু হল।বাইবেল সঙ্গে রাখা বা নিজেকে ক্রিশ্চান বললে শাস্তি পেতে হবে(আরো অনেক জটিলতা ছিল।সেগুলো আর লিখলাম না)।রাজার কথাই শেষ কথা।কিন্তু কোভেনান্টর্সরা এই অত্যাচার মেনে নিলো না।শুরু হলো বিদ্রোহ।১৮৬১ থেকে ১৮৮৮ স্কটল্যান্ডের ইতিহাসের কিলিং টাইম। প্রায় ১৮০০০ ক্রিশ্চানের মুণ্ডচ্ছেদ করা হয় গ্রাসমার্কেট এলাকায়।যে বাজারে ঘোড়া ও ঘাসের সওদা চলছিল একশো বছরেরও বেশি ধরে,লোকেদের বিশ্রাম ও আমোদের জায়গা ছিল যে চত্ত্বর,সেখানে শোনা যেতে লাগলো বিভীষিকাময় আর্তনাদ।শয়ে শয়ে লোককে ক্রীতদাস বানিয়ে চালান করে দেওয়া হলো জাহাজে করে।

আমরা সকালে রয়াল মাইল থেকে হেঁটে এগোচ্ছিলাম গ্রাসমার্কেটের দিকে।হাড়কাঁপানো ঠান্ডা,তাই বলে লোকেদের ভিড় কম নয়।দূরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এডিনব্রা ফোর্ট।পাশের গোলকধাঁধা গলিগুলোর ভিতর থেকে ভেসে আসছে ব্যাগপাইপারের সুর।আমাদের স্যান্ডমান ট্যুরের গাইড হলো জেন।তাকে পেয়ে আমরা হাতে চাঁদ পেয়েছি।তার মুখেই শুনছি এখানকার চমকপ্রদ ইতিহাস।কত যুদ্ধ করে যে গণতন্ত্র আদায় করতে হয়েছে তার একটার পর একটা কাহিনী আর স্মারক চিহ্নগুলো ছড়িয়ে আছে আমাদের সামনে।গেলিক ভাষায় আগে ডান ইডন বলা হতো এডিনব্রাকে।প্রায় হাজার বছর আগে নানা গেলিক রাজ্য আর হাইল্যান্ডস যুক্ত করে স্কটল্যান্ডের পত্তন করে।আসলে ভাইকিং আক্রমণ এটি ধারালো হয়ে উঠেছিল যে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে এই ছোট স্কট রাজ্যগুলোকে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইংল্যান্ড স্কটল্যান্ডের দখল নিতে উঠেপড়ে লাগে।একের পর এক যুদ্ধ চলেছে এখানে।স্কট যোদ্ধা উইলিয়াম ওয়ালেসের ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের কথা তো "ব্রেভহাৰ্ট " সিনেমার সূত্রে সকলেরই জানা।যুদ্ধ,গৃহযুদ্ধ আর প্লেগে একসময় এডিনব্রা বসবাসের যোগ্য ছিল না।১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড সন্ধি করে এডিনব্রার সৎকার শুরু করে।যুক্তরাজ্যের অধীনে থাকলেও স্কটদের নিজেদের চার্চ আর নীতিব্যবস্থা আছে।আমরা হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলাম সেন্ট গাইলস চার্চ,ট্রন কির্ক,ব্যারি ক্লোস,ওল্ড ফিসমার্কেট,রাইটার মিউজিয়াম নানানা জায়গা।কি ছেড়ে কি দেখবো বুঝতে পারছি না।প্রায় দুহাজার বছরের ইতিহাস যদি চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে যায় তাহলে এরকম মনে হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।একদিকে চলেছে পৃথিবীবিখ্যাত লেখকদের গল্প,রবার্ট লুইস স্টিভেনসন,গ্রাহামে,স্পার্ক,রাউলিং,আর্থার কোনান ডয়েল,ওয়াল্টার স্কট অন্যদিকে স্কট আর গেলিকদের যুদ্ধের ইতিহাস।
Writer Museum
চার্চের  আধিপত্যের কাহিনীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে এডিনবার্গের রহস্যময়ী জাদুবিদ্যা,উইচ আর ঘোস্টক্রাফট এর গল্প। 
Edinburgh’s Royal Mile
David Hume
ততক্ষণে আমরা পৌঁছে গেছি বিখ্যাত স্কট পন্ডিত ডেভিড হিউমের প্রতিমার কাছে।ডেভিড হিউমকে এখানকার লোকেরা এটি শ্রদ্ধা করে যে রয়াল মাইল দিয়ে হাঁটলে দেখা যাবে পথচলতি লোকেরা তার বুড়ো আঙ্গুল ছুঁয়ে যাচ্ছে।এতে নাকি তার মতন বুদ্ধি হয়।তারই কথায় : 'All the perceptions of the human mind resolve themselves into two distinct kinds, which I shall call IMPRESSIONS and IDEAS." হেন্ সাবজেক্ট নেই যা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি। আমি অবশ্য আমার বুদ্ধি বাড়িয়ে নিতে অনিচ্ছুক,কিন্তু তা সত্ত্বেও বুড়ো আঙ্গুল ধরে একটু আশীর্বাদ নিতে খারাপ লাগলো না। 


Greyfriars-bobby-edin.jpg
Greyfriars Bobby

তারপরে একে একে ক্যাননগেট চার্চ(এডম স্মিথ থেকে শুরু করে রবার্ট ফার্গুসন,নানা মনীষীর কবর আছে এখানে),ক্যানোনবল হাউস(এখন থেকে নাকি যুদ্ধের সময় কামানের গোলা ছোঁড়া হয়েছিল হলিরুড প্যালেসে,সেই গোলা এখনো দেওয়ালে দেখতে পাওয়া যায়),পার্লামেন্ট,সিটি চেম্বার সবই দেখা হলো।তারপর আমরা চললুম বিখ্যাত গ্রেফ্রায়ারস কির্কয়ার্ড সেমেট্রির দিকে।নানা কারণে এই জায়গাটা লোকেদের মনে দাগ কেটে যায়।গোরস্থানের মধ্যেই আছে পুরোনো গির্জা।ববি নামের এক প্রভুভক্ত কুকুরের গল্পের সাথে এই গোরস্থানের নাম জড়িয়ে আছে।ববির প্রভু জন গ্রে মারা যাওয়ার প্রায় ১৩ বছর পর্যন্ত কুকুরটি এসে তার কবরের সামনে বসে থাকতো সারাদিন।ববির স্মৃতিরক্ষার্থে একটা মূর্তিও আছে সামনেই। 
Image result for greyfriars
Greyfriars Kirkwire Church
The Cemetery 
আরেকটি ঘটনা জড়িয়ে আছে হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রাউলিং কে নিয়ে।কাছেই এলিফ্যান্ট হাউস ক্যাফেতে বসেই তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন হ্যারির গল্প।অনেকেরই মতে এই কবরগুলো দেখেই তিনি অনেক চরিত্রের নাম ভেবেছিলেন।গোরস্থানের মধ্যে ম্যাকগনগেল,রিডল,স্নেপ সকলের নামই দেখতে পাওয়া যায়।গোরস্থানের লাগোয়া জর্জ হ্যারিয়েট স্কুল।একসময় বিশেষ গুণসম্পন্ন অনাথ ছাত্রদের জন্যে শুরু হয়েছিল এই স্কুল।স্কুলের চারটে হাউস Lauriston (green),Greyfriars (white),Raeburn (red),আর Castle (blue),কিঁছু মনে পড়ছে নাকি?ঠিকই।হগওয়ার্টস কথা রাউলিংয়ের মাথায় আসে এখান থেকেই।
Image result for elephant cafe edinburgh
Elephant House Cafe
আমার মতো পটারপাগলদের জন্যে যে জায়গাটায় সারাদিন কাটানো যায়,তাতে কোনো সন্দেহই নেই।এর মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।গ্রেয়ফ্রায়ার্স থেকে বেরিয়ে এলিফ্যান্ট হাউস ক্যাফে দেখে আমরা চললুম মিউজিয়াম দেখতে।সময় কম।দুহাজার বছরের ইতিহাস মাথায় নিয়ে বেরিয়ে এসে বুঝলাম শীত আরো বেড়েছে।টুকটুক করে হাঁটা দিলাম ফোর্টের দিকে।মাথাপিছু সতেরো পাউন্ড দিয়ে টিকিট কাটতে গা নিশপিশ করছিলো ঠিকই কিন্তু ভিতরে চৌহদ্দির মধ্যে গিয়ে পৌঁছে যা দৃশ্য দেখতে পাওয়া গেলো,আফসোসের জায়গা রইলো না।

পাহাড়ের ওপরের কেল্লা থেকে প্রায় সারা শহরটা দেখা যাচ্ছে।ওল্ডটাউন ছাড়িয়ে নিউ টাউন,এমনকি নর্থ সি অব্দি দেখতে পাচ্ছি আমরা।দূরের পাহাড়ের ওপর নতুন করে বরফ পড়াতে চূড়াগুলো ধপধপে সাদা হয়ে আছে।অনেকক্ষণ আর কিছুই মনে থাকলো না।হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম।হাওয়ার তোড়ে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে,চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। কিন্তু তও আমরা তাকিয়েই আছি সামনে।প্রত্যেকটা যাত্রার মধ্যে কয়েকটা মুহূর্ত আসে যখন বুঝতে পারি,কয়েক বছর পর যখন দিনগুলো আবছা হয়ে যাবে তখন অনেক কিছুই হয়তো মনে থাকবে না।কত জায়গা,কত রাস্তা,কত নতুন অভিজ্ঞতা!কিন্তু সেই কয়েকটা মুহূর্ত থেকে যাবে একইরকম ভাবে,চিরনতুন হয়ে সারাজীবনের জন্যে।এই জন্যেই আসা।এইজন্যেই আসি, আসব। কেউ বুঝবে হয়তো,কেউ বুঝবে না।
The Mountains
Related image
View from Fort